পাঁচ বছর পর ছাড়া পেয়েছেন নিবারণচন্দ্র ঘটক, চেহারায় তাঁর বিশেষ বদল হয়নি, শুধু চুলে সাদার পরিমাণ বেড়েছে খানিকটা। কলকাতা থেকে বেরোবার আগে নজরুল ভেবেছিল স্যরকে একটা চিঠি লিখবে। খানিকটা সঙ্কোচে, খানিকটা অনিশ্চয়তায় লেখা হয়নি চিঠিটা। স্যর কি তাকে চিনতে পারবেন? এখন স্যর থাকেন কোথায়? অবিশ্যি শিয়ারশোলের রাজবাড়ির ঠিকানায় স্যরের নামে চিঠি লিখলে সে চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছে যাবারই কথা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেক কিছু ভেবে চিঠি লেখা থেকে বিরতই থেকেছে নজরুল।
তবুও কিন্তু সেই রাজবাড়িতেই যেতে হল। এখানে-ওখানে খোঁজ করে, একে-ওকে, এমনকি স্কুলের মাষ্টারমশাইদেরও জিজ্ঞাসা করে নিবারণবাবুর কোন খবর পাওয়া গেল না। রাজবাড়িতে গিয়ে খোঁজ করায় নজরুল চেনে না এমন একজন তার পরিচয় জানতে চাইল। পরিচয় শুনে, সে নজরুলকে বলে পরের দিন আসতে। পরের দিন রাজবাড়ির সেই লোকটা তাকে নিয়ে গেল একটা ছোট বাড়িতে, নজরুলের মনে হল স্যর একাই থাকেন সেখানে। স্যর একটু হাসলেন ওকে দেখে। জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছিস?
ভালোই ছিলাম স্যর, কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে খুব মন খারাপ।
মন খারাপ? কেন? তুই কী করিস আজকাল?
বলবার মতো তেমন কিছুই করি না স্যর, দু'দিন আগে পর্যন্ত দৈনিক নবযুগ নামে একটা সান্ধ্য দৈনিকে তিন সম্পাদকের একজন হিসেবে কাজ করতুম।
সে তো ভাল কাজ, তা 'করতুম' কেন? ছেড়ে দিয়েছিস নাকি?
কয়েকদিন আগে হাওড়ায় গিয়ে একজনের সঙ্গে পরিচয় হল, বলে নজরুল, তাঁর কাছে বাঘা যতীনের অনেক কথা শুনলুম। সেই থেকে দিবারাত্র আপনার কথাই মনে পড়ছে স্যর। মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যেও আপনাকে স্বপ্ন দেখছি। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে আমি সময় নষ্ট করছি। পল্টনে গিয়ে এই যে গুলি-গোলা-বেয়নেট চালানো শিখে এলুম, সে কি কোন কাজেই লাগবে না? শেষ পর্যন্ত অনেক ভাবনাচিন্তা করে আপনার কাছেই এলুম স্যর।
আমার কাছে যে এসেছিস সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু তোর সিদ্ধান্ত তোকেই নিতে হবে। তোর সঙ্গে হাওড়ায় কার দেখা হয়েছিল আমি জানি না, জানতে চাইও না, শুধু একটা কথা আমি নিশ্চিতভাবে জানি, বিপ্লবী আন্দোলন এখন অনেকটাই স্তিমিত। এই যে গান্ধী নামের এক ভদ্রলোক এখন প্রায় একাই বৃটিশবিরোধী সব আন্দোলনেরই মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তিনি মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছেন বিনা অস্ত্রে বৃটিশ-খেদানো সম্ভব। এই বিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে লাভ নেই এখন, আরও কিছুটা সময় গান্ধীকে দিতেই হবে। গঙ্গার দু'পার ধরে যত ছেলেরা আমাদের সঙ্গে কাজ করত, তাদের মধ্যেও অনেকেই এখন গান্ধীর রাস্তায়। তবে জেনে রাখিস, যে সংগঠন বাঘা যতীন-রাসবিহারী বসুরা তৈরি করেছিলেন, তা সহজে ভেঙে পড়ার নয়; দেশে বিদেশে যাদের কাজ করার, তারা করেই যাচ্ছে। একটা কথা মনে রাখবি। যে বস্তুতে প্রাণ থাকে তা একই গতিতে চিরকাল এগিয়ে যেতে পারে না, জৈবিক কারণেই মাঝে মাঝে গতি শ্লথ হয়, কোন কোন সময় কিছুদিনের জন্যে স্তব্ধও হয়তো হতে হয়। ঠাণ্ডা মাথায়, বুঝেসুজে, সে সময়টুকু তো দিতেই হবে।
তাহলে আমি এখন কী করব স্যর?
নিবারণবাবুকে একটু চিন্তিত দেখায়, বেশ কিছুক্ষণ তিনি নজরুলের চোখে চোখ রেখে চুপ করে থাকেন। অস্বস্তি হয় নজরুলের, একটু পর চোখ নামিয়ে নেয় সে।
তুই তো আমাদের স্কুলে ক্লাশ এইটে ভর্তি হয়েছিলি, থার্ড ক্লাশে, তাই না? তুই পুব বাংলার ময়মনসিংহ থেকে এসেছিলি না?
আপনার মনে আছে স্যর? – নজরুল উচ্ছ্বসিত, ময়মনসিংহে আমি দরিরামপুর হাই স্কুলে পড়তুম।
মনে যে আছে তার কারণ আছে। আমাদের স্কুলে এসে তুই সেকেণ্ড ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়েছিলি সংস্কৃত। সাধারণত মুসলিম ছাত্ররা সেকেণ্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে ফারসী নিত, তুই কিন্তু বেশ জোরজার করেই সংস্কৃত নিলি। সংস্কৃতর মাষ্টারমশাই আবিষ্কার করলেন যে আগের ক্লাশ পর্যন্ত তুই সংস্কৃত পড়িসইনি, এমনকি দেবনাগরী অক্ষরও চিনতিস না। তবুও তোর জেদ, অক্ষর তুই চিনে নিবি, কিন্তু এ জীবনে ফারসী পড়বি না। মৌলবি হাফিজ নুরুন্নবী সাহেব তোকে জেরা করে বের করলেন, আগের বছর দরিরামপুর স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় তুই ফারসীতে আটানব্বই নম্বর পেয়ে ক্লাশে ফার্স্ট হয়েছিলি। কিন্তু একেবারেই ফারসী জানত না এমন কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেস মার্কস দিয়ে পাশ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারই প্রতিবাদে তুই নাকি প্রতিজ্ঞা করেছিলি জীবনে আর ফারসী পড়বি না। শেষ পর্যন্ত নুরুন্নবী সাহেবের বেতের কাছে তোকে হার মানতে হয়েছিল, ঠিক?
লজ্জা পেয়ে যায় নজরুল, স্যর, এতটা আপনার মনে আছে?
হ্যাঁ, মনে আছে বলেই তোকে এখন আমি একটা প্রস্তাব দেব, বলেন নিবারণ বাবু। আচ্ছা, দরিরামপুরের হেডমাষ্টারমশাইকে মনে আছে তোর?
দেখলে নিশ্চয়ই চিনব স্যর, কিন্তু নাম মনে নেই, বোধ হয় হেড স্যরের নাম জানতামও না।
বিপিনচন্দ্র চাকলাদার, বলেন নিবারণ বাবু, নাম জানতিস না, আর, আরও যেটা জানতিস না তা হল, উনি অনুশীলন সমিতির একজন সভ্য ছিলেন, এখনও আছেন। তুই এক কাজ কর। যত তাড়াতাড়ি পারিস, দরিরামপুর চলে যা। বিপিনবাবুর সঙ্গে দেখা কর। ওঁর মনে আছে তোকে। ক্লাশ সেভেন থেকে এইটে সদ্য-ওঠা একটা ছেলের হেডমাস্টারের মুখের উপর তাঁর অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কথা মনে আছে ওঁর। উনিই তোকে রাস্তা বাতলাবেন।
নানারকমের যান, খানিকটা পায়ে হাঁটা, গোরুর গাড়ি খানিকটা, এই সবের মাধ্যমে যখন কাজির শিমলা গ্রামে পৌঁছল নজরুল, তখন ভর দুপুর। কপালজোরে জানুয়ারির শীত, আর পল্টন থেকে পাওয়া মোটা উলের পুরো-হাতা-সোয়েটারের দৌলতে কষ্ট কম হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই গ্রামে এখন খাবে কোথায় আর শোবেই বা কোথায়! দরিরামপুরের স্কুলে পড়বার সময় এই গ্রামে যাঁর বাড়িতে থাকত নজরুল তাঁর নাম কাজি শাখাওয়াতউল্লাহ্। আসানসোলে যে পুলিশ অফিসার রুটির দোকানের চাকরির থেকে উদ্ধার করেছিলেন নজরুলকে তাঁর নাম কাজি রফিজুল্লাহ্। নজরুলের পড়াশোনায় উৎসাহ দেখে রফিজুল্লাহ্ সাহেব ওকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ময়মনসিংহের কাজির শিমলা গ্রামে নিজের দাদা শাখাওয়াতউল্লাহ্ সাহেবের বাড়িতে। সেখান থেকেই দরিরামপুর হাই স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল নজরুলকে। পাঁচ মাইল দূরের এই স্কুলে যাতায়াতের অসুবিধের জন্যে – বিশেষ করে বর্ষাকালে – শেষ অবধি নজরুল থেকেছে ওই দরিরামপুরেই। বিচুতিয়া বেপারির বাড়িতে। অন্যের বাড়িতে থেকে স্কুলে পড়ার এই ব্যবস্থাকে তখন বলা হত জায়গীর ব্যবস্থা। দূর দূর গ্রাম থেকে যেসব ছেলেরা পড়তে আসত আর একটু বড় জায়গায়, তারা অনেকে স্থানীয় মানুষের বাড়িতে জায়গীর থাকতে পারত। একটু-আধটু বাড়ির কাজের বিনিময়ে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। দরিরামপুরে থাকার এই ব্যবস্থাটাও করে দিয়েছিলেন কাজি শাখাওয়াতউল্লাহ্ সাহেবই। নজরুল ঠিক করল সেই শাখাওয়াতউল্লাহ্ সাহেবের বাড়িতেই যাবে প্রথম।
যেটুকু কালো দাগ ছিল শাখাওয়াতউল্লাহ্ সাহেবের চুল-দাড়িতে, সেটুকুও নেই আর। সবটাই সাদা। কিন্তু নজরুলকে চিনতে সময় লাগল না। প্রাথমিক কুশল বিনিময়, কে কী করে কোথায় কে আছে এখন – এই সব সংবাদ বিনিময়ের পর নজরুল বলল, দরিরামপুরের হেড স্যরের সঙ্গে সে দেখা করবে এবং কয়েকদিন হয়তো দরিরামপুরেই থাকবে। সে রাতটা তাঁর বাড়িতেই কাটিয়ে যাবার জন্যে অনুরোধ করলেন শাখাওয়াতউল্লাহ্ সাহেব।
পরের দিন সকালবেলাতেই নজরুলকে দেখে উচ্ছ্বসিত বিপিনবাবু। মনে হল, তিনি যেন নজরুলের প্রতীক্ষাতেই ছিলেন। তুই কাজি নজরুল ইসলাম না? – দেখা হতেই প্রথম এ-ই প্রশ্ন স্যরের!
হ্যাঁ স্যর, আপনি চিনতে পারছেন?
চিনতে পারব না! তোর কাছে একটা ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপার ছিল যে রে। তখন কী করে জানব তুই হঠাৎ স্কুল ছেড়ে চলে যাবি। আর সেই বয়েসে তোর কাছে ক্ষমা চাইতে গেলেও কি বুঝতে পারতিস তুই?
ছি ছি, এসব কী বলছেন স্যর।
ছি ছি তো বটেই, কিন্তু আমি শত চেষ্টা করলেও সেই বয়েসে তুই বুঝতে পারতিস না। সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে ছাত্রসংখ্যা বছর বছর না বেড়ে যদি কমে যায়, সরকার তাহলে সে স্কুলের সাহায্য বন্ধ করে দেবে। সাহায্য বন্ধ, তো স্কুল বন্ধ। স্কুল বন্ধ, তো গ্রামের চাষার বাড়ির ছেলেরা ভারি খুশি, পড়াশোনা করতে হবে না আর। তাই গ্রামের স্কুলের মাষ্টারমশাইদের বড় সাবধানে চলতে হয়। চেষ্টা করতে হয়, যাতে কেউ ফেল না করে। ফেল করলেই তো স্কুলে আসা বন্ধ করে দেবে ছেলেরা। তাই তাদের পাশ করাবার জন্যে মাঝে মাঝে গ্রেস মার্কস দিতে হয় বৈকি। কিন্তু সেই বয়েসে তোকে এ কথা বললে তুই কি বুঝতিস? তোর বরঞ্চ মনে হত, ভালোই তো, যার পড়াশোনার ইচ্ছে নেই তাকে পড়িয়ে লাভ কী! কি রে, ঠিক বলেছি না?
খুবই লজ্জা পায় নজরুল, স্যর, সেই অল্প বয়েসে না বুঝে আপনার সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করেছিলুম, এ তো আমারই অপরাধ। ক্ষমা তো আমারই চাওয়া উচিত।
ঠিক আছে ঠিক আছে, বলেন বিপিনবাবু, তুই করিস কী আজকাল, এতদিন পর এই গ্রামে আবার কেন?
নজরুল তার পল্টনে যাওয়ার কথা, ফিরে এসে মুজফ্ফরের সঙ্গে দৈনিক নবযুগ চালাবার কথা, সবই বলে। খবরের কাগজের কাজ ছেড়ে শেষ পর্যন্ত শিয়ারশোল স্কুলের মাষ্টারমশাই নিবারণচন্দ্র ঘটকের সঙ্গে দেখা করার কথাও বলে। নিবারণবাবুর নির্দেশেই যে সে দরিরামপুরে এসেছে, এ কথা বলতেও ভোলে না। তারপর জিজ্ঞেস করে স্যরকে, স্যর, খবরের কাগজে লেখালিখি করে কী লাভ?
খবরের কাগজে লিখে একেবারে যে লাভ নেই সে কথা বলতে পারি না, স্যর বলেন, স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করার প্রতিজ্ঞা করেছিল যারা, সেই যুবকরা যদি শুধুমাত্র বৃটিশ রাজার অধীনে, রাজার চাকরদের মর্জি মতো, অল্প খানিকটা শাসন চালাবার অধিকারের আশায় গান্ধীর ভিক্ষাদর্শে সন্তুষ্ট হতে চায়, তখন, যে কাজটা তারা করছে তার অনেকটাই যে ভুল, সেটা তাদের বুঝিয়ে দেবে কে? বোঝাতে পারবে তারাই যারা যুক্তি দিয়ে আবেগ দিয়ে আদর্শের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে কলম ধরবে। আজ বিরাটসংখ্যক যুবমনে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে প্রগতিশীল সাহসী দেশপ্রেমিক সাংবাদিকতার প্রয়োজন অনেক বেড়ে গেছে বাবা।
কিন্তু স্যর, বিদেশী শাসক সেই সাংবাদিকতা কি মেনে নেবে? আমাদের দৈনিক নবযুগ চালু হয়েছে গত বছর জুলাই মাসে। বারোই জুলাই বেরিয়েছিল আমাদের প্রথম সংখ্যা। সেই হিসেবে মাত্র ছ' মাস। এরই মধ্যে আমাদের কাগজ হোম ডিপার্টমেন্টের হুমকি পেয়েছে চার-পাঁচবার, জামানত বাজেয়াপ্ত করে জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে একবার, শেষ পর্যন্ত দু' হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে তবে আবার পাওয়া গেছে ছাপাবার অনুমতি।
এ কথাটা তুই ঠিকই বলেছিস, বলেন স্যর, যে কাগজ সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে চলতে চায় তাকে বৃটিশ সরকার চলতে দেবেই বা কেন! কিন্তু আমি যা-ই মনে করি আর যা-ই মুখে বলি, মুশকিল হয়েছে এই যে গান্ধীর এই তথাকথিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলন কমবয়েসী ছেলেদের মধ্যেও প্রভাব যে ফেলেছে অনেকটাই, তা-ও অস্বীকার করতে পারি না। ভয় হয় একটা পুরো জেনারেশন না ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। আমরা তাই একটা অন্য কথা ভাবছি। গান্ধীর আন্দোলনের পুরোপুরি বিরোধিতা না করেও – এমনকি প্রয়োজন হলে সেই আন্দোলনে একটু-আধটু অংশ নিয়েও – যুবসমাজকে সমাজ সংস্কারের নানা কাজে ব্যস্ত রাখা।
এই পর্যন্ত বলার পর হঠাৎ যেন মনে পড়েছে এই ভাবে স্যর জিজ্ঞেস করেন নজরুলকে, এখন কয়েকদিন এখানে থাকবি তো?
এসেছি যখন, নজরুল বলে, আমার তো থাকতে ভালই লাগবে। কিন্তু আপনি কী কাজ দেবেন সেটাই বড় কথা, সেটা যেখানে থেকেই হোক না কেন।
স্কুলে পড়ার সময় তুই বিচুতিয়া বেপারির বাড়িতে থাকতিস না? এখন দিন তিনেক আমার বাড়িতেই থেকে যা, আর তোর পুরোনো সব স্মৃতি, দরিরামপুর, কাজির শিমলা, এ সব রোমন্থন কর। পথে-ঘাটে ঘোরাঘুরি কর। ভালোই লাগবে মনে হয়। তিন দিন পর আমি যাব কুমিল্লা, সঙ্গে তোকে নিয়ে যাব। কুমিল্লার অতীন বাবুর নাম শুনেছিস? অতীন্দ্র রায়চৌধুরি?
নজরুল কোন অতীন বাবুকে মনে করতে পারে না।
বিপিনবাবু স্যর একাই থাকেন। তাঁর অতি ছোট বাড়িটার একটা কোণের ঘরে নজরুলের থাকার ব্যবস্থা হল। একজন বৃদ্ধা বাড়ির যাবতীয় কাজকর্ম করেন। দিদি সম্বোধন করে স্যর তাঁর সঙ্গে নজরুলের আলাপ করিয়ে দিলেন। বললেন, এ নজরুল, আমার ছাত্র। এখানকার স্কুলেই পড়ত আগে, থাকতও গ্রামের একজনের বাড়িতে। এখন কয়েকদিনের জন্যে এই গ্রামে আবার থাকতে এসেছে। ও ভালো গান গায়, বাঁশিও বাজায় খুব ভালো। যখন স্কুলে পড়ত ওর গান আর বাঁশির সুর গ্রামের সবায়ের খুব পছন্দের ছিল। যে ক'দিন ও থাকবে, আবার রাস্তাঘাটে ঘুরে ঘুরে বাঁশি বাজাবে, গান গাইবে। যখন ইচ্ছে, আসবে। যখন ইচ্ছে, যাবে। তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি ওকে। দেখো, কষ্ট না পায়।
নজরুলের যেমন স্বভাব, মুহূর্তের মধ্যেই স্যরের যিনি দিদি তিনি হয়ে গেলেন ওর মাসিমা। মাসিমাকে স্বতঃপ্রবৃত্ব হয়েই বাঁশি বাজিয়ে শোনায় সে, আর তার পরেই বলে, আমি কিন্তু চান-টান খাওয়া-দাওয়া সেরেই বেরোব মাসিমা। স্কুলে পড়বার সময় যে আম গাছটার তলায় বসে বাঁশি বাজাতুম সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
আম গাছটা খুঁজে পেতে যে অনেকটা সময় গেল এমন নয়। নজরুল অবাক হয়ে দেখে, এই যে ছ-সাত বছর বাদে সে ফিরে এসেছে দরিরামপুরে, কিছুই যেন বদলায়নি। এই আমগাছটা, এর সামনের পুকুরটাও তো ঠিক আগের মতোই আছে। এখানে বসে বসেই দূরে বিচুতিয়া বেপারীর বাড়িটা দেখা যায়, বাড়ির সামনের কাঁঠাল গাছটা একই রকম ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, কোথায় গেল মাঝখানের এতগুলো বছর! নজরুলের মনে হয়, সে যেন স্কুলের পর ওই বাড়িটাতেই কোনরকমে বইখাতাগুলো রেখে দৌড়ে এখানে এসে বসলো এইমাত্র। সূর্য অস্ত যাবার আর বেশি দেরি নেই, লালচে আকাশের রং পুকুরের জলে পড়ে নিস্তরঙ্গ জলটারও রংও বদলিয়ে দিল। এরই মাঝে এক দঙ্গল কিশোরীর কলধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে পুকুর-পার। ওরই মধ্যে শ্যামলা একটি মেয়ে, বন্ধুদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বোধ হয় নজরুলের দিকে তাকিয়ে নিল একটা মুহূর্তের জন্যে। তার শিথিল বেণী থেকে কি খসে পড়ল একটা ছোট্ট মাথার কাঁটা? কবে যেন সেই ছোট্ট কাঁটাটাকে বুক-পকেটে ভরে নিয়ে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল নজরুল তার ছোট টিনের বাক্সটায়। তারপর চুরুলিয়া-আসানসোল-শিয়ারশোল-কলকাতা-নৌশহরা-করাচি হয়ে আবার কলকাতায় যখন ফেরে নজরুল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রীটের ঠিকানায়, তখন ওর জিনিসপত্রের মধ্যে মুজফ্ফর আহ্মদের চোখে পড়ে যায় এতদিন-ধরে-যত্ন-করে-রেখে-দেওয়া ওই মাথার কাঁটা!
এখনও একটু একটু আলো আছে। নজরুল জানে আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঝুপ করে নেমে আসবে অন্ধকার, আর পাড়াগাঁয়ের রাস্তায় জনমনিষ্যির চিহ্নও দেখা যাবে না। রাস্তায় হঠাৎ দেখা সীতুর সঙ্গে। সীতু! কী যেন পুরো নামটা ওর! নজরুল মনে করতে পারে না, সীতু কিন্তু চেনে ওকে, কাজি না? সীতুকে ও বলে বিশেষ কাজে ও দরিরামপুরে এসেছে দিনকয়েকের জন্যে, এখন আছে হেড স্যর বিপিন বাবুর বাড়িতে।
হেড স্যরের বাড়িতে? – সীতু একটু অবাকই হয়। ঠিক আছে, বলে সীতু, কাল ভোরবেলা আমি এসে তোর ঘুম ভাঙাব, খেজুর রস খাইয়ে যাব তোকে, খাবি তো?
ভোরবেলা তুই যদি ঘুম ভাঙাতে আসিস আমার, স্যরের ঘুমও তো ভেঙে যাবে রে।
তাতে কী? – হাসে সীতু, স্যরের জন্যেও তো আনব।
স্যরের জন্যেও যদি খেজুর রস আনে, তাহলে স্যর কি আর বিরক্ত হতে পারেন? – এত সরল যুক্তি! নজরুল আপন মনেই হেসে ফেলে।
কুমিল্লায় যাবার দিন স্যর বলেন, অতীন বাবু আমার চেয়ে বয়েসে অনেক ছোট হলেও পুব বাংলায় যে-সব বিপ্লবী নেতা আপাতত জেলের বাইরে আছেন উনিই তাদের মধ্যে প্রধান। কুমিল্লাতেই বাড়ি। সেখানে আমাদের সবায়ের মীটিং হবে একটা। গান্ধীর আন্দোলনের মধ্যেও বিপ্লবী আদর্শে অনুপ্রাণিত ছেলেরা কীভাবে কী কী কাজ করতে পারে, সে সবই আলোচনা করব আমরা। তুই থাকবি সেই মীটিঙে। তারপর নিজেই নিজের কর্তব্য স্থির করতে পারবি।
বিপিনবাবুর মুখে অতীন্দ্র রায়চৌধুরির কথা শুনে নজরুলের ধারণা হয়েছিল কুমিল্লায় পৌঁছিয়ে ওরা প্রথমে অতীন্দ্র বাবুর বাড়িতেই যাবে। কিন্তু স্যরের মাথায় ছিল অন্য পরিকল্পনা। স্যর ওকে নিয়ে সোজা উঠলেন জেলার কংগ্রেস নেতা বসন্তকুমার মজুমদারের বাড়ি। যাওয়ার পথে নজরুল শুধু জানল, যাঁর বাড়িতে যাওয়া হচ্ছে তিনি এখন কংগ্রেসের নেতা হলেও বিপ্লবী দল যুগান্তরের কিছুদিন আগেও তিনি একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন, এখনও আছেন। গান্ধীপ্রধান কংগ্রেসকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা বা বর্জন না করেও বিপ্লবী কর্মীরা কীভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে কাজ করতে পারে সে বিষয়ে বসন্তবাবুর সঙ্গেই প্রথম পরামর্শ করতে চান বিপিনবাবু।
বসন্তবাবুর বাড়ি কুমিল্লায় কান্দিরপাড়ে। তাঁর সঙ্গে কলকাতায় অনেকের পরিচয়। নজরুলের নাম তিনি আগেই শুনেছেন। তিনি জানেন, দৈনিক নবযুগ পত্রিকার যে সে সম্পাদক শুধু তা-ই নয়, সে এরই মধ্যে কলকাতায় একজন পরিচিত কবি, গায়ক এবং সঙ্গীতজ্ঞও। বসন্তবাবু বললেন, সমস্যাটা খুব যে কঠিন তা নয়। গান্ধী বলেছেন আপাতত কিছুদিন হিংসা নয়। উনি অহিংসার জোরটা পরীক্ষা করে দেখতে চান। দেখুন না। হিংসা না হয় না-ই করলাম এখন, কিন্তু সহিংস আন্দোলন যখন প্রয়োজন হবে, তার জন্যে তৈরি থাকব না কেন? উনি তো এক বছর সময় চেয়েছেন, এক বছর হয়ে গেলে আবারও হয়তো কিছুদিন চাইবেন। সফল যদি না হন, তখন কী বলবেন উনি? হয়তো বলবেন অনেক কিছুই, কে জানে! কিন্তু সেই অনেক কিছু যে আমাদের মনের মতোই হবে তার তো কোন মানে নেই। আমাদের মনের মতো নয় এমন কথা গান্ধী বলতে পারবেন তখনই, যদি আমরা তৈরি না থাকি। আমাদের প্রস্তুতিটাই আসল কথা। বিপ্লবী আন্দোলনে যারা বিশ্বাসী তাদের তো একটা সুবিধে আছে। তাদের ঢাকঢোলের দরকার নেই। খবরের কাগজগুলো তাদের সম্বন্ধে কিছুই যদি না লেখে তাতেও অসুবিধে নেই। সত্যি কথা হচ্ছে এই যে, খবরের কাগজ যতই কম লেখে ততই মঙ্গল। আমাদের আসল মন্ত্র হবে, সব সময়ের জন্যে প্রস্তুত থাকা, যখনই প্রয়োজন হবে সেই মুহূর্তেই যেন ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি।
নজরুল বলল, তৈরি থাকা মানে কী? বাঘা যতীন যেমন করতেন, অনেক দূরে মানুষের বাস নেই যেখানে, ছেলেদের সেখানে নিয়ে গিয়ে বন্দুক ছোঁড়া প্রাকটিস করানো?
সেটাও হতে পারে, কিন্তু মানুষের বাস নেই যেখানে, বাঘাযতীনের কাজ তো শুধু সেখানেই নয়। বাঘা যতীনই প্রথম বিপ্লবী যিনি আমাদের শিখিয়েছেন মানুষের সঙ্গে কাজ করতে। সব রকমের মানুষের সঙ্গে, বলতে থাকেন বসন্ত, সে মিলিটারির ব্যারাকেই হোক অথবা খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষই হোক। আসল লড়াইয়ের দিন যদি মানুষ আমাদের পাশে না থাকে তাহলে লড়াইটাতে আমরা জিতব কীভাবে? কিন্তু সাধারণ মানুষ আমাদের পাশে থাকবে কেন? স্বাধীনতার আন্দোলন তো আছেই, তবে তারই সঙ্গে সাধারণ মানুষের বেঁচে-থাকার লড়াইয়েও থাকতে হবে সারা বছর, বিশ্বাস অর্জন করতে হবে তাদের, তবেই না আমাদের লড়াই আর তাদের লড়াই মিলে একটাই লড়াই হয়ে উঠবে। এই যে এখন চাঁদপুর-গোয়ালন্দে স্টীমার ধর্মঘট চলছে, এ তো এক দিনে হয়নি। স্টীমার কর্মচারিদের সঙ্গে মাসের পর মাস আমরা কাজ করেছি, তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে লড়াই করেছি, শেষমেশ ধর্মঘট। গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের ফল কী হবে আমরা ঠিক ঠিক জানি না, কিন্তু এটা জানি, যুগান্তরের কর্মীরা ঘুমোচ্ছে না। যেদিন দরকার হবে, আমাদের আন্দোলন আগের মতোই বৃটিশ সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করবে। আর এ-ও জেনে রাখবেন মাষ্টারমশাই, বিপ্লবীরা একেবারেই ঘুমিয়ে নেই। ঠিকই, অনেক দিন কোন বড় অপারেশনের কথা শোনেননি আপনারা, তার মানে এই নয় যে অপারেশনের জন্যে তৈরি হচ্ছে না কেউ।
এই কথা চলতে চলতেই ঘরে ঢোকেন একজন মহিলা, ঢুকেই বলেন, আপনাদের যে ভেতরে আসতে হবে একবার।
বসন্তবাবু পরিচয় করিয়ে দেন, তাঁর স্ত্রী হেমপ্রভা। হেমপ্রভার নীরব শাসনে আলাপচারি বন্ধ হয় তখনকার মতো, এবং তাঁর পিছন পিছন তিনজনেই ঢোকেন বসন্ত মজুমদারের বাড়ির অন্দরে।
আসন পাতাই ছিল। পাতা আসনগুলোর সামনে ঝকঝকে কাঁসার থালায় সদ্যভাজা লুচি, ফুলকপি-আলু দিয়ে একটা তরকারি, আর পাশে একটা করে পায়েসের বাটি। মাষ্টারমশাই বিপিনবাবু একটু অস্বস্তি দেখান। নজরুল অবিশ্যি বিনা বাক্যব্যয়ে বসে পড়ে, এবং প্রশান্ত হাসিতে বিপিনবাবুর আপত্তিকে নস্যাৎ করে তাঁর হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে পাশে বসে পড়েন বসন্ত। সামনেই বসেন হেমপ্রভা এবং স্বাভাবিক মমতায় তিনজনের পাতেই প্রতিটি খাদ্যবস্তুই আরও একাধিকবার পরিবেশন করেন। খাদ্যবস্তুতে অতিথিদের সমস্ত মনোযোগ আকর্ষণ করাবার স্বাভাবিক পারদর্শিতায় হেমপ্রভা সব রকমের রাজনৈতিক আলোচনা আপাতত স্থগিত করিয়ে দেন, এবং পরিবেশিত খাদ্য ব্যতীত অন্য সবরকমের আকর্ষণ বিস্মৃত হন অতিথিরা।
ওঁদের থাকার ব্যবস্থাও সেদিনের জন্যে যে বসন্ত-হেমপ্রভার বাড়িতেই সে কথা ঘোষণা করে হেমপ্রভা জানান পরের দিন ওঁদের পাশের বাড়ির বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত এবং ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ সত্যেন্দ্রনাথ বসু সকালেই ওঁদের বাড়িতে আসবেন। তারপর জলখাবার খেয়ে সকলে মিলে যাওয়া হবে অতীন্দ্রবাবুর বাড়িতে। যে বিপুল ভোজন এইমাত্র শেষ হল বারবার সেটাকেও 'জলখাবার' নামে ঘোষণা করে হেমপ্রভা বোধ হয় আজ রাত্রের নৈশ'ভোজন'-এর জন্যে মানসিক প্রস্তুতির সময় দিলেন নজরুল আর বিপিনবাবুকে। তারপর “আমি এখ্খুনি চা নিয়ে আসছি” বলে বিদায় নিলেন সাময়িক ভাবে।
সকলের – এমনকি নিজেরও – চা নিয়ে হেমপ্রভা যখন ফিরলেন ততক্ষণে বাকিরা ফিরে গেছেন বাইরের ঘরে।
বসন্তবাবু বলছিলেন চাঁদপুর আর গোয়ালন্দের স্টীমার-ধর্মঘটের কথা। এই সর্বাত্মক ধর্মঘট কংগ্রেসের নামে সংগঠিত করেছেন বসন্তবাবু আর তাঁর সঙ্গীরা। বসন্তবাবু কংগ্রেস নেতা হলে কী হয়, কুমিল্লার মানুষ তাঁকে যুগান্তরের কর্মী নামেই চেনে। বিপ্লবী আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের কথায় হেমপ্রভা জানালেন উনিশশো এগারো সাল থেকে তিনি নিজে কংগ্রেসের সদস্য। আজকের চাঁদপুর-গোয়ালন্দের স্টীমার ধর্মঘটে তাঁর স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে তিনিও লড়াই করছেন। গোয়ালন্দে মহিলা সংগঠন তৈরি করেছেন তিনি, নারায়ণগঞ্জের স্টীমার ধর্মঘটেও তাঁর মহিলা কর্মী সংসদ লড়াই করছে। নজরুলের দিকে ফিরে হেমপ্রভা বলেন, তুমি – তোমাকে তুমিই বলছি, তুমি তো ছেলেমানুষ – তুমি আসবে না আমাদের সঙ্গে?
আসব বলেই তো তোমাদের এখানে এসেছি মা, কোন কোন মহিলার সংস্পর্শে নজরুলের স্নেহকাঙাল হৃদয় দ্রবীভূত হয়ে যায় একেবারে, তার কণ্ঠস্বরে কাঁপন ধরে, চোখের পাতা যায় ভিজে।
পাশের বাড়ির বীরেন সেনগুপ্ত সকাল হতে-না-হতেই হাজির। বীরেনের জন্ম এই কুমিল্লাতেই, বেড়ে ওঠা পড়াশোনাও এখানে, এখানকার বিখ্যাত ঈশ্বর পাঠশালায় কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর এখন কলকাতায় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত জাতীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে সে। কয়েকদিন আগে ফিরেছে কলকাতা থেকে, নজরুলের নাম সে জানতই, এখন কুমিল্লায় নজরুলের আসার খবর পেয়ে আর দেরি করতে মন চায়নি তার। নজরুলের চেয়ে চার-পাঁচ বছরের বড় সে, কিন্তু বন্ধুত্ব হতে সময় লাগল না।
অধ্যক্ষ সত্যেন্দ্রনাথ বসু আসেন একটু পর। তাঁর সঙ্গে তাঁর ভিক্টোরিয়া কলেজের কয়েকজন ছাত্র। খবর পেয়ে এসে হাজির হন খিলাফত আন্দোলনের নেতা আফতাবুল ইসলামও। হেমপ্রভা-বসন্তর আতিথেয়তার পর দল বেঁধে অতীন্দ্র রায়চৌধুরির বাড়িতে হৈ চৈ করতে করতে পৌঁছে যান সবাই, কিন্তু সেখানে গিয়ে জানা গেল বাড়িতে নেই অতীন্দ্র। মাষ্টারমশাই বিপিনবাবু আজই ফিরে যাবেন দরিরামপুর, তিনি একটু অধৈর্য হয়ে বাড়ির সামনে পায়চারি করতে থাকেন, সঙ্গে নজরুল আর বীরেন। একটু পর দূর থেকে দেখা যায় প্রায় দৌড়োতে দৌড়োতে আসছেন অতীন্দ্র, তিনি বোধ হয় তাঁর বাড়িতে সবায়ের আসার খবর পেয়েছেন। সামনেই দাঁড়িয়েছিল ঝাঁকরা একমাথা বাবরি চুলে হলুদরঙা পাঞ্জাবি পরিহিত নজরুল। খাদি গেরুয়া উত্তরীয়টি তার লুটিয়ে নেমেছে হাঁটু পর্যন্ত। নজরুলকে দেখেই চিনতে পারেন অতীন্দ্র, হাসিমুখে দুহাত তুলে এগিয়ে আসেন তিনি। মুহূর্তের মধ্যে দৌড়িয়ে তাঁর কাছে পৌঁছিয়ে যায় নজরুল, জড়িয়ে ধরে তাঁকে, মুখে স্বতস্ফূর্ত সম্ভাষণ: দাদারে দাদা! হেসে, অতীন্দ্র বলেন, ভাইরে ভাই! সমবেত হাততালিতে মুখর হয় অতীন্দ্রর পাড়া।
বিপিনবাবু দেখলেন, খুব বেশি আলোচনা করার প্রয়োজনই হল না। কুমিল্লায় বোঝাই যায় না কংগ্রেসী কে আর কে-ই বা যুগান্তর-অনুশীলনের কর্মপন্থী। স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা সর্বাত্মক রূপ দেখে অভিভূত তিনি। গান্ধী অবিশ্যি প্রকাশ্যেই বলেছেন যুগান্তরের ছেলেরাই তাঁর স্বরাজ-আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এতদিন গান্ধীর এই দাবিকে ভিত্তিহীন মনে করে এসেছেন তিনি, আজ বোধ হয় নতুন করে ভাবতে হবে তাঁকে! নজরুলের দিকে যতবারই দৃষ্টি পড়ে বিপিনবাবুর, ততই তিনি অবাক হন। সে যেন এই কুমিল্লারই মানুষ। অতীন্দ্রর উচ্চকণ্ঠনিনাদ আর নজরুলের হো হো হাসি মাতিয়ে তুলেছে কুমিল্লাবাসীকে, সব তর্কের অবসান করে এখন বোধ হয় সময় মরণপণ লড়াইয়ের। অতীন্দ্র হঠাৎ হেঁকে বলেন, এখন একটা গান হোক কাজি।
কোথা থেকে একটা হারমোনিয়ম জুটে যায়। নিজের উত্তরীয় খুলে নিয়ে হারমোনিয়মটাকে বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে নেয় নজরুল, সে গেয়ে ওঠে:
এস এস ওগো মরণ।
এই মরণ-ভীতু মানুষ মেষের ভয় কর গো হরণ।।
না বেরিয়েই পথে যারা পথের ভয়ে ঘরে
বন্ধ-করা অন্ধকারে মরার আগেই মরে,
তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ তাদের বুকের পরে
ভীম রুদ্রতালে নাচুক তোমার ভাঙন-ভরা চরণ।।
দীপক রাগে বাজাও জীবন-বাঁশী,
মড়ার মুখেও আগুন উঠুক হাসি!
কাঁধে পিঠে কাঁদে যথা শিকল জুতোর ছাপ
নাই সেখানে মানুষ সেথা বাঁচাও মহাপাপ!
সে দেশের বুকে শ্মশান মশান জ্বালুক তোমার শাপ,
সেথা জাগুক নবীন সৃষ্টি আবার হোক নব নামকরণ।।
জ্ঞান বুড়ো ঐ বলছে জীবন মায়া,
নাশ কর ঐ ভীরুর কায়া ছায়া!
মুক্তিদাতা মরণ! এসে কালবোশেখীর বেশে,
মরার আগেই মরল যারা নাও তাদেরে এসে,
জীবন তুমি সৃষ্টি তুমি জরা মরার দেশে
তাই শিকল বিকল মাগছে তোমার মরণ-হরণ-শরণ।।
গান শেষ হলে নজরুল বলে, এবার সবাই মিলে। আমি এক লাইন গাইব, সবাই মিলে তারপর গাইবে সেই লাইনটাই। কাউকে কিছু ভাববার সময়ই দেয় না নজরুল, প্রথম লাইন গেয়ে সে চুপ করে দাঁড়ায়। কলেজের ছাত্র যারা এসেছিল, তারা যোগ দেয়, সেই লাইনটাই গেয়ে ওঠে তারা। তার পরের লাইনে অতীন্দ্র যোগ দেন, দেন হেমপ্রভা আর বীরেনও। ধীরে ধীরে সকলেই যখন যোগ দেয় নজরুল তার গলায় ঝোলান হারমোনিয়ম নিয়ে নেমে পড়ে রাস্তায়। কুমিল্লাবাসী অবাক হয়ে দেখে বাবরি চুলের যুবকের নেতৃত্বে মিছিল চলেছে গান গাইতে গাইতে। ডাকতে হয়না কাউকে, এ বাড়ি-ও বাড়ি থেকে নেমে আসে ছেলেমেয়ের দল, পথিকরা অবাক হয়ে দেখে কেউ, কেউ নিজেকেই অবাক করে যোগ দেয় এই গানের মিছিলে। বিপ্লব না অসহযোগ আন্দোলন জানে না কেউ, নতুন আছড়ে-পড়া ঢেউ – সে কি গানের ঢেউ? – ভাসিয়ে নিয়ে যায় কুমিল্লাকে।
কতক্ষণ ওরা এই মিছিলে হেঁটেছিল জানে না নজরুল, জানে না মিছিলের কেউই! শহরের কোন রাস্তাই বোধ হয় বাদ পড়ে না। এক সময় মিছিল এসে থামে বসন্ত-হেমপ্রভার বাড়ির সামনে। বসন্ত হেসে জিজ্ঞেস করেন বিপিনবাবুকে, আপনার ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা তাহলে আজকের মতো স্থগিতই থাক স্যর।
না না, কোন প্রশ্নই নেই। ফিরে আমাকে যেতেই হবে আজ, খানিকটা অপরাধীর কণ্ঠে বলেন বিপিনবাবু, এই হুল্লোড়ে এমনই মেতে উঠেছিলাম, ঠিক যেন ছেলেবেলায় ফিরে গিয়েছিলাম আবার, কিন্তু যেতে তো হবেই এখন। তারপর নজরুলের দিকে ফিরে বলেন, তুমি মনে হয় তোমার মনের মতো কাজ পেয়ে গেছ কাজি, আপাতত আমাকে আর প্রয়োজন নেই তোমার। তারপর মিছিলের মানুষদের দিকে দেখিয়ে বলেন, তোমাকে পথ দেখাবার সহসৈনিকদের দিকে তাকিয়ে দেখ, আন্দোলনের প্রতিটি বাঁকে এঁরাই থাকবেন তোমার সঙ্গে, আজ আমি তাহলে আসি?
কোন কথা বলে না নজরুল, নত হয়ে স্যরকে প্রণাম করে। অধ্যক্ষ সত্যেনবাবু তাঁর কলেজের দুটি ছেলের কাঁধে হাত দিয়ে এগিয়ে আসেন। ছেলেদের বলেন, তোরা দুজন স্যরের সঙ্গে যাবি। তারপর বসন্ত-হেমপ্রভার দিকে আঙুল তুলে হাসিমুখে কৃত্রিম ক্ষোভের গলায় বলেন, এই যে এঁরা, এঁদের এই স্টীমার ধর্মঘটের ফলে যাতায়াতটা এখন কঠিন হয়ে গেছে। বলতে বলতে পাঞ্জাবির পকেটে হাত চলে যায় তাঁর, ওয়ালেট বের করে তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে অনেকগুলো টাকা বের করে ছেলেদের একজনের হাতে গুঁজে দেন তিনি, স্যরকে একেবারে দরিরামপুরে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসবি। তোদের মা-বাবাকে জানিয়ে দেব আমি।
এবার এগিয়ে আসেন হেমপ্রভা। বিপিনবাবু আর কলেজের ছেলে দুজনকে বলেন, সকাল থেকে প্রায় অভুক্ত আছেন আপনারা। বাড়িতে যা আছে, খেয়ে যাবেন অন্তত। তারপর নজরুলকে বলেন, আর তুমি? তুমি কী করবে এখন?
নজরুলের বদলে জবাব দেয় বীরেন, ও আপাতত আমার সঙ্গে যাবে। আপনি নিজেও যথেষ্ট ক্লান্ত আছেন। তার উপর স্যরের আর আমাদের এই দুই বন্ধুর আতিথেয়তার দায়িত্বও তো নিয়ে নিলেন।
আমার হিসেবের মধ্যে ও-ও তো ছিল, বলেন হেমপ্রভা। সকাল থেকে ও-ও তো প্রায় অভুক্ত। ওকে না খাইয়ে কী করে খাব আমি? আমি আর তোমার কাকু? দেখবে একটা জিনিস? কাঁধে-ঝোলানো ব্যাগটা থেকে একটা কাগজ বের করে বীরেনের হাতে দিতে দিতে হেমপ্রভা বলেন, আজ সকালে বেরোবার আগে ও আমাকে এটা দিল। কাগজটা খোলে বীরেন, পড়ে:
কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়া
আসিলে আলোক-জননী।
প্রভায় তোমার উদিল প্রভাত
হেম-প্রভ হল ধরণী।।
বীরেন হেসে বলে, তাহলে নিয়ে যান ওকেও। মিছিল তাহলে আজকের মতো এখানেই শেষ।