স বান্ধবঃ
ওরা এখন থাকে টার্নার স্ট্রিটে। আর ওই রাস্তাতেই ‘নবযুগ’-এরও অফিস। সেখান থেকে ওদের বাসস্থান খুব দূরে নয়। পবিত্র আর শৈলজানন্দর সঙ্গে পিংলাকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়ে সোজাই অফিসে আসছিল নজরুল আর মুজফ্ফর। মোহিতলাল ওদের সঙ্গ ছাড়েননি, বললেন, আমিও আপনাদের অফিসে যাব। কর্মরত কবিকে একটু দেখতে চাই।
কর্মরত কবিকে দেখতে চাইলে আসতেই পারেন, নজরুল বলে, তবে আমাদের অফিস দেখলে একটু আশাহতই হবেন। আর তা ছাড়া ঝটপট অফিসের কাজ সেরে আমাকে যেতে হবে দুবের বাড়ি, শুনলেনই তো ‘নবযুগ’-এর সোল সেলিং এজেন্ট সে। এতক্ষণে কাগজের বিলি-টিলি সেরে বাড়ি ফিরে এসেছে নিশ্চয়ই। পঞ্চাশ টাকা তাকে দেব, কাল থেকেই যাতে হাওড়ায় পিংলাকে অন্তত দেড়শো-দুশো কাগজ পাঠিয়ে দেয়। আমি নিজে ডেলিভারির সময় থাকব কাল। কাজেই, বুঝতে পারছেন তো, আমার সঙ্গে থাকলে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে হবে আপনাকেও।
সে না হয় ঘুরলামই একটু, কবিসঙ্গ তো হবে, হেসে বলেন মোহিত।
খুব সাজানো-গোছানো বড়সড়ো একটা অফিস-বিল্ডিং দেখবেন এমনটা আশা করেননি মোহিতলাল, কিন্তু তাই বলে এমন! প্রিয়নাথ গুহর সঙ্গে একবার স্টেট্স্ম্যানের অফিসে গিয়েছিলেন; নিচের তলায় ছাপাখানা, ওপরে লম্বা লম্বা ঘরে লোকজন ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছে, টেলিপ্রিন্টারের আওয়াজই কেমন যেন সম্ভ্রম জাগায়। পিএনজি নিজে বসেন যে ঘরে, সেখানে একটাই বড় টেবিল। কোণের দিকে একটা ছোট টেবিলের উলটো দিকে বসে কাজ করছিল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে একজন, হেসে গুড মর্নিং বলে সম্ভাষণ করল।
আর এখানে? দোতলা বাড়ির একতলার একটা ছোট অংশে গোটা কয়েক চেয়ার-টেবিল-টুল-আলমারি। ঝাঁটপাটও খুব নিয়মিত পড়ে বলে মনে হল না। একটা টেবিলে ডাঁই করা কিছু ফাইল, আর সেখানে বসে কাজ করছে বাইশ-তেইশ বছরের একটা ছেলে। মুজফ্ফর ঢুকেই তাকে জিজ্ঞেস করলেন, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস কিছু পাঠিয়েছে নাকি?
ফাইলে রেখে দিয়েছি, জবাব দিল ছেলেটি।
একটু দূরে একটা টুলে বসেছিল একজন। তার নাম বিশু। সে বলল, চা করি?
হ্যাঁ, করবেই তো, নজরুল জবাব দেয়। অদূরে একটা ইলেক্ট্রিক হিটার, কাজে লেগে যায় সে।
নজরুল বসল যেখানে, সে টেবিলের ওপর এক তাড়া প্রুফ। আমি কাজ করি, আপনি দেখুন, মোহিতলালকে বলে নজরুল, দোরঙা একটা পেনসিল দিয়ে প্রুফ দেখতে দেখতে। তারপর হঠাৎ বিশুকে চেঁচিয়ে বলে, স্যারের জন্যে কাপডিশ বের কোরো।
ফাইল থেকে মুখ তোলেন মুজফ্ফর, হেসে বলেন, ভাগ্যিস বললে, না হলে বিশু ওই কলাই করা গেলাসেই চা খাওয়াত স্যারকে।
একটু সঙ্কুচিত হয়ে বলেন মোহিতলাল, তাতে কী হয়েছে, দিলেই বা।
না না, আপনার অস্বস্তি হত, আপনি মুখে কিছু বলতেন না হয়তো, কিন্তু ঠিক হত না সেটা। কয়েকজোড়া কাপডিশ কিনে দিয়েছেন হক সাহেব, বলেছেন, অতিথিদের যেন ভাল কাপেই চা দেওয়া হয়, কাগজ একটু বড় হলে বড় অফিসও হবে, আর তার সঙ্গে মানানসই যা যা, হবে সেগুলোও।
আপনাদের তো ভালই চলছে মনে হয়, বড় হতে সময় লাগবে না খুব একটা। এখন বিক্কিরি কেমন?
ভালই, বলেন মুজফ্ফর, ছাপা যা হয় সবই বেরিয়ে যায়, এ কাজীর হাতযশ ছাড়া কিছু নয়। দুবে তো বলে কাজীর এডিটোরিয়াল পড়বার জন্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যায় লোকজনের মধ্যে। কলকাতার নানা মোড়ে কাগজ আসবার জন্যে অপেক্ষা করে লোকজন।
হ্যাঁ, আমিও পড়েছি দুয়েকটা। তবে আমার পছন্দ আপনাদের হেডলাইনগুলো। পড়লেই বোঝা যায় এ কোন কবির তৈরি। এডিটোরিয়ালও ভালই, তবে একটু বেশি গরম, তাই না?
কাজী, শুনে নাও, নজরুলের দিকে তাকিয়ে বলেন মুজফ্ফর, এত গরম যে গভর্নমেন্টের হাতে ছ্যাঁকা লেগে যাচ্ছে। ওয়ার্নিংও পেয়েছি আমরা কয়েকবার।
কথা বলতে বলতে চা এসে যায়। বেশ সুদর্শন পেয়ালা-পিরিচের জোড়াখানা বসে মোহিতলালের সামনে। মুজফ্ফর আর নজরুলের টেবিলে রাখা হয় সাদা কলাই করা গেলাস। অস্বস্তি বোধ করেন মোহিতলাল, বলেন, এক যাত্রায় এরকম পৃথক ফল ঠিক নয়, আমিও দিব্যি খেতে পারতুম আপনাদের মতো।
আপনি হয়তো পারতেন, বলে নজরুল, কিন্তু অসম্মান হতো আবুল কাসেম ফজলুল হক সাহেবের। তাঁরই ডেরায় বসে তাঁর অসম্মান করা যায় কি? চলুন আমাদের আস্তানায়, তারপর আমাদের সঙ্গে মান-অপমান শেয়ার করে নেবেন।
চা শেষ হলে সংশোধিত প্রুফগুলো মুজফ্ফরের হাতে দেয় নজরুল। বলে, পর পর তিন দিনের এডিটোরিয়াল দিয়ে গেলুম। কাল সকালে পিংলার সঙ্গে যাচ্ছি হাওড়ায়, যদি কোন কারণে আটকিয়ে যাই, এডিটোরিয়ালের অভাবে কাগজ বেরনো বন্ধ হবে না। তুমি তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বাড়ি ফিরো আহ্মদ ভাই, শৈলজা আর পবিত্র অপেক্ষা করছে। আমি দুবের বাড়ি ঘুরেই আসছি। তারপর মোহিতলালের দিকে ফিরে বলে, চলুন স্যার।
ঠিকানা টার্নার স্ট্রিট ঠিকই, কিন্তু ওরা যেখানটায় থাকে সেখানে পৌঁছবার জন্যে বাঁদিকে ঘুরে গলির মধ্যে আর একটা গলিতে ঢুকতে হল। রাস্তার দু’দিকেই খোলার চালের বস্তি। সেগুলো পেরিয়ে শেষ বাড়িটায় থাকে ওরা। একটা ঘর। বারান্দা, উঠোন, শৌচালয়, খোলা স্নানের জায়গা আর রান্নাঘর। ঢুকতে ঢুকতেই শৈলজা-পবিত্রর গলা শোনা যাচ্ছিল। মোহিতলাল বললেন, আপনার বন্ধুরা এখনও আছেন মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, থাকবেই তো, জবাব নজরুলের, এসেছে যখন, রাত্তিরে খেয়েদেয়েই যাবে। আপনিও নৈশভোজনে স্বাগত।
ঘরে দু’খানা তক্তপোশ, দেওয়ালের সঙ্গেই কয়েকটা তাক গোছের, দু’খানা হাতলবিহীন চেয়ার, এ ছাড়া আসবাব বিশেষ নেই। ওরা ঢুকল যখন, তক্তপোশ দুটো টেনে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, মুজফ্ফরও ফিরে এসেছে ততক্ষণে, বোঝা যাচ্ছে আড্ডায় মশগুল ওরা। একটা চেয়ার মোহিতলালকে এগিয়ে দেয় নজরুল, আর একটায় নিজে বসতে বসতে লক্ষ করে চেয়ারটার নিচে থালায় ঢাকা একটা অ্যালুমিনিয়ামের বেশ বড়সড়ো বাটি।
এ বাটিটা আবার কোত্থেকে এল? – জিজ্ঞেস করে নজরুল।
তোমার রাঙাখালা দিয়ে গেলেন কিছুক্ষণ আগে, পবিত্র জানায়।
রাঙাখালা? – বিস্মিত মোহিতলালের স্বতঃস্ফূর্ত প্রশ্ন।
জবাব দেয় মুজফ্ফর, যে বস্তিটা পেরিয়ে ঢুকলেন আমাদের এই আস্তানায়, সেটার বাসিন্দারা প্রধানত মুসলমান। কাজী তাঁদের অনেকের সঙ্গেই সম্পর্ক পাতিয়ে নিয়েছে, ওই চাচা খালা আপ্পা এরকম সব। ওর খালাদের মধ্যে একজন আছেন একটু ফর্সা গোছের, তাই তিনি রাঙাখালা। কাজীর উপর খুব খুশি, মাঝে মাঝেই নিজের রান্না কিছু কিছু খাবার আমাদের দিয়ে যান। আজ বোধ হয় পবিত্রদের গলা শুনে বুঝতে পেরেছেন আমাদের ঘরে আজ অতিথি আছে। তাই একটা বড় বাটিতে কিছু দিয়ে গেছেন।
কিছু ঠিকই, কিন্তু সেই কিছুটা কী? খুলেই দেখা যাক, বলতে বলতে বাটিটা তুলে নিয়ে চাপা দেওয়া থালাটা সরিয়ে দেয় নজরুল। এক বাটি আলুর দম, কড়া মশলায় বেশ লালচে দেখাচ্ছে। দে গোরুর গা ধুইয়ে – উচ্ছ্বসিত নজরুলের চিৎকৃত কণ্ঠস্বর শোনা যায়, মাহ্মুদের দোকান থেকে রুটি নিয়ে আয় শৈলজা, রাত্তিরের ডিনারটা জমে যাবে। তারপর মোহিতলালের দিকে ফিরে বলে, স্যার, ক’খানা রুটি আপনার জন্যে?
না না, আমি খাব না, আমার মেসে খাবার বলা আছে, বলতে বলতে উঠে দাঁড়ান মোহিতলাল, বাড়িটা চিনে গেলুম, এই নেবুতলায় আমার ইশকুল, আসব মাঝে মাঝে।
মুজফ্ফর নেমে আসে তক্তপোশ থেকে, চলুন আপনাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি।
শিককাবাব পেলে নিয়ে এসো, একটা শিক কিনলেই চলবে, পেছন থেকে নজরুলের কণ্ঠস্বর শুনতে পান মোহিতলাল আর মুজফ্ফর।