এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • সীমানা - ২৭

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০৬ মে ২০২৩ | ২২৩৮ বার পঠিত
  • ছবি: সুনন্দ পাত্র


    ২৭

    নজরুলের সংসার – ১



    এখন আনন্দনাড়ু কোটবার পালা মাসুদা খাতুন মুসাম্মাতের।

    বিয়ে করবে কাজি, তার মা বিরজাসুন্দরী তার মধ্যে নেই, এ কি ভাবা যায়? কিন্তু ভাবা যা যায় না তা-ও তো ঘটে। বিরজাসুন্দরী ও তাঁর স্বামী ইন্দ্রকুমার এই বিয়েতে আপত্তি করেছেন। কী আপত্তি স্পষ্ট করেননি তাঁরা, কিন্তু এ-বিয়ে কিছুতেই তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না। সারা কলকাতায় ঢি ঢি। এত যে প্রগতিশীল প্রবাসী, নজরুলের লেখা পেলেই যারা ছাপত – শুধু যে ছাপত তা-ই তো নয় – প্রতিটি লেখার বিনিময়ে একটা ভদ্রগোছের সাম্মানিক দক্ষিণাও জুটে যেত প্রবাসীর থেকে, এমনকি তারাও নজরুলের এই বিবাহে বিরোধীপক্ষ।

    তবে মূলত ওই প্রবাসীই। আর তার সঙ্গে ব্রাহ্মদেরও এক গুচ্ছ। এক গুচ্ছই, কারণ সবাই তো নিশ্চয়ই নয়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ শোনা যাচ্ছে আশীর্বাণী পাঠিয়েছেন। ব্রাহ্মদের বাইরের হিন্দুদের মধ্যে অবিশ্যি তেমন কিছু তাপ-উত্তাপ বোঝা যাচ্ছে না। কট্টর মৌলবাদী হিন্দুদের নজরুল ইসলাম প্রথম থেকেই না-পসন্দ। তাঁরা নজরুল পড়েন না, তাকে নিয়ে আলোচনাও করেন না। 'আমি মানিনাকো কোন আইন' ঘোষণাকারীর কাছ থেকে তাঁদের কোনদিনই কোন আশা নেই, কাজেই আশাভঙ্গেরও প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু এই দুই গোষ্ঠীর বাইরেও আর এক দল হিন্দু আছেন যাঁরা নজরুলের এই বিবাহের প্রস্তাবে অস্বস্তি বোধ করেন। মোহিতলাল মজুমদার ধর্মীয় চিন্তায় প্রায়-গোঁড়া হিন্দু, অথচ বাংলা কবিতায় আরবী-ফারসী আবহ আনয়নকারী নজরুলের এক সময় তিনি প্রায় অনুরাগীই ছিলেন। আজকাল অবিশ্যি নজরুলের লেখনী তাঁর খানিকটা অপছন্দেরই তালিকাতে। তবুও, ধূমকেতুর দপ্তরের আড্ডাতেও তাঁকে দেখা যায় কখনও কখনও। ধূমকেতুর ম্যানেজার শান্তিপদ সিংহ, সে মোহিতলালের পূর্বতন ছাত্র ইশকুলে। তারই সুবাদে ধূমকেতুর আড্ডায় মোহিতলালও আসেন কখনো কখনো। নজরুলের কবিতায় হিন্দু দেবদেবীর রূপকল্পের ব্যবহার ইদানিং পছন্দ করেন না তিনি; এতটাই অপছন্দ যে এমনকি নজরুল-ঘনিষ্ঠ মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের কাছেও তাঁর নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন একবার – স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ! হিন্দু মেয়ের পাণিগ্রহণ স্বভাবতই অপছন্দ মোহিতলাল আর তাঁর শনিবারের চিঠির ঘনিষ্ঠদের।

    কিন্তু মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজও নজরুলের বিবাহে তাদের বিরক্তি প্রকাশ করছে স্পষ্টতই। পাত্রীকে ধর্মান্তরিত করে শেষ পর্যন্ত মুসলমানীর সঙ্গেই যদি হত বিয়ে, আপত্তি ছিল না; কিন্তু যে যার নিজের নিজের ধর্মে অবিচলিত থাকবে, এ কি মেনে নেওয়া যায়? ছোলতান নামের যে পত্রিকা নজরুলের কারাবাসের এবং অনশনের সময় নজরুলের সমর্থনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল, তারাই এই বিবাহের প্রস্তাব শোনার পর হঠাৎ আবিষ্কার করল, হিন্দু পারিপার্শ্বিকতার যে চাপে নজরুলের 'মোছলমান' বৈশিষ্ট্য এতদিন রুদ্ধশ্বাস নির্জীব হয়ে ছিল তার আর কোনই আশা রইল না!

    আর নজরুল নিজে? সে তো নিজের জন্যে কখনও কিছু ভাবেইনি; যা যা ঘটবার তার জীবনে সেগুলো ঘটেই যায় সে জানে। তার এখন মাঝে মাঝে মনে পড়ে মুজফ্‌ফরের কিছুদিন আগের একটা মন্তব্য। ধর, একটা কাগজে দাগ কেটে পাশাপাশি দু' রঙে দুটো আলাদা ভাগ করলাম, বলেছিল মুজফ্‌ফর, একটা ভাগে ইসলাম আর একটায় হিন্দু ধর্ম। ওই দাগটাই দুটো ধর্মের সীমানা। তুমি কোথায় জান? ঠিক ওই দাগটার মাঝখানে। ডাইনে-বাঁয়ে যেদিকেই যাও তুমি সমান স্বচ্ছন্দ। তুমি হিন্দুও মুসলমানও, তুমি না-মুসলমান না-হিন্দুও। তুমি বাঙালি। বাঙালিই শুধু নও, তুমিই হিন্দু-মুসলমানের সীমানা। মনে রেখ কাজি, এই যে এতটা গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছ তুমি, এর জন্যে কোন প্রাইজ নেই, আছে তিরস্কার। মনে রেখ, কেউ তোমার গুণ গাইবে না এ জন্যে, কিন্তু গালাগালি দিতে ছাড়বে না কেউই। সুযোগ পেলেই অসুবিধেয় ফেলবার চেষ্টা করবে তোমাকে। মুসলমানরাও, হিন্দুরাও! চার মাস আগে তেওতা গ্রামে এক মুহূর্তের নিয়ন্ত্রণ হারানো এক মুহূর্তের অসতর্কতার পর গিরিবালার কাছে কোন মিথ্যে বলার চেষ্টা কাজি করেনি। বলেছিল, আপনাদের অসম্মান আমি হতে দেব না। তিন-চার মাস সময় দিন আমায়।

    তিন মাস হয়ে গেছে, চার মাস চলছে এখন। কাজির সামনে গোটাকয়েক সমস্যা। সে থাকবে কোথায়? বিয়ের পর তো মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে সংসার পাতা চলবে না। তা ছাড়া, বিয়ের আগে কলকাতায় এসে কোথায় থাকবেন গিরিবালা? গিরিবালা আর তাঁর মেয়ে? আর বিয়ে হবেই বা কোথায়? বিয়ের ব্যবস্থা কে করবে? খরচ কত? টাকাপয়সা দেবে কে?

    গিরিবালা কিন্তু ভয় পেলেন না। নজরুলকে তিনি চেনেন ভাল মতই, তার প্রতিভার উপর শ্রদ্ধাই শুধু নয়, মানুষ হিসেবে তার উপর তাঁর অগাধ ভরসা। স্বামীহারা হয়ে দেবরের যে সংসারে তিনি আশ্রয় পেয়েছিলেন কুমিল্লার সেই সংসার ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন তিনি। নজরুল মা নামে ডাকত যে বিরজাসুন্দরীকে – তার গর্ভধারিণী মায়ের চেয়েও কাজির কাছে কম ছিলেন না যিনি – সেই বিরজাসুন্দরী নিজে কলকাতায় এসে সকন্যা গিরিবালাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন। সে চেষ্টাও ব্যর্থ হল।

    এই পরিস্থিতিতে দেখা গেল কাজির আর একজন মা-কে। ইনি মাসুদা খাতুন মুসাম্মাত, অনেকে ডাকে মিসেস রহ্‌মান নামে। বয়েসে নজরুল ইসলামের চেয়ে পনেরো বছরের বড়। নজরুল তাঁর বিশেষ স্নেহের পাত্র, তাঁকে মা ডাকে; বাঙালি মুসলমান সমাজে সেই সময় তিনি নারী আন্দোলনের মুখ। পিতা হুগলির সরকারি উকিল খানবাহাদুর মজাহারুল আনওয়র চৌধুরি, স্বামী শ্রীরামপুর মহকুমার সাব-রেজিস্ট্রার মাহ্‌মুদুর রহ্‌মান। নিয়মিত মাসুদার প্রবন্ধ গল্প উপন্যাস বেরোয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, সওগাত, সাম্যবাদী, ধূমকেতু ইত্যাদি পত্রিকায়। একাই একশো হয়ে পঁচিশে এপ্রিল শুক্কুরবার কলকাতার ছ'নম্বর হাজি লেনে পঁচিশ বছরের নজরুলের সঙ্গে ষোল বছরের দুলি বা আশালতা বা প্রমীলার শুভ বিবাহ সম্পন্ন করালেন মাসুদা খাতুন মুসাম্মাত।

    কাজটা সহজ ছিল না। প্রমীলা তখনও নাবালিকা, স্বধর্মের কোন পাত্রর সঙ্গে অভিভাবকদের সম্মতিক্রমে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিবাহ সম্পন্ন করানো যেতেই পারত, সেই সময়ের হিসেবে তো ষোল বছরের অবিবাহিতা হিন্দু বা মুসলমান কন্যা প্রায় অরক্ষণীয়াই! কিন্তু এই বিয়ের পাত্র তো মুসলমান আর পাত্রী যে হিন্দু (বা ব্রাহ্ম!)! তাতে অসুবিধে কী? পাত্রীর ধর্মান্তকরণেই তো ল্যাঠা চুকে যায়! কিন্তু পাত্র রাজি নয় তাতে। জন্মগত নিজের ধর্ম সে অন্যের উপর চাপিয়ে দেবে কেন? এদিকে সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্টও চলবে না; পাত্রী নাবালিকা, বয়েস আঠের হয়নি!

    কেউ কেউ বলল, এ সমস্যা তো নতুন নয়। এই যে আমাদের দেশে মুঘল সম্রাটরা অনেকেই হিন্দু রাজপুত্রীদের বিবাহ করেছেন ধর্মান্তরিত না করিয়েও, রাজান্তঃপুরে রমরমিয়ে হিন্দু ধর্ম পালনও করেছেন ভক্তিমতী বিবাহিতা পুত্রবতী মহিষীরা, কারও কারও ধর্মাচরণের সুবিধের জন্যে এমনকি মন্দিরও স্থাপন করিয়ে দিয়েছেন মুসলমান মুঘল সম্রাট – এসব তাহলে হত কীভাবে?

    খোঁজ নিয়ে মুসলমান বর এবং অমুসলমান কনের বিবাহ-অনুষ্ঠানের এক লোকায়ত পন্থার কথা জানা গেল। পন্থাটি আহ্‌লুল কিতাব নামে পরিচিত। মুসলমানরা বিশ্বাস করেন খ্রীষ্টিয় এবং য়ুহুদী ধর্মাবলম্বীদের কাছেও ঈশ্বর বা আল্লাহ্‌র কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে; আহ্‌লুল কিতাবের বিশ্বাস অনুযায়ী কনের খ্রীষ্টিয় বা য়ুহুদী বিশ্বাস অটুট রেখেও মুসলমান বর তাকে শুধু যে বিবাহ করতে পারে এমনটাই নয়, নিজে উদ্যোগ নিয়ে কনেকে এই বিয়ের পর সেই কন্যার বিশ্বাস পালনে সাহায্য করতে বর নিজে বাধ্য থাকবে। অর্থাৎ কনের নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী উপাসনালয়ে তাকে পৌঁছিয়ে দেবার এবং উপাসনার শেষে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনবার ব্যবস্থা বরই করবে। এত প্রাচীন সভ্যতার দেশ ভারতবর্ষ যেখানে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে নানা ধর্মাবলম্বীরা বারবার এসে থেকে গিয়েছে, সেখানে কি আল্লাহ্‌র কিতাব
    না-এসে পারে? মুসলমান নবাবরা তাঁদের নিজেদের ধর্মবিশ্বাস অটুট রেখেও হিন্দু মহিষীদের স্বধর্ম পালনে তাই সাহায্যকারীই হয়েছেন, প্রয়োজনে মন্দিরও স্থাপনা করেছেন। অতএব আহ্‌লুল কিতাব মত অনুযায়ী কাজি নজরুল ইসলাম এবং কুমারী আশালতা সেনগুপ্তর শুভ বিবাহ সপন্ন করালেন মাসুদা খাতুন মুসাম্মাত, পৌরোহিত্য করলেন মঈনুদ্দিন হোসায়ন, উকিল আবদুস সালাম আর সাক্ষী খান মঈনুদ্দিন আর মোহাম্মদ আলি।

    হুগলি জেলে বন্দী থাকবার সময় হুগলির অনেক ছেলের সঙ্গে প্রায় বন্ধুত্বই হয়ে গিয়েছিল কাজির। তাদের কেউ কেউ কংগ্রেস-কর্মী, বিপ্লবী কোন সংগঠনে যুক্ত কেউ, কেউ-বা শুধুই তরলমতি তরুণ, স্কুল-কলেজে পড়ে অথবা এমনকি তা-ও নয়। এরাই ছিল কলকাতার সঙ্গে, আবদুল হালীম পবিত্র বা নলিনীদার সঙ্গে, কাজির যোগাযোগের সেতু। অনশনের সময় অনশনকারীদের প্রাত্যহিক স্বাস্থ্য-বুলেটিন কলকাতার পত্রপত্রিকায় পৌঁছত এদেরই উদ্যোগে। কাজিকে পাওয়া যাবে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে – এই খবর পেয়ে এরাই কাজির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে এখন। কাজি যদি হুগলিতে থাকতে রাজি হয়, একটা কেন দশটা ভাড়া বাড়ি জোগাড় করে দেবে এরা।

    তা তো দেবে, কিন্তু সংসার চলবে কীভাবে? নিয়ম করে টাকা দিত প্রবাসী, যে-কোন একটা লেখা ছাপলেই কিছু অর্থপ্রাপ্তি। এখন তো সে-রাস্তাও বন্ধ। মুজফ্‌ফর থাকলে নির্ঘাত ব্যবস্থা করত একটা কিছু, এত লোককে চেনে সে। কিন্তু সে-ও তো জেল-এ। অতএব সে-কথা ভাববার সময় এখন নয়। তা ছাড়া, ভবিষ্যৎ কীভাবে চলবে সে-কথা কাজি ভেবেছেই বা কবে!

    অবস্থা যখন এরকম, নিজে থেকেই তখন সাড়া দিলেন এমন একজন মানুষ যাঁর কথা কাজি ভাবেইনি। শিশির ভাদুড়ি। বসন্তলীলা নাটক প্রযোজনা করে, তাতে অভিনয় করে, উনিশশো টাকা সংগ্রহ করে কাজিকে দিলেন তিনি। এপ্রিলের গোড়ায় অ্যালফ্রেড থিয়েটারে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, নির্মলচন্দ্র চন্দ্র, প্রফুল্ল সরকারদের উদ্যোগে নজরুলকে সম্বর্ধনা দেওয়া হল। সঙ্গে অনেক উপহার। সেগুলোও কাজে লাগবে সংসার পাততে হলে।

    বিয়ের পর কয়েকদিন প্রমীলা-আশালতা-দুলি আর তার মা গিরিবালাকে নিয়ে বৌবাজারে বিজলী পত্রিকার অফিসে থাকার ব্যবস্থা হল কাজির। তারপর হুগলি। কংগ্রেস কর্মী খগেন ঘোষের কাঠঘড়ার বাড়িতে কিছুদিন কাটিয়ে অবশেষে মোগলপুরায় হামিদুল নবী মোক্তারের বাড়িতে। হগলি তো প্রায় কলকাতাই। শুধু হুগলির বন্ধুরা নয়, কলকাতার বন্ধুদেরও যাতায়াতে বাড়ি এবং আড্ডা সকাল-সন্ধ্যে ভরপুর। এখান থেকেই প্রকাশিত হল বিষের বাঁশী আর ভাঙার গান। আগস্টে। প্রকাশ আর বাজেয়াপ্ত দুটোই। মাঝে সময়ের ব্যবধান নেই বললেই চলে। আর সেই সময়েই জন্মাষ্টমীর দিন জন্ম হল নজরুল-প্রমীলার প্রথম সন্তানের। পুত্র। যেমনটা কাজির পক্ষেই স্বাভাবিক, সে জন্মাষ্টমীতে ভূমিষ্ঠ পুত্রর নাম রাখল কৃষ্ণ, কৃষ্ণমহম্মদ। তার আকীকাও অনুষ্ঠিত হল ঘটা করে। কলকাতা থেকে কাজির বন্ধুরা প্রায় সবাই এল, এল হুগলির বন্ধুরাও – তারাই তো হোস্ট! আজাদ কামাল, পোশাকী এই নামের দুর্বল শিশুটি বেশিদিন বাঁচেনি, কাজির বন্ধু ভূতপূর্ব মেডিকাল ছাত্র প্রেমেনও এই আশঙ্কাই করেছিল!

    অর্থাৎ বিবাহোত্তর উনিশশো চব্বিশ কাজির পক্ষে উষ্ণপ্রেমের মধুচন্দ্রিমায় ভরাট সুখবর্ষ নয়; অর্থাভাব – সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থদ্বয় বাজেয়াপ্ত – পুত্রশোক এবং সময় বুঝে ঠিক এই সময়টাতেই ছিদ্রান্বেষী সজনীকান্ত দাসের শনিবারের চিঠির লাগাতার কর্দমক্ষেপ অভিযান!

    যদিও কাজি এতে কতটা বিচলিত বোঝা যায় না। সে হুগলির বাসিন্দা এখন, এখানকার কংগ্রেসকর্মী বা বিপ্লবী, সবাই তার বন্ধু, সবাই সহযোদ্ধা। ঘরে হাঁড়ি চড়ুক-না-চড়ুক, চাঁদনী ঘাটে গান্ধী এলে সে তাঁকে চরকার গান শোনাতে পৌঁছিয়ে যায়, চন্দননগরের বিপ্লবী যুবকরা ভাটপাড়ায় কবাডি প্রতিযোগিতায় খেলতে গেলে সে সভাপতির আসন থেকে উঠে এসে চন্দননগরের দলে লেগে যায় খেলতে। এমন সময় বাংলাদেশের কাশী নামে পরিচিত তারকেশ্বরের মোহন্তদের কদাচারকে কেন্দ্র করে যে তুমুল আন্দোলন ক্রমে ক্রমে গড়ে ওঠে, সেখানে প্রায় নেতার ভূমিকায় দেখা যায় তাকে।

    ব্যাপারটা শুরু হল ব্যারিস্টার-সন্ন্যাসী শ্রমিক-নেতা স্বামী বিশ্বানন্দের উদ্যোগে। তারকেশ্বর মন্দিরের মোহন্ত তখন সতীশগিরি। মন্দিরের প্রাত্যহিক প্রণামী এবং আনুসঙ্গিক আয় ছাড়াও নিয়মিত লাখ দেড়েক টাকার কুসীদজাত অর্থাগমে মন্দির পরিচালকদের অনৈতিক ক্রিয়াকর্মের নানা সুযোগ। 'বাবার থানে হত্যা'-দেওয়া অসহায় নারীমাংস এবং তরল-কঠিন-বায়বীয় নানা মাদকের ছড়াছড়ি। অথচ প্রতিবাদ দূরে থাক, অসহায় ধর্মভীরু তীর্থযাত্রী সব জেনেশুনেও পাপের কবলমুক্ত হতে পারে না। এই কি তাহলে বিধাতাপ্রদত্ত শাস্তি?

    কদাচারের বিবরণ শুধু লোকমুখেই নয়, নানা যাত্রাপালায়, নাট্যমঞ্চে ততদিনে বহুশ্রুত, বহুআলোচিত। খবর শুনে আসানসোলের শ্রমিক নেতা স্বামী বিশ্বানন্দ চক্ষুকর্ণের সম্মিলিত সাক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রতিবাদ করায় মন্দির কর্তৃপক্ষের পোষা লাঠিয়ালদের হাতে প্রবল প্রহৃত হন। খবর পেয়ে যুগান্তর দলের সভ্য সশস্ত্র বিপ্লবী শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ধরানাথ ভট্টাচার্যও মোহন্তবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সেই সময় বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নেতৃত্বে কংগ্রেস-অন্তর্গত স্বরাজ্য দল। তাঁর কাছে খবর পৌঁছলে দেশবন্ধু বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির মাধ্যমে একটা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির সভ্য হলেন অন্যদের সঙ্গে দেশবন্ধু নিজে এবং সুভাষচন্দ্র বসুও। পণ্ডিত ধরানাথ ভট্টাচার্যের উদ্যোগে মন্দির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয় কাজি নজরুল ইসলামকে। 'মোহ-অন্তের গান' – এই নামে নজরুল একটা গান লিখে তাতে সুরসংযোগ করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুধু হুগলির গ্রাম-শহরেই নয়, প্রায় সারা বাংলা দেশে ছড়িয়ে দেয়। একটা নতুন মাত্রা পায় আন্দোলন।

    অনুসন্ধান কমিটি খবর পায়, টাকা এবং প্রতিপত্তির জোর ছাড়াও মন্দির কর্তৃপক্ষের মস্ত একটা জোর দৈহিক শক্তি। সহস্রাধিক লাঠিয়ালের শাসনে কর্তৃপক্ষ এবং মন্দির সুরক্ষিত। লাঠিয়ালদের নেতৃত্ব দেয় সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এক মহাশক্তিধর বেপরোয়া পালোয়ান। প্রয়োজন অনুভব করলেই লাঠির ঘায়ে এক-আধটা খুন-জখম এদের কাছে জলভাত। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এই লাঠিশক্তির মোকাবিলা করবে সত্যাগ্রহ। স্থির হয় বাংলা তেরশো একত্রিশের সাতাশে জ্যৈষ্ঠ সত্যাগ্রহ উদ্বোধন করবেন বাংলার জনপ্রিয় নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন। সঙ্গে থাকবেন সুভাষচন্দ্র বসু,
    ডঃ জে-এম-সেনগুপ্ত, পণ্ডিত ধরানাথ ভট্টাচার্য, আকরম খান ইত্যাদি।

    বৈশাখ মাসের ভারতীতে নজরুল ইসলাম লিখল বিদ্রোহী বাণী নামে এক কবিতা। লোকের মুখে মুখে এই কবিতা প্রচার হয়ে এমন আবেগের সৃষ্টি করল যে সত্যাগ্রহের উদ্বোধনের দিন মাঠে আর লোক ধরে না:


                                                    দোহাই তোদের! এবার তোরা সত্যি করে সত্য বল!
                                                    ঢের দেখালি ঢাকঢাকঢাক গুড়গুড় ঢের মিথ্যা ছল।
                                                    এবার তোরা সত্য বল।
                                                    পেটে এক আর মুখে আরেক – এই যে তোদের ভণ্ডামি
                                                    এতেই তোরা লোক হাসালি, বিশ্বে হলি কম-দামি।
                                                    নিজের কাছেও ক্ষুদ্র হলি আপন ফাঁসির আফশোসে
                                                    বাইরে ফাঁকা পাঁইতারা তাই, নাই তলোয়ার খাপ-কোষে।
                                                    তাই হলি সব সেরেফ আজ
                                                    কাপুরুষ আর ফেরেববাজ,
                                                    সত্য কথা বলতে ডরাস, তোরা আবার করবি কাজ
                                                    ফোপরা ঢেঁকির নেইকো লাজ।
                                                    ইলশেগুঁড়ির বৃষ্টি দেখেই ঘর ছুটিস সব রামছাগল
                                                    যুক্তি তোদের খুব বুঝেছি দুধকে দুধ আর জলকে জল।
                                                    এবার তোরা সত্য বল।
                                                    … … … …
                                                   
                                                    নরম গরম পচে গেছে, আমরা নবীন চরম দল!
                                                    ডুবেছি না ডুবতে আছি, স্বর্গ কিংবা পাতাল-তল।


    আন্দোলনের উদ্বোধনের দিন সকাল থেকেই মন্দির-সংলগ্ন বিশাল মাঠে জনসমাগম। আর সেই সমাগমকে ঘিরে আছে সত্য ও তার দলবল। কর্তৃপক্ষের সঙ্কেত পেলেই শুরু হবে নিধনযজ্ঞ। নির্দিষ্ট সময়ে কাজির দিকে তাকিয়ে দেশবন্ধু বললেন, সত্যাগ্রহ শুরু হোক কাজির উদ্বোধন সঙ্গীত দিয়ে। দৃপ্ত কণ্ঠে কাজি গান ধরে:


                                                    জাগো আজ দণ্ড হাতে চণ্ড বঙ্গবাসী
                                                    ডুবাল পাপ-চণ্ডাল
                                                    তোদের বাংলাদেশের কাশী।।
                                                    তোরা হত্যা দিতিস যাঁর থানে আজ সেই দেবতাই কেঁদে
                                                    ওরে তোদের দ্বারেই হত্যা দিয়ে মাগেন সহায় আপনি আসি।
                                                    জাগো বঙ্গবাসী।।


    লাঠিয়ালরা প্রস্তুত। সঙ্কেতমাত্র ঝাঁপিয়ে পড়বে। মন্দিরের পাশেই এই গান! এ কি ভাবা যায়! এই মঞ্চেরই এক কোণে দাঁড়িয়ে সত্য নিজে, নীরব। অনেকগুলো চোখ তার দিকে। গান শেষ হলে সে বলে, কাজি, আর একবার গাও। দ্বিগুণ উৎসাহে কাজি গেয়ে চলে:


                                                    মোহের যার নাই কো অন্ত
                                                    পূজারি সেই মোহান্ত
                                                    মা-বোনে সর্বস্বান্ত করছে বেদী-মূলে।
                                                    ওদের পূজার প্রসাদ বলে খাওয়ায় পাপ-পুঁজ সে গুলে।
                                                    তোরা তীর্থে গিয়ে দেখে আসিস পাপ-ব্যাভিচার রাশি রাশি
                                                    জাগো বঙ্গবাসী।।
                                                    পুণ্যের ব্যবসাদারি
                                                    চালায় সব এই ব্যাপারি,
                                                    জমাচ্ছে হাঁড়ি হাঁড়ি টাকার কাঁড়ি ঘরে।
                                                    হায় ছাই মেখে যে ভিখারি শিব বেড়ান ভিক্ষা করে।
                                                    ওরে তাঁর পূজারী দিনে দিনে ফুলে হচ্ছে খোদার খাসি।
                                                    জাগো বঙ্গবাসী।।


    গান শেষ হলে মঞ্চের এক কোণ থেকে অন্য কোণে ধীর পায়ে হেঁটে সত্য নিজের হাতের লাঠি কাজি আর দেশবন্ধুর পায়ের তলায় রেখে শপথ নিল মোহন্তের সর্বনাশের। সেদিন সত্যাগ্রহে অংশ নিল সে নিজে আর শয়ে শয়ে তার অনুবর্তীরাও। শেষ পর্যন্ত সতীশগিরির বিরুদ্ধে মামলায় তার অধিকার কেড়ে নিয়ে আদালত এক জন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে তারকেশ্বর মন্দিরের পরিচালনার ক্ষমতা তুলে দেয়। কিন্তু তবুও, একদল মৌলবাদী গোঁড়া হিন্দুর বীতরাগ হয়তো চিরদিনের জন্যেই অঙ্গভূষণ হয়ে ওঠে কাজি নজরুলের।

    তারকেশ্বরের লড়াইয়ের এই সাফল্যের পর আরও অনেক বেশি বেশি নজরুলের ডাক আসতে থাকে নানা রাজনৈতিক ক্রিয়া-কর্মে, স্বরাজ্য দলের সে যেন এক সদস্যই! অসহযোগ আন্দোলনের সময় যুবরাজ যখন কলকাতায় আসেন, ধর্মঘটের অস্বস্তি এড়াতে তখন বন্দী দেশবন্ধুকে কারামুক্ত করে গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন দেশবন্ধু। তারই প্রতিশোধ নিল সরকার উনিশশো চব্বিশে যখন ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে স্বরাজ্য দল প্রায় একচ্ছত্র জয়লাভ করল। বেঙ্গল অর্ডিনান্স প্রবর্তন করে শয়ে শয়ে কংগ্রেস-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হল। কিন্তু পরোয়া কী! কাজি নজরুল ইসলাম তো একাই একশো! সংসারের অবস্থা যদিও বদলায় না তার একটুও, তবুও কাজি যেন নিশ্চিন্তে প্রাক্‌-বিবাহ দিনগুলোর মতো মনের খুশিতে প্রাণের আবেগে দূরকে নিকট পরকে ভাই-সম আচরণে কখন যে বাইরে থাকে আর কখন ঘরে ঠিক থাকে না তার।

    পুজোর কয়েকদিন আগে, তখনও বেশ প্যাচপেচে গরম, কাজি বেরিয়েছিল সকালে। ঘেমে-নেয়ে ক্লান্ত কাজি মোগলপুরার বাড়িতে ফিরেছে শ্রান্ত-ক্ষুধার্ত হয়ে। বাড়ি এসেই ঢক ঢক করে এক ঘটি জল খেল সে। নিজের খিদের কথা আজকাল চট করে বলে না কাজি, বাড়িতে খাবার-দাবার আছে কিনা, অন্যদের খাওয়া হয়েছে কিনা, এসব জিজ্ঞেস করার সাহস তার নেই। তার জল খাওয়া শেষ হতেই দুলি বলে, খেতে দেব? এখন খাবে তো?

    দেবে? কী দেবে? – জিজ্ঞেস করে কাজি।

    কেন, তুমি যে জোড়া ইলিশ পাঠিয়েছ প্রাণতোষদাকে দিয়ে সকাল বেলায়, তা-ই তো রান্না করল মা। কী ভালো মাছ, মাছের তেলেই যেন মাছ রান্না হয়। কিন্তু এই অবেলায় বেশি খেও না; মাছ ভাজা দিই আর একটু তেল; আর তারপর পাতলা করে ঝোল রেঁধেছে মা কালোজিরে আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে। ভাতের সঙ্গে দিই একটু?

    খানিকটা অবাক হয় কাজি, তারপর সামলে নেয়, কখন এল প্রাণতোষ?

    সকালেই তো, বলে দুলি। বলল, চন্দননগরের ঘাটে নাকি ধরা পড়েছে। মাছ দেখে তুমি কিনলে এক জোড়া; ওকে বললে, মাছ দুটো বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিবি রে? কত বুদ্ধি প্রাণতোষদার, শুধু মাছ আনবে? এক থলে তরি-তরকারি কিনেছে, চাল কিনেছে, সর্ষের তেলও। বেশ ভাবনা-চিন্তা করে, বল? বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত এমন ছেলের, তাই না?

    হেসে ফেলে কাজি, বলে, ওকে বলব সে-কথা। বলব, তুমি কনে দেখছ ওর জন্যে।

    কাজি খেতে বসে, নিকোনো মেঝেতে বসে খায় ও, সামনে বসে থাকে দুলি। খাওয়া হয়ে গেলে বাইরে কুয়োতলা থেকে আঁচিয়ে আসে সে, ততক্ষণে দুলি নিজের খাবার বেড়ে এনে খেতে বসেছে। একটু দূরে একটা চেয়ারে বসে দুলির খাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কাজি; দুলির মুখ থেকে, দুলির সমস্ত অবয়ব থেকে, খুশির আনন্দ যেন উপচে পড়ছে! কাজি ভাবে, এইটুকু, এইটুকুই শুধু! খেতে দেওয়া আর খাওয়া, এতে যে-সুখ সেটুকুও দিতে পারেনি ও দুলিকে বিয়ের পর। দুলির দিকে তাকিয়ে চোখে জল আসে তার, বাচ্চাটা হতে গিয়ে ধকল গেছে খুব, বড্ড রোগা হয়ে গেছে দুলি, এখন ওর ভালোমন্দ খাওয়া দরকার জেনেও কিছু করতে পারে না সে। কলকাতার বন্ধুরা আসে তার, কেউ কেউ এলেই সঙ্গে আনে খাবার-দাবার, ফল-পাকুড়; হুগলির ছেলেরা বাজার করে দিয়ে যায় তাতেই সংসার চলে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে কাজি, বিয়ের আগে ও কি ভেবেছিল অবস্থাটা একেবারে এরকম হয়ে যাবে! আগস্টেই বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল বিষের বাঁশী আর ভাঙার গান, কত আশা করেছিল এই বই দুটো বিক্রি হলে টাকা-পয়সা পাবে! নিজেকেই ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে; এত কিছু জানে, এত কিছু শিখেছে, শুধু শেখেনি একটাই কাজ! 'কিসে কড়ি আসে দুটো!'

    পরদিন প্রাণতোষ বলে, তোমার টাকাতেই তো ইলিশ কিনলুম কাজিদা। সেই যে পুলিশ এসেছিল বাজেয়াপ্ত ভাঙার গান আর বিষের বাঁশী নিয়ে যেতে, ক'খানা পেয়েছিল মনে আছে? সব তো আগে-ভাগেই সরিয়ে রেখেছিলুম আমরা। এখন সেগুলো বিক্কিরি করেই তো তোমার বাজার করি। আর, মনে রাখবে, আমাদের তো দোকান নেই, বই বিক্কিরির ব্যবসা তো নেই আমাদের, আমাদের কাছে খদ্দের আসে অনেক খোঁজখবর করে, অনেক তৈরি হয়ে। বুঝলে তো, শুধুই তেলেভাজা বিক্কিরি করি না আমরা, আমরা বেচি হাতে-গরম তেলেভাজা; নিষিদ্ধ মাল, দাম দুনো!

    এবারে ফরিদপুরের প্রাদেশিক সম্মেলনে কাজিরও ডাক পড়ল। সম্মেলনে গান্ধীজি এসেছেন, এসেছেন দেশবন্ধুও। কারাবন্দী সুভাষ – যিনি নজরুলকে “জ্যান্ত মানুষ” উপাধি দিয়েছেন – বন্দীদশাজনিত তাঁর অনুপস্থিতিতে নজরুলকে বিশেষভাবে নিমন্ত্রণ করেছেন তাঁরই বন্ধু হেমন্তকুমার সরকার। সম্মেলনে এবং সম্মেলনের বাইরেও অনেক গান গেয়ে ফরিদপুরবাসীকে মাতিয়ে রাখল কাজি। এবং, বিস্মিত আনন্দে প্রাণতোষের কথার সত্যতাও উপভোগ করল সে – নিষিদ্ধ দুই কাব্যগ্রন্থ, বিষের বাঁশী আর ভাঙার গান বিক্কিরি হচ্ছে দেদার! কিন্তু কাজি নজরুল কি পাবে তার গ্রন্থস্বত্বের অংশ? মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়ায় কাজি, কিছুদিন আগেই সে তার নতুন গল্পসংগ্রহ রিক্তের বেদন প্রকাশের চুক্তিপত্র সই করেছে ওরিয়েন্টাল প্রিন্টার্স অ্যাণ্ড পাবলিশার্সের মোহম্মদ মোজাম্মেল হকের সঙ্গে। বিক্রি অনুযায়ী অর্থপ্রাপ্তির শর্তে নয়, একেবারে কপিরাইটের নিঃশর্ত এককালীন বিক্কিরি! একশো-দেড়শো যা-ই হোক, টাকাটা একেবারেই পাওয়া যাবে তো!

    সারাজীবনের আর্থিক দৈন্য মেনে নিতে হয়েছে কাজিকে। তার মানে কি এই যে, কাজির রচনা পড়েনি মানুষ? অথবা, পড়লেও অর্থমূল্যে কেনেনি তার গ্রন্থাদি?

    আসলে, কাজি জন্ম-সন্ন্যাসী। ভবিষ্যত তো আল্লাহ্‌ দেখবেন, এ-ই কাজির ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। আমার এখন একশো টাকা বড় দরকার; যা বেচলে, যেভাবে বেচলে, আপাতত একশো টাকা পাব আমি, তা-ই আমার ঢের। তাই, কাজির গ্রন্থাদি বিপণনে অর্থপ্রাপ্তি ঘটেছে বহু মানুষের, রীতিমতো প্রাপ্তি। অনবরত হাতবদল হয়েছে তার গ্রন্থের স্বত্ব। রিক্তের বেদনও ওরিয়েন্টাল থেকে হাতবদল হয়ে পৌচেছে ডি-এম-লাইব্রেরিতে! কাজির এক-একখানা বই বড়লোক করল কতজনকে!

    কাজির পকেট সেই শূন্যই!



    ক্রমশ...

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৬ মে ২০২৩ | ২২৩৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন