সর্ব প্রথমে বন্দনা গাই
তোমারই ওগো বারিতালা।
তারপরে দরুদ পড়ি
মোহাম্মদ সাল্লেয়ালা।।
সকল পীর আর দেবতা-কুলে
সকল গুরুর চরণ মূলে
জানাই সেলাম হস্ত তুলে
দোওয়া কর তোমরা সবে,
হয় যেন গো মুখ উজাল্লা।
সর্বপ্রথমে বন্দনা গাই তোমারই
ওগো খোদাতাল্লা।
এ-গান আমার বছর দশেক বয়েসের রচনা, বলে কাজি। জ্ঞান হয়ে অবধি গান গাইছি। কে যে আমাকে দিয়ে রচনা করায় আর কে গাওয়ায়, বুঝতে পারি না।
এ তো লেটোপালার মুখপাতের গান, তাই না? – বলে নলিনী।
হ্যাঁ, লেটো। কিন্তু দেখ, সকল পীর আর দেবতা-কুলে যখন গাইছি, তখন এক এবং একই মাত্র সর্বশক্তিমান আল্লার কথা মনেও তো আসেনি আমার, গেয়েছি দেবতা কুল! কুল, খেয়াল কর! আসলে, হিন্দু-মুসলমানের ঝগড়া-ঝাঁটিটা তো বাঁধানো হল প্ল্যান করে; আমাদের ছেলেবেলায় এ-গান হিন্দুরাও শুনতো, মুসলমানরাও। তার জন্যে কাফেরও হতে হয়নি কাউকে, জাতও খোয়াতে হয়নি কারো। হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলেই মজা করে শুনতো লেটোর গান।
আড্ডা হচ্ছিল জেলেটোলায় নলিনী সরকারের বাড়িতে। কাজি আর নলিনীদা ছাড়া সেখানে ছিল দুলিও। সাধারণত বন্ধুদের সঙ্গে কাজির আড্ডায় দুলি থাকে না, সে বিয়ের পর থেকেই অন্তঃপুরবাসিনী। জেলেটোলায় থাকতে এল যখন, নলিনী বলল, দেখ প্রমীলা, আমার বাড়িতে রান্নার লোক আছে, তা ছাড়া আছে আমার গিন্নীও। কাজেই তোমার সারাদিন ধরে উনুনের আঁচের ধারে বসে থাকার দরকার নেই। রান্নাঘরে থাকবার জন্যে নেহাৎই যদি মন আঁকুপাকু করে, তাহলে একটু-আধটু কুটনো কুটে রাঁধুনীকে সাহায্য করতে পার তুমি! কিন্তু কাউকে বলা নেই কওয়া নেই, সে কাজটা নিয়ে নিয়েছেন দুলির মা গিরিবালা, সঙ্গে নাতির খিদমতগারিটাও। দুলি তাই আপাতত বেকার, তা ছাড়া সে এখন সন্তানসম্ভবাও, তাই বহুদিন পর কাজির বন্ধুদের আড্ডায় তাকে দেখা যাচ্ছে আজকাল।
দুলি বলে ওঠে, আর-একটা মজার গান আছে ওর, সেটা বোধ হয় কবিগানের তরজায় গাইবার। কাজিকে বলে, শুনিয়ে দাও না সেটাও। হুঁ, কাজি বলে, সেটাও একটা মজার ব্যাপার ছিল, কবিগান। তবে সেটা আরও বছর দুয়েক পর। তখন মসজিদের মাদ্রাসায় পড়া এবং পড়ানো শেষ করে স্কুলেও যাই মাঝে মাঝে। ইংরিজি শিখছি একটু একটু, সে বিদ্যেও ফলাচ্ছি গানে। শুনবে?
ওহে ছড়াদার, ওহে that পাল্লাদার
মস্ত বড় mad,
চেহারাটাও monkey like
দেখতে ভারী cad!
monkey লড়বে বাবারণ সাথ
ইয়ে বড়া তাজ্জব বাৎ।
জানে না ও ছোট্ট হলেও
হামভি lion lad!
এবার বাকিটাও শোন,
শোন ও ভাইbrother দোহার গণ
মচ্ছর ছানারা সব করিয়াছে পণ
গান গাইবে আমার মাঝে
খবর বড় sad!
শিয়ারশোলের ইশকুলে যখন ভর্তি হলুম, কাজি বলতে থাকে, তখন আমার কবিতা নজরে পড়ল হেড স্যর নগেন্দ্রবাবুর। তিনি মাঝে-মাঝেই আমার কবিতার খাতা দেখতে চাইতেন; দেখে, ছন্দ-টন্দ নিয়ে খানিকটা আলোচনাও করতেন। মাঝে মাঝে এক-আধটা শব্দ এক-আধটা লাইন বদলিয়ে দেবার উপদেশও দিতেন স্যর। তিনিই স্কুলের আর একজন মাষ্টারমশাই, সতীশবাবু স্যর, সতীশ কাঞ্জিলাল – শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা করতেন তিনি নিয়মিত – তাঁর কাছে আমার কথা বলেছিলেন। কাঞ্জিলাল স্যর আমাকে তাঁর বাড়ীতে নিয়ে গেছেন অনেকবার। তাঁর কাছে সঙ্গীতের গোড়ার কথা কিছু কিছু শিখেছি। কিন্তু সেখানে গিয়ে আরেকটা লাভ হল আমার। কী জানো? স্যরের বাড়ির কর্ত্রী ছিলেন একজন বিধবা মহিলা, তিনি স্যরের দিদি ছিলেন না পিসি আমি ভুলে গেছি এতদিনে। তিনি অনেক মজার মজার পুরোনো বাংলা গান জানতেন। সে গানে আসছি। তার আগে তাঁর সম্বন্ধে আরও কিছু বলি। পদবিতে কাঞ্জিলাল; বুঝতে পারছ তো, কুলীন ব্রাহ্মণবংশের বাল্যবিধবা, বৈধব্যের সমস্ত রকমের কঠিন নিয়ম মেনে চলতেন তিনি; বলব মেনে চলতেন হাসি মুখেই; কারণ সাধারণ একটা থান কাপড়, ন্যাড়ামাথা – এই মহিলার মজার মজার গল্প আর গান হামেশাই শুনেছি আমি, আমার সেই অল্প বয়েসে কখনও তাঁর হাসিমুখ ছাড়া আর কিছু দেখিনি। ধার্মিক মহিলা, সব রকমের পুজো-আর্চা, ব্রত-ট্রত সবই করতেন, কিন্তু গানগুলো তাঁর – কী বলব! – ধার্মিক গান না অন্য কিছু? তাঁর গান শোন একটা এবার:
ও বৃন্দে দূতী রে,
তোদের কালায় নাকি পেঁচোয় পেয়েছে।
কালা শুয়ে ছিল গোপীর গোয়ালে
তাইতে তোদের কালায় নাকি পেঁচোয় পেয়েছে।
ও কোথা রাধা রূপসী
ও গোবিন্দে প্রাণগোবিন্দে দেখ গো আসি।
তোদের কালা-র এবার বেজায় কাশি
বাঁচে কি না-বাঁচে।
বৃন্দা হল শ্রীরাধার সখী, কাজি বলে চলে, সম্বোধনে বৃন্দে তাহলে রাধার সখীকে বলা হচ্ছে। কী বলা হচ্ছে? তোদের কালায় নাকি পেঁচোয় পেয়েছে। কালা কে? গাত্রবর্ণ কালো, কালা তাই সখাসখীদের কাছে শ্রীকৃষ্ণের ডাকনাম। তাকে পেঁচোয় – অর্থাৎ ভূতে – ধরেছে। ভেবে দেখ, শ্রীকৃষ্ণকেও ভূতে ধরে! আর কেন ধরে? কীভাবে? সে নাকি গোপীর গোয়ালে শুয়েছিল। গোপী কৃষ্ণেরও সখী, রাধারও। তাহলে সেই সখীর গোয়ালে কী মতলবে কালা – এমনকি ভূতে ধরবার সম্ভাবনা সত্ত্বেও – কেন লুকিয়ে লুকিয়ে শুয়েছিল – তা সহজেই অনুমেয়। আর কালাকে যে পেঁচোয় ধরেছে সে তো বোঝা গেল, কিন্তু শুধু তা-ই তো নয়, সেই পেঁচোয় ধরবার বার্তাটাও তো দিতে হবে। দেওয়া হবে কাকে? স্বয়ং শ্রীরাধিকাকে। কী সে বার্তার ধরন? না, সারা রাত্তির খোলা গোয়ালঘরে শুয়ে থেকে পেঁচোগ্রস্ত কালা-র এমন কাশি হয়েছে, সে বাঁচে কি না-বাঁচে!
অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে নলিনী, বলে, এ গান একবার দাদাঠাকুরকে শোনাতে হবে।
সে তুই শোনাস নলিনীদা, বলে কাজি, কিন্তু ব্যাপারটা খেয়াল কর্। দেবতার সঙ্গে সম্পর্কটা একেবারেই বন্ধুর মতো, তাঁকে ভয় করবার কোন কারণ নেই। তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা চলে, মজা করা যায়! ইংরিজিতে একটা কথা আছে না, গড-ফিয়ারিং? আমাদের বাংলায় কিন্তু গড-ফিয়ারিং কেউ নয়, আমরা সবাই গড-লাভিং। ময়মনসিংহের দরিরামপুরে যখন ইশকুলে পড়তুম, তখন দুগ্গা পুজোর ছুটিতে এক ব্যাটা মোচলমান ছোঁড়ার গলায় দুগ্গা-যাত্রা শুনেছি: এক বেটি সিঁহের পরে/ অসুরের টিহি ধরে/ তার গলায় দিসে হোঁচা/ এক দুগ্গি দ্যাখলাম চাচা! গ্রামের হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলে সেই যাত্রা দেখছে, হাততালি দিচ্ছে, পয়সাও ছুঁড়ে দিচ্ছে। বছর কয়েক আগে, গান্ধী-আলিভাইদের নেতৃত্বে যখন খিলাফত আন্দোলন তুঙ্গে, তখন সংস্কৃত কলেজের প্রফেসর আমার এক গ্রামতুতো দাদা-কাম-বন্ধুকে বলতে শুনেছি, খিলাফৎ আন্দোলন আসলে মুসলমান এলিটদের। আমাদের এই বাংলার মুসলমানরা ধর্মে মুসলমান বটে, কিন্তু তাদের হাঁটাচলা-গানবাজনা-সুখদুঃখের অভিব্যক্তি একেবারেই তাদের নিজস্ব। বাইরের খোলসটা ছাড়ালে তার যে অন্তর, প্রতিবেশী হিন্দুদের থেকে তা এমন কিছু আলাদা নয়। খলিফা যে কী বস্তু আর কোন্ দেশে কোন্ খলিফা আছেন, খবরই রাখে না বাংলার জেলে-চাষা মুসলমানরা। একটু-আধটু আরবী ফার্সি পড়া মৌলবীরা তাদের যতই খিলাফৎ বোঝাবার চেষ্টা করুক, ওসব তারা বোঝেও না, বোঝবার আগ্রহও তাদের নেই। মৌলবীরা তাদের যতই আল্লাহ্কে ভয় করতে শেখাক, তারা কিন্তু আল্লাহ্কে বন্ধু বলেই মনে করে; যাঁর কাছে অভাবের সময় যদি কিছু চাওয়া যায়, ভালো মনে করলে সামর্থ্য থাকলে, তিনি দেবেন। ভয়ের তোয়াক্কাই তিনি করেন না, একটু-আধটু ইয়ার্কি আল্লাহ্ পছন্দই করবেন, যেমন পাড়ার দাদু করে! অযথা রাগ করতে যাবেন কেন! ভেবে দেখ্ নলিনীদা, তাদের হিন্দু প্রতিবেশীদের ইয়ার্কিটার মাত্রা বোঝা ভার; কালা, সে তো ভগবানই, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, তার এমন কাশি সে বাঁচে কি না-বাঁচে! একটু-আধটু সদ্য-ফার্সি-শেখা মৌলবিদের চেয়ে পাশের বাড়ির হিন্দু বন্ধুর কাছে বাঙালি মুসলমানরা অনেক বেশি প্রাণ খুলে কথা বলতে পারে। কেন? আসলে, দুজনেরই মনের ধরণটা ঠিক একই রকমের। তুই তো জানিসই নলিনীদা, দেশবন্ধু যখন দেহত্যাগ করলেন তখন ইন্দ্রপতন নামে একটা কবিতায় লিখেছিলুম, দাতাকর্ণের সম নিজ সুতে কারাগার-যুপে ফেলে/ ত্যাগের করাতে কাটিয়াছ বীর বারেবারে অবহেলে!/ ইব্রাহিমের মতো বাচ্চার গালে খঞ্জর দিয়া/ কোরবানি দিলে সত্যের নামে, হে মানব নবী-হিয়া!/ ফেরেশ্তা সব করিছে সালাম, দেবতা নোয়ায় মাথা,/ ভগবান-বুকে মানবের তরে শ্রেষ্ঠ আসন পাতা!
কী গণ্ডগোল তাই নিয়ে! কেউ আমার গলা কাটে তো আর-কেউ পারলে ঠেলে দোজ্খে ফেলে দেয়! মোসলেম জগৎ তো বলেই দিল ইসলামের বিন্দুমাত্র শোণিতও আমার শিরায় নাকি নেই। যাঁর নামে লক্ষ লক্ষ পাপী মুক্তি পেয়েছে সেই মহামানব পয়গম্বরের সঙ্গে দেশবন্ধুর মতো মানুষের তুলনা দিয়ে পৃথিবীর সব মোসলেমের প্রাণে আমি এমন নাকি গুরুতর আঘাত দিয়েছি যে আমার লেখনীকে অভিসম্পাৎ; আর আমাকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। কলমের মুখে নাকি আমি যাকে-তাকে নবী পয়গম্বর, খোদার চেয়ে বড় করে তাকে হিন্দুদের সামনে ধরছি, আর হিন্দুরা তাই নিয়ে আমাদের পবিত্র মহান নবী পয়গম্বরদের প্রতি হীন অশ্রদ্ধার ভাব পোষণ করবে!
এই সব দেখে শুনে, বুঝলি তো নলিনীদা, আর কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে না। এই সওগাতের নাসিরুদ্দিন সাহেব অবিশ্যি প্রাণপণে চেষ্টা করছেন শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানদের চৈতন্য জাগাতে, বিশেষ করে সাপ্তাহিক সওগাতে অনেক নতুন ছেলেদের সুযোগও দেওয়া হচ্ছে, ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রামের ছাত্রছাত্রীরা সাড়াও দিচ্ছে খানিকটা, কিন্তু আমার আর ভাল্লাগে না। গত একবছরে আমি কবিতা আর লিখলুম ক'টা, যা লিখছি সবই গান। দুলিকে দেখিয়ে হেসে বলে কাজি, আর এই যে দুলি, ওর বুদ্ধিতেই লিখছি এত গান।
যাক, তবু তুই স্বীকার করলি দুলির বুদ্ধিতেই লিখছিস গান, বলে নলিনী, তো বুদ্ধিটা কিরকম?
আসে বসন্ত ফুলবনে সাজে বনভূমি সুন্দরী – গানটা তোমার মনে আছে? – জিজ্ঞেস করে কাজি, সওগাতে বেরিয়েছিল যেটা? আছে মনে?
হ্যাঁ, আছেই তো, বলে নলিনী, এমনকি গুনগুন করে দু'লাইন গেয়ে শুনিয়েও দেয়।
ওই গানটা লেখার আগের রাতে প্রবল জ্বর হয়েছিল আমার। দুলি পরে বলেছিল, প্রায় বেহুঁশই ছিলুম আমি। ঠাণ্ডা জলে আমার মাথা ধোয়াচ্ছিল দুলি, আর সেই সময় বেহুঁশ আমার গলা এবং নাক থেকে অর্ধস্ফুট কিছু শব্দ খানিকটা পরিচিত সুর-তালে বেরোচ্ছিল মাঝে-মাঝেই। দুলি পরে আমায় বলেছিল যে সুরটা খানিকটা চেনা-চেনা, কিন্তু কবে কোথায় ও শুনেছে এই সুর তা মনে করতে পারছিল না। ঠিক বলছি তো দুলি?
দুলি কোন জবাব দেয় না, সামান্য হাসিতে ও যে একমত তা জানিয়ে দেয়।
পরের দিন সকালে আমার জ্বর কোথায় যে পালাল! আমি আসে বসন্ত গানটা পুরোপুরি লিখে ফেললুম, এবং নিজের মনে একটু-একটু গাইতেও শুরু করলুম। দুলি বলল, এই সুরই ও শুনেছিল আগের রাতে আমার মাথা ধোয়াবার সময়! তখন আমার জ্বর কিন্তু একেবারেই নেই। দুলি বলল, নিশ্চয়ই তরাসে জ্বর হয়েছিল আমার। তরাসে জ্বর কী আমি জানিনা, কিন্তু আমি বুঝলুম আমার ভেতর থেকে গান এখন বাইরে আসতে চাইছে বিশেষ সুরে – বাংলা ভাষায় গজলের সুর, যাকে আমি বলতে চেয়েছিলুম গজল নজরুলী। সে যাই হোক, বেশ কিছুদিন ধরেই কবিতা তেমন আসছিল না আমার, মৌ-লোভীদের বিচিত্র বিরূপ সমালোচনায় প্রায় ধ্বস্ত হচ্ছিলুম আমি। অনেক কিছুই করছিলুম, কিন্তু নিজের পছন্দের কাজটাই হচ্ছিল না। এমন সময় এই গান আমায় বাঁচিয়ে দিল নলিনীদা।
নলিনী বলল, ভালোই তো, নিজের মনের খুশিতে গান লিখছিস, সুর দিচ্ছিস, গাইছিস; এখন তো মোটামুটি অর্থপ্রাপ্তিও হচ্ছে।
তা হচ্ছে, বলে কাজি, বিশেষ করে রেকর্ডের কম্পানীর কাছ থেকে হঠাৎ করে অতগুলো টাকা পেয়ে পুরোনো ধারগুলো যে শোধ করে দিতে পারলুম, এ তো কপালের জোর! আর টাকার কথা বলতে গেলে দুলির কথাই ঘুরে ফিরে আসবে। তখন তো কাগজ-কলম নিয়ে বসলেই গান লিখতে পারছি, আর লেখার সঙ্গে সঙ্গেই গুনগুন করে সুর। পত্রিকাগুলোর থেকে দশ টাকা পাই এক-একটা গানের জন্যে। দুলি আমায় বলল একদিন, দিনে তিনটে করে গান লেখ, আর পাঠাতে থাক সব কাগজে। কিছু্দিনের মধ্যেই বিশ-তিরিশ টাকা আসতে থাকবে রোজ। পরামর্শটা আমাকে বাঁচিয়ে দিল সেদিন। চুলোয় যাক কবিতা, গানই ভাবছি লিখব এখন থেকে নলিনীদা। গানে অনেক মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায়। লিখব সুর দেব আর গাইব।
চব্বিশে সেপ্টেম্বর নিখিলবঙ্গ ছাত্র সম্মিলনীর তৃতীয় দিনের অধিবেশনে জওহরলাল নেহ্রুর সভাপতিত্ব করবার কথা। ছাত্রনেতারা নজরুলকে ধরেছে সেখানে বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তি করতে হবে। যাই-ই যদি, নজরুল বলে ছাত্রদের, গান গাইব। গান ছাড়া আর কিছু নয়। শুধু উদ্বোধনী সঙ্গীত। সভাকে মাতিয়ে দিল সে ওঠ্ রে চাষী ভারতবাসী ধর কষে লাঙল গেয়ে। কয়েকদিন পরেই শ্রীহট্টে প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রসম্মেলনে নজরুলকে নিয়ে যাবার জন্যে এক গুচ্ছ ছাত্রের একটা দল এসেছে কলকাতায়। কথাবার্তায় আঁচ পাওয়া গেল একদল মৌলবাদী সভা পণ্ড করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ছাত্রদের ইচ্ছে নজরুল সেখানে দুর্গম গিরি কান্তার মরু গায়। ওরা আগে থেকে মহড়া দিয়ে রেখেছে, যখনই কবি গাইবেন হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন, তখনই এক দল ছাত্র নৃত্যরত অবস্থায় মঞ্চে প্রবেশ করে কবিকে সঙ্গ দেবে। গোঁড়া ধর্মব্যবসায়ীদের মুখের মতো জবাব হবে সেটা।
কাজি বলে, নাচটা হবে কেমন?
ভালোই হবে, ছেলেরা বলে, বিলেতের কলেজ থেকে নাচগান শিখে আসা একজন কোরিয়োগ্রাফীর দায়িত্ব নিয়েছেন, খুবই পরিশ্রম করছেন তিনি।
সে তো ভালো কথা, কিন্তু তোমাদের ধম্মীয় গুরুরা? তারা মারপিট করবে না তো?
আপনি চিন্তা করবেন না কাজিদা, আমাদের ব্যায়াম সমিতির ছেলেরা আপনাকে ঘিরে থাকবে। সিলেটে আপনার গায়ে হাত দেবার সাহস কারো হবে না।
সেটাই তো চিন্তার কথা, বলে কাজি, আমাকে যদি ঘিরে থাকে ছেলেরা, তবে তাদেরও দুয়েকজনকে ধরাশায়ী করে তারপর আমায় নামতে হবে ময়দানে। তোমাদের ব্যায়াম সমিতিকে বলে দিও, ঘিরে রাখতে হয় তো ওই মোল্লাগুরুদের যেন ঘিরে রাখে ওরা, আমার হাত থেকে বাঁচলে তবে তো বেহেশ্তে স্থান হবে তাদের।
ঢাকার হকিস্টিকের ঘটনাটা শোনা ছিল কয়েকজনের, তারা হেসে বলে, সে আমরা জানি কাজিদা, আপনি সঙ্গে থাকলে আমরা ভয় পাই না।
সম্মেলনের শুরুর দিনই সকালে পৌঁছল ওরা সিলেট স্টেশনে। দেখা গেল ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ আর ফজলুল হক সাহেবও এসেছেন; স্টেশনে বিরাট জনতা, তারা অতিথিদের সংবর্ধনা জানাতে হাজির। হক সাহেব সম্মেলনের সভাপতি আর শহীদুল্লাহ্ সাহেব প্রধান বক্তা। দুপুরের প্রীতিভোজের পর গিরিশচন্দ্র বিদ্যালয়ে সম্মেলন। হক সাহেব শুরুতেই নজরুলকে উদ্বোধন সঙ্গীত গাইতে আহ্বান করলেন। সভা পণ্ড করার জন্যে এসেছিল যারা দেখা গেল তাদের দলবল কম নয়। কাজির নাম উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই তারা শুরু করল হৈ হৈ, কিন্তু সমবেত ছাত্রের দল রুখে দিল তাদের। এবার নজরুল এল মঞ্চে ধীর পায়ে, সালাম জানাল যাঁরা সভায় এসেছেন তাঁদের প্রত্যেককে। যারা হৈ হৈ করছিল তাদের উদ্দেশে বলল, সভায় এসেছেন যখন ধৈর্য ধরে শুনুন আমার গান। পছন্দ না হলে আমায় কোতল করা তো আপনাদেরই হাতে। এই কথায় একেবারে স্তব্ধ সভাঘর। গানের প্রতিক্রিয়ার জন্যে দু'পক্ষই প্রস্তুত। শোনা গেল নজরুলের কণ্ঠ:
বাজল কি রে ভোরের সানাই নিদ-মহলার আঁধার পুরে
শুনছি আজান গগনতলে অতীত রাতের মিনার-চুড়ে।।
সরাইখানায় যাত্রীরা কি বন্ধু জাগো উঠল হাঁকি
নীড় ছেড়ে ওই প্রভাতপাখি গুলিস্তানে চলল উড়ে।।
তীর্থ-পথিক দেশবিদেশের আরফাতে আজ জুটল কি ফের
লা শরীক আল্লাহ্-মন্ত্রের নামল কি বান পাহাড় তুরে।।
আঁজলা ভরে আনল কি প্রাণ কারবালাতে বীর শহীদান
আজকে রওশন জমীন-আশমান নওজোয়ানির সুরখ্ নুরে।।
গান শেষ হবার পর কয়েক সেকেণ্ড সভাস্থল একেবারে নিশ্চুপ। থমথমে শান্ত। মনে হয় গানটা বুঝি পুরোপুরি ধাতস্থ হতে সময় নিচ্ছে সভা। তারপর হাততালিতে ফেটে পড়ে ঘরখানা। সভা পণ্ডের দলে ছিল যারা, তাদের মধ্যেও বেশ কয়েকজনকে দেখা গেল হাততালিতে যোগ দিতে। মাথা নীচু করে কয়েকজনকে বেরিয়ে যেতেও দেখা গেল। এরপর আর রোখা যায় না নজরুলকে। ছেলেরা যেমন আগে থেকেই বলেছিল, কোরিয়োগ্রাফীর সঙ্গে জমে গেল দুর্গম গিরি কান্তার মরু। রাত্তিরে খাওয়ার সময় শহীদুল্লাহ্ সাহেব কাজিকে বললেন, দারুণ গান শোনালে কাজি, এ গানকে কী গান বলব? ইসলামি?
আপনি যা বলতে চান তা-ই বলুন না। আপনি এ-গানের যা নাম দেবেন তা-ই আমি মাথা পেতে নেব। আপনার ভালো লেগেছে শুনেই নিজেকে পুরস্কৃত লাগছে।
একটু একটু ফার্সি আমি জানি, বলেন শহীদুল্লাহ্ সাহেব, কিন্তু ওমর খৈয়মের রুবাইয়াৎ আমি ফার্সিতে পড়িনি। পড়েছি ফিট্জেরাল্ড সাহেবের ইংরিজি অনুবাদ। আজ তোমার গানখানা শুনতে শুনতে ফিট্জেরাল্ড সাহেবের অনুবাদ-করা একটা রুবাই আমার বারবার মনে পড়ছিল:
Dreaming when the Dawn's left-hand was in the Sky
I heard a voice within the Tavern cry,
“Awake, my Little ones, and fill the Cup,
Before Life's Liquor in its Cup be dry.”
ওমর খৈয়ম খুব প্রতিষ্ঠিত সাধু-সন্ত ঘরানার লোক ছিলেন না, অনেক ইসলামি ধর্মগুরুই তাঁকে পছন্দ করতেন না এরকমটা জানি, কিন্তু আজানের সুরকে প্রায় খৈয়ামের ভাষায় তুমি যে “নিদ-মহলার আঁধার পুরে” “সরাইখানায় যাত্রীরা কি বন্ধু জাগো উঠল হাঁকি” গাইলে সে তো প্রায় “I heard a voice within the Tavern cry!” আর হেঁকে কী বলছে? “লা শরীক আল্লাহ্-মন্ত্র!” যা ফিট্জেরাল্ডের ভাষায় “fill the Cup before Life's Liquor in its Cup be dry!”
Life's Liquor! লা শরীক আল্লাহ্-মন্ত্র! অনবদ্য!
কাজি বলল, স্যর, আপনাকে একটা প্রণাম করতে ইচ্ছে করছে। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে প্রণাম করেছিলুম আপনার সামনে। আজ এখানে গুরুদেব নেই – ঢিপ করে নিজের মাথাটা শহীদুল্লাহ্ সাহেবের পায়ে ঠেকিয়ে কাজি বলে – কিন্তু আপনি যে-ভাবে আমার গানের লাইন আমাকেই বুঝিয়ে দিলেন, তাতে কৃতজ্ঞতা জানাবার আর কোন ভাষা আমার জানা নেই। ফার্সিতে ওমর খৈয়ম আমাকে খানিকটা পড়িয়েছিলেন করাচির সেনা ব্যারাকে এক পঞ্জাবি মৌলভী সাহেব। সেই বই আমার কাছে আছে। আমি একা থাকলে অনেক সময়ই রুবাইয়ৎ পড়ে সময় কাটাই। ওমর খৈয়মকে আমি আল্লার থেকে অভিন্ন মনে করিনা। কিন্তু স্পষ্ট করে তাঁর ভাষাই ইসলামি গানে ব্যবহার করার কথা আমি কখনও ভাবিনি, অথচ তা কীভাবে আমাকে ঋদ্ধ করেছে, ফিট্জেরাল্ডের লাইন থেকে তা আপনি আমাকে দেখিয়ে দিলেন। এরপরেও আপনাকে গুরুদেবের স্থান না দিই কীভাবে বলুন।
তুমি প্রণাম করেই তোমাকে আশীর্বাদ করার সাহস দিলে আমাকে, সেই সাহসের জোরেই তোমাকে আমি আশীর্বাদ করছি, তুমি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ ইসলামি সঙ্গীত-রচয়িতা হবে। মূর্খ মৌলভীরা যতই তোমাকে নাস্তিক মনে করুক, তোমার চেয়ে বড় আস্তিক মুসলমান আমি দেখিনি। আর তোমার আস্তিক্যের সাহসেই আর একটা কাজ তুমি করেছ। আমি নিজে সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু এটা বুঝেছি তোমার আজকের এই গানে তুমি এমন একটা সুর দিয়েছ যা মনোহরণ, অথচ ইসলামি সঙ্গীতের পরিচিত সুর নয়। কী সুর এটা?
নজরুল হাসে। তারপর বলে, অপরাধ নেবেন না স্যর, যে সুরের জোরে এখন বাংলা গানে আমি খানিকটা পরিচিত হয়েছি এটা মূলত সেই সুরই, সামান্য এধার-ওধার করা। গজলেরই সুর স্যর।
তোমার গজল সার্থক হোক, বলেন শহীদুল্লাহ্ সাহেব।
সে বছরেই বাসস্থান বদল করার প্রয়োজন হল কাজির। যখন দুলিরা থাকত কৃষ্ণনগরে, আর নজরুল জেলেটোলায় থেকে কলকাতার সঙ্গে তার যোগাযোগ রেখে চলত, তখন ছিল এক রকম। এখন আসন্নপ্রসবা দুলিকে নিয়ে নলিনীদা'র বাড়িতে দিনের পর দিন বাস করায় উভয় পক্ষেরই অসুবিধে। কলকাতায় এসে অবধি তার প্রায়-অভিভাবক নাসিরুদ্দিন সাহেব। ওয়েলেসলি স্ট্রীটের যে-বাড়িতে সওগাতের অফিস এবং ছাপাখানা সেই বাড়িতে কাজিকে সপরিবার নিয়ে এলেন তিনি। সেখানেও ব্যবস্থা তেমন সুবিধের নয়। অবশেষে ধূমকেতুর ম্যানেজার ছিল যে শান্তিপদ সিংহ, সে-ই ব্যবস্থা করল একটা। এন্টালিতে শান্তিপদদের নিজেদের বাড়ি। সেই যে বাড়ি, ৮/১ পানবাগান লেন, তার দোতলায় সপরিবার নজরুলদের থাকার ব্যবস্থা করে দিল সে। নীচের তলায় থাকে তারা নিজেরা। এই বাড়িতেই দুলির কোলে এল আর একটি পুত্রসন্তান, সব্যসাচী।
ডিসেম্বরের শেষে দেশের সমস্ত প্রাদেশিক শ্রমিক ও কৃষক সংগঠন যুক্ত হয়ে তৈরি হল All India Workers and Peasants Party; তাদের সর্বভারতীয় সম্মেলন কলকাতায়, অ্যালবার্ট হলে। নজরুল, কৃষক-শ্রমিক দলের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন নজরুল, এই দলের প্রথম মুখপত্র লাঙলের প্রথম ও প্রধান পরিচালক নজরুল – এই সম্মেলনে উপস্থিত থাকল শুধুই উদ্বোধনী সঙ্গীতের গায়ক হিসেবে। এর মধ্যে কলকাতায় দলের কার্যালয় হ্যারিসন রোড থেকে উঠে এসেছে ২/১ য়্যোরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেন-এ; এই একই অফিস এখন মুজফ্ফর আহ্মদ-আবদুল হালীমদের বাসস্থানই শুধু নয়, কম্যুনিস্ট পার্টির কাজও তারা ওই অফিস থেকেই চালায়। নজরুলের বর্তমান বাসস্থানের খুবই কাছে এই অফিস। পাথর-ছোঁড়া দূরত্ব বললেই হয়! ফলে মুজফ্ফরের সঙ্গে নজরুলের যোগাযোগ আবার অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু তা সত্বেও তাকে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে বিশেষ টানতে পারছে না মুজফ্ফর! সে বোঝে, আপাতত সঙ্গীতেই তার কাজি সম্পূর্ণ নিবেদিত।
ইদানিং পানবাগানের বাড়িতে প্রায়ই মুজফ্ফর দেখতে পায় আগে-চিনত-না-এমন-একজন মানুষকে। ইনি গ্রামোফোন কম্পানীর সঙ্গীতের প্রশিক্ষক ওস্তাদ জমীরুদ্দীন খান সাহেব। নিজের সম্বন্ধে কাজি বারবারই বলেছে তার নিজের সাঙ্গীতিক দক্ষতা অনেকটাই জন্মগত, পরে লেটোর দলে সে কাজ করে এবং নানা শুভানুধ্যায়ীর সাহায্যে সেই দক্ষতা খানিকটা পুষ্ট হয়। করাচির সেনাব্যারাকে অনেক রকমের সঙ্গীতযন্ত্রের সঙ্গে সে পরিচিত হয়, এবং স্বরলিপির সাহায্যে রবীন্দ্রনাথের গানও অভ্যাস করতে শুরু করে। শুধু সুরই নয়, রবীন্দ্রনাথের এই গানের ভাষাও তাকে সঙ্গীতজগৎ থেকে অবিচ্ছিন্ন করে রাখে। কিন্তু সত্যি কথা এই যে এখন – যখন সঙ্গীতেই তার জীবন ও জীবিকা নির্ভর করছে – তাকে সঙ্গীতের যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। তা-ই ওস্তাদ জমীরুদ্দীন খান সাহেব। তাঁর কাছ থেকে কাজি নিয়মিত খেয়াল ধ্রুপদ ঠুংরি এবং সব রকমের রাগপ্রধান সঙ্গীতের তালিম নিচ্ছে।
নানা শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে কাজ করা এখন মুজফ্ফরের অন্যতম প্রধান সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যস্ততা। গঙ্গার দুপারে পাট সুতো এবং এমনকি এঞ্জিনীয়রিঙেরও নানা কারখানা গড়ে ওঠায় বিভিন্ন অভিযোগে শ্রমিক অসন্তোষ এবং তার ফলস্বরূপ শ্রমিক আন্দোলনও এখন এই সব অঞ্চলে নিয়মিত ঘটনা। এই শ্রমিক আন্দোলন আন্তর্জাতিক চেহারা নিতে শুরু করে গ্রেট ব্রিটেনের কম্যুনিস্ট পার্টির সক্রিয় অংশগ্রহণে। বেশ কয়েকজন সাদা-চামড়ার শ্রমিক নেতা তখন কলকাতা এবং বোম্বাইতে এসে শুধু থাকতেই যে শুরু করলেন তা-ই নয়, তাঁরাও স্থানীয় শ্রমিক আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠলেন। এঁদেরই একজন ফিলিপ স্প্রাট, তিনি তখন ব্রিটিশ কম্যুনিস্ট পার্টির সভ্য। যদিও All India Workers and Peasants Party ঠিক কম্যুনিস্ট পার্টি নয়, তবুও বন্ধুভাবাপন্ন গোষ্ঠী হিসেবে এই দলের কার্যকারিতার বিষয়ে কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ষষ্ঠ অধিবেশনে আলোচনা হয়। শ্রমিক এবং কৃষকদের একই সংস্থা যুক্ত-শ্রেণীস্বার্থের পক্ষে কতটা অনু্কূল এবং কার্যকর হতে পারে এ-বিষয়েও আলোচনা এবং সমালোচনা হয়। এই সময় হেমন্ত সরকার সপরিবার কুষ্ঠিয়াতে থাকতেন। বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের নেতা হলেও ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজেকে কৃষক নেতা হিসেবেই দেখতেন, এবং সেই সূত্রে সমকালীন অনেক কংগ্রেস-নেতার তিনি অপছন্দের তালিকায় ছিলেন। ঠিক হল কুষ্ঠিয়াতেই প্রথম কৃষকদের নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন, বঙ্গীয় কৃষক লীগ তৈরি হবে।
এবার কাজিকে ছাড়ল না মুজফ্ফর। চাষাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দল তো তোমারই কল্পনা কাজি, মুজফ্ফর বলে তাকে। মনে আছে কৃষ্ণনগরের সম্মেলনে তোমার সেই উদ্বোধন সঙ্গীত? সেই ওঠ রে চাষী জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল? নজরুলের যাবতীয় অস্বস্তিকে অগ্রাহ্য করে সম্পূর্ণ গানটাই আবৃত্তি করে মুজফ্ফর, একেবারে শেষের ওই বিশ্বজয়ী দস্যু রাজার হয়-কে করব নয়!/ ওরে দেখবে এবার সভ্যজগৎ চাষার কত বল– পর্যন্ত।
কাজি অবাক হয়, হয়তো খুশিও।
মুজফ্ফর বলে, তোমার সঙ্গীতের আগ্রহ এবং সাফল্যে আমরা, যারা তোমার বন্ধু, খুবই খুশি, যেমন খুশি ছিলুম তোমার পত্রিকা সম্পাদনায় এবং কবিতায়। কিন্তু একটা কথা তো ভুললে চলবে না কাজি। মানুষের কাছে আমাদের অঙ্গীকার। খেটে-খাওয়া মানুষের সংগ্রামে অংশগ্রহণ তো তোমার-আমার প্রতিজ্ঞা ছিল, তা ভুলি কীভাবে?
কাজির কণ্ঠস্বরে এবার আবেগ, সে বলে, আমি হেরে গেছি মুজফ্ফর ভাই, আমার কথা আমি রাখতে পারিনি।
ভুল বলছ, বলে মুজফ্ফর, আসলে তুমি লড়ছ এক সঙ্গে অনেকগুলো ফ্রন্টে, আমরা লড়ছি একটাই ফ্রন্টে। তোমার তুলনায় তাই ক্লেশ আমাদের কম, এটাই তফাৎ।
মার্চের প্রথম সপ্তাহে হালীম-স্প্রাট-মুজফ্ফর-নজরুলের কুষ্ঠিয়ায় বঙ্গীয় কৃষক লীগ প্রতিষ্ঠার প্রথম অধিবেশনে যোগ দেওয়া স্থির হল। নজরুলের বিয়ের পর যা কখনো হয়নি তা-ই ঘটল এবার। দুলি বলে, আমরাও যাব। কে জানে, ঢাকা এবং কুমারী ফজিলতউন্নেসার সঙ্গে কাজির ঘনিষ্ঠতার কথা হয়তো কিছু কিছু মনে পড়ে তার: আমি যাব, বলে দুলি, আমি বুলবুল সানি – সব্যসাচীর ডাক নাম রাখা হয়েছে সানি, সান-ইয়াৎ-সেন এর নাম অনুসারে – আর মা। হেমন্তদা তো থাকেন ওখানে, আমরা হেমন্তদার বাড়িতে থাকব, তোমরা সভা-সমিতি কোরো।
দু'দিনের প্রাথমিক মীটিং। কাজি যেন ফিরে পেল তার রাজনৈতিক দিনগুলো। হেমন্তদার বাড়িতে নিজের পরিবারকে রেখে সে মীটিঙেই মশগুল, বাইরে থেকে অনেকে এসেছিলেন। প্রথম অধিবেশন হল দু'দিন ধরে। তারপর আরও কাজ আছে। মীটিঙে যতগুলো বিরোধী কণ্ঠস্বর শোনা গেল, প্রতিটি নিয়েই বিশদ আলোচনা চলবে। মুজফ্ফর-স্প্রাট-হালীমের কাজ আছে কলকাতায়, দু'দিন পরেই ফিরে এল তারা, তাদের সঙ্গে গিরিবালা এবং সপুত্রক দুলিও। থেকে গেল কাজি। সব আলোচনা শেষ করেই সে আসবে।
মুজফ্ফররা যখন ট্রেনে, তখনই খবর পাওয়া গেল, আগের দিন য়্যোরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেনের অফিসে পুলিশের অভিযান হয়েছে। শেয়ালদা স্টেশন থেকে সোজা সেখানে চলে গেল মুজফ্ফর। হালীমের সঙ্গে বাড়ি ফিরল দুলিরা।
কলকাতায় ফিরে য়্যোরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেনের অফিসে আসে কাজি, কী ব্যাপার? কী মতলব পুলিশের?
বোঝা যাচ্ছে না এখনো, বলে মুজফ্ফর, কাগজপত্তর নিয়ে গেছে কিছু, গণবাণীর নতুন-পুরোনো নিয়ে যতগুলো সংখ্যা পেয়েছে, নিয়ে গেছে সবই। আমাদের কাউকে এখনো পর্যন্ত ডেকে পাঠায়নি, কাজেই আমরা নিশ্চিন্তে আছি।
সেদিন বেশ জমিয়েই আড্ডা হল, গানবাজনাও। বেশ কিছুক্ষণ থাকল কাজি, বলে গেল বঙ্গীয় কৃষক লীগ প্রতিষ্ঠার আর কোন অসুবিধেই রইল না। একটু-আধটু আপত্তি তুলেছিল যারা, তাদের প্রায় সবাইকেই বোঝানো গেছে। ত্রিপুরা থেকে যে ওয়াসীমুদ্দীন সাহেব এসেছিলেন, তিনি পরের মীটিংটা ত্রিপুরাতেই ডাকবেন বলে গেছেন, তোমাদের সুবিধে হলেই একটা মীটিঙের দিন ফাইনাল করা যাবে।
নজরুলের উৎসাহে মুজফ্ফর ভারী খুশি, তাকে বোধ হয় আবার লড়াইয়ের জগতে ফিরিয়ে আনা যাবে!
সেই সময় কলকাতার কর্পোরেশনে মেথর-ঝাড়ুদারদের আন্দোলনে সক্রিয় মুজফ্ফর। হঠাৎ একদিন নানা জায়গায় খোঁজ-খবর করতে করতে য়্যোরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেনের অফিসে হাজির শচীনন্দন। শচীনন্দনের সঙ্গে নজরুলের আলাপ হয়েছিল হাওড়ায়, পিংলার বাড়িতে গান গাইতে গিয়ে। সেই আলাপ প্রায়-বন্ধুত্বের পর্যায়ে পৌঁছেছিল পরের দিন শিবপুরে, ভীমদার তেলে-ভাজা দোকানে গিয়ে। তারপর থেকেই শচী যোগাযোগ রেখেছে নজরুলের সঙ্গে, এবং সেই সূত্রেই সে মুজফ্ফরের সঙ্গেও পরিচিত হয়। উনিশশো ছাব্বিশের দাঙ্গার সময় শিবপুর থেকেই অগ্রদূত নামে একটা পত্রিকা বের করে শচী, সেই পত্রিকার জন্যে শচীর অনুরোধে কাজি লেখে পথের দিশা নামে ছোট একটা কবিতা:
চারদিকে এই গুণ্ডা এবং বদ্মায়েশির আখড়া দিয়ে
রে অগ্রদূত, চলতে কি তুই পারবি আপন প্রাণ বাঁচিয়ে?
পারবি যেতে ভেদ করে এই চক্র-পথের চক্রব্যূহ?
উঠবি কি তুই পাষাণ ফুঁড়ে বনস্পতি মহীরুহ?
আজকে প্রাণের গো-ভাগাড়ে উড়ছে শুধু চিল-শকুনি,
এর মাঝে তুই আলোক-শিশু কোন্ অভিযান করবি, শুনি?
এবার শচী মুজফ্ফরকে বলে, হাওড়ায় সে কলকাতা কর্পোরেশনের মেথর-ঝাড়ুদারদের ইউনিয়নের মতো একটা সংগঠন গড়ে তুলতে চায়। পিংলার সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে সে অনেক মেথর-ঝাড়ুদারদের চেনে, পিংলার মাকে সে-ও মাইয়া সম্বোধন করে, এবং এদের সক্রিয় সহযোগিতা সে পাবে। এ-ছাড়াও তাদের শিবপুরেরই দুজন সক্রিয় কংগ্রেস কর্মী – তাঁদের নাম জীবনকৃষ্ণ মাইতি এবং অগম দত্ত – কংগ্রেস কর্মী হলেও তাঁরা মনে করেন এ-কাজ কংগ্রেসকে দিয়ে হবে না – তাঁরাও এই ইউনিয়নের ব্যাপারে খুবই উৎসাহী।
শচীকে নিয়ে পানবাগানে কাজির বাড়িতে পৌঁছে গেল মুজফ্ফর। কাজিরও যথেষ্ট উৎসাহ। শচীকে সে বলল, মাইয়াকে সে কথা দিয়ে এসেছিল তাদের বাড়িতে আবার গান শোনাতে যাবে। ওরা যদি এই ইউনিয়ন সত্যিই তৈরি করে, তাহলে ইউনিয়নের উদ্বোধনের দিন সে নিজেও যাবে, পিংলাদের বস্তিতে যদি আসর বসানো যায় তাহলে সেদিন সে গানও শোনাবে সেখানে।
প্রায় সময়ই লাগল না। জমি যেন তৈরিই ছিল, কয়েক দিনের মধ্যেই স্ক্যাভেঞ্জার্স ইউনিয়ন অব বেঙ্গল-এর হাওড়া শাখা গঠিত হয়ে গেল। কাজি নজরুল ইসলাম এখন তো গানের জগতে পরিচিত নাম। তার সঙ্গীত পরিবেশনের নামে এই শাখার উদ্বোধন হল জমজমাট। জীবনকৃষ্ণ এবং অগম ছাড়াও উদ্বোধনের দিন শচীর সঙ্গে এল আরও একজন। এর নাম বটুকেশ্বর দত্ত। বাঙালি হলেও বটুকেশ্বর কানপুরে মানুষ, সেখানে স্কুলে পড়েছে সে, ফলে হিন্দী ভালো জানে। মেথর-জমাদারদের মধ্যে অনেকেই হিন্দীভাষী। পরে, হাওড়ায় যখন স্ক্যাভেঞ্জার্স ইউনিয়নের আন্দোলন শুরু হয়, বটুকেশ্বর হিন্দীতে তাদের অনেক কথা বুঝিয়ে বলতে পারত। এমনকি আন্দোলনের কোন কোন ইশতেহারও সে লিখে দিয়েছে। উনিশশো উনতিরিশে সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্ব্লীতে ভগত সিং-এর সঙ্গে বোমা ছোঁড়ার সময় ধরা পড়েছিল বটুকেশ্বর।
স্ক্যাভেঞ্জার্স ইউনিয়ন উদ্বোধনের দিন কাজির জন্যে অপেক্ষা করছিল আর একটা ভালো-লাগার চমক। কাজি জানত না, শচী নিজে শান্তিনিকেতন পর্যন্ত গিয়ে খবর দিয়ে এসেছিল পিংলাকে। অনুষ্ঠানের আগের দিন পৌঁছিয়ে গেল পিংলা। শাখা অফিস খোলা হল। এই শাখার কী গুরুত্ব মুজফ্ফর বোঝাল অল্প কথায়। কলকাতার মতো হাওড়াতেও মেথর-ঝাড়ুদারদের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আন্দোলন মানেই লড়াই। লড়াই না করে কোন-কিছুই পাওয়া যায় না। কিন্তু লড়াই করব বললেই লড়াই হয় না। তার জন্যে নিজেদের তৈরি করতে হয়। অন্য যারা লড়াই করে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়, শিখতে হয় তাদের কাছ থেকে। এর পর গান গাইল নজরুল অনেকগুলো। মাইয়াকে সে খালা বলে ডেকেছিল আগের বার। ভারী খুশি খালা। গান শেষে মুজফ্ফর আর স্প্রাট ফিরে গেল। কাজি থেকে গেল সেই রাতটা। পরের দিন কাজির সঙ্গে পানবাগানে এসে এক রাত্তির সেখানে থেকে বুলবুলকে নানা পাখির রঙচঙে একটা ছবির বই দিয়ে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, পিংলা ফিরে গেল শান্তিনিকেতন।
কয়েকদিন পর, ২০শে মার্চ, মধ্যরাত্রের পুলিশী অভিযানে ওই য়্যোরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেনের অফিস থেকেই গ্রেপ্তার হয় মুজফ্ফর আর স্প্রাট।
এরপর বিখ্যাত মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা। হাওড়ায় সলতেতে আগুন জ্বালিয়ে এসেছিল মুজফ্ফর। শচী আর জীবনকৃষ্ণর নেতৃত্বে সফল আন্দোলনও হল হাওড়ায়। বঙ্গীয় কৃষক লীগ কিন্তু থেকে গেল স্বপ্নেই।
মুজফ্ফরের সঙ্গে কাজির আবার দেখা হবে সাত বছর পর।