নবযুগের চাকরি ছেড়ে দেবার পর টার্ণার স্ট্রীটের বাড়িতে থাকার আর কোন মানেই হয় না। নজরুলও নেই, একাই সে। আর তা ছাড়াও, ফজলুল হক সাহেবকে ভালোমতই চিনেছে মুজফ্ফর। কাছাকাছি থাকলেই কারণে-অকারণে মাঝে-মাঝেই ডেকে পাঠাবেন। বাড়িটা ছেড়েই দিল মুজফ্ফর। মুসলমান সাহিত্য সমিতির প্রায় সকলেই চাইছিলেন ও আবার ফিরে যাক বত্রিশ নম্বরেই, সাহিত্য সমিতির হোলটাইমারই হয়ে যাক আবার। কিন্তু সমিতির আড্ডায় নিয়মিত যোগ দেওয়া বন্ধ না-করেও সেখানে থাকার প্রস্তাবটা এড়িয়ে গেল মুজফ্ফর। প্রথমে দু'খানা, পরে তা-ও কমিয়ে একখানা, ঘর ভাড়া নিল তালতলা লেন-এ।
কুমিল্লা থেকে শেয়ালদায় পৌঁছবার পর নজরুলকে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তালতলায় গেল না মুজফ্ফর। নজরুলের শরীর এখনও পুরোপুরি সারেনি। মুজফ্ফর নিজে ঘরে কখন থাকে কখন থাকে না তার ঠিক নেই। কাজেই দিনকয়েকের জন্যে সাহিত্য সমিতির অফিসেই নজরুলকে রাখা ভালো। ওখানে কেউ-না-কেউ থাকেই সব সময়।
কাজিকে নিয়ে বত্তিরিশের আড্ডা জমে গেল আরেকবার। গান-বাজনা, কবিতার আবৃত্তি, গান্ধীর অসহযোগ বনাম রবীন্দ্রনাথের পল্লী-স্বরাজ – তর্ক হুল্লোড় ঘন ঘন চা-পান-জর্দা, সময় যে কোথা দিয়ে চলে যায় বোঝাই যায় না। এরই মধ্যে ছোট্ট একটা অস্বস্তি প্রায়ই কষ্ট দিয়ে যায় নজরুলকে। যখনই সে একা হয়, কিছুক্ষণের জন্যে হলেও তখনই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে কষ্টটা! এই যে সকাল থেকে নানা আড্ডার পেছনে এত খরচ হচ্ছে চায়ের দোকান পানের দোকান পুঁটিরামের দোকানে, তাতে কতটুকু অংশ আছে নজরুলের! নবযুগে চাকরি করেছে যে মাস ছয়েক, কম হলেও মাসান্তে তখন নিয়মিত একটা আয় ছিল। আর এখন?
ঠিক দুপুরবেলাটায় বত্তিরিশ নম্বর একটু ফাঁকা থাকে, ও আর কক্ষসঙ্গী আফজালুল হক মাঝে মাঝেই সেই সময় একটু বিশ্রামের অবসর পায়। সব সঙ্কোচ কাটিয়ে আজ আফজালুলকে বলে কাজি, এক্কেবারে ফুটো কলসি হয়ে গেছি আফজাল সাহেব, এই যে সারাদিন আড্ডাতে এত খরচ হয়, এক পয়সাও কন্ট্রিবিয়ুট করতে পারিনা।
আরে এত ভাবছেন কেন, হেসে জবাব দেয় আফজালুল, আপনি এখন অসুস্থ, আর একটু সুস্থ হয়ে উঠুন, আবার আয় করবেন।
হয়তো করব, জানিনা। কিন্তু মাঝে মাঝেই খুব অসহায় লাগে। কুমিল্লায় যেটুকু লেখালিখি করেছি সেগুলো ছাপতে দিচ্ছি একে একে। কিন্তু ছাপে যারা, তাদের অবস্থা তো বুঝি, তারাই বা কত পয়সা আর দিতে পারে!
তারা হয়তো খুব বেশি দিতে পারবে না, ঠিকই বলেছেন আপনি। তবে একটা কথা। আমি যতদূর জানি, আপনি তো কোন বই ছাপেননি এখনো। আমার মনে হয় আপনার পুরোনো অনেক লেখাই এখন বই হতে পারে। ছাপলে বিক্রি হওয়া উচিত। প্রকাশকদের সঙ্গে আর্থিক চুক্তি করতেই পারেন আপনি। আপনি কখনো কথা বলেছেন কোন প্রকাশকের সঙ্গে?
কথা কী বলব, বলে কাজি, আমি তো ভাবিইনি কখনো এমন ভাবে।
যেমন ধরুন আপনার ব্যথার দান, বলতে থাকে আফজালুল। মনে আছে গল্পটা? প্রথম দিকে সাহিত্য পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, বেশ বড় গল্প। একটা আস্ত বই হতে পারে ওই গল্পটাই। ছেপে ফেলুন না।
ছেপে তো ফেলব, কিন্তু কীভাবে?
হুঁ, কীভাবে!– একটু ভাবিত দেখায় আফজালুলকে। কিছুক্ষণ নীরবে থাকার পর সে বলে ধীরে ধীরে, আপনি কি জানেন কাজি সাহেব, যে মোসলেম পাবলিশিং হাউজ নামে আমাদের একটা প্রকাশনা সংস্থা আছে? তিন নম্বর কলেজ স্কোয়ারে? সেখান থেকে আমরাই হয়তো ছাপতে পারি আপনার বই, অবিশ্যি আপনার যদি আপত্তি না থাকে।
আপত্তি? – বলে নজরুল, আপত্তির প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? আপনি আমাদের বন্ধু মানুষ, একটা ভালো পত্রিকার সম্পাদক, নিজেও প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক, আপনি ছাপলে তো আমার খুশি হবারই কথা।
ঠিক আছে, বলে আফজালুল, এই কথাই রইল। আপনার নিজের হাতের লেখা পাণ্ডুলিপিটা কি আছে? থাকলে আমায় দিয়ে দেবেন ওটা। না থাকলে জানাবেন আমাকে। আমি ব্যবস্থা করে নেব। ছাপা তো হয়েইছিল সাহিত্য সমিতির পত্রিকায়, অসুবিধে হবে না।
কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকে নজরুল, চুপচাপ। এটা মন্দ হল না। ছাপা বই, লেখক কাজি নজরুল ইসলাম। আট-দশ বছর আগেও লেটোর দলে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছে। রাতে শুয়েছে যখন যেখানে জায়গা পায়। এখন তার নিজের লেখা বই ছাপা হবে! মলাটের উপর ছাপা থাকবে ব্যথার দান, একটু নীচেই কাজি নজরুল ইসলাম! মলাট খুলেও নিশ্চয়ই তাই। একটা পাতা থাকবে, যেখানে শুধু বইয়ের নাম আর ওর নিজের নাম! ভাবতেও সুখ।
কী, কাজি সাহেব, ঘুমোলেন নাকি? – আফজালুলের ডাকে চিন্তার সুতোটা ছিঁড়ে যায়, আপনার ফুটো কলসির সমস্যাটার সমাধান কী হল শুনলেন না তো।
আপনি তো বললেনই, আপনি ছাপবেন বইটা।
সে তো বলেইছি, বলছি তো এখনও, কিন্তু আপনার সমস্যার সমাধান?
আগে তো ছাপুন, বিক্রি শুরু হোক তো আগে, তার আগে আর সমাধান কী হবে বলুন।
আপনি বোঝেননি কাজি সাহেব, আমার প্রস্তাবটাই বোঝেননি আপনি। কবে আপনার বই এক কপি বিক্রি হবে, তারপর সেই বিক্রির টাকা থেকে বইয়ের দোকানদারের লাভ, কাগজের দাম, ছাপা আর বাঁধাইয়ের খরচ, আরও নানা খুচরো খরচ বাদ দেবার পর হাতে যা পড়ে থাকবে সেখান থেকে প্রকাশক তার নিজের লভ্যাংশ তুলে নেবার পর যেটুকু বেঁচে থাকবে, তার থেকে খানিকটা অংশ তো পাবেন আপনি, মানে লেখক, তাই না? একখানা গল্পে একটা চটি বইই হবে, তার আর দাম কত হবে? ধরুন, এক টাকা-ই হল। তাহলে, আপনার পাওনা কত হয়? ক' পয়সা হয়? আর কত দিনেই বা আসবে সেটা আপনার হাতে ভেবে দেখেছেন?
কাজি এসব ভাবেনি। কিন্তু ইশকুলে-পড়া যোগ-বিয়োগের অঙ্কের মতো সহজ করে ব্যাপারটা আফজালুল বলায় এক ধরণের উত্তেজনা তৈরি হয় তার মধ্যে। সে শুয়ে থাকতে পারে না আর, ধীরে ধীরে উঠে বসে বিছানার ওপর। তারপর বলে, তাহলে?
তাহলে, বলে আফজালুল, অন্য উপায়ও আছে। সেটা বলি আপনাকে।
কাজি কোন কথা বলে না, গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে আফজালুলের দিকে। ততক্ষণে উঠে বসেছে আফজালুলও। সে বলে, আপনার কাছ থেকে আপনার বইয়ের কপিরাইট কিনে নেব আমি। কপিরাইট কিনে নেওয়া মানে কী? বইটা ছাপা হলে আপনার সম্মান আপনি পাবেন, বইয়ে লেখক হিসেবে আপনারই নাম থাকবে, কাগজপত্রে সমালোচনা বেরোলে সম্মান-অসম্মান সবই আপনার, কিন্তু বিক্রি হল বা হল না, হলেও কতগুলো হল, কী দামে হল, কে কিনল, ছাপাখানা বাঁধাইকার কত পয়সা পেল, কিছুই জানতে হবে না আপনাকে। এই সব দায় আপনি বেচে দিয়েছেন আমাকে, মানে প্রকাশককে।
আপনি তো বলছিলেন ব্যথার দানের কথা। কিন্তু ব্যথার দান তো আগেই ছাপা হয়ে গেছে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায়। তাহলে আর ছাপবার রাইট বেচব কীভাবে আপনাকে?
কোন অসুবিধে নেই কাজি সাহেব, কোনই অসুবিধে নেই। সাহিত্য পত্রিকাকে আপনি একবারই মাত্র ছাপবার অধিকার দিয়েছিলেন, তার বদলে ওরা যদি আপনাকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়েও থাকে সেটা হল সম্মানমূল্য। তাতে কপিরাইট ওদের হয়ে যায়নি, কপিরাইট এখনও পর্যন্ত আপনারই আছে। এবার ধরুন আপনি কপিরাইট বিক্রি করে দিলেন, সে আমাদের মোসলেম পাবলিশিং হাউজকে হোক বা যে কোন প্রকাশককেই হোক, যে কিনল, কপিরাইট এখন হয়ে গেল তার। বই সে ছাপবে তার সুবিধেমত। ধরুন, কিছু একটা অসুবিধে হল তার, ছাপতে দেরি হচ্ছে। অন্য কেউ এখন ছাপতে চায় আপনার বই। এবার যে-ই ছাপতে চাইবে আপনার বই বা তার অংশবিশেষ, সে কিন্তু আপনার কাছে আসবে না। কারণ কপিরাইট আর আপনার নেই, আপনি বেচে দিয়েছেন। অর্থাৎ, যে কপিরাইট কিনেছে আপনার কাছ থেকে, তার অনুমতি নেবে সে, আপনার নয় কিন্তু। হাসতে হাসতে এবার যোগ দেয় আফজালুল, স্রষ্টা আপনিই, কিন্তু একবার বিক্রি করে দেবার পর আপনার আর কোন অধিকার নেই।
কবিতা-গল্প যা-ই লিখুক নজরুল লেখে নিজের তাগিদে, নিজের উচ্ছ্বাসে, ছাপা হলে কিছু কিছু টাকাপয়সা পায়ই মাঝে মাঝে – অনেক সময় আবার পায়ও না – কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে এমন আইনকানু্নের প্যাঁচ আছে আগে ভাবেনি কখনও। এবার সে জিজ্ঞেস করে আফজালুলকে, আপনার কাছে যদি বেচে দিই কপিরাইট, কত দাম হবে তার?
মন্দ হবে না, বলে আফজালুল, আপনি নতুন লেখক ঠিকই, কিন্তু এখনই জনপ্রিয়, আপনাকে একশো টাকা দেব আমি। আজই দেব, ছাপার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে না আপনাকে। আমি ছাপব আমার সুবিধে মতো, যদি ভূমিকা একটা লিখতে চান আপনি – লেখাই ভালো – আপনাকে বলব আমি ঠিক সময়ে। কিন্তু টাকাটা ফেলে রাখব না, এমনকি ফর্মাল কন্ট্র্যাক্ট একটা করতে হবে – আপনাকে-আমাকে দুজনকেই সই করতে হবে তাতে – কিন্তু তার জন্যেও আপনার টাকাটা ফেলে রাখব না আমি। আপনি রাজি হলে আজই দিয়ে দেব টাকাটা।
একশো টাকা! নগদ! আজই! নজরুলের পকেটে এই মুহূর্তে একটা ফুটো-পয়সাও নেই, কিন্তু এক মুহূর্তেই বদলিয়ে যেতে পারে সেই অবস্থাটা। আজই সন্ধ্যেবেলার আড্ডায় যা খরচ হবে হাসতে হাসতে সবটাই দিয়ে দিতে পারবে কাজি। ও যা বুঝল আফজালুলের কথায়, অঙ্ক কষে যে কথাটা সহজ করে বুঝিয়ে দিল আফজালুল, তা হচ্ছে বই বিক্রির এক বিকল্প হিসেব। এক-একখানা বইয়ের বিক্রি, কয়েক পয়সা! টাকা-আনা-পয়সার হিসেবে ক'খানা বই বিক্রি হলে একটা টাকা হয়? কিন্তু তার বদলে যদি বিক্রি করা যায় একটা বইয়ের কপিরাইট, এক মুহূর্তেই তাহলে পকেটে এসে যেতে পারে এক গুচ্ছ টাকা!
ঠিক আছে, আমি রাজি। ব্যথার দানের কপিরাইটই দেব আপনাকে, আজই, বলতে বলতে চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে নজরুল।
কাজি যখন উপরে উঠে আসে ততক্ষণে এক এক করে নিয়মিত আড্ডাধারীরা আসতে শুরু করেছে। নিয়মিতদের বাইরে একজন এসেছে আজ, নলিনীকান্ত সরকার। কাজিকে দেখেই হৈ হৈ করে ওঠে নলিনী, বিপ্লব-টিপ্লব শেষ করে অবশেষে তুই ফিরে এসেছিস খবর পেয়েছি, কবিতা-টবিতা লিখছিস আবার?
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধানই ভাঙে, বলে কাজি, বারীন দাদা বলেছিলেন নিবারণবাবু স্যরকে বলতে, আমাকে যেন
বন্দুক-টন্দুক না দিয়ে গান আর পদ্যেই একট-আধটু বিপ্লব করবার সুযোগ দেন। তো, তা-ই তো হল শেষমেশ। স্যর পাঠালেন দরিরামপুরের হেডস্যরের কাছে, সঙ্গে করে তিনি নিয়ে গেলেন কুমিল্লায়, আর তারপর ওই গান-কবিতাই আবার। কুমিল্লায় গিয়ে দেখলুম কংগ্রেসবাদী, সন্ত্রাসবাদী গান্ধীবাদী সব বাদীই এক। সবাই মিলে গানই গাওয়া হল। তো গানই যদি গাইতে হয় শেষ পর্যন্ত, তাহলে আর কলকাতা কী দোষ করল! কাজেই ব্যাক টু ক্যালকাটা!
লিখলিটা কী কুমিল্লায়? দে তাহলে দুচারখানা আমায়, বিজলীতে ছাপি।
কূল কুমিল্লার কূল কাব্যি বিজলীর জন্যে নয়, বুঝলি?– নজরুল বলে। তোরা তো সব আবার জেল-ফেরৎ আন্দামান-ফেরৎ সন্ত্রাসবাদীদের দল। তোদের জন্যে রক্ত গরম করা গান চাই। যখন গরম গান জমবে দু-চারখানা তোকে দেওয়া যাবে। এখন বরং তুই-ই শোনা গান।
গান শোনাতে কোন আপত্তি নেই নলিনীর। বলল, গরম গানের কথা বললি যখন গরম গানই শোন। এ গান হাসির গান, তবে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে না, হাসতে হাসতে রক্ত গরম হয়। নলিনী ধরে দাদাঠাকুরের গান। হাসির গানই বলবে লোকে, কিন্তু নিছক হাসির তো নয়, প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদের গান সবই। নলিনী যেমন বলেছিল, হাতের মুঠো শক্ত হয়না কারো ঠিকই, কিন্তু গান শোনার পর অনেক প্রশ্ন নিয়ে নিজেরই মুখোমুখি হয় শ্রোতা। নলিনীর যেমন স্বভাব, মাঝে মাঝে গান থামিয়ে এক-একটা গানের পশ্চাদপট আলোচনা করে, কবে লিখেছিলেন এ গান দাদাঠাকুর, কী অবস্থায়। জমে যায় আসর।
চা-পান-টুকটাক জলখাবারও আসতে থাকে মাঝে মাঝে, তখন একটু বিরতি।
এমনই একটা বিরতিতে হঠাৎ বলে ওঠে পবিত্র, কী ব্যাপার রে নুরু, নীচে চায়ের দোকান পানের দোকান এমনকি পুঁটিরামের দোকানেও দাম নিচ্ছে না কোন কিছুর। দাম দিতে গেলেই বলছে, ও আপনি যান বাবু, ওই দোতলায় আছেন না কাজিবাবু, তিনি বলে গেছেন, তাঁর সঙ্গে হিসেব হবে!
শুনে কাজি বলে, সে হবে এখন। কী রে নলিনীদা, থেমে গেলি কেন, ধর আর একখানা। মুজফ্ফরও এসে গেছে অনেকক্ষণ হল, বসে আছে আফজালুলের তক্তপোশের এককোণে, তার সঙ্গে পবিত্র চোখাচোখি হয়, কেউই কথা বলে না।
হারমোনিয়ামের রীড-এ কয়েক সেকেণ্ড আঙুল চালিয়ে একটু থামে নলিনী। তারপর বলে, দাদাঠাকুরের বেশির ভাগ গানই তাৎক্ষণিক, গান গাইতে গাইতেই রচনা করে ফেলেন। এখন যে গানটা গাইব, শুনেছি বিখ্যাত সলিসিটর, কংগ্রেসের নেতা এবং কলকাতা কর্পোরেশনের প্রাক্তন কাউন্সিলর নির্মলচন্দ্র চন্দ্রর বাড়িতে পুজোর সময় এই গানটা রচিত এবং প্রথম গাওয়া হয়। ওই পুজোয় আমন্ত্রিত ভদ্রলোকদের মধ্যে একজন দাদাঠাকুরকে জিজ্ঞেস করেন, আপনাকে যদি বিনা প্রস্তুতিতে, একেবারেই চিন্তা না করে মা দুর্গাকে সম্বোধন করতে হয়, কী সম্বোধন আপনি করবেন?
একটুও না ভেবে দাদাঠাকুর জবাব দেন, জগদম্বা। সম্বোধন করতে হলে মা জগদম্বে বলে সম্বোধন করব।
তাহলে ওই জগদম্বে দিয়েই একটা গান শোনান না, জগদম্বের সঙ্গে মিলিয়ে আবার তার পরের লাইন।
দাদাঠাকুর বুঝতেই পেরেছিলেন ভদ্রলোকের কী মতলব। ভদ্রলোক যখন কথা বলছেন তখনই হারমোনিয়মের রীডে আঙুল চলছিলই দাদাঠাকুরের। তিনি একটুও না ভেবে গাইলেন – গেয়ে দেখায় নলিনী –
দুটো মনের কথা তোরে
বলি জগদম্বে,
বল্ দেখি মা দীনের দুঃখ
কোনকালে আর কমবে।
হৈ হৈ শুরু হয়ে গেল পুজোমণ্ডপে। হাততালির পর হাততালি। ভদ্রলোক বললেন, থামবেন না, চালিয়ে যান।
চালিয়ে গেলেন দাদাঠাকুর – নলিনী আবার গায় –
শোন মাগো দশভুজা
সেদিন তোমার করব পূজা
যেদিন মা নির্মলের মতো
লক্ষ টাকা জমবে!
আবার হাততালি, বলতে থাকে নলিনী, নির্মলবাবু ভদ্রলোকের পিঠে হাত দিয়ে বোধ হয় নিবারণেরই চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু ভদ্রলোকের তখন রোখ চেপে গেছে বোধ হয়, তিনি বললেন, চালিয়ে যান। হাসতে হাসতে দাদাঠাকুর ধরলেন – নলিনী আবার শোনায় –
যত পাওনাদারে লাগায় ব্যথা
তাই পালিয়ে এসেছি ক্যালকাটা,
আর, হেথায় যদি ধরে ব্যাটা
পালাব মা বম্বে।
ভদ্রলোক স্তম্ভিত। বললেন, আপনি তো সাধারণ লোক নয় মশাই, জগদম্বের সঙ্গে বম্বে মিলিয়ে দিলেন! যদি বলি আরো কয়েক লাইন চাই?
সে আপনি চাইতেই পারেন, বলেন দাদাঠাকুর, কিন্তু এবার আমি একটা প্রশ্ন করি আপনাকে। আচ্ছা, এই মণ্ডপে তাকিয়ে দেখুন, লোকে নানারকমের পোশাক পরেছে, গরদ-মটকা-সিল্ক আছে, সাধারণ সুতির কাপড়ও পরেছে অনেকে, কিন্তু খদ্দর পরেছেন শুধু আপনিই। এরকম কেন?
বেশ গর্বের সঙ্গে উত্তর দেন ভদ্রলোক, আমরা তো গান্ধীবাদী, কলের কাপড় বর্জন করেছি।
তাই? শুনুন তাহলে, বলেন দাদাঠাকুর – গেয়ে শোনায় নলিনী –
দেশের দুঃখ দেখে গাঁধী
পরতে বলে গেল খাদি
যত হারামজাদা হারামজাদি
ঠেকায়না নিতম্বে!
হাত জোড় করেন ভদ্রলোক। পাংশু মুখে কষ্টের হাসি এনে বলেন, আপনি প্রতিভাবান দাদা, পূজ্য, পরম পূজনীয়।
হাসেন দাদাঠাকুর, হাসতে হাসতেই বলেন, তবে শেষ করে দিই গানটা, কী বলেন? নলিনী গায়,
যদি কষ্ট দেওয়া মনে থাকে
আর কেন রাখিস আমাকে
ডেকে নে মা শেষের ডাকে
কাজ কি আর বিলম্বে?
নলিনীর এই যে গল্প করে করে আড্ডা চালাতে চালাতে গান গাইতে গাইতে নিজের বক্তব্য তুলে ধরার স্টাইল – তা মুগ্ধ করে সবাইকে। হাত তুলে মুজফ্ফর বলে, এই খাদির ব্যাপারে আমি একটা গল্প বলতে পারি?
আড্ডায় অংশ নিয়মিত নিলেও মুজফ্ফর স্বভাবতই অল্পভাষী, সে হাত তুলে এই প্রস্তাব দেওয়ায় সকলেই তার গল্প শোনায় আগ্রহ দেখায়।
মুজফ্ফর বলে, খাদিতে নিতম্ব না ঠেকানোর দাদাঠাকুরীয় বিবরণে গল্পটা মনে পড়ে গেল। হাওড়ার একজনের কাছে শোনা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হাওড়া জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি, খদ্দরই পরেন, বিশেষ করে সভা-টভায় এলে তো পরেনই। হঠাৎ একদিন একটা মীটিঙে তাঁকে দেখা গেল মিলের পোশাকে। একজন জিজ্ঞাসা করেই বসল, কী ব্যাপার শরৎদা, খাদি ছেড়েছেন নাকি? ছাড়িনি, জবাব দিলেন শরৎবাবু, তবে আর একটু স্বাস্থ্যবান একজন কাজের লোক খুঁজছি। যে আমার বাড়িতে কাজ করে, সে আমার কাপড় কাচতে আপত্তি করেছে। বলেছে, জলে ডোবালে কাপড় নাকি এতই ভারি হয়ে যায় যে তোলা যায় না!
আজকের মতো আড্ডা শেষ। সবাই একে একে চলে যেতে শুরু করে। শেষ বেরোবে মুজফ্ফর। এটাই তার রুটিন। ঘরে যখন ওরা শুধু তিনজন, আফজালুল মুজফ্ফর আর কাজি, আফজালুল তখন তার তক্তপোশের নীচে থেকে স্টীলের একটা ট্রাঙ্ক টেনে নেয়। সেখান থেকে গুনে গুনে দশখানা দশ টাকার নোট বের করে সে। তারপর ট্রাঙ্কটা তক্তপোশের নীচে পা দিয়ে ঠেলে টাকাগুলো দেয় কাজিকে।
নিঃশব্দে কাজি নেয় টাকাগুলো, সোজা ঢুকিয়ে দেয় তার পাঞ্জাবির পকেটে।
কোন কথা না বলে মুখে জিজ্ঞাসার চিহ্ন ফোটায় মুজফ্ফর।
আফজালুল বলে, কাজি সাহেবের ব্যথার দান ছাপাব আমি। কাজি সাহেব আমাকে আজ কপিরাইট দিয়েছেন।
কোন কথা না বলে কাজির দিকে তাকায় মুজফ্ফর। তারপর বলে, কাল সকালে একটা জরুরি কাজে যেতে হবে আমাদের দুজনকেই। আমি কাল সকালে আসব, তৈরি হয়ে থেকো। ফিরতে ফিরতে দেরি হতে পারে। কাজেই কাল আর এখানে না ফিরে তালতলা লেনে ফিরব আমরা দুজনেই। তোমার শরীর তো এখন অনেকটাই ভালো। এবার থেকে তালতলাতেই থাকি দুজনে?
বেশ তো, বলে কাজি, চল, তোমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি।
উঁহুঁ, বলে মুজফ্ফর, কাল আমি সকাল সকাল আসব। আজ বিশ্রাম নাও।
পরের দিন সকাল আটটাতেই হাজির মুজফ্ফর। কাজি ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে, মুজফ্ফরকে জিজ্ঞেস করল, সকালে কিছু খেয়েছ?
খাইনি, বলে মুজফ্ফর, চল না এখন, কিছু খেয়ে নেব বাইরে।
পুঁটিরামের লুচি খাইনি অনেক দিন, বলে কাজি, ভেবেছিলুম তুমি এলে আজ আমরা লুচি খাব।
লুচি খাবে? বেশ তো। জলখাবারে লুচি-আলুর দমের চেয়ে ভালো আর কীইবা হতে পারে! তো কী করবে? নীচে যাবে না আনিয়ে নেব?
আফজালুল ছিল না ওখানে। কাজি বলে, আফজাল সাহেব তো বাথরূমে। দরজা খোলা রেখে এমনিতেই তো আমরা বেরোতে পারব না। আসুক আফজাল সাহেব। ওকেও জিজ্ঞেস করি কী করবে।
আফজাল ফিরে এসে বলে, আপনারাই যান। আমি আজ লুচির মূডে নেই।
পুঁটিরামের দোকানে বসেই আজ সকালের জরুরি কাজটা মুজফ্ফর বুঝিয়ে দেয় কাজিকে। ওরা এখান থেকে যাবে মৌলভি লেনে, কুত্বুদ্দিন আহ্মদ নামের একজনের বাড়ি। কুত্বুদ্দীন সাহেবের বাড়ির ভাড়াটে কলকাতা মাদ্রাসার একদল ছাত্রের সঙ্গে মুজফ্ফরের সম্প্রতি পরিচয় হয়েছে এই বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রিডিং রূমেই। এই ছেলেরা খিলাফৎ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, গান্ধীর অসহযোগ এবং খাদি আন্দোলনের সমর্থক, কুত্বুদ্দীন সাহেবের বাড়ির নীচের তলায় নিজেদের শোয়ার ঘরের পাশেই খিলাফতিস্ট উইভিং সেন্টার নামে চরকা এবং তাঁত বসিয়েছে। মুজফ্ফরের নাম ওরা জানতই, জানত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা এবং নবযুগের কথাও। কাজি নজরুল ইসলামের নামও ওরা জানে, তার লেখাও পড়েছে। নতুন একটা বাংলা দৈনিক পত্রিকা বের করায় মুজফ্ফরের আগ্রহের কথা ওরা মন দিয়ে শুনল। কয়েকদিন পর মুজফ্ফরকে ওরা জানায়, কুত্বুদ্দিন সাহেবও বাংলা পত্রিকার ব্যাপারে আগ্রহী। উনি মুজফ্ফরের সঙ্গে দেখা করতে চান। তাই আজ যাওয়ার প্ল্যান।
কিন্তু যাওয়ার আগে কুত্বুদ্দিন সাহেবের সম্বন্ধে অনেক খবর নিয়েছে মুজফ্ফর। উচ্চশিক্ষিত এই ভদ্রলোক মৌলানা আবুল কালাম আজাদের বিখ্যাত উর্দু পত্রিকা আল হিলাল এবং আল বালাগ-এর ম্যানেজার ছিলেন, তার আগে মিলিটারি অ্যাকাউন্টস অফিসে অডিটরের কাজ করতেন। খিলাফত আন্দোলনের সমর্থক কুত্বুদ্দিন কলকাতায় নানা শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত। নিজে উর্দুভাষী হয়েও মুজফ্ফরের প্রস্তাবিত বাংলা দৈনিকের ব্যাপারে ইনি সাহায্য করতে ইচ্ছুক, এই কথা শুনে মুজফ্ফর চমৎকৃত। মুজফ্ফর বলল, মনে হল দেরি না করাই ভালো, আর যাই যদি আমরা দুজনেই যাব।
প্রাথমিক আলাপ-টালাপের পর ভদ্রলোক বললেন, প্রথমেই আপনারা দৈনিকের কথা ভাবছেন কেন? ধরুন, আমরা যদি একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা দিয়ে শুরু করি, তাহলে কেমন হয়? সাপ্তাহিক পত্রিকায় কিছু অনুরাগী পাঠক যদি তৈরি হয়, পরে যখন দৈনিক বের করব তখন তাদেরই সূত্রে দৈনিকের একটা রেডি-মেড বাজার পাওয়া যাবে, তাই না?
হয়তো তাই, বলে মুজফ্ফর, কিন্তু দৈনিকের পাঠক আর সাপ্তাহিকের পাঠকের মধ্যে একটা মূল ফারাক আছে। দৈনিকের পাঠক টাটকা খবর চায়, হয়তো তারই সঙ্গে সেই টাটকা খবর নিয়ে, অথবা এমনকি খবরের বাইরেও – যেমন শিল্প সাহিত্য সামাজিক নানা বিষয় ইত্যাদির – কিছু আলোচনাতেও আগ্রহ থাকে তার। সাপ্তাহিকের পাঠক কিন্তু টাটকা খবরের জন্যে আলাদা করে একটা দৈনিক পত্রিকাই পড়বে।
সে তো ঠিকই, কুত্বুদ্দিন সাহেব বলেন, সেই জন্যেই দৈনিক সংবাদপত্র বের করতে গেলে নিজেদের ছাপাখানা চাই। সংবাদপত্রে সারারাত কাজ চলে, রাত তিনটে-সাড়ে তিনটের সময় পাওয়া খবরও পরের দিন ভোরবেলার পত্রিকায় ছাপা হয়। কাজেই নিজেদের একটা ছাপাখানা, চব্বিশ ঘন্টা কাজ করার মতো যথেষ্ট-সংখ্যক কর্মী, এ সব না রাখতে পারলে দৈনিক কাগজ চালানোই যাবে না।
নজরুল বলে, কুত্বুদ্দিন সাহেবের এ-কথার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। আমাদের দৈনিক নবযুগ সান্ধ্য-দৈনিক ছিল, তা-ও মাত্র এক পাতার কাগজ। কাগজ বিক্রি নিয়ে আমাদের বিশেষ চিন্তা ছিল না, যা ছাপা হত সবই বিক্রি হয়ে যেত। কিন্তু সারা রাত্তির ছাপাখানা খুলে রাখতে পারতুম না, তাই ভোরবেলার টাটকা খবরও আমরা দিতে পারতুম না। আমাদের নবযুগ দৈনিক হলেও, পাঠকদের কাছে এ কাগজ দ্বিতীয় কাগজই ছিল। সকালবেলা অন্য কোন দৈনিক পড়ত আমাদের পাঠকরা, আর সন্ধ্যেবেলা নবযুগ – আমাদের নানা টিপ্পনী এবং রাজনৈতিক আলোচনায় তাদের উৎসাহ ছিল। আমার তো মনে হয়, এবার যদি সীরিয়াসলি একটা দৈনিক কাগজ আমরা বের করতে চাই তাহলে নিজেদের ছাপাখানা এবং অনেক বেশি কর্মচারি আমাদের দরকার হবে।
এ বিষয়ে আমার একটা ভাবনা আছে, মুজফ্ফর বলে, বলব? আমি ভাবছিলাম আমরা একটা জয়েন্ট-স্টক কম্পানি তৈরি করব। মানে, ধরুন, খ্যাতনামা অথচ জনপ্রিয় কয়েকজন ধনী মানুষকে ডিরেক্টর পদ দিয়ে একটা কম্পানির প্রস্তাব দিলাম আমরা। প্রসপেক্টাস যাকে বলে, সেরকম একটা খাড়া করা হল, তার ভিত্তিতে শেয়ার কেনার জন্যে আমরা সাধারণ মানুষকে আহ্বান করব। আমার বিশ্বাস, নাম-করা ধনী মানুষেরা আমাদের ডিরেক্টর হতে রাজি হলে জনসাধারণের আস্থা তৈরি হবে, এবং যথেষ্ট-সংখ্যক শেয়ার বিক্রি হবে। সে টাকাতেই আমাদের কাজ করবার মতো মূলধন সংগ্রহ হবে। তখন আমরা ছাপাখানা, যথেষ্ট-সংখ্যক কর্মচারি, এসবের কথা ভাবতে পারব।
নানা রকমের আলোচনা, একটু-আধটু তর্কাতর্কির পর শেষ পর্যন্ত মুজফ্ফরের প্রস্তাব মেনেই নিলেন কুত্বুদ্দিন, বললেন, ঠিক আছে, প্রসপেক্টাসের একটা মুসাবিদা করা হোক। এই যে আপনি ধনী খ্যাতনামা মানুষদের ডিরেক্টর করার কথা বললেন, আমার মনে হয়, একজন মুসলমান এবং একজন হিন্দু ডিরেক্টর জোগাড় করা দরকার। তাতে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটা বোঝা যাবে। আবুল কালাম আজাদকে বললেই রাজি হয়ে যাবেন, কিন্তু ওঁকে বলব না। ওঁর নাম থাকলেই পুলিশ প্রথম থেকেই বাগড়া দেবে। দু-দুটো কাগজ তো দেখলাম। আমি বরং মৌলানা আবুবক্র্ সাহেবকে পাওয়ার চেষ্টা করছি, আপনারা দেখুন কোন জনপ্রিয় হিন্দু ধনী মানুষকে ধরতে পারেন কিনা। আর আমাদের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে এই কাগজের ব্যাপারে এখন থেকেই আলোচনা চালাতে থাকুন। এঁরাই আমাদের শেয়ার কিনবেন, মুখে মুখে প্রচার এঁরাই করবেন। আর একটা কথা, খুব বেশি না হলেও এখন থেকেই খরচও তো শুরু হবে কিছু কিছু। প্রসপেক্টাস ছাপা, কিছু-কিছু আইনী পরামর্শ, বিজ্ঞাপন দেওয়া – এসব আছে, না? কিন্তু আপনারা এ নিয়ে চিন্তা করবেন না, প্রাথমিক অবস্থার খরচ-টরচগুলো আমিই চালিয়ে নেব।
খুশি মনেই তালতলা লেনের বাড়িতে ফেরে ওরা। নজরুল এই প্রথম এল এখানে। নীচের তলার যে ঘরখানা ভাড়া নিয়েছে মুজফ্ফর, সেটা এ বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। ফলত আলো-হাওয়া আছে যথেষ্ট। ঘর থেকে একটু দূরে বাথরূমও আছে একটা। দোতলার চারখানা ঘর ভাড়া নিয়েছেন যাঁরা, নীচের বাকি তিনখানা ঘরও তাঁদেরই। নীচের বাথরূম কিন্তু ব্যবহার করেন না তাঁরা। এঁরাও কুমিল্লার লোক, অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে যে ফয়জুন্নিসা গার্লস হাই স্কুলে পড়া ছেড়ে দিয়েছে কমলা আর দুলি, সেই ফয়জুন্নিসারই দৌহিত্র এঁরা।
টার্ণার লেনের বাড়িতে যে চায়ের ব্যবস্থা ছিল ওদের, ইলেকট্রিক হীটার সমেত সেই পুরো ব্যবস্থাটাই তুলে নিয়ে এসেছে মুজফ্ফর। সঙ্গে দুজনের দু'খানা চেয়ার আর দু'খানা তক্তপোশ। চা খেয়ে মুখোমুখি চেয়ারে বসল ওরা। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সুবাদে কলকাতায় অনেক প্রতিষ্ঠিত মানুষের সঙ্গেই কমবেশি পরিচয় আছে মুজফ্ফরের। ও বলল ও চেষ্টা করবে কিরণশঙ্কর রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। ওঁকে যদি ডিরেক্টর হতে রাজি করানো যায় তা হলে খুবই ভালো। সাহিত্য সমিতির প্রসঙ্গে এল আফজালুলের কথাও। একটু ইতস্তত করেও শেষ পর্যন্ত মুজফ্ফর জিজ্ঞাসাই করে ফেলল, তোমাকে কি একশো টাকাই দিল আফজাল ব্যথার দান-এর কপিরাইটের জন্যে?
হুঁ, নজরুলের সংক্ষিপ্ত জবাব।
সেদিন দাদাঠাকুরের গান শোনাচ্ছিল না নলিনীকান্ত? কলকাতা কেবল ভুলে ভরা, মুজফ্ফর বলতে থাকে, হেথায় বুদ্ধিমানে করে চুরি...! আমার ওই গানটাই মনে পড়ে যাচ্ছে। একশো টাকা! একশো টাকায় পুরো কপিরাইট! মানে, সারাজীবন ধরে ওই একটা বইয়ের যতগুলো সংস্করণ হবে, যে-সংস্করণেরই হোক, যতবার যে-বই বিক্রি হবে, তাতে তোমার কোন অধিকার নেই, সব প্রাপ্য আফজালের! বিনিময়ে তুমি পেলে মাত্র দশ টাকার দশখানা নোট! তোমার উপর আমি বড়দাগিরি করতে চাই না কাজি, কিন্তু আমার বড় দুশ্চিন্তা হয়, তু্মি এমন সরল মানুষ, তোমাকে সবাই না এমনিই ঠকিয়ে নিয়ে যায়!
মাথাটা একটু নীচু করে বসে থাকে কাজি, একটা কথারও কোন প্রতিবাদ করে না। মুজফ্ফর যা বলছে তার প্রতিটি শব্দের যাথার্থ্য নিয়ে কোন সন্দেহই নেই তার, কিন্তু যে কথাটা মুজফ্ফর বোঝে না তা হল, স্নেহ-ভালোবাসা জোরদার হলেও মুজফ্ফর আর ও সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্রের দুজন মানুষ। পকেটে যখন পয়সা নেই মুজফ্ফর তখন কোন আড্ডাতেও নেই। যদি-বা কখনও গিয়ে পড়লোও কোন আড্ডাতে হঠাৎ, কিছুতেই কোন খাওয়াদাওয়ার মধ্যে থাকবে না সে। আত্মসম্মান বোধ প্রবল, নিজের চিন্তা-ভাবনা স্পষ্ট প্রকাশে সে স্বচ্ছন্দ, যথেষ্ট বন্ধুবৎসল, কিন্তু পকেটে যখন পয়সা নেই সেটা মেনে নেবার মত চারিত্রিক দৃঢ়তাও আছে তার। কাজি অন্যরকমের, তার ধার করতে আপত্তি নেই, নেই দিতেও। এই যে গতকাল এত খরচ হল আড্ডায়, তার সমস্তটাই বহন করতে পেরেছে সে, তাতেই তার আনন্দ। একশো টাকা পেয়ে তো যাবই, আজই পাব, অতএব সেই ভরসায় চায়ের দোকান পানের দোকান অথবা পুঁটিরামের দোকানে সাময়িক ধার করায় তার গ্লানি নেই একেবারেই। গ্লানি তো নেইই, আছে আনন্দ! এই আনন্দ সে মুজফ্ফরকে বোঝাবে কী ভাবে!
আর তাছাড়া, এখনই তার কেমন যেন মন খারাপ হচ্ছে কুমিল্লার জন্যে। শরীর ভালো হয়ে গেছে, সে আবার একবার কুমিল্লায় যাবে। যত তাড়াতাড়ি পারে! আর, আগের বারের মতো ভিখিরি হয়ে সে যাবে না এবার। আফজালকে অনেক ধন্যবাদ, এখন সে শিখে গেছে কীভাবে টাকা জোগাড় করা যায়। আর কোন্ কোন্ রচনার কপিরাইট বিক্রি করা যাবে এখনই ভাবতে শুরু করেছে সে।
কাজিকে এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে দেখে খারাপ লাগে মুজফ্ফরের। একেই ওর শরীর ভালো নেই, তার ওপর আবার বকাবকি করল সে। সত্যিই তো, বেচারার স্বভাবই এরকম। কাজি বিশ্বাস করে না ভূ-ভারতে এমন কোন মানুষই নেই। কেউ যদি ঠকিয়েও নেয়, কাজি হজম করে নেবে বিনা বাক্যব্যয়ে। মুজফ্ফর বলে, তোমার শরীর ঠিক আছে, কাজি?
কাজি বলে, হ্যাঁ ভালোই তো।
তোমার মনে আছে, সেই যে হক সাহেব দু'হাজার টাকা দিয়ে নবযুগের ডিক্লারেশন নিতে চাইলেন না, তখন কেমন মাথা গরম হয়েছিল আমাদের? মনটা একটু ভালো করবার জন্যেই তোমাকে নিয়ে আমি গেলাম খিদিরপুর ডকের পাড়ায়, মনে আছে তোমার? চল, আজও একবার সেখানেই যাই। অনেক দিন ওই জাহাজি ছেলেগুলোর সঙ্গে দেখা হয়নি। ওদের সঙ্গে কথা বললেই মন ভালো হয়ে যায়। যাবে?
খিদিরপুরে পৌঁছেই ওরা খবর পায় কোন একটা দুর্গাবাড়ির মাঠে নাকি মীটিং চলছে, দাউদ সাহেব এসেছেন। সোজা সেখানেই পৌঁছে যায় ওরা। জনাবিশেক জাহাজি বসে আছে মাটিতে, একটা ছোট টেবিল সামনে রেখে চেয়ারে বসে আছেন দাউদ সাহেব। ওদের দেখতে পেয়েই ব্যস্ত হয়ে ওঠেন দাউদ, মাঠে-বসা মানুষদের মধ্যে একজনকে বলেন আরও দুটো চেয়ার নিয়ে আসতে। হাত তুলে বাধা দেয় মুজফ্ফর, মাটিতেই বসে পড়ে ওরা।
মীটিং শেষ হয়ে যায় মিনিট পনেরর মধ্যে। যতক্ষণ মীটিং চলছিল, দাউদ সাহেব কথা বলছিলেন, শুনছিলেন, আর লিখেও চলছিলেন একই সঙ্গে। মীটিং শেষ হবার পর নিজের লেখাটা পড়ে শোনান দাউদ, জিজ্ঞেস করেন কারো কিছু বলবার আছে কিনা। দেখা গেল সবাই নীরব। দাউদ বলেন, তাহলে মীটিং শেষ। মনে রাখতে হবে যা যা আমরা ঠিক করলাম, সবাই মিলেই করলাম। সেই হিসেবেই চলব আমরা। খোদা হাফেজ। দুগ্গা-দুগ্গা।
প্রথম যে বার মুজফ্ফরের সঙ্গে নজরুল এসেছিল খিদিরপুরে, তখন যে দোকানে সকালের জলখাবার খেয়েছিল ওরা, সেখানেই দাউদ সাহেব নিয়ে গেলেন ওদের। নজরুলের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, তিনজনের জন্যে চায়ের অর্ডার দিয়ে, মুজফ্ফরকে বলেন দাউদ, ব্যাপারটা কী আপনার, আহ্মদ সাহেব? কতদিন দেখা নেই আপনার! আমার তো যতদূর মনে পড়ে সেই কলেজ স্ট্রীটে একটা মিছিলে শেষ দেখেছিলাম আপনাকে – সে তো বছর দেড়-দুই হবে – তারপর থেকেই একেবারে বেপাত্তা হয়ে গেলেন! আপনার খবর কিছু কিছু পাই ঠিকই, নবযুগ বের করলেন, মাঝে মাঝে একটা-দুটো পড়েওছি, আবার শুনলাম সেটা বন্ধও হয়ে গেল, কী করছেন আজকাল?
কী যে করছি নিজেও জানি না, বলে মুজফ্ফর, মন-মেজাজ ভালো করতে তাই বন্ধুকে নিয়ে গঙ্গার হাওয়া খেতে এলাম।
তা বেশ করেছেন, বলেন দাউদ, যেখান থেকে ট্রাম ধরলেন সেই জায়গা থেকে পাঁচ মিনিট হেঁটে অমন চমৎকার গঙ্গার হাওয়া খাওয়ার জায়গা ছেড়ে খিদিরপুরের বস্তিতে হাওয়া খেতে আসা মন্দ নয়। আর, মাঝে মাঝে এমন যদি আসেন তাহলে আমাদের মতো কুলির সর্দারদের সঙ্গেও দেখা হয়ে যায়। কিন্তু, সত্যি সত্যিই নবযুগে প্রবলেমটা কী হল বলুন তো। ভালোই তো চলছিল কাগজটা, কুলি-মজুরদের কথাও তো লিখছিলেন মাঝে মাঝেই। সেটাই তো আপনার প্রাণের বিষয়!
এই যে আমার বন্ধু কাজি নজরুল ইসলাম, মুজফ্ফর বলে, ও একটা আর্টিক্ল্ লিখেছিল মুহাজিরদের ব্যাপারে, সেটা নিয়ে হোম ডিপার্টমেন্ট ঝামেলা করল খানিকটা, হক সাহেব বোধ হয় ভয়ই পেয়ে গেলেন তাতে। সেই সব নিয়ে ঝামেলা হল আর কি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, পড়েছিলাম লেখাটা, দাউদ তাকান নজরুলের দিকে, দারুণ লিখেছিলেন তো, তবে তখনই মনে হয়েছিল আমার, গাভ্মেন্টের সইলে হয়...! তাহলে কী করবেন এখন, আর একটা কাগজ বের করবেন নাকি?
চেষ্টায় আছি, মুজফ্ফর বলে, এবার একটু বড়োসড়ো প্ল্যান, ন্যাশনাল জর্ণাল্স্ লিমিটেড নামে একটা কম্পানি ফ্লোট করার চেষ্টায় আছি। সব যদি ঠিকঠাক চলে, তাহলে একটা বাংলা ডেইলী...
আরে আরে, এ তো বড় প্রজেক্ট, উইশ য়্যু গূড লাক, কিন্তু এ তো আপনার একার প্রজেক্ট নয়, সঙ্গে কারা আছে?
কুত্বুদ্দিন আহ্মদের নাম শুনেছেন?
কুত্বুদ্দিন? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের চেলা তো? খিলাফতি? ও তো শুনেছি এখন সোশ্যালিজ্মের দিকে ঝুঁকেছে, আপনার সঙ্গে মিলবে ভালো। মানুষটা খুব ভালো, জানেন তো। এক কথার মানুষ, আর একবগ্গাও আছে মৌলানা সাহেবেরই মতো। আমার তো মনে হয় এতদিনে একটা ঠিক লোক পেয়েছেন আপনি। এই ডেইলী আপনার চলবে। কুত্বুদ্দিন বহৎ লড়াকু আদমী। মৌলানা সাহেবের পত্রিকা ছিল না, আল হিলাল? ও তার ম্যানেজার ছিল। গাভ্মেন্ট ঝামেলা করল, কাগজ বন্ধ হয়ে গেল। আবার বের করল আল বালাগ, ছোড়নেওয়ালা নহী। এখন তো ট্ট্রেড য়্যুনিয়নও করছে শুনেছি, হোটেলের বাবুর্চি-খানসামাদের নিয়ে। বহৎ সচ্চা আদমী, সাক্সেসফুল হবেই হবে। এবার, মুজফ্ফর সাহেব, আপনি একজন খুব ভালো মানুষকে খুঁজে বের করেছেন। কম্পানী রেজিস্ট্রেশন হলে আমাকে জানাবেন, আমি সাধ্যমতো সাবস্ক্রাইব করব।
মুজফ্ফর হাসে। বলে, দেখলেন তো, এসপ্ল্যানেড ট্রাম ডিপো থেকে মাত্র পাঁচ মিনিট হেঁটে গঙ্গার হাওয়া না খেয়ে খিদিরপুর পর্যন্ত উজিয়ে এসে ভালোই হয়েছে। প্রথম সাবস্ক্রিপশনের অঙ্গীকার পাওয়া গেল, আর পাওয়া গেল আপনার শুভেচ্ছা।
শুভেচ্ছা তো আছেই, নিশ্চয়ই আছে, বলেন দাউদ, আপনাকে তো আমি চিনি, অনেকবার আপনার সঙ্গে আপনার আদর্শ নিয়ে আলোচনা করেছি, তক্ক করেছি। আমার বিশেষ করে ভালো লাগছে কেন জানেন? ঠিক আপনার মতো করেই ভাবে এমন আর একজন মানুষ আপনি খুঁজে পেয়েছেন বলে। ওই যে বললাম কুত্বুদ্দিন সাহেব এখন সোশ্যালিজ্মের দিকে ঝুঁকেছে, এটাই বড় কথা। এখন হয়তো কুত্বুদ্দিনের সুবাদে আরও কিছু শিক্ষিত খিলাফতিদের সঙ্গে আপনার আলাপ হবে। আমি একটা কথা বলব, আমাকে সাম্প্রদায়িক বলে মনে করবেন না। ইসলাম হল গিয়ে আপনার, বিশ্বভ্রাতৃত্বের ধর্ম। খিলাফত আন্দোলনটার জোরও কিন্তু এই বিশ্বভ্রাতৃত্বের চিন্তায়। কংগ্রেসের সঙ্গে খিলাফতিদের যে জোট সে জোট কেন টেকা মুশকিল জানেন? কংগ্রেসের চোখটা অন্তর্মুখী, ন্যাশনালিস্ট। ইসলামের চিন্তা আন্তর্জাতিক,
প্যান-ইসলামিজ্ম্। আপনি মুহাজিরদের কথা বলছিলেন না? দেশ স্বাধীন নয় অতএব দেশ ছেড়ে চলে যাই, এ কথা কি কোন কংগ্রেসি ভাববে? কিন্তু খিলাফৎ আন্দোলনের তেমন কিছু ভবিষ্যত দেখা যাচ্ছে না মনে করেই দু' হাজার মুহাজিরিন দেশ ছেড়ে চলে যাবার চেষ্টা করল। ফীল্ডে গিয়ে লড়বে তারা! এইখানেই তফাৎ। শিক্ষিত খিলাফতিদের সঙ্গে আপনি কথা বলে দেখুন। অনেকেই তারা এভাবেই ভাবে এখন। ব্যতিক্রম হচ্ছেন আবুল কালাম আজাদ। নিজের জন্ম মদিনাতে হওয়া সত্ত্বেও পাঁড়-কংগ্রেসিদের থেকেও আদর্শের দিক থেকে তিনি বেশি ন্যাশনালিস্ট।
আর একবার করে চা আনতে বলেন দাউদ সাহেব। তারপর বলতে থাকেন, মনে আছে পনের সালের কথা? লাহোরের নানা কলেজ থেকে পনেরজন মুসলিম কলেজ-ছাত্র মুহাজির হয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পার হয়ে কাবুলে পৌঁছে গেল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেটা, খুবই বিপজ্জনক কাজ। কাবুলের সঙ্গে জর্মনদের সখ্য, আর ইংরেজদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাশিয়ার জার-সম্রাটের। পনের সালের ডিসেম্বর মাসে রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ কাবুলে অস্থায়ী ভারত সরকার গঠন করলেন। এই ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই সেই অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রীও হয়েছিল তখনকার মতো। সে হোক, তারা তো আর মন্ত্রী হবার জন্যে দেশত্যাগ করেনি, করেছে বিধর্মী ইংরেজের সঙ্গ ত্যাগ করার জন্যে, আর মনে-প্রাণে তারা লড়তে চায় তুর্কের হয়ে। সে সুযোগ সে সময় তাদের হল না, কিন্তু সতের সালে রাশিয়ার শ্রমিক বিপ্লবের পর অবস্থাটা অনেক বদলিয়ে গেল। যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এল রাশিয়া। এই ছেলেদের মধ্যে অনেকেই সীমান্ত পেরিয়ে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের নির্মাণক্রিয়াটা নিজেদের চর্মচক্ষুতে দেখল। কেউ কেউ প্রথমেই হয়ে গেল সমাজতন্ত্রী, কেউ কেউ প্ল্যান-ইসলামিজমের প্রেরণায় লড়াই করতেও গেল, কেউ কেউ আবার ওখানকার শ্রমজীবী প্রাচ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে একেবারে কম্যুনিস্ট হয়েই বেরোল। আসল কথাটা কী জানেন তো, ইসলাম ধর্মটা শিক্ষিত ছেলেদের টেনে আনে আন্তর্জাতিক ইকোসিস্টেমে, দেখার চোখটা অন্য রকমের হয়ে যায় তাদের। সোশ্যালিজ্মের শিক্ষাটাও মূলত তাই, পুঁজির কোন দেশ-বিদেশ নেই!
চা-টা শেষ হয়ে গেছে এতক্ষণে। দাউদ বলেন, আহ্মদ সাহেব, আপনাকে গত কয়েকবছর ধরেই দেখছি তো, আমার প্রথম থেকেই মনে হয়েছে আপনার মানসিক গড়নটাই সোশ্যালিজ্ম্-মুখী। আমার মনে হয়, কাজি সাহেব ছাড়াও আপনি এবার ঠিক-ঠিক সহকর্মী পাচ্ছেন আর একজন: কুত্বুদ্দিন আহ্মদ। খিলাফতি সোশ্যালিস্ট। এ-দেশে
নন-খিলাফতি সোশ্যালিস্ট এখনো তৈরি হয়নি।