কয়েকদিন বত্তিরিশের আড্ডায় আসেনি কাজি, আজ বেলা বারটা নাগাদ তালতলায় ওদের বাসস্থানে হাজির আফজালুল হক, ব্যাপারটা কী?
নজরুল তখনো ঘুমোচ্ছিল, আফজালের হাঁক-ডাকে ঘুম ভাঙল তার। এখনো ঘুমিয়ে, শরীর-টরীর খারাপ হল নাকি, জিজ্ঞেস করে আফজাল।
না, শরীর ঠিকই আছে, কাল রাতে ঘুম হয়নি, সেটা মেক-আপ করছিলুম।
ঘুম হয়নি? আপনার? কেন? সব ঠিকঠাক আছে তো?
ঠিকঠাক নেই কোনকিছুই আফজাল সাহেব, বলে কাজি, কাল রাত থেকে সব কিছু বদলে গিয়েছে, যে-কবিতাটা লিখতে চেয়েছিলুম সেই ছোটবেলার থেকে, কাল রাতে লিখে ফেলেছি সেটা; আমার নিদ্রা-জাগরণের সবকিছুই ওলোটপালোট হয়ে গেছে তার পর থেকে।
হেসে ফেলে আফজালুল, আপনার কত আর বয়েস হবে, নজরুল সাহেব, বাইশ-তেইশ বড় জোর। এর মধ্যেই আপনি আশৈশব যে কবিতাটা লিখতে চেয়েছিলেন সেটা লিখে ফেললেন? কই দেখান দেখি কবিতাটা, পড়ি।
সকালে বেরিয়ে যাবার আগে ঘরের সিমেন্ট-করা তাকে খাতাখানা তুলে রেখে গিয়েছিল মুজফ্ফর। চারদিকে তাকিয়ে সেটাতে নজর পড়ে কাজির। সে খাতাখানা নামিয়ে এনে যে-পাতা থেকে কবিতাটার শুরু সেই পাতাটা খুলে আফজালের হাতে দেয়, বলে, পড়ুন, আমি ততক্ষণ চা তৈরি করি।
নজরুল চা তৈরি করে আফজালকে এক কাপ দেয়, নিজের কাপে চুমুক দিয়ে দেখে আফজল আরেকবার পড়বার জন্যে পাতাগুলো দ্রুত উল্টে যাচ্ছে। নজরুলের দিকে তাকিয়ে সে বলে, এ তো মারাত্মক কবিতা, নিজে পড়ে সুখ নেই, আপনি পড়ুন, আপনার গলায় শুনি।
মারাত্মক? মারাত্মক মানে?
মারাত্মক ছাড়া এ কবিতার বিষয়ে আর কোন শব্দ আমি ভাবতে পারছি না কাজিসাহেব।
চায়ের কাপটা পাশে রেখে সঙ্গে সঙ্গে কবিতাটা পড়তে শুরু করে কাজি, বল বীর/ বল উন্নত মম শির/ শির নেহারি আমারই নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির! একবার শুরু করে আর থামা হয় না নজরুলের, পাশের চায়ের কাপটা দ্বিতীয় চুমুকের আগেই পরিত্যক্ত অবস্থায় বসে থাকে, আফজালুলের অবস্থাও একইরকম, হাতে কাপ নিয়ে সে নজরুলের দিকে তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক। গলা ওঠে আর নামে, আওয়াজ মৃদুতা আর তীব্রতার মাঝে এলোমেলো ঘোরাঘুরি করতে থাকে, তালতলা লেনের ক্ষুদ্র ঘরটিতে যেন বিস্ফোরণের দোলা।
কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতার পর আফজাল বলে, আমি অপেক্ষা করছি। আপনাকে ঘুম থেকে তুললাম। আপনি তৈরি হয়ে নিন, একটু বাথরূম থেকে ঘুরে আসুন, আমরা বেরোব।
মিনিট কুড়ি পর দরজাটা বাইরে থেকে টেনে ঠিক বেরিয়ে আসবার মুহূর্তে আফজাল বলে, আপনার খাতাখানা ফেলে যাবেন না। আবার পড়ব কবিতাটা। খাতা নেওয়া হয়, আফজাল বলে, আপনাকে মিষ্টি খাওয়াব, পেট ভরে। এমন কবিতা শোনানোর জন্যে কৃতজ্ঞতা দেখাবার অন্য রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না। চলুন, বৌবাজারে যাই, ভীম নাগ।
ভীম নাগের দোকানের ভেতরে বসে ওরা, দই আর সন্দেশের অর্ডার দেওয়া হয় – পেট ভরে খাওয়ার এবং খাওয়াবার অঙ্গীকার। আফজাল জিজ্ঞেস করে কাজিকে, এই কবিতাটা ছাপাবেন কোথায়?
ছাপাব কোথায়? কেন, যে কোন পত্রিকায় ছাপালেই তো হয়।
আমাকে দেবেন?
আপনাকে? আপনার পত্রিকায়? মোসলেম ভারত? নয় কেন? আজই নিয়ে যান না।
হেসে ফেলে আফজাল, নিয়ে তো যাবই, তাই তো বললাম আপনাকে খাতাটা নিয়ে বেরোতে। তাহলে নিই খাতাখানা?
খাতা নেবেন কেন, এই খাতা কি ছাড়া যায়? আমার শ্রেষ্ঠ কবিতা লেখা হয়েছে যে খাতায় সেটা পরম যত্নে আমি তুলে রাখব। আপনাকে বরঞ্চ আমি কবিতাটা কপি করে দিই।
দেবেন? ঠিক আছে, আমি তাহলে – এই তো পাশেই একটা স্টেশনারী দোকান আছে – কয়েকটা কাগজ কিনে আনি, আপনি বসুন।
নজরুল কিছু জবাব দেবার আগেই বেরিয়ে যায় আফজাল, ওর দইয়ের ভাঁড় আর কলাপাতায় সন্দেশ পড়েই থাকে। একটু পরে ফেরে সে, পকেটে ফাউণ্টেন পেন একটা ওর থাকেই সব সময়, সেটা আর কাগজগুলো নজরুলকে এগিয়ে দেয়, বলে, আপনি আগে সন্দেশ-টন্দেশগুলো শেষ করুন, তারপর লিখবেন।
খাওয়া হয়ে গেলে নজরুল ফাউণ্টেন পেনটা হাতে তুলে নেয়, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে সেটা, তারপর বলে, এটা দিয়ে লিখব? জবাবের অপেক্ষায় না থেকে কাগজগুলো টেনে নিয়ে শিরোনাম লেখে প্রথম, বিদ্রোহী, তার পরের লাইনে কাজি নজরুল ইসলাম, আর তারপর লিখতে শুরু করে কবিতাটা। কয়েকবার পড়ে পড়ে কবিতাটা এখন ওর প্রায় মুখস্থই হয়ে গেছে, খাতাটা সামনে থাকলেও খুব বেশি সেটা কাজে লাগে না। লেখা শেষ হলে আফজালকে কাগজগুলো দেয় ও, বলে, বত্তিরিশে ফিরে সেলাই করে নেবেন। কাগজগুলো নেয় আফজাল, পেনটা কাজি ফেরৎ দিতে গেলে ও নিতে চায় না সেটা, বলে, আপনি রেখেই দিন না ওটা।
উঁহুঁ, বলে কাজি, আমার মাথায় একটা বিশেষ কলম আছে, আমেরিকান, সেটাই আমার প্রথম ফাউন্টেন পেন হবে।
আমেরিকান? আপনার কি নামী দামী সব জিনিষের শখ আছে?
নিশ্চয়ই, বলে কাজি, বড়লোক হবার শখ আছে বৈকি। পাঁচিল-ঘেরা গেটওয়ালা বাড়ি, সামনে দারোয়ান, গ্যারেজে বিরাট বড় গাড়ি, এ সব শখ আছে তো। আপনি দেখবেন, এক দিন এ সবই হবে আমার।
আপনাকে খুব ভালোভাবে চিনি, এরকম একটা অহঙ্কার আমার ছিল। আজ দেখছি অনেক চেনা বাকি আছে।
কী জানি কেন, নজরুলের আজ বত্তিরিশ নম্বরে যাবার ইচ্ছে ছিল না। ভীম নাগ থেকেই ও ফিরে এল তালতলায়। অত লোভনীয় সন্দেশ, অনেকগুলো খাওয়া হয়েছে। কিরণশঙ্করের বাড়িতে ডাবের জল ছিল গলা মসৃণ করার জন্যে, আর আজ ছিল দই। কিন্তু ডাবের জলের তুলনায় সেটা অনেক ওজনদার। নজরুল তার নিজের জন্যে নির্দিষ্ট চৌকিটাতে শুল। এবং সামনের খোলা দরজাটা বন্ধ করার কথা মনে হবার আগেই ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙল কাঁধটাকে একটা হাত নাড়া দেওয়ায়। চোখ খুলে কাজি দেখে সামনে অবিনাশদা, অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য। অবিনাশদা বারীন দাদার বন্ধু, তাঁর সঙ্গে আন্দামানে একই সময় বন্দী ছিলেন। আজকাল বিজলী পত্রিকায় সম্পাদকমণ্ডলীতে আছেন। প্রেস-এ যাবার পথে প্রায়ই তালতলায় ওদের ডেরায় একটু আড্ডা-ফাড্ডা দিয়ে, চা খেয়ে যান। আজও সেরকমই এসেছিলেন, এসে দেখেন হাট-করে খোলা দরজা, মুজফ্ফর নেই ঘরে, আর কাজি মড়ার মতো ঘুমোচ্ছে। দরজাটা বন্ধ করানোর জন্যেই কাজির ঘুম ভাঙালেন।
একটু অপ্রস্তুত হেসে কাজি বলে, পেটটা এত ভরা ছিল, শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি।
এমন পেট-ভরা, কোথাও নেমন্তন্ন খেয়ে এলে নাকি?
না, ঠিক নেমন্তন্ন নয়, ভীম নাগের দোকানে নিয়ে গিয়ে পেট ভরে দই-সন্দেশ খাওয়াল আফজাল।
আফজাল? মানে আফজালুল হক? মোসলেম ভারতের? হঠাৎ?
ওকে কবিতা শোনালুম একটা, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা, শুনে খুশি হয়ে আমাকে খাইয়ে দিল।
তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা? বল কী! লিখে ফেলেছ? তাহলে আমিই বা কী দোষ করলুম? আমাকে শোনাচ্ছ না কেন?
আপনি শুনলেই শোনাব আপনাকে। তাহলে বসুন। চা করি, খান। তারপর।
শুনে, কবিতার খাতাটা হাতে নিয়ে কবিতাটা আবার পড়লেন অবিনাশ। তারপর নজরুলের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, করেছ কী কাজি, এ কী কবিতা! এমন আশ্চর্য কবিতা পড়িনি কখনো আগে। কবে লিখলে?
গতকাল, কাজি বলে, ঘুম আসছিল না কাল রাতে; তারপর হঠাৎ কেমন মনে হল, একটা কবিতা লিখতে হবে। ওদিকে মুজফ্ফর তখন গভীর ঘুমে। আমি উঠে ভয়ে ভয়ে আলোটা জ্বালালুম, পাছে ওর ঘুম ভাঙিয়ে দিই। দেখলুম ও ঘুমিয়েই চলেছে, আলো বুঝতেও পারছে না। তখন লিখতে শুরু করলুম, পেনসিল দিয়ে। কেমন যে একটা তোলপাড় হচ্ছিল মনের মধ্যে বোঝাতে পারব না আপনাকে। মনে হচ্ছিল, দোয়াত-কলম দিয়ে পারব না লিখতে, কালি শুকিয়ে যাওয়া, দোয়াতে আবার কলম ডোবানো, এসব করতে পারব না, করার সময় হবে না। পেনসিল দিয়ে কিন্তু ঝর ঝর করে লেখাটা হয়ে গেল অবিনাশদা। লেখাটা দেখুন, বিশেষ কিছু কাটাকুটি নেই, যেন আমার মাথার মধ্যে ছিলই কবিতাটা। শুরু করতেই নিজেই নিজেকে যেন টেনে নিয়ে গেল। লেখা শেষ হতে, মুজফ্ফরকে ঘুম ভাঙিয়ে টেনে তুললুম। কাউকে একটা শোনাতেই হবে।
তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, বলতে থাকে কাজি, আমাকে ঘুম থেকে তুলল আফজাল। ওকে শোনালুম কবিতাটা। আপনি যেমন অবাক হলেন এখন, ও-ও সেরকমই অবাক হয়েছিল তখন। বলল, চল তোমাকে মিষ্টি খাওয়াব।
তো, কবিতাটা কী করবে এখন?
আফজাল নিয়ে গেছে, ও ছাপাবে।
ছাপাবে? আফজাল? ওর পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যা তো বেরিয়েছে সবে পরশুদিন, সেখানে তো আর ঢোকাতে পারবে না। অঘ্রাণ শেষ হয়ে গেছে, তুমি কি মনে কর ওর পরের সংখ্যা, যেটাকে অফিশিয়ালি ও কার্তিক সংখ্যা বলবে, সেটা কোনমতেই মাঘ-ফাল্গুনের আগে বেরোতে পারবে? তুমি তো পাগল হয়ে যাবে তাহলে। এই কবিতাটা, যেটা, তুমি যেমন বললে, মাথায় যখন তোমার এসেছে তোমাকে লিখতে হয়েছে সেই মুহূর্তেই; দোয়াতে কলম ডোবাবার জন্যে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারনি, একটানা লিখে যাবার জন্যে পেনসিল দিয়ে লিখেছ; সেই তোমার শ্রেষ্ঠ কবিতাটি, ছাপা হবার জন্যে তুমি অপেক্ষা করতে পারবে? পারবে সেই ফাল্গুন পর্যন্ত? কী মনে হয় তোমার?
নজরুলকে স্পষ্টতই অসহায় দেখতে লাগে; বলে, কী করব তাহলে?
আমাকে দাও, আমার পরের সংখ্যা বেরোবে জানুয়ারির ফার্স্ট-উইকে, বরঞ্চ আমি চেষ্টা করব আরও আগে বের করতে।
কিন্তু, কাজি বলে, আমি যে আফজালকে কথা দিয়ে দিয়েছি।
বেশ করেছ দিয়েছ। আর তোমার কথার খেলাপ তুমি করছোও না। আমি প্রস্তাব দিচ্ছি সাপ্তাহিক বিজলীর আগামী সংখ্যায় আমি কবিতাটা ছাপাব। একটু আগে জানতে পারলে এই সংখ্যাতেই ছাপানো যেত, কিন্তু বর্তমান সংখ্যাটা বেরিয়ে গেছে গতকালই। তবুও, পরের সংখ্যাটা নির্দিষ্ট দিনের আগেই আমি বের করবার চেষ্টা করব। এবং, তোমার দেওয়া-কথার সম্মান রাখবার জন্যে আমরা এই কথাও ছাপিয়ে দেব যে, মোসলেম ভারত পত্রিকার কার্তিক সংখ্যা থেকে এই কবিতা পুনর্মুদ্রিত হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে, খাতায়-কলমে, অর্থাৎ অফিশিয়ালি, কবিতাটা প্রথম প্রকাশের কৃতিত্ব আফজালুল হকের পত্রিকাই পেল। ঠিক আছে?
উনিশশো বাইশের ৬-ই জানুয়ারি, বাংলায় বাইশে পৌষ, সকাল থেকেই কলকাতায় অকালবর্ষণ। পৌষের ঠাণ্ডা পড়ল আরো জাঁকিয়ে। এরই মধ্যে বিজলী পত্রিকার সেই দিনের সাপ্তাহিক সংখ্যাটি পত্রিকার নানা বিক্রয় কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে। প্রাত্যহিক খবরের কাগজের যেসব গ্রাহকরা হকার মারফৎ বাড়িতে বসেই কাগজ পায়, তাদের মধ্যে বিজলীরও গ্রাহক যারা, তাদের বাড়িতে বাড়িতে সকালেই বিজলী, দীর্ঘ কবিতা কাজি নজরুল ইসলামের বিদ্রোহীসহ। এবং যাদুমন্ত্রে যেন কলকাতার নানা বাড়িতে শীতও উধাও। ছাতা-মাথায়, বর্ষাতি-আবৃত ক্রেতার দল বিজলী নিঃশেষিত বিক্রয়কেন্দ্র থেকে ব্যর্থমনোরথ হয়ে পৌঁছিয়ে যায় বিজলীর দপ্তরে। তিন-দিন পর পুনর্মুদ্রণ হয় সংখ্যাটির। মোট উনত্রিশ হাজার কপি বিজলী ছাপানো হল সেই সংখ্যায়। রেকর্ড সেল। দু-লক্ষেরও বেশি বাঙালি পাঠক পড়ল বিদ্রোহী।
অবিনাশ ভট্টাচার্য কিন্তু তাঁর কথা রাখলেন। বিজলীতে লেখা হল – “মোজাম্মেল হক-এর সম্পাদিত কার্তিক-সংখ্যা মোসলেম ভারত থেকে এটি পুনর্মুদ্রিত হল, কারণ কবিতাটি এত সুন্দর হয়েছে যে, আমাদের স্থানাভাব হলেও
বিজলী-র পাঠকপাঠিকাদের উপহার দেবার লোভ আমরা সম্বরণ করতে পারলাম না।” অতএব অন্য পত্রিকাগুলোও আর চুপ করে বসে থাকতে পারে না। চেনা-অচেনা নানা বাংলা মাসিক-সাপ্তাহিকে বেশ কিছুদিন ধরে পুনর্মুদ্রিত হতে থাকে বিদ্রোহী, কেউ কারো অনুমতি নেবার তোয়াক্কাও করে না। এমনকি প্রবাসীও। তেরশো আঠাশের মাঘ-সংখ্যা প্রবাসীতেও পুনর্মুদ্রণ হল বিদ্রোহীর। এমন কবিতা লেখা হয়েছে বাংলায়, তা পড়বার অধিকার যেন সব বাংলাভাষীরই আছে। কলেজ-স্ট্রীট অঞ্চলের নানা অফিস কর্মচারি-ছাত্র-মেসের বাসিন্দারা তো পড়শী নজরুলের। বত্রিশ নম্বরে এসে তারা নজরুলের সঙ্গ দাবি করে। অনেকে ধরে নিয়ে যায় তাকে নিজেদের মেস-এ। কয়েক কাপ চা আর কয়েক খিলি পানের বিনিময়ে তারা গান-আবৃত্তি শোনবার আর আড্ডা দেবার সুযোগ পায় কবির সঙ্গে। মোটের ওপর, কলকাতায় বিদ্রোহী নিয়ে হৈ হৈ!
বিজলীর একটা সংখ্যা নিয়ে পরের দিন সকালেই জোড়াসাঁকোয় ঠাকুরবাড়িতে পৌঁছল কাজি। গুরুদেব গুরুদেব বলে প্রবল চিৎকার করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে সে। তার গলা শুনে কবি বেরিয়ে আসেন, সিঁড়ির ল্যাণ্ডিঙে মুখোমুখি হয় তারা। কবিকে দেখেই কাজি বলে ওঠে, আপনাকে খুন করব আমি, খুন করতেই এসেছি, বলেই কবির পায়ে মাথা রাখে সে। খুন তো করেই ফেলেছিস, কবি বলেন হেসে, এমন কবিতা লিখেছিস তুই, তোর অগ্রজ আমরা সবাই খুন হয়ে গেছি। কবি জড়িয়ে ধরেন কাজিকে।
আপনি পড়েছেন?
পড়িনি আবার? সুধাকান্ত নিয়ে এসেছিল, কালই তো পড়লুম। এ কবিতা কাজি নজরুল ইসলাম ছাড়া আর কেউ কোনদিন লিখতে পারবে না। তুই একটু সাবধানে থাকিস কাজি। আমার কেমন যেন ভয় হয় তোকে নিয়ে, কেমন যেন মনে হয় – বড় বড় কবিদের যেমন হয় – কীট্স্-এর যেমন – তোর জীবনেও একটা ট্র্যাজেডি বোধ হয় অপেক্ষা করছে।
করুক, বলে কাজি, বেঁচে থাকতে আপনার ভালোবাসা পেয়েছি আপনার আশীর্বাদ পেয়েছি – আর কী চাই!
সুভাষ আর দেশবন্ধুর গ্রেপ্তারের পর দেশবন্ধুর বাঙ্গলার কথা পত্রিকা সম্পাদিকা হিসেবে চালাতে লাগলেন দেশবন্ধুর স্ত্রী বাসন্তী দেবী। সুভাষ তাঁকে মা বলে ডাকে। তার কাছে তিনি নজরুল ইসলামের কথা শুনেছেন। নারায়ণ পত্রিকাতে নজরুলের বাঁধন হারা উপন্যাসের কিছু কিছু উদ্ধৃতি পড়েওছেন তিনি। এবার বিদ্রোহী পড়বার পর দেশবন্ধুর খুড়তুতো ভাই সুকুমাররঞ্জনকে তিনি পাঠালেন কাজির কাছে, বাঙ্গলার কথার জন্যে একটা কবিতা সংগ্রহ করে আনতে।
একে-ওকে জিজ্ঞেস করে তালতলার বাড়িতে একদিন পৌঁছোয় সুকুমার। বাসন্তী দেবীর সঙ্গে কাজির পরিচয় নেই, তা সত্ত্বেও তিনি কবিতা সংগ্রহের জন্যে তাঁর দেওরকে পাঠিয়েছেন শুনে উৎফুল্ল কাজি বলে, আপনি একটু বসুন, আমি লিখে দিচ্ছি এক্খুনি। নীচু-গলায় নানা গল্পে জমে যান মুজফ্ফর আর সুকুমার, তাদের দিকে পিছন ফিরে কাজি লিখতে থাকে কবিতা। ঘন্টাখানেক পর কবিতাটা, যে কবিতার নাম দিল নজরুল ভাঙার গান, যা তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গান হিসেবে পরিচিত হবে ভবিষ্যতে, ডেকে তাদের শোনায় কাজি:
কারার ওই লৌহ-কপাট
ভেঙে ফেল, কর্রে লোপাট
রক্তজমাট
শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী!
ওরে ও তরুণ ঈশান
বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ
ধ্বংস-নিশান
উড়ুক প্রাচী'র প্রাচীর ভেদি!
সুকুমার কবিতাটা নেয়, বলে, বৌদি একদিন দুপুর বেলা খেতে আসার জন্যে নেমন্তন্ন করেছেন আপনাকে। যে কোন দিন, যে দিন সুবিধে হয় আপনার, আগে থেকে জানাবার কিছু নেই, দুপুরে রোজই থাকেন বৌদি।
যদি কালই যাই? – হেসে জিজ্ঞেস করে কাজি।
আসতে পারেন, এমনকি আজও, আমার সঙ্গেই। বৌদি বললেন, ও কর্মব্যস্ত মানুষ। আমি আগে থেকে একটা দিন ঠিক করে বলে দিলে ওর যদি অসুবিধে হয়! ওকে বলে দিও, যেদিন ওর সময় হবে, কোন সঙ্কোচ না-করে আসে যেন। সুভাষের কাছে ওর কথা শুনেছি, সুভাষ বলেছে ও সঙ্কোচ করার লোকই নয়।
ভাঙার গান বাঙ্গলার কথায় প্রকাশিত হল ২০শে জানুয়ারি। বিদ্রোহীর পর ভাঙার গান। বাঙলার সাহিত্যজগতে নতুন এক লড়াকু ধারা তৈরি হয়ে গেল যেন। উনিশশো পনেরয় বাঘা যতীনের মৃত্যুর পর স্বাধীনতা আন্দোলনের যে বিপ্লবী ধারা স্তিমিত হয়ে এসেছিল সাময়িকভাবে, সেই ধারায়, মনে হল, জলসিঞ্চন করলেন দশপ্রহরণধারিনী মায়ের মুসলমান সন্তান নজরুল।
সেই দিনই বিকেলে বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রীট থেকে নজরুলের বাসস্থানের ঠিকানা পেয়ে হুগলীর বিপ্লবী হামিদুল হক আর বিজয় মোদক এলেন কাজির সঙ্গে দেখা করতে। নজরুলকে হুগলি জাতীয় বিদ্যামন্দিরে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গেলেন তাঁরা।
নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার আবৃত্তি আর কারার ওই লৌহকপাট গানে মেতে উঠল হুগলী। ফেব্রুয়ারির পাঁচ তারিখে চৌরিচৌরায় সত্যাগ্রহী জনতা ও পুলিশের খণ্ডযুদ্ধ এবং কতিপয় পুলিশকর্মীর জীবন্ত দাহন, আর সঙ্গে সঙ্গে গান্ধীজির আন্দোলন স্থগিত রাখার ঘোষণা মিলিয়ে-মিশিয়ে দেশের উত্তাল অবস্থা সত্ত্বেও বিদ্রোহী-কবি কাজি নজরুল ইসলামকে নিয়ে তখন বাংলায় অন্তত প্রবল আবেগ। নজরুলের গান আর কবিতা তখন শতকণ্ঠে। যে-কটি পত্রিকা নজরুলের এই কবিতা আর গান ছেপেছে তারা গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে প্রায় হিমসিম খাচ্ছে। আফজালুল হক সেই আগস্ট মাসেই কিনেছিলেন নজরুলের ব্যথার দান-এর সত্ত্ব। আর বিদ্রোহীও তো প্রথম সংগ্রহ করেছিলেন তিনিই।
গ্রাহক-আবেগের কিছু আর্থিক পুরষ্কার কি তাঁরও প্রাপ্য নয়! এই উত্তাল অবস্থায় আর অপেক্ষা করলেন না আফজাল। ফেব্রুয়ারিতেই কলেজ স্কোয়ার ঈস্ট-এর মোসলেম পাবলিশিং হাউস প্রকাশ করল ব্যথার দান – নজরুলের প্রথম প্রকাশিত গল্পপুস্তক, মূল্য দেড় টাকা!
ভীম নাগের সন্দেশ, কয়েক কাপ চা, আর কয়েক খিলি পানেই নজরুল যে সন্তুষ্ট সে তো সবাই জানে। যে চারশো টাকা ওরিয়েন্টাল প্রিন্টিং অ্যাণ্ড পাবলিশিং কম্পানীর কাছ থেকে পেয়ে পুজোর উপহার কিনে আগের বার কুমিল্লায় গিয়েছিল সে, সে টাকাও তো এরই মধ্যে নিঃশেষিত। এখন, তার কবিতা গান আর গল্প যে ওই ভীম নাগের সন্দেশের মতোই বিক্রি হচ্ছে মুঠো মুঠো, তা কি একেবারেই বোঝে না কাজি? মাত্র একশো টাকায় ব্যথার দানের কপিরাইট আফজালুল হকের কাছে বিক্রি করায় মুজফ্ফরের ধমক কি এখনও বাজে না তার কানে? বাংলাভাষী পাঠক-শ্রোতার অভূতপূর্ব চাহিদার এই মুহূর্তে ঠিক সেই-সময়কার বাংলার সফলতম কবি-গীতিকার-গল্পকার কাজি নজরুল ইসলামের পকেটে ক'টা পয়সা? অর্থাভাবে সে কি এখনও মার খাবে, এখনও কি সে পিঠ পেতে রেখেছে ক্রমাগত গুম গুম গুম কিল খেয়ে যাবার জন্যে?
হঠাৎ কুমিল্লার কথা মনে পড়ে যায় তার।
কুমিল্লা? এই তো কুমিল্লা থেকে ফিরলে, গলার তীব্রতা আর নিজের আয়ত্বে রাখতে পারে না মুজফ্ফর। ওর সেই পরিচিত ভদ্রলোক – আবদুর হাফিজ শরীফাবাদী – এর মধ্যে নজরুল আর মুজফ্ফরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মস্কো-থেকে-আসা কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের যে নেতার সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দেবেন বলেছিলেন, সেই পুলিন গুপ্তর সঙ্গে। পুলিনকে নাকি পাঠিয়েছেন এম-এন-রায়, ভারতে তাঁর ভূতপূর্ব বিপ্লবী সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করবার জন্যে। না পারলে অন্তত কিছু খিলাফতি, কিছু কংগ্রেস-নেতার সঙ্গে। কয়েকদিনের মেলামেশায়, এবং এককালের ডাকসাইটে সন্ত্রাসবাদী নেতা ভূপেন্দ্রকুমার দত্তর ধারণা অনুযায়ী বোঝা যাচ্ছে, যে এই পুলিন ঠিক-ঠিক কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নেতা কোনমতেই নয়, যা সে বলে তার বেশির ভাগটাই ধাপ্পা, ওরই দেওয়া নানা বিবরণের মধ্যে যদি ক্রস-চেক করা যায় তাহলেই ওর ধাপ্পা সহজেই বোঝা যায়, যদিও যথেষ্ট বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও এম-এন রায় নিজে ওকে বিশ্বাস করেছেন। অন্য কিছু না হোক, মুজফ্ফর কিন্তু মনে করে, এই লোকটার যোগাযোগে কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল এবং এম-এন-রায়ের সঙ্গে তাদের যোগাযোগটা অন্তত হতে পারে। সেটাই বা কম কী? ওরা যে কাজটা করতে চায়, সে কাজটা তো পুলিন গুপ্তকে বাদ দিয়েও করা যায়। আর করা যায়ই বা কেন, শেষ পর্যন্ত এই ধাপ্পাবাজ পুলিনকে বাদ দিয়েই তো যা-করবার তা করতে হবে।
মানলুম, বলে কাজি, ওরই সূত্রে এম-এন-রায়ের সঙ্গে যোগাযোগের পর আমরাই ওর চরিত্র ফাঁস করে দেব তাঁর কাছে, কিন্তু তিনি যে আমাদেরই বিশ্বাস করবেন তার কী মানে?
বিশ্বাস না-ই করতে পারেন, বলে মুজফ্ফর, সে ক্ষেত্রে উনিই হয়তো আমাদের ত্যাগ করবেন। করুন, আমাদের কী ক্ষতি? আমরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থাকব। থাকব সাময়িক ভাবে। দেখ কাজি, সমাজতন্ত্রের আন্তর্জাতিক আন্দোলনে থাকবার যে সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি, আমাদের মতো গরীব পরাধীন দেশে থেকে সে কাজটা যে খুব সহজসাধ্য নয় তা তো আমরা জানিই। কিন্তু চেষ্টা আমাদের চালিয়ে যেতেই হবে। আর এটাও মনে রেখ, একটা কথা রায়সাহেবকেও বুঝতে হবে। আমরা যদি আসল লোক না-ই হই, তাহলে আমরা কী? একটাই হতে পারে, আমরা পুলিশের লোক। যদি পুলিশেরই লোক হই, তা হলে উনি যাকে বিশ্বাস করেন সেই পুলিন গুপ্ত আমাদেরই সঙ্গে কেন যোগাযোগ করল? ওঁকে ধরিয়ে দেবার জন্যে? আর তা ছাড়া, এখানকার পুলিশ এম-এন-রায়কে ধরবে কী করে? কেনই বা? মস্কো বা বার্লিন, যে দুটো জায়গায় উনি থাকেন, তার কোনটাই তো বৃটিশ শাসনের জায়গা নয়।
এম-এন-রায় তো আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। তাঁকে ধরবার জন্যে তো আর টিকটিকি লাগিয়ে কেস তৈরি করতে হবে না! তাঁকে জব্দ ভারতের পুলিশ করবে কীভাবে?
মানলুম, বলে কাজি, কিন্তু, এখানে এখন আমার কাজটা কী? আমাদের নিজেদেরই সন্দেহ আছে পুলিনকে নিয়ে, ও তো শুধুই আমাদের এখানে-ওখানে পাঠাচ্ছে, আর ওর ব্যক্তিগত কাজই করাচ্ছে। সেই কাজ যদি আরও কিছুদিন তুমি করতেই চাও তো কর, কিন্তু আমি এখানে বসে কী করব?
তুমি যে কথাটা বলছ, বলে মুজফ্ফর, সেটা ঠিকই। পুলিনের সঙ্গে যেটুকু যোগাযোগ এখনো কিছুদিন রাখতে হবে সেটা আমি একাই করতে পারি। কিন্তু ন্যাশনাল জর্ণাল্স্? কুত্বুদ্দিন সাহেবের এত টাকা-পয়সা খরচ করে কম্পানীর প্রাথমিক রেজিস্ট্রেশন হল, প্রসপেক্টাস ছাপা হল, কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল, এখন তুমি কুমিল্লায় চলে যাবে?
আমি কি চিরকালের জন্যে যাচ্ছি? কাগজের কাজ শুরু হবার আগেই আমি ফিরে আসব।
ফিরেই যদি আসবে তাহলে এখন যেতে চাইছ কেন? কী কাজ আছে তোমার কুমিল্লায়?
আমার যেতে ইচ্ছে করছে, জবাব দেয় কাজি।
দেখ কাজি, খানিকটা বিরক্ত হয়েই বলে মুজফ্ফর, এটা কি নেহাৎই ছেলেমানুষি হচ্ছে না? যখন-তখন তোমার কুমিল্লায় যেতে ইচ্ছে করলেই হল! আর, এমন ইচ্ছেটা হবেই বা কেন?
কলকাতায় আপাতত আমি কী করছি? – মুজফ্ফরের কথার সরাসরি জবাব না-দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে কাজি। সকালে ঘুম থেকে ওঠবার পর থেকে চার বেলা খাচ্ছি আর ঘুমোচ্ছি। তুমি তো তবু, আর কিছু না হোক, ওই চালবাজ পুলিন গুপ্তর খিদমৎ খাটছ? কিন্তু আমি?
তুমি তো কিছু লেখালেখি করলেই পার। নিজেই বলছ অগাধ সময় হাতে, তাহলে কিছু লিখছ না কেন?
আমার লেখা আসছে না, প্রায় বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে বলে কাজি।
তাহলে আমি আর কী বলব? কুমিল্লায় গেলেই তোমার লেখা আসবে?
আসে তো, প্রায় অবুঝের মতো জবাব দেয় কাজি।
ঠিক আছে, শেষ তুণটা এবার ছাড়ে মুজফ্ফর, এবার ফিরলে আর তিনের চারের সি তালতলা লেনে ফিরো না।
মানে?
তুমি না থাকলে এই ঘরটা রেখে দেবার সত্যি সত্যিই কোন মানে হয়না কাজি। আমি তো চালচুলোহীন ফকির-দরবেশ গোছের লোক, যত্রতত্র ভোজন আর হট্টমন্দিরে শয়নই আমার ভবিতব্য। এ ঘরটা ছেড়েই দেব।