বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বাড়িটা ঠিক চেনে না নজরুল। গতকাল বত্তিরিশের আড্ডায় পবিত্র খবর আনলো, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ নাকি পরের দিন, মানে আজ, রবীন্দ্রনাথকে ষাট বছরের জন্মদিনের সম্বর্ধনা দেবে। ওই সাহিত্য পরিষদেরই বাড়িতে। পবিত্র নিজে তো যাবেই, ওর মেস কাছাকাছিই, হেঁটেই পৌঁছে যেতে পারবে ও, আর কেউ ইন্টারেস্টেড নাকি? স্বভাবতই নজরুল যেতে চায়, আর মুজফ্ফরও তো নিশ্চয়ই চাইবে যেতে। মুজফ্ফরের তো যাওয়া-আসা আছেই সাহিত্য পরিষদে, এক সময় নিয়মিতই সে আসতো সেখানে। মুজফ্ফরের দিকে তাকিয়ে দেখা গেল প্রবল বেগে ঘাড় নাড়ছে সে, কাল সে কোনমতেই যেতে পারবে না; কাল সকাল থেকেই সে ব্যস্ত, আবদুর রেজ্জাক খান আর তার দুয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে তার বসবার কথা আছে, কোন কারণেই তার পক্ষে এটা 'মিস' করা সম্ভব নয়। তাহলে? নজরুল তো চেনে না জায়গাটা। মুজফ্ফর বলল, শেয়ালদা থেকে ট্রামে উঠে ডানদিকে চোখ রেখে যেও, ঠিক পৌঁছে যাবে। পবিত্র বলল, কী রে, আমি আসব নাকি কাল সকালে তোদের তালতলায়?
আসতে চান আসুন, বলে মুজফ্ফর, তবে আপনারা চাইলেও কি আর কাজিকে খোকা করে রাখতে পারবেন? একা একা হিল্লী দিল্লী কুমিল্লী ঘুরে বিপ্লব-টিপ্লব করে এল তার ওপর আবার–
তার ওপর আবার কী? কলে পড়ে বড়দাকেও ডেকে পাঠালুম তাই তো?– নজরুল বলে গোমড়া মুখে।
ইয়ার্কি থেকে ঝগড়া-ঝাঁটিতে না পৌঁছে যায় ভেবে পবিত্র গলাটা একটু তুলেই বলে, ব্যস ব্যস, এনাফ। আমার কথা শোন্ কাজি, শেয়ালদাতেও আসতে হবে না তোকে। তোদের তালতলা থেকে হেঁটে হেঁটে সোজা আসবি ধর্মতলার মোড়ে। মানে মৌলালিতে, বুঝলি তো? শ্যামবাজার-বাগবাজারের দিকে যায় যে ট্রামগুলো তার মধ্যে একটায় উঠবি। সায়েন্স কলেজ চিনতে পারবি তো? সায়েন্স কলেজ পেরোলেই ডান দিকে নজর রাখিস। জায়গাটা মানিকতলায়। একেবারে সার্কুলার রোডের ওপর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ লেখা বাড়ি। ভুল করার কোন উপায়ই নেই। আর সভা শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত আমি বাড়িটার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকব। যদি ঠিক সময় পৌঁছোস তাহলে দেখতেই পাবি আমাকে, ঠিক আছে?
পৌঁছোলো কাজি ঠিকই, তবে একটু দেরিতে। বাড়ির সামনে পবিত্রর থাকবার কথা, নেই। তার মানে সভা শুরু হয়ে গেছে। ভেতরে ঢুকল কাজি, কবি এসে গেছেন। বসেও আছেন একেবারে মঞ্চের উপর। লালপাড় সাদা শাড়ি পরা দুটি মেয়ে – নজরুল পরে শুনেছিল ওরা দুই বোন, কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচির মেয়ে – একজনের হাতে চন্দনের বাটি আর একজনের হাতে মালা, কবিকে মালা আর চন্দন পরাচ্ছে। হন হন করে হেঁটে মঞ্চের উপর কাজি উঠে যায়, পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে কবিকে। কবি ওর মাথায় হাত রাখেন, হেসে পাশের খালি চেয়ারটা দেখিয়ে ইঙ্গিতে বলেন বসতে। থতমত খায় নজরুল, বুঝতে পারে না কী করবে, একটু ইতস্তত ভাব। কবি বোঝেন; বলেন, বোসো না। আর তো উপায় নেই, বসেই পড়ে সে।
সামনের প্রথম দুই সারিতে বসে ছিল যারা, তাদের মধ্যে রীতিমতো গুঞ্জন। নজরুল বসেই থাকে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে। ফিসফিস করে একটা গলা শোনা যায়, ঠিক লোককেই বসিয়েছেন, গুরুদেবের পর তো উনিই। কেউ একটা মৃদু প্রতিবাদও করল বোধ হয়। গুরুদেব, মনে হল মজাই পাচ্ছেন, একটু হাসি-হাসি মুখে আড়-চোখে তাকান নজরুলের দিকে। আরষ্ট নজরুল সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে তৃতীয় সারিতে বসে-থাকা পবিত্র হাতদুটো মাথার ওপর তুলে দিয়ে হাসিমুখে শব্দহীন হাততালি দিয়ে চলেছে। একটু চোখাচোখিও হল বোধ হয়।
নজরুল একটা শ্বাস ছাড়ল।
এই ধরণের সভায় যা হয়; উপনিষদ থেকে পাঠ করলেন একজন, আর-একজন কেউ রবীন্দ্রনাথেরই গান একটা গেয়ে শোনালেন, আরও দুয়েকটা বক্তৃতা। মানপত্র পাঠ হল, কবিকে ফলমূলমিষ্টান্নাদি, গরদের জোড় ফাউন্টেন পেন ও কাশ্মিরী শাল একখানা উপহার দেওয়া হল; অতি অল্প কথায় সাহিত্য-পরিষদ এবং উপস্থিত ভদ্রজনদের উদ্দেশে কবি শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। প্রণামের ভীড় তারপর রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে। তারপর কবিকে কেন্দ্র করে একটি মনুষ্যবলয় তাঁকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে সম্ভবত জোড়াসাঁকো পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিতে গেলেন।
মঞ্চে দাঁড়িয়েই থাকল কাজি কিছুক্ষণ। ভীড় কমে গেলে দেখল পবিত্র দাঁড়িয়ে আছে তার জন্যে। নজরুল বলল, আমি কি খুবই দেরি করে এসেছি?
খুবই, জবাব পবিত্রর, আমি পরিষদভবনের বাইরে রাস্তার উপর দাঁড়িয়েছিলুম। যেভাবে কবিকে বের করে নিয়ে গেল এখন, ঠিক সেভাবেই এক দল লোক তাঁকে নিয়ে এসেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলুম। তারপর মনে হল, আর দাঁড়িয়ে লাভ নেই। কিন্তু লাভ তো হল তোর। রবীন্দ্রনাথের সম্বর্ধনা না রবীন্দ্র-নজরুল সম্বর্ধনা বোঝা যাচ্ছিল না তো।
কথা বলতে বলতে ওরা বেরিয়ে যাবে, প্রায় খালিই হয়ে গেছে সভাগৃহ, এমন সময় সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত
চশমা-চোখে সুদর্শন এক যুবক এসে দাঁড়াল ওদের সামনে। আচ্ছা, আপনার নাম কি কাজি নজরুল ইসলাম? – যুবকটি প্রশ্ন করে কাজিকে।
হ্যাঁ, তাই, বলে কাজি, কিন্তু এ কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন? আপনি তো নিশ্চয়ই কাজি নজরুলের জন্যে এখানে আসেননি। আর কাজি নজরুলের জন্যে এমন সভায় আসবেও না কেউ।
সোজাসুজি এ-কথার উত্তর না দিয়ে যুবক বলে, আমি সামনের দিকের একটা সারিতে বসেছিলাম, এমন সময় আপনি মঞ্চে উঠে এসে কবিগুরুকে প্রণাম করলেন। মনে হল কবিই আপনাকে তাঁর পাশের খালি চেয়ারটায় বসতে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু আপনি বসার সঙ্গে সঙ্গেই সামনের দিকে যারা বসেছিল তাদের মধ্যে ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেল। আমি সামনের দিকেই ছিলাম, লোকজনের কথাবার্তা কানে যাওয়ায় বুঝতে পারলাম আপনার নাম কাজি নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথের আপনাকে ওই চেয়ারে বসতে বলায় সামনের দিকে যারা বসেছিল তাদের একদল মনে করছে কবি ঠিকই করেছেন কারণ ভবিষ্যতে আপনিই তাঁর উত্তরাধিকারী। তারা আপনার নাম ধরেই বলছে সে কথা। অন্যদল তা মানছে না। আমি তো আপনাকে চিনি না, কিন্তু আপনার নাম জানি, খানিকটা-খানিকটা আপনার লেখা পড়েওছি। তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করে বুঝতে চাইছিলাম ব্যাপারটা আমি ঠিকই বুঝেছি কিনা।
এতক্ষণে ওরা ভিতরের আধো-অন্ধকার থেকে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। যুবকটির দিকে তাকিয়ে নজরুল আর পবিত্র – দুজনেই বুঝল যুবকের সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি সাধারণ নয়, খদ্দরের। অত্যন্ত নম্র চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট, ছিপছিপে লম্বা শরীর মিলিয়ে সে অতি সুদর্শন। যুবক এবার হাত জোড় করে নমস্কার করে বলে, আমার নাম সুভাষ, সুভাষ বসু, আমি এসেছিলাম কবিকে একটা প্রণাম করব বলে, কিন্তু সুযোগ হল না।
সুভাষ বসু? – পবিত্র জিজ্ঞেস করে, আপনিই কি আই-সি-এস ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন?
তা দিয়েছি, বলে যুবকটি, কিন্তু আপনি বুঝলেন কী করে? এই খদ্দরের জোরে?
খদ্দর খানিকটা সাহায্য করেছে বুঝতে এটা ঠিকই, কিন্তু আপনাকে তো স্টেটস্ম্যানই বিখ্যাত করে দিয়েছে। বলেছে ইস্তাহারপ্রচারবিদ্যায় আপনি নাকি সিমলাকেও হার মানিয়েছেন। বলেছে, আপনার আই-সি-এস ত্যাগে ব্রিটিশ সরকারের যতটা ক্ষতি কংগ্রেসের ততটাই লাভ। এর পরেও কি আপনার খদ্দর আর সুভাষ বসু নাম মেলাতে পারব না?
মৃদু একটু হাসে সুভাষ, বলে উনি তো নজরুল ইসলাম, আপনার নামটা জানা হল না।
আমি পবিত্র গাঙ্গুলি, কাজি নজরুলের বন্ধু।
আপনারা কোন দিকে যাবেন? – সুভাষ বলে, আমার সঙ্গে একটা গাড়ি আছে, সুবিধে হলে আমার সঙ্গে আসতে পারেন।
আপনি কোন দিকে যাবেন সেটা আগে শোনা যাক, বলে কাজি।
কলেজ স্ট্রীট অঞ্চলে। শ্যামাচরণ দে মশায়ের বাড়ি। দাদার শ্বশুরালয়।
তাহলে তো আসতেই পারি, বলে কাজি, আমরা যাব মেডিক্যাল কলেজের কাছে, আয় না পবিত্র, তুইও চল।
পবিত্র আপত্তি করে না, সুভাষ বলে, গাড়িটা একটু দূরে রাখতে বলেছি, দুয়েক মিনিটের হাঁটা-পথ।
হাঁটতে হাঁটতেই সুভাষ বলে, নজরুল সাহেব, আপনার লেখা পড়েছি নারায়ণ পত্রিকায়।
নারায়ণ? চিত্তরঞ্জন দাশের? কিন্তু আমি তো নারায়ণে লিখিনি কখনও।
আপনার লেখবার প্রয়োজন হয়নি। আপনার একটা পত্রোপন্যাস – বাংলায় তো আমার মনে হয় প্রথম – বাঁধন হারা, নারায়ণে বেশ খানিকটা করে উদ্ধৃত হয় প্রতি সংখ্যাতেই, আমরা পড়ি। আপনাকে নিয়ে আলোচনাও হয়, আমি তো এখানকার কিছুই জানতাম না, এই তো সবে কয়েকমাস হল বিলেত থেকে ফিরেছি...
গাড়িটার সামনে ততক্ষণে পৌঁছিয়ে গেছে ওরা, যেখানে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে তার উল্টো দিকেই ড্রাইভার বসেছিল একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে, দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি এসে দরজাটা খুলে দিল। সুভাষ দরজাটা ধরে প্রথমে নজরুলকে তারপর পবিত্রকে উঠিয়ে দিয়ে নিজে উঠল তারপর। ড্রাইভারের সীটের নীচে ছিল হ্যাণ্ডেলটা, সেটা বের করে, গাড়িটার স্টার্ট চালু করে, হ্যাণ্ডেলটা নীচে আবার রেখে ড্রাইভার বসল নিজের জায়গায়। মৃদু স্বরে সুভাষ বলল, মেডিক্যাল কলেজের দিকে।
নজরুলের সঙ্গে কথাবার্তায় ছেদ পড়েছিল যেখানে, ঠিক সেই জায়গাতেই আবার ধরল সুভাষ, কলকাতার সাহিত্য-টাহিত্যের ব্যাপারটা এখনও অবধি প্রায় কিছুই জানি না বললেই হয়। আপাতত হাতের সামনে বাংলায় লেখা যা পাই তাই-ই পড়ি। আপনারটাও পড়ি, তবে সেটা তো খানিকটা পরের মুখে ঝাল খাওয়া গোছের, বারীন ঘোষ যেটুকু উদ্ধৃত করেন আর যা মন্তব্য করেন তার থেকেই যতটা বুঝতে পারি। কিন্তু বাঙালি লেখকের লেখায় রূপকথার যুদ্ধ-টুদ্ধ ছাড়াও আধুনিক যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করাটা একেবারেই নতুন বলে মনে হল।
নজরুল হেসে বলে, ওই উপন্যাসটা লিখেছি একেবারেই যুদ্ধের পরিবেশে বসে, করাচির আর্মি ব্যারাকে।
আর্মি ব্যারাকে? আপনি আর্মিতে ছিলেন নাকি?
হ্যাঁ, ফর্টি-নাইন বেঙ্গলী ব্যাটালিয়ান, ব্যাটালিয়ান কোয়ার্টার-মাস্টার হাবিলদার কাজি নজরুল ইসলাম।
ওর বলার ভঙ্গিতে হেসে ওঠে সুভাষ, এতটা আশা করিনি, বলে সে, আমি তো ভেবেছিলাম নেহাৎই অন্নপায়ী বঙ্গবাসী স্তন্যপায়ী জীব, আপনি যে ধুতি-পাঞ্জাবি-গেরুয়া উত্তরীয়র আড়ালে এমন মিলিটারি ব্যক্তিত্ব তা কে ভেবেছিল? তাই বুঝি আপনার লেখায় এমন মিলিটারি মেজাজ?
মিলিটারি মেজাজ কোথায় পেলেন? বাঁধন হারা তো নেহাৎই প্রেমের গল্প, ফোড়ন কাটে পবিত্র।
না না না না, আমি গল্পটার কথা বলছি না, আমি তো বিদেশে ছিলাম তাই আমি পড়িনি, কিন্তু শুনেছি নজরুল সাহেব নাকি নবযুগ নামে এক দৈনিক পত্রিকা বেনামে সম্পাদনা করতেন, আর সেখানে গরম গরম সম্পাদকীয় লিখতেন।
হেসে ওঠে পবিত্র, ঠিকই শুনেছেন, সেই গরমের ভয়েই ওর মালিক-কাম-অফিশিয়াল সম্পাদক আবুল কাসেম ফজলুল হক নানা অছিলায় বন্ধ করে দিলেন কাগজখানা। কিন্তু ওর কথা থাক, স্টেটসম্যানে আপনার সম্বন্ধে পড়ে আপনার ব্যাপারে প্রবল কৌতূহল আছে আমার। আচ্ছা, আই-সি-এস এর কাজ যদি না-ই করেন তাহলে আই-সি-এস দেবার জন্যে বিলেত অবধি গেলেন কেন?
সত্যি কথা এই যে বিলেত যাবার ইচ্ছে আমার ছিলই, কেম্ব্রিজে পড়বার এবং ট্রাইপজ দেবার, কিন্তু তাতে তো বিপুল খরচ। বাড়ির খুব বাধ্য ছেলে ছিলাম না, কাজেই সে কথাটা বাবাকে বলতে পারছিলাম না মুখ ফুটে। এমন সময় বাবাই কথাটা তুললো, বিলেতে গিয়ে আই-সি-এস এর জন্যে তৈরি হবার কথা। বিশেষ কিছু ভাবিনি সেই সময়, শুনেইছি আই-সি-এস খুব কঠিন পরীক্ষা, দিলে পাশ করব কিনা অনিশ্চিত, কিন্তু ট্রাইপজটা তো হবেই। মুশকিলটা হল কখন জানেন? যখন আই-সি-এস পাশ করে গেলাম সহজেই। এমনিতেই ব্রিটিশ সরকারের গোলামী করবার ইচ্ছে আমার কোনদিনই ছিল না, স্কটিশে বি-এ ক্লাশে ভর্তি হবার আগে – ঠিক নজরুল সাহেবের মতো পুরোদস্তুর আর্মি না হলেও – আই-ডি-এফ, মানে, ইণ্ডিয়ান ডিফেন্স ফোর্সে ভর্তি হয়ে যুদ্ধবিদ্যের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছি, কেম্ব্রিজেও য়্যুনিভার্সিটি কোর-এর মেম্বার ছিলাম, ভাবলাম লড়াইটা ইংরেজের বিরুদ্ধে করলে কেমন হয়! এক বন্ধুর মাধ্যমে চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ হল। উনি উৎসাহ দিলেন। বছরখানেক লেগে গেল বাড়ির সবাইকে বোঝাতে। সবাইকে শেষ পর্যন্ত বোঝাতে হয়তো পারিনি, কিন্তু আমার মেজদা আর সবচেয়ে বড় কথা আমার মা-ও আমার পক্ষে দাঁড়াল। মনস্থির করে ফেললাম। যে জাহাজে দেশে ফিরেছি, মার্সাইয়ের পোর্টে সেই একই জাহাজে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ। খুব স্পষ্ট করে উৎসাহ না দিলেও...
গাড়িটা এখন কলেজ স্কোয়ার ছাড়াচ্ছে। পবিত্র বলল, আপনার কথার মাঝখানে বাধা দিচ্ছি। আমরা কিন্তু গন্তব্যস্থলে এসে পড়েছি।
অ্যাঁ, তাই? সুভাষ এতক্ষণ গাড়ির জানলার বাইরে তাকায়ইনি। বাইরের দিকে তাকিয়ে এবার একটু অপ্রস্তুত মুখে হেসে বলল, তাহলে? কিন্তু কথা তো শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে গেল। আমরা একটু বসতে পারি কোথাও? ধরুন, এই কলেজ স্কোয়ারে? এই, দাঁড় করাও তো গাড়িটা, ড্রাইভারকে বলল সে।
কোন উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না-করে গাড়ি থেকে নামে সুভাষ, ওর পিছনেই একে একে নামে পবিত্র আর নজরুল। সুভাষ জিজ্ঞেস করে, আপনারা যেতেন কোথায়?
বাঁ-দিকের দোতলা বাড়িটার দিকে আঙুল দেখিয়ে কাজি বলে, এই বাড়ির দোতলায়। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিস। আসবেন নাকি?
আসতে তো পারিই, বলে সুভাষ। কিন্তু মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিস, আরও লোকজন তো থাকবে। আমাদের যেমন নিরালায় কথা হচ্ছিল সেটা তো হবে না। তার চেয়ে আমি একটা কথা বলব? আমরা কলেজ স্কোয়ারে বসি না।
বলেই, উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে গাড়ির ড্রাইভারের কাছে গিয়ে সুভাষ কিছু নির্দেশ দেয়, ওরা শুনতে পায় না। গাড়িটা খানিকটা সোজা গিয়ে মেডিক্যাল কলেজে ঢুকে যায়। সুভাষ ওদের কাছে ফিরে এসে বলে, ও গাড়ি ঘুরিয়ে অ্যালবার্ট হলের সামনে রাখবে। চলুন, আমরা যাই। অতি-পরিচিত জায়গায় আসার স্বচ্ছন্দতায় মির্জাপুর স্ট্রীটের একটা গেট দিয়ে কলেজ স্কোয়ারের ভিতরে একটা বেঞ্চে বসে ওরা তিনজন।
বসতে বসতেই সুভাষ বলে, রবীন্দ্রনাথ আমাকে বোম্বাই পোর্টে নেমে গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে বলেন। চিত্তরঞ্জনেরও একই নির্দেশ ছিল।
মনে হল পবিত্র আর অপেক্ষা করতে পারছে না, সুভাষ থামতে-না-থামতেই বলে, হ্যাঁ, সেটাই বলছিলাম, গান্ধীজি। গান্ধীজিকে আপনার কেমন লাগল?
সুভাষ হেসে ফেলে, কেমন লাগল – এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। ওঁর একটা চমৎকার হাসি আছে, সেই হাসিতে আমাকে অভ্যর্থনা করলেন। মণিভবন নামে একটা বাড়িতে আমাদের দেখা হয়েছিল, সেখানে সবাই-ই তো খদ্দরের পোশাক পরেছিল, আমার পরণে স্যুট, আমি একটু অস্বস্তি বোধ করছিলাম, গান্ধীজির হাসিতে আমার অস্বস্তি কমল। উনি আমাকে অল্প কথায় ওঁর চার দফা অসহযোগের কর্মসূচী বোঝালেন। আর সেই বিকেলেই ট্রেন ধরে কলকাতায় রওনা দিয়ে চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে দেখা করতে বললেন। আমি চলে এলাম।
পবিত্র বোধ হয় আবার কিছু বলবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু সুভাষ নজরুলের দিকে তাকিয়ে বলল, নজরুল সাহেব, আজ সকালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে আপনি যখন কনফার্ম করলেন আপনিই নজরুল ইসলাম, আমি তখনই আপনাকে একটা প্রস্তাব দেব ভাবছিলাম। সেই জন্যেই আমি আপনার নবযুগের কথাটা তুলছিলাম। আপনারা তো এতক্ষণে শুনেইছেন, কয়েকমাস আগে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেবার বাসনায় আমি চিত্তরঞ্জন দাশ মশায়ের সঙ্গে দেখা করি। তিনি অতি স্নেহে আমাকে তাঁর সঙ্গী করতে রাজি হলেন। আমাকে তিনি প্রথম দিনেই দুটো কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন; এক, গৌড়ীয় বিদ্যায়তনের অধ্যক্ষতা, এবং দুই, বাংলায় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রচারের দায়িত্ব। ওই যে স্টেট্স্ম্যানের মন্তব্যের যে-কথা পবিত্রবাবু বলছিলেন সেটা ওই প্রচারেরই একটা অংশবিশেষ। কিন্তু আমার বাসনা আছে, বাংলার কংগ্রেসের পক্ষ থেকে একটা বাংলা দৈনিকপত্র বের করার। আমি ভাবছিলাম, এ ব্যাপারে যদি আপনার সক্রিয় সাহায্য পাওয়া যায়।
ঠিক কী ধরণের সাহায্যের কথা আপনি ভাবছেন? – জিজ্ঞেস করে নজরুল।
দাঁড়ান দাঁড়ান, আমার কথা শেষ হয়নি, নজরুলকে প্রায় থামিয়ে দিয়েই বলে ওঠে সুভাষ, দৈনিক পত্রের সম্পাদনায় সাহায্য করার কথাটা ভেবেছিলাম প্রথমে, তারপর আপনার ফর্টি-নাইন বেঙ্গলী ব্যাটালিয়নের ব্যাকগ্রাউণ্ডটা শোনার পর আরও একটা অন্য কথা মনে হল। আপনারা স্টেটসম্যান যখন পড়েন তখন নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে বাংলার কংগ্রেসে আমরা একটা ভলান্টিয়ার বাহিনী তৈরি করেছি। আপনি যদি একদিন সময় দেন তাহলে এই বাহিনীর ব্যাপারে বিশদে আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে পারি। কিন্তু তবুও, আমার মতলবটা আগে থেকেই জানিয়ে রাখি আপনাকে। আপনাকে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থক ধরে নিয়েই বলছি, আমাদের ভলান্টিয়ার বাহিনীর একটা দায়িত্বও আপনাকে দিতে চাই।
এই কথা চলতে চলতেই অতি দ্রুত চিন্তা শুরু করে পবিত্র। মুজফ্ফর ছাড়া আর কেউই কাজিকে ওর মতো ঘনিষ্ঠ ভাবে জানে না, আগুপিছু না-ভেবে মুহূর্তের প্ররোচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা ওর মতো অপরিণামদর্শীর পক্ষে খুবই সম্ভব। কাজি কিছু বলার আগেই ও বলে ওঠে, এ তো আপনি একেবারে মনের মতো কাজ দিচ্ছেন কাজিকে। ও তো এইসবই চায়; তবে আমি যতদূর জানি, ঠিক এই মুহূর্তেই কুমিল্লায় ওর একটা কমিটমেন্ট আছে, আগামী কয়েক মাস ওকে তো পাবেনই না।
হ্যাঁ, তিন মাস তো বটেই, বলে কাজি।
তাতে কী আছে, বলে সুভাষ, মাস তিন-চার না হয় অপেক্ষা করাই যাবে। আচ্ছা, আপনারা থাকেন কোথায়?
জবাব দেয় পবিত্র। 'আপনারা' বলছেন, কিন্তু আমরা তো এক জায়গায় থাকি না। কাজি থাকে তালতলায়, ওর এক বন্ধুর সঙ্গে ঘর শেয়ার করে; আর আমি থাকি হাতিবাগান আর মানিকতলার মাঝামাঝি একটা জায়গায়, মেস-এ। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিস হচ্ছে আমাদের সবায়েরই যোগাযোগের জায়গা। প্রায় রোজই আমরা কেউ-না-কেউ আসিই ওখানে। কাউকে দিয়ে ওখানে একটা খবর পাঠিয়ে দিলে সে খবর আমরা ঠিকই পেয়ে যাব।
ঠিক আছে, তাই-ই হবে, আমি আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেব এর মধ্যে, বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় সুভাষ। পবিত্র বলে, কিন্তু আমার কৌতূহলটা মিটল না সুভাষবাবু, আমি আপনাকে গান্ধীজির বিষয়ে একটা প্রশ্ন করেছিলুম।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বলে সুভাষ, গান্ধীজির হাসিটা চমৎকার আপনাকে বলেছি, এ-ও বলেছি, প্রথম দিনের পরিচয়েই উনি আমাকে অসহযোগের চার দফা কর্মসূচি বোঝাবার চেষ্টা করলেন। যে কথাটা আপনাকে আগে বলিনি এখন বলছি, তা হল আমি সেদিন অসহযোগ আন্দোলনের উপযোগিতা ঠিক ঠিক বুঝতে পারিনি, অর্থাৎ অসহযোগ থেকে স্বাধীনতায় স্বচ্ছন্দ উত্তরণ – গান্ধীজি যা বলতে চাইছিলেন সেটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি। এমনিতে আমি বিনা তর্কে কোন কিছু চট করে মেনে নেবার লোক নই, কিন্তু গান্ধীজির বলবার ভঙ্গিতে এমন একটা স্বতস্ফুর্ততা ছিল, জোর ছিল এমন একটা, আমার মনে হল কী জানি, আমিই হয়তো বুঝতে পারছি না নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্যে। কাজেই কথা আর না বাড়িয়ে কলকাতায় চলে এলাম। চিত্তরঞ্জন দাশ মশাইকে যখন বললাম এ কথা, উনি বললেন অসহযোগের ফলে স্বাধীনতা কীভাবে আসবে সেটা উনিও বোঝেননি, বোঝেননি মোতিলাল নেহ্রুও, কিন্তু সারা দেশ যেভাবে এবং যে উৎসাহের সঙ্গে ওঁর কথা মেনে নিয়েছে তাতে ওঁরা মনে করেছেন আপাতত গান্ধীজির কথা মেনে নিয়ে কাজে নেমে পড়াটাই কাজের কাজ।
নজরুল বলে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথও তো মেনে নিতে পারেননি বলেই শুনেছি।
সুভাষের মুখটা কেমন যেন অপ্রস্তুত দেখায়। এবার বাঁ হাতটা তুলে ঘড়ি দেখে সে, তারপর ধীরে ধীরে আবার বসে পড়ে, যে জাহাজে আমি ফিরেছি সেই একই জাহাজে মার্সাই থেকে রবীন্দ্রনাথও এসেছেন, আপনাদের বলেছি বোধ হয়। বেশ কয়েকটা দিন-রাত তাঁর সঙ্গে কাটিয়েছি তখন, আমার আই-সি-এস ছেড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে আসার ব্যাপারটা নিয়ে কোন স্পষ্ট মন্তব্য করেননি তিনি, কিন্তু নিরুৎসাহও করেননি। ইন্টারমীডিয়েট ক্লাশে পড়বার সময় আমি একবার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেবার পল্লী-সংগঠন সম্বন্ধে অনেক কথা তিনি বলেছিলেন আমাদের। কবির মনে ছিল না, কিন্তু একবার মনে করিয়ে দিতেই আবার পল্লী-স্বরাজ নিয়ে তাঁর চিন্তার কথা অনেক বললেন। সবটাই গঠনমূলক চিন্তা। অসহযোগের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ আগ্রহ আছে বলে মনে হল না, তিনি ভাঙার নয়, গড়ার সংগঠিত আন্দোলনেই উৎসাহী বলে আমার মনে হল। তাঁর স্বাধীনতা আন্দোলনের চিন্তায় দেখলাম অনেকটাই আইরিশ আন্দোলনের প্রভাব আছে। সত্যি কথা বলতে কি, তাঁর কথাবার্তার মধ্যে একবারও গান্ধীজির নাম শুনেছি বলেও আমি মনে করতে পারি না। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও সব শেষে তিনি আমাকে বললেন, স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশগ্রহণই যদি আমার উদ্দেশ্য হয়, আমি যেন বোম্বাইতে নেমে নিশ্চয়ই একবার গান্ধীজির সঙ্গে কথা বলি। দেখুন, বলতে থাকে সুভাষ, আমি তো আর গান্ধীজির মতো অত বড় মানুষ নই, সেই বোম্বাইয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হবার পর আমার সঙ্গে তাঁর আর কোন যোগাযোগই হয়নি। আমি চিত্তরঞ্জন দাশ মশায়ের নির্দেশ পালন করি, তিনি মানুষও অত্যন্ত ভালো। তাঁর নেতৃত্বে কাজ করতে পেরে আমি ভালোই আছি। তবে গান্ধীজির ব্যাপারটা আমাকে অবাক করে। চিত্তরঞ্জন, মোতিলালজি, রবীন্দ্রনাথ – এঁরা তো সবাই কতো বড় মাপের মানুষ। এঁদের মধ্যে গান্ধীজির সঙ্গে মত মেলে না এমন মানুষ যেমন আছেন, গান্ধীজির মত একেবারেই বোধগম্য হয়নি এমন মানুষও আছেন! কিন্তু এঁরা কেউই তাঁকে অস্বীকার তো করতে পারেননি!
এবার সুভাষ উঠে পড়ে। বলে, আপনাদের অনেক দেরি করিয়ে দিলাম। আমাকেও এবার যেতে হবে, আমার দাদা অপেক্ষা করবেন।
বেঞ্চে বসেই সুভাষের যাওয়ার পথে চেয়ে থাকে ওরা, দক্ষিণ থেকে উত্তরে চলেছে সে দ্রুতপদে।
সুভাষ চোখের আড়াল হতেই পরস্পরের দিকে মৃদু হেসে তাকায় পবিত্র আর কাজি, কাজি বলে, খিদে পেয়েছে?
পেয়েছে, কিন্তু খাবি কোথায়?
তুই তো আমাদের তালতলার ডেরায় আসিসনি কখনো, কাজি বলে পবিত্রকে, চল আজ তোকে চিনিয়ে দেব জায়গাটা, যাবার পথে চাঁদনিতে রুটি-কাবাব চলবে? আমি হোস্ট।
জানি, কাল তুই আড়াইশো টাকা পেয়েছিস। কিন্তু মনে রাখিস, তোর টার্গেট পাঁচশো।
পাঁচশো হবে না, ওরিয়েন্টাল আরও শ' দেড়েকই দেবে মনে হয়।
ক'খানা পাণ্ডুলিপি গেল?
তুইও মুজফ্ফর আহ্মদের মতো কথা বলছিস। পাণ্ডুলিপি তো তৈরিই হয় পাবলিশারের কাছে যাবার জন্যে।
সেটা ঠিকই, বলে পবিত্র, কিন্তু তোর পাণ্ডুলিপি তো পকেটের টাকা, হাত ঢুকিয়ে বের করলেই খরচ, মানে শূন্য!
এ-ছাড়া আর কী হতে পারে? টাকা তো পকেটে পোরার জন্যেই।
তোর মতো চিরকাঙালের পক্ষে তাই, কিন্তু ভেবেচিন্তে চলে যারা তাদের টাকা ব্যাঙ্কে পোরার জন্যে। না যদি তুলে ফেলিস পুরোটা একসঙ্গে, সারা জীবন তোকে সুদ দেবে একটু একটু করে। কপিরাইট হল ব্যাঙ্কের টাকা, সেটা যদি পাবলিশারকে দিয়ে দিস, তোর পকেটে সঙ্গে সঙ্গে আসে টাকা খানিকটা ঠিকই, কিন্তু পাবলিশারের কাছে সেটাই হয়ে যায় ব্যাঙ্কের টাকা, বুঝলি?
বুঝলুম, কিন্তু দেখিস, দেখে রাখিস, আমারও গাড়ি হবে বাড়ি হবে।
তুই গাড়ি-বাড়ি চাস?
চাইব না কেন? সবাই চায়। জন্মে অবধি ভিখিরি হয়েছি, চিরকালই থাকব নাকি তাই?
ওঃ, আমি তো ভেবেছিলুম তুই শুধুই প্রেমের কাঙাল, বাড়ি-গাড়িরও কাঙাল তা তো বুঝিনি।
আপাতত আমি রুটির কাঙাল, সঙ্গে একটু কাবাব।
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে পবিত্র বলে, চালাও পানসি বেলঘরিয়া।
বেলঘরিয়া এখান থেকে বেশি দূর নয়, ট্রামে আর চাপব না, বলে কাজি, বলেই এক লাফে বেঞ্চি থেকে উঠে পড়ে হাঁটতে থাকে হনহন।
মৌরি চিবোতে চিবোতে ধর্মতলা স্ট্রীটে পড়তেই বোঝা গেল অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছে আশপাশে। যেদিকের ফুটপাথে ওরা, তার উল্টোদিকের ফুটপাথ ধরে একটু এগোলেই সামনের ডানদিকে যে গলিটা সোজা জানবাজারের দিকে চলে গেছে, সেদিকে দৌড়িয়ে ঢুকে যাচ্ছে এক দল লোক, আবার বেরিয়েও আসছে অনেকে। ওদেরও ওই রাস্তা দিয়েই যাবার কথা, ওরা একটু এগোল।
গলিটার দুধারেই ছোট বড় নানা জামাকাপড়ের দোকান। দেখা গেল প্রায় সব দোকানই বন্ধ, দুয়েকটা তখনও বন্ধ করা হচ্ছে। গলিটার শেষ মুখেই বোঝা গেল ব্যাপারটা কী। বহু মানুষের ভীড়, তারই মাঝে সাত-আট ফুট ব্যাসার্ধের একটা গোলাকৃতি ফাঁকা জায়গায় রাশিকৃত জামাকাপড়; সেগুলোতে আগুন লাগানো হয়েছে, একজন একটা টিন থেকে কিছু একটা – সম্ভবত কেরোসিন তেল – ঢেলে দিল জ্বলন্ত জামাকাপড়গুলোর ওপর, আগুনটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। সমবেত মানুষদের, মনে হল উল্লাসধ্বনি – মহাত্মা গান্ধী কি জয়, আল্লাহু আকবর! হিন্দু মুসলমান কি জয়!
নজরুল আর পবিত্রর দুজোড়া পা যেন আঠা দিয়ে কেউ আটকিয়ে দিয়েছে রাস্তার সঙ্গে। হতবাক হয়ে ওরা দেখল চার-পাঁচজন লোক আরও দু' বস্তা কাপড় ওই অগ্নিশিখার মধ্যে ঢেলে দিল। কেরোসিনের টিন থেকে ঢালা হল আরও খানিকটা, বস্ত্রযজ্ঞের আগুন এখন আকাশমুখী! মহাত্মা গান্ধী কি জয়!
নজরুলের হাত শক্ত করে ধরে আকর্ষণ করে পবিত্র, হঠাৎ ঝাঁকানিতে বোধ হয় সম্বিৎ ফিরে পায় কাজি, কিছু-একটা বলতে পবিত্রর দিকে তাকিয়ে দেখে ওর বাঁ-হাতের তর্জনী ওষ্ঠাধরে। ওই একই গলি দিয়ে দ্রুত ফিরে আসে ওরা, ধর্মতলা স্ট্রীটে আবার পড়ার পর ঘোরে ডানদিকে, ওয়েলিংটন স্কোয়ারের দিকে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পবিত্র বলে, মহাত্মা গান্ধী কি জয়!
কাজি বলে, কিরণশঙ্করবাবু বলছিলেন আগামী কাল গান্ধীজি আসছেন কলকাতায়, পরশু দিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জোড়াসাঁকোয় ওঁর বসবার কথা।