কলগীতি উদ্বোধনের পর শান্তিনিকেতনে ফিরে গেছে পিংলা। যাবার সময় বলে গেছে স্যর আর গুরুদেবের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করবে গোসাবায় কবে ফিরবে। যায় যদি, এবার আর আগের বারের মতো তিন সপ্তাহের প্ল্যান নয়, একটু দীর্ঘ সময়ই কাটাবে সেখানে, একেবারে শিক্ষার্থীর মতো।
ফিরে যাবার আগের দিন কাজিদার বাড়ির আলমারি থেকে কিছু বইপত্তর আর ম্যাগাজিন উলটে-পালটে দেখছিল সে। চোখে পড়ল, সদ্য প্রকাশিত সওগাত পত্রিকায় কাজিদার বিষয়ে একটা খবর আছে, তাতে সওগাত লিখেছে, “ইনি সম্প্রতি পাইওনিয়ার ফিল্ম্ কোম্পানীর ফিল্ম্ ডিরেক্টর নিযুক্ত হইয়াছেন। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে আর কেহ ছায়াচিত্রজগতে এরূপ উচ্চপদের অধিকারী হন নাই। আমরা কবিকে তাঁহার এই সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতেছি।”
ফিল্ম্ ডিরেক্টর? তাহলে ঠিকই ভেবেছিল ও। আর শৈলজাদাও ঠিকই ধরতে পেরেছে কাজিদার আসল প্রতিভাটা। ঠিক সেই মুহূর্তেই বাড়িতে ছিল না কাজি, থাকলে একটা হৈ হৈ কাণ্ড ঘটাত পিংলা। কাজিদা গেছে গ্রামোফোনের অফিসে, আজ রাত্তিরে ওদের সবায়ের নেমন্তন্ন নলিনীদার বাড়িতে, বলে গেছে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবার চেষ্টা করবে।
কাজিদা যখন ফিরল সন্ধ্যে তখনও হয়নি। সঙ্গে একজন ভদ্রলোক। কাজিদা আলাপ করিয়ে দিল। ভদ্রলোক নবারুণ পত্রিকার সম্পাদক। আজ সারাদিন গ্রামোফোনের অফিসে বসেছিলেন। কাজিদা নাকি এঁকে কথা দিয়েছিল নবারুণের শারদীয়া সংখ্যায় একটা কবিতা দেবে। এতদিন অপেক্ষা করে কবিতা না-পেয়ে ভদ্রলোক আজ সকালেই গ্রামোফোনের অফিসে পৌঁছে গেছেন।
আরে, আমি ওকে বললুম, ওর কবিতা আমার লেখা হয়ে গেছে অনেক দিন আগেই, গলায় একরাশ অস্বস্তি নিয়ে ভদ্রলোকের সামনেই পিংলাকে বলে কাজি, একটু-আধটু করেকশন করে কাল-পরশুর মধ্যে আমি নিজেই পৌঁছিয়ে দেব, কিন্তু শুনলে তো। বারবার বলে, আজকের পুরো দিনটাই আপনাকে উৎসর্গ করেছি, কবিতাটা পকেটে নিয়ে তবে ফিরব; এবার পিংলার দিকে ফিরে আবার বলে, দেখ্ দেখি কী মুশকিল।
মুশকিল কেন হবে, বলে পিংলা, সম্পাদকের অন্যতম প্রধান কাজই তো এই। যে লেখাটা চাই সেটা চাই। একদম ঠিক করেছেন মশাই, পিংলা বলে ভদ্রলোককে, শেষ পর্যন্ত কবিতার কারেকশনও হত না, আর আপনিও পেতেন না কবিতাটা। তার বদলে গ্রামোফোন কম্পানীতে ধরনা-দেওয়া কেউ একজন সুর সমেত একটা আস্ত গান লিখিয়ে সেটা শিখে, হয়তো-বা রেকর্ড করেও চলে যেত।
এই রে এই রে, এ তো দেখি শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল – শেষ পর্যন্ত তুইও, পিংলা! – বলতে বলতে একটা খাতা আলমারি থেকে বের করতে করতে পিংলাকে বলে কাজি, আরে, ও বসে রইল ওকে একটু চা খাওয়া!
ঠিক ঠিক, বলতে বলতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায় পিংলা।
চায়ের ব্যবস্থা করে যখন বাইরের ঘরে ফেরে সে, তখন আলমারির থেকে বের-করা খাতাটায় ঝুঁকে পড়ে কাজি লিখছে কিছু। নিঃশব্দে বসে পড়ে সে অপেক্ষমান ভদ্রলোকের উল্টো দিকে, এবং দুজনেই বসে থাকে নীরবে। কিছুক্ষণ পর খুকু ঢোকে একটা ট্রেতে তিন কাপ চা আর সঙ্গে কিছু বিস্কুট নিয়ে। ট্রে-খানা ওদের সামনে নামিয়ে রেখে ফিরে যায় সে। ওদের চা শেষ হতে হতেই কাজি বলে, পড়ছি, তোমরা দুজনেই শোন। শোনার পর প্রথমেই সম্পাদক মশাই বলেন, দারুণ, আমার বসে-থাকা সার্থক।
তাহলে একটু বোস কপি করে দিই, বলতে বলতে নিজের চায়ের কাপ তুলে নেয় কাজি।
ভদ্রলোক কবিতাটা নিয়ে বিদায় নেবার পর পিংলা বলে, কাজিদা, তৈরি হয়ে নাও। সবাই তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে। খেয়াল আছে তো, আজ নলিনীদার বাড়িতে নেমন্তন্ন। কাল আমি খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাব, ভোরের ট্রেনটা-ই ধরবার ইচ্ছে আছে। কাজি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িয়ে খাতাটা আলমারিতে তুলে দেবার জন্যে হাতে নেয়। পিংলা বলে, উহুঁ, খাতাটা আমাকে দাও। প্রথমত কবিতাটা আমি নিজে এখন পড়ব, তারপর ওটা সঙ্গে করে নিয়ে যাব নলিনীদার বাড়ি। আজ তোমাকে নিয়ে একটু আলোচনার ইচ্ছে আছে।
বাড়ির ভেতরে যেতে যেতেও দাঁড়িয়ে পড়ে কাজি, এই এক আলোচক জুটেছেন, এখন আবার একে রামে রক্ষে নেই সুগ্রীব সহায়।
দুজনের মধ্যে কাকে যে তুমি সুগ্রীব বললে কে জানে, বলে পিংলা, যাই হোক, যাকেই বল কিছু যায় আসে না। তুমি কার ওপর অভিমান করে নিজের আনএক্সপ্লোর্ড্ পোটেনশিয়ালটা নষ্ট করছ সেটা বোঝা দরকার।
কাজির কবিতাটা পড়ে বিস্ময় প্রকাশ করে নলিনী, পড়ে কয়েকবার। বলে, করেছিস কী, কাজি? এ তো তোর পুরোনো দিনের কবিতার মতো। ইদানিং তো এরকম লেখা দেখি না আর:
বিশ হস্তে সে লুণ্ঠন করে, বিষ ছড়ায়ে সে বিশ্বে
দশমুখ দিয়া গ্রাস করে, হানে ত্রাস নিরন্ন নিঃস্বে।
লুণ্ঠন করে, গুণ্ঠন খোলে কুলনারীদের দর্পী
তার লালসার বহ্নিতে দেয় ধর্ম-পুণ্য অর্পি।
রাবণের ইমেজারি? – বলে নলিনী, তারপর নীরবে কয়েকটা লাইন পড়া হলে আবার প্রকাশ্যে পড়ে খানিকটা:
দশদিক জুড়ি দশমুণ্ডের সর্বগ্রাসী গ্রাস তার
মরুভূ্র মতো ক্ষুধাতুর তার রসনা করিয়া বিস্তার
করিছে লেহন, শ্যাম ধরা তাই হল কন্টকাকীর্ণা
চিরযৌবনা শস্যশ্যামলা নিপীড়নে জরাজীর্ণা।
তাই তো হবে, বলে পিংলা, শুনলেন না, এটা ওই নবারুণ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যার জন্যে লেখা; আগমনী নাম দিয়েছে বটে, কিন্তু এ তো অকাল-বোধনের আগমনী। শেষ চারটে লাইন দেখুন,
মোদের আঁখির নীলমণি এই পুত্রকন্যা নিত্য
অঞ্জলি দিই মায়ের চরণে ছিঁড়িয়া হৃদয় চিত্ত;
তবু যদি নাহি জাগে সে পাষাণী যোগ-নিদ্রা-বিমগ্ন,
ভৃগুর মতন আঘাত হানিয়া করিব দুয়ার ভগ্ন।
পিংলা আরেকবার শেষ লাইনটা একটু নিম্নস্বরে নিজের মনে মনেই যেন বলে, 'ভৃগুর মতন আঘাত হানিয়া করিব দুয়ার ভগ্ন', তারপর বলতে থাকে – আমার তো, সেই যে ধূমকেতুতে বেরিয়েছিল – সেই লাইনগুলো মনে পড়ছে:
অনেক পাঁঠা মোষ খেয়েছিস রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা;
আয় পাষাণী, এবার নিবি আপন ছেলের রক্তসুধা!
দুর্বলদের বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তিপূজা
দূর করে দে, বল মা ছেলের রক্ত মাগে মা দশভূজা।
সেদিন হবে জননী তোর সত্যিকারের আগমনী
বাজবে বোধন বাজনা সেদিন গাইবে নবজাগরণী।
'ম্যয় ভুখা হুঁ মায়ি' বলে আয় এবার আনন্দময়ী
কৈলাস হতে গিরিরাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি
আয় উমা আনন্দময়ী।
ধূমকেতুতে? – বলে কাজি, আর তারপর কী হয়েছিল মনে আছে? একটি বছর শ্রীঘর বাস।
মনে তো আছেই, বলে পিংলা, সে কি ভুলতে পারি? তিন তিনটে জেল, চল্লিশ দিনের অনশন।
তা-ই কি চাইছিস তোরা আবার?
আমরা চাইছিওনা, আর আমাদের চাওয়ায় কিছু যায়-আসেও না। কিন্তু কাজিদা, সেই সময় তুমি তো গান্ধীজির
প্রায়-সদ্য-শেষ-হওয়া অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত ছিলে। চৌরিচৌরার পর গান্ধীজি আন্দোলন প্রত্যাহার না করে নিলে তখনও থাকতে। পুলিশের লিষ্টিতে তোমার নাম তো সেই কুমিল্লার দিন থেকেই ছিল; সে এক অন্যরকমের সময় ছিল, তখনকার সময় আর এখনকার সময় তো এক নয়।
হয়তো নয়, বলে কাজি, কিন্তু ধূমকেতু মামলার অত দিন পর তিরিশ সালেও তো আমাকে আবার গ্রেপ্তার করল ব্রিটিশ রাজসরকার, করেনি? আমার তো আর কোন রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম নেই তখন, উনত্রিশ সালে লাহোর জেলে পঁয়ষট্টি দিন অনশনের পর যখন মারা গেল যতীন দাস, তখন শুধু একটা কবিতা লিখেছিলুম আমি। কবিতার নামও যতীন দাস। সেই কবিতা আর বালেশ্বরের যুদ্ধে বাঘা যতীনের মৃত্যু উপলক্ষে লেখা নবভারতের হলদিঘাট, আর তার সঙ্গে আরও কয়েকটা অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে প্রলয়শিখা ছাপা হল। তিরিশের আগস্টে। নভেম্বরে আমাকে আবার গ্রেপ্তার করা হল রাজদ্রোহের অপরাধে। এবারটা আমি ঠিক করলুম আর আমি জেল-এ যাচ্ছি না। আমি সুভাষ বাবু নই যে আমার কোন পোষ্য নেই, আমি জওহরলাল নই যে আমার পরিবারকে আমার বাপ দেখবে। আমার ছেলেবউয়ের কী হবে আমি জেল-এ গেলে? গানের জোরে ততদিনে আমার খানিকটা সঙ্গতি বেড়েছে। অনেক পয়সা খরচ করলুম আমি। জামিনের ব্যবস্থা হল। বাঘা বাঘা উকিল আমার হয়ে লড়লেন। রেগেমেগে সরকার বাজেয়াপ্ত করল প্রলয়শিখাও। আর তা ছাড়া, কোর্ট তো সরকারেরই। আগের বার, ধূমকেতুর মামলায়, আমি নিজেই লিখিত সওয়াল করেছিলুম রাজবন্দীর জবানবন্দী নামে। তাতে বিচারকের সম্বন্ধে বলেছিলুম, সে সত্যের নয়, সে রাজার। সে ন্যায়ের নয়, সে আইনের। সে স্বাধীন নয়, সে রাজ-ভৃত্য। এবারও দেখা গেল, তা-ই। বড় বড় আইনবিদের সওয়ালের বিনিময়ে ছ-মাসের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়ে গেল। শেষ মুহূর্তে অবিশ্যি বেঁচে গেলুম। কোন আইনবিদের পারদর্শিতায় নয়, রাজনীতির খেলায়! গান্ধী-আরউইন চুক্তি সই হল, আমাকে দয়া করে আমার মুক্তির নির্দেশ দিলেন গান্ধীজি। আমি কোনদিন নিজেকে অহিংস হিসেবে দেখিনি, কিন্তু তাতে কী হবে! রাজনীতি, রাজনীতিই বাঁচালো আমায়; গান্ধীর হাত আমার মাথায়, জেলে-এ আমাকে পোরে কার সাধ্য! শুনেছি গান্ধী বলেছিলেন, ভগত সিং-টিংরা নাকি মরতেই চেয়েছিল; তাদের সে ইচ্ছাও পূরণ করলেন তিনি!
যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে আছে কাজি, একটু দম নিয়ে বলল, আমি কিন্তু ভগত সিং নই, আমি সাবধানে আছি, আমি কিছুতেই
জেল-এ আর যাব না। আর কবিতা? প্রথম প্রথম ভাবতুম দিব্যি তো গান লিখে ভালোই আছি, তখন দিনে দু-তিনটে গান লেখা আমার কাছে কিছুই নয়। গান-পিছু দশ টাকা পাই মন্দ কী!
এই পর্যন্ত বলে নলিনীকান্তর দিকে আঙুল দেখায় কাজি। দেখ্ পিংলা, সে বলে, দিব্যি ভালোমানুষের মতো তোর কথায় সমানে সায় দিয়ে চলেছে এই লোকটা, নলিনীকান্ত সরকার। আমাকে তখন বলেছিল কথাটা গোপন রাখতে – এতদিন কথা রেখেও ছিলুম – আজ হাঁড়ি ভাঙতেই হবে। ভাঙি, নলিনীদা?
নলিনী হাসে। কীসের ভয় দেখাচ্ছিস রে এত? ভাঙ না, কোন্ হাঁড়ি তোর হেঁসেলে আছে।
কৃষ্ণনগরে যখন ছিলুম, অনেক টাকা ধার হয়ে গিয়েছিল তখন। সেই সময় থেকেই গান লিখে টাকা আয় করছিলুম, তাতে নতুন করে আর ধার করতে হচ্ছিল না ঠিকই, কিন্তু পুরোনো ধার শোধ করার পক্ষে সে টাকা যথেষ্ট নয়। এই যে বড়াই করে বললুম, গানের জোরে ততদিনে আমার খানিকটা সঙ্গতি বেড়েছে, সেটা হল কেমন করে? সঙ্গতি বাড়লো কীভাবে? সেই সময় একটা কাণ্ড ঘটেছিল। হরেন দত্ত নামে এক ভদ্রলোক আমার একটা পুরোনো গান – বেশ দিব্যি মনে আছে বহরমপুরের জেল থেকে ছাড়া পাবার কিছুদিন পরেই সে-গান লিখেছিলুম – ওই বহরমপুরেরই একটা বিয়ে বাড়িতে বসে – জাতের নামে বজ্জাতি – কোথা থেকে গানটা পেয়েছিলেন ভদ্রলোক আজও জানিনা – কিন্তু সেটা তিনি এইচ-এম-ভিতে রেকর্ড করে ফেললেন। এইচ-এম-ভি তখন আমাকে প্রায় চেনেই না, নাম যদি শুনেও থাকে মনে রাখেনি; দিলীপদার সঙ্গেই বোধ হয় এক-আধটা গজলের রেকর্ড-ফেকর্ড হয়েছিল ততদিনে। আমাদের এই নলিনীদা সেই সময় এইচ-এম-ভির নিয়মিত আর্টিস্ট। ওদের তখন গানের ডিপার্টমেন্টের প্রধান ছিলেন ভগবতী ভট্টাচার্য নামে এক ভদ্রলোক। হরেন দত্তর জাতের নামে বজ্জাতি ভগবতীবাবুর প্রযোজনাতেই হয়েছিল। নলিনীদার সূত্রে তিনি আমার কথা জানতে পারেন, আর নলিনীদাকেই অনুরোধ করেন আমাকে ওঁর অফিসে পাঠিয়ে দিতে। গেলুম আমি, খুব একটা বেশি কিছু আশা করে যে গেছি তা নয়। ভদ্রলোক কিন্তু সেই প্রথম দিনেই আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ওই জাতের নামে বজ্জাতির অ্যাকাউন্টে যত টাকা কপিরাইট হিসেবে আমার পাওনা হয়েছিল সব পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দিলেন! কত টাকা আমার আর মনে নেই, কিন্তু অনেক টাকা। কৃষ্ণনগরে আমার যত ধার হয়েছিল সব শোধ হয়ে গেল সেই টাকায়, আর আমায় পায় কে! ধার শোধ করে কৃষ্ণনগর ছেড়ে চলে এলুম কলকাতায়। কলকাতায় কোথায়? নলিনীদারই বাড়িতে।
কিছুদিন পর বুঝলুম কবিতা আমাকে ছেড়ে গেছে, আর আসবে না আমার কাছে। ঘ্যানঘ্যান করিস না নলিনীদা, তুই না থাকলে গ্রামোফোন কম্পানী আমাকে কে চেনাতো বল্? তবে, কবিতা যে আসছে না, তার দায়িত্ব তোরও নয়, গ্রামোফোন কম্পানীরও নয়। হয়তো আমারও নয়, দায়িত্ব একমাত্র ভগবানের।
ভগবানের? আচ্ছা! বেশ ভালো একটা নন্দ ঘোষ আবিষ্কার করেছিস তো, বলে নলিনীদা। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত একরাশ চেলা-চামুণ্ডা-ঘেরিত হয়ে বসে থাকলে, কী আর হবে? কবিতা আসবে? ওই যে রিহার্স্যাল রূমে ঢুকেই গুনগুন করতে শুরু করিস গাদাখানেক পান মুখে পুরে, তখন ওই গুনগুনানির লাইনে যেমন-তেমন শব্দ বসিয়ে ডজনখানেক গান রচনা করতে তোর কতটা সময় লাগে আমি জানি না? কবিতা লিখতে গেলে ভাবতে হয়; সুরেই মাৎ করে দেব মনে করলে গান লেখা চলতে পারে, কবিতা নয়। আমি জানি, তুই এক্খুনি বিদ্রোহী কবিতার কথা বলবি। বলবি, তখন তো ভাবতে হয়নি, কে যেন আমাকে দিয়ে জোর করে ওই কবিতা লিখিয়ে নিয়েছিল, আমি তো শুধু খাতার ওপর পেনসিল চালিয়েছিলুম! দেখ্ কাজি, আমার মুখ খোলাস না। বিদ্রোহীর মতো কবিতার লাইন তোর এখনো আসে – এই যে কবিতার খাতাটা পিংলা নিয়ে এসেছে, যে কবিতাটা তুই নবারুণের জন্যে লিখে দিয়েছিস কাল সন্ধ্যেবেলাতেই, ওই যে কী যেন লাইনটা – বলো তো পিংলা বলো আর একবার–
পিংলা বলে, ভৃগুর মতন আঘাত হানিয়া করিব দুয়ার ভগ্ন।
হ্যাঁ, বেশ জোর গলায় নলিনী বলে, ওই লাইনটা তোর বিদ্রোহীর লাইনগুলোর থেকে আলাদা? ভগবানের কাজ ভগবান ঠিকই করছেন, তুই-ই শুধু খেয়াল করছিস না। খেয়াল করলে আরও অনেক বিদ্রোহী কবিতা তুই লিখতে পারতিস।
কাজির চোখেমুখে স্পষ্টতই অস্বস্তি, সে বলে, জানিনা কেন, কিন্তু বুলবুলের যখন অসুখ হল, আমার মনে হল, বুলবুলের অসুখটা হয়েছে আমার কবিতা-লেখা বন্ধ হয়ে যাবার ফলে। পিংলা হয়তো জানবে না, ও তো দূরে থাকে, কিন্তু নলিনীদা, তোরা তো সবাই জানিস, জমিরুদ্দিন সাহেব যখন আসতেন, ও সারাক্ষণ বসে থাকত সামনে, আর মন দিয়ে শুনতো সব গান। হারমোনিয়ম বাজালেই শুনে রাগের নাম বলে দিতে পারত। যখন আমার বন্ধুরা কেউ আসত, অথবা আমিই যেতুম কারো বাড়ি, কিছুতেই একা ছাড়ত না আমায়। তোমরা হাসতে, কিন্তু আমার বন্ধুদের সামনে কখনো ও আমাকে বাবা বলে ডাকেনি। কনিষ্ঠ বন্ধুরা বলতো কাজিদা, ও-ও তাই-ই বলত, ও যেন আর একজন কনিষ্ঠ বন্ধু আমার! তাই যখন অমন মারাত্মক ব্যাধি হল ওর, আমার কেমন জানি মনে হল ও রাগ করেছে আমার ওপর। কবিতা লিখছি না, গ্রামোফোন কম্পানীতে সময় দিচ্ছি বেশি, তাই রাগ করেছে ও। আমি তাই আবার কবিতা লিখতে বসলুম। এমনিতে কবিতা আসছিল না, তখন অন্য রাস্তা ধরলুম।
এবার পিংলার দিকে সোজা তাকায় কাজি, বলে, তোর মনে আছে পিংলা, করাচির সেই মৌলভি সাহেবের কথা? পঞ্জাবি সেই মৌলভি সাহেব? যিনি আমাকে হাফিজ পড়াতেন আর গজল গেয়ে শোনাতেন?
মনে নেই? – এসব মানুষদের ভুলতে পারি? – পিংলা বলে।
আমি ঠিক করলুম, মৌলিক কবিতা আসছে না তো না-ই আসুক, আমি হাফিজের গজল অনুবাদ করব। আমার ধারণা ছিল, অনুবাদ করতে করতে এক-আধটা মৌলিক পংক্তি ঠিকই বেরোবে। দুলিকে কতদিন যে আমি বলেছি, দেখো, মৌলিক একটা-আধটা লাইন লিখতে পারলেই এই অসুখ ছেড়ে যাবে বুলবুলকে। লিখতে কিন্তু পারিনি নলিনীদা, আমার হাফিজ অনুবাদ যেদিন শেষ হল, বুলবুল আমার উড়ে গেল সেদিনই।
খানিকটা হালকা মেজাজে যদিও শুরু হয়েছিল আড্ডাটা, কেমন একটা থমথমে পরিবেশ এখন। একটু চায়ের জোগাড় দেখি, বলতে বলতে নলিনী চলে যায় বাড়ির ভেতরে। পিংলা বলে কাজিকে, তু্মি কষ্ট পেলে কাজিদা? আসলে, তোমাকে ভালোবাসি বলেই এত কিছু বলি। তোমার মতো কবিতা ক'জন লিখতে পারে বল। তাই-ই বলি। যাকগে, ছেড়ে দাও; কবিতা যখন নিজে থেকে আসবে তখনই লিখ। আমার মাথায় কিন্তু আসলে ছিল অন্য কথা। কাল তোমার বাড়িতে সওগাতের একটা খবর পড়লুম। তোমাকে নিয়ে খবর, এই দেখ না সওগাতখানা।
সওগাত খুলে পিংলা দেখায় যে তাতে কাজির সম্বন্ধে লিখেছে, ইনি সম্প্রতি পাইওনিয়ার ফিল্ম্ কোম্পানীর ফিল্ম্ ডিরেক্টর নিযুক্ত হইয়াছেন।
এই খবর দেখে তুই ভাবলি সত্যি সত্যিই ওই পাইয়োনিয়ার না কী কম্পানী, আমি তাদের ফিল্ম্ ডিরেক্টর হয়েছি? আরে যত উজবুগের রিপোর্টিং। ওরা জানে নাকি ফিল্ম্ ডিরেক্টর কাকে বলে? মিউজিক ডিরেক্টর, ডিরেক্টর অব লাইটিং, ডিরেক্টর অব ফোটোগ্রাফী আর ফিল্ম্ ডিরেক্টর বলতে ওরা একই বোঝে। মিউজিক ডিরেক্টরও তো ডিরেক্টর, শুনেছে তাই, লিখে দিল ফিল্ম্ ডিরেক্টর! যত্তো সব!
ও, একটু বোকা-বোকা হেসে পিংলা বলে, সেদিন শৈলজাদা বলছিলেন না, পাতালপুরীতে তুমি যা কন্ট্রিবিউট করেছ তাতে তোমার আর শৈলজাদার নাম জয়েন্ট ডিরেক্টর হিসেবে ঘোষিত হওয়া উচিত!
চায়ের ব্যবস্থা করে ফিরতে ফিরতে নলিনী শুনতে পায় কাজি আর পিংলার কথাবার্তার শেষাংশটা, সে ঢুকতে ঢুকতে বলে, সেদিন কলগীতির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে শৈলজাবাবু এ-কথাটা আমাকেও বলেছেন, বললেন এই সিনেমায় কাজির কী কন্ট্রিবিউশন তা শুধু আমিই জানি। ও যদি সত্যি-সত্যিই সিনেমা পরিচালনার দায়িত্ব নেয়, তাহলে বাংলা সিনেমায় নতুন যুগ আসবে।
পিংলা বলে, তুমি যখন বলছ কবিতা লেখা তোমার স্বাভাবিক ভাবে এখন আসছে না, বাদ দাও কবিতা লেখা। সিনেমা অনেক বড় ফীল্ড ওতেই মন দাও না তুমি। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ যখন রাশিয়া থেকে ফিরলেন – আমাকে নয়, কিন্তু – গুরুদেবের আশপাশে যে-সব গুণী মানুষরা সব-সময়ই থাকেন, শুনলুম কবি তাদের বলেছেন, ওখানে আইজেনস্টাইন নামের একজনের তৈরি করা ব্যাট্ল্শিপ পোটেমকিন নামে দীর্ঘ একটা সিনেমা উনি দেখে এসেছেন, সেই সিনেমার সঙ্গে এখানে যে-সব সিনেমা দেখেছেন তার কোন তুলনাই হয় না। উনি নাকি বলেছেন, অনেকের ধারণা সিনেমা আর কিছুই না, শুধু ক্যামেরায় তোলা একটা নাটকের মতো। এমনকি, নিজের নটীর পূজা সম্বন্ধেও নাকি বলেছেন, ওটা কোন সিনেমাই হয়নি, সিনেমা আধুনিক মানুষের আবিষ্কৃত একটা সম্পূর্ণ অন্যরকমের শিল্প – এ ছবি-আঁকা-মূর্তি-গড়া নয় যা গুহাবাসী মানুষরাও করত, এ কবিতা-লেখা-গান-গাওয়া নয় যা বেদ-উপনিষদের সময়েও মানুষের আয়ত্ব ছিল – এই শিল্পের ভাষাই অন্য, এবং সে-ভাষা এখন ক্রমাগত তৈরি হয়ে চলেছে, আর শিল্পের নতুন নতুন চমক শিখছে মানুষ। কবি বলেছেন, আমাদের বাঙালি শিল্পীদের মধ্যে যাদের চোখ-কান খোলা আছে, তারাও নিশ্চয়ই লক্ষ্য করছে সেই ভাষা। কবি নাকি বলেছেন, উনি অপেক্ষা করছেন সেই প্রতিভাবানের জন্যে যাঁর হাতে নতুন ভাষার এই নতুন শিল্প তৈরি হবে।
এর পর আবেগরুদ্ধ হয়ে আসে পিংলার গলা, সে বলে, কবি তোমার নাম করেননি, কিন্তু তুমি তো জানো তোমার সম্বন্ধে কী উঁচু ধারণা তাঁর; কেন জানিনা, আমার মনে হয় কবি তোমার কথাই ভাবছেন।
দূর পাগলা, হেসে বলে কাজি, কবি কি পিংলা নাকি! এত লোক থাকতে কাজি!
এতক্ষণ চুপ করে ছিল নলিনী, সে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে, এত লোক মানে? কত লোক? রবীন্দ্রনাথ তোর কথা ভেবেই এসব বলেছেন আমি বলছি না, তবে ভেবেও যদি থাকেন তোর কথা, আমি অবাক হব না। ঠিক এই মুহূর্তে শিল্পের এতগুলো দিকে তোর মতো কাজ করার লোক আমি তো দেখতে পাচ্ছি না। তারপর যখন নতুন নতুন ভাবনার কথাই উঠল, তা-ই ধর না। ধ্রুবর পরিচালক তুই ছিলি না, এমনকি ধ্রুবর ভূমিকায় তোকে নেবার কথা পরিচালক আগে তো ভাবেনইনি। যখন দায়ে পড়ে তোকে সেই ভূমিকা দিতে হল, তুই নিজের সাজসজ্জা পুরো বদলে দিলি। একেবারে বিপ্লবী পরিবর্তন! সেই কথকতা-যাত্রাপালার দিনের পক্ককেশ নারদকে নিয়ে এলি আধুনিক কেশে, আধুনিক বেশে; লোকে নেয়নি? এটাই পিংলা যা বলছে তাই! এটাই সিনেমার ক্ষেত্রে নতুন ভাবনা!
লোকে নিয়েছে কিনা, কাজি বলে, তুইও জানিস না, আমিও জানি না। তবে হ্যাঁ, সিনেমায় যেটুকু কাজ করছি, আমার ভালো লাগছে। ভালো লাগছে সিনেমার মানুষগুলোকেও। এমনকি দিকপাল নাটকের মানুষরাও সিনেমার কথা ভাবছেন। সিরাজদ্দৌলার রিহার্স্যালে গিয়েছিলুম স্টার থিয়েটারে, শিশির ভাদুড়ি মশাই বললেন তিনিও সিনেমার কথা ভাবছেন।
সেই ব্যাপারেই, নলিনী বলে, ওই পিংলা বলছিল না? – রবীন্দ্রনাথ সবাইকে সাবধান করে দিচ্ছেন। আমি বলছি না থিয়েটারের লোক সিনেমায় আসতে পারে না। কিন্তু আসতে হলে নাটককে পেছনে ফেলে রেখে আসতে হবে। কেউ কেউ পারবেন ঠিকই, কিন্তু যিনি পারবেন না তাঁর সিনেমায় না-আসাই ভালো।
কাজি বলে, আমি তো নিজেই বলেছি, এবার শৈলজার সঙ্গে রানিগঞ্জে কাজ করতে গিয়ে আমি মিউজিক ডিরেক্টরের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুললুম। শৈলজা মেনে নিল বলেই কাজটা হল, ও তো বলেইছে ভালো হয়েছে। তবে প্রেমেনের কথাটা আমার কানে লেগে আছে। সিনেমাটা শেষ অবধি দাঁড়ায় ওই এডিটরের কাঁচিতে। তোদের কথা দিচ্ছি, এবার থেকে স্টুডিওর ভেতরে একটু সময় কাটাবার চেষ্টা করব। ভাষাটা যখন নতুন, শিখতে শুরু করতেই হবে।