এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • সীমানা - ৩৪

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৯ আগস্ট ২০২৩ | ১৪৭৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ছবি: সুনন্দ পাত্র


    ৩৪

    বিদ্রোহী কবি ও কাব্যের মূল্য



    বুলবুল দাবি করলেও কাজি জানে ও পড়তে শেখেনি; সমস্তটাই অবিশ্বাস্য স্মৃতিশক্তি, মুখস্থ বিদ্যে! কাজির অনেক বন্ধুকেই বুলবুল চমকিয়ে দেয় ওর ছবিওয়ালা পাখির বইটা দেখিয়ে। যে-কোন পাতা খুলে ওকে পড়তে বললেই পাখির ছবি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ছবির ঠিক নীচে ইংরিজিতে লেখাটা পড়বে, যে প্রথমবার দেখবে তার মনে হতেই পারে ও পড়তে শিখে গেছে। তবুও কাজি বলল, ঠিক আছে, কোথায় উডপেকার আছে দেখা তো।

    অবলীলায় W-এর পাতাটা খুলে উডপেকারের ছবিটাকে দেখায় ও, তারপর ছবির নীচে যেখানে ইংরিজিতে পাখির নামটা লেখা আছে সেখানে আঙুল নিয়ে যায়; বলে, উডপেকার। এবার কী দেখাব, জেব্রা ডাভ?

    কাজি বলে, না, স্প্যারো। স্প্যারোও দেখানো হয়।

    বেশ তো, কাজি বলে, কাল সকাল থেকে a b c d পড়বি। আর সন্ধ্যেবেলা অ আ ক খ। মা'র কাছে।

    আমি মা'র কাছে পড়ব না। তোমার কাছে পড়ব।

    কাজি পিংলাকে বলে, এই একটা কায়দা শিখেছে, মা'র কাছে পড়ব না। তোমার কাছে পড়ব। অতিরিক্ত আদর পেয়ে পেয়ে এক্কেবারে বাঁদর হয়ে যাচ্ছে। এতদিনে অক্ষরপরিচয় তো নিশ্চয়ই হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু শিখবেই না।

    ওর বয়েস কত হল? – জিজ্ঞেস করে পিংলা।

    এই সেপ্টেম্বরে তিন পুরো হয়েছে, বলে কাজি, এতদিনে প্রথম ভাগ শেষ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল।

    পিংলা বলল, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ এখন একেবারে ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। সামনের মার্চে বোধ হয় য়্যোরোপ-আমেরিকায় যাবেন, তারই প্রস্তুতি চলছে এখন। এবারের প্রোগ্রাম প্রায় বছরখানেকের। ফিরলে, আমি বুলবুলকে পাঠভবনে ভর্তি করে নেবার কথা বলব। পরের সেশন শুরু হতে হতে ও তো প্রায় পাঁচ বছরের হয়ে যাবে। লেখাপড়া গানবাজনা ছবি-আঁকা – যা শিখতে চায় শিখুক না। শুনলুম, গানে ওর ভারী ঝোঁক।

    হ্যাঁ, জমীরুদ্দিন সাহেব তাই-ই বলছিলেন, কাজি বলে, হারমোনিয়ম বাজালেই রাগ চিনতে পারে, তার ওপর সাঙ্ঘাতিক তালের কান। শুধু একটাই দোষ, এখন থেকেই প্রচণ্ড আড্ডাবাজ। আমার বন্ধুরা কেউ এলেই তাদের সঙ্গে তাদের বাড়ি চলে যাবে। শুনেছি, কোথাও গিয়ে নিজের বাড়ির কথা নাকি বলেই না, রেগুলার আড্ডাবাজদের মতো অন্য সব বিষয়েই কথা বলে। আর খালি পাকা পাকা কথা শিখছে।

    কাজি এখন প্রতিদিন সকালে যায় গ্রামোফোন কম্পানীর রিহার্স্যাল রূমে; চিৎপুর, লক্ষ্মী ভবনে। নিয়মিত মাসোহারায় সে এখন গ্রামোফোন কম্পানির ট্রেনার। সেদিন রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে পিংলা বলে, কাল সকালেই আমি ফিরে যাব।

    এখনই শুয়ে পড়বি নাকি? – কাজি বলে, আমরা তো এখন তাস খেলব।

    তাস? তুমি তাস খেল নাকি? জানতুম না তো, বলে পিংলা, কখনও তো খেলতে দেখিনি আগে, দাবা খেলতে দেখেছি কখনও কখনও, কিন্তু তাস!...জানতুম না তো! আমি তো তাস খেলতেই জানি না।

    সে শিখে নিলেই জানবি। কিন্তু ইচ্ছে না হলে শুয়েই পড়। কাল সকালে আমার সঙ্গেই বেরোবি।

    চারজন লাগে তো, পিংলা ঠিক তখনই না উঠে বলতে থাকে, কে কে খেলবে তোমরা?

    তোর বৌদি, মাসিমা, আমি আর খুকু।

    খুকু?

    হ্যাঁ, খুকুর সঙ্গে আলাপ হয়নি তোর? বড্ড লাজুক...

    হ্যাঁ, দেখেছি একটা ছোট মেয়েকে, বার কয়েকই তো দেখলাম, কিন্তু পালিয়ে পালিয়ে যায়।

    এই খুকু, বলে হাঁক পাড়ে কাজি; বলে, আমার মেয়ে, ওর ভালো নাম শান্তি, শান্তিলতা।

    বলতে বলতে শান্তি আসে, কাজি আলাপ করিয়ে দেয়, আমার বন্ধু পিংলা।

    শান্তি ঠিক হাসে না, ধীরে ধীরে মাথা নাড়ায়। একটু আরষ্ট, কিন্তু বোঝা যায় পিংলা নামটা ওর অপরিচিত নয়।

    পরের দিন সকাল থেকেই কাজির বেরোবার প্রস্তুতি। অবিশ্যি সকালটাই দেরিতে শুরু হল। উনপঞ্চাশ নম্বর বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের ভূতপূর্ব কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার কাজি নজরুল ইসলাম আজকাল সকাল আটটাতেও ঘুম থেকে উঠতে পারে না। গতকাল রাতে ঘুম ভেঙে একবার উঠেছিল পিংলা, রাত তখন সোয়া দুটো, তখনও ওই তাস খেলার ঘরে আলো জ্বলছিল।

    কাজি ঘুম থেকে ওঠবার আগেই কিন্তু মসজিদবাড়ি স্ট্রীটের এই বাড়িতে জনসমাগম শুরু হয়ে গেছে। এক এক করে লোক আসছে তার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে। নীচে একটা আলাদা ঘরে তারা অপেক্ষা করছে। অনেকগুলো খবরের কাগজ আসে এ-বাড়িতে। তার মধ্যে একখানা পিংলাকে দিয়ে যায় খুকু, অন্যগুলো ভাগাভাগি করে পড়তে থাকে অপেক্ষমান দর্শনার্থীরা। রান্নাঘরে প্রমীলা আর তার মা ব্যস্ত, খুকু একমনে পান সাজতে বসেছে। একটু পরে চোখ মুছতে মুছতে বুলবুল এসে বসে খুকুর পাশে, কচি কচি হাতে পান সাজতে থাকে সে-ও, আর অনর্গল কথা বলে চলে খুকুর সঙ্গে, উত্তরের কোন প্রত্যাশা না-করেই!

    আধঘন্টাটাক পরে, যে ঘরে পিংলা কাজি ঢোকে সেখানে। তার পরনে ধুতি আর গরদের পাঞ্জাবি, কাঁধে ভাঁজ-করা একটা গেরুয়া রঙের চাদর, ভুরভুর করে সুগন্ধ ছড়াচ্ছে সে। পিংলা বলে, কী মেখেছ?

    হুঁ হুঁ বাবা, ফরাসী সেন্ট; স্নো-পাউডারও, কাজি জবাব দেয়।

    আচ্ছা? এ-সব কবে থেকে ধরলে?

    হো হো করে হাসে কাজি, জবাব দেয় না এ প্রশ্নের, বলে, চল্‌ খেয়ে নিই।

    কাজির পেছন পেছন যায় পিংলা। ঘরে ঢুকতেই একটা বড় আয়না চোখে পড়ে। মেঝেতে একটা মাদুরের ওপর এখনো স্নো-পাউডারের কৌটো পড়ে আছে। একটু দূরে দুটো পিঁড়ি পাতা পাশাপাশি, পিঁড়ি দুটোর প্রত্যেকটার সামনের মেঝেতে খানিকটা জায়গা ছেড়ে ওপরের দিকে একটু ডান দিক ঘেঁসে একটা করে জলভরা গেলাস। কাজি বসে একটা পিঁড়িতে, পিংলাও পাশেরটায়। একটু পরে প্রমীলা ঢোকে ঘরে, তার দুহাতে দুটো থালা। একটু পেছনে আসে খুকু, কেটলিতে চা বাঁ হাতে ধরা, আঙটায় আঙুল ঢুকিয়ে ডান হাতে দুখানা কাপ। প্রমীলা থালা রাখে কাজি আর পিংলার সামনে, তাতে দুখানা করে পরোটা আর ডিমের ওমলেট। ওমলেটগুলো বেশ পুরু, মনে হয় ভেতরে বেশ ভালোমতো পূর দেওয়া। থালা দুটো রেখেই দ্রুত বেরিয়ে যায় সে, একটু পরেই ফিরে আসে আরও পরোটা একটা থালায় সাজিয়ে। ততক্ষণে খেতে শুরু করে দিয়েছে ওরা, কাপে চা-ও ঢালা হয়ে গেছে খুকুর।

    প্রমীলা বলে, আরও পরোটা দেব কিন্তু।

    জবাব দেয় পিংলা, কাজিদাকে দেবেন। আমাকে আর নয়।

    কাজিদা নিলে তো, বলে প্রমীলা, আজ আপনার অনারে খাচ্ছে। অন্যদিন তো শুধু চা খেয়েই বেরিয়ে যায়, সারাদিন ধরে শুধু চা আর পান খেয়েই থাকে। গ্রামোফোন কম্পানির লোক একজন আসে আমাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে, দশরথ, তার কাছে শুনেছি ওখানেও কিছু খায় না।

    পরোটা আর নেয় না দুজনের কেউই, কাজি চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে খুকুকে জিজ্ঞেস করে, কতোজন অপেক্ষা করছে রে?

    ছ-সাতজন, বলে খুকু।

    ওদের বলে দে গ্রামোফোনে পৌঁছে যেতে। আমরা আসছি।

    রাস্তায় বেরিয়ে ট্রামের উদ্দেশে হাঁটতে থাকে ওরা। কাজি বলে, তোকে আজ আমার কর্মস্থল দেখাব। সারাদিনের খাটুনির বহরটা তুই দেখবি।

    শুধুই কি খাটুনি, কাজিদা? তুমি আনন্দ পাও না?

    পাই না বললে সত্যি কথা বলা হবে না, বলে কাজি, এই যে এত লোক আসে – গেলেই দেখতে পাবি – এক-একজন
    এক-একরকমের গান চায়; হারমোনিয়ম বাজাচ্ছি, মনে মনে গুনগুন করছি, লিখে ফেলছি এক-একটা গান, ওপর ওপর খানিকটা শিখিয়ে দিলুম, পাশের ঘরে সে চলে গেল প্র্যাকটিস করতে। পাশের ঘর থেকে মাঝে মাঝে আসে দেখাতে, দিনের শেষে রেকর্ড করার জন্যে সে রেডি এক্কেবারে! এরকম একজন নয়, দুজন নয়, বেশ পাঁচ-ছ' জন প্রত্যেক দিন। এক-একজনের এক-এক রকমের গান – কেউ রাগপ্রধান, গজল কেউ, কেউ-বা ভক্তিগীতি। ভক্তিগীতি মানে অনেক কিছুই হতে পারে, ধর রাধা কৃষ্ণ বিষয়ক গান হল, বা শুধুই ঈশ্বর বা প্রভুর উদ্দেশে জয়গান, অথবা ইসলামি গান। কাজেই, দিনের শেষে একটু যে শ্লাঘার বোধ হয় না তা নয়, কিন্তু ক্রিয়েটিভ কিছু করার যা আনন্দ...

    কাজি কথা শেষ করে না, ওর মনের মধ্যে একটা কষ্ট আছে পিংলা বুঝতে পারে। দুপুর অবধি পিংলা থাকে রিহার্স্যাল রূমে, লক্ষ্য করে সব। ঠিক যেমনটা কাজি বলছিল, অনেকে মিলে ঘিরে বসেছে ওকে, মুখে সব সময়ই পান; পাশে একটা পিকদান রাখা, মাঝে মাঝে না-চাইতেই চা এসে যায়। তারই মধ্যে মেঝেতে একটা কার্পেটে বসে কাজি, হারমোনিয়ম সামনে। হারমোনিয়মের ওপরেই একটা খাতা। কাজিকে কেউ বলল একটা কিছু, হারমোনিয়মটা একটু বাজিয়ে নিল কাজি চোখ বুজে, তারপর ওই খাতাতেই লিখল একটা-দুটো লাইন। আবার একটু হারমোনিয়ম, আবার খাতায় লেখা একটু। এই ভাবে গানটা পুরোটাই লেখা হল। একটু নীচু গলায় পুরো গানটা দুয়েকবার গাইল কাজি, যে সামনে বসে আছে তাকে বলল গলা মেলাতে। গলা মেলানোও হল, তারপর খাতাটা দেখে একটা কাগজে গানটা লিখে নিল লোকটা। সে-ই নিশ্চয়ই ভবিষ্যতের শিল্পী যার গলায় গানটা রেকর্ড করা হবে। কাগজটা নিয়ে এখন পাশের ঘরে চলে যায় সে গানটা অভ্যেস করতে।

    এভাবে তিনজনের গান লেখা এবং শেখা হয়ে গেলে পিংলা বলে কাজিদা, আমি এবার যাব। আর দেরি করলে ট্রেন পাব না।

    যাবি কী রে, কাজি বলে, খাবি তো কিছু।

    সকালে যা খাওয়া হয়েছে তারপর আর পেটে জায়গা নেই, বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় পিংলা, বলে, তোমাকে চিন্তা করতে হবে না তুমি কাজ কর।

    যথেষ্ট আদর-যত্ন পেয়েছে কাজির বাড়িতে, তবুও ভারাক্রান্ত মন পিংলার। এই কাজিদাকে তো ও চেনে না। হাওড়ায় যেখানে ওর জন্ম, যেখানে ওর কেটেছে ছেলেবেলা থেকে, সেখানকার একটা দৃশ্যের কথা ওর মনে পড়ে। যে-অঞ্চলে ওরা থাকে হাওড়ায়, রাস্তার দুপাশেই সেখানে ছোট ছোট কামারশালা বা লোহার কারখানা। ছেলেবেলায় কামারশালায় কাজ হচ্ছে দেখলেই ও দাঁড়িয়ে পড়ত। আগুন জ্বলছে একদিকে, তার ঠিক পাশেই বসে একটা লোক মাঝে মাঝেই ওপর থেকে নেমে আসা একটা দড়ি ধরে টান দিচ্ছে, আর আগুনটা বেড়ে বেড়ে যাচ্ছে, এটার নাম হাপর। সেই হাপরে গরম হচ্ছে কতকগুলো লোহার টুকরো। গরম হতে হতে লাল হয়ে যায় সেগুলো। পাশেই তিনজন লোক বসে আছে মুখোমুখি, ঠিক যেন জ্যামিতির অতএব-চিহ্ন। তাদের সামনে একটা লোহার বড়সড়ো ইঁটের মতো, তার মাঝখানে একটা গর্ত। মুখোমুখি-বসা লোক তিনজনের একজন আগুনের থেকে একটা গনগনে লাল-হয়ে-যাওয়া লোহার টুকরো সাঁড়াশি দিয়ে ধরে গর্তে রাখল খাড়া করে; রেখে, টুকরোটা ওই সাঁড়াশি দিয়ে ধরেই থাকল সে। টুকরোটা পুরোটাই ঢোকে না গর্তে, বেশ খানিকটা যেন জেগে আছে, গর্তের ওপর থেকে দেখা যায়। এখন, তিনজনের বাকি দুজন – তাদের হাতে লোহার হাতুড়ি – একের পর এক হাতুড়ি ঠুকতে লাগল ওই গর্ত-থেকে-বেরিয়ে-আসা অংশটায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই জেগে-থাকা অংশটুকু কেমন-যেন একটু চ্যাপ্টা মতন হয়ে গেল। যে-লোকটা সাঁড়াশি দিয়ে এতক্ষণ ধরে রেখেছে লোহার টুকরোটাকে, সে এবার তার পাশেই একটা জল-ভরা জায়গায় রেখে দেয় সেটা। ছ্যাঁক করে একটা শব্দ হয়। টুকরোটা এখন একটা বড়সড়ো পেরেকের মতো। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে যখন পিংলা দেখত এই পেরেক তৈরি করা, অবাক হত সে। লোহার টুকরোর পেরেক বনে-যাওয়ায় চমৎকারিত্ব আছে একটা নিশ্চয়ই, কিন্তু পিংলা অবাক হত লোকগুলোকে দেখে। কোন বাক্যবিনিময় নেই তাদের মধ্যে। চার-চারজন লোক এক জায়গায় বসে কাজ করছে, একেবারে কলের মতো; ঠিক সময়ে ঠিক কাজটা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অন্য কারো কোন অস্তিত্বই যেন নেই কারো কাছে। প্রত্যেকেই একা, আর সামনে শুধু একটা লোহার টুকরোর পেরেকে পরিবর্তন। কতক্ষণ যে দাঁড়িয়ে থেকে এই আশ্চর্য দৃশ্য দেখত পিংলা! হয়তো কখনও কখনও এক-দেড় ঘন্টার পর ওদের একজন হাই তুলতো একটা, বিরতি। তারপর বসে বসে বিড়ি খেত ওরা। বিড়ি খাওয়া শেষ হলে আবার কাজের শুরু।

    দিনের পর দিন পিংলা ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদের কাজ দেখেছে। হয়তো কখনো একজন থুতু ফেলতে বাইরে এসেছে একবার; পিংলাকে দেখেছে, বলেছে, কী খোকাবাবু ইশকুলে যাওনি? উত্তর শোনার জন্যে এমনকি অপেক্ষাও করেনি সে, ভেতরে ঢুকে গিয়ে আবার নিজের কাজ।

    পিংলা শুনেছে, কাজিদা আজকাল নানা জায়গায় নানা সভায় বলে বেড়াচ্ছে সে এখন কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছে। ছেড়ে তো দিতেই হবে; এই রিহার্স্যাল রূমের কাজই যার প্রধান কাজ, সে কবিতা লিখবে কোথা থেকে? কবিতা তো যন্ত্রে লেখা হয় না, সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত প্রতিদিন এভাবে একটার পর একটা সঙ্গীত রচনা করে তাতে সুর দিয়ে গায়ককে রেকর্ডিঙের জন্যে তৈরি করে দিতে হলে সেই সঙ্গীতজ্ঞকে তো যন্ত্র হতে হয়। কাজিদাকে লক্ষ্য করছিল সে; কাজিদাও অন্য কোন কথা বলে না, তার সামনে-বসা গান-জানা অন্য মানুষটাকে যেন হাতুড়ি-পিটিয়ে শিল্পীতে পরিবর্তন করার কাজ নিয়েছে সে। একটাও বেশি কথা নয়, হারমোনিয়মে গুনগুন করা, দুয়েক লাইন লেখা, হারমোনিয়ম বাজিয়ে সেই দুয়েক লাইন একটু গেয়ে নেওয়া, আবার গুনগুন, আবার লেখা দুয়েক লাইন..., এই ভাবে ধীরে ধীরে একটা গান-জানা মানুষকে রেকর্ড কম্পানীর শিল্পীতে পরিবর্তন করা! বিড়ি খাওয়ার বিরতিও নেই এখানে, একরাশ সাজা-পান রয়েছে পাশেই, তোল আর মুখে পোর। চা-এসে যায় না চাইতেই, বিরতির কোন প্রয়োজনই হয় না। কামারশালার কর্মী তো থুতু ফেলতেও বাইরে আসতে পারত মাঝে-মাঝে। কাজিদার পাশেই কিন্তু পিকদানিটাও রাখা! আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছিল পিংলা, কোন কোন লোক তাদের কাজিদাকে এমনকি হারমোনিয়মের ওপর রাখা খাতাটায় লিখতেও দিচ্ছিল না। প্রাথমিক গুনগুনানির পর যখন খাতাটায় হাত দিতে যাবে কাজিদা, ঠিক তখনই একটা কাগজ এগিয়ে দিচ্ছিল তারা। নিজের খাতায় না-লিখে ওদের ওই কাগজটাতেই গানটা লিখে দিচ্ছিল কাজিদা। লোকটার হয়তো সুবিধে হল তাতে, খাতা থেকে নকল করার পরিশ্রমটুকু বেঁচে গেল! কিন্তু এতে যে আরও একটা ঘটনা ঘটছিল তা কি কোনদিন কাজিদা ভেবে দেখেছে? গানটার এমনকি একটা নকলও রইল না নিজের কাছে।
    এ-গান কার লেখা তা কি ইতিহাস ভবিষ্যতে বলতে পারবে?

    গতকাল যখন অ্যালবার্ট হলে কাজিদাকে বাংলার জাতীয় কবি ঘোষণা করে শ্রেষ্ঠ বাঙালিরা সম্বর্ধনা দিচ্ছিলেন, তাঁরা বারবার করে তাকে বিদ্রোহী কবি আখ্যা দিচ্ছিলেন তখন; কবিতা আর গানের সূক্ষ্ম ভিন্নতাবিভাগের তো কোন প্রয়োজনই ছিল না সেদিন। সুভাষবাবু তো স্পষ্টই বললেন, “নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বলা হয় – এটা সত্য কথা। তাঁর অন্তরটা যে বিদ্রোহী, তা স্পষ্ট বুঝা যায়। আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব – তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান গাইব। আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সর্বদাই ঘুরে বেড়াই, বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত শুনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু নজরুলের 'দুর্গম-গিরি-কান্তার-মরু'র মত প্রাণ-মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না।” কাজিদা নিজেও তো সম্বর্ধনার উত্তরে বলেছিল,
    “...আমি জানি, আমাকে পরিপূর্ণরূপে আজও দিতে পারিনি; আমার দেবার ক্ষুধা আজও মেটেনি। যে উচ্চ গিরিশিখরের পলাতক সাগরসন্ধানী জলস্রোত আমি, সেই গিরিশিখরের মহিমাকে যেন খর্ব না করি, যেন মরুপথে পথ না হারাই!– এই আশীর্বাদ আপনারা করুন।”

    পিংলার বারবার মনে হচ্ছিল, গ্রামোফোন কম্পানীর এই রিহার্স্যাল রূমই কাজিদার সেই মরুপথ। সাবধান না-হলে এই মরূপথেই তার পথ হারাবার সম্ভাবনা। অথচ এ-ও তো ঠিক, এই গ্রামোফোন কম্পানীই আজ কাজিদাকে খানিকটা অর্থস্বাচ্ছল্যের আস্বাদ দিয়েছে। কাজিদার কবিতার দারুণ চাহিদা, ছাপা হলেই হু হু করে বিক্রি শুরু হয়ে যায়। তারপর এক মাস হলেই শোনা যায় বইখানাই হয়তো বাজেয়াপ্ত করে দিয়েছে সরকার। বাজেয়াপ্ত-হওয়া অনেক বইই পড়ে থাকে নানা জায়গায়। এ-বই আপাতত আর ছাপা হবে না জেনে অনেক বেশি অর্থমূল্যে তা কিনতে রাজি থাকে অনেক পাঠক। বিক্রিও হয় আড়ালে। কিন্তু সে-টাকা শেষ পর্যন্ত আসে কি কাজিদার কাছে? স্বভাবতই অর্থাভাবগ্রস্ত – অথচ হাতে দুপয়সা এলে চার পয়সা খরচ না করতে পারলে যে তৃপ্ত হয় না – বাজারে সেই কাজিদার অতএব ঋণ অঢেল। ঋণ শোধ করতে গ্রন্থস্বত্ব বিক্রি – এবং অবশ্যই উচিত মূল্যের ভগ্নাংশমাত্র সানন্দে গ্রহণ করা! এই ভাবে গ্রন্থস্বত্ব খোয়াবার জুড়ি মেলে না কাজিদার। সে ক্ষেত্রে আজ তো এ-কথা মানতেই হয় যে, গ্রামোফোন কম্পানীই বাঁচিয়ে দিল কাজিদা আর তার পরিবারকে!

    অথচ, এই গ্রামোফোন কম্পানীর হাত থেকেই এখন তাকে বাঁচাতে হবে। তার অন্তরাত্মা তা না হলে বাঁচবে কীভাবে? কবিতা ছাড়া কাজিদাকে কি ভাবা যায়? সারাদিন ধরে এক জায়গায় বসে অন্যের মর্জিমাফিক গান লেখ, সুর দাও সঙ্গে সঙ্গে, গান শেখাও একের পর এক তথাকথিত শিল্পীকে, সমস্ত ভাবনা-চিন্তা-কল্পনার উৎসমুখকে বেঁধে রাখ প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে, আর তারপর বিধ্বস্ত মন নিয়ে রাতের বেলায় খেলতে বোসো অকিঞ্চিৎকর তাসের খেলা যতক্ষণ না ঘুম আসে। পরের দিন আবার এই নিয়মই চক্রবৎ! তারপরও কি আর কবিতা আসে! পিংলার মনে পড়ে মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের কথা। এই একটিমাত্র লোকই হয়তো বাঁচাতে পারত তাকে। সে আজ বন্দী!

    ঠিক দু'সপ্তাহ পর – ডিসেম্বরের একত্রিশ তারিখে – মনোমোহন থিয়েটারে মন্মথ রায়ের গীতিনাট্য মহুয়া মঞ্চস্থ হল। সরযূবালার কণ্ঠে পনের-ষোলখানা গান মাতিয়ে দিল মঞ্চ। সবই নজরুলের লেখা এবং সুর। বিশেষ করে এই নাটকের জন্যেই যে গানগুলো সব লেখা হয়েছিল তা নয় কিন্তু; অনেক গানই আগে লেখা, ঠিক জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল নাটকে। তবুও, দর্শকদের উচ্ছ্বাস এবার কাজিকে এনে দিল নতুন এক সম্ভাবনার সামনে। কাব্য থেকে দৃশ্যকাব্য। নাটক এবং হয়তো বা চলচ্চিত্রও! নাটক মঞ্চসফল হলেই নতুন বাজার খুলে যায় গানের, শুরু হয় গানের রেকর্ড বিক্রি। লোকের মুখে মুখে এখন কাজিদার গান। সেক্ষেত্রে বইয়ের প্রকাশকই বা অলস থাকে কেন! তের পৃষ্ঠার মহুয়ার গান – কথা ও সুর কাজি নজরুল ইসলাম – ডি-এম লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত হয়ে ঘুরতে থাকে লোকের হাতে হাতে! শুধু বই বিক্রি নয়, এখন কাজির হাতে আসে রেকর্ড বিক্রির স্বত্বের ভাগও! কবিতা আর লিখতে পারে না কাজিদা, স্নো-পাউডারের প্রসাধনে আর ফরাসী সৌরভে কবিতার উৎসমুখ কি চাপা পড়ে যায়!

    কবিতার উৎসমুখ ঠিক কোথায়? মস্তিষ্কে? নাকি হৃদয়ের মাঝখানে কোথাও? পল্টনে যখন ছিল কাজি, পঞ্জাবী এক মৌলভী সাহেব তখন ওদের ব্যারাকেই থাকতেন। তাঁর কাছেই সে পড়েছিল ওমর খৈয়াম আর হাফিজ। হাফিজের কয়েকটা গজলের অনুবাদও সে করেছিল কলকাতায় এসে। কয়েকটার পর আর হয়ে ওঠেনি। সিলেটের ছাত্রদের এক সভায় ওর কণ্ঠে 'বাজল কি রে ভোরের সানাই নিদ্‌মহলার আঁধার-পুরে' শুনে ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ-এর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল ডক্টর মহম্মদ শহীদুল্লার। সে-কথা তিনি বলেওছিলেন কাজিকে। বলেছিলেন, তিনি নিজে ওমর খৈয়াম পড়েছেন ফিট্‌জেরাল্ডের ইংরিজি অনুবাদে; ওই ফিট্‌জেরাল্ডই বাংলার অনেককেই অনুপ্রাণিত করেছেন ওমরের বাংলা ভাবানুবাদ করতে।

    কাজি এখন ভাবে, নিজে যখন সে কবিতা লেখে, না-লেখা লাইনগুলো তার শরীরে – মস্তিষ্কে না হৃদয়ে – না রক্তে – না অন্য কোথাও – এমনভাবে তাণ্ডব শুরু করে যে তখন না-লিখে সে পারে না, না-লিখে তার মুক্তি নেই। সেই তাণ্ডব সে এখন বুঝছে না ঠিকই, কিন্তু কবিতা ছাড়া তার নিজের অস্তিত্ব কোথায়? কবিতা তো তাকে লিখতে হবেই। সন্ধ্যের পর গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূম থেকে ফিরে সে তার সংগ্রহের হাফিজের রুবাইয়াতগুলো খুলে বসে। হাফিজ অনুবাদ করলে কেমন হয়?

    ধীরে ধীরে পল্টনের দিনে যেন ফিরে যায় কাজি। হাফিজ পড়তে পড়তে সে-ই পল্টনের দিনগুলোয়, যখন মৌলভী সাহেবের কণ্ঠে শুনত হাফিজ আর ওমর খৈয়াম – আর শুনে সেই কণ্ঠধ্বনির অনুরণন হত নিজের মনের মধ্যে – সেই দিনগুলোর কথা তার মনে পড়ে। সে এখন স্থিরচিত্ত, বাংলায় হাফিজের অনুবাদ সে করবে। তাস খেলা বন্ধ এখন, সারাদিন সে মনে মনে অপেক্ষা করে সন্ধ্যেবেলা কখন বাড়ি ফিরে হাফিজ নিয়ে বসতে পারবে।

    কাজির এই নতুন উত্তেজনার মধ্যেই নববর্ষের উৎসবের ঠিক পরে-পরেই জ্বরে পড়ল বুলবুল। প্রথমে সাধারণ জ্বর সর্দিকাশি মনে হয়েছিল, তিন-চারদিন পর জ্বরটা একশো চার ডিগ্রী ছাড়াল। এবং প্রবল ব্যথা সর্বাঙ্গে। মাথায় বরফ দিয়ে জ্বর নামাতে হয়; আশপাশের ডাক্তাররা প্রথম দিকে কয়েকদিনের মধ্যেই কমে যাবার আশ্বাস দিলেও জ্বর কমবার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। এমন সময় একটা-দুটো করে গুটি দেখা যায় গায়ে, এবং এ-জ্বর যে গুটিবসন্তের তা বোঝা যায় নির্ভুলভাবে । এবার ডাক্তার ছেড়ে হোমিওপ্যাথ-কবিরাজ-হেকিম-নখদর্পণ-জলপড়া-সাধুবাবা-কবচ-তাবিজ – বাকি থাকে না কিছুই। দিনের বেলা কাজি বাড়িতে থাকে না, সন্ধ্যেবেলা ফিরেই সে বুলবুলের শিয়রের পাশে বসে রোজ, কিছুক্ষণ গল্প বলে গান গেয়ে তাকে ভোলাতে চেষ্টা করে। এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে বুলবুল, তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জল; খাতাবই নিয়ে কাজি খুলে বসে হাফিজ, সারারাত কেটে যায় এ-ভাবেই বুলবুলের শিয়রের পাশে।

    নিদারুণ কষ্টে কয়েক সপ্তাহ কাটল বুলবুলের, তারপরেই সব শেষ মে মাসের সাত তারিখে। হতবাক কাজি ছেলের মৃতদেহের দিকে তাকায়; বুলবুলের শরীর অর্ধেক হয়ে গেছে; তার উজ্জ্বল গৌরবর্ণ শরীরে এখন অদ্ভুত কয়েকটা বর্ণের সমাহার – এই গাত্রবর্ণ কি মৃত্যুরই? – বুঝতে পারে না কাজি, চেহারায় প্রায় চেনাই যায় না বুলবুলকে; তার চোখেও গুটি বেরিয়েছিল, মৃত্যুর আগে নিশ্চয়ই প্রবল কষ্ট পেয়েছিল সে, চোখ থেকে গড়িয়ে এসেছিল যে জল তা শুকিয়ে চিহ্ণ রেখে গেছে! বাঁচলে হয়তো বুলবুল অন্ধই হয়ে যেত। প্রমীলার চোখের জল বাধা মানে না, গিরিবালা প্রস্তরবৎ নির্বাক হয়ে বসে আছেন। পানবাগানের বাড়িতে জন্ম হয়েছিল সানির, তার বয়েস এখন এক বছরের একটু বেশি, সব কিছু দেখে সে-ও হয়তো বুঝেছে কিছু; কাঁদে না সে একটুও, ক্রন্দনরতা মায়ের কোলে শুয়ে পড়ে, মা ভেঙে পড়ে বুক-ভাঙা কান্নায়।

    বুক-চাপা কান্না বুকেই রেখে কাজি প্রয়োজনীয় পিতৃকৃত্য সারে। তার নিয়মিত কাজকর্ম চলে পূর্ববৎ, গ্রামোফোন কম্পানীর রিহার্স্যাল রূমেও তাকে প্রাত্যহিক কাজ করতে দেখা যায়, এমনকী নানা সভায় এবং অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়া বা গান গাওয়াও বন্ধ হয় না। রাতের তাস খেলাটা বন্ধ করে দেয় কাজি, সেই সময়টা প্রায়-সমাপ্ত হাফিজ অনুবাদের সম্পাদনার কাজ চালিয়ে যায় সে। তার তাড়া আছে; হাফিজ, একমাত্র হাফিজই সে সদ্য দেহান্তরিত বুলবুলকে দিতে পারে!

    দিলও তা-ই। কয়েকদিনের মধ্যেই প্রবল পরিশ্রম করে শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী অ্যাণ্ড সন্স প্রকাশ করে দিলেন মূল পারসি থেকে কাজিকৃত তিয়াত্তরটি রুবাইয়ের অনুবাদ, রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ, মূল পারসির ছন্দ অবিকৃত রেখে। বুলবুলকে এই গ্রন্থ উৎসর্গ করে কাজি লিখল:

    “বাবা বুলবুল!

    “তোমার মৃত্যু শিয়রে বসে বুলবুল-ই-শিরাজ হাফিজের রুবাইয়াতের অনুবাদ আরম্ভ করি।

    “যেদিন অনুবাদ শেষ করে উঠলাম, সেদিন তুমি আমার কাননের বুলবুলি উড়ে গেছ। যে দেশে গেছ তুমি, সে কি বুলবুলিস্তান ইরানের চেয়েও সুন্দর?

    “জানি না তু্মি কোথায়। যে লোকেই থাক, তোমার শোক-সন্তপ্ত পিতার এই শেষদান চুম্বন বলে গ্রহণ করো।

    “তোমার চার বছরের কচি গলায় যে সুর শিখে গেলে, তা ইরানের বুলবুলিকেও বিস্ময়ান্বিত করে তুলবে।...”

    এই অনুবাদকাব্যের ছোট্ট ভূমিকাটি হাফিজের-সঙ্গে-প্রায়-অপরিচিত বাঙালি পাঠকের হাফিজ-পাঠের প্রস্তুতি হিসেবে যেমন প্রয়োজনীয় এবং আকর্ষক, নজরুলের ব্যক্তিগত আবেগেরও ঠিক তেমনই কবিসুলভ বুক-ভাঙা উপস্থাপনও বটে:

    “...যেদিন অনুবাদ শেষ হল, সেদিন আমার খোকা বুলবুল চলে গেছে।

    “আমার জীবনের যা ছিল প্রিয়তম, যা ছিল শ্রেয়তম, তারই নজরানা দিয়ে শিরাজের বুলবুল-কবিকে বাংলায় আমন্ত্রণ করে আনলাম।

    “বাংলার শাসনকর্তা গিয়াসুদ্দিনের আমন্ত্রণকে ইরানের কবি-সম্রাট হাফিজ উপেক্ষা করেছিলেন। আমার আহ্বান উপেক্ষিত হয়নি। যে পথ দিয়ে আমার পুত্রের 'জানাজা' (শবযান) চলে গেল, সেই পথ দিয়ে আমার বন্ধু, আমার প্রিয়তম ইরানি কবি আমার দ্বারে এলেন। আমার চোখের জলে তাঁর চরণ অভিষিক্ত হল।”...

    নানা পত্রিকায় প্রশংসা পেল বুলবুল-ই-শিরাজ। বিক্রিও হল ভালোই, কিন্তু কাজির হাতে এখনো তার সেই পরিচিত বিদ্রোহী কবিতা আর আসে না। কেমন-যেন নিরুত্তাপ তার জীবন এখন। সে আগে যে বিদ্রোহী কবিতা লিখত; সেই কবিতার নানা অলঙ্কার, আবেগের প্রকাশে ইতিহাস-পুরাণের নানা চরিত্রের আবির্ভাব, প্রায়শই তৈরি করত বিরোধ। বিশেষ করে ধর্ম-সওদাগর এবং তাদের চেলাদের কোলাহল-বিতর্ক। কেউ শাসাতো কাজিকে, অভিসম্পাত দিত কেউ। কবিতা লেখা বন্ধ হয়ে এ-সবও বন্ধ হয়ে গেছে। তার নির্দোষ সঙ্গীত এখন আর তেমন বিচলিত করে না কারোকে। কাজেই ধর্মান্ধদের বিরূপতা কমে গেছে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তার গান এখন ঘরে ঘরে; কিন্তু মানুষ-কাজিকে নিয়ে, কবি-কাজিকে নিয়ে আলোচনা কমে গেছে অনেকটাই। কাজি এখন প্রায় ব্যক্তিগত মানুষ। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে যখন লাহোর জেলে তেষট্টি দিন অনশনের পর মৃত্যু হল যতীন দাসের, সেই যতীন দাসের মরদেহ বহন করে হাওড়া স্টেশন থেকে সুভাষবাবুর নেতৃত্বে যখন লক্ষ লক্ষ লোকের দু-তিন মাইল দীর্ঘ মিছিল শহরের রাস্তায় হেঁটেছিল, কাজি যোগ দেয়নি তাতে; এই বছরেই এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সাহস দেখিয়েছে একদল তরুণ বাঙালি; এই আগস্টেই তো চার্লস টেগার্টের মতো ঘৃণিত পুলিশ কমিশনারের উপর লালবাজার থেকে ঢিল-ছোঁড়া-দূরত্বে বোমার আক্রমণ চালিয়ে নিহত হয়েছে আর এক বাঙালি তরুণ। কাজির কি কিছু এসে গেছে তাতে? অন্তত কোন পত্রিকাতে কাজির কোন বিদ্রোহী কবিতা তো দেখেনি কেউ।

    এমন সময় ব্রজবিহারী বর্মনের সঙ্গে আলোচনা করে কাজির অগ্রন্থিত কিছু কবিতা – ব্রজবিহারীর ভাষায় “গরম গরম কবিতা” – প্রলয়শিখা নামে এক কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হল, কতদিন আর নীরবে বৃটিশ সরকারের সব অন্যায়ই মেনে নেওয়া যায়! যতীন দাসের স্মৃতিতেও এবার ছাপা হল কবিতা। প্রকাশক ও মুদ্রাকর কাজি নিজেই, কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটের মহামায়া প্রেস থেকে মুদ্রিত হয়ে কাজির বাসস্থান, পঞ্চাশের দুই মসজিদবাড়ি স্ট্রীট, এই গ্রন্থের ঘোষিত প্রকাশস্থান। বোধ হয় তার কবিতার যাবতীয় দায় কাজি এবার একাই নিতে চায়। ব্রজবিহারী বর্মন শুধুই পরিবেশক।

    সেপ্টেম্বরে শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী অ্যাণ্ড সন্স প্রকাশ করল নজরুল-গীতিকা নামে একশো সাতাশখানা নজরুলগীতির একটা সঙ্কলন, নজরুলের গানের বিপুল বৈচিত্র্যের – ঠুংরি গজল ধ্রুপদ কীর্তন বাউল ভাটিয়ালি টপ্পা খেয়ালের – এক সহজবহ সমাবেশ। এরকম একটা সঙ্কলন হাতের সামনে পেলে 'কাজিদার গান'-এর প্রেমিক বাঙালিদের চোখ তা এড়াবে না, এমনটা জানা ছিল ব্যবসায়ী প্রকাশকের। কিন্তু ধূমকেতুর নজরুল ইসলাম তো এখনো বেঁচে।
    নজরুল-গীতিকার অন্য অংশগুলোর সঙ্গে কাজি জুড়ে দিল জাতীয় সঙ্গীত শিরোনামে আরও কয়েকটি গান। সঙ্গে গেল মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের অনুরোধে কাজিকৃত অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীতও, যদিও পূর্বপ্রকাশিত সঞ্চিতা কবিতাসঙ্কলন গ্রন্থেও ছাপা হয়েছিল এই গানখানা।

    এবং নভেম্বরে আবার গ্রেপ্তার হল কাজি।

    চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন রোধ করা গেছে ঠিকই, কিন্তু বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সূর্য সেন এখনও অধরা, এবং সেই অবস্থায় পুলিশের সর্বাধিনায়ক চার্লস টেগার্টের ওপরও আক্রমণ! আক্রমণ কলকাতার প্রকাশ্য রাজপথে! এই অবস্থাতেও নজরুল তার প্রলয়শিখায় ছেপেছে নব-ভারতের হলদিঘাট! যতীন মুখুজ্জের বালেশ্বর-লড়াইয়ের স্মরণে! যে যতীন আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে ব্রিটিশ শাসনকে চুরমার করতে চেয়েছিল! বাঘাযতীন নামে খ্যাত ব্রিটিশ সরকারের সেই তথাকথিত শত্রুর বীরত্বে উচ্ছ্বসিত কবিতা! শুধু তা-ই নয়, এবার তার প্রলয়শিখায় সে কবিতা লিখেছে ভগত সিং-শিবরাম রাজগুরুর সহকর্মী শহীদ যতীন দাসকে নিয়েও। গানের বইতে আবার ছেপেছে অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত! আর বিশ্বাস নেই কোন বাঙালিকে। ধূমকেতুর নজরুল, ছেলে-খেপানো নজরুলকেও কোন-মতেই বিশ্বাস করা যায় না! আনন্দবাজার জানালো:

    কবি নজরুল ইসলামকে অদ্য ১২৪ (ক) ধারা অনুসারে রাজদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করিয়া প্রধান প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে উপস্থিত করা হইয়াছিল। তাঁহাকে পাঁচ শত টাকার জামিনে মুক্তি দেওয়া হইয়াছে। 'প্রলয়শিখা' নামে কবির লিখিত এক পুস্তিকা সম্বন্ধেই এই অভিযোগ উপস্থিত করা হইয়াছে।

    প্রলয়শিখা তো এর আগে সেপ্টেম্বরেই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, তার পরেও রাজদ্রোহের অভিযোগে কাজিও গ্রেপ্তার! এত ভয় কবিকে! এ ঘটনা তো প্রায় নজিরবিহীন – আদালতে কাজির পক্ষের আইনবিদ কেশব গুপ্ত বিস্ময় প্রকাশ করেন।

    বেশ কয়েকবার মামলা মুলতুবি রাখবার পর পনেরই ডিসেম্বর প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট রক্‌স্‌বার্গ কাজিকে ছ'মাসের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলেন। হাইকোর্ট অবিশ্যি জামিনে কিছুদিনের জন্যে রেহাই দেয় কাজিকে, সঙ্গে-সঙ্গেই তার হাজতবাস শুরু হয় না। অবশেষে গান্ধী-আরউইন চুক্তি অনুসারে উনিশশো একত্রিশের মার্চে তার সাজা একেবারেই মকুব হয়। প্রলয়শিখা কিন্তু কারান্তরালেই থাকে। কাব্যের মুক্তি হয়নি।



    ক্রমশ...

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৯ আগস্ট ২০২৩ | ১৪৭৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন