কিছুটা নৌকোয়, কিছুটা পায়ে হেঁটে, পরের দিন ভোরবেলায় যখন পৌঁছোয় ওরা কান্দিরপাড়ে, নজরুলের গা তখন পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। কোনরকমে ধরাধরি করে বিছানায় ওকে শুইয়ে দেয় বীরেন, যতটা পারে নিজেই শুরু করে শুশ্রূষা। খবর পেয়ে পাশের বাড়ি থেকে হেমপ্রভা পাঠিয়ে দেন বীরেনের খাবার আর নজরুলের পথ্য। এক ফাঁকে গিয়ে পাড়ার ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে ওষুধও নিয়ে আসে বীরেন। ওষুধ খেয়েও সারাদিন প্রায় আচ্ছন্নের মতো শুয়েই থাকে নজরুল, ভারি মাথাটা সে তুলতেই পারছে না।
বিরজাসুন্দরীরা ফেরেন পরের দিন সকালে। কাজিকে এতটা অসুস্থ দেখবেন সম্ভবত ভাবেননি ওঁরা। সময় একটুও নষ্ট না করে ওর দায়িত্ব নিয়ে নেন বিরজাসুন্দরী, আর তাঁর সহকারী হয়ে যায় দুলি। সারাদিন ধরে চলে মাথা ধোয়ানো, জলপটি দেওয়া, গা স্পঞ্জ করানো, সময় মতো ওষুধ আর পথ্য দেওয়া। দিন তিনেকের মাথায় অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠে কাজি, বিছানায় বসতে পারে, ধরে ধরে ঘরের মধ্যে হাঁটতেও পারে খানিকটা। হাঁফ ছাড়ার সাহস পান বিরজাসুন্দরী। দুলিও।
কদিন ধরেই দুলির কাছে কাগজ-কলম চাইছে কাজি, একটা চিঠি লেখা ওর জরুরি প্রয়োজন। অবশেষে পুরো কাগজ নয়, একখানা পোস্ট-কার্ড এনে দিল দুলি, যতটুকু এই পোস্ট-কার্ডে ধরবে ততটুকুই লেখ। বেশি লেখবার মতো সুস্থ তুমি এখনো হওনি, দুলির কড়া শাসন।
পত্রপ্রাপকের নাম লেখে কাজি, মুজফ্ফর আহ্মদ। কিন্তু ঠিকানা কি? কোথায় থাকে এখন মুজফ্ফর? শেষ পর্যন্ত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ঠিকানাই লেখে কাজি। যেখানেই থাকুক, এই ঠিকানায় পাঠালে চিঠি নিশ্চয়ই পাবে সে। কান্দিরপাড়ের এই বাড়ির ঠিকানা লেখে কাজি চিঠির একেবারে উপরে, তারপর কয়েকটি বাক্য মাত্র: আলি আকবর খাঁ প্রতারণা এবং অপমান করেছে আমাকে, আমি উপরের ঠিকানায় আছি। অসুস্থ। সম্বলহীন, সর্বহারা। যথাশীঘ্র অন্তত কুড়িটা টাকা উপরের ঠিকানায় পাঠাও। কাজি।
কিন্তু সত্যিই কি কাজি সর্বহারা? হেমপ্রভা-বসন্তর সূত্রে কুমিল্লা শহর খবর পেয়ে গেছে কাজি নজরুলের অসুস্থতার। এবার দলে দলে ছেলেরা আসতে থাকে তাদের কাজিদার কাছে। গান-কবিতা-গল্পে জমজমাট হয়ে ওঠে কান্দিরপাড়ের এই বাড়ি। বিরজাসুন্দরী-ইন্দ্রকুমার নিষেধ করেন না কাউকে। শরীরের চেয়েও মনের আরামই বেশি দরকার এখন কাজির। দ্রুত সুস্থ হতে শুরু করে সে, নতুন নতুন গান লেখা হয়, আবার শুরু হবে তাদের প্রভাতফেরী।
নজরুলের পোস্টকার্ডটা মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে পৌঁছল জুন মাসের শেষ সপ্তাহে। আলি আকবরের পাঠানো নজরুল-নার্গিসের বিবাহের নিমন্ত্রণপত্র জ্যৈষ্ঠের একেবারে শেষে পেয়েছিলেন মাসিক মোহাম্মদীর সম্পাদক মহম্মদ ওয়াজেদ আলি, সঙ্গে নজরুলের নামে পাঠানো একটা বিশেষ অনুরোধ: নিমন্ত্রণপত্রটি যেন মোহাম্মদীতে ছাপিয়ে দেওয়া হয়! একই অনুরোধ বাঙ্গালী নামের আর-একটা পত্রিকায়। 'অপূর্ব নিমন্ত্রণপত্র' শিরোনামে তা ছাপাও হল বাঙ্গালীতে। পবিত্র গাঙ্গুলি আর মুজফ্ফর আহ্মদের নামে পাঠানো আমন্ত্রণপত্রদুটো পৌঁছেছিল অনুষ্ঠান শেষ হবার পর! কাজেই, যাওয়া হোক-বা-না-হোক নজরুলের বন্ধুরা বিবাহের খবর পেয়েইছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত বিবাহবাসরে কী হয়েছিল তা জানত না কেউ।
এখন, নজরুলের চিঠিটা পেয়ে হতভম্ব মুজফ্ফর। সে ভাবছিল বিয়ের পর এখন নতুন-বিয়ের মেজাজে আছে কাজি, তাই বন্ধুদের ভুলে আছে আপাতত।
পরের দিনই বত্তিরিশ নম্বরে বসে সব বন্ধুরা, এখন কী করা যাবে?
প্রথম কাজ হল, টাকা পাঠানো। খুব অসুবিধেয় না পড়লে এমন ভাবে টাকা চাইত না কাজি, অথচ বন্ধুদের সকলেরই তো ভাঁড়ে মা ভবানী!
মুজফ্ফর বলল, টাকা সে যোগাড় করে এনেছে। রাইটার্স বিল্ডিঙে কাজ করে তার এক বন্ধু, চিঠি পেয়েই তার কাছে গিয়েছিল মুজফ্ফর, কুড়িটা টাকা যোগাড় হয়েছে। কলেজ স্ট্রীট থেকে বেরিয়ে প্রথম শেয়ালদা স্টেশনে যাবে সে, স্টেশন থেকে টেলিগ্রাম পাঠালে তাড়াতাড়ি পৌঁছোয়, টাকাটা সে 'তার' করে দেবে আজই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কতটা অসুস্থ নজরুল। সে যদি অসুস্থই হয়, তাহলে বন্ধুদের মধ্যে একজনের তো যাওয়া নিশ্চয়ই দরকার, তাকে নিয়ে আসতে হবে কলকাতাতেই, অসুস্থ অবস্থায় কুমিল্লাতে ফেলে রাখাটা ঠিক হবে না।
কিন্তু যাবেন কীভাবে? – বলে আফজালুল হক, শুনেছি তো গোয়ালন্দ-চাঁদপুরে স্টীমারে নাকি ধর্মঘট, আসাম লাইনের ট্রেনও সেই ধর্মঘটের সমর্থনে বন্ধ।
এবার কথা বলে পবিত্র, ঠিকানাটা আর একবার দেখান আহ্মদ ভাই, একটু চেনা-চেনা লাগল। ঠিকানা দেখে সে বলে, বীরেন সেনগুপ্ত নামে একজনকে চিনি আমি, ন্যাশনাল স্কুলে পড়ায়, আগে কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালায় পড়াত, ওরও বাড়ি কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে, আমার কেমন জানি মনে হচ্ছে এই ঠিকানাটা সেই বাড়িরই, বীরেনকে আমি চিঠি লিখছি এখনই, ওদের বাড়িই যদি হয় তাহলে সব খবরই পাওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গেই চিঠি লিখে ডাকে সে চিঠি ফেলে দেয় পবিত্র।
খবর পাওয়া গেল রেলওয়ে এবং স্টীমার-কর্মীদের ধর্মঘটের মধ্যেও সারাদিনে একটি ট্রেন এবং একটি স্টীমার
পুলিশ-প্রহরায় চালানো হচ্ছে। ধর্মঘটের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও সবাই মিলে সেদিন মুজফ্ফরকেই দায়িত্ব দিল কুমিল্লায় যাবার। এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে টাকা। কে দেবে যাওয়া-আসার খরচের টাকা? সংস্কৃত কলেজের সেই অধ্যাপক ফকিরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় দিলেন তিরিশটি টাকা। তাই নিয়েই রওনা দিল মুজফ্ফর। পবিত্রর চিঠির উত্তর এসে গিয়েছিল এর মধ্যে। ওই বীরেন সেনগুপ্তর বাড়িই।
মুজফ্ফর যখন গিয়ে পৌঁছল কান্দিরপাড়ে, ততদিনে নজরুল অনেকটাই সুস্থ। পবিত্রর সঙ্গে চিঠি দেওয়া-নেওয়া হয়েছে, কাজেই কান্দিরপাড়ের সবাই আশাই করছিল নজরুলের বন্ধু কোন একজন আসবেই। মুজফ্ফর আসায় নজরুল খুবই খুশি, খুশি মুজফ্ফরও। শুধুই যে প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল তা-ই তো নয়, কাজি যে এখন অনেকটাই সুস্থ তা-ও বোঝা গেল। এক দঙ্গল যুবক ঘিরে আছে কাজিকে, কথাবার্তায় বোঝা যায় সেদিন সকালেই ওদের প্রভাতফেরী হয়েছে, সেটা নিয়েই জোর আলোচনা চলছে ওদের মধ্যে। যদিও দু-রাত্তির প্রায় না ঘুমিয়েই এসেছে মুজফ্ফর, সে-ও জমে যায় আড্ডায়।
সবায়ের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে রাত্তিরে বসে ওরা তিনজন, মুজফ্ফর কাজি আর বীরেন। এখন কাজি সুস্থ ঠিকই, কিন্তু আলি আকবরের অপমানের ধাক্কাটা সামলানো সহজ ছিল না। আগে বোঝেনি, এখন খানিকটা সুস্থ হয়ে আলি আকবরের ছকটা একটু একটু বুঝতে পারছে সে। বীরেনকে কাজি বলে, বুঝলে বীরেন, এই যে মানুষটাকে দেখছো, মুজফ্ফর আহ্মদ, এ আমার প্রিয়তম বন্ধুই শুধু নয়, আমার বড়দাও।
বড়দা? – বিস্মিত বীরেন, মানে?
যৌথ পরিবার জানো? – বলতে থাকে কাজি, যে যৌথ পরিবারগুলো টিকে আছে এখনো, দেখবে সেগুলোর মাথায় একজন করে বড়দা থাকেন। অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন সবাইকে, আর নিজের জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা দিয়ে মা-পাখির মতো আগলিয়ে রাখেন ছোটদের। যারা তাঁর কথা শোনে না, বিপদে পড়ে তারাই। এই যে আলি আকবর, এর সঙ্গে আমাদের পরিচয় মুজফ্ফরের সূত্রেই। মুজফ্ফর নিজে কিন্তু পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই ঠিক ঠিক চিনেছে আলিকে, বিশ্বাস করেনি এক দিনের জন্যেও। পরিচয়ের সাত-আট বছর পর কলকাতায় হঠাৎ আবার একদিন দেখা আকবরের সঙ্গে মুজফ্ফরের, আর সে দিন আকবর নাকি চিনতেও পারেনি ওকে। অথচ, আয়রনিটা কী জান, মুজফ্ফরের পেছন পেছন এসে, কারো নিমন্ত্রণ বা আবাহন ছাড়াই, আলি ডেরা নিয়ে নিল মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে। সেই সূত্রেই আমার সঙ্গে আলি আকবরের আলাপ। অনেক দিন ধরেই আকবর আমাকে বলছিল ওর সঙ্গে ওর বাড়িতে বেড়াতে আসতে। আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল মুজফ্ফর, কিছুতেই আসতে দেয়নি। আমার অদৃষ্ট, শেষ পর্যন্ত নিজে নিজেই যেখানে এসে পৌঁছলাম – তোমাদের এই বাড়িতে – সেটা প্রায় আলির নিজের পাড়াই। ওর খপ্পরে পড়তেই হল আমাকে; বিধাতাপুরুষ আমার জন্মলগ্নে আমার কপালে অনেক দুঃখর সঙ্গে এই দুঃখটাও লিখে রেখেছিলেন নিশ্চয়ই।
চুপচাপ বসে বসে নিজের প্রশংসা শোনার অভ্যেস নেই মুজফ্ফরের, সে বলল, কিন্তু দুঃখটা কী তা তো বুঝলাম না কাজি, বিয়ে তো কোন দুঃখের ব্যাপার নয়, তা ছাড়া মেয়েটিকে তো তুমি ভালোইবেসেছিলে। পবিত্রকে তুমি নিজে যা লিখেছিলে তাতে তো মনে হয় না তুমি ওকে ভালোবাসনি।
ভালোবাসিনি সে কথা কিন্তু আমি বলিনি মুজফ্ফর ভাই; ভালোবেসেছিলুম, এখনও বোধ হয় বাসি। ভালোবাসাটা খাঁটিই ছিল, আলি আকবর কিন্তু সেটাকে ব্যবহার করল একটা ফাঁদের মতো। কুমিল্লায় এ বাড়িতে প্রথম যখন আলির সঙ্গে দেখা হয় আমার, মনে হল মেঘ চাইবার আগেই জল পেয়ে গেছে ও। কলকাতায় তুমি কিছুতেই যেতে দাওনি আমায় ওর বাড়িতে, আর এখানে যখন এল আলি, দেখল পাঁঠা নিজেই হাঁড়িকাঠে গলা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে!
বীরেন কোন কথা বলেনি এতক্ষণ, এবার সে বলে, আমার মনে হয় কাজি ঠিকই বলছে। পূর্ব-পরিচিত একজনের সঙ্গে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত দেখা, তার ফলে উচ্ছ্বাস, তাকে আট-দশ মাইল দূরে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবার চেষ্টা, এগুলো অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু কাজিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্যে যতটা লেগে থাকছিল আলি, সেটা
এ-বাড়ির সকলেরই, এমনকি মায়েরও চোখে পড়েছিল খুব। একদিন তো আমি নিজে থেকেই বললুম, ঠিক আছে কাজি, ও এত করে বলছে, চল না আমরা দুজনেই যাই, কয়েকদিন থেকে আসি ওর বাড়িতে। তখন কিন্তু ওর হাবভাবে স্পষ্টই বোঝা গেল, ও আমাকে চায় না; কাজিকে, শুধু কাজিকেই চায়।
কারণ আছে, বলে কাজি। আলি আকবর যথেষ্ট ধুরন্ধর লোক, আমার আর্থিক সংগতি কেমন তা ওর ভালো মতোই জানা। আর আমার পকেটে রেস্ত থাকলে সেটা ওর মতো চালাক লোকের বুঝতে সময় লাগবার কথা নয়। ও আমাকে দেখেই বুঝেছিল পয়সা-কড়ি বিশেষ নেই আমার। সেই অবস্থায় আমাকে যদি দৌলতপুরে নিয়ে গিয়ে একা ফেলতে পারে একবার, তাহলে আমি পুরোপুরি ওর কব্জায়। এই অবধি বলে মুজফ্ফরকে জিজ্ঞেস করে কাজি, আচ্ছা মুজফ্ফর ভাই, সেই যে আমি শৈলজার দেওয়া ফেয়ারওয়েলের পর কলকাতা ছাড়লুম, তারপর তোমার সঙ্গে এই এখানে আমার প্রথম দেখা, তাই তো? আচ্ছা, এর মধ্যে তুমি ক'খানা চিঠি পেয়েছ আমার?
তোমার চিঠি? এই জুনের শেষের দিকে পেলাম তো। সেটাই। এ ছাড়া আর তো কোন চিঠি পাইনি । সেটা পেয়েই তো এলাম এখানে। তবে হ্যাঁ, তোমার বিয়ের খবরটা পেয়েছিলাম ওয়াজেদ মিয়ার কাছে, সে নেমন্তন্নের একটা কার্ড পেয়েছিল, আর তার সঙ্গে মোহাম্মদীতে সেটা ছাপিয়ে দেবার অনুরোধ। পবিত্রর আর আমার কার্ডটা বিয়ের দু'দিন পর পৌঁছেছিল, কাজেই আমাদের আর আসা হয়নি।
আমি যে খুব ঘনঘন চিঠি লিখছিলুম তোমাদের তা নয়, বলে কাজি। দৌলতপুরে যেতে যেতে পকেট একেবারে শূন্য, তা ছাড়া, আলি আকবরের ব্যবহারটাও খুব সুবিধের লাগছিল না আমার। কিছু একটা লুকোচ্ছে, কিছু একটা বলি-বলি করেও বলছে না আমাকে, এরকম একটা ভাব। ভাবলুম তোমাকে আর পবিত্রকে জানাই। ব্যাগ খুলে দেখি পড়ে আছে শুধু ডাকটিকিট লাগান তিনখানা খাম। তারই দুটোয় তোমাকে আর পবিত্রকে দু'খানা চিঠি লিখে আকবরকে দিলুম পাঠিয়ে দেবার জন্যে। তোমাদের কাছ থেকে কোন জবাব পাইনি। সন্দেহ হচ্ছিল চিঠি দুটো সত্যিই ডাকবাক্সে ফেলা হয়েছে কিনা। আজ তো তুমিই বললে সে চিঠি তোমরা পাওনি। তিন নন্বর খামটায় পরে পবিত্রকে চিঠি দিয়েছিলুম নার্গিসের কথা জানিয়ে। পোস্ট-অফিস পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে সেটা আমি নিজেই ডাকে দিয়েছিলুম, সে চিঠি কিন্তু পেয়েছে পবিত্র, উত্তরও দিয়েছিল তার।
নার্গিসের সঙ্গে বিয়ের কথা হয়ে যাবার পরেই আলি বদলে গেল একেবারে, বলতে থাকে নজরুল। আমার তো কোন কাজ নেই, পকেটেও নেই পয়সা। যে সব বাচ্চাগুলো বিকেল হলেই চলে আসত তাদের ভাইজানের কাছে – ওদের বাড়ির বাচ্চারা ছাড়াও গ্রামের অন্য ছেলেমেয়েরাও আসত রোজই, সবারই আমি ভাইজান – তাদেরও আসাযাওয়া বন্ধ হয়ে গেল একেবারে। নার্গিস যেন লুকিয়ে আছে কোথাও, তাকে দেখতেই পাই না অথচ শুনি মামাবাড়িতেই আছে সে। আর আলি? কখনো একটা চিঠি দেখাতে আসে, কখনো আমার আব্বা-আম্মার খোঁজ নেয়, তারপরেই উধাও। বুবু এখতারউন্নেসা আমার মায়ের মতো, তাঁর কাছে শুনি, মামা-ভাগ্নী সারাদিন নাকি পড়াশোনা করছে। সুযোগ পেয়ে একদিন জিজ্ঞেস করি আকবরকে, কী এত পড়াশোনা? বলে, শেক্সপীয়র পড়াছে ভাগ্নীকে আর জেন অস্টেন! তার সঙ্গে শরৎ-বঙ্কিম! ভাবো!
বটে!– বলে মুজফ্ফর, তারপর হেসে বলে, আর পড়ালেই বা আপত্তি কী! কবির বিবিকে কবির যোগ্য করে তুলতে হবে না!
ঠিকই তো!– মশকরায় যোগ দেয় বীরেনও।
নজরুল বলে, শুনে আমিও খুব একটা সীরিয়াসলি নিইনি ব্যাপারটা, মজাই পেয়েছিলুম। পরে বুঝলুম, যতটা সরল মনে হচ্ছে, ঘটনাটা ঠিক ততটা সরল নয়। ওদের বাড়িতে আলি আকবরের আলাদা একটা জায়গা আছে, গ্র্যাজুয়েট বলে কথা! কিন্তু তা সত্ত্বেও বিয়ের কথাটা পাকা করবার আগে ও নিজেই আমাকে বলেছিল, নার্গিসের অভিভাবকদের মধ্যে ও একজন, একজনই মাত্র, একমাত্র নয়। সত্যি সত্যিই ভেবে দেখ মুজফ্ফর ভাই, আমার মতো ছন্নছাড়া বিত্তহীন আশ্রয়হীন একটা ছেলে কি সত্যিই বিয়ের জন্যে ভাল পাত্র? যদি মেনেও নেওয়া যায় যে কবি হিসেবে আমার খানিকটা দাম আছে, তা হলেও বউকে ভাতকাপড় মাথার উপর একটা ছাদ দেবার যোগ্যতা যে আছে তার প্রমাণ কী? কিন্তু বিয়েটা তো আসল কথা নয়, আমাকে আলির প্রয়োজন ছিল তার নিজের জন্যে। তোমার মনে আছে লিচুচোর নামে ছোটদের জন্যে একটা কবিতা সাহিত্য সমিতিতে ওর ঘরে বসেই আমি লিখে দিয়েছিলাম? সেই কবিতাটাই কাল হল। এই কান্দিরপাড় থেকে ওর বাড়িতে যেতে যেতেই ও আমাকে প্রস্তাব দিল ওর ব্যবসায় ওর সঙ্গে যোগ দিতে। ও বলেছিল, শিশু সাহিত্যের প্রকাশনা ওর ব্যবসা, আর সে ব্যবসায় আমি যোগ দিলে বাংলা শিশুসাহিত্যকে কোথায় নিয়ে যাওয়া যায় ও দেখিয়ে দেবে সবাইকে। আর আমাকে টাকাপয়সাও দিতে হবে না, কিছুই করতে হবে না। শুধু লেখাটাই হবে ওই ব্যবসায় আমার প্রধান মূলধন!
মুজফ্ফর বলে, তোমার মনে আছে কাজি, যখন ও তোমাকে বারবার ওর বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে আসতে চাইছিল, আমি তখন বলেছিলাম তোমায়, আমার পরামর্শ যদি শুনতে চাও তাহলে তুমি কিছুতেই আলি আকবরের সঙ্গে তার বাড়িতে যাবে না? আমার কেমন জানি মনে হয়েছিল নিয়ে গেলে ও তোমাকে একটা বিপদে ফেলতেও পারে।
সেইজন্যেই তো তোমাকে বড়দা বললুম মুজফ্ফর ভাই। এই কান্দিরপাড়ে তুমি তো ছিলে না, আমি অভিবাবকহীন হয়ে পড়লুম। যাই হোক, বলতে থাকে নজরুল, আমি যেটা বুঝলুম তা হচ্ছে এই, যে কবি যতই হই, আকবরের দাদাদের মধ্যে কেউ কেউ জামাই হিসেবে চালচুলোহীন আমাকে পছন্দ করছে না। না করবারই যে কথা তা তো অস্বীকার করা যায় না। আলি তাই নার্গিসের মাকে বোঝাল, যে করেই হোক আমাকে ও ঘরজামাই রাখবার ব্যবস্থা করছে। ভেবে দেখ, বিধবা রমণী, জাহাজে-চাকরি-করা ছেলে বাইরে বাইরেই থাকে। সে ক্ষেত্রে একমাত্র মেয়ের যদি এমন কারো সঙ্গে বিয়ে হয় যে দেখতে-শুনতে মন্দ নয়, মেয়েরও পছন্দ তাকে, আবার ভায়ের ব্যবসার অংশীদার হয়ে ঘর-জামাই হয়ে শাশুড়ি-মেয়ের সঙ্গেই থাকবে, তবে মন্দ কী! তার ওপর সে আবার কবিও বটে! আর মেয়ের নিজের কথা ভাব। তার নিজের পছন্দের বরের জন্যে তাকে তৈরি করতে যে মামা এত পরিশ্রম করে এত সব ভারী ভারী বই পড়াচ্ছে তাকে, সেই মামার কথা তো শুনতে হবেই! ফলে কী হল? যে ভাইরা এই বিয়েতে রাজি হচ্ছিল না,
মা-মেয়েকে দলে পেয়ে বিদ্বান ছোট ভাই একেবারে চুপ করিয়ে দিল তাদের!
মুজফ্ফর বলে, প্লটটা তুমি ঠিকই বুঝেছ মনে হচ্ছে, কিন্তু একটা কথা। নার্গিসকে তুমি ভালবেসেছিলে, এই মাত্র বললে এখনও ভালবাসো তুমি তাকে, সে কী অপরাধ করল যে এত বড় শাস্তিটা পেতে হল তাকে?
নজরুল চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা, বলে, আলি যখন বিয়ের প্রস্তাব দেয় আমাকে, আমি তখন জিজ্ঞেস করেছিলুম, আপনি কি আপনার ভাগ্নীর মতামত নিয়েছেন? সে কি চায় আমাকে? যে উত্তর আমি পেয়েছিলুম তা হল, আপনি চাইলে ও এক কাপড়ে আজ রাতেই বেরিয়ে যাবে আপনার সঙ্গে। বিয়ের দিন রাত্তিরে যখন বুঝতে পারলুম ওদের ওই আকদের শর্ত কিছুতেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে, তখন বাসরে আমি নার্গিসকে প্রস্তাব দিয়েছিলুম – মনে রেখো মুজফ্ফর ভাই, আকদে আমি সই করিনি, কিন্তু ইজাব কবুল তো হয়েছিল – আমি প্রস্তাব দিয়েছিলুম, আমার হাত ধর, আমরা বেরিয়ে যাই। গলাটা ধরে আসে কাজির। কিছুক্ষণ নিঃশব্দ বসে থাকে সে। তারপর বলে, ও রাজি হয়নি।
পরের দিনই কলকাতায় ফিরে যাবার ইচ্ছে ছিল মুজফ্ফরের কিন্তু বাদ সাধলেন বিরজাসুন্দরী। কাজিকে বললেন, কুমিল্লার রথযাত্রা বিখ্যাত, কালই রথযাত্রা, না দেখেই চলে যাবি?
তার পরের দিন, অর্থাৎ ৮ই জুলাই সকালে নজরুল আর মুজফ্ফর রওনা দিল কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন থেকে। অনুশীলন দলের নেতা অতীন্দ্র রায়চৌধুরি আর খিলাফত আন্দোলনের নেতা আফতাবুল ইসলাম মিছিল করে প্রায় শহর-ভাঙা মানুষজনকে নিয়ে স্টেশনে এসে ট্রেনে তুলে দিলেন ওদের।
কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর। সেখান থেকে গোয়ালন্দ। তারপর শিয়ালদার ট্রেন। ট্রেনে একটু গুছিয়ে বসার পর ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে মুজফ্ফর। কুমিল্লায় তোমাকে বলিনি কিছু, বলে সে, এই চিঠিটা বেশ কয়েকদিন আগে সাহিত্য সমিতির অফিসে এসেছে। নাও, পড়ে দেখ।
খামের মুখটা ছেঁড়ে কাজি। ডুবে যায় চিঠিটার মধ্যে। মুজফ্ফর তাকিয়ে থাকে কাজির মুখের দিকে, আর তীব্র কৌতূহলে দেখতে থাকে নজরুলের মুখে অহরহ বদলাতে থাকা নানা প্রতিক্রিয়ার ছাপ।
পতিসর, ২৫শে মে, ১৯২১
প্রিয় কাজিদা,
তোমার ঠিকানা জানি না, অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করেছি বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রীটের ঠিকানাতেই এই চিঠিটা পাঠাব। যেখানেই তু্মি থাক না কেন চিঠিটা তাহলে তুমি পাবেই। কয়েকদিন আগে অথবা পরে।
সেদিন সেই যে তুমি আর শহীদুল্লাহ্ সাহেব চলে গেলে, তার তিন দিন পর কালীমোহনবাবু স্যর ফিরে আসার আগে পর্যন্ত পুরো সময়টাই স্যরের (অতুল সেন) সঙ্গে কাটিয়েছি। উনিশশো পাঁচের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়, যখন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, ঠিক একই সময়ে, তিনি আরও একটা কাজ করছিলেন, এই খবরটা দিলেন স্যর। পতিসরে ওঁদের পারিবারিক জমিদারিতে একটা কৃষি ব্যাঙ্ক খুললেন তিনি। স্যর বললেন, এটাই রবীন্দ্রনাথের তৈরি করা প্রথম কৃষিব্যাঙ্ক নয়। এরও আগে, আঠেরোশো চুরানব্বই সালেই শিলাইদহে সম্ভবত পৃথিবীর সর্বপ্রথম কৃষিব্যাঙ্ক খোলেন গুরুদেব। দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পাবার কয়েকবছরের মধ্যেই গুরুদেব আবিষ্কার করেন গ্রামের মানুষের – অর্থাৎ আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষেরই – একটা প্রধান সমস্যা হল মাথার উপরে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকা সুদসমেত বিরাট একটা ঋণের দুঃসহ চাপ। কৃষিব্যবস্থাটাই এমন যে বাঁচতে হলে চাষার ঋণ না করে উপায় নেই, অর্থাৎ সেই ঋণের চাপ নেওয়াটাই তার অদৃষ্ট। এর সমাধান হল কৃষিব্যাঙ্ক, যেখান থেকে শোধযোগ্য হারে সুদের বিনিময়ে চাষাকে ঋণ দেওয়া যাবে। এই ব্যাঙ্কের জন্যে ব্যক্তিগত অর্থ ছাড়াও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে বহু টাকার ঋণ নেন গুরুদেব, কিন্তু চাষার উপকারটা একেবারে চোখে দেখা গেল। পরে অবিশ্যি নোবেল প্রাইজ পাবার পর কিছু টাকা শান্তিনিকেতনের জলনিকাশি এবং তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে খরচ করে বাকি বিরাশি হাজার টাকার সমস্তটাই পতিসরের কৃষিব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দিলেন গুরুদেব। এই টাকার জন্যে প্রতি বছর আট হাজার টাকা সুদ পেত শান্তিনিকেতন, কাজেই শান্তিনিকেতনেরও খানিকটা উপকার হল, আর স্থানীয় চাষাদের শোধযোগ্য সুদে ঋণ দেওয়াও চলতে লাগল। শুনে আশ্চর্য হবে, সুদখোর মহাজনদের এতটাই ক্ষতি হল এতে যে কিছুদিন পর থেকে এরাও যথাযোগ্য সুদ পাবার আশায় বিনিয়োগ করতে শুরু করল এই কৃষিব্যাঙ্কেই!
তুমি হয়তো ভাবছ এই খবরটা তোমাকে জানাচ্ছি কেন। তুমি খবরের কাগজ চালাও, সাধারণ মানুষের কথা লেখ, আর বিদেশী শাসকের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জানাও। আমি তো জানি, যে কাজ তুমি কর, তাতে তুমি মোটেই সন্তুষ্ট নও। মনেপ্রাণে তুমি সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের দলে, মহাত্মা গান্ধীকে ব্যক্তিগত ভাবে শ্রদ্ধা করলেও সুযোগ পেলেই তুমি বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপে নেমে পড়ায় বিশ্বাসী। ওই কাজটাই তোমার মনের মতো কাজ। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছ কি, যে স্বরাজের জন্যে এত লড়াই এত তর্কাতর্কি সেটা যদি হঠাৎ হাতের মুঠোয় এসেও যায়, তাহলেও স্বরাজটা কার হবে? দেশের শতকরা নব্বই জন মানুষের অশিক্ষা দারিদ্র স্বাস্থ্যহীনতা কূপমণ্ডুকতা স্বার্থপরতা পরশ্রীকাতরতা যতদিন দূর না হচ্ছে ততদিন স্ব-রাজটা আসলে কার বা কাদের রাজ হবে? সেই রাজটা যাদের রাজ, তারা দেশী হল অথবা বিদেশী, তাতে কার কী আসে যায়!
পতিসরে এসে যে আন্দোলনে আমি জড়িয়েছি – ব্রতীবালক আন্দোলন – সেটার উল্লেখ কবি যখন করেছিলেন তুমি তখন ছিলে, মনে আছে? তোমাদের কলকাতায় ফিরে আসার দিন সকালের জলখাবারের আসরে কথাটা উঠেছিল। কবি আমাকে বলেছিলেন, ধর্মীয় ব্রত পালনের মতোই এই ব্রতও ব্রতীর কাছ থেকে প্রধানত কষ্টসহিষ্ণুতাই দাবি করে। এই কষ্টের মধ্যে প্রাপ্তি এক ধরণের আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু ওইটুকু প্রাপ্তিই যে সব, এই কথাটা ব্রতীকে অহরহই মনে রাখতে হয়। আমি বলেছিলুম, আমি মনে রাখব। অতুল সেন স্যরের সঙ্গে পতিসরে এসে বুঝলুম, কষ্টের কথাটা গুরুদেব বাড়িয়েই বলেছিলেন। এখানে এসে দেখলুম গুরুদেবের পরিকল্পনাটা স্বরাজেরই, তবে সেটা পল্লীস্বরাজ। ভাবটা এই, আমাদের পল্লী, আমরাই চালাই। পল্লীর প্রয়োজনে নিজেরা যা সৃষ্টি করি, নিজেরাই বাঁচাই তাকে। যেমন ধর, পানীয় জলের একটা দীঘি চাই। চাই, এই কথাটা পল্লীবাসীদের বুঝতে হবে আগে। বুঝি যদি, সবাই মিলে কোমর-বেঁধে লাগব, নিজেদের পরিশ্রমেই নিজেরাই খুঁড়ে নেব আমাদের দীঘি; জমিদারকে বলব না আপনি খুঁড়িয়ে দিন। পানীয় জলের দীঘি, নিজেদের প্রয়োজনে নিজেদের পরিশ্রমে গড়া, একে কি আমরা নোংরা হতে দিতে পারি? ম্যালেরিয়ার মশার আঁতুড়ঘর বানাতে পারি? আমাদের গড়া নিজেদের দীঘির স্বাস্থ্য আমরা নিজেরা ঠিকই দেখব, আমরাই একে বাঁচিয়ে রাখব।
দীঘিটা তোমাকে একটা উদাহরণ হিসেবে বললুম। এখানে গুরুদেব যে পরিচালন-ব্যবস্থা চালু করেছেন তার পোশাকি নাম হিতৈষী সভা। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলি। ঠাকুরবাড়ির নানা জমিদারি বিভিন্ন পরগণায় বিভক্ত। এই যে আমি এখন পতিসরে এসেছি, এই পতিসর হচ্ছে কালিগ্রাম পরগণার তিনটে বিভাগের মধ্যে একটা বিভাগ। বাকি দুটোর নাম রামতা আর রাতোয়াল। প্রত্যেকটা বিভাগের প্রতিটি গ্রামের মানুষরা তাঁদের নিজেদের গ্রামের একজনকে গ্রামপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত করেন। প্রত্যেক বিভাগের গ্রামপ্রধানদের নিয়ে তৈরি হয় বিভাগীয় হিতৈষী সভা। এই তিন বিভাগের হিতৈষী সভাগুলো পাঁচজনের একটা কেন্দ্রীয় হিতৈষী সভা গঠন করে। এই পাঁচজন হচ্ছে পরগণার পঞ্চ প্রধান। এই কেন্দ্রীয় হিতৈষী সভায় জমিদারের একজন প্রতিনিধিও থাকেন।
এখন এই হিতৈষী সভার কাজকর্মের জন্যে টাকাপয়সা তো চাই। এই টাকাপয়সা সংগ্রহ করাটাও কিন্তু স্বরাজের ভাবনায় সম্পৃক্ত। গ্রামবাসীরা তাদের খাজনা দেবার সময় প্রতি টাকায় তিন পয়সা করে চাঁদা দেয়। এই চাঁদা থেকেই হিতৈষী সভার তহবিল গঠিত হয়। মোট চাঁদা যা ওঠে সেটাকে তিন ভাগ করে প্রতিটি বিভাগের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সমস্ত কাজ তত্ত্বাবধান করার জন্যে বিভাগীয় হিতৈষী সভা একজন বেতনভোগী কর্মী নিয়োগ করে। শুনেছি, গত বছর চাঁদা উঠেছিল পাঁচ হাজার টাকা, এস্টেট থেকে আরও দুহাজার তার সঙ্গে যোগ করা হয়।
যতটুকু বললুম এর পর আরও ডিটেল-এ গেলে চিঠিটা বড় হয়ে যাবে। তা ছাড়া চিঠির শেষে তোমাকে এমন একটা খবর দেব যাতে চমকে উঠবে তুমি। কাজেই আপাতত শুধু আমি এখানে কী করছি সেটুকু তোমাকে জানিয়ে রাখি।
স্যরের উপদেশ মতো আমি এখন ব্রতীবালকদের কাজ লক্ষ্য করছি, যতটা পারছি সাহায্যও করছি ওদের। যে সব গ্রামগুলোকে নিয়ে হিতৈষী সভা, তার প্রতিটি গ্রামে স্কুলে পড়ছে, এবং অন্তত-মিড্ল্-স্কুলের চেয়ে নীচে নয়, এমন কিছু বালককে নিয়ে ব্রতীবালক সংগঠন। বুঝতেই পারছ, এমন ছেলে বেশি পাওয়া যায় না, কিন্তু যত জন পাওয়া যায় তাদের প্রত্যেককে পাঁচটি করে পরিবারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এদের কাজ হচ্ছে প্রতিটি বাড়ির আবালবৃদ্ধবনিতাকে পড়তে শেখানো। ছোটদের অক্ষরপরিচয় হলেই তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ওই গ্রামেরই কোন নিম্ন-প্রাথমিক ইশকুলে (শুনে তুমি অবাক হবে, এরই মধ্যে কালিগ্রাম হিতৈষী সভার অধীনে প্রায় দু'শো নিম্ন-প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন হয়ে গেছে)। এ ছাড়াও গৃহস্থদের জনস্বাস্থ্য সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা এবং উপদেশ দেয় ব্রতীবালকরা। এর মধ্যে প্রধান কাজ হল বাড়ির ভেতরে এবং বাইরে পরিষ্কার রাখা। বড়রা যদি ছোটদের কথা না শোনে তাহলে দা কোদাল কুড়ুল নিয়ে ব্রতীবালকরা নিজেরাই বাড়ির ভেতর আর বাইরের জঙ্গল আগাছা পরিষ্কার করে সেখানে লঙ্কা বেগুন ইত্যাদি লাগিয়ে দেয়। দেখেশুনে বড়রাও কাজে উৎসাহ পায়। স্বাস্থ্যবিষয়ে এ ছাড়াও আর একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে ব্রতীবালকরা। নিজের নিজের দায়িত্বের বাড়িতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঝাড়-ফুঁক ইত্যাদির কবলে না পড়তে দিয়ে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া। কবি নিজে অবিশ্যি খুবই কম আসতে পারেন পতিসরে, কিন্তু যখনই আসেন, তিনি নিজেই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করেন গ্রামের মানুষদের। এ ছাড়াও পতিসরে ডাক্তার-ওষুধ সমেত একটা মোটামুটি হাসপাতাল এখনই আছে, প্রতিটি বিভাগে ছোটখাটো ডিসপেন্সারিও আছে। কাজেই প্রাথমিক চিকিৎসা এখনই উপলব্ধ। যেভাবে কাজ চলছে, আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে চিকিৎসাব্যবস্থার আরও উন্নতি ঘটানো যাবে।
ব্রতীবালকদের আর একটা কাজ হল নিজেদের উন্নতিসাধন, শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যোন্নতি। ব্রতীরা নিয়মিত ব্যায়াম এবং নানারকমের শরীরচর্চা করে। মাঝে মাঝে ইশকুলের মাষ্টারমশাইদের সঙ্গে তাদের সভা হয়,
জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে চর্চা হয় এই সভায়। একটা ভ্রাম্যমান গ্রন্থাগারেরও পরিকল্পনা আছে, সেটা শুরু হলে শুধু ব্রতীবালক নয়, গ্রামের উৎসাহী মানুষদের সঙ্গে মুদ্রিত গ্রন্থের খানিকটা আত্মীয়তাও হয়তো গড়ে উঠবে ভবিষ্যতে। বুঝতেই পারছ, এই সব নিয়ে আমি ভালোই আছি। স্যরের মতে, আমারও শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যোন্নতি এখনই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
যে চমকটার কথা তোমাকে আগেই বলেছিলুম, সেটা এখন খোলসা করি। সেই ভীমদার তেলেভাজার দোকানের কথা মনে আছে তোমার? বাঘাযতীনকে নিয়ে অনেক ঘটনার কথা আমাদের গল্প করে শুনিয়েছিল ভীমদা। শেষ গল্পটা গৃহবন্দী অবস্থায় বাঘা যতীনের হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার ঘটনা। সেই যে নিরুদ্দেশ, তারপর আর ভীমদার সঙ্গে কোন যোগাযোগ হয়নি বাঘা যতীনের। পরে তাঁর সম্বন্ধে শেষ খবর পাওয়া গেছে উনিশশো পনেরয়, বুড়ি বালামের লড়াইয়ের পর। এই যে তিন-চার বছরের ফাঁকটুকু, এটা সেদিন অনেকটাই ভরাট করে দিলেন স্যর, অতুল সেন স্যর।
তোমার মনে আছে শান্তিনিকেতনে প্রথম যখন আমরা স্যরকে দেখি, রবীন্দ্রনাথ তখন স্যরকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ইনি অতুল সেন? বলেছিলেন, অতুলবাবু হাওড়ায় বাগনানের স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন? গুরুদেব তোমাকেই বিশেষ করে বলেছিলেন, হাওড়ার সেই বাগনান, যেখানে তোর বাঘা যতীন শিক্ষকতা করছিল, পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল একবার সেখান থেকে, আর ফেরেনি। বাঘা যতীনের পুরো ঘটনাটা সেদিন স্যর বললেন।
বাগনানের রথতলা ময়দানে ছিল বাগনান হাই স্কুল। ট্রেনে না উঠে বড় রাস্তা ধরে যদি হাওড়া থেকে উড়িষ্যার দিকে যেতে চাও, স্কুলটা একেবারে সেই রাস্তার উপর। বাগনান ছাড়িয়ে খানিকটা গেলেই হাওড়া জেলার শেষ, তারপর রূপনারায়ণ পেরিয়ে মেদনীপুরের শুরু। মেদনীপুর পেরোলেই আরম্ভ হয় উড়িষ্যা, বুড়ি বালাম সেখান থেকে বেশি দূর নয়। সম্ভবত বালেশ্বর-বুড়ি বালামের সঙ্গে সহজ যোগাযোগের কথা মনে রেখেই বাঘা যতীন ডেরা নিয়েছিলেন এই বাগনানে। বাগনান হাই স্কুলে তিনি শিক্ষকতার কাজ নিলেন। আসন্ন লড়াইয়ের জন্যে তখন অস্ত্র সংগ্রহ করছেন বাঘা যতীন, রিভলভার-টিভলভারগুলো জমা করছেন স্কুলেই। হেডমাস্টার এবং বাঘাযতীনের সহকর্মী অনেক শিক্ষকই ব্যাপারটা জানেন। যেহেতু তাঁরা প্রত্যেকেই বাঘা যতীনের লড়াইয়ের সমর্থক, অতএব সবটাই গোপন রাখা যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন পুলিশ খবর পেয়ে হাজির, তারা তল্লাশি করবে। বাঘা যতীন আগেই খবর পেয়ে গেলেন, স্কুলে সেদিন এলেন না তিনি। কিন্তু তল্লাশি তো হবে।
হেডমাস্টার বললেন, তল্লাশি করুন, আপনাদের কাজ আপনারা নিশ্চয়ই করবেন, তবে আমাকে আমার কাজ করতে দিন। স্কুলে প্রশস্ত ভালো বাগান ছিল। মালিদের বললেন, সাহেবদের বসাও বাগানে। ওঁরা অতিথি, আগে অতিথি সৎকার, তার পর অন্য কাজ। চেয়ার-টেয়ার টেনে বসানো হল পুলিশের লোকদের, হেডমাস্টার মশাই নিজেও বসলেন, দু'জন গেল বাম্পার নামে খ্যাত বাগনানের বিখ্যাত রাজভোগ আনতে। স্কুলের ঠিক পাশেই দুলেপাড়া, সেখানে থাকত বাগানের এক মালি, সে এসে হাত জোড় করে বলল, এই গরমে এঁরা এসেছেন, এঁদের জন্যে একটু ঠাণ্ডা জল নিয়ে আসি?
অনুমতি নিয়ে বিরাট একটা জালা মাথায় করে বেরিয়ে গেল মালি, ফিরে এল ঠাণ্ডা জল নিয়ে। পরিতৃপ্তির জল-মিষ্টি খেয়ে পুলিশ ঢুকল স্কুলবাড়ির ভেতর, তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছুই পাওয়া গেল না!
বুঝতেই পারছ ওই জালাতেই রিভলভারগুলো নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল মালি!
ভীমদা আমাদের বলেছিল, ওই ভীমদার তেলেভাজা দোকানের বাড়িতে বাঘা যতীনের খোঁজে দ্বিতীয়বার পুলিশ ফিরে আসবার আগেই ভীমদার স্ত্রী কমলা একটা হাঁড়িতে করে বোমা তৈরির সরঞ্জাম নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল স্নান করবার নামে। কমলাকে বাঘা যতীন মা লক্ষ্মী বলে ডাকতেন। মেয়ের মতো ভালোবাসতেন তাকে। দুজনের মধ্যে কি টেলিপ্যাথির যোগ ছিল? শেষ করছি।
তোমার স্নেহের
পিংলা
চিঠি পড়া শেষ হলে মুজফ্ফরের দিকে তাকায় নজরুল, তার চোখ-ভরা জল। বলে, শহীদুল্লাহ্ সাহেবের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে যখন গিয়েছিলুম, থেকে যেতে বলেছিলেন গুরুদেব। বলেছিলেন, আমার জন্যে কাজ ভাবা আছে তাঁর। তখন কথা শুনিনি। এখন মনে হচ্ছে থেকে গেলেই বোধ হয় ভালো হত।