এ-বছরেও ফেব্রুয়ারির প্রায়-শেষে, ফাল্গুনের গোড়ায়, আবার ডাক ঢাকায়; মুসলিম সাহিত্য সমাজের অনুষ্ঠান। গত বছরের অনুষ্ঠানে কাজি অভিযান শুরুর ঘোষণা করেছিল গান গেয়ে এবং বক্তৃতায়, এবার অভিযান এগিয়েছে অনেকটাই; কাজিই অনুষ্ঠানের মধ্যমণি, তাকে ঘিরেই হৈ হৈ। ঢাকা য়্যুনিভার্সিটির মুসলিম হল মিলনায়তনে উদ্বোধন শুধু সাহিত্য সমাজের বার্ষিক অধিবেশনের নয়, শিখা পত্রিকার দ্বিতীয় বার্ষিক সংখ্যারও প্রকাশ হল সেখানে। গজলের অপ্রতিহত জনপ্রিয়তা এবার কাজিকে নিয়ে গেছে ঢাকার প্রায় ঘরে ঘরে, কাজির কোন পরিচিতর সঙ্গে বিন্দুমাত্রও পরিচয় আছে এমন যে-কোন ব্যক্তিই তাকে নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে; সঙ্কোচহীন কাজি তো গানেই ডুবে, যে নিয়ে যায় তারই সঙ্গে যায় সে, তার কণ্ঠে গান, মুখে পান-জর্দা, তৃষ্ণাহরণে কাপের পর কাপ চা!
এভাবেই সে পৌঁছে গেল ফজিলতউন্নেসার কাছে। বাইশ-তেইশ বছরের তন্বী ফজিলতউন্নেসা ঢাকা য়্যুনিভার্সিটির নক্ষত্ররাজির উজ্জ্বলতম, গ্রামীণ স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষক পিতার প্রত্যক্ষ অভিভাবকত্ব থেকে দূরবাসিনী –
হোস্টেল-আবাসিকা নয় – কনিষ্ঠা সহোদরার অভিভাবিকা হিসেবে ঢাকা সহরে ভাড়াবাড়ির বাসিন্দা। ইডেন কলেজের পর কলকাতার বেথুনে পড়েছে সে, উভয় কলেজেই সে ডাকসাইটে ভালো ছাত্রী হিসেবে পরিচিত ছিল, এখন ঢাকা য়্যুনিভার্সিটিতে স্নাতকোত্তর গণিতের প্রশ্নাতীত শ্রেষ্ঠ পড়ুয়া। মহিলা ছাড়াও তার পুরুষ বন্ধুর অভাব নেই, এবং তাদের সঙ্গে মেলামেশায় সে একেবারেই স্বাভাবিক।
কাজির গানে সে মুগ্ধ, কবিতায় উচ্ছ্বসিত, পান-জর্দায় বিরক্ত। শিয়ারশোলে কৈশোরের শেষ, পল্টনে যৌবনপ্রাপ্তি, মুসলমান সাহিত্য সমিতির পুরুষ-প্রধান পরিবেশে শ্বাস-প্রশ্বাস, সাবালিকা তরুণী-যুবতি বিবর্জিত পরিবেশে বেড়ে ওঠা মিলিয়ে-মিশিয়ে যে কাজি প্রায়-তিরিশেও সুযোগ পেলেই তার ময়মনসিংহের কৈশোরের সেই হারিয়ে-খুঁজে পেয়ে-আবার-হারিয়ে-যাওয়া মাথার কাঁটাটার খোঁজে থাকেই, তার কাছে সহজেই – মাথায় এক ঝুড়ি দুষ্টুমি নিয়েই কিনা কে জানে – হেসে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল ফজিলতউন্নেসা, হাত দেখতে জানেন? এমন স্বচ্ছন্দে সদ্য পরিচিতা মুসলমান যুবতির না-চাইতেই পেয়ে-যাওয়া করদ্বয়? কাজি শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, ম্যাথ্ম্যাটিক্স্? অঙ্ক? অঙ্ক কষে শেষ পর্যন্ত কী করবেন? তাতেই এই অঘটন! দেখুন না কী লেখা আছে, উচ্চারণে করযুগল এগিয়ে দেয় এই অবিবাহিতা মুসলিম সুন্দরী। ঘর্মসিক্ত ঈষদোষ্ণ করদ্বয় কম্প্রবক্ষ কাজির হস্তধৃত! পাণিগ্রহণের আবেদনই বুঝি, আনাড়ি ভাবনা তার!
অতএব, গত বছরেই আলাপ হয়েছিল যে মোতাহার হোসেনের সঙ্গে, ফজিলতউন্নেসার সে দূর-সম্পর্কিত অগ্রজ জেনে এ-বছর তারই সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা পাতিয়ে ফেলল কাজি, প্রায় হরিহর-আত্মা। যেখানে ছিল ঢাকায় এসেই, সেই আবুল হোসেনের বাড়ি প্রায় বিনা-কারণে বিনা-নোটিশে ছেড়ে মোতাহারের সঙ্গে একই বাসস্থানে থাকা, বর্ধমান হাউজ। মোতাহারেরই সঙ্গে ফজিলতউন্নেসার অনতিদূর বাসস্থানে দু-বেলা যাতায়াত, এবং, সম্ভবত আর-একটু সাহস সঞ্চয় করার পর, একা-একাই। এ-বছর ঢাকার মেয়াদ বেশিদিনের নয়, ফিরতে হবে চব্বিশ তারিখেই। তেমন কিছু ঘনিষ্ঠতা হতে পারার আগেই ফেরার স্টীমারে উঠতেই হল কাজিকে। তারপর স্টীমারে বসেই মোতাহারকে চিঠি।
আর কী সে চিঠি? কাজি লেখে, অঙ্কশাস্ত্রী পাহারা দিচ্ছে ফুলবাগানের শ্রেষ্ঠ ফুলখানা। সেই পাহারাদারের নজর এড়িয়ে এই পুষ্পচয়নের দুঃসাহস হবে কার? এমন সময় বাগানে ঢোকে মধুপিয়াসী মৌমাছি। কোন্ পাহারাদার রুখবে তাকে? আর সেই মৌমাছি যদি একই সঙ্গে হয় কবিও?
এইসব নানা হেঁয়ালির কথা বলতে বলতে এই চিঠিতে এক সময় স্পষ্ট করেই বলে কাজি, “যে আমায় এমন করে চোখের জলে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে – সে আমার আজকের নয়, সে আমার জন্ম-জন্মান্তরের, লোক-লোকান্তরের দুখজাগানিয়া। তার সাথে নব নব লোকে এই চোখের জলে দেখা এবং ছাড়াছাড়ি।”
এই পত্র শেষ হয় এবারের ঢাকা-আগমনকে স্পষ্ট করেই তীর্থযাত্রা ঘোষণা করে: এতদিনে আমি যেন আপনাকে খুঁজে পেলাম। এবারে আমি পেয়েছি – প্রাণের দোসর বন্ধু তোমায় এবং চোখের জলের প্রিয়াকে।
প্রায়-তিরিশের কাজি যেন সদ্য-প্রেমোন্মত্ত কিশোর। পরের দিন সকালেই কৃষ্ণনগর, আর সেই বিকেলেই আবার চিঠি লিখতে বসে কাজি। এবার আর কোন কাব্যিক ব্যঞ্জনা ছল-চাতুরী নয়; স্পষ্ট ঘোষণা, সে ডুবেছে। প্রেমোন্মাদের চিরকেলে বিলাপের মতোই এই তিরিশ-ছুঁই-ছুঁই নব কিশোর যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে প্রিয়াকে লিখতে পারে না সোজাসুজি; মোতাহারকে লেখে, এ চিঠি শুধু তোমার এবং আর একজনের। একে secret মনে করো। আর একজনকে দিও এই চিঠিটা দুদিনের জন্য। ভাবা যায়!
চিঠিটা পড়ে এই 'আর একজন' কী মন্তব্য করবেন তা শোনার জন্যে ধৈর্য ধরতে পারে না কাজি। ঢাকায় রংমহলার তিমির-দুয়ার খুলে দেবার যে অনুনয় শুধু ছিল চোখ ইশারায়, এখন শেষ পর্যন্ত তা পত্রের ভাষায় নিবেদিত। উত্তর আসে ঝটিতি। নামঞ্জুর। এবং, সুমধুর ভাষায় পিঠ চাপড়িয়ে প্রত্যাখ্যান নয়; যা-বলার, গণিতবিদের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সংশয়হীন ঋজু ভাষায় তা ব্যক্ত। পয়লা মার্চ কৃষ্ণনগর থেকে মোতাহারকে আবার লেখে কাজি। তার আগের দিন, অর্থাৎ উনত্রিশে ফেব্রুয়ারি সকাল দশটায় মোতাহার আর তার বোনের চিঠি একসঙ্গেই পেয়েছে কাজি। এমনিতেই শরীর খারাপ ছিল, এই পত্রদ্বয়ের ফলেই হোক বা না হোক, শরীর আরও খারাপ হল। তাই একদিন দেরি উত্তর দিতে। মোতাহারকে এই চিঠিতে মোতিহার – হ্যাঁ, মোতিহার – সম্বোধনে জানানো হয়েছে, “সকালে তোমার বোনকে শেষ চিঠি লিখলাম। শেষ চিঠি মানে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে চিঠি দিয়ে আর অপমানিতা করব না, তাঁকে – এবং আমাকেও!”
এই প্রত্যাখ্যান এবং অপমানের পর শরীর খারাপ তো লাগেই। ঘরে থাকতে মন চায় না। কৃষ্ণনগরের গ্রেস কটেজের বাইরের আমতলায় হাঁটাহাঁটি করেও যায় না মনের অবসাদ। এমন সময় কলকাতা থেকে তার বেয়ে প্রশ্ন এল দিলীপ রায়ের কাছ থেকে – ঢাকা থেকে ফিরেছ?
ফিরেছি। – জবাব দেয় কাজি, কাল দুপুরেই কলকাতা যাচ্ছি।
মোতাহারকে লেখে কাজি, এখন কলকাতায় দু-দশদিন থাকব। অতএব তোমরা কেউ পত্র দিলে সেখানেই দিও। আমার কলকাতার ঠিকানা – ১৫, জেলিয়াটোলা স্ট্রীট, কলিকাতা। কলকাতার ঠিকানা দিয়ে যাকে লিখছে কাজি, সে কিন্তু এখনও, ফজিলতউন্নেসার এই প্রত্যাখ্যানের পরেও, শুধু 'তুমি' নামে সম্বোধিত নয়, 'তু্মি'-র বদলে 'তোমরা কেউ!' 'তোমরা কেউ পত্র দিলে!' কিসের আশায়?
পরের চিঠি এবার জেলেটোলার থেকেই, আসলে বন্ধু নলিনীকান্ত সরকারের বাড়ি যেটা, মার্চের আট তারিখে। যদিও 'মোতিহার'কে লেখা সেই পত্র, কান্নাভরা সেই পত্রেও স্পষ্ট-অস্পষ্ট স্বরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার আসে একটিই নাম, ফজিলতউন্নেসা! শেষ আকুতি, “যেদিন আমি ঐ দূর তারার দেশে চলে যাব – সেদিন তাকে বলো এই চিঠি দেখিয়ে – সে যেন দুটি ফোঁটা অশ্রু তর্পণ দেয় শুধু আমার নামে। হয়তো আমি সেদিন খুশিতে উল্কা-ফুল হয়ে তার নোটন খোঁপায় ঝরে পড়ব।”
চিঠির পর চিঠি। কলকাতায় এসে সুবিধেই হয়েছে, পাশে শায়িতা দুলির ঘুম ভাঙাতে হচ্ছে না। কখনও মাঝ-রাতে বন্ধুর বাড়ির ছাদে বসে, কখনও বা সওগাতের অফিসে বসে, রাত বারটায়। সদ্য গোঁফ-গজানো কিশোর যেন! সব চিঠিই স্পষ্টত 'মোতিহার'কে লেখা, সে-ই উপলক্ষ। লক্ষ্য কিন্তু ওই একটিই ধ্রুবতারা, নাম যার ফজিলতউন্নেসা!
এই সব ঘটনা – যতই ঘটনার পাত্রপাত্রীরা অন্যরকম মনে করুক – চাউর হতে সময় লাগে না। গুজবে ডানা লাগে, ঢাকা থেকে কৃষ্ণনগরে তার উড়ে আসতে সময় লাগে শুধু বোধ হয় কয়েক মুহূর্ত। দিনের পর দিন কাজি আসে না কৃষ্ণনগরে, সেই যে কবে গেছে কলকাতায়, বাড়িতে বাচ্চা একটা ছেলে আছে, দুজন অসমবয়েসী মহিলা নীরবে তার প্রতীক্ষায়, সে কথা কি জানে না কাজি? শোনা যায় সে কবে হুগলির কোন্ বাড়িতে গান গাইতে গিয়েছিল, সেখান থেকে ফেরেনি দুদিন। কলকাতাতেও তার নানা আড্ডা, খাবার-শোবার জায়গার অভাব নেই, অভাব নেই ভক্তেরও! এরই মধ্যে গ্রেস কটেজের এক প্রতিবেশিনী দুলিকে বলেন, ঢাকায় কোন্ কলেজের কোন্ মেয়েকে নিয়ে কাজিকে জড়িয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। দুলির ভয় করে না?
কিসের ভয়, দিদি?– বলে দুলি, অমন মানুষের পেছনে মেয়েরা না দৌড়োলেই তো অবাক হবার, তাই না? ওসব নিয়ে তোমরা ভেব না। ওই মানুষের ভালোবাসা কিল মেরে আদায় করে নিতে হয়, সে-সব বিদ্যে কলেজের ভারী ভারী বইতে নেইই তো। ও নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। অনেক দিন না এলে আমার শুধু চিন্তা হয় শরীরটা কেমন আছে। মাঝে মাঝেই ম্যালেরিয়ার জ্বর মাথা চাগিয়ে ওঠে, তখন তো দেখবার-শোনবার কাউকে চাই!
এদিকে এসে গেল ঈদ। যদিও ফজিলতউন্নেসাকে লেখা আগের চিঠিকেই শেষ চিঠি নামে অভিহিত করেছিল কাজি নিজেই, তবুও আরেকবার লেখার সুযোগ হাতছাড়া করে না সে: ঈদ মুবারক।
তা ছাড়াও বার্ষিক সওগাতের জন্যে একটা গল্প পাঠিয়েছে ফজিলতউন্নেসা – শুধু দু'দিনের দেখা। সম্পাদক কাজিকেই দিয়েছেন সেই গল্প একটু ঘষামাজা করে দিতে। কাজি লেখে, “...সওগাত সম্পাদক আমায় তাহা (গল্পটি) দেখিয়া দিতে দিয়াছেন। কিন্তু আপনার অনুমতি ব্যতীত তাহার একটি অক্ষর বদলাইবারও সাহস নাই আমার, আমি লেখাটি পড়িয়াছি। যদি ধৃষ্টতা মার্জনা করেন – তাহা হইলে আমি উহার এক-আধটু অদল-বদল করিয়া ঠিক গল্প করিয়া তুলিবার চেষ্টা করি। সামান্য এক-আধটু বাড়াইয়া দিলেই উহা একটা ভালো গল্প হইবে। অবশ্য এ স্পর্ধা আমার নাই যে আপনার লেখার তাহাতে কিছুমাত্র সৌন্দর্য বা গৌরব বাড়িবে। মনে হয় গল্পটা বড্ডো তাড়াতাড়ি লিখিয়াছেন। উহা যেন আপনার অযত্ন-লালিতা। অবশ্য আপনার অসম্মতি থাকিলে যেমন আছে তেমনটা ছাপিবেন সম্পাদক সাহেব। আপনার অমত থাকিলে স্পষ্ট করিয়া লিখিবেন, কিছুমাত্র দুঃখিত হইব না তাহাতে। আর আমার লিখিবার কিছু নাই। আপনার খবরটুকু পাইলেই আমি নিশ্চিন্ত হইতে পারিব।”
এতখানি চিঠি! সে কি করবে অমত? হাত চুলকোয় কাজির, এ-গল্পকে কোথায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়! কিন্তু বড় স্বাধীনচেতা সে, যদি রাজি না হয়!
কাজি লেগে থাকে। এবার তার শেষ নিবেদন।
নিজের নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ পরিচায়ক কবিতাসমূহের একটা সঙ্কলন – সঞ্চিতা – প্রকাশ করতে চায় কাজি। সে লেখে: “আপনি বাংলার মুসলিম নারীদের রানী। আপনার অসামান্য প্রতিভার উদ্দেশে সামান্য কবির অপার শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ সঞ্চিতা আপনার নামে উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইতে চাই। আশা করি এজন্য আপনার আর সম্মতিপত্র লইতে হইবে না। আমি ক্ষুদ্র কবি, আমার জীবনের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া পুষ্পাঞ্জলী অর্পণ করা ব্যতীত আপনার প্রতিভার জন্য কী সম্মান করিব?”
শেষ পর্যন্ত সঞ্চিতা যে নিবেদিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের শ্রীশ্রীচরণারবিন্দে সে তো সকলেই জানে!
একটানা তিন সপ্তাহেরও বেশি হয়ে গেছে সে কৃষ্ণনগর ছাড়ার পর। কেমন আছে ওরা কৃষ্ণনগরে, কাজি ভাবে একবার। ভালোই আছে নিশ্চয়ই, না হলে খবর আসত ঠিকই। এবার সেখানে ফেরবার কথা ভাবছে কাজি। কিছু টাকা সংগ্রহ হয়েছে এর মধ্যে, খানিকটা ঋণশোধ হবে। ছেলের জন্যে আন্দাজ করে একটা সাহেবী পোশাক কিনেছে সে, সঙ্গে আছে সেটা। দুলির জন্যে একটা স্টোভ। পাম্প করে জ্বালাতে হয়। ডক্টর দে চেয়েছিলেন ইঞ্জেকশনের ছুঁচ গরম জলে ফোটাবার জন্যে।
খোকার জামাটা লাগল না ঠিক ঠিক। অনেকটা বড়। তবু ভালো, বড়। আর একটু লম্বায় বাড়লে তখন নিশ্চয়ই পরতে পারবে।
সওগাতের সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের পর থেকেই কাজি নজরুল ইসলামের নামে কৃষ্ণনগরের ঠিকানায় একটা করে সৌজন্য কপি আসে প্রতি সপ্তাহে। কাজি হয়তো খবরই রাখে না এসবের, কিন্তু দুলি আর তার মা গিরিবালা এই পত্রিকার নিয়মিত পাঠিকা। বেশ কিছুদিন আগে, তখন ওরা হুগলিতে থাকত, 'করুণা' নামে দুলির লেখা একটা কবিতা 'সাম্যবাদী'তে বেরিয়েছিল। একটু-আধটু কবিতা সে মাঝে-মাঝেই লেখে চুপচাপ। খুব-একটা দেখায় না কাউকে। নিয়মিত সওগাত পড়তে পড়তে তারও সওগাতে কবিতা ছাপাবার ইচ্ছে হয় একটু-একটু; ভেবেছিল, এবার কাজি কলকাতা থেকে ফিরলে বলবে সে-কথা। কিন্তু কেমন-যেন একটু বাধো-বাধো ঠেকল তার কথাটা বলতে গিয়ে। কাজির সঙ্গে তার দূরত্ব কি বাড়ছে একটু একটু?
কৃষ্ণনগরে এসে রোববার বাজার থেকে অনেক কিছু কিনল কাজি। এবার ধার শোধ করেছে যাদের তাদের কাছ থেকে একটু বেশিই খাতির পাওয়া গেল। নিজের শরীরের যত্ন নেবার প্রতিশ্রুতি দুলিকে দিয়ে সোমবারের ভোরবেলায় আবার কলকাতা অভিমুখে সে।
সওগাতের সান্ধ্য-মজলিশ, সাপ্তাহিকের 'চানাচুর' বিভাগের লেখা তৈরি, এসব নিয়মিত কাজ ছাড়াও কাজির এখন কলকাতায় প্রধান ব্যস্ততা গান আর নিজের কবিতার আবৃত্তি নিয়ে। গত বছর ইণ্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানী নামে বেতারসম্প্রচারের এক সংস্থা তৈরি হয়েছে কলকাতায়। গ্রাহক যন্ত্র – যা আটপৌরে বেতার বা রেডিও নামে বাঙালির ঘরে ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে, তাতে প্রায়ই সম্প্রচার হয় কাজির গান – স্বকণ্ঠে বা পেশাদার অন্য গায়কের কণ্ঠেও। বিনিময়ে অর্থলাভ হয় কাজির। ইদানিং স্বরচিত কবিতা আবৃত্তির অনুরোধও আসে মাঝে মাঝে। কাজি কখনও প্রত্যাখ্যান করে না এ অনুরোধ। এ-ছাড়াও, এইচ-এম-ভি নামে এক রেকর্ডিং কম্পানী শিল্পীদের কণ্ঠস্বর বা সঙ্গীতযন্ত্রের নানা শিল্প-উৎপাদন রেকর্ড করে তার নতুন এক বাজারই তৈরি করে ফেলল। এই রেকর্ডের গানের বাজারে নজরুলের অভিনব গজল-গানের প্রবল চাহিদা। নানা অনুষ্ঠানে দিলীপের সঙ্গে তারও ডাক পড়ে। নিজেদের
বন্ধু-বান্ধব আর পরিচিতদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানা উৎসবেও তার গান শুনতে চায় সবাই। ভয়ানক ব্যস্ত সে। মেজাজও ভালো, গান গেয়ে অর্থপ্রাপ্তির কথা আগে সে ভাবতেও পারত না। এখন ঋণের প্রয়োজনও তো কমছেই একটু একটু করে!
এরই মধ্যে এইচ-এম-ভি-র ইলেকট্রিক রেকর্ডিঙের ব্যবস্থার উদ্বোধন করলেন রবীন্দ্রনাথ নিজে। দমদমের স্টুডিও ছাড়াও চিৎপুরে তৈরি হল তাদের রিহার্স্যাল রূম। কয়েকবছর আগে কাজির জাতের নামে বজ্জাতি গানখানা নিজেই সুর দিয়ে হরেন্দ্রনাথ ঘোষ নামে একজন এইচ-এম-ভি তে রেকর্ড করেন। সে সময় কোন অর্থপ্রাপ্তি ঘটেনি কাজির, এমনকি হয়তো গীতিকার হিসেবে তার নামও প্রচারিত হয়নি। এমনই তো হয়, গান তো গায়কের নামেই চলে! এবার, এতদিন পর, কয়েকশো টাকা পাঠিয়ে দিল কম্পানী কাজিকে তার রচনাস্বত্ব হিসেবে। কাজি আপ্লুত! এতদিনে সে কৃষ্ণনগরের সব দেনা শোধ করে দিতে পারবে।
অর্থকষ্ট খানিকটা কমেছে, ফলে মেজাজও ভালোই। কিন্তু যতই অর্থকষ্ট কমে, তার সঙ্গে তাল দিয়ে নানা অকাজের সময়ও কমে যায় তেমনি। তবুও, চিরকেলে হুল্লোড়বাজ কাজি এখন নানা ব্যস্ততার মধ্যেও সুযোগ খোঁজে হুল্লোড়ের সময় বের করে নেবার। জুন মাসে কলকাতার ময়দানে এক বিলিতি ফুটবল দলকে মোহনবাগান হারিয়ে দিল ছ-ছটা গোলে। খেলার মাঠে ছিল কাজি আর তার কল্লোলের বন্ধুরা। গোলদাতা খেলোয়ারটি ঢাকার ছেলে। ঠিক হল, ঢাকাতেই তাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হবে। মাঠ থেকে সবান্ধব কাজি ছোটে শেয়ালদায়। সেখান থেকে ঢাকা মেলে পরের দিন সকালেই ঢাকা। ঢাকায় পৌঁছেছে কাজি, আর কি মনে থাকে কলকাতা বা কৃষ্ণনগর! বুদ্ধদেবদের কাগজ প্রগতিতে এবার দিয়ে দিল দুখানা গজল স্বরলিপি সমেত! ঢাকায় ডাকল গজলের বান আবার!
আগের বারে ঢাকায় এসে দিলীপের ছাত্রী রাণুর গান শুনেছিল সে। আহা, কী তার গলা! তাকে গান শেখাবে বলেওছিল, কিন্তু সেবার তো ঢাকায় তার অন্য টান! এবার কাজি প্রতি সন্ধ্যায় গান শেখাতে যায় ঢাকার প্রত্যন্ত পল্লী বনগাঁয়, রাণু সোমদের বাড়িতে। প্রায় সপ্তা' তিনেক হয়ে গেছে, কলকাতার কথা কাজির খেয়ালও নেই! গান শেখাতে শেখাতে সময়েরও খেয়াল থাকে না, রোজই ফিরতে ফিরতে অনেক রাত। সেবার ওই বনগাঁ পাড়ার ছেলেরা হকিস্টিকের সাহায্যে কাজিকে রাস্তায় ধরে একটু শিক্ষা দিতে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি শিক্ষাদাতা এবং শিক্ষার্থীর কাজ বদলাবদলি হয়ে যায়!
ঢাকার কাগজে বেরিয়েছিল খবরটা। সেখান থেকে কলকাতাতেও।
সন্ধ্যেবেলা সাপ্তাহিক সওগাতের বিশে জুলাই সংখ্যাটা পড়ছিল দুলি, যেমন পড়ে প্রতি সপ্তাহেই। এবার সেখানে বিশেষ একটা খবর: “গত ২৪শে জুন রাত্রি দশ ঘটিকার সময় বাংলার মুসলিম সমাজের গৌরব, বীররসের প্রাণপ্রতিষ্ঠাতা বিদ্রোহী, জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম সাহেব তাঁহার এক বন্ধুর বাসা হইতে ফিরিবার সময় ১৫/২০ জন হিন্দু যুবক তাহাকে হকি স্টিক হাতে আক্রমণ করে। কবি সাহেব খালি হাতে তাহাদিগকে বাধা দিতে যাইয়া হাতে, শরীরে আঘাত পান এবং জোরে একজনকে ধাক্কা দিয়া তাহার হাতের হকি স্টিক দ্বারা সকল যুবককে ছাগল ভেড়ার ন্যায় মারিতে মারিতে তাড়াইয়া দেন। আমরা জানি ২০/২৫ জন ভালো পাহলোয়ানও বিদ্রোহী কবি হাবিলদার নজরুল ইসলাম সাহেবের নিকট শক্তি পরীক্ষায় টিকিবে না।”
খবরটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে দুলি, তারপর মাকে দেখায়। চব্বিশে জুনের ঘটনা, এখন জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ। মানে এক মাস! কতটা আহত সে হয়েছে, কোথায় আছে এখন, কোন খবর নেই! কেউ একবার ওদের জানায়ওনি! পরের দিন সকালেই কাজিকে একটা টেলিগ্রাম পাঠায় দুলি, সওগাতের ঠিকানায়: এভ্রিওয়ান সিক রাশ হোম।
তার পরের দিন ভোরের ট্রেনেই আসে কাজি: কী হয়েছে তোমাদের?
আর তোমার? – প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় দুলি।
কেন, আমি তো ঠিকই আছি।
জামাটা খোল, বলে দুলি, ক'টা হকিস্টিকের দাগ আছে বুকে-পিঠে, দেখি।
তুমি কী ভাবে জানলে?
তুমি কি ভাবো, তুমি না জানালে আমরা কিছুই জানতে পারি না? তোমার সব খবর রাখি, সব।
পকেটে আছে টাকা, কৃষ্ণনগরের সব দেনা শোধ হয়। এই মাস শেষ হলেই শেয়ালদার ট্রেনে ওঠে ওরা সবাই। এবার থেকে কৃষ্ণনগর আর নয়, কলকাতার পনের নম্বর জেলিয়াটোলা স্ট্রীটই ওদের সবায়ের ঠিকানা।