কলগীতি বন্ধ হবার পর নিজেকে কি আবার মুক্ত মনে হয় কাজির?
একটা সময় ছিল যখন পকেটে দু-দশটা টাকা থাকলেই নিজেকে প্রায় দুনিয়ার মালিক বলে মনে হত তার। তার মনে পড়ে যায় সেই দিনের কথা যখন আফজালুল মাত্র একশো টাকার বিনিময়ে তার প্রথম বইয়ের কপিরাইট কিনেছিল। দশখানা দশ টাকার নোট পকেটে ভরে নিজেকে প্রায় রাজাবাদশা মনে হয়েছিল কাজির, পরপর কয়েকদিন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির আড্ডায় যাবতীয় বন্ধুদের আপ্যায়নের দায়িত্ব সে তো নিজের ঘাড়েই নিয়ে নিয়েছিল। অনেক বুদ্ধির জোরে যদি না মুজফ্ফর তাকে নিয়ে আসত তার তালতলার এক-ঘরের আবাসস্থলে, তাহলে সে টাকার আয়ু ছিল বড় জোর দুয়েকদিন।
আজ আর সেই দিন নেই কাজির। গান তাকে সত্যিসত্যিই প্রায় রাজাবাদশাই বানিয়ে দিয়েছিল। তার গানে এখনো
সে-জোর আছে, কিন্তু মস্ত বড় এক আইনবিদ তার আধ্যাত্মিক গুরুকে সাক্ষী রেখে রাজাবাদশার ভাণ্ডারের প্রবেশপথ বদলিয়ে দিয়েছে, গ্রামোফোন কম্পানী আর প্রকাশকদের দরজা থেকে বেরিয়ে সহজ রাস্তায় সোজা না হেঁটে তার একমুখী রাজার ধন এখন সহজেই পৌঁছিয়ে যায় অসীমকৃষ্ণ দত্ত, সলিসিটার-এর ভাণ্ডারে!
কাজিকে ভালোমতই জানত নলিনী। কাজি যখন গ্রামোফোন কম্পানীতে ভগবতীবাবুর সঙ্গে নলিনীর ব্যবস্থা অনুযায়ী দেখা করতে গিয়েছিল, তখন পই পই করে নলিনী তাকে বলে দিয়েছিল, কম্পানীর সঙ্গে তোর গান রেকর্ড করার চুক্তি যদি হয় শেষ পর্যন্ত, কোনমতেই সে ক্ষেত্রে থোক নগদ-বিদায়ে রাজি হবি না। থোক টাকা পকেটে ঢুকলেই সঙ্গে সঙ্গে খরচ করবার রাস্তা যে কাজি খুঁজে বের করবে, তা ভালো মতোই নলিনীর জানা। সে বলেছিল, গানের রেকর্ড হবে, আর প্রতিটি রেকর্ডের বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে তোর কপিরাইটের অ্যাকাউন্টে জমা পড়বে টাকা। আজীবন, বুঝতে পারলি? যতই কাজির গান জনপ্রিয় হয়েছে ততই ওর রেকর্ডের বিক্রি বেড়েছে, আর ততই ওর তহবিল ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। যদি বরদাচরণের বুদ্ধিতে অসীমকৃষ্ণর সঙ্গে আজকের এই অদ্ভুত চুক্তি কাজি না করত, চার হাজার টাকা শোধ করতে কতদিন লাগত ওর? কোন বন্ধুকে বলল না, কারো সঙ্গে পরামর্শ করল না, এক লহমায় নিজেকে নিজেই পথের ভিখিরি বানিয়ে নিল কাজি! আর এই বরদাচরণ – তিনি তো সার্থক যোগী বলেই পরিচিত – মুহূর্তে মুহূর্তে যোগের এক স্তর থেকে উচ্চতর স্তরে নাকি তিনি উন্নীত করছেন কাজিকে! কাজির দৌলত অত বড় একজন সলিসিটারকে পাইয়ে দিয়ে কী লাভ তাঁর হয়েছিল কে জানে! তবে হ্যাঁ, কাজির সরলতার সুযোগে তাকে তিনি দারুণ ক্ষমতাবান যোগী যে বানিয়ে দিয়েছেন তাতে তো কোন ভুল নেই! নলিনী সে ক্ষমতার পরিচয় তো নিজেই পেয়েছে! হঠাৎ নলিনীকে একদিন বলে কাজি, নলিনীদা, এতদিন তো যোগসাধনা করছিস, যোগের কোন্ স্তরে তুই উঠেছিস জানিস তা?
না ভাই, বলে নলিনী, ও-সব জানিনা।
আমার কথা বিশ্বাস কর্ নলিনীদা, বলে কাজি, আমি দেখেছি তুই সচ্চিদানন্দ স্তরে উঠেছিস, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হতে পারিসনি। বোস, তোকে আমি সচ্চিদানন্দ স্তরে প্রতিষ্ঠিত করে দিচ্ছি; আমার কপালের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাক।
তারপর চোখ বুজে দু-তিন মিনিট প্রাণায়ামের মতো শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে, চোখ খুলে বলল, দিয়েছি। তোকে আমি সচ্চিদানন্দ স্তরে প্রতিষ্ঠিত করে দিলুম।
নলিনীও যোগাভ্যাস করে, কিন্তু তার বাস্তব জ্ঞান টনটনে। কাজির কাণ্ড দেখে সে বুঝল, অবস্থার ফেরে কাজি তার মনের স্থিরতা হারিয়েছে – হয়তো তা সাময়িক, তবু – বন্ধুদের জানানো দরকার। ইতোমধ্যে সজনীকান্ত দাসের সঙ্গে পবিত্র আর নলিনীর মাধ্যমে কাজির সখ্য তৈরি হয়েছে। খবর পেয়ে কাজিকে উদ্বেগ জানিয়ে চিঠি লেখে সজনীকান্ত, তোমার শরীর ঠিক আছে তো? কাজি জবাব দিল পদ্যে,
ভালোই আমি ছিলাম এবং ভালোই আমি আছি –
হৃদয়-পদ্মে মধু পেল মনের মৌমাছি।
এই লাইন যে লিখতে পারে তার মনের স্থৈর্য নিয়ে সন্দেহ? মুচকি হাসে সজনীকান্ত।
এর মধ্যে মুক্তি পেল বিদ্যাপতি আর সাপুড়ে নামের দুটি চলচ্চিত্র পরপর। বাংলা ভাষায় মূলত তৈরি হলেও দুটি ছবিরই হিন্দী সংস্করণ প্রকাশিত হয়ে সর্বভারতীয় স্তরে পাওয়া গেল যথেষ্ট প্রশংসা এবং অবশ্যই অর্থ। সাপুড়ে ছবির নজরুল রচিত ও সুরারোপিত তিনখানা গান, 'আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই', 'হলুদ গাঁদার ফুল রাঙা পলাশ ফুল' এবং 'কথা কইবে না বউ তোর সাথে আড়ি' তখন লোকের মুখে মুখে। বিদ্যাপতির কাহিনীকার কাজি নজরুল ইসলাম, সঙ্গীত রচয়িতা হিসেবে নজরুল ইসলামের সঙ্গে শৈলেন রায়ের নামও আছে। এর আগে সাতখানা রেকর্ডে গ্রামোফোন কম্পানী প্রকাশিত বিদ্যাপতি গীতিনাট্যও যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল, যদিও অসীমকৃষ্ণর সঙ্গে নতুন ব্যবস্থার পর সেই রেকর্ড বিক্রি থেকে আর কোন প্রাপ্তি নেই কাজির; যাবতীয় টাকার অভিমুখ এখন অসীমকৃষ্ণর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের দিকে ।
এদিকে অতুলবাবু স্যরের স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের সহযোগিতা এবং সাহায্যে শ্যামপুরে কয়েকজন চাষীর খানিকটা করে চাষযোগ্য জমি মিলিয়ে একটা চলনসই মাপের একটানা চাষের জমির ব্যবস্থা করা গেছে। যে ট্র্যাক্টরের সাহায্যে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ শিলাইদহে চাষের ব্যবস্থা করেছিলেন, খানিকটা মেরামতি করে সেই ট্র্যাক্টরখানাও নিয়ে আসা গেছে শ্যামপুরে। স্যরের এক বন্ধুপুত্র, যিনি বিহারের পুসা গ্রামে ইম্পীরিয়াল ইনস্টিট্যুট অব অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চে শিখেছিলেন আধুনিক কৃষিবিদ্যা – উনিশশো চৌত্রিশে বিহারের ভূমিকম্পে সেই পুসা অঞ্চল এবং সেখানকার ইনস্টিট্যুট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উনিশশো ছত্রিশে ওই ইনস্টিট্যুট দিল্লীতে স্থানান্তরিত হবার পর থেকে দিল্লীতেই থাকেন আজকাল – তিনি কিছুদিন শ্যামপুরে থেকে চাষীদের শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন। সব মিলিয়ে পিংলার প্রস্তাবিত কারিগরী শিক্ষা নিকেতনের কৃষি বিভাগ কাজ শুরু করার জন্যে প্রস্তুত। বাংলার জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলামকে সেই শিক্ষা নিকেতনের উদ্বোধনের জন্যে নিয়ে এসেছে পিংলা।
চাষের জন্যে যে জমির ব্যবস্থা হয়েছে, সেখানেই সামিয়ানার নীচে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। শিক্ষার্থী চাষীরা, গ্রামের চাষীরা এবং কৌতূহলী আর উৎসাহী মানুষরা বসেছে জমিতেই। কয়েক বছর আগে বাংলার নানা জায়গায় ঘুরে কতই-না কৃষক সম্মেলনে অংশ নিয়েছে কাজি। তার মনে পড়ে যায় কৃষ্ণনগরের নিখিলবঙ্গীয় প্রজা সম্মেলনের কথা, যে সম্মেলনের জন্যে সে বিশেষ করে লিখেছিল ওঠ রে চাষী জগদ্বাসী ধর কষে লাঙ্গল। সেই শুরু; আর সেখান থেকে হেমন্ত সরকার, মুজফ্ফর আহ্মদ, হালীম আর ফিলিপ স্প্রাটের সঙ্গে কুষ্ঠিয়ায় বঙ্গীয় কৃষক লীগ প্রতিষ্ঠার অধিবেশনই কাজির সরাসরি রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের শেষ। পিংলা আগেভাগেই কাজিকে জানিয়ে রেখেছিল, উপস্থিত চাষীদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান প্রায় সমান সমান। কাজি কোন বক্তৃতা দেবার চেষ্টাও করল না, সে ধরল গান, 'ওঠ রে চাষী জগদ্বাসী' গানের শেষ অর্ধাংশ দিয়ে যার শুরু:
ও ভাই আমরা মাটির খাঁটি ছেলে দূর্বাদলশ্যাম
আর মোদের রূপেই ছড়িয়ে আছেন রাবণ-অরি রাম।
ওই হালের ফলায় শস্য ওঠে সীতা তাঁরই নাম
আজ হরছে রাবণ সেই সীতারে – সেই সাধের ফসল।।
আজ জাগ রে কৃষাণ সব তো গেছে কিসের বা আর ভয়,
এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়।
ওই বিশ্বজয়ী দস্যু রাজার হয়-কে করব নয়
ওরে দেখবে এবার সভ্যজগৎ চাষার কত বল।।
অনুষ্ঠান শেষ করল কাজি সমবেত দর্শক-শ্রোতাদের তার বিখ্যাত ইসলামি গান শুনিয়ে:
বাজল কি রে ভোরের সানাই নিদ-মহলার আঁধার পুরে
শুনছি আজান গগনতলে অতীত রাতের মিনার-চুড়ে।।
********
আঁজলা ভরে আনল কি প্রাণ কারবালাতে বীর শহীদান
আজকে রওশন জমীন-আশমান নওজোয়ানির সুরখ্ নুরে।।
পিংলা আজ আর শান্তিনিকেতনে ফিরবে না। কাজির সঙ্গে সে এল কাজির বাড়িতে। এবং এতটা পথ একসঙ্গে আসতে আসতে পিংলা জানতে পারল অনেক কিছুই, যা আগে জানত না সে। আগের বার কাজি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিল যখন গোরা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের গান দেবার ব্যাপারে তাঁর সম্মতি আনতে, সেই দিন শান্তিনিকেতনে সে ছিল না, অতুলবাবু স্যরের সঙ্গে শ্যামপুরে এসেছিল সে। পরে যখন কাজিদার শান্তিনিকেতনে আসবার কথা জানতে পারল, তখন তো সুধাকান্তদাদার যোগাযোগের সূত্রে সওগাত পত্রিকার অফিসে এসে ও দেখা করে গিয়েইছিল কাজিদার সঙ্গে, কিন্তু কাজিদার বাড়িতে যেতে পারেনি। বৌদি, মানে কাজিদার স্ত্রী যে এত অসুস্থ তা জানতই না সে। সে শুনেছিল কাজিদা এখন সপরিবার কোন এক যোগীপুরুষের শিষ্য, কিন্তু এই যোগীপুরুষের প্রভাব তার ওপর এখন কতটা সে ধারণা ছিল না পিংলার। এখন শুনল, এই যোগীপুরুষের আশীর্বাদেই নাকি প্রাণ ফিরে পেয়ে – শুয়ে শুয়েই – সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন বৌদি। বৌদির চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে একেবারেই নিঃস্ব হয়ে গেছে কাজিদা। তার ওপর অত ধুমধাম করে উদ্বোধন করা কলগীতিও বন্ধ হয়ে গেছে ঋণশোধ না করতে পেরে নীলামে চড়ে। কাজিদা আজ সর্বস্বান্ত, ক্রাইসলার গাড়িখানা আর নেই, বালিগঞ্জে যে জমি কিনেছিল সে, তা-ও বেচে দিতে হয়েছে।
প্রথমে কাজি বলতে চায়নি, কিন্তু কথায় কথায় জানা গেল অসীমকৃষ্ণ দত্ত নামে এক বিখ্যাত সলিসিটারের কাছে গুরুদেব বরদাচরণের সহায়তায় সমস্ত রেকর্ড এবং প্রকাশিত যাবতীয় বইয়ের কপিরাইট বন্ধক রেখে কিছু নগদ টাকা ধার করে সে নানা জনের কাছে তার খুচরো ঋণ শোধ করেছে।
সমস্ত কপিরাইট? – ঈষৎ উত্তেজিত শোনায় পিংলার কণ্ঠস্বর।
হ্যাঁ, সমস্তই, তা-ও তো দাদা বলে দিলেন; অসীমবাবুও দাদার শিষ্য, তাঁর কথার উপর আর কথা বললেন না।
তাঁর কথার উপর আর কথা বললেন না!– রাগত কণ্ঠে বলে পিংলা, কী কথা বলবেন! সমস্ত কপিরাইট? কত ধার দিয়েছিলেন, দশ-পনের হাজারের বেশি তো নয়?
যা হয়ে গেছে ছেড়ে দে পিংলা – পিংলার মুখে দশ-পনের হাজার টাকার কথা শুনে সঙ্কোচে একেবারে গুটিয়ে যায় নজরুল – যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আর কথা বলে কী লাভ বল্?
কিন্তু তোমার সংসার এখন চলছে কীভাবে? – ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করে পিংলা।
চলছে, চলে যাচ্ছে সংসার, কাজি বলে, গ্রামোফোন কম্পানীর কাছ থেকে কপিরাইটের টাকা আর পাচ্ছি না তো, ওরা তাই আমাকে একটা মাসিক অ্যালাওয়েন্স দিচ্ছে, ওই জুনিয়র আর্টিস্টদের শিখিয়ে-পড়িয়ে তৈরি করে দিচ্ছি তো। ওরাই বা কী করবে বল্! তবে হ্যাঁ, রেডিওর টাকাটাও আছে। প্রোগ্রাম হিসেবে টাকা দেয় ওরা। চলে যাচ্ছে সব মিলিয়ে।
জুনিয়র আর্টিস্টদের তৈরি করিয়ে দিচ্ছ, তাই গ্রামোফোন কম্পানী মাসিক অ্যালাওয়েন্স দিচ্ছে একটা, তাই না? ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে পিংলা। এতে গ্রামোফোন কম্পানীর কতটা বেশি লাভ হচ্ছে সেটা কখনও ভেবে দেখেছ? তুমি নিজে যদি গাইতে, রেকর্ড করাতে, তোমাকে আজীবন তোমার রেটে ওদের কপিরাইটের টাকা দিতে হত। এখন সামান্য একটা অ্যালাওয়েন্স দিয়ে, আরও সামান্য টাকা জুনিয়রদের দিয়ে, তোমারই গানের রেকর্ড বেচছে ওরা, কতটা মুনাফা বাড়ছে ওদের কখনো ভেবে দেখেছ?
এই পর্যন্ত বলার পর হঠাৎ কোন একটা চিন্তা আসে পিংলার মাথায়, সে বলে, আচ্ছা, এই যে সিনেমাগুলো হচ্ছে, তুমি যেগুলোর জন্যে গান লিখে দিচ্ছ, আর্টিস্টদের ট্রেনিং দিচ্ছ, পরে সে গানের রেকর্ডও বেরোচ্ছে, তার জন্যে কী ফী পাচ্ছ তুমি?
ফী? আলাদা করে ফী চাইব কী করে বল্, সিনেমার প্রোডিউসার যে টাকা দেয় আমাকে মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে, তার মধ্যে তো এসব ধরাই থাকে।
ওফ্ কাজিদা, তোমাকে নিয়ে আর পারা যাবে না, বলে পিংলা। এই যে নানান পত্রিকায় কবিতা-টবিতা দাও তুমি, সে জন্যে কখনও কখনও কিছু কিছু টাকাও তো পাও? পাও না? আর পেলেই, সে কবিতার কপিরাইট চলে যায় তোমার? তা-ই যদি হয় তাহলে পরে তোমার কবিতার বইয়ে সেই পূর্ব-প্রকাশিত কবিতাটা দাও কী করে? সিনেমার জন্যে গান লিখে টাকা পাচ্ছ, তাই সেই গানের কপিরাইট তোমার চলে গেল? গ্রামোফোন কম্পানী যতবার ইচ্ছে চাহিদা অনুযায়ী সেই রেকর্ড রিপ্রোডিউস করে মুনাফা লুটবে, আর তুমি কোন্ সলিসিটারের সঙ্গে কী চুক্তি করেছ সেই যুক্তিতে সবকিছু চেয়ে চেয়ে দেখবে?
আইনের মারপ্যাঁচ, বুঝলি পিংলা, সবটাই আইনের মারপ্যাঁচ, বলে কাজি, কী আর করতে পারি বল্।
করতে পার অনেক কিছুই, বলে পিংলা, কিন্তু নিজের মাথাটা যদি গুরুদেবের কাছে আগেভাগেই বাঁধা রেখে দাও, তাহলে আর করবেটা কী?
আহত মুখ করে কাজি বলে, দাদাকে নিয়ে অশ্রদ্ধেয় কথা বলিস না পিংলা, আমার খারাপ লাগে।
একটু অপ্রস্তুত হয় পিংলা, বলে, তোমাকে আহত করতে আমার ভালো লাগে না কাজিদা, কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই বুঝতে পারছি তুমি বড় কষ্টে আছ। নানান দিক থেকে। তুমি জান কিনা জানি না, শান্তিনিকেতনে তোমার অনুরাগী বেশ একদল লোক আছেন। গুরুদেবের তোমার ওপর স্নেহের কথা তাঁরাও জানেন। তুমি শুনলে খুশি হবে, এই দলের পাণ্ডা হচ্ছেন সুধাকান্তদাদা। আমার শ্যামপুরের প্রজেক্টের ব্যাপারেও সুধাকান্তদাদার খুব উৎসাহ। তাঁকে গতকাল শ্যামপুরের অনুষ্ঠানে আসার জন্যে বলতে গিয়েছিলুম। অন্য কমিটমেন্টের জন্যে নিজে আসতে পারলেন না, কিন্তু তুমি আসবে শুনে আমাকে এই বইখানা দিলেন – কাঁধের ব্যাগটা থেকে একখানা বই বের করে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলতে থাকে পিংলা – বললেন এটা কাজিকে দেখাস, ওর রিয়্যাক্ট করা উচিত।
বইখানা গত বছরের ভাদ্র সংখ্যার মাসিক মোহাম্মদী। এতে এম ইউসুফ নামে একজন কিছু একটা লিখেছেন, শিরোনাম 'মরিয়াছে নজরুল।'
কাজি বলে, আমি শুনেছি কেউ একটা অপমানজনক লিখেছে কিছু। আমি পড়িইনি।
তুমি হয়তো উপেক্ষা করতে পার এসব লেখা। কিন্তু তোমাকে যারা ভালোবাসে, তারা তো তা পারবে না। তাছাড়া, এই লেখাটায় খানিকটা সাম্প্রদায়িক উসকানিও আছে, বলতে বলতে উদ্দিষ্ট পাতায় পৌঁছিয়ে লাল-কালিতে দাগ দেওয়া একটা অংশ পিংলা পড়ে শোনায়:
“বিদ্রোহী কামালের জয়যাত্রাতে যে বিদ্রোহী কবির অগ্নিবীণায় জ্বলিয়া উঠিয়াছিল অগ্নিসুর, জয়ডঙ্কার তালে তালে যে কবি গদগদ কণ্ঠে গাহিয়া উঠিয়াছিলেন – কামাল তুনে কামাল কিয়া ভাই – আজি গাজী কামালের চিরবিদায়ে বিশ্ব যখন কাঁদিয়া গাহে শোকের গীতি মর্সিয়া, তখন সে কবি স্থির নিশ্চয় নির্বিকার নির্বাক। দেশবন্ধুর মহাপ্রয়াণে যে দরদী কবির অশ্রু চিত্তনামায় হইয়া উঠিয়াছিল মূর্ত, সেই বেদনার কবির আজ চোখে নাই এক বিন্দু অশ্রু, মুখে নাই ভাষা, বুকে নাই স্পন্দন। কামাল মরিয়াও মরে নাই, মৃত্যুকে উপহাস করিয়াছে মাত্র। কিন্তু বাঁচিয়াও আজ মরিয়াছে নজরুল।”
নজরুলের মুখে নিয়ন্ত্রিত একটা অর্ধস্ফুট হাসির আভাস; সে বলে, 'মরিয়াছে?'
শোন্ পিংলা, নজরুল বলতে থাকে, তোকে একটা কথা বলি শোন্। এই যে ইউসুফ না কী নাম বললি তাকে আমি চিনি না। চিত্তনামা যখন লিখেছিলুম তখন আমি দেশের কথা, দেশের স্বাধীনতার কথা ছাড়া আর কিছুই ভাবতুম না। দেশের স্বাধীনতাই ছিল আমার জীবনের একমাত্র কামনা। চিত্তরঞ্জনের মৃত্যু দেশের পক্ষে একটা গভীর ক্ষত। যা লিখেছিলুম তখন সেটাই ছিল আমার আবেগের প্রকাশ। আজ কিন্তু আল্লাহ্ ছাড়া আর কিছুর কামনাই আমার নেই। লিডার হওয়ার লোভ ও দুর্মতি থেকে আল্লাহ্ আমাকে বাঁচিয়েছেন। আজ মোল্লা মৌলবি সাহেবদের মুসলমানির কাছে টেকা দায়। কিন্তু তাদের আজ যদি বলি যে ইসলামের অর্থ আত্মসমর্পণ – আল্লাতালায় সেই পরম আত্মসমর্পণ কার হয়েছে?
পিংলা বলে, তু্মি যা বলছ তার সব আমি বুঝতে পারছি কিনা জানি না, কিন্তু এ-কথা তো ঠিকই যে তোমার 'কামাল তুনে কামাল কিয়া ভাই' সে সময়ে হাজার হাজার মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
আমার বলিস না পিংলা, লাইন আমার নয়, বলতে থাকে কাজি, যিনি আমায় চালাচ্ছিলেন সেদিনের সেই অদৃশ্য সারথিই এই লাইন আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু নিজেই তিনি আমাকে সে-পথে আর চলতে দিলেন না। শুনে রাখ্ পিংলা, আমার সাহিত্যসাধনা বিলাস ছিল না। আমি আমার জন্মক্ষণ থেকে যেন আমার শক্তি বা আমার অস্তিত্বকে, existenceকে খুঁজে ফিরেছি। জীবনে কোনদিন কোন বন্ধনকে স্বীকার করতে পারলাম না। কোন স্নেহ-ভালোবাসা আমায় বুকে টেনে রাখতে পারল না। এই পরম তৃষ্ণা যে কোন্ পরম সুন্দরের তা বুঝতে পারিনি। কিন্তু আজ সেই মুখখানি খুঁজে পেয়েছি – আজ তাঁর দেখা পেয়ে প্রথম উপলব্ধি করেছি রসো বৈ সঃ, অনন্ত আকাশ বেয়ে মধুক্ষরণ কী করে হয়, সে মধু পান করেছি। আমার এই পরম মধুময় অস্তিত্বে প্রেমশক্তিতে আত্মসমর্পণ করে আমি বেঁচে গেছি – কাজি মরেনি তোরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস – আমি বেঁচে গেছি, আমার অনন্ত জীবনকে ফিরে পেয়েছি।
কাজির বাড়িতে ঢোকবার পর পিংলার মনে হয়, যেন এক আনন্দহীন মৃত্যুপুরীতে প্রবেশ করল সে। সানি-নিনি দু'ভাইয়ের একজনও বাড়িতে ছিল না সেদিন, তারা কোথায় গেছে কে জানে; কাজিদার শাশুড়ি গিরিবালা টিমটিমে আলো-জ্বলা একটা বারান্দার এক কোণায় বসে ছিঁড়ে-যাওয়া জামা একটা সেলাই করে মেরামত করছেন, তাঁর সামনে বসে আছে চোদ্দ-পনের বছরের একটা ছেলে। আগের বার যখন এসেছিল তখনও এই ছেলেটিকে এই পরিবারেই দেখেছিল পিংলা। নাম শুনেছিল বিজয়, এ কাজিদার পালিতা কন্যা খুকুর ভাই, সবাই তখন একে খোকা নামে ডাকছিল। পিংলাকে দেখে খুশিতে একটু হাসলেন গিরিবালা, উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ বাবা?
শোবার ঘরে একটা ছোট তক্তপোশে শুয়ে আছে প্রমীলা। তার পাশেই একটা টুলে বসে শান্তিলতা, ডাকনাম খুকু, কাজিদার পালিতা কন্যা। শায়িতা প্রমীলার চুলে সে চিরুনি চালাচ্ছে। পিংলাকে দেখতে পেয়েই খুশিতে খুকু বলে উঠল, ও মা, পিংলা কাকু! শুনে, প্রমীলাও একটু পাশ ফিরে পিংলাকে দেখে হাসে, বলে, কেমন আছেন পিংলা ঠাকুরপো?
আগের বার, যেবার কাজির কলগীতির উদ্বোধন হল, পিংলা সেবার কাজির পরিবারের সঙ্গে বেশ কয়েকদিন ছিল। সেই সময় খুকুর সঙ্গেও খানিকটা ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছিল তার। তারও আগে, যেবার কাজিকে জাতীয় কবির পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল, পিংলা এসেছিল তখন। বুলবুলকে সঙ্গে নিয়ে অ্যালবার্ট হলে গিয়েছিল সে। সেবারেই সে লক্ষ্য করেছে, বুলবুলকে খুব ভালোবাসত খুকু। কতো আর বয়েস তখন খুকুর! আর বয়েস যা, দেখতে লাগতো তার চেয়েও ছোট। পিংলার মনে আছে সেই বার সে যখন কাজির বাড়িতে এক রাত কাটিয়ে পরের দিন সকালে কাজির সঙ্গে তার গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল-রূমে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল, তখন পান সাজছিল খুকু। কাজির জন্যে। চল্লিশ-পঞ্চাশটা সাজা পান কাজি নিয়ে যেত রোজ সকালে, তার সারাদিনের খোরাক। খুকু সাজছিল পান, আর তার পাশে একটানা বকবক করতে করতে তার ছোট ছোট আঙুল দিয়ে পান সাজছিল বুলবুলও। একবার চোখ বুজলেই সে দৃশ্য এখনও প্রায় স্পষ্ট দেখতে পায় পিংলা।
দিনের বেলায় যা খায় কাজি, তা-ই আজকাল ওর ক্ষুন্নিবৃত্তির প্রধান উপাদান। শ্যামপুরে ওকে ডালভাত-মাছ-সব্জী খাইয়েছিল পিংলা, আর বাগনান থেকে কেনা বাম্পার নামের রাজভোগ। ফেরার পথে চা-ও খেয়েছে বারদুয়েক। রাত্তিরে কিন্তু আজকাল বিশেষ কিছু খায় না কাজি। খুকু বলল, মেসোর জন্যে মুগের ডাল ভিজিয়ে রাখি, আর একটু নারকোল কোরা। কোন কোনদিন তার সঙ্গে একটা-দুটো কলা ; ব্যস আর কিছু না। রাত্তিরে রোজ ধ্যান করে তো মাসির বিছানায় বসে, লালগোলার জেঠু বলে দিয়েছে উন্নতি যদি হয় এতেই হবে। আর রাত্তিরে মেসো যে ভাত-রুটি খাওয়া বন্ধ করেছে, সে-ও লালগোলার জেঠুর কথায়। এখন তো ধ্যানের সময় মেসোর চেহারাটা কেমন জানি হয়ে যায়; অমন সুন্দর মেসোর বড় বড় চোখ, কিন্তু ধ্যানের সময় দেখলে মনে হয় ঠেলে যেন বেরিয়ে আসবে! তা ছাড়া অনেকক্ষণ বাদে বাদে দম ছাড়ে। দম বন্ধ করে রাখে যতক্ষণ, মনে হয় ভারী কষ্ট পাচ্ছে। মাসি তো প্রথম প্রথম ভয় পেত খুব, তাই আমাকেও বলতো ঘরে বসে থাকতে। তারপর সব শুনে লালগোলার জেঠু নাকি বলেছিল ঘরে মাসি ছাড়া কেউ থাকবে না। একটু দম নিয়ে আবার বলে খুকু, কাকু তোমাকে খেতে দিই?
খেতে খেতে অনেক গল্প হয়। এটা-ওটা গল্প করতে করতে খুকু হঠাৎ একবার বলে, সাপুড়ে বই দেখেছ? আর বিদ্যাপতি?
না রে, দেখিনি, দেখা হয়ে ওঠেনি আমার, বলে পিংলা। অন্য অনেক কাজে ব্যস্ত থাকি তো, সিনেমা দেখবার সময়ই পাই না। তুই দেখেছিস?
উঁহু, আমিও দেখিনি। মেসো বলেছিল দেখতে নিয়ে যাবে, কিন্তু আমি গেলাম না। মাসি এই শরীর নিয়ে একা একা শুয়ে থাকবে, আমার যেতে ইচ্ছে করল না। মেসো বলল, বাড়িতে বসে বসেই যাতে দেখতে পাই, তার ব্যবস্থা করে দেবে। কী একটা মেশিন নাকি লাগবে, সেটা আনতে পারলে বাড়িতে বসেই দেখা যাবে। তারপর কী হল জান?
কী হল?
ওই যে কী যেন আম, কী যেন, মনে করার চেষ্টা প্রাণপণ করে খুকু, সেই আমের নামে নাম – কী আম? – হ্যাঁ, মনে পড়েছে, ফজলি আম, ফজলি। বোম্বাই থেকে ওই ফজলি কম্পানী নামে একটা লোক, সে নাকি সিনেমা কম্পানীর মালিক, সে চিঠি লিখল মেসোকে কলকাতা ছেড়ে বোম্বাই চলে যেতে। সেখানে তারা বাড়ি দেবে মেসোকে, গাড়িও দেবে, সেখানে গেলে মেসো সিনেমার বইই শুধু করবে। কিন্তু মেসো রাজি হল না। বলল, শুধু বাড়ি-গাড়িতে আমার হবে না, আমার একটা পুকুরও চাই। আচ্ছা কাকু, বোম্বাইতে পুকুর আছে?
আমিও তো সেই কথাই ভাবছি, বলে পিংলা। আমার তো মনে হয় না আছে। এ তো আর আমাদের বাংলা দেশ নয়, যে যেখানে যাবি সেখানেই পুকুরের ছড়াছড়ি! এমনকি, আমাদের এই কলকাতা শহরেই কি পুকুর কম? বোম্বাইতে আমার মনে হয় না এমনটা হবে।
পরের দিন সকালে কাজিকে বলে পিংলা, শুনলুম, একটা পুকুরের অভাবে তোমার বোম্বাই যাওয়াই হল না।
হেসে ফেলে কাজি, কে বলল তোকে? খুকু?
কে বলল সেটাই কি বড় কথা হল? খুকু তো আদ্ধেক কথাই বোঝেনি। ঘটনাটা কী?
হিন্দী এডিশনে বিদ্যাপতি আর সাপুড়ে – দুটোই খুব ভালো রেভেন্যু দিয়েছিল বলে বোম্বাইয়ের ফিল্ম্ ওয়র্ল্ড-এর ধারণা, বলে কাজি। ওখানকার ফজলে ব্রাদার্স নামের একটা ফিল্ম্ প্রোডিউসিং কম্পানী আমাকে অফার দিচ্ছিল বোম্বাইতে সেট্ল্ করে হোলটাইম ফিল্মের কাজ করি। ডিটেইলে কোন আলোচনা হয়নি; বাড়ি-গাড়ি অফার করেছিল, আমি অ্যাভয়েড করবার জন্যে বললুম, আমার বাগান-পুকুরও চাই। তারপর ওরা চেপে গেছে।
তুমি অ্যাভয়েড করলে কেন, কাজিদা? এটা তো তোমার – যাকে বলে – একটা গোল্ডেন অপরচুনিটি ছিল, আমরা সবাই মিলে কতদিন ধরে এই কথাই তো তোমাকে বলছিলুম। বলছিলুম, ফিল্মের হোলটাইমার হয়ে যাও। এদেশে সিনেমার অনেক প্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে তোমার কাছ থেকে, মৌলিক প্রাপ্তি।
বলছিলি যে সে কথাটা ঠিকই, কিন্তু আমার পক্ষে তখন কলকাতা ছেড়ে যাওয়া কোনমতেই সম্ভব ছিল না। দেখ্, তোর বৌদি যে আজও বেঁচে আছে সে শুধু দাদার আশীর্বাদে। উঠতে পারে না, শুয়ে থাকতে হয় নিশ্চয়ই, তবু ওই শুয়ে শুয়েই যে সংসার সামলাচ্ছে, আমার জন্যে রান্নাবান্না করছে, ছেলেদেরও দেখাশোনা করছে – এ শুধু দাদার আশীর্বাদেই সম্ভব হয়েছে, কোন পক্ষাঘাত-আক্রান্ত মানুষের পক্ষে তা-না-হলে এ কোনমতেই সম্ভব ছিল না। সেই সময় দাদার শরীরটাও ভালো যাচ্ছিল না। শুধুমাত্র সিনেমা করে দুটো পয়সা আয় করব মনে করে তখন যদি আমি কলকাতা ছেড়ে দাদাকে প্রায় একা ফেলে চলে যেতুম সেটা ঘোরতর পাপের কাজ হত। তোরা আমার বন্ধু। তোরাও যদি না বুঝিস তাহলে কে বুঝবে আমাকে?
তখন সেই ঘোরতর অসুস্থতার মধ্যেই অনেক পরিশ্রম করে দাদা একটা বই লিখছিলেন, বলতে থাকে কাজি, পথহারার পথ নাম। আমরা অনেক বারণ করেছিলুম, শুনলেন না। বললেন, তোমরা তো আমার সঙ্গে মিশেছ, কথা বলেছ, একসঙ্গে কতই না গল্পগুজব করেছ। কিন্তু ভবিষ্যতের মানুষ, যারা এখনো জন্মায়নি, অথবা জন্মালেও বড় হয়নি এখনো? পৃ্থিবীতে জন্মগ্রহণ করা একটা ভাগ্যের ব্যাপার। আমরা যারা সেই সৌভাগ্যলাভ করেছি তাদের তো একটা কর্তব্য আছে ভবিষ্যতে যারা পৃথিবীতে আসবে তাদের জন্যে। আমরা এখানে কী দেখেছি, কী শিখেছি, কতো রকমের কষ্ট মানুষকে পেতে দেখেছি, আর সেই কষ্টলাঘবের কতো রকমের শিক্ষাও পেয়েছি, ভবিষ্যতের মানুষকে তার ইতিহাস শোনাতে হবে না? পথহারার পথ-এ আমি সেই কাহিনীই শোনাব। আমাকে বললেন, তুমি বরঞ্চ একটা কাজ কর কাজিভায়া। এই বইয়ের একটা ভূমিকা তুমি লিখে ফেল। তুমি প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক। তুমি লিখলে বইয়ের পাঠক-সংখ্যা অনেক বাড়বে। অনেক বেশি মানুষের হাতে এই বই পৌঁছবে। লেখাটা আমার সার্থক হবে।
কয়েকমাস ধরে, কাজি বলতে থাকে, আমি শুধু এই ভূমিকাটুকুই লিখেছি তখন, অন্য কোন সাহিত্যকর্ম করিনি। এ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনা। তোকে একটা বই দিয়ে দেব ভেবেছিলুম, কিন্তু, তুই কিছু মনে করিস না পিংলা, গতকাল তোর সঙ্গে কথাবার্তায় বুঝলুম, দাদার ওপর বিশেষ শ্রদ্ধা তোর নেই। আমরা – যারা দাদার গুণমুগ্ধ – ঠিক করেছি এই বই শুধুমাত্র তাদেরই দেওয়া হবে যারা শ্রদ্ধার সঙ্গে এর যথার্থ মূল্য দেবে। মূল্য মানে আর্থিক মূল্যও। তারপর সেই মূল্য ধরে দেওয়া হবে তাঁর পরিবারকে। আমি জানি, আমার কথায় তুই হয়তো মূল্য দিয়েই কিনতে চাইবি এই বই, কিন্তু তোকে নিতে আমি বলব না। দাদার প্রতি তাহলে অশ্রদ্ধা প্রদর্শন হবে, তুই আমাকে ক্ষমা করিস।
হেসে পিংলা বলে, তুমি কিচ্ছু ভেব না কাজিদা, আমি কিছুই মনে করিনি। কিন্তু কাল তোমাকে যে কথাটা বলছিলুম সেটা আরেকবার বলি। তোমার ওই সলিসিটারের সঙ্গে চুক্তিটা। তুমি বললে, তোমার যাবতীয় রেকর্ডের আর বইয়ের কপিরাইট তুমি ওই ভদ্রলোকের কাছে বন্ধক রেখেছ যতদিন না ধারটা পুরোপুরি শোধ হয়ে যায়, ততদিনের জন্যে, তাই তো?
কেন আবার ওই কথা তুলছিস? – কাজির কণ্ঠস্বরে খানিকটা বুঝি বিরক্তি, উষ্মাও হতে পারে।
তুলছি, মানে আমাকে তুলতে হচ্ছে, তুমি ব্যাপারটা একেবারেই বোঝনি বলে। পিংলা বলতে থাকে, তোমাকে বুঝতে হবে, যেদিন ওই চুক্তি তোমরা সই করেছিলে, তোমার বন্ধকটা সেই দিন পর্যন্ত তোমার যা প্রপার্টি, তার ওপর কপিরাইটের গ্যারান্টি। কিন্তু, ওই দিনের পর তু্মি যে কাজ করবে, আর তার ফলে তোমার যে নতুন করে কপিরাইট আবার তৈরি হবে, সেটা কিন্তু তোমারই থাকবে, সেটা তোমাদের চুক্তিতে কভার্ড নয়। তার মানে, এই যে এখন তুমি সিনেমায় গান লিখছ, শেখাচ্ছ, রেকর্ডও হচ্ছে, এগুলো যেহেতু সবই ওই চুক্তির পরে, অতএব এখনকার এই রেকর্ডের ওপর তোমার যে কপিরাইট সেটা তোমার সলিসিটারের সঙ্গে চুক্তির বাইরে।
কাজি খানিকটা রাগত স্বরেই বলল, আমি এসব আইন-টাইন বুঝি না।
বোঝ না তো বটেই, আমিও যে খুব একটা ভালো বুঝি তা নয়। কাজেই বোঝে এমন একজনের সঙ্গে আমাদের কথা বলতে হবে। আমি যোগাযোগ করছি, ব্যবস্থা একটা হলেই তোমাকে আমি জানাব। তখন কিন্তু তুমি পালাবে না।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, বলে কাজি, সে তখন দেখা যাবে।
তাহলে আমি এগোই এখন কাজিদা, পিংলা বলে, প্রথমে শ্যামপুর, তারপর সেখান থেকে শান্তিনিকেতন। উঠে দাঁড়ায় পিংলা এক মুহূর্তের জন্যে, তারপর আবার বসে পড়ে।
হ্যাঁ শোন, বলে সে, যাবার আগে তোমাকে আর একটা অনুরোধ করব। এই অনুরোধটা সুধাকান্তদাদার পক্ষ থেকে। সুধাকান্তদাদা বলেছেন, গত-বছর সতেরই ফেব্রুয়ারিতে তুমি নাকি রেডিওতে বাংলা ছন্দ নিয়ে একটা প্রোগ্রাম করেছিলে। রেডিওর ভাষায়, কথিকা। ওঁর ভাষাতেই বলি, উনি বলেছেন, অনবদ্য। বলেছেন, এই কথিকা শুনে উনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না তুমি কীভাবে সর্বত্র বলে বেড়াচ্ছ, কবিতা তোমাকে ছেড়ে গেছে! সুধাকান্তদাদা আমাকে বিশেষ করে তোমাকে বলতে বলে দিয়েছেন যে, তুমি যে শুধু কবিতা লেখা চালিয়েই যাবে তা-ই নয়, রেডিওতে তুমি কবিতা রচনার একটা শিক্ষাবাসরও চালু করতে পার। তুমি ইচ্ছে প্রকাশ করলে রেডিওর কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই রাজি হবে। শুধু যে নতুন কবির দল আর কবিতা লেখায় উৎসাহীরাই এতে উপকৃত হবে তা-ই নয়, প্রতিষ্ঠিত অনেক কবিরও তুমি তাতে কৃতজ্ঞতাভাজন হবে।
কবিতার ব্যাপারে আমারও একটা কথা তোমাকে বলবার আছে কাজিদা, পিংলা বলতে থাকে। গুরুদেবের এই
আশি-বছরের জন্মদিন তো সারা দেশেই ধুমধাম করে পালন করা হল। সেই উপলক্ষে তো কতই কবিতা লিখেছে সবাই। তোমারও একটা কবিতা আমি পড়লুম যেন কোথায়, তার শেষ স্তবকটা তোমাকে বলি,
আজ আমি ভুলে গেছি আমি ছিনু কবি,
ফুটেছি কমল হয়ে তব করে রবি!
প্রস্ফুটিত সে কমল তব জন্মদিনে
সমর্পিনু শ্রীচরণে লহ কৃপা করি।
জানি না জীবনে মোর এই শুভদিন
আবার আসিবে ফিরে কবে কোন লোকে!
আমি জানি মোর আগে রবি নিভিবে না
তার আগে ঝরে যেন যাই শতদল!
শেষ লাইনটা কী হল কাজিদা? গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়েসে তুমি আটতিরিশ বছরের ছোট! এ-লাইন তুমি লিখলে কীভাবে? কেন লিখলে? লাইনটা পড়ে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলুম না তুমি সত্যি-সত্যিই এরকম একটা লাইন লিখেছ, লিখতে পেরেছ। খুব স্বার্থপরের মতো তোমাকে একটা কথা বলি কাজিদা, শোন। তুমি জান, এই পৃথিবীতে আমার নিজের বলতে আছে দুজন মাত্র মানুষ, আমার মা আর তুমি। মা'র কোন অসুখ নেই, কিন্তু বয়েসের হাতে মা নিজেকে সঁপে দিয়েছে। দেখলে তুমি অবাক হয়ে যাবে, মা সত্যি-সত্যিই ছোট হয়ে যাচ্ছে। আমি জানি না সকলের এমন হয় কিনা, কিন্তু যখনই আমি দেখা করতে যাই মায়ের সঙ্গে, দেখি, মা আগের বারের তুলনায় একটু ছোট হয়ে গেছে। উচ্চতায়। সত্যি বলছি কাজিদা, যদিও মা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না আজকাল, তবুও আমি বুঝতে পারি। ফিতে দিয়ে মেপে দেখলে নিশ্চয়ই দেখতে পাব আগের তুলনায় একটুখানি ছোট। আমি এর কারণ জানিনা, কিন্তু ছোট হয়ে যাচ্ছে মা, এটা সত্যি! আর, রোগাও। অতি দ্রুত ওজনও কমে যাচ্ছে। তবুও কিন্তু কোন অভিযোগ নেই মা'র, জিজ্ঞেস করলে বলে, কোন নাকি কষ্ট নেই! হয়তো এটাই ইচ্ছামৃত্যু, হয়তো এটাই মাটির টানে ফিরে যাওয়া। আমার ভাই মা'র যত্ন করে খুবই, তাই আমি নিশ্চিন্ত থাকি, কিন্তু মনে মনে জানি, যে-কোন দিনই শুনতে পাব মা আর নেই!
কিন্তু তুমি?– বলতে থাকে পিংলা, তোমার কথা আলাদা কাজিদা। মা যখন থাকবে না তুমিই তখন আমার একমাত্র আত্মীয়, তুমি ছাড়া আমি তো নির্বান্ধব হয়ে যাব। পৃ্থিবীতে জন্ম-মৃত্যু কারো নিজের হাতে নয়, আমি জানি। কিন্তু এই বয়েসেই তুমি মৃত্যুর কথা ভাববে কেন?
কাজি একটু অস্বস্তিতে পড়ে। তারপর বলে, মৃত্যু যদি আসেই তাহলে কেউই কি রুখতে পারবে?
তা হয়তো পারবে না, বলে পিংলা, কিন্তু তুমি কি সেই কারণে নিজেই নিজের মৃত্যু কামনা করবে? তুমি জান, গুরুদেবের জন্মদিনের উৎসবের পর এক মাসের মধ্যেই ছিল তোমার নিজের জন্মদিন? জান, জান তো নিশ্চয়ই। অনেকেই সেদিন তোমাকে হয়তো জন্মদিনের শুভকামনাও জানিয়েছে। মুসলিম সাহিত্যপরিষদ নামের এক সংগঠন সেদিন ডেন্টাল কলেজের হল-এ তোমার জন্মদিন পালন করছিল, তুমি জান?
নজরুল হাসে। কেন, কী হয়েছে তাতে?
সেখানে কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচি একটা স্বরচিত কবিতা পড়েছিলেন, তার অংশবিশেষ আমি মনে রেখেছি:
কাব্যের অমৃতরসে চিত্ত যার প্রমত্ত মশগুল,
মালঞ্চে যাহার নিত্য ফোটে ফুল, ডাকে বুলবুল, –
সেই নজরুল কবি, তারি এই জনম-তিথিতে
কোন প্রশান্তির বাণী কেবা তারে যাবে শুনাইতে?
যে জন সুরের রাজা, কী সুর লাগিবে তার কানে,
অবেলায় বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠ যার, সে কি তাহা জানে?
শেষ লাইনটা, ওই অবেলায় বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠ, ওটা পড়ে আমি ছটফট করেছি কয়েকদিন, এ কী লাইন লিখলেন যতীন বাগচি! কেন লিখলেন? তারপর হঠাৎ একদিন মাথায় এল, তুমি, তুমিই দায়ী এই লাইনটার জন্যে। মাত্র কয়েকদিন আগে গুরুদেবের জন্মদিনে এই লাইনটার উপক্রমণিকা তো তুমিই লিখেছিলে!
কাজি হেসে বলে, যতীন বাগচি সদ্ব্রাহ্মণ, অতি শুদ্ধাচারী মানুষ, তিনি হয়তো ঈশ্বরের ভবিষ্যদ্বাণী আগেই শুনেছেন।
পিংলা বলে, এরকম একটা সীরিয়স কথা তুমি এত হাল্কাভাবে নিচ্ছ কী করে আমি বুঝতে পারছি না।
দেখ্ পিংলা, বলে কাজি, যতীন বাগচি মশাই অতি ভালো মানুষ, আমাকে স্নেহও করেন খুব, আমার মনে হয় উনি ইচ্ছে করেই লিখেছেন ওই লাইনটা। একটা চালু কথা আছে না, কারো নামে কোন দুঃসংবাদ যদি ছড়িয়ে পড়ে খুব, তাহলে শেষ পর্যন্ত সেটা আর সত্যি থাকেনা, দুঃসংবাদের 'দু'-টা কেটে যায়! তুই আমার যে-লাইনটা বললি, গুরুদেবের উদ্দেশে যেটা লিখেছিলুম, সেটা বোধ হয় উনিও পড়েছিলেন, তাই বোধ হয় কাটিয়ে দেবার জন্যে নিজের কবিতাতেও লিখলেন, অনেক লোক পড়বে তো!
হেসে ফেলে পিংলা, তুমি মজা করছ, না? এরকম মজা আর কোর না। আমার ভালো লাগছে না।
এবার উঠে দাঁড়ায় পিংলা, ব্যাগটা নিজের কাঁধে চাপায়। তারপর বলে, আমি এবার যাব, এর পর ট্রেনটা আর পাওয়া যাবে না। তবে যাবার আগে একটা কথা আরেকবার বলে যাই। সিনেমার সম্বন্ধে তোমাকে আগে যা বলেছি, সব আমি উইদ্ড্র করে নিচ্ছি। প্রাণের থেকে সিনেমা-করার ব্যাপারটা তুমি মেনে নিতে পেরেছ বলে মনে হয় না। পারলে, ফজলে ব্রাদার্সের অফারটা তুমি ছেড়ে দিতে পারতে না। তুমি কবিতাই লেখ। প্রাণভরে লেখ। আর গানও গাও। আর, ওই যে সুধাকান্তদাদা বলেছেন, রেডিওয় একটা কবিতা রচনার শিক্ষাবাসর – ওটা চালু করে দাও যত তাড়াতাড়ি পার। কর যদি, আমি নিয়মিত ওই আসরে হাজির থাকব ছাত্র হিসেবে। আমিও আজকাল একটু-আধটু কবিতা লিখছি কিনা।
কবিতা লিখছিস? – উত্তেজিত কাজি, শোনা তাহলে।
তুমি আগে চালু কর তোমার আসর।