বিকেলে হেমপ্রভা-বসন্তর বাড়িতে আবার আসে বীরেন। হেমপ্রভাকে বহু কষ্টে বুঝিয়ে-বাজিয়ে শেষ পর্যন্ত নজরুলকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসতে পারে সে। হেমপ্রভা বলছিলেন, ছেলেটা প্রথম আলাপেই মা বলে ডেকেছিল আমায়, আমার তো নিজেরও দু্টোই মেয়ে, আন্দোলনও করি মেয়েদের নিয়েই। ভেবেছিলাম ফাউ একটা ছেলে পাওয়া গেল, সে-ও যদি তোমার না সয়...
এ-টুকুই বলেছিলেন বীরেনকে, এ-টুকুই। পাশের বাড়ির ছেলে বীরেন – ছেলেবেলা থেকেই দেখছেন ওকে, ভারি ভদ্র, কাকিমা বলে ডাকে ওঁকে – কথাটা শুনে একেবারে কুঁকড়ে গেল। বলল, আমি বুঝিনি কাকিমা। আমি ভাবলুম, মুসলমানের ছেলে, আলাদা করে কী ব্যবস্থা করবেন আপনি, হয়তো অসুবিধে হবে। এবারটা তো আমি একাই এসেছি, কমলিনী কলকাতাতেই থেকে গেল, ভাবলুম আমার ঘরে একসঙ্গেই শুতে পারবে, তাই। আর তাছাড়া, কতক্ষণ আর ঘরে থাকবে ও! আজ একদিনেই কুমিল্লায় যে পরিচিতিটা হয়ে গেল ওর, ও তো বাইরে-বাইরেই কাটাবে সারাদিন। আপনাদের বসবার ঘরটা তো আমাদের বাড়িরটার মতো ছোট নয়, আমি ভেবে রেখেছি গানবাজনা হলে আপনার বাড়িতেই হবে। কিন্তু আপনি যদি চান, তাহলে আপনার কাছেই থাকল না হয়।
হেসে ফেলেন হেমপ্রভা, না না, তুমি ঠিকই বলেছ। ছোটবেলা থেকেই তো দেখছি তোমাকে, না ভেবেচিন্তে কথা বলবার ছেলে তুমি নও। আর বেড়াতে তো আসেনি, এসেছে স্বরাজের জন্যে লড়বে বলে। বাড়িতে তো বসে থাকবে না, এই ঢুকবে, এই বেরোবে; আর আমরা দুজনেও তো বাড়িতে বসে থাকার লোক নই, আমার মেয়েদুটো হয়তো বুঝতেই পারবে না কখন কী কথা বলা দরকার। আর তাছাড়া, কথা বলার জন্যে আর আড্ডা দেবার জন্যে নিজের কাছাকাছি বয়েসের কেউ থাকলেই সুবিধে। কাজেই সব কিছু মিলিয়ে ভাবলে তোমাদের বাড়িতে থাকাটাই ভালো। তবে ওই। ওই যে গানবাজনার আসরের কথাটা বললে, সেটা মনে রেখ। সেটা কিন্তু আমাদের বাড়িতে হওয়াই ভালো। আর তা ছাড়া, আর একটা কথা। খুব তৃপ্তি করে খেয়েছে এই দু'দিন। আমি কিন্তু মাঝে মাঝে খাওয়াব ওকে।
ওকে? মানে, শুধু ওকে!? আপনার পিঠে-পায়েসের থেকে আমাকে বাদ দেবেন নাকি?
দেওয়াই উচিত, তবে এবারটা কাজির খাতিরে সেটা না হয় ভেবে দেখা যাবে।
বীরেনের বাবা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত কুমিল্লায় কোর্ট অব ওয়ার্ডস-এর ইনস্পেক্টর। ওঁদের পৈতৃক বাড়ি মাণিকগঞ্জে, তেওতা গ্রামে। অনেক দিন কুমিল্লায় আছেন। ছেলে বীরেন তার স্ত্রী কমলিনী আর শিশুপুত্র রাখালকে নিয়ে এখন কলকাতাতেই থাকে, কলকাতাই বীরেনের কর্মস্থল এখন। বাড়িতে ইন্দ্রকুমারের স্ত্রী বিরজাসুন্দরী আর দুই কন্যা। এক, কমলা, বাচ্চু যার আটপৌরে নাম, আর পুচকে অঞ্জলি। অঞ্জলি অবিশ্যি জটু নামেই বেশি পরিচিত। আর থাকেন তাঁর বিধবা বৌদি তের বছরের মেয়ে আশালতাকে নিয়ে। আশালতার ডাক নাম দোলন, তাকে দুলু বা দুলি নামেও ডাকা হয়। এ বাড়িতে সাহিত্য সঙ্গীত আর রাজনীতিতে সবায়েরই আগ্রহ। অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে সরকারি ফয়জুন্নিসা গার্লস হাই স্কুল ছেড়ে দিয়েছে এমনকি কমলা আর দুলিও।
নজরুলকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে মা মা বলে জোরে ডাকতে শুরু করে বীরেন। বিরজাসুন্দরী বেরিয়ে আসেন, তাঁর পিছন পিছন তাঁর বিধবা জা গিরিবালা। এই যে মা, নজরুল। ওকে কিন্তু কাজি বলে ডাকতে হবে। বলা শেষ করার আগেই নজরুল পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বিরজাসুন্দরী আর গিরিবালার। গিরিবালার সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেয় বীরেন, আমার জ্যাঠাইমা। এরপর প্রায় লাইন করে আসে জটু, তারপর বাচ্চু আর দুলু। সবশেষে ইন্দ্রকুমার।
প্রণাম-পরিচয়ের পর্ব শেষ হতে-না-হতে বীরেন বলে ওঠে, তাহলে?
তাহলে, তাহলে কী? – কেউ কিছু বলার আগেই জটুর দিকে চেয়ে হেসে বলে নজরুল, তাহলে, আমাদের যাত্রা হল শুরু? গেয়েও ওঠে সে, এখন বাতাস ছুটুক, তুফান উঠুক, ফিরব না গো আর–/ তোমারে করি নমস্কার।/ আমাদের যাত্রা হল শুরু এখন ওগো কর্ণধার।/ তোমারে করি নমস্কার।
এ মা ভুল ভুল, এত বড় ছেলে, জানে না, চিৎকার করে ওঠে জটু, আমাদের যাত্রা হল শুরু দিয়ে শুরু করতে হবে তো, তোমারে করি নমস্কার তো তার পরের লাইন!
জটুকে দু-হাত দিয়ে শূন্যে তুলে ধরে নজরুল, ঠিক বলেছ, এক্কেবারে ঠিক, আজ থেকে তোমার কাছেই গান শিখব আমরা সবাই।
সবাই হাততালি দিয়ে ওঠে, হা হা করে হেসে ওঠেন ইন্দ্রকুমার, ঘাবড়িয়ে-যাওয়া মুখ করে জটু তাকায় এদিক-ওদিক, এমন সময় দু'হাত তুলে সবাইকে থামায় নজরুল। নিস্তব্ধ ঘরে হঠাৎ গলাটা খাদে নামিয়ে কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণের উচ্চতায় বলে ওঠে নজরুল, এত হাসি কেন জনগণ, কহিলাম যাত্রা হবে শুরু আমাদের...
মনে হল সকলেই একটু সময় নিচ্ছে ধাতস্থ হতে, ততক্ষণে বীরেনকে সম্বোধন করে নজরুল, হে বীরেন্দ্র, জান না কি যাত্রার ভাষা, করনি কি কোনদিন যাত্রার ঢঙে উচ্চারণ?
একটু ঢোক গিলে বীরেন উত্তর দেয়, যাত্রার ঢঙে উচ্চারণ? সে তো আমি বহুবার করিয়াছি মহারাজ শৈশবের কালে। কিন্তু বহু পুরানো সে কথা।
এবার সামনে দাঁড়ানো জটু-বাচ্চু-দুলির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলতে থাকে সে, আজিকার এই সব অপোগণ্ড বালিকার দল, কিছুমাত্র বুঝিবে কি যাত্রাপালা কিংবা লেটোগান?
জবাব দেয় দুলি, বুঝিব না এই কথা বলে যারা তাহারা শুনুক, অপোগণ্ড বালিকারা নয়, শৈশবের ছন্দোবদ্ধ যাত্রাগান ভুলিয়াছে যারা, অকালবৃদ্ধ সেই শিক্ষকমশায়, অপোগণ্ড তাহাদেরই কয়।
হা হা করে হাসতে হাসতে হাততালি দিতে দিতে বলতে থাকেন ইন্দ্রকুমার, একেবারে মুখের মতো জবাব।
সমবেত হাসি-হুল্লোড়ের মধ্যে মায়ের কোমর জড়িয়ে মুখ গুঁজে দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে জটু।
নজরুল হাসতে হাসতে আবার তুলে ধরে জটুকে, আর রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরেই গেয়ে ওঠে:
কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলে গো শুকনো মায়ের শাড়ি।
কে জানিত আসবে কাজিদাদা আমাদের এই বাড়ি,
সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চু আর দুলুও গাইতে থাকে রবীন্দ্রনাথের আসল গানখানাই,
তুমিপার হয়ে এসেছ মরু, নাই যে সেথায় ছায়াতরু –
পথের দুঃখ দিলেম তোমায় এমন ভাগ্যহত।
পুরো গানটাই গাওয়া হয়, বাড়ির সবাই গলা মেলায়, চোখ দিয়ে জল ঝরতে ঝরতে জটুর মুখেও ফুটে ওঠে হাসি।
পাড়ার ছেলেরা আসতে শুরু করে পরের দিন সকাল থেকেই। নজরুলের গানের মিছিল তাকে একদিনেই কুমিল্লা শহরে বিখ্যাত করে দিয়েছে। যারা সেদিন নজরুলের সঙ্গে গলা আর পা মিলিয়েছিল তারা তো আছেই, কিন্তু যারা ঠিক সেই সময়টায় ছিল না কাছাকাছি, খবর পেয়ে তারাও হাজির। সকলের অনুরোধে নজরুলকে বারবার গান শোনাতে হয়। শুধু তাই নয়, প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন রাস্তায় রাস্তায় শহরের ছেলেমেয়েদের নিয়ে দেশাত্মবোধক গানের মিছিল বের করবার পরিকল্পনাও হয়।
বিকেলে আসেন অতীন্দ্র রায়চৌধুরি। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তকে তিনি কাকাবাবু বলে ডাকেন, এবং বীরেন্দ্রকে বীরেনদা। এর মধ্যে বিরজাসুন্দরী হয়ে গেছেন নজরুলের মা আর গিরিবালা মাসিমা। সবাইকে নিয়ে আড্ডায় বসেন অতীন্দ্র। বলেন, প্রথম আলাপেই কাজি আমায় দাদা ডেকেছে, আর আমি ওকে ভাই। এখন দাদা হিসেবেই বলি। দরিরামপুরের বিপিনবাবু স্যর ওকে নিয়ে এসেছেন কুমিল্লায় স্বাধীনতার লড়াইয়ে লড়বার জন্যে। এই যে লড়াই, এ লড়াইয়ের যুদ্ধক্ষেত্র এখন চাঁদপুর আর গোয়ালন্দ। ওখানে স্টীমার আর বন্দর ধর্মঘটকে সফল করাই এখন এখানকার স্বাধীনতার লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় কাজ। দিনের পর দিন শ্রমিকরা ওখানে বসে আছে, ওদের মালিকদের আর সরকারের নানারকমের ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করছে ওরা। আমরা কেউ-না-কেউ প্রত্যেক দিনই ওখানে হাজির থাকি ওদের মনোবল বাড়াবার জন্যে। আমি চাই, কাজিও ওখানে আসুক। ওর গান, কবিতা আবৃত্তি আর বক্তৃতা শ্রমিকদের সাহস যোগাবে।
গান বা কবিতার আবৃত্তি ঠিক আছে দাদা, কিন্তু ওই বক্তৃতাটা বাদ দিতে হবে, বলে নজরুল, মুখোমুখি এক-আধজনের সঙ্গে কথা বলতে রাজি আছি, কিন্তু বক্তৃতা দেওয়াটা একেবারেই পেশাদার রাজনীতিকের কাজ।
বিপিনবাবু স্যর যা বললেন তাতে তো বুঝলাম তুমি দৈনিক নবযুগের কাজ ছেড়ে বিপ্লবী কাজের সন্ধানে দরিরামপুর হয়ে আমাদের এই কুমিল্লায় পৌঁছিয়েছ। আর, এখানেই পেয়ে গেছ তুমি মনের মতো কাজ। পেশাদার রাজনীতিক আর কাকে বলে! তুমি তো সর্বক্ষণেরই রাজনৈতিক কর্মী এখন।
এক মুহূর্তের জন্যে নজরুলের মুখে কেমন একটা অসহায়তা ফুটে ওঠে যেন। তারপরেই হেসে বলে সে, কবে যাওয়া হবে চাঁদপুর? গোয়ালন্দ?
পরের দিন সকালেই হাজির অতীন্দ্র, চল, চাঁদপুর যাব আজ। এই শুরু। তারপর রোজই কোথাও না কোথাও যাওয়া, গান গাওয়া, কবিতা আবৃত্তি, এইসব। এরই মধ্যে একদিন অতীন্দ্র ওকে নিয়ে গেলেন সবিতা আশ্রম নামে একটা জায়গায়। আশ্রম, কিন্তু কোন ঠাকুর-দেবতার মন্দির বা গুরুর দেখা পাওয়া গেল না সেখানে। অতীন্দ্র জিজ্ঞেস করেন নজরুলকে, মহেশ ভট্টাচার্যর নাম শুনেছ?
একজন মহেশ ভট্টাচার্যর নাম শুনেছি, বলে নজরুল, হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ব্যবসা আছে যাঁর। কিন্তু কেন?
সেই মহেশ ভট্টাচার্যই জমি দিয়েছেন এই আশ্রমের জন্যে, দু'শো একরেরও বেশি জমি। ব্রাহ্মণবেড়িয়ায় জন্ম তাঁর, সারা দেশের জন্যেই যতটা পারেন, করেন, কিন্তু নিজের জন্মস্থানকে ভোলেননি কোনদিন। এখানকার বিখ্যাত স্কুল ঈশ্বর পাঠশালা – আমাদের বীরেনদা যেখানে শিক্ষক ছিল জাতীয় বিদ্যালয়ে যাবার আগে – সেই স্কুলও মহেশবাবুই তাঁর বাবা ঈশ্বরদাস তর্কসিদ্ধান্তর স্মৃতিতে তৈরি করেন, আর মায়ের স্মৃতিতে রামমালা গ্রন্থাগার আর মেয়েদের জন্যে রামমালা হোস্টেল। এ-ছাড়াও নিবেদিতা গার্লস স্কুল আর নিবেদিতা ছাত্রী নিবাস। এই যে সবিতা মিশন আশ্রম দেখছ, খাদি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কুমিল্লার কংগ্রেস কমিটি এই আশ্রমকে গড়ে তুলতে চায়। তার কিছু কিছু কাজও শুরু হয়েছে এখন। কিন্তু তোমাকে এখানে এনেছি অন্য কারণে। এটা আপাতত শুধু তুমিই জেনে রাখ, বেশি হৈ হৈ করার দরকার নেই। কথাটা হচ্ছে এই যে কুমিল্লায় এখন বোধ হয় এমন লোক নেই যে তোমার গান শোনেনি। কিন্তু যাদের শোনাতে পারলে তুমি সবচেয়ে খুশি হতে, তাদেরই শোনাতে পারনি এখনো।
তারা কারা? – জিজ্ঞেস করে নজরুল।
চল, ভেতরে যাই, বলেন অতীন্দ্র।
প্রৌঢ়া এক মহিলার পিছন পিছন এক ঝুড়ি কাটা সব্জী মাথায় নিয়ে একজনকে দেখতে পাওয়া গেল গেট পেরিয়েই। অতীন্দ্রকে দেখেই হাসিমুখে এগিয়ে আসেন মহিলা। অতীন্দ্র বলেন, মা, এই যে আমার সঙ্গে যে, সে কাজি নজরুল ইসলাম। ওর গানে এখন কুমিল্লা শহর কেঁপে উঠেছে। সবাই শুনল, শুধু তুমি আর তোমার ছেলেরা বাদ পড়েছ। তাই ধরে নিয়ে এলাম ওকে।
তাই নাকি? – হাসিমুখে বলেন মহিলা, তারপর সব্জী বয়ে আনছিল যে তাকে বলেন, ধীরাজ, একবার যা তো বাবা, সব্বাইকে ডেকে আন। যে যে-অবস্থায় আছে, ধরে আনবি।
দৌড়িয়ে চলে যায় ধীরাজ, বেতের একটা শীতলপাটি পেতে বসতে দেন মহিলা ওদের, দলবল নিয়ে ধীরাজ ফিরে আসবার আগেই সামনে বসিয়ে দেন একবাটি করে মুড়ি আর খেজুর গুড়। ছেলেরা যারা আসে তাদের কারো গায়ে কাদা শুকিয়ে, মাথার চুল আর গা ভর্তি তুলোর আঁশ কারো, কারো আবার ধুতি অথবা লুঙ্গির নীচের দিকটা খানিকটা ভিজে। নজরুলকে পরিচয় করিয়ে দেন অতীন্দ্র, এ কাজি নজরুল ইসলাম, তোমরা কেউ এর নাম শুনেছ কিনা জানিনা, এ কিন্তু কলকাতায় বিখ্যাত। খুবই বিখ্যাত, কবি আর গাইয়ে হিসেবে। আপাতত কুমিল্লায় আছে, আমাদের সঙ্গে একসাথে কাজ করছে। এখানে কাজি আসার পর থেকেই প্রায়ই গান গেয়ে ওকে নিয়ে রাস্তায় মিছিল করছে কুমিল্লার ছেলেমেয়েরা। তোমরা নিজেরা তো এখন মিছিলে যেতে পারবে না, তাই ওকে ধরে নিয়ে এলাম, ও তোমাদের গান শোনাবে আজ।
হারমোনিয়ম পাওয়া গেল না, খালি গলাতেই গান ধরে নজরুল। রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে শুরু, রাগসঙ্গীত দুয়েকটা, আর তারপর কাজির নিজের গান। শেষ গানটি গাওয়ার আগে বলে কাজি, তোমরা নিজেরা এখন মিছিলে যেতে পারবে না এ কথা শুনলুম দাদার মুখে, কিন্তু কেন যে পারবে না বোঝা গেল না সেটা। সে যাই হোক, আমাদের মিছিলের একটা গান আমি তোমাদের শোনাতে চাই। এই গানটা, মনে হয়, এখন কুমিল্লার সব ছেলেমেয়েই শিখে নিয়েছে। এটা কিন্তু তোমাদেরও শিখতে হবে। দাদা বললেন তোমরা এখন মিছিলে যেতে পারবে না। কেন পারবে না, আবার বলছি, সে আমি জানি না। কিন্তু আজ না হোক, একদিন-না-একদিন তো পারবেই। কাজেই, এ গানটা তোমাদের আমি শেখাতে চাই। শেখা সহজ। প্রথম দিনেই অনেক ছেলে শিখে নিয়েছিল মাত্র একবার শুনেই। তোমরা যদি শিখতে রাজি থাক, তা হলেই আমি গানটা গাইব। রাজি?
হৈ হৈ করে রাজি হয়ে যায় ছেলের দল। কাজির সেই পুরোনো কায়দা – আমি এক লাইন করে গাইব, তারপর তোমরাও সবাই গাইবে সেই লাইনটা – কাজে লেগে যায়। আধ ঘন্টার মধ্যেই এস এস ওগো মরণ।/
এই মরণ-ভীতু মানুষ মেষের ভয় কর গো হরণ।।/ – ছেলেরা সমবেত গাইতে শেখে।
ফেরার আগে খেয়ে যাওয়ার জন্যে পেড়াপীড়ি করেন মহিলা। অতীন্দ্র বলেন, কাজিকে খাওয়াবার অনেক সুযোগ পাবে মা, কিন্তু আজ নয়। ওকে খাওয়াতে গেলে কয়েকদিন আগে বলতে হবে। ভাগ্যবান ছেলে, ও আসার পর থেকেই ঘরে ঘরে কুমিল্লার মায়েরা ওর জন্যে রান্না করে বসে থাকেন। যাঁকে ওর কথা দেওয়া আছে, তিনি যদি না খাওয়াতে পারেন আজ, তাহলে বোধ হয় তাঁরও আজ খাওয়া হবে না। বেরোবার আগে পায়ে হাত দিয়ে মহিলাকে প্রণাম করে নজরুল। ওর থুতনি স্পর্শ করেন মহিলা, বলেন, এর পর যেদিন আসবে, সেদিন খেয়ে যেও। আর তুমিও, বলেন অতীন্দ্রকে।
বাইরে বেরিয়ে অতীন্দ্র বলেন, কী বুঝলে?
কিছুই না, বলে কাজি।
যাদের দেখলে, তাদের প্রত্যেককে পুলিশ খুঁজছে, বলেন অতীন্দ্র। এরা বাংলার নানা প্রান্তের অনুশীলন-যুগান্তরের ছেলে। সবিতা মিশন আশ্রম যখন খোলা হল, কংগ্রেস ঘোষণা করল, খাদি মিশন হবে এখানে। আর খাদি মিশন চালাবে কারা? চরকায় সুতো কাটা, তার বয়ন, বাগানে সব্জী ফলানো, মাছের চাষ – এসব করবে কে? বুঝতেই পারছ, তবে এসব ঘোষণা করা হয়নি কখনো। কিন্তু, কাজ তো হচ্ছে! আমাদের কুমিল্লায়, বুঝলে তো কাজি, স্বাধীনতা আন্দোলনে কোন দলাদলি নেই। যে পন্থা যার পছন্দ, সে তা-ই করুক। সবায়ের নৈতিক সমর্থন সবাই পাবে।
আর মা? – কাজি জিজ্ঞেস করে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের এক শহীদের মা। শহীদের নাম জিজ্ঞেস কোরো না, যেদিন জানবার নিজেই জানবে। বাঘা যতীনের একটা চিন্তা ছিল, জানো? এই যে বিদেশী রাজার বিরুদ্ধে লড়াই, এতে তো শহীদ হবে অনেকে, দীর্ঘ কারাদণ্ড, দীপান্তর, এসব তো হবেই। অনেক পরিবারের অনেকরকম ক্ষতি হবে। তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা চাই। সামাজিক, আর্থিক, মানসিক পুনর্বাসন। এই আশ্রমের যে মাকে দেখলে – যাঁকে আমরা সবাই মা বলেই ডাকি – তিনি এক সন্তান হারিয়ে এতগুলো সন্তান পেয়েছেন। বুক দিয়ে আগলে রাখেন তাদের। আর এই ছেলেরা তো বাড়িঘর ছেড়ে এসেছে, মা-বাবা-নিজের মানুষদের ছেড়ে এসেছে। পুলিশের চোখে যতই আণ্ডারগ্রাউণ্ড হোক, মা তো তবু পেয়েছে একজন। নিজের মায়ের কোন বিকল্প হয় না ঠিকই, তবুও কিন্তু বিপ্লবীর মা সবায়ের মা হতে নিজে নিজেই শিখে যান।
আর্দ্র আঁখিপল্লব, নতমস্তক নজরুল এগিয়ে চলে ধীরপদে, নির্বাক।
আর এভাবেই কাটতে থাকে দিনগুলো। কখনও স্টীমার-শ্রমিকদের মধ্যে চাঁদপুরে বা গোয়ালন্দে, কোনদিন অধ্যক্ষ সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বাড়িতে, কখনও বা ভিক্টোরিয়া কলেজের হোস্টেলের ঘরে, ছাত্রদের সঙ্গে। নিছক আড্ডা কোনদিন, কোনদিন বা সবাই মিলে প্রভাত-ফেরী। আর হেমপ্রভা-বসন্তর বাড়ির প্রায়-প্রাত্যহিক সঙ্গীত সন্ধ্যায় জটু-বাচ্চু-দুলু আর শান্তিলতা-অরুণাকে গান শেখানো।
এই সব নিয়ে কি ভালো আছে নজরুল? কলকাতা ছেড়ে যখন বেরিয়ে পড়েছিল বিপ্লবের সন্ধানে, জীবনটা ঠিক কেমন হবে সে কথা ভাবেনি তখন। বিপ্লবের কল্পনাতেই কেমন যেন একটা গা-গরম করা ভাব আছে। আছে একটা রহস্য, আছে জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি একটা দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে চলার গা-ছমছম-করা দুঃসাহসের মজা। মারো অথবা মরোর চ্যালেঞ্জ। কিন্তু নিবারণবাবু বিপিনবাবু হয়ে শেষ পর্যন্ত কুমিল্লায় এসে আজকাল আছে কেমন নজরুল?
তিন মাস শেষ হতে চলল। অনেক নতুন নতুন গুণী মানুষের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। ভালোই লাগে তাদের সঙ্গ। এই তো সেদিন অধ্যক্ষ সত্যেনবাবুর বাড়িতে আলাপ হয়ে গেল আশ্চর্য এক মানুষের সঙ্গে। মানুষটির পরিচয় পেয়ে বিস্মিত নজরুল। মহারাজ নবদ্বীপচন্দ্র। ত্রিপুরার রাজকুমার। থাকেন পূর্ব কুমিল্লার চর্থায় তাঁর নিজস্ব প্রাসাদে। নিজে সঙ্গীতশিল্পী এবং সেতারবাদক। তাঁর বাবা নিজের ছেলেকে বঞ্চিত করে ভাইকে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন ত্রিপুরায়। সে ভাই কিন্তু অগ্রজের ভুল নিজে করেননি আর, তাঁর সিংহাসন পেয়েছে তাঁর নিজের ছেলেই। রাজবাড়ি-টাজবাড়ি সব বিচিত্র জায়গা। বঞ্চিত রাজকুমার শুধুই বঞ্চনার শিকারই ন'ন, যেহেতু বঞ্চিত অতএব সন্দেহেরও শিকার তিনি। তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা, সেই হিসেবে, খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কুমার তাই বেরিয়ে আসেন রাজপ্রাসাদের থেকে। ত্রিপুরা রাজ্যের বাইরে, কুমিল্লায় তৈরি হয় তাঁর প্রাসাদ। সেখানে মহিষী মণিপুর-রাজকুমারী নিরুপমা আর সন্তানদের নিয়ে তাঁর সুখের সঙ্গীতসংসার। কুমার নবদ্বীপচন্দ্রের সেতার বা সঙ্গীত শোনা হল না সেদিন, এটা-সেটা টুকটাক কথাবার্তা হল, সত্যেনবাবুর অনুরোধে তাঁকে গানও শোনাল কাজি, রবীন্দ্রনাথের গান। যাবার আগে কাজিকে তিনি প্রাসাদে নিমন্ত্রণ করে গেলেন।
প্রাসাদে যাওয়া কাজির এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। যেতে যেতেই সত্যেনবাবু শোনাচ্ছিলেন এই রাজবংশের কাহিনী। ভারতের দীর্ঘতম রাজবংশ, গত দেড় হাজার বছরের অবিচ্ছিন্ন রাজত্ব ত্রিপুরার এই রাজবংশের। প্রাসাদের প্রবেশমুখে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে দাঁড়িয়েছিলেন স্বয়ং কুমার নবদ্বীপচন্দ্র। মূল প্রাসাদে প্রবেশ করার আগে বিস্তীর্ণ ফল-ফুলের বাগান আর জলাশয় ঘুরিয়ে দেখালেন অতিথিদের। প্রাসাদের অভ্যন্তরে কোথা থেকে যেন ভেসে আসে কোন সঙ্গীতযন্ত্রের মূর্ছনা; কে কোথায় বাজাচ্ছে বোঝা যায় না। কুমার বলেন, এ প্রাসাদের অধিবাসীরা সকলেই কমবেশি সঙ্গীতসাধক, কেউ নিজের কণ্ঠে গান গায়, কেউ যন্ত্রে, কেউ বা শুধুই সঙ্গতকারী।
রাজকীয় অভ্যর্থনা, অতুলনীয় ভোজ্যপেয়, আর যাকে বলে সাঙ্গীতিক আড্ডা। সঙ্গে সঙ্গীত শ্রবণ ও পরিবেশন। এত কিছুর পর দেববর্মন-বংশীয় কুমার নবদ্বীপচন্দ্রের সন্তান পালন বিষয়ে এমন কিছু কথা শুনল কাজি যে তার মন একেবারে ভরে গেল।
নবদ্বীপচন্দ্রের কনিষ্ঠতম সন্তান এখন এই প্রাসাদেই থাকে। রাজবাড়ির প্রথা অনুযায়ী শৈশবে ত্রিপুরার আগরতলায় কুমার বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয়েছিল তাকেও। অভিজাত ধনী পরিবারের ছেলেদের এই স্কুলের অর্থপ্রাণ অর্থসচেতক সঙ্গ থেকে ছেলেকে মুক্ত করবার জন্যে তাকে কুমিল্লায় নিয়ে আসেন নবদ্বীপচন্দ্র, ভর্তি করে দেন স্থানীয় ইউসুফ স্কুলে। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বাবার কাছে সঙ্গীতশিক্ষার শুরু। প্রাথমিক স্কুলের পড়া শেষ হলে একেবারে সাধারণ মধ্যবিত্ত ছেলেদের সঙ্গে তাকে পড়তে পাঠান কুমিল্লা জেলা স্কুলে ক্লাশ ফাইভ-এ। সেখান থেকে যথাসময়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করবার পর এখন সে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে ফার্স্ট ইয়ার ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। ছেলেটির নাম শচীন, তাকে ডেকে পাঠালেন তার বাবা। সত্যেন বাবুর কলেজের ছাত্র সে, এসে স্যরকে প্রণাম করে, তারপর বসল। কাজিকেও প্রণাম করতে গেল সে, কাজি আটকাল তাকে। মনে হল নিজের চেয়ে সাত-আট বছরের ছোট হবে ছেলেটি। সে বলল, ভবিষ্যতে সে গাইয়েই হতে চায়। মৃদু অনুরোধেই একটা গান শোনাল সে, ঈষৎ সানুনাসিক কণ্ঠস্বর তার মিষ্টি গলাকে অসাধারণ আকর্ষণীয় করে তুলেছে, তা ছাড়া ভারি সচ্ছন্দ তার গায়কি। নজরুল একেবারে উচ্ছ্বসিত।
শচীন বলল কাজি নজরুল ইসলামের কথা সে বন্ধুদের কাছে শুনেছে। সে নিজে কাজির গানে আগ্রহী। কাজি কি তাকে শেখাবে একটা-দুটো গান?
আজ সারাটা দিন তো খুবই ভালো কাটল কাজির। কিন্তু তবুও, সন্ধ্যের পর কান্দিরপাড়ে সেনগুপ্ত বাড়িতে ফিরল যখন সে, কেমন যেন একটা অস্ফুট অবর্ণনীয় মন খারাপ তার।
সেই যে পিংলার সঙ্গে হাওড়ায় গিয়েছিল, আর সেখানে গিয়ে ভীমদার সঙ্গে দেখা হল তার, তারপর থেকেই মনে হচ্ছিল সময় নষ্ট করছে সে। মুজফ্ফরকেও ঠিক মতো তার মনের অবস্থা বোঝাতে পারেনি, শৈলজাকেও নয়। কয়েক রাত্তির স্বপ্ন দেখল নিবারণবাবু স্যরকে। স্যর যেন তাকে বলছেন, দেশের কাজ পড়ে রইল, আর তুই কবিতা-গল্প লিখে আর গান গেয়ে সময় নষ্ট করছিস! মুজফ্ফরের সঙ্গেও যে দেশের কাজ করার কথাই হয়েছিল, নবযুগের সম্পাদকীয় কাজ করার সময়ে তারা যে দেশপ্রেমের তাগিদেই করছিল সে কাজ, সে কথা ভুলে গেল নজরুল। অথচ যখন দৈনিক নবযুগের কাজ শুরু করে ওরা, তখন তো মনে হয়েছিল লড়াই করতেই ময়দানে নামছে ওরা। শুধু একদিন – একদিন মাত্র – ভীমদার সঙ্গে কথা বলেই চিন্তা-ভাবনা সব ওলোট-পালোট হয়ে গেল! এই যে তিন মাসের উপর হয়ে গেছে সে কলকাতা ছেড়ে এসেছে, দেশের জন্যে কী বিপ্লবটা সে করেছে! নষ্ট, শুধুই সময় নষ্ট!
আর তা ছাড়া, ক'টা কবিতাই বা সে লিখেছে এই তিন মাসে? ক'টা গান? নজরুল জানে, যখন সে ব্যস্ত থাকে নানা কাজের চাপে, যখন মনে হয় দিনগুলোয় কেন চব্বিশ ঘন্টাই মাত্র হল, কেন টেনে বাড়ানো গেল না আরও কয়েকঘন্টা, তখনই কবিতা আসে তার মাথায়। এখন এই অলস জীবনে, কই, কবিতা লিখতেও তো ইচ্ছে করে না তার! দিন দশেক আগে বীরেনের স্ত্রী-পুত্র এসেছে কলকাতা থেকে, তার আগে পর্যন্ত তো রাত্তিরে শুতে যেতে যেতে বীরেনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, নানা রকমের কাজের প্ল্যান করতে করতেও, উত্তেজনা ধরে রাখা যেত। এখন শূন্য ঘরে শূন্য বিছানায় দিনের শেষে তার ঘুমও আসতে চায় না।
কয়েকদিন আগে হঠাৎ খুব অভিমান হল কাজির। এই যে তিন মাসেরও বেশি হল সে এসেছে কলকাতা থেকে, বন্ধুরা তো কেউ খোঁজ নিল না তার। আবার একটু পরেই হাসি পায় কাজির। তার ঠিকানা জানবে কী করে বন্ধুরা! সে কোথায় আছে জানে কি কেউ? সে কি কাউকে চিঠি লিখেছে এর মধ্যে? শেষ যেদিন মুজফ্ফর আর শৈলজার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, মুজফ্ফর তাকে জড়িয়ে ধরে যা বলেছিল, সে কথা তো স্পষ্টই মনে আছে ওর,
তুমি একটা কথা আমায় দিয়ে যাও ভাই। যেখানেই যাও, কোন অসুবিধেয় পড়লে জানাবে আমাকে। আমি
যেখানেই থাকি, ঠিক পৌঁছিয়ে যাব। তোমার মধ্যে কিছু একটা করার আকুতি তৈরি হয়েছে, আমি বাধা দিতে চাই না। কিন্তু আমি যে তোমার বন্ধু এ কথা তুমি ভুলো না কোনদিন।
তাহলে? ও তো এক-আধটা চিঠিও লিখতে পারত মুজফ্ফরকে। নাঃ, কাল সকালেই মুজফ্ফরকে চিঠি লিখবে কাজি।
ঘুমোতে যাবার আগে নিজের ব্যাগটা একটু নেড়েচেড়ে দেখতে চায় সে। কী কাগজপত্র আছে দেখতে হবে। কাল থেকে সে আবার কবিতা লেখার চেষ্টা করবে।
ব্যাগের মধ্যে হাতটা ঢুকিয়ে প্রথমেই সেই বইটায় লাগল হাতটা। জুলিয়ান বোরখার্টের দ্য পীপ্ল্স্ মার্কস। কাজির মনে পড়ে ট্রেন ছাড়বার আগের মুহূর্তে মুজফ্ফর এসেছিল হাওড়া স্টেশনে। সঙ্গে এই বইটা। এই বইটাই মুজফ্ফরের কাছ থেকে সে চেয়ে নিয়েছিল পড়বে বলে, কিন্তু টার্ণার স্ট্রীট ছেড়ে আসবার সময় সঙ্গে আনেনি বইটা। পরে মুজফ্ফরই নিজে নিয়ে এসেছিল হাওড়া স্টেশনে। বলেছিল, কোন দ্বন্দ্বের বোধ হলে, নিজেকে উদভ্রান্ত লাগলে, বইটা যেন পড়ে কাজি। এই-ক'দিন বইটার কথা মনেই পড়েনি তার। আজ যেন ওতে হাত লেগে মুজফ্ফরের ছোঁয়া পায় সে, মুজফ্ফরের গন্ধ। চোখে জল আসে কাজির।
শীত-বসন্ত কেটে গিয়ে কখন যে বৈশাখ এসে গেছে টেরও পায়নি সে। ক'দিন ধরেই শুকনো হাওয়া, মা বিরজাসুন্দরী বলছিলেন, এবার কালবৈশাখীর ঝড় হবে, গরমটা কমবে তখন। এমনিতে কুমিল্লা পুকুরের শহর, যে কোন দিকে কয়েক পা হাঁটলেই ছোট-বড় পুকুর নজরে পড়ে। কান্দিরপাড়ের এই বাড়িটার পাশেই একটা পুকুর, বাঁশিটা হাতে নিয়ে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে সকালবেলাই পুকুরের ধারে গিয়ে বসে কাজি, বাঁশিতে দেয় ফুঁ। ঘন্টাখানেক পর মনটা একটু শান্ত হয় তার, ব্যাগ থেকে কাগজ-পেনসিল নিয়ে লিখতে শুরু করে সে। লেখে আর কাটে, কাটে আবার লেখে, এভাবে বেশ কিছুক্ষণ যাবার পর পিছন থেকে কচি-গলার শব্দ: কাজিদাদা, মা খেতে ডাকছে।
ঘাড় ফিরিয়ে কাজি দেখে জটু, ও মা তুই, চল্ চল্, যাই খেতে।
তুমি বাঁশি বাজাচ্ছিলে কাজিদাদা, আমি শুনেছি। আমি শুনেছি, মা শুনেছে, ছোড়দি শুনেছে, রাঙাদিদি শুনেছে, বৌদি শুনেছে, সবাই শুনেছে।
ও, তাই বুঝি? – বলে কাজি, ঠিক আছে, এখন চল্, খাওয়া হবে। আমি খাব, মা খাবে, ছোড়দি খাবে, রাঙাদিদি খাবে, বৌদি খাবে। শুধু খাবে না আমাদের জটু সোনা, বল্,?
হাততালি দেয় জটু, এ মা হেরে গেছে হেরে গেছে, কিচ্ছু জানে না, আমার খাওয়া তো হয়েই গেছে।
হেরে গেছি, গেছিই তো, কাগজপত্র ব্যাগে ভরতে ভরতে কাজি খেয়াল করে, ওর কাগজে সবই কাটা, কিছুই লেখা হয়নি শেষ পর্যন্ত!
তবুও, এটাই এখন থেকে রুটিন। সকালবেলাই বেরিয়ে পড়ে কাজি, এসে বসে পুকুরের ধারে। বাঁশি বাজায় খানিকটা, তারপর চেষ্টা করে কিছু একটা লিখতে। তার পর জটু বাচ্চু দুলির মধ্যে কেউ – আজকাল আবার বীরেনের ছেলে রাখালও জুটেছে ওদের সঙ্গে – এসে ডেকে নিয়ে যায়। মুজফ্ফরকে একটা চিঠি লিখবে ভেবেছিল। শেষ পর্যন্ত তা-ও হয়ে ওঠে না।
সেদিন সকালে ছিল প্রভাত-ফেরী। কলেজের ছেলেরা এসে ডেকে নিয়ে গেছে কাজিকে। দু-তিন ঘন্টা রাস্তায় রাস্তায় গান গাওয়ার পর দুপুরে সে পুকুরে সাঁতার কাটার মতলব করল। স্নানের আগে ব্যাগের থেকে কাগজ বের করে বসে কাজি, কিছুক্ষণ এক মনে চেয়ে থাকে পুকুরের দিকে, তারপরেই হঠাৎ দ্রুতবেগে লিখতে থাকে:
যাস কোথা সই একলা ও তুই অলস বৈশাখে
জল নিতে যে যাবি ও লো কলস কই কাঁখে?
সাঁঝ ভেবে তুই ভর-দুপুরেই দুকূল নাচায়ে
পুকুর পানে ঝুমুর ঝুমুর নুপুর বাজায়ে
যাসনে একা হাবা-ছুঁড়ি
অফুট জবা চাঁপা কুড়ি তুই!
ওলো রঙ দেখে তোর লাল-গালে যায়
দিগ-বধূ ফাগ থাবা থাবা ছুঁড়ি।
পিকবধূ সব টিটকিরি দেয় বুলবুলি চুমকুরি
আহা বউল-ব্যাকুল মহুল তরুর সরস ঐ শাখে।
অনেক দিন পর কবিতা বেরোল হাত থেকে। বেশ কয়েকবার কবিতাটা পড়ে কাজি নিজে। বেশ হয়েছে, ভালই হয়েছে!– নিজের মনেই বলে কাজি, তারপর ব্যাগ থেকে বের করে একটা লুঙ্গি। মাথা দিয়ে গলিয়ে দেয় লুঙ্গিটা, এবার জামাকাপড় বদলিয়ে পুকুরে নামবে সে। এমন সময় দ্রুতপদে দেখা যায় দুলিকে, সে আসছে পুকুরের দিকেই, নিশ্চয়ই তাকেই ডাকতে আসছে। একটু অপেক্ষা করে কাজি, দুলি এসে পৌঁছোয়, তাড়াতাড়ি আসায় একটু জোরে জোরে শ্বাস টানছে সে। কাজি বলে, আমি একটা ডুব দিয়ে আসি, তু্মি ততক্ষণ পড় এই কবিতাটা, খাতাটা দেয় দুলির হাতে।
কবিতাটা হাতে নেয় দুলি, পড়তে থাকে, জলে নামার বদলে দুলির মুখের দিকে তাকিয়ে একটু অপেক্ষা করে কাজি, কী জানি কেন, মনে হয় দুলির শ্বাস টানবার প্রক্রিয়াটা দ্রুত হয় আর একটু। খাতাটা বন্ধ করে দুলি, মুখটা গম্ভীর। পরক্ষণেই গাম্ভীর্য ভেদ করে একটু হাসির আভা, মুখটা একটু লালচে, জোর-করে-চেপে-থাকা ঠোঁটের মধ্যে থেকে অস্ফুট একটু যাঃও-শব্দ, কাজির সঙ্গে এক মুহূর্তের চোখাচোখি, তারপর দৌড়িয়ে দুলির ফিরে যাওয়া। আর, দৌড়তে দৌড়তে একবার পিছন ফিরে চেঁচিয়ে বলা, তাড়াতাড়ি এসো, খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাবে!
তের বছরের দুলি – বাইশ বছরের কাজি – সবাই বলে চাঁপার কলির মতো রঙ দুলির – ভাবতে ভাবতে জলতলে টানটান ভাসতে থাকে নজরুল।
সেদিনই সন্ধ্যেবেলায় ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। পাশের বাড়ির হেমপ্রভাদের বাড়িতে গিয়েছিল ওরা সবাই, ইন্দ্রকুমার একাই ছিলেন বাড়িতে। সেই সময় এল একজন। কলকাতা থেকে এসেছে এই ধর্মঘটের মধ্যে। অনেক কষ্ট করে চাঁদপুর থেকে আসতে পেরেছে কোনমতে। সবাই যখন ফিরল, সে তখন ইন্দ্রকুমারের সঙ্গে গল্প করছে। দেখা গেল আগন্তুক সবারই পরিচিত। বাড়ির সবাই কিন্তু এই দেখে আশ্চর্য হল যে এমনকি নজরুলও চেনে একে! চেনে, কিন্তু একে দেখে খুবই অবাকও হয়েছে নজরুল।
কেমন আছেন, কাজিসাহেব?– উঠে দাঁড়িয়ে বলে আগন্তুক।
আরে আপনি এখানে? কী ব্যাপার?
কী সব্বোনাশ, এ কী প্রশ্ন আপনার কাজিসাহেব! মায়ের বাড়িতে ছেলের আসতে কি কারণ লাগে নাকি?
এবার কথা বলেন বিরজাসুন্দরী, আলিও আমার আর একটা ছেলে। বীরেনের সঙ্গে ও কুমিল্লা জেলা স্কুলে পড়ত। বীরেনের বন্ধুরা প্রায় সবাই আমাকে মা বলে ডাকে, মায়ের মতোই ভালোবাসে। ও-ও। আমরা তো জানতুম না ও তোরও বন্ধু।
বন্ধু বলে বন্ধু!– উচ্ছ্বাস দেখায় আলি, কাজিসাহেব যুদ্ধ থেকে ফিরে যেদিন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির বাড়িতে থাকতে এলেন, সেদিন থেকে বন্ধুত্ব আমার সঙ্গে, আমিও তখন ওখানে থাকতাম কিনা। এটা কিন্তু ভারি ভালো হল, যাবেন নাকি কাজিসাহেব আমাদের বাড়িতে? ঘুরে আসবেন নাকি? বেশি দূর নয়, এখান থেকে মাইল আট-দশ হবে।
কাজিকে উত্তর দেবার সুযোগ দেন না বিরজাসুন্দরী, আলিকে বলেন, তুই তো এসে অবধি সেই একই ভাবে কাকাবাবুর সঙ্গে গল্প করছিস, যা, কাপড়জামা ছেড়ে একটু হাত-মুখ ধুয়ে আয়, আমরা সবাই পাশের বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি, এখন তুই আর কাকাবাবু খাবি শুধু, আমি চটপট ব্যবস্থা করছি, যা।
খুব একটা স্বস্তি বোধ করে না নজরুল আলি আকবর খাঁকে দেখে। এ কথা ঠিকই যে করাচি থেকে ও যখন ফিরে আসে, সেই সময় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির একটা ছোট ঘরে আলি একা-একাই থাকত। মুজফ্ফরের সঙ্গে আরও আট-ন' বছর আগে একবার আলাপ হয়েছিল আলি আকবরের, ঢাকায়। এবার যখন দেখা হয় মুজফ্ফর তখন সাহিত্য সমিতির সহ-সম্পাদক এবং বেতনভুক সর্বক্ষণের কর্মী। আলি এবারে প্রথমে চিনতেই পারেনি তাকে। কিন্তু পুরোনো আলাপের সূত্রে তারই সঙ্গে প্রায় বিনা আমন্ত্রণেই আলি পৌঁছে যায় সাহিত্য সমিতির বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রীটের আস্তানায়। সেখানে কারো সঙ্গে ওর পরিচয় ছিল না, মুজফ্ফর তো অপছন্দই করতো ওকে। কারণে-অকারণে ও মিথ্যে কথা বলে, মুজফ্ফরের এটাই সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল ওর বিরুদ্ধে। তা সত্ত্বেও কিন্তু সমিতির একখানা ঘর ও মুজফ্ফরের বন্ধু হিসেবেই দখল করল; ব্যাপারটা পছন্দ না হলেও চক্ষুলজ্জার খাতিরে কেউ সে কথা বলতেও পারল না ওকে। মুজফ্ফর বরাবরই ভেবে এসেছে মুখে কিছু না বললেও মনে মনে সবাই মুজফ্ফরকেই দায়ী করেছে এমন একটা লোকের জবর দখল করে ওখানে নিঃশুল্ক থেকে যাবার জন্যে। নজরুল যখন সাহিত্য সমিতিতে প্রথম আসে, তখন সেই জবর-দখল ঘরেই ছিল আলি আকবর। সেই সময় একটা খারাপ অসুখ হয়েছিল ওর, খুব একটা হাঁটা-চলা করতেও পারত না, শুয়েই থাকত প্রায় সব সময়। নজরুল অবিশ্যি স্বভাব দৌর্বল্যে বহুবার বাইরে থেকে ওর জন্যে খাবার-দাবার কিনে এনেছে, নানা ব্যাপারে সাহায্যও করেছে ওকে।
সাংবাদিকতা ইদানিং যখন ততটা ভালো লাগছিল না আর নজরুলের, আফজালুল হকের তক্তপোশের আড্ডায় সে কথা তখন তো উঠেওছে কতবার। সে সময় আলি আকবর নজরুলের সঙ্গে বার বার একমত হয়েছে যে এক জন কবির পক্ষে খবরের কাগজের চাকরি শুধুই সময়ের অপব্যবহার। শুধু একমত হওয়া নয়, ওর নিজের দেশের বাড়িতে যাবার জন্যে নজরুলকে ও আহ্বান করেছে কতবার: চলুন না, একবার ঘুরে আসবেন, খারাপ লাগবে না। মুজফ্ফরের যদি আপত্তি না থাকতো, এতদিনে কত বার ঘোরা হয়ে যেত। এখন, আবার সেই আলি আকবর! আর, ঠিক সেই সময়েই, যখন মুজফ্ফরের কথা মনে পড়ে বার বার মন খারাপ হচ্ছে কাজির!
অবিশ্যি কাজির যেমন স্বভাব, দু-তিনদিন পরেই সে রাজি হয়ে যায় আলির সঙ্গে যেতে। সত্যি সত্যিই তেমন কিছু কাজের কাজ তো হচ্ছিলও না কুমিল্লায়, কয়েকদিন না হয় আলিদের দৌলতপুর থেকে ঘুরে আসাই যাক।
বৈশাখ মাস। বর্ষা আসেনি তখনো, ফলে নদীমাতৃক দেশে জলের উপর নৌকোর অভাব হল না। নৌকোয় উঠেই আলি বলে, কতদিনের স্বপ্ন আমার সফল হল আপনি আন্দাজ করতে পারেন, কাজিসাহেব?
কী স্বপ্ন?– জিজ্ঞেস করে কাজি।
মনে পড়ে আপনি যখন প্রথম করাচি থেকে এলেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমাজে, তখন কত উপকার করেছেন আমার?
উপকার? কই, মনে করতে পারি না তো তেমন কিছু, বলে কাজি।
সেটা আপনার মহানুভবতা। নিজের বাড়ি থেকে অত দূরে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছি, আত্মীয়-বন্ধু কেউ নেই কাছাকাছি, এমন সময় দিনের পর দিন আপনি আমার সেবা করেছেন। মনে করে করে ঠিক ঠিক কোন খাবারটা আমার খাওয়া দরকার, কোন সময়ে কোন ওষুধটা প্রয়োজন, বাজার থেকে কিনে এনে আপনিই জুগিয়েছেন সব। মন খারাপ হলে কবিতা শুনিয়েছেন, গান গেয়েছেন, অনাত্মীয় অপরিচিতের জন্যে কে করে এতসব! তখন থেকেই মনে মনে ভেবেছি সুযোগ পেলে একবার নিজের বাড়িতে নিয়ে আসব আপনাকে। কত বার তো বলেওছি আপনাকে সে কথা। আজ আমার কী যে ভালো লাগছে আপনাকে বোঝাতে পারব না কাজিসাহেব।
কাজি হাসে, তখন যদি জানতুম আপনি একেবারে অঙ্ক কষে উপকারের ডেবিট-ক্রেডিট হিসেব করবেন, তাহলে মুসলমান সমিতিতে আপনার ওই ঘরের ত্রিসীমানাতেও যেতুম না আমি। উপকার কিসের মশাই? বত্তিরিশ নম্বর তো একটা ব্যাচিলর্স ডেন, একজনের অসুখ-বিসুখ করলে অন্যরা যদি না-ই দেখত, তাহলে ওই সমিতি তো এতদিনে ভেঙেচুরে সাহিত্যের ইতিহাসের রাস্তায় উল্টে পড়ে থাকত! ওসব কথা ছাড়ুন, এখন আপনার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কী ভালোমন্দ খাওয়াবেন বলুন।
ভালো আর কী জুটবে বলুন আমাদের ওই অজ-পাড়াগাঁয়ে। খাওয়া-দাওয়া হয়তো মন্দই হবে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তবুও বলছি, ভালোই লাগবে আপনার। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে ছোট ছোট ভাইপো-ভাইঝি আছে অনেকগুলো। আপনি তো শিশুমনের রাজা একেবারে, ভালো আপনার লাগতেই হবে।
শিশুমনের রাজা! আশ্চর্য উপাধি দিলেন তো একটা। এরকমটা কেন আপনার মনে হল বলুন তো।
আপনার সেই লিচুচোর কবিতাটা মনে পড়ছে?
লিচুচোর?– কয়েকটা মুহূর্ত সময় নেয় নজরুল, হ্যাঁ! মনে পড়ছে বৈকি। আপনার ঘরে বসেই লিখেছিলুম তো।
কবিতাটা মনে আছে?
কবিতাটা...না, না বোধ হয়... মনে পড়ছে না... আর পড়বেই বা কীভাবে, ওই যে আপনাকে লিখে দিলুম, তারপর তো আর দেখিইনি কবিতাটা। ছেপেছিলেন নাকি? ছাপা হয়েছিল কোথাও?
আপনার কবিতা কি আপনার অনুমতি ছাড়া ছাপতে পারি কাজিসাহেব? আমি বলেছিলাম, আমি ছোটদের প্রকাশক, নিজেই ছোটদের জন্যে লেখবার চেষ্টা করি। তো, আমার কবিতার বহর দেখে, আপনি নিজেই হাসতে হাসতে লিখে দিলেন লিচুচোরের মতো কবিতা! কলকাতায় আমায় কেউ চেনে না, কিন্তু ঢাকায় যদি যান কখনও, দেখবেন বেশ অনেকটাই পরিচিতি আছে আমার সেখানে। আপনাকে একবার নিয়ে যাব ঢাকায়, তখন বুঝতে পারবেন। আমার, জানেন তো, খুব ইচ্ছে আছে আপনাকে ঢুকিয়ে নিই এই প্রকাশনার ব্যবসায়। বাংলা শিশুসাহিত্যকে কোথায় নিয়ে যাওয়া যায় দেখিয়ে দেব বাংলার মানুষকে। আপনি শুধু লিখবেন, আর কিছু ভাবতে হবে না আপনাকে। বাকিটা আমার উপর ছেড়ে দিন।
বাকিটা, মানে ব্যবসাটা? সেটা তো ছাড়াই আছে আপনার জন্যে, আমি লিখি আর না-ই লিখি।
এক মুহূর্তের জন্যে কি থমকে গেল আলি? ব্যবসাটা 'ছাড়াই আছে' মানে কী? 'আমি লিখি আর না-ই লিখি' বলতে কী বোঝাচ্ছে নজরুল? আলির বই-প্রকাশনার যে ব্যবসাতে নজরুলকে সঙ্গে চায় আলি আকবর খান, সেখানে তো লেখাটাই হবে নজরুলের দেয় প্রধান মূলধন। নজরুলকে ঘিরে তার যে পরিকল্পনা, 'না-ই লিখি' বলে নজরুল কি তার বাইরে রাখতে চাইছে নিজেকে? চালচুলোহীন, আবেগতাড়িত, স্বার্থচিন্তায় সম্পূর্ণ উদাসীন এই প্রতিভাকে নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসবার এই যে শেষ সুযোগ পেয়েছে আলি, সেটাকে কোনমতেই তো ছেড়ে দেওয়া চলবে না!
গলায় একরাশ আক্ষেপ নিয়ে আলি আকবর খাঁ বলে, নাঃ, আপনাকে সীরিয়স করা গেল না আর।
দৌলতপুরে ওদের বাড়িতে গিয়ে সহজেই সবায়ের সঙ্গে মিশে গেল কাজি, ছোটদের সে ভাইজান। সেই ছোটদের সামনে আলি আকবর খাঁ শুনিয়ে দিল কাজি নজরুলের লিচুচোর কবিতা, বড়রাও জুটল এসে। সম্পূর্ণ মুখস্থ কবিতাটা রীতিমতো আবৃত্তি করল সে। গলার ওঠানামা, বাচনভঙ্গি আর অসাধারণ অভিনয়-কুশলতা একেবারে মাতিয়ে দিল সবাইকে। শুধু কবিতা নয়, আলি আকবরের কাছে ছোটরা শুনেছে কাজি গানও লেখে, এমনকি গায়ও। অতএব সন্ধ্যেবেলা গানের আসর। আসর শেষ হলে গান শেখাবার পালা। শুধু এই বাড়ির ছোটরাই নয়, গ্রামের আশপাশের বাড়ি থেকেও অনেক ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হাজির হয়, নাচগানে বাড়ি একেবারে জমজমাট।
আলি আকবরের বিধবা নিঃসন্তান দিদি এখতারউন্নেসা ভাইদের এই সংসারের কর্ত্রী। আত্মীয়সঙ্গহীন নজরুল তার স্নেহস্পর্শে একেবারে আপ্লুত। এই বাড়ির সংলগ্ন পুকুর আর তার পাশেই আমগাছটার নীচে শানবাঁধানো জায়গাটা কাজির ভারি ভালো লেগে গেল। বৈশাখের এই গরমে পুকুরে বারবার সে নামে সাঁতার কাটতে আর রোদ পড়লেই আমতলায় বসে বাজায় বাঁশি। পুকুরে নামলে কাজির খেয়াল থাকে না সময়ের কথা, তার ভাত আগলিয়ে বসে থাকে এখতারউন্নেসা, কাজি যাকে ডাকে বুবু বলে। অগোছালো সুদর্শন ঝাঁকড়া-চুলের এই ছেলেটির বুবু-ডাকে এখতারউন্নেসার ভ্রাতৃ-স্নেহ যেন মাতৃস্নেহে রূপান্তরিত হয়, সেই গলিত স্নেহে নিমজ্জমান কাজি কি বোঝে বুবু তার জন্যে না-খেয়ে তার ভাত আগলিয়ে বসে আছে ঘন্টার পর ঘন্টা? বোঝে কি তার খাওয়া হয়ে গেলে তবেই বুবু নিজে খাওয়ার সময় পাবে? খরবৈশাখের দিবানিদ্রার পর আমতলা থেকে বাঁশির স্বর ভেসে আসে যেই, চায়ের গেলাস হাতে বুবু পৌঁছিয়ে যায় সেখানে। তাকে দেখতে পেলেই বাঁশি নীরব হয়, উঠে দাঁড়িয়ে দু'হাত দিয়ে গেলাসটা নেয় কাজি। চা শেষ হলে বাঁশি আবার বেজে ওঠে, কয়েকমিনিট সেখানে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে যায় বুবু।
এ বাড়িতে এখতারউন্নেসার মুখের উপর কথা বলে না প্রায় কেউই। এখতারউন্নেসাও অবিশ্যি তার নিজের অবস্থান ভালো মতোই বোঝে। ভাইদের সঙ্গে তার তেমন কিছু মতবিরোধ কোন বিষয়ে এখনও পর্যন্ত বিশেষ দেখা যায়নি। কিন্তু, এখন কিছুদিন ধরে একটু অস্বস্তিতে আছে সে। ছোট ভাই আকবর আলি তাদের বংশে একমাত্র গ্র্যাজুয়েট, ছোট হলেও বিদ্বান হিসেবে সে বিশেষ খাতির পায় সবায়ের কাছ থেকে। এমনকি সবার চাইতে বড় তার দাদা আলতাফ আলি, যে নিজেও গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক, সে-ও তার ব্যবহারে বিশেষ সম্ভ্রম দেখায় আকবরকে। তাকে নিয়ে আলতাফের এতই গর্ব যে স্কুলের ছুটি থাকলেই সে নিজেই বেরিয়ে পড়ে আকবরের প্রকাশনার বই ক্যানভাস করতে।
নিছক বন্ধু হিসেবে যে কাজিকে নিয়ে এসেছে আকবর, এ-কথা মনে হচ্ছে না এখতারউন্নেসার। এ বাড়িতে যেদিন প্রথম এল, সেদিনই দুপুর বেলা কলকাতায় তার বন্ধুদের দুখানা চিঠি লিখেছিল কাজি। আকবরকে বলেছিল চিঠি দুখানা কলকাতায় পাঠিয়ে দিতে হবে। খামে চিঠি দুটো ভরে নিজেই ঠিকানা লিখে দিয়েছিল সে। তখন সবাইকে চা দিচ্ছিল বুবু, আকবর বুবুকেই বলল চা দেওয়া হয়ে গেলে চিঠি দুখানা ওর ঘরে রেখে আসতে। ও পরে পোস্ট অফিসে নিয়ে গিয়ে পাঠিয়ে দেবে। চিঠি দুটো হাতে নিতে নিতে অসাবধানে এক ফোঁটা চা চলকে পড়ে একটা খামের উপর। সঙ্গে সঙ্গেই আঁচল দিয়ে সেটা মুছে নেয় বুবু, তবু খামটার উপর দাগ একটু ছিলই। কাজি বোধ হয় বন্ধুদের কাছ থেকে ওর চিঠির উত্তর আশা করছিল, এখনও না পেয়ে গতকাল ও আকবরকে জিজ্ঞেস করছিল চিঠি দু'খানা পাঠানো হয়েছে কিনা। আকবর বলল, নিশ্চয়ই। সে তো সেই দিনই পোস্ট অফিসে নিজে গিয়ে পাঠিয়ে দিয়ে এসেছে চিঠি দুটো। অথচ, আজই, আকবরের ঘরে ওর বইপত্র গুছিয়ে রাখতে গিয়ে সেই খামদুটোই দেখতে পেয়েছে বুবু! সেই চায়ের দাগ! খামের উপর সেই নজরুলের নিজের হাতের বড় বড় অক্ষরে লেখা ঠিকানা! এত খারাপ লাগল বুবুর! আকবর কি চায় না কাজি তার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে? আর, যোগাযোগ যদি রাখেও কাজি, আকবরের তাতে কী আসে যায়! এখতারউন্নেসার একবার মনে হল ছোটভাই আকবরকে ডেকে মিথ্যে কথা বলবার জন্যে ধমকায়। মিথ্যে কথা আকবর ছোট বেলাতেও বলত খুব। তখন তো ও কতবার ধমকেছে আকবরকে। কিন্তু এখন তো ওরা বড় হয়ে গেছে। এখন কি আগের মতো, সেই ইশকুলের দিনের মতো, ধমকানো যায় এত বিদ্বান ছোট ভাইকে?
আজই কাণ্ড ঘটল একটা। দুপুরের খাওয়া শেষ করে এই মাত্র ঘরে গিয়ে শুয়েছে নজরুল, এখন বুবু নিজের ভাত বেড়ে বসেছে। ওর সামনে আছে হেনা, ওদের ভাই ওয়ারেছ আলির মেয়ে। হেনার লেখাপড়ায় মন নেই একেবারে, এক বছর মাত্র স্কুলে গিয়েছিল, অনেক কান্নাকাটি করে সেটাও আপাতত বন্ধ। গত বছর তের পেরিয়ে চোদ্দয় পা দিয়েছে সে, কিন্তু সমবয়েসী মেয়েদের মতো গানবাজনা বা সাজগোজেও তার কোন উৎসাহ নেই। ফুফুকে রান্নাবান্নায় সাহায্য করা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন ব্যাপারেই কোন আগ্রহ নেই হেনার। ফুফুর পাতে তরকারি ফুরিয়েছে, তাই দেখে রসুইঘরে দৌড়িয়ে গিয়ে খানিকটা তরকারি নিয়ে এসে ফুফুর পাতে আগ্রহ করে যখন ঢেলে দিচ্ছে সে, ঠিক তখনই কোথা থেকে হঠাৎ আকবর আলি বাড়ির ভিতরে এসে ঢুকল; বাইরে কোথাও গিয়েছিল সে, বৈশাখের গরমে তাকে বেশ কাহিলই দেখাচ্ছিল। হেনার সঙ্গে দেখা হবে এমনটা ভাবেনি বোধ হয় আকবর, কিন্তু দেখা হতে সে কেমন যেন হঠাৎ রাগে ফেটে পড়ল।
তুই চুল বাঁধিসনি কেন, হেনা? – গলাটা বেশ রীতিমতো তুলেই বলে আকবর, কতবার তোকে বলেছি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ভদ্র-সভ্যদের মতো থাকবি বাড়িতে। আমি বাড়িতে থাকি না, কেউ বলেই না কিছু, ইশকুলে যাওয়া বন্ধ করেছিস একেবারেই। কাল যখন কাজি বসেছিল বাচ্চাদের নিয়ে গান শেখাতে সেখানেও তোকে দেখলাম না, কী ভেবেছিসটা কী তুই? শুধু এভাবে ধিঙ্গিপনা করেই চলে যাবে জীবনটা?
একটা কথারও জবাব দেয় না হেনা, কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে, মাথাটা নীচু, ভয়ে জুজু একেবারে। এখতারউন্নেসা বলে, এই তো বাঁধবে এবার চুল। যতক্ষণ না ফুফুর খাওয়া হচ্ছে, ওর ভালো লাগে না কিছু করতে। হেনার দিকে তাকিয়ে বলে, যা তো মা, চাচা বলছে, একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে আয়। যাঃ।
হেনার যাওয়াটুকুর জন্যেই অপেক্ষা। বুবুকে বলে আকবর, এই মেয়েটার ভবিষ্যত নিয়ে কিছু ভেবেছ তোমরা?
ভবিষ্যত নিয়ে ভেবে লাভ আছে কিছু? – বুবু বলে, যা ওর কপালে আছে হবে তা-ই।
তোমাদের এই সব কথা শুনলে আমি চুপ করে থাকতে পারি না বুবু, এটা কি একটা কথা হল? এখন কি আর সেই আগের দিন আছে? লেখাপড়া শিখল না, গান গাইতে ওর ভাল লাগে না – আসলে গানও তো লেখাপড়ারই ব্যাপার – কোন একটা গানের কথাগুলোও ঠিক মতো উচ্চারণ করতে পারে না। তের-চোদ্দ বছর বয়েস হয়েছে, কোথায় একটু সেজেগুজে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকবে, সে বুদ্ধিও নেই ওর মাথায়। ভেবে দেখ তো, এই যে নজরুল এসেছে, ওর আত্মীয়স্বজন বলতে কেউ নেই, অথচ কতো বড় কবি, কত গুণের ছেলে, কী চেহারা – ওর কাছে গিয়ে একটু গান শেখবার জন্যে বসতেও তো পারে। আমাদের পরিবারে তো আর সেই আগেকার দিনের মতো পর্দা নেই যে কেউ বারণ করছে! ধর, নজরুলের যদি চোখে লেগে যায় – কার চোখে কে যে লাগে কেউ বলতে পারে? – তাহলে ওর জীবনটাই তো বদলিয়ে যাবে।
বুবু বলে, নজরুলকে নিয়ে তোর কী হিসাব আছে তা তুই-ই জানিস। তবে যা তুই বললি সেটা যদি আমি ঠিক বুঝে থাকি তাহলে তোর ভাবনাটা তুই বদলা ভাই, বদলিয়ে ফেল। হেনার আব্বা কিন্তু তোর ভাবনাটা বুঝে ফেলেছে আগেই, ও তো বেশি কথা বলে না, কিন্তু সেদিন গজরাচ্ছিল। গজরাচ্ছিল আপন মনেই, কিন্তু মনে হল সবাইকে শোনাতেও চাইছে। বলছিল, কোথাকার একটা কবিয়ালকে ধরে বাড়িতে নিয়ে এসে রেখেছে। শুধু গান আর হৈ হুল্লোড় আর বাঁশি বাজানো। বাচ্চাকাচ্চাগুলো সব ঘিরে আছে হতভাগাটাকে সব সময়, কিসের থেকে কী হয়ে যাবে খেয়াল আছে কারো!
বুবুর কথা শুনে হতবাক আকবর। চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে উঠে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল সে।
ওদের বাড়ি থেকে একটু দূরে থাকে পরিবারের সবচেয়ে বড় মেয়ে আসমতুন্নেসা, সে-ও বিধবা, কিন্তু তার ছেলে একটি, মেয়েও আছে। ছেলে জাহাজে চাকরি করে, প্রায় সারা বছরই সে বাইরে-বাইরে, তাই ভাইদের বাড়ির কাছাকাছিই থাকে আসমতুন্নেসা ষোল-সতের বছরের অনূঢ়া মেয়ে দুবরাজকে নিয়ে। সেদিন বিকেলে তার বাড়িতে হাজির আকবর।
কী ব্যাপার বুবু, এতদিন তোমাদের কোন খবরই নেই অথচ আমাদের বাড়ি জমজমাট, বলতে বলতে বাড়ির একেবারে ভিতরে ঢুকে আসে সে।
কেন মামা, জমজমাট কেন? – হাসিমুখে প্রশ্ন করে দুবরাজ। তার মা বোধ হয় কোন কাজে এধার-ওধার কোথাও গিয়েছে।
আমার এক বন্ধু এসেছে কলকাতা থেকে, বলে আকবর। ওর নাম কাজি নজরুল ইসলাম। বিরাট বড় কবি, প্রায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো। আর শুধু কবিই নয়, গান লেখে, গান গায়, বাঁশি বাজায়।
এই পর্যন্ত বলতে বলতেই আসমতুন্নেসা হাজির, সে রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল। বলল, হিঁদু?
হিন্দু কেন হবে, আকবর বলে, মুসলমানের ছেলেরা বড় কবি হতে পারে না নাকি? তোমরা আসনি এতদিন, তাই ডাকতে এলাম। তৈরি হয়ে নাও, আমার সঙ্গেই এস।
বেলা প্রায় পড়ে এসেছে, বুবু বলে, এখনই অন্ধকার হয়ে যাবে। এখন গেলে ফিরতে ফিরতে রাত্তির। তার চেয়ে বরং কাল সকালে যাই। আমরাই চলে যাব, তোকে আসতে হবে না।
রাত্তির, তাতে কী হয়েছে? – বলে আকবর। ওখানেই থেকে যেও। ফিরবে না আজ।
কিন্তু আমি তো রান্না করে ফেলেছি। এই বৈশাখের গরমে খাবার রেখে এলে খারাপ হয়ে যাবে, আজ তুই যা, কালই আমরা যাব।
দুবরাজ বলে, কাল কেন মা, যেটা তু্মি রান্না করেছ, চল না আমরা নিয়েই যাই সেটা। ওখানকার রান্না, এখানকার রান্না, সব মিলিয়ে রাত্তিরে খাওয়া যাবে।
দেখেছ বুবু, তোমার মেয়ের বুদ্ধি তোমার চেয়ে অনেক বেশি, ঠিক ওর মামাদের মতো হয়েছে, হাসতে হাসতে বলে আকবর, কত সহজে সমাধান করে দিল তোমার সমস্যার।
সে তো জানি, ছদ্ম অভিমান বুবুর গলায়, কাঁটালের তরকারি চাপিয়ে এসেছি, যা তো মণি, একটু জল ঢেলে দিয়ে আয়, আমি ততক্ষণ তৈরি হয়ে নি'।