সাধারণ থার্ড ক্লাসে শোবার জায়গা নেই। গোয়ালন্দ থেকে বেশ কষ্ট করেই উঠতে হয়েছে। যাক, তবু কোনরকমে বসবার একটা জায়গা পাওয়া গেল। হোল্ড-অলটা পায়ের নীচে আর ব্যাগটা পাশে রেখে কোনমতে নিজেকে গুঁজে দিয়েছে কাজি জানলার ধারে একটা জায়গায়। এতক্ষণে ট্রেনের দুলুনিতে আর পাশের সহযাত্রীর সহযোগিতায় ওর গড়-পড়তা-বাঙালির-চেয়ে-বড়সড়ো-দেহটা খাপে-খাপে পেছনের হেলান দেবার কাষ্ঠখণ্ডের সঙ্গে সংলগ্ন হল। আসবার সময়ে স্টীমারের ফাউল-কারি আর ভাতটা ভারি স্বাদু ছিল। চোখ দুটো যেন ধীরে ধীরে লেগে আসে কাজির।
অন্যদিন ছাপা একটা শাড়ি পরে মেয়েটা, আজ হলুদ-রঙা লালপেড়ে লাল ডুরে একটা শাড়ি পরেছে, সঙ্গে মেমসাহেবদের মতো পুরো হাতা ব্লাউজ। আঁচলটা কোমরে গোঁজা। বন্ধুদের সঙ্গে এত হাসাহাসি কিসের, কিসের এত মাথা দুলিয়ে গল্প করা! কাজির দিকে ফিরেও তাকাল না একবার। এমন সময় কে-যেন ওর নাম ধরে ডাকল। 'যাই' বলে সাড়া দিয়ে এক ঝলক কাজির দিকে তাকিয়ে দৌড়িয়ে ফিক করে একটু হেসে কোন্ দিকে যে চলে গেল সে বোঝাও গেল না কিছু। কাজি ভালো করে মেয়েটার পায়ের ছাপ পড়েছিল যেখানে সেদিকে তাকায়। পড়ে আছে একটা মাথার কাঁটা! সযত্নে সেটা নীচু হয়ে তুলতে যাবে এমন সময় পিঠে দুম দুম দুম তিনটে কিল! চটকা ভেঙে চোখ মেলে কাজি। আশপাশের মানুষদের দিকে তাকায় সে। কেউ কি লক্ষ্য করছে ওকে?
ওই ভালো-লাগার কিল-ই মন ভালো করে দেয় ওর। আসবার সময় বিরজাসুন্দরী 'মা' খাবার দিয়ে দিয়েছিলেন, পরোটা আর আলুর দম, এক বোতল জলও দিয়ে দিল দুলি, ব্যাগে রাখা আছে সব। কার্তিকের পড়ন্ত বেলা, বাইরের লাল আকাশ আর দিগন্তবিস্তারি সবুজ-সাদায় মনটা কেমন যেন ঝরঝরে লাগে। কাউকে বলেনি, কিন্তু গতকাল সেপাইটা থানার লক-আপ-এ নিয়ে যাবার সময় লাঠির একটা কোঁৎকাও দিয়েছিল ওকে। আচ্ছা, লোকটা তো কাজিকে দেখেইনি আগে, কাজির ওপর ওর রাগের তো কোন কারণই নেই। তবুও কেন ওই কোঁৎকা? যেটুকু কথা ও বলেছে কাজির সঙ্গে, তাতে কাজি বুঝতে পেরেছে ওই কুমিল্লা অঞ্চলেরই মানুষ হবে সে। পুলিশের কনস্টেব্ল্, সাধারণ মানুষই নিশ্চয়ই। তাহলে এই যে মাসখানেক ধরে এত প্রভাত-ফেরী, এত প্রচার যে ওরা করল, এর কয়েকমাস আগেও এই কুমিল্লাতেই রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের যে প্রচার ওরা করেছে, এর কি কিছুই ফল নেই? একটা সাধারণ কনস্টেব্ল্, পেয়েছে কাজটা তাই পুলিশের কাজ করছে, না যদি পেত তা হলে হয়তো বাজারে একটা মুদির দোকান করত ও, কিংবা কিংবা...
কাজি সত্যিই ভেবে পায় না কী অন্য কাজ ওই লোকটা করতে পারত। যদি ধরে নেওয়া যায় পারিবারিক জমি-জিরেত নেই ওর, সে ক্ষেত্রে চাষবাসের কাজের প্রশ্ন ওঠে না। কনস্টেব্লের কাজ করে, অর্থাৎ স্কুলের গণ্ডী হয়তো ও পেরোয়ইনি, হয়তো সাত-আট ক্লাস অবধি পড়েছে স্কুলে, কিংবা তা-ও নয়; কুমিল্লা বা তার আশপাশের অঞ্চলে জীবিকার জন্যে আর কী কাজই বা করতে পারত ও! ধরা যাক, যে কাজটা ও পেয়েছে – স্বাস্থ্য-টাস্থ্য সাধারণ লোকের তুলনায় নিশ্চয়ই ভালোই ছিল ওর – তাই পেয়ে গেছে পুলিশের কাজটা – কিন্তু না পেত যদি? একেবারে এমন দুঃস্থ তো নয় নিশ্চয়ই যে ভিক্ষে করবে বা জাহাজঘাটা-রেলস্টেশনে কুলিগিরি করবে। হয়তো বড় কোন শহরে চলে যেত, টুকটাক অর্ডার সাপ্লাই-টাপ্লাইয়ের কাজটাজ করতো হয়তো। আর না যেত যদি? ধরা যাক থেকেই গেল লোকটা ওই কুমিল্লাতেই। যে প্রভাত-ফেরী কাজি আর তার সহকর্মীরা করেছে, বিদেশী দখলদারির বিরুদ্ধে যে প্রচারের কাজ করেছে ওরা, পুলিশের চাকরি না পেলে ওই প্রচারের লক্ষ্য তো সে-ও, ওই লোকটাও? এমনকি পুলিশের চাকরি সত্ত্বেও প্রচারের লক্ষ্য তো সে না হওয়ার কারণ নেই। তাহলে, লোকটা – ওপরওয়ালার নির্দেশে ওকে লক-আপ পর্যন্ত যে সে নিয়ে গেছে তাতে বলার কিছু নেই – কিন্তু ওই কোঁৎকাটা, ওটার যুক্তি কী ছিল? তাহলে, গান্ধী যে হিংসার বিরুদ্ধে কথা বলেন, সেই হিংসাটাই মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক? অচেনা মানুষকে অপ্রয়োজনীয় কোঁৎকা হিংসারই পরিচায়ক নিশ্চয়ই। যে অহিংসার বাণী প্রচার করেন গান্ধী, তা কি তাহলে মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা নয়? তার মানে, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে গান্ধী চাইছেন এমন কিছু, যা তাঁর, মানে গান্ধীজির, আপন-মনের-মাধুরীসৃষ্ট অস্বাভাবিক একটা মানসিক অবস্থান? তা হলে সেটা কি বাস্তব?
সুভাষবাবুর সঙ্গে আলাপের দিনটা মনে পড়ে কাজির। পবিত্র বারবার খুঁচিয়েও গান্ধীর বিরুদ্ধে একটাও কথা বলাতে পারেনি সুভাষকে দিয়ে। তাঁর পদ্ধতিতে লড়াই করে কীভাবে যে অসহযোগ আন্দোলন থেকে স্বাধীনতায় স্বচ্ছন্দ উত্তরণ হবে তা সুভাষ নিজে, এবং এমনকি চিত্তরঞ্জন বা মতিলালও যে বুঝতে পারেননি এটুকু বলেও, শেষ অবধিও কিন্তু সুভাষ গান্ধীর বিরুদ্ধে একটাও কথা বলেননি। এমনকি রবীন্দ্রনাথ, যাঁর সঙ্গে কথাবার্তায় সুভাষ গান্ধীর সঙ্গে স্পষ্টতই মতবিরোধ লক্ষ্য করেছেন, তিনিও সেই গান্ধীকে যে এতটুকুও ছোট করেননি তা-ই শুধু নয়, সুভাষকেও গান্ধীর উপদেশ নিতে পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি।
এই ধন্দটা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না কাজি। মনের গভীরে তার সশস্ত্র লড়াইয়ে আস্থা, নিজের-প্রাণ-তুচ্ছ-করা সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরাই তার আদর্শ, তবুও গান্ধীর কথা হেমপ্রভা লিখতে বললে সে স্বচ্ছন্দে স্বতস্ফূর্ত লিখে ফেলে, 'মুক্তি সে তো নিজের প্রাণে!' কিন্তু পরাধীনতা থেকে মুক্তি, সে তো বোঝা যাবে, ছোঁয়া যাবে। পুরো দেশটাই তো বদলিয়ে যাবে সেই মুক্তিতে। সেই মুক্তিকে শুধুমাত্র যার যার নিজের নিজের প্রাণের বোধ বললে সত্যের অপলাপ হয় না? কিন্তু সত্যের অপলাপ – যার আর এক নাম মিথ্যে – সে তো রীতিমতো ভেবে-চিন্তে বলতে হয়! কোন একটা বিশেষ উদ্দেশ্য না থাকলে মিথ্যে কি আর বলা যায়! তা হলে কোন্ উদ্দেশ্যে লিখেছে লাইনটা কাজি?
ও আর ভাবতে পারে না। এ ব্যাপারটাই সুভাষবাবুর সঙ্গে ও আলোচনা করতে চায়। পবিত্র লিখেছে পুলিশ নাকি
যে-কোন দিন সুভাষকে গ্রেপ্তার করবে বলে কলকাতায় এখন জোর গুজব। কাজেই, দেরি করা চলবে না। সুভাষের সঙ্গেই ও কাজ করতে চায়, গিয়েই প্রথম কাজ হল সুভাষের সঙ্গে দেখা করা।
কাজির ফেরাটা হঠাৎই হচ্ছে, মুজফ্ফর জানে না ও ফিরবে কবে। মুজফ্ফর অনেকবার বলা সত্ত্বেও ওদের ঘরের একটা ডুপ্লিকেট চাবি কাজি রাখেনি নিজের কাছে, তাই সোজা তালতলায় না গিয়ে ও বত্তিরিশেই পৌঁছল। পৌঁছে, আফজালুলকে জিজ্ঞেস করল পবিত্রর কথা, কবে ও আসতে পারে। আফজালুল বলে, কালই তো এসেছিল, মনে হয় না খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া আজকালের মধ্যে আসবে আবার। তবে, কয়েকদিন ধরে মুজফ্ফর আহ্মদ আসছেন রোজই, আপনার খবর নিচ্ছেন। আপনি নাকি ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে যাননি, কাজেই কুমিল্লা থেকে ফিরে নিশ্চয়ই আসবেন এখানেই।
সেই বিকেলেই মুজফ্ফরের সঙ্গে তালতলায় ফেরে কাজি। ফিরতে ফিরতে রাস্তাতেই বলে মুজফ্ফর, ভাগ্যে তুমি এলে আজ, না হলে তো মুশকিল হত।
কিসের মুশকিল? – প্রশ্ন কাজির।
কিরণশঙ্কর রাজি হয়েছেন ডিরেক্টর হতে, মৌলভী আবুবক্র্ও। তুমি এলে সবাই মিলে একবার বসে, ওই যে
জয়েন্ট-স্টক কম্পানীর কথা ভাবা হয়েছিল – ওই যে ন্যাশনাল জর্ণালস লিমিটেড – ওটার একটা প্রসপেক্টাস ড্রাফ্ট্ করতে হবে।
সে তো হবেই, বলে কাজি, কিন্তু আমার প্রায়োরিটি এখন অন্য। আমার প্রথম কাজ এখন সুভাষবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা। পবিত্র চিঠি লিখেছিল, সুভাষবাবুর নাকি যখন-তখন অ্যারেস্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা। ওই যে ভলান্টিয়ার বাহিনীর কথাটা সুভাষবাবু বলেছিলেন আমি ওটাকে নিয়ে অনেক ভেবেছি। কুমিল্লায় তো তৈরিও করেছিলুম একটা। ও ব্যাপারটা ফাইনালাইজ করি প্রথম।
পবিত্রর সঙ্গে যোগাযোগ করে যে ঠিকানা সুভাষবাবু দিয়েছিলেন সেখানে একটা চিঠি পাঠায় কাজি। উত্তর আসে
দু' দিন পরেই। বত্রিশ নম্বরে। কুমিল্লার হরতালের অসামান্য সাফল্যের জন্যে অভিনন্দন জানিয়েছেন সুভাষ নজরুলকে। ভলান্টিয়ার বাহিনীর পরিচালনা নিয়ে অনেক কিছুই উনি ভেবেছেন, সেটা নিয়ে নজরুলের সঙ্গে অনতিবিলম্বেই বসবেন। আপাতত দুয়েকটা অন্য কাজে ব্যস্ত আছেন, সেগুলো হয়ে গেলেই বসা হবে।
কয়েকটা দিন প্রায় বিনা-কাজেই কেটে গেল। এর মধ্যে মুজফ্ফর আহ্মদ যোগাযোগ রেখে যাচ্ছেন কুত্বুদ্দিন আহ্মদ আর কিরণশঙ্করের সঙ্গে। ততদিনে প্রস্তাবিত কম্পানীর প্রসপেক্টাসের একটা প্রাথমিক মুশাবিদা করে ফেলেছেন কুত্বুদ্দিন। ডিসেম্বরের গোড়ায় কিরণশঙ্করের বাড়িতে মীটিঙের কথা হল। কুত্বুদ্দিনের বাড়ি থেকে ফিরে মুজফ্ফর জানায় সে-কথা কাজিকে।
মীটিঙে ইংরিজি আর বাংলা ভাষায় তাঁর প্রাথমিক মুশাবিদা সঙ্গে করে এনেছিলেন কুত্বুদ্দিন আহ্মদ সাহেব। বাংলাটা পড়ে শোনালেন উনি, টাইপ-করা ইংরিজিটা হাতে নিয়ে চোখ বোলাচ্ছিলেন কিরণশঙ্কর। হাসিমুখে বললেন ড্রাফ্টিং তো চমৎকার করেছেন আহ্মদ সাহেব। তবে একটা জিনিষ খেয়াল করলাম। বাংলায় যেখানে লিখেছেন কৃষক-মজুর, ইংরিজিতে সে-জায়গায় প্রোলেটারিয়েট। আপনি তো আবুল কালাম আজাদের বন্ধু, আবার কম্যুনিস্টও নাকি? শব্দটা, মানে ওই যে প্রোলেটারিয়েট শব্দটা, ওটা ইংরিজি ভাষারই, তবে মার্কস সাহেবের ভারি পছন্দের শব্দ, আর লেনিন-টেনিনরা শব্দটায় নতুন একটা মাত্রা এনে দিয়েছে।
আপনার আপত্তি থাকলে অন্য কিছুও ভাবতে পারি, বলেন কুত্বুদ্দিন, তারপর মুজফ্ফরের দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনার কী মনে হয়?
সভার কার্যবিবরণী লিখছিল মুজফ্ফর, সে জবাব দেবার আগেই কিরণশঙ্কর বলেন, আরে না না, প্রোলেটারিয়েট দিব্যি চলবে, বাঙালি নব্য-শিক্ষিতদের বড় প্রিয় এই শব্দ, একটা মস্ত বড় সেকশন অব শিক্ষিত মানুষ এই শব্দের জোরেই হয়তো চলে আসবে আমাদের কাগজের কম্পানীতে। আর, আমার কথা যদি বলেন, আমি তো কংগ্রেসি, মস্ত বড় আমাদের প্ল্যাটফর্ম; মতিলালপুত্রকেই দেখুন না, ওঁর মতো প্রায়-কম্যুনিস্ট আমাদের দলে আরও অনেক আছেন। প্রোলেটারিয়েটে আমার নিজের কোন আপত্তিই নেই, আপনার সম্বন্ধে শুনেছিলাম আপনি খিলাফতি, খিলাফতিরা তো ধর্মভীরু হয় বলে শুনেছিলাম, তাই এই কম্যুনিস্টি শব্দটা শুনে একটু অবাক হচ্ছিলাম।
তাহলে শব্দটা রইল, তাই তো? মুজফ্ফর সাহেব, এই আলোচনাটা একটু নোট করবেন ভাই, বলেন কুত্বুদ্দিন, তারপর আবার কিরণশঙ্করের উদ্দেশেই বলেন, ন্যাশনাল জর্ণাল্স্ লিমিটেড নামটা সবাই অ্যাপ্রুভ করছেন তো?
সে তো আগের থেকেই অ্যাপ্রুভ করা আছে, নজরুল বলে।
মুজফ্ফর নজরুলের কথা শুনে হাসে একটু, তারপর আবুবক্র্-এর দিকে তাকিয়ে বলে, মৌলানা সাহেব তো কোন কথাই বলছেন না, আপনার মতামত তো বোঝা যাচ্ছে না কিছুই।
আবুবক্র্ বসে ছিলেন এমন একটা জায়গায় যার ঠিক উল্টো দিকেই একটা দরজা। মুজফ্ফরের কথার মাঝখানেই সেই দরজাটা খুলে যায়, তলায় চাকা লাগানো একটু-বেঁটে-একটু-ছোটখাটো-টেবিল-গোছের কিছু-একটা ঠেলতে ঠেলতে ঘরে ঢুকলো একজন, টেবিলটার ওপর কয়েকটা চিনেমাটির রেকাবিতে নানা মিষ্টি সাজানো। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে হাসতে হাসতে আবুবক্র্ বলেন, এইবার কথা বলব। ওই যে, মিষ্টান্নমেতরেজনাঃ, আমার মতো ইতরজন ওই মিষ্টির লোভেই জমিদারবাবুর বাড়িতে ঢুকেছি, মীটিং-ফিটিং তো অজুহাত মাত্র। কিন্তু বাছা, মিষ্টান্নবহনকারীকে সম্বোধন করে আবুবক্র্ বলেন, শুগারের রোগী, যা এনেছ কোন একটা প্লেটে শুধুমাত্র একখানা রেখে বাকিগুলো তুলে নিয়ে ওই প্লেটটি আমাকে দাও। যেগুলো তুললে, সেগুলো বাকি সব প্লেটে ভাগ করে দিতে পার।
কিরণশঙ্করের দেয়াল-ফাটানো হা হা হাসিতে অত বড় ঘরটাও যেন কাঁপতে থাকে, এটা মৌলভী সাহেবের অন্যায় হল। এ একেবারে আমার কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি ছোঁড়া। মীটিঙে এসে একটাও কথা বললেন না, এখন বলছেন জমিদারবাবুর বাড়িতে এসেছেন মিষ্টির লোভে। নিজের বাড়িতে অ্যালাউ করবে না, এবার শুগার বাড়লে বলবেন কিরণশঙ্কর জোর করে খাইয়ে দিল।
জোর? জোর করার কথা আসে কোথা থেকে? – বলেন আবুবক্র্, মোগল সম্রাট আকবরের জন্মের কথা জানেন তো? তাঁর জন্মের সময় তাঁর পিতা যুদ্ধপর্যুদস্ত হুমায়ুন কিছু পারিষদ এবং গর্ভবতী যুবতী সম্রাজ্ঞীসহ অমরকোটের রাণার দুর্গে আশ্রিত। সেই অবস্থায় পুত্র জালাল উদ্দিন মহম্মদ আকবরের জন্ম হয়। পারিষদদের কাছে মহার্ঘ কিছু আছে কিনা খোঁজ করতে করতে জৌহর নামক একজন পণ্ডিত আমীরের কাছে দু'শো খোরাসানী স্বর্ণমুদ্রা, একটি রজতনির্মিত রিস্টলেট এবং এবং খানিকটা মৃগনাভি হুমায়ুন পেয়ে গেলেন। স্বর্ণমুদ্রা বা রজতনির্মিত অলঙ্কারটি হুমায়ুন গ্রহণ করলেন না। মৃগনাভিটুকু স্বহস্তে বহু ছোট ছোট টুকরো করে উপস্থিত সকলকে একটি করে টুকরো তিনি উপহার দিলেন। নিজের শরীরজাত যে মৃগনাভির সুগন্ধে মাতোয়ালা মৃগটি নিজেই উন্মাদগ্রস্ত হয়, সেই গন্ধে বহু যোজন আমোদিত হল। মঙ্গলাচরণ করে হুমায়ুন উপস্থিত সকলকে বললেন, আপনারা প্রার্থনা করুন, এই আশ্চর্য সুগন্ধের মতো আমার এই সদ্যোজাত পুত্র আকবারের সুকর্মের ফল এবং যশ যেন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। দেখুন, আমরা আর মৃগনাভি কোথায় পাব। আমি জানতাম জমিদার কিরণশঙ্করবাবুর বাড়িতে আমাদের পত্রিকার শুভ জন্মের বীজ আজ বপণ করা হবে। আমরা কি সবাই এই প্রার্থনা করতে পারি না যে, এই পত্রিকার প্রাণ হবে যে ভাষা, সেই ভাষায় এই পৃথিবীতে যাঁরা কথা বলেন, তাঁদের সকলের প্রিয় মিষ্টান্নের স্বাদের মতো এই পত্রিকাও দীর্ঘকাল এই বাংলাভাষীদের মনোরঞ্জন করবে, আর মিষ্টান্নের মতোই প্রিয়তম হবে? আর সত্যি কথা বলতে কি, এত কিছুর জন্যে রক্তে সামান্য শর্করাবৃদ্ধির কী আর মূল্য?
কিছুমাত্র নয়, বলেন কুত্বুদ্দিন আহ্মদ।
সাধু সাধু, বলে ওঠেন কিরণশঙ্কর, সকল রকম সাধুসঙ্কল্পের সূচনা হোক সন্দেশ দিয়ে।
তা হোক, আবার কথা বলেন কুত্বুদ্দিন সাহেব, মৌলভী সাহেবের মতো আমি পূর্বাহ্ণেই স্বীয় রক্তের শর্করা-সংক্রান্ত কোন ঘোষণা করিনি। কিন্তু এতগুলো নানা ছাঁচের নানা পাকের সন্দেশ শেষ পর্যন্ত আমার পক্ষে ব্যক্তিগত দুর্গ্রহ হয়ে না দাঁড়ায়।
আপনিও? মানে, শর্করাধিক্যের রোগী আপনিও? – আবার কথা বলেন কিরণশঙ্কর, বেশি সন্দেশগুলো তাহলে আমাদের বিশ্বজয়ী কবি কাজি নজরুল ইসলামকেই চালান করে দিন, সম্প্রতি উনি কুমিল্লা বিজয় করে ফিরেছেন, তার জন্যে আলাদা করে একটা সম্বর্ধনা তো ওঁর প্রাপ্যই ছিল।
কুমিল্লা বিজয়? – মৌলানা আবুবক্র্ খানিকটা অবাক।
ও, আপনি বাংলা কাগজ দেখেননি বোধ হয়। এই যে সতেরই নভেম্বর সারা ভারতে হরতাল হল, সেই হরতাল সত্যি সত্যিই সর্বাত্মক হয়েছে মাত্র দুটি জায়গায়; এক, কলকাতা আর দুই, কুমিল্লা। কুমিল্লায় হরতালের উদ্যোক্তা এবং নেতা ছিলেন আমাদের কবি কাজি নজরুল ইসলাম। নতুন নতুন গান লিখে গান শিখিয়ে এক মাস ধরে কুমিল্লার সব মানুষজনকে নিয়ে নিয়মিত প্রভাত-ফেরী করেছেন, এমনকি গ্রেপ্তারও হয়েছেন।
কাজি বলে, না না গ্রেপ্তারটা কিছু নয়, পুলিশ একটু ভয় দেখাবার চেষ্টা করেছিল মাত্র, ঘন্টাখানেক বাদেই ছেড়ে দিয়েছে।
কিন্তু কুমিল্লায় কেন, আপনি তো কুমিল্লার লোক ন'ন, বলেন কুত্বুদ্দিন।
তা নই, বলে কাজি, কয়েকমাস আগে যখন আসাম লাইনের রেল-এ আর গোয়ালন্দের স্টীমারে ধর্মঘট হয়েছিল, আমি সেই সময় কুমিল্লায় গিয়ে পড়েছিলুম পাকেচক্রে, ওখানকার মানুষজনের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হল, খানিকটা বন্ধুত্বও হয়ে গেল। তখনও প্রভাত ফেরীটেরি হয়েছিল, সেই সূত্রেই এবারেও ধর্মঘটের সময় ওদের সঙ্গে যোগ দিলুম।
কুমিল্লায় গেলে থাকেন কোথায়, জিজ্ঞেস করেন কিরণশঙ্কর।
সাধারণত কান্দির পাড়।
আরে, কান্দির পাড়ে তো বসন্তদার বাড়ি, আমাদের কংগ্রেসের লড়াকু নেতা বসন্ত মজুমদার।
ঠিকই বলেছেন, কাজি বলে, বসন্ত মজুমদারের বাড়ির পাশের বাড়িতেই থাকি, আমার কাছাকাছি বয়েসের একজন আছেন ওখানে, তিনিও কংগ্রেস-কর্মী, আজকাল কলকাতায় –
–আমাদের জাতীয় বিদ্যালয়ে পড়ায়, তাই তো? ও তো আমার সহকর্মী, বীরেন তো?
চেনেন?
চিনি মানে, বীরেন সেনগুপ্ত শুধুই আমার সহকর্মী নাকি? ওরা তো আমার প্রতিবেশীও।
তার মানে, কলকাতায় ওরা এই পাড়াতেই থাকে? এই য়্যোরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেনে?
কলকাতায় নয় নজরুল সাহেব, কলকাতায় নয়; তেওতা, মানে মাণিকগঞ্জে আমাদের বাড়ি যেখানে, যথেষ্ট উত্তেজিত শোনায় কিরণশঙ্করের কণ্ঠস্বর।
খুব নিবিষ্ট হয়ে শুনলেও প্রায় নীরবেই ছিল এতক্ষণ মুজফ্ফর, এবার কিরণশঙ্করের উদ্দেশে সে বলে, মাণিকগঞ্জের তেওতায় তো শুনেছি আপনাদের বিশাল জমিদারি, সেই জমিদারিরই প্রজা বীরেনবাবুরা?
প্রজা হতে যাবে কোন্ দুঃখে? ওরা কি চাষবাস করে নাকি? ওদের বাড়ি আমাদের বসতবাড়ির প্রায় সংলগ্নই বলতে পারেন। বীরেনের জ্যাঠামশাই – তিনিও বসন্ত, বসন্তকুমার সেনগুপ্ত – ত্রিপুরা রাজ-এস্টেটে নায়েব ছিলেন, আর ওঁর ছোটভাই, মানে বীরেনের পিতৃদেব, ইন্দ্রকুমার, কুমিল্লার কোর্ট অব ওয়র্ডসের ইন্সপেক্টর। কুমিল্লায় কান্দির পাড়ে তিনি বাড়ি করেছেন। বসন্তকাকুর অকালমৃত্যুতে ছোট ভাই ইন্দ্রকুমার তাঁর বিধবা পত্নী গিরিবালা আর একমাত্র কন্যা দুলি – মানে, পোষাকী নাম যার আশালতা – তাদের কুমিল্লায় নিয়ে যান। বোঝা গেল ব্যাপারটা?
পৃথিবীটা যে সত্যি-সত্যিই গোল তা এমনি করেই বারবার প্রমাণ হয়ে যায়, হাসি হাসি মুখে প্রায় দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলেন মৌলভী সাহেব, একই জায়গায় সবাই ফিরে ফিরে আসে বারবার।
কিরণশঙ্করের বাড়ির মীটিঙের পর খানিকটা ফুরফুরে মেজাজে ছিল মুজফ্ফর আর কাজি, দৈনিক পত্রিকার ব্যবস্থাটা ভালোই এগোচ্ছে মনে হচ্ছে, এদিকে মুজফ্ফরের পূর্ব-পরিচিত আবদুল হাফিজ শরীফাবাদী নামে এক ভদ্রলোক মস্কো-থেকে-আসা একজন কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নেতার সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দেবেন বলেও জানিয়েছেন, তিনি নাকি কলকাতায় কিছু সমমনস্ক মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান। এর মধ্যে গুজব যা রটেছিল বাস্তবে হল তার চেয়ে বেশি; ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখে গ্রেপ্তার হলেন শুধু সুভাষ নয়, স্বয়ং দেশবন্ধুও। সারা কলকাতায় প্রায় অঘোষিত হরতাল হয়ে গেল ওইদিন। সুভাষের সম্বন্ধে কাজির একটা বিশেষ শ্রদ্ধা তৈরি হয়েছে সেই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে রবীন্দ্রনাথের সম্বর্ধনার দিন থেকেই, গান্ধীর সম্বন্ধে সুভাষের ঈষৎ কুণ্ঠামিশ্রিত শ্রদ্ধার ফাঁক দিয়ে কেমন জানি বাঘাযতীন-নিবারণবাবুস্যরদের উদ্দাম লড়াইয়ের একটা প্রবণতাকে উঁকি দিতে লক্ষ্য করেছিল সে। এই গ্রেপ্তারের পর প্রবল উত্তেজনা কাজির, বলে, এ ভাবে কিন্তু মহাত্মাজীর অহিংস পন্থায় দাঁড়িয়ে মার খাওয়ার চেয়ে পূর্বসূরিদের
মেরে-মরার নীতি বোধ হয় অনেক বেশি ফলপ্রসূ হত।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পেরিয়ে হঠাৎ খুব ঠাণ্ডা পড়ে গেল। ক'দিন ধরেই কথা কম বলছে সে, একটু অস্থির অস্থির ভাব, কেমন যেন তার নিজেকে জোর করে ধরে রাখার একটা প্রয়াস চোখে পড়ে। তার হো হো অট্টহাসি,
ঘি-চপচপ-কাবলি-মটর, চালাও-পানসি-বেলঘরিয়া আর দে-গোরুর-গা-ধুইয়ে গর্জন হঠাৎ কেমন যেন স্তিমিত হয়ে এসেছে মনে হচ্ছে। অত যে প্রিয় বত্তিরিশ নম্বর কলেজ স্ট্রীট আর সেখানকার আড্ডা, সেখানেও দু'দিন গেল না কাজি, মুজফ্ফরের সঙ্গে তার সম্প্রতি-গড়ে-উঠতে-থাকা খিলাফতি-সমাজবাদী মজুর সংগঠনের কর্মী-সমর্থকদের নানা ডেরাতেও নয়।
এরই মধ্যে এক ভোর-রাতে মুজফ্ফরকে ঠেলে তোলে কাজি। হঠাৎ ঘুম-ভেঙে ওঠার চমকানিতে ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারে না মুজফ্ফর, কী হল? কিছু হয়েছে নাকি?
না, মুখটা ধুয়ে এসো, বলে কাজি।
মুজফ্ফরের এটাই অভ্যেস, ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে বাথরূমে যাবে, চোখ-মুখ ধুয়ে এসে বসবে কিছুক্ষণ, তারপর চায়ের জল ফুটিয়ে চা ভিজিয়ে ঘুম থেকে তুলে দেবে কাজিকে। নজরুলের চোখের সাদা অংশটায় স্বভাবতই লালের আভা থাকে একটু, আজ মুজফ্ফর বাথরূম থেকে ফিরে দেখল ওর চোখ দুটো টকটকে লাল। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোমার?
কিছু না, বোসো, মুজফ্ফরের তক্তপোশের দিকে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে ও। বসবার পর মুজফ্ফর খেয়াল করে নজরুলের পাশে ভাঁজ-করা একখানা খাতার মাঝখানে একটা পেনসিল। পেনসিলটা সরিয়ে খাতাখানা খোলে সে, বলে, কাল সারারাত ধরে একটা কবিতা লিখেছি, শোন।
কবিতা পড়তে শুরু করে কাজি। কাজির প্রথম কবিতা – যা মুক্তি নামে ছাপা হয়েছিল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় – সে কবিতার সঙ্গে মুজফ্ফরের আবেগ নিবিড় ভাবে জড়িত। পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে সেই কবিতা ছাপাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ও-ই। শুধুমাত্র তা-ই নয়, কবিতার মুক্তি নামটাও ওরই দেওয়া। কিন্তু, আজ এ কী কবিতা পড়ছে কাজি? পৃথিবীতে যে-সব মানুষ নিজের আবেগ নিজের উচ্ছ্বাস নিজের মধ্যেই ধরে রাখে, মুখের ভাষায় তা প্রকাশ না করতে পারাই যাদের স্বভাব, মুজফ্ফর সেই শ্রেণীর লোক। সে ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসে। কবিতার প্রতিটি স্তবকের ক্রিয়া নিজের স্নায়ুতে বুঝতে পারে সে, এক ধরণের কম্পন সে অনুভব করে তার সর্বাঙ্গে। এ কি কবিতা? যেন পৃথিবীর মাটির ঊর্ধ্বে কোন চলমান অচেনা জগতে পলকে পলকে তাকে নিয়ে যাচ্ছে কবিতার ছন্দ, আর সেই ছন্দে সে মুহূর্তে যে একটি শব্দই সম্পৃক্ত হতে পারে ঠিক জায়গায় ছন্দোবদ্ধ সেই আশ্চর্য শব্দটি! ছন্দ এবং শব্দের এই আশ্চর্য উন্মত্ত সহাবস্থান এক অসাধারণ আনন্দের অজানা স্বাদে তৃপ্ত করতে থাকে মুজফ্ফরকে। কবিতার শেষ স্তবকের শেষ চরণটিতে যেন উড্ডীন পাখিটি আকাশ থেকে ধীরে নেমে আসে:
মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না,
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হারা খেয়ালী বিধির
বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দেব পদচিহ্ন,
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!!
আমি চির বিদ্রোহী বীর –
আমিবিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত-শির!
কবিতা পড়া শেষ হলে কাজির কাছ থেকে নীরবে খাতাটা চেয়ে নেয় মুজফ্ফর, বিনা বাক্যবিনিময়ে পড়তে শুরু করে সে কবিতাটা। কতো বার সে কবিতাটা পড়ল তা জানে না মুজফ্ফর, শেষ বার পড়ার পর দেখে পাশের তক্তপোশে মুখটায় ছোট একটা হাঁ-করে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে কাজি, তার নাসিকা-মুখগহ্বর থেকে ধীরে ধীরে নিঃসৃত হচ্ছে – কে জানে, হয়তো – তৃপ্তিরই একটা শব্দ!