বিদ্রোহী তকমা যার নামের সঙ্গে এঁটে যায় একবার, তার তো শত্রুর অভাব হয় না। শত্রু যদি না-ও হয়, তার বিরোধী তো হয় অনেকেই। বিরোধ তো আছেই, এবং যে-বিষয়ে বিরোধ তার প্রতিবাদ করে যে, সে-ই প্রতিবাদী, সে-ই বিদ্রোহী। কাজি নজরুলের নাম আর পাঁচজন বাঙালি জেনেছে তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে। এবং সেই জানার এখনো এক দশকও হয়নি। এরই মধ্যে গড়পড়তা বাঙালি শুধু নয়, বাঙালিদের যাঁরা নেতৃস্থানীয়, তাঁরা সবাই মিলে তাকে জাতীয় কবি এবং বিদ্রোহী কবি দুটো উপাধিই দিয়ে ফেলেছেন। যাঁরা পছন্দ করেননি ব্যাপারটা তাঁরা হয়তো কাজিকে হুঙ্কারবাদী উপাধিতেও উল্লেখ করেন – সেটা অবিশ্যি খানিকটা স্বগতোক্তির মতোই; কারণ বাংলা সাহিত্যে যাঁর উপর আর কথা চলে না সেই রবীন্দ্রনাথও – জাতির জীবনে নজরুল বসন্ত এনেছে – এই কথা বলে নিজের হাতে ১০ই ফাল্গুন, ১৩২৯ তারিখ-চিহ্নিত স্বাক্ষরসহ তাঁর বসন্ত গীতিনাট্যখানা খোদ কারাগারে বন্দী কাজিকে উৎসর্গ করে তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
বুলবুল আর নেই, এই নিষ্ঠুর সত্যটা এখন কতদিনে কাজি হজম করতে পারবে সে নিজেই জানে না। প্রমীলার সঙ্গে বিবাহ, সে-ও তো পাঁচ-ছ' বছর পেরিয়ে গেছে। বিবাহ পূর্ববর্তী জীবনের যত্রতত্র ভোজন এবং হট্টমন্দিরে শয়ন – দিনযাপনের এই ছক কাজিকে বদলাতে হয়েছে। স্ত্রী এবং শাশুড়িকে নিয়ে গরীবের সংসার চালানোও যে কতটা কঠিন, প্রতি পলে বুঝেছে কাজি। আর তার বন্ধুরাও যে তার তুলনায় অবস্থাপন্ন এমনটা তো নয়, কাজেই সাধ্যাতীত অঙ্কে ঋণগ্রস্ত হয়ে অবশেষে হেমন্ত সরকারের সাহায্যে হুগলি ছেড়ে কৃষ্ণনগর; পাঁচজনের সাহায্যে সেখানে খানিকটা গুছিয়ে নেবার পর ক্রমাগত অসুস্থতা এবং অর্থাভাবে প্রায় ভেঙে-পড়ার মুখে এসে গ্রামোফোন কম্পানীর কাছ থেকে আশাতীত ভাবে কয়েকশো টাকা পাবার পর আবার ঋণমুক্তি, এবং কলকাতায় পাকাপাকি বসবাস। এর পর ক্রমে ক্রমে আর্থিক উন্নতি এবং এখনকার প্রায়-স্বাচ্ছল্যের অবস্থা।
আজাদ কামাল বা কৃষ্ণ মহম্মদ – কাজি-প্রমীলার প্রথম সন্তান – বেশি দিন বাঁচেনি। যদিও ঘটা করে তার আকীকা অনুষ্ঠান করেছিল কাজি হুগলিতে, কিন্তু এই সত্যি কথাটা স্বীকার না করে উপায় নেই যে তাকে কেন্দ্র করে মা-বাবার আবেগ এবং স্নেহ সম্পূর্ণ জমাট-বাঁধবার আগেই সে চলে গেল পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে। বুলবুল কিন্তু বাবা-মা'র চোখের মণি। তার মৃত্যুর যন্ত্রণা সামলিয়ে ওঠা কঠিন। রোগটা যে তার গুটিবসন্ত এটা জানবার পর থেকেই বিনিদ্র প্রতিটি রাত্রি কাজি কাটিয়েছে তার শিয়রের পাশে। স্মৃতির দরজায় ঘা দিয়ে সেনা-ব্যারাকের পঞ্জাবী মৌলভীর প্রসাদে অধীত আরবী-ফার্সির জ্ঞান রোমন্থন করে স্বতঃস্ফূর্ত মৌলিক কবিতার বদলে হাফিজ অনুবাদ করত সে সেই রাতগুলোয়। ছেলেবেলায় শুধুমাত্র স্বরবর্ণের সাহায্যে আরবী একটু একটু পড়তে শিখেছিল কাজি, আর পাঁচটা বাঙালি মুসলমান সন্তানের মতই হজরত মহম্মদের জীবনী পাঠ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি ছেলেবেলায়; সেই কথা মনে করে এখন হয়তো বাংলা-ভাষায় কিশোরপাঠ্য হজরত-জীবনী লেখার কথাও ভাবে সে, তারও তো সন্তানরা আছে। এক সময় নিজেকে নাস্তিক বলে প্রচার করার চেষ্টা করত সে, তবু তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা জানে যে সে ব্যক্তিগত বিশ্বাসে ধার্মিক, কিন্তু ধর্মাচরণে সে নিজেকে যুক্তিনিষ্ঠ বলে মনে করে। যুক্তির প্রতি তার নিষ্ঠাই অনেকের কাছে নাস্তিক্য মনে হত, কারণ ধর্মান্ধ না হলে এ-দেশে মানুষকে ধর্মনিষ্ঠ মনে করা হয় না। জন্মসূত্রে সে মুসলমান, তার শৈশবের পিতৃহীনতা খানিকটা জীবনধারণের প্রয়োজনেই তাকে কিশোর বয়েসে নানা মুসলমানী ক্রিয়াকলাপ শিখতে খানিকটা বাধ্যই করেছিল, এবং বাংলার গ্রামীন হিন্দু-মুসলমান সমাজে বেড়ে ওঠার ফলে – গ্রামীণ সংস্কৃতির ধর্মীয় নিরপেক্ষতা – এবং কৈশোরেই লেটোর দলে যোগ দেওয়া – তাকে রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ-কথকতার আকর্ষণ থেকেও বঞ্চিত করেনি। হজরত-জীবনী পড়বার জন্যে তাকে অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল, পল্টনে যাবার পর ওই পঞ্জাবী উদার মৌলভীর সঙ্গে পরিচয় পর্যন্ত। হয়তো সে তার নিজের সন্তানদের ক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষার অভাব রাখতে চায়নি।
দারিদ্রের অনেকগুলো অবস্থা পেরিয়ে আজ যেখানে পৌঁচেছে কাজি, কোন হঠকারিতায় সেখান থেকে আগের অবস্থায় সে ফিরে যেতে চায় না। বুলবুল আর ইহজগতে নেই, কিন্তু এখন আছে সানি, কাজি সব্যসাচি বা কাজি সানিয়াৎসেন যার অপর নাম। এক বছর পাঁচ মাস তার বয়েস। তাকে তো বড় করে তুলতেই হবে। তার জীবনে যেন স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব না হয়। কাজি তাই তার এখনকার রুটিন বদলাতে চায় না। রোজ সকালে প্রতিদিনের মতো সে পৌঁছিয়ে যায় গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমে।
গত বছর ডিসেম্বরে যখন বাদল গুপ্ত, বিনয় বসু আর দীনেশ গুপ্ত নামে তিন যুবক সারা বাংলার টনক নড়িয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের স্নায়ুকেন্দ্র রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করে, কাজি তখন কোন কথা বলেনি, সে জামিনে মুক্ত ছিল তখন। গান্ধী-আরউইন সমঝোতার পর উনিশশো একত্রিশের ছাব্বিশে মার্চ তার কারাদণ্ড মাপ করে দিল সরকার। তার তিনদিন আগেই ভগত সিং, শুকদেব থাপার আর শিবরাম রাজগুরুর ফাঁসি হয়ে গেছে – হয়েছে গান্ধী আরউইন চুক্তি সত্বেও! গান্ধী মন্তব্য করেছেন, তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টা সত্বেও “...those who didn't want to live” – তাদের তিনি বাঁচাতে পারেননি!
Qazi does want to live! – দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজি নিজের মনে-মনেই উচ্চারণ করে কথাগুলো।
এমন সময় নাসিরুদ্দীন সাহেব একদিন হঠাৎ ধরে ফেলেন কাজিকে; মঈনুদ্দিনের সঙ্গে কাজি দেখা করতে এসেছিল সওগাতের অফিসে, কী ব্যাপার কাজিসাহেব, আজকাল কেমন যেন পালিয়ে পালিয়ে বেড়ান! – হেসে মন্তব্য করেন নাসির।
আপনার কাছ থেকে পালাব সাধ্য কী, আর পালাইও যদি পরকালে জবাবটা কী দেব?
আমার কাছ থেকে নয়। কিন্তু মনে হয় সওগাতের কাছ থেকে পালাচ্ছেন। কতদিন হল, একটাও কবিতা আমরা পাইনি। নঈমের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, ও বলল, কাজিদার কাছে কবিতা চাইলে কোনমতে একটা-দুটো গান দিয়ে পালায়।
পালাই, ভুল বলেনি নঈম, পালাইটাই ঠিক কথা। পালাই লজ্জায়। কী যে হয়ে গেছে হঠাৎ, চেষ্টা করলেও নিজের পছন্দসই কবিতা লিখতে পারছি না। অথচ, দিনের মধ্যে গান যে কতগুলো লিখতে পারি, কী বলব।
কিছুই বলবেন না, নাজিম সাহেব বলেন, সৃষ্টিশীল কাজ কি আর কারো হুকুমে হবে? এখন তো শুনতে পাই গ্রামোফোন কম্পানী এমন চাপ দিচ্ছে আপনাকে, গান ছাড়া নিজের কথাও ভাববার সময় নেই আপনার। আমি বললুম বলে মনে করবেন না কিছু, আপনি বন্ধু মানুষ তাই ঠাট্টা করছিলুম। আমি জানি, আবার যখন কবিতা আসবে আপনার মাথায়, সওগাতকে আপনি বঞ্চিত করবেন না। আপনার সামনে যতগুলো লাইন খাড়া, সব লাইনেরই প্রথমে সওগাত দাঁড়িয়ে আছে, এ-কথাটা মনে রাখবেন!
একটা কথা মনে পড়ছে নাসির সাহেব, আপনাকে বলি, বলে কাজি। কৃষ্ণনগরে থাকতুম যখন, অসুস্থ অবস্থায় একবার কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতায় এসেছিলুম; আপনি ছিলেন না, এখানকার অফিসের লোকজন আমাকে পৌঁছিয়ে দিয়েছিল কৃষ্ণনগরের বাড়ি পর্যন্ত। একটু সুস্থ হবার পর আপনার কাছ থেকে চিঠি পেলুম একটা। চিঠিটা প্রায় মৃতসঞ্জীবনীর কাজ করেছিল আমার পক্ষে। ওটাতে দুটো খুব প্রয়োজনীয় কথা লিখেছিলেন আপনি। একটা হল, বহুদিনের অশিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক চৈতন্যহীনতা নব্যশিক্ষিত বাঙালি মুসলমানকে খানিকটা হীনমন্যতার শিকারে পরিণত করেছে। দ্বিতীয় যে-কথাটা বলেছিলেন আপনি তা হল, সেই হীনমন্যতার শিকার যে পাঠক, সেই পাঠকের শিকার হয়েছি আমি। আমার লেখায় ইসলামি সংস্কৃতির তথাকথিত অনুপস্থিতি এদের প্রথমে বিরক্ত এবং ধীরে ধীরে পরে রাগান্বিত করে; শেষ পর্যন্ত নজরুল-বিরোধীতাই এদের উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমার কাব্যে হিন্দু পুরাণাশ্রিত রূপকল্পই এদের চোখে পড়ে, বাংলা ভাষায় আরবী ফার্সি এবং নানা ইসলামি শব্দ বা কল্পনার প্রয়োগ – যা এক সময় প্রায় একা আমিই করেছি – এদের চোখেই পড়ে না। মনে আছে আপনার?
মনে তো আছেই, বলেন নাসির, আমি প্রস্তাব করেছিলুম, বিশেষ করে মুসলমান পাঠকের কথা মনে রেখেই প্রস্তাব করেছিলুম যে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালি লেখকদের একটা নতুন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, যে আন্দোলনে বিশেষ করে মনে রাখতে হবে এই পাঠকদের কথা; যারা বাঙালি প্রথম, মুসলমান তারপর। অনেকটা দেরি এরই মধ্যে হয়ে গেছে, কবি-সাহিত্যিকের কাছ থেকে না পেয়ে এই পাঠকরা এখন প্রেরণা পাচ্ছে মোল্লা-মৌলভীদের কাছ থেকে। তার ফল যা হবার তা-ই তো হবে।
খানিকটা আপনার প্রেরণাতেই, বলতে থাকে কাজি, আমি আমার আরবীর জ্ঞানটাকে একটু মেরামত করলুম। এখন ভাবছি হজরত মোহম্মদের জীবনী বাংলা ভাষায় লিখব, আর তারপর, কোর-আন শরীফের বঙ্গানুবাদ। এমন ভাষায়, এমন স্বচ্ছন্দ বাংলা ভাষায়, এবং ছন্দে, যে বাঙালি কিশোর-কিশোরীরাও ভালোবেসে এ-কাব্য পড়বে, মুখস্থ করবে। হজরত মোহম্মদের জীবনী পড়ে আর কোর-আন শরীফ পড়ে যে মুসলমান-সন্তান বড় হয়ে উঠবে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সে ধর্মনিষ্ঠ হবে, কিন্তু অন্য ধর্ম আর অন্য ধর্মের অনুগামীদের বিরুদ্ধাচরণ করবে না।
বোশেখ-জষ্টি সংখ্যা নামে চিহ্নিত, কিন্তু জষ্টিতে প্রকাশিত 'সওগাত'-এ নজরুলের কবিতা বেরোল অনেকদিন পর – কবিতার নাম মরুভাস্কর। সম্পাদকের পক্ষ থেকে এই কবিতার পাদটীকা:– কবি হজরত মোহাম্মদের জীবনীকাব্য লিখিতেছেন, এ কবিতাটি তাহার পূর্বাংশ।
আষাঢ়ে বেরোল জয়তী পত্রিকায় ওই মরুভাস্করেরই পরের অংশ, অভিবন্দনা।
একে তো ইদানিং কালের মধ্যে নজরুলের তেমন কোন কবিতা দেখা যায়নি সাময়িক কোন পত্রপত্রিকায়, আর এবার পর পর যে দুখানা কবিতা, তা একেবারে ভিন্ন স্বাদের। খানিকটা হৈ হৈ-ই হল নানা জায়গায়। খবর পেয়ে শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী অ্যাণ্ড সন্সের মনোরঞ্জন চক্রবর্তী ধরে পড়লেন নজরুলকে: এই কাব্য তাড়াতাড়ি শেষ করুন কাজিসাহেব। সারা বাংলা পড়তে চাইবে হজরত মোহম্মদের জীবনী, প্রচুর বিক্রি হবে, আপনার কবিতা যারা পড়েনি কখনও তারাও কিনবে এই বই।
আর্থিক দিক থেকে বোধ হয় এখনই কাজির সবচেয়ে অনুকূল সময়। যত জনপ্রিয় হচ্ছে তার গান ততই বিক্রি হচ্ছে গানের রেকর্ড, আর সেই রেকর্ডের বিক্রয়সত্ত্বও অবিলম্বে পৌঁছোচ্ছে তার ব্যাঙ্ক-অ্যাকাউন্টে। যে-বাড়িটাতে এখন থাকে সে, সে বাড়িটা বিশেষ ভালো নয়; পুরোনো, ভাঙাচোরা একটু। মসজিদবাড়ি স্ট্রীটের যে বাড়িতে থাকবার সময় বুলবুল মারা গেল, সে বাড়িতে সর্বত্র বুলবুলের স্মৃতি। সেখানে থাকতে পারেনি কাজি। তার বন্ধু নলিনীকান্ত সরকারের জেলেটোলার বাড়িতে সে সপরিবার চলে আসে বুলবুলের মৃত্যুর পরেই। তারপর, যেমন-তেমন একটা বাড়ি দেখে নিয়ে সেই পাড়াতেই থাকতে শুরু করে ওরা। ইদানিং নলিনীকান্ত বিবেকানন্দ রোডে একটা নতুন ফ্ল্যাট-বাড়িতে উঠে এসেছে। কাছাকাছির মধ্যেই আরও একটা বড় বাড়ি খালি পাওয়া গেল। বিবেকানন্দ রোডেই যদিও বাড়িটা, কর্পোরেশনের ঠিকানায় নাম সীতানাথ রোড। এখানে বাসা বাঁধল এখন সপরিবার কাজি। আর, নতুন বাড়িতে এসেই সে খুলে ফেলল একটা গানের স্কুল, বুলবুল সঙ্গীত বিদ্যালয়, নলিনীকান্তর বাইরের ঘরে। নলিনীকান্তরও উৎসাহ কম না, দুজনে মিলে চালাতে পারবে এই স্কুল।
কলকাতায় কাজি যখন প্রথম থাকতে এসেছিল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার অফিসে, তখন থেকেই কলকাতাকে সে ভালোবেসেছে। কিন্তু কলকাতার যে জিনিসটাকে সে ভালোবাসতে পারেনি কোনদিন তা হল এখানকার পরিবহন ব্যবস্থা। শহরটা তো ছোট নয়, এখানে এক জায়গা থেকে অন্য কোথাও পৌঁছোতে এক আছে ট্রামগাড়ি। পালকি বা রিকশ-টিকশও আছে, কিন্তু মনুষ্যবাহিত যানে উঠতে অস্বস্তি হয়। ট্রামের ধর্মঘটের সময় খোলা মালবাহী একরকমের মোটরচালিত যানে কিছু বসবার চেয়ার-টেয়ার বসিয়ে অফিস-যাত্রীদের যাতায়াতের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল; পরে ঢাকা-ফাকা লাগিয়ে এগুলোরই কিছু কিছু 'বাস' নামে চালু হল। চলতে শুরু করলেই 'এই পড়ে যাই' 'এই পড়ে যাই' একটা ভয় মানুষের। কাজি পারতপক্ষে চড়ে না ওতে। বড়লোকদের নিজেদের নানা নামের নানা চেহারার প্রাইভেট ঘোড়ার গাড়ি আছে, আর ইদানিং মোটর-চালিত 'মোটরকার'ও চালু হয়েছে। ঘোড়ার গাড়ি ভাড়াতেও পাওয়া যায় – হাওড়ার জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট গুরুসদয় দত্ত সে-গাড়ি সম্বন্ধে বলেছেন, “ঘোড়ার গাড়ি বিশ্রী, সবটাই ঢাকা!” বিশ্রী যে, সে ব্যাপারে একেবারেই ভিন্নমত নয় কাজি। এ শহরে থাকতে হলে, অতএব, ট্রামে চড়তেই হয়। কাজির কিন্তু পছন্দ ওই মোটরকারই। মোটরকার ভাড়ায় পাওয়া যায়, ট্যাক্সি নাম তার। পকেটে যথেষ্ট পয়সা থাকলে – নিজেরই হোক বা ধার করা – কাজি ট্যাক্সিতেই চড়ে। এবার সে একখানা ছোট 'কার' কিনেই ফেলল; এই 'কার'-এর নাম পীজো, ফরাসী দেশ থেকে আমদানি করা!
মনোরঞ্জন চক্রবর্তী পেছনে লেগেইছিলেন কাজির, মরুভাস্কর এগোচ্ছে তো?
নাঃ, তেমন এগোচ্ছে না। ওই সওগাত আর জয়তীতে বেরোবার পর আর এগোচ্ছেই না কলম।
এগোবে কী করে, বলেন মনোরঞ্জন, গ্রামোফোন কম্পানীর এত কাজের চাপের পর আবার গানের স্কুল খুলে
ফেললেন। সব মানুষেরই তো পরিশ্রমের একটা সীমা থাকে।
বুলবুলের নামে গানের স্কুল, ওতে আমার কোন পরিশ্রমই হয় না। মনে হয় বুলবুলই গান শিখছে আমার কাছে। আর তাছাড়া নলিনীদা আছে, সে তো আমার চেয়েও বেশি সময় দেয় ওখানে।
ওই গানের স্কুলেই একদিন হঠাৎ হাজির যতিবাবু, তিনি বোধ হয় জানতেন না গানের স্কুলটায় নজরুলও গান শেখায়। বাইরের ঘরে স্কুল, হঠাৎ ঢুকে পড়ে কাজিকে দেখে একটু থতমত। বললেন, আপনি এখানে? ভেবেছিলুম এখানে সেরে আপনার বাড়িতে যাব।
যতিবাবু নলিনীরই বন্ধু, সেই সূত্রেই নজরুলের সঙ্গে আলাপ, এখন বন্ধুত্বই বলা যায়। জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি বাড়ি ফিরতে দেরি হবে?
না না, কাজি বলে, আমার তো ক্লাস শেষ হয়ে গেল, এখনই ছুটি দিয়ে দেব ওদের।
ঠিক আছে, আমি আপনার বাড়ি আসছি, নলিনীর সঙ্গে একটু কথা বলে যাই, বলেই যতিবাবু গানের স্কুল থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে গেলেন।
যতিবাবুর আসলে ছেলের বিয়ে। বিয়ে নিমতিতা গ্রামে, মুর্শিদাবাদে; ওখানকার জমিদারের মেয়ের সঙ্গে। নেমন্তন্ন করতে বেরিয়েছেন। নলিনীকে নেমন্তন্ন করার পর নলিনীকে সঙ্গে নিয়েই এলেন নজরুলের বাড়িতে। বললেন, গ্রামের বিয়ে, কলকাতার লোকরা এ-সব গ্রাম্য বিয়ে দেখেইনি। আমাদের বরযাত্রীর দল পৌঁছবে বিয়ের তিন দিন আগে। সেখানে একটা বাড়ির আলাদা ব্যবস্থা থাকবে আমাদের জন্যে। তিন দিন আগের থেকেই বিয়ের হৈ চৈ শুরু। আপনাকে আমাদের দলে চাইছি। রেলগাড়িতে একটা গোটা কামরা রিজার্ভ করেছি, আশা করি আপনাদের কষ্ট হবে না। আপনি না এলে জমবে না স্যর।
কিন্তু আমাকে তো কেউই চেনে না ওখানে...
নজরুলের কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন না যতিবাবু, চেনে না, বলেন কী? আপনাকে সবাই চেনে, তবে হ্যাঁ, আপনি চেনেন না সবাইকে। নলিনীকে তো চেনেন, ও হল বরের ঘরের মাসি আর কনের ঘরের পিসি। ও তো ধনুক-ভাঙা পণ করে রেখেছে, কাজিকে যদি নিয়ে যেতে পারেন তবেই সবাই মিলে যাব, না হলে নয়। আসুন না কাজিসাহেব, দেখবেন ভালোই লাগবে আপনার।
তবে হ্যাঁ, যতিবাবু যে বলেছিলেন কাজি না চিনলেও কাজিকে চেনে অনেকেই – সে কথাটা যে সত্যি তা বোঝা গেল ট্রেনে ওঠার পর থেকেই। সহযাত্রীদের অনেকেই কাজির গান শুনেছে, দুয়েক লাইন গেয়ে শুনিয়েও দিল কেউ কেউ। কাজি অবাক হয়ে দেখে, ওর গান নিয়ে এত কথা, কিন্তু কবিতা নিয়ে প্রায় সবাই-ই নীরব। নলিনী বলল, ব্যাপারটা এরকমই হয়। একজন কবি, বড় কবি, তাঁর নাম শুনেছে অনেকেই, এক-আধবার তাঁর কবিতাও যে শোনেনি এমনটা নয়, তবে ওই পর্যন্তই। নিজের উদ্যোগে কবিতার বই কিনে বাড়িতে একা-একা কবিতা পড়া – সাধারণ বাঙালির কম্মো নয়! কবিতা পড়ে কবিরাই, নিদেনপক্ষে যারা কবিযশঃপ্রার্থী! গান কিন্তু ভালো লাগলেই তা সবায়েরই গাইতে ইচ্ছে করে, যার নিজের ওপর ভরসা নেই ততটা, সে-ও হয়তো গায় নিজের অজান্তেই স্নানের সময় মাথায় জল ঢালতে ঢালতে, আর যে নিজেকে গায়ক ভাবে তার তো কথাই নেই, দেখলে তো কতো জন শুনিয়েও দিল তোমাকে তোমারই গান।
নিমতিতাতেও তাই। যে-বাড়িতে বরযাত্রীদের রাখা হয়েছে তা জমিদার বাড়ির অনতিদূরে। ওই অঞ্চলেরই কিছু মানুষের ওপর ওদের দেখাশোনার দায়িত্ব। তাদের মধ্যে অন্তত তিনজন কাজিকে বলে, কাজি যখন বহরমপুরের জেলে বন্দী ছিল, সেই সময় তারা জেলের প্রধান ফটকের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত কাজি আর তার বন্ধুদের গান শোনার আশায়।
নিমতিতায় তিনদিন সবাই মিলে এক বাড়িতে থাকা। অতএব মাঝে মাঝেই কাজির কবিতা আবৃত্তি এবং গান হয়ই। কাজি লক্ষ্য করে, ওদের চেয়ে দশ-বার বছরের বড় এক ভদ্রলোক, প্রৌঢ়ত্বের সুষমার ছোঁয়াচ তাঁর চেহারায়, প্রশান্ত সদাহাস্যময়, মাঝে মাঝে আসেন; গান বা আবৃত্তি শোনেন চুপচাপ, আর কখন যেন সকলের অলক্ষ্যে চলেও যান। কাজির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল একবার; হাস্যবিনিময়, কাজির নাম তাঁর যে অজানা নয় সেটা প্রকাশ, এইটুকুই।
কাজি একদিন নলিনীর কাছে ভদ্রলোকের পরিচয় জানতে চায়। জানা গেল উনি বরদাচরণ মজুমদার, নিমতিতা স্কুলে এক সময় শিক্ষকতা করতেন, নলিনী সেই স্কুলের সময় থেকেই চেনে ওঁকে, এখন উনি লালগোলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। এ-অঞ্চলে সকলের শ্রদ্ধাভাজন, কন্যার বিবাহ উপলক্ষে জমিদারবাবু ওঁকে আনিয়েছেন, তাঁর বাড়িতেই উনি অতিথি, এখানে মাঝে-মাঝে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন। নলিনী আরও বলে, উনি গৃহস্থ হলেও প্রতিষ্ঠিত যোগী, যোগের ক্ষেত্রে সংসারত্যাগী অরবিন্দর সমকক্ষ তো নিশ্চয়ই।
কলকাতায় যেন ওত পেতে বসেছিল মনোরঞ্জন। যেদিন দুপুরে পৌঁছল কাজি, সেদিনই সন্ধ্যেবেলা তার আগমন। প্রথমে সে জল খায় এক গেলাস, তারপর ব্যাগ থেকে বের করে একটা কাগজ। ইংরিজিতে ঘন টাইপ-করা কাগজটা দেখে কাজি বলে, কী এনেছেন? ওটা দেখেই তো ভয় করছে। আপনার কাছ থেকে তেমন কিছু ধার করেছি মনে পড়ছে না তো আমার। কোর্টের সামন নাকি?
কোর্টের সামন আনিনি এখনো, মনোরঞ্জন বলেন, তবে কথার খেলাপ হলে এবার আনবার ব্যবস্থা করছি। পড়ে দেখুন।
টাইপ-করা ইংরিজি, দেখে তো মনে হচ্ছে উকিলি ইংরিজি হবে, ও পড়ে মানে বুঝব না, ওর মধ্যে মোদ্দা কথাটা কী সেটা বলুন, বলে কাজি।
এ-বাড়িতে মনোরঞ্জন খুবই পরিচিত মুখ। মাঝে-মাঝেই আসেন, সব সময়ই যে কাজের কথা বলতে আসেন তেমনটা নয়। এসেই বলেন, এদিকে এসেছিলুম ভাবলুম কাজিসাহেবের সঙ্গে একটু আড্ডা মেরে যাই। তারপর জিজ্ঞেস করেন মুজফ্ফর আহ্মদের কথা। মনোরঞ্জনের বাবা, শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে প্রথম পরিচয় মুজফ্ফরেরই। সেই সান্ধ্য- দৈনিক নবযুগের সময় থেকে। কালিকা টাইপ ফাউণ্ড্রী নামে টাইপ কারখানা ছিল শরৎচন্দ্রর। কথা দিয়ে কথা রাখবার লোক, কখনও কথার খেলাপ করতেন না। তাঁর কাছ থেকেই বাংলা টাইপ কেনা হয়েছিল নবযুগের জন্যে, মনোরঞ্জন তখন সদ্য ব্যবসায় এসেছেন, খোলা হয়েছে কালিকা প্রেস।
মনোরঞ্জনের গলা শুনেই দরজা দিয়ে উঁকি দেয় দুলি: গলা শুনেছি চা না খেয়ে পালাবেন না।
তা পালাব না, কিন্তু একবার ভেতরে আসুন বৌদি, নালিশ আছে।
আঁচলে হাত মুছতে মুছতে প্রমীলা আসে ভেতরে। মনোরঞ্জন বলেন, হজরত মহম্মদের জীবনী নিয়ে কবিতা লিখছিলেন কাজিসাহেব। হৈ হৈ পড়ে গেছে চারদিকে, কিন্তু দুটো ছোট ছোট অংশ লিখেই চুপ করে গেছেন। আমি মতলব করেছিলুম সবটা লেখা হয়ে গেলে একটা বই করব; বলেওছিলুম, কিন্তু কথা শুনছেন না। আসলে এখন মনস্থির করে কাজই করতে পারছেন না। একে তো গ্রামোফোন কম্পানী আছেই, তার উপর এখন আবার থিয়েটার কম্পানীর লোকজনরা জুটেছে। তাছাড়াও খুচরো কাজ; কোথায় বরযাত্রী যেতে হবে, কোথায় কোন্ বক্তৃতা, কোথায় আবার গানের আসর! আমি তাই একটা চুক্তির মুসাবিদা করে নিয়ে এসেছি। এক মাসের জন্যে আপনারা সবাই দার্জিলিং থেকে ঘুরে আসুন। খরচ আমার পাবলিশিং কম্পানী দেবে। ওখানে বন্ধুবান্ধব নেই ডিস্টার্ব করার লোকজনও নেই কেউ, জীবনী কাব্যটা লেখা হয়ে যাবে। ফিরলেই আমি ছাপব। কপিরাইট কাজিসাহেবেরই। পাঁচশো টাকা অ্যাডভান্সও আমি দিয়ে যাব। আপনি একটু জোর করুন বৌদি।
আমি জোর করলেই শোনবার লোক কিনা, বলে দুলি, তা ছাড়া অন্য অসুবিধেও আছে। এই দুরন্ত সানিকে নিয়ে আমি আর মা দুজনেই পাগল-পাগল হয়ে যাই, আমাদের সবাই মিলে কোথাও যাওয়া এখন একেবারে অসম্ভব। এক কাজ করুন না, আপনি আর ও, দুজনে চলে যান না। মাথার উপরে সব সময় আপনি থাকলে আমিও নিশ্চিন্ত থাকব, আর ফাঁকিও দিতে পারবে না একেবারে, জব্দ হয়ে যাবে। যাই, আমি আপনার চা-টা নিয়ে আসি।
কাজিও মনে মনে জানে, মাথার ওপরে মনোরঞ্জনকে চাপিয়ে নিশ্চিন্ত থাকবে দুলি। তাকে একা-একা দার্জিলিঙে ছেড়ে দিতে রাজি নয় সে। মুখে কিছু বলে না দুলি, কিন্তু ফজিলতউন্নেসা এবং ঢাকার হকি স্টিকের গল্প তার কাজির ওপর বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। তার মনে আছে, মুজফ্ফর-হালীমের সঙ্গে এমনকি কুষ্ঠিয়াতেও বঙ্গীয় কৃষক লীগের মীটিঙে সে কাজিকে একা যেতে দেয়নি। প্রায় জোর করেই সঙ্গে গিয়ে হেমন্তদার বাড়িতে থেকেছে। নিজে সে এখন সন্তানসম্ভবা, তা না হলে সে নিজে যেতে রাজি হতই। এখন অন্তত কেউ-একজন থাক, যার চোখ এড়িয়ে যাওয়া শক্ত হবে কাজির পক্ষে।
দুলি ভেতরে চলে গেলে চোখ নাচায় কাজি, কী বুঝলেন?
স্ত্রী-জাতি মাতৃসমা, মায়ের আদেশ তো পালন করতেই হয়।
মায়ের আদেশটা তো বুঝলেন ওপর-ওপর, আমার জন্যে কী আদেশ সেটা বুঝতে গেলে একটু গভীরে যেতে হবে।
মানে?
স্ত্রী-জাতির দিকে ভালোভাবে তাকাতেও তো শেখেননি, বুঝবেন আর কী ভাবে? বোঝেননি উনি ক্যারিং?
অ্যাঁ?
হ্যাঁ। নভেম্বর-ডিসেম্বরে ডিউ। আমি একটু বুঝে নিই এই সময়টায় আমার যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা। আইডিয়াটা আমার মন্দ লাগল না। নিরিবিলিতে দার্জিলিঙে। আপনাকে দু'দিন পর জানাচ্ছি।