মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে কাজির শেষ দেখা হয়েছিল তিন বছরেরও আগে, কাজির যেদিন এক বছরের সাজা ঘোষণা হয়, উনিশশো তেইশের ষোলই জানুয়ারি। সশ্রম কারাদণ্ড। চীফ প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর কোর্টের লক-আপে কাজির সঙ্গে দেখা করল মুজফ্ফর। সাজা ঘোষণার পরে-পরেই কাজিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল সার্কুলার রোডের প্রেসিডেন্সী জেলে। সেখান থেকে আলিপুর। সেই বছরেরই সতেরই মে ধরা পড়ে মুজফ্ফর নিজে, হুগলি জেলে তখন নজরুলদের অনশন চলছে। কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দী ছিল মুজফ্ফর, মারাত্মক যক্ষারোগগ্রস্ত মুজফ্ফরকে আড়াই বছর বন্দীদশার পর মাসদুয়েক আগে আলমোড়ায় মুক্তি দেওয়া হয়, এ-বছর জানুয়ারির দু' তারিখে সে ফিরেছে কলকাতায়। কাজি তখন হুগলি থেকে কৃষ্ণনগরে যাবার জন্যে বাঁধছে তার বাক্স-প্যাটরা। হেমন্ত সরকার বললেন, ফেব্রুয়ারির ছয় আর সাত তারিখে নিখিলবঙ্গীয় প্রজা সম্মেলন কৃষ্ণনগরে। তখন কৃষ্ণনগরে বন্ধুকে দেখতে আসুন, তার আগে আসবেন না।
ভোরবেলা শেয়ালদা থেকে ট্রেনে উঠেছে মুজফ্ফর, সঙ্গে আবদুল হালীম, তার দাদা শামসুদ্দীন হুসয়ন, কুত্বুদ্দিন আহ্মদ আর সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কৃষ্ণনগরে ট্রেন দাঁড়াল যখন, কাজি দাঁড়িয়ে, তার পরনে পল্টনের পোশাক। কড়া ইস্তিরি করা এই পোশাক কাজির ভারী পছন্দের। কাজিকে দেখেই তাকে জড়িয়ে ধরে মুজফ্ফর। ওদের দুজনের আবেগ সকলেই বোঝে। কিছুক্ষণ পর সৌম্যেন ঠাকুর এগিয়ে এসে করমর্দন করেন; পূর্বপরিচিত না-হলেও তাঁর চেহারায় ঠাকুরবাড়ির ছাপ কারো দৃষ্টি এড়ায় না। সৌম্যেন বলেন, মুখোমুখি পরিচয় না থাকলেও কাজিকে তিনি ভালোই চেনেন; শামসুদ্দীন সাহেব তো শান্তিনিকেতনের ইশকুলে পড়াতেন আগে, কাজেই তাঁর সঙ্গেও সৌম্যেনের অনেকদিনের বন্ধুত্ব, আর মুজফ্ফর আর হালীমের সঙ্গে তো ট্রেনে অনেক আলাপই হল।
স্টেশনের বাইরে কৃষ্ণনগর শহর যেন সেজে উঠেছে সম্মেলন উপলক্ষে, সারা বাংলা থেকে প্রতিনিধিরা এসেছে, স্বেচ্ছাসেবকরা আগত অতিথিদের সাহায্য করতে সদাপ্রস্তুত, কাজি নজরুল ইসলাম তাদের সর্বাধিনায়ক, ব্যস্ততার তার সীমা নেই। তার উপর উদ্বোধন সঙ্গীতের দায়িত্বও তার।
নজরুল ইসলাম উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইবেন – এই ঘোষণায় উপস্থিত প্রতিনিধিদের মধ্যে গুঞ্জন শোনা যায়। লাঙল পত্রিকার একেবারে প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল নজরুলের এগারোটি কবিতা: সাম্যবাদী, ঈশ্বর, মানুষ, পাপ, চোর-ডাকাত, বারাঙ্গনা, মিথ্যাবাদী, নারী, রাজাপ্রজা, সাম্য ও কুলি-মজুর। এবং সব-ক'টি কবিতা মিলে একটিই প্রধান নাম কবিতার – সাম্যবাদী। পাঠকদের এত প্রিয় হয়েছিল এই কবিতাসমষ্টি যে প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্টল থেকে সমস্ত পত্রিকা বিক্রি হয়ে যায়। ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে শুধু এই একাদশ কবিতার বত্রিশ পৃষ্ঠার একটি সংগ্রহ প্রকাশ করা হয় কয়েকদিনের মধ্যেই। একই সুরে-ছন্দে যদিও, বিষয়বৈচিত্রে সারা বাংলার পাঠকের মন কেড়ে নেয় এই কবিতাবলী। ফলত, নজরুলের নাম ঘোষিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই এবারের এই উদ্বোধনী সঙ্গীতের বিষয় কী হতে পারে, তাই নিয়ে কৌতূহলের অন্ত ছিল না। কৌতূহল নিবারণ করল নজরুল জানুয়ারির লাঙলে প্রকাশিত 'কৃষকের গান' গেয়ে:
ওঠ রে চাষী জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল
আমরা মরতে আছি ভালো করেই মরব এবার চল।।
* * * * * *
আজ জাগ রে কৃষাণ সব তো গেছে কিসের বা আর ভয়,
এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়।
ওই বিশ্বজয়ী দস্যু রাজার হয়-কে করব নয়।
ওরে দেখবে এবার সভ্যজগৎ চাষার কত বল।।
গান শেষ হলে প্রতিনিধিদের অভিনন্দন ও সমবেত হাততালির মধ্যেই এক ফাঁকে মুজফ্ফরকে কাজি বলে গেল, মুজফ্ফর আর হালীম-কুত্বুদ্দিন-শামসুদ্দীন সাহেব এই দু'দিনের জন্যে তার বাড়িতেই অতিথি।
এবারের সম্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য হল, জাতীয় কংগ্রেসের অন্তর্গত লেবার স্বরাজ পার্টিকে কংগ্রেসের বাইরে বঙ্গীয় শ্রমিক ও কৃষক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, শ্রমিক ও কৃষকদের নিজস্ব একটা দল চাই। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পর থেকেই কাজি নজরুল ইসলামের বিতর্কিত লড়াকু এক বিদ্রোহী সত্ত্বা বাংলাভাষী মানুষের মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর ভাবাদর্শে এবং নেতৃত্বে যে অসহযোগ আন্দোলনে কাজি ঝাঁপিয়ে পড়ে তার সঙ্গে কাজির সেই ভাবমূর্তির আপাতবৈপরীত্য অনেকের সঙ্গে তখন কাজির নিজের কাছেও খানিকটা ধরা পড়ে। ধূমকেতুর সারথিত্ব কাজির সেই অসহযোগ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ের চিন্তাভাবনারই খানিকটা প্রকাশ। বিয়ের পর হুগলিতে সংসারযাপনের সময় থেকেই রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে আরও অনেক বেশি অংশগ্রহণ, এবং হেমন্ত সরকার, কুত্বুদ্দীন আহ্মদ, শামসুদ্দীন হুসায়ন, আবদুল হালীম ইত্যাদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর যোগাযোগ ও সময়যাপনের সঙ্গে সঙ্গেই খেটে-খাওয়া মজুর কৃষক এবং সমাজের নিম্নস্তরের শোষিত মানুষের সংগ্রামের গুরুত্ব কাজির মনে প্রকটতর হতে শুরু করে। শ্রমিক-কৃষকদের নিজস্ব একটা সংগঠনের কথা সেই সময়ের আলোচনা-বিতর্কের মধ্যেই বারবার উঠে আসে, এবং উঠে আসে লাঙল পত্রিকা প্রকাশের কথা। কাজি যে এই পত্রিকার স্থপতি ও প্রধান পরিচালকের দায়িত্ব নিল, এতে অবাক হবার কিছু ছিল না। এবং শ্রমিক-কৃষকের লড়াই-সম্পর্কিত গভীরতর চিন্তা থেকেই এমনকি জাতীয় কংগ্রেস-অন্তর্গত শ্রমিক-প্রজা স্বরাজ দলেরও ইস্তাহার ও নিয়মাবলী কাজিই রচনা করল। কৃষ্ণনগরের এই সম্মেলনে আর-এক ধাপ এগিয়ে এই সংগঠনকে কংগ্রেস-নির্ভরতা থেকে মুক্ত করার প্রয়াস ছিল, আর খানিকটা ছিল নবনির্মিত এই দলের পতাকায় শ্রমিক শ্রেণীর গুরুত্বের প্রকাশ; কৃষক-শ্রমিক নয়, শ্রমিক-কৃষক দল নামকরণ। কিন্তু সম্মেলনে শ্রমিকদের তুলনায় কৃষক প্রতিনিধি অনেক বেশি থাকায় বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল নামই পছন্দ হল সংখ্যাগুরু প্রতিনিধিদের, ইংরিজিতে অবিশ্যি The Workers' and Peasants' Party of Bengal অনুমোদিত হল।
প্রতিনিধিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা ভালোই ছিল; প্রথম দিনের সম্মেলনের শেষে মুজফ্ফর আর আবদুল হালীম কাজির সঙ্গে গেল তার গোলাপটির বাড়িতে। যাবার পথেই মুজফ্ফর কাজিকে বুঝিয়ে দিয়েছে, এই কনফারেন্সের সময় ওর বাড়িতে তাদের অতিথি হওয়া ভালো দেখায় না, পরে একবার এসে ওরা কয়েকদিন কাটিয়ে যাবে সেখানে। আজকের যাওয়া শুধু দুলি আর মাসিমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। দুলিকে জিজ্ঞেস করে মুজফ্ফর, চিনতে পারছ? হ্যাঁ, বলে দুলি, আপনি তো কান্দিরপাড়ে এসেছিলেন; রথের দিন ঘোড়ার গাড়িতে আমরা তিন বোন – জটু কমলা আর আমি, আর তাছাড়াও রাখাল, আপনাদের সঙ্গে রথের মেলা দেখতে গিয়েছিলাম। রাঙাদাও ছিল। এই কথা বলেই নীচু হয়ে মুজফ্ফরের পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় দেয় দুলি, বলে, আপনাকেই খুঁজছিলাম দাদা, আজ থেকে দাদা বলেই ডাকব আপনাকে, শুধুই দাদা।
দাদা? - খুশি ঝরে পড়ে মুজফ্ফরের গলা দিয়ে; বাড়ির আমি ছোট ছেলে, বলে মুজফ্ফর, আমাকে দাদা বলে ডাকবার কেউ ছিল না এতদিন। ভালোই হল, বোন পেয়ে গেলুম একটা।
মাসিমা বললেন, তিনিও দিব্যি চিনেছেন মুজফ্ফরকে। অসুস্থ নুরুকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সে অনেক কষ্ট করে, তখন রেলে ধর্মঘট চলছিল, সে কথা কি ভোলা যায়?
দু'দিনের সম্মেলন ভালো মতই কেটে গেল, কৃষ্ণনগরে আসবার পর থেকে এতদিন পর্যন্ত কাজি কৃষ্ণনগরের বাইরে কোথাও যায়নি; প্রমোদ আর তারকের ব্যবস্থাপনায় সংসারে একটা স্থিতির অবস্থা এসেছে, প্রতিদিনের বাজার ঠিক সময়ে এসে যায়, ডাক্তারবাবুর চিকিৎসায় অতি দ্রুত সেরে উঠছে কাজি, পাড়ার ছেলেদের আসাযাওয়ায় বাড়ি গমগম করছে সব সময়, কাজির পুরোনো দিনের মতো হাঁকডাক আর হৈ হৈ এখন শুধু শান্তির নয়, মজারও আবহ এনেছে বাড়িতে। বিয়ের পর এত সুখ দুলি আর পায়নি কোনদিন।
এর মধ্যে হেমন্তদা একদিন এলেন এই বাড়িতে। কাজিকে বললেন, ওয়ার্কার্স-পেজান্টস পার্টির কনফারেন্সে আমাদের কৃষ্ণনগরের খুব সুনাম হয়েছে, তোমার নাম তো সবার মুখে মুখে। মে-তে কিন্তু অনেক বড় – প্রভিনশিয়াল – কনফারেন্স কংগ্রেসের। তার সঙ্গে আরও দুটো ছোট কনফারেন্স আছে একই সময়, ছাত্র সম্মেলন আর যুব সম্মেলন। খুব বড় বড় অল-ইণ্ডিয়া লীডাররাও হয়তো আসবেন। পুরো কনফারেন্সের দায়িত্ব তোমার। এরই মধ্যে হয়তো তোমাকে ট্যুরেও যেতে হতে পারে মাঝে মাঝে, ওয়ার্কার্স-পেজান্টস কনফারেন্সের ফলো-আপ মীটিং দুয়েকটা অ্যাটেণ্ড করার জন্যে। আমি তাই বলি, তোমার চেলাদের নিয়ে লেগে যাও এখন থেকেই, তোমার ওই ফৌজি ড্রেসটা এবার সবাই খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করল, ওটাই আর-একটু বড় স্কেলে করা যায় কিনা ভেবে দেখো, ফাণ্ডের অসুবিধে হবে না।
পুরো ফেব্রুয়ারি মাসটাও কৃষ্ণনগরেই থাকল কাজি। প্রমোদ আর তারককে ডেকে বলে সে, জনা পঞ্চাশেক ছেলে চাই, মে-মাসে প্রভিনশিয়াল কনফারেন্স, এবারের ভলান্টিয়ার বাহিনীটা আর-একটু বড় করতে হবে, অনেক আগে থেকেই নানারকমের ড্রিল শিখতে হবে, কতদিনে জোগাড় করতে পারবি ছেলেদের?
ছেলেদের জোগাড় করতে সময় লাগে না বিশেষ। যে মাঠে কাজিকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল সেই মাঠেই পরের দিন বিকেলে জমা হয় ছেলেরা। কয়েক সারিতে তাদের দাঁড় করিয়ে ড্রিল করায় কাজি; কয়েকদিনের ড্রিলের পরেই অনেকটা শেখে তারা। পাঁচটা ছোট ছোট দলে ভাগ করা হয় তাদের, প্রতি দলে বড়দের একজন নেতা, যেমন তারক প্রমোদ গোবিন্দ শিবেন ইত্যাদি। এই নেতাদের বলা হবে গ্রূপ কম্যাণ্ডার।
হেমন্তদা বলেছিলেন ফাণ্ডের অসুবিধে হবে না। কাজি তার ভলান্টিয়ারদের জন্যে য়্যুনিফর্ম তৈরি করাতে চায়, হেমন্তদার বাড়িতে গিয়ে আলোচনা করে, তিন-চারদিন পরেই একজন দর্জি আর জুতোর মাপ নেবার একজনকে পাঠিয়ে দেন হেমন্তদা প্যারেডের মাঠে। সবায়ের মাপ নেওয়া হয়, ছোটদের শর্টস আর শার্ট, পায়ের জন্যে কেড্স্, গ্রূপ কম্যাণ্ডারদের ট্রাউজার্স্ শার্ট আর কেড্স্। তাদের হুইস্ল্ও দেওয়া হবে একটা করে।
ডক্টর দে বলেছিলেন, শরীর যতটা পারমিট করবে ততটা কাজ স্বচ্ছন্দে করতে পারবেন। শরীর কতটা পারমিট করবে তা কি বোঝা যায়? সকাল থেকে সারা দিন অবিশ্রাম কাজ করছে কাজি – এইসব ছোট ছোট ছেলেদের তৈরি করা কি সহজ কাজ? – আর চলছে দেদার চা আর পান! সংসারের কাজের মধ্যে একটু অবসর পেলেই পান সাজতে বসে দুলি। মাঝে মাঝে কাজির ওপর রাগ করে সে এত পরিশ্রমের জন্যে, কিন্তু সত্যি কথা এই যে, মনে মনে সে ভারী খুশি। এই কৃষ্ণনগরে এসে তার সংসারের ধারা বদলিয়েছে অনেকটা, একটা ছন্দে চলছে সংসার, সব মেয়েই মনে মনে যা চায় এতদিনে পেয়েছে সে।
মার্চের এগারো তারিখে ফরিদপুর মাদারিপুরে বাংলা আর আসামের যুক্ত প্রাদেশিক মৎস্যজীবী সম্মেলনের শুরু, দু'দিনের এই বৃত্তিজীবী সম্মেলন বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলেরই সাংগঠনিক কাজ। হেমন্ত সরকার যাবেন, কাজির কাছে বিশেষ করে অনুরোধ এসেছে সম্মেলনে উদ্বোধন সঙ্গীত গাইবার। এবারের নিখিলবঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক সম্মেলনে শুধুমাত্র কৃষকদের কেন্দ্র করে যে উদ্বোধন সঙ্গীত শুনিয়েছিল কাজি, তা শ্রোতাদের মনে নতুন আবেগের সৃষ্টি করেছিল, মাদারিপুরের সংগঠকরা তাই বিশেষ করে উদ্বোধন সঙ্গীতের জন্যেই অনুরোধ করেছে। আমন্ত্রণপত্রটা কাজি দেখায় দুলিকে; দুলি বলে, যেতে তো হবেই, তোমার কাজ তুমি করবে না তো কে করবে!
গ্রূপ কম্যাণ্ডারদের যত্ন করে শেখাতে থাকে কাজি, সে থাকবে না যে ক'দিন তখন যেন ভলান্টিয়রদের প্রশিক্ষণে কোন ভাঁটা না পড়ে। একই সঙ্গে কাজি লিখতে থাকে ধীবরসম্প্রদায়ের কথা মনে রেখে উদ্বোধন সঙ্গীত:
আমরা নীচে পড়ে রইব না আর
শোন রে ও ভাই জেলে
এবার উঠব রে সব ঠেলে।
ওই বিশ্বসভায় উঠল সবাই রে
ওই মুটে-মজুর-জেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে।।
ও ভাই আমরা জলে জাল ফেলে রই
হোথা ডাঙার পরে
আজ জাল ফেলেছে জালিম যত
জমিদারের চরে।
ও ভাই ডাঙার বাঘ ওই মানুষ-দেশে
ছেলেমেয়ে ফেলে এসে রে
আমরা বুকের আগুন নিবাই রে ভাই
নয়ন-সলিল ঢেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে।
গানে সুরসংযোগের কাজ শুরু হয়, আর তারই মধ্যে অনু্রোধ আসে মার্চের ছ' তারিখে দিনাজপুরের ডিস্ট্রিক্ট কনফারেন্সেও অংশ নেবার জন্যে। নিখিলবঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিকদলের কৃষ্ণনগর সম্মেলনের পর এই প্রথম জেলাস্তরীয় সম্মেলনে অংশগ্রহণের আহ্বান নজরুল উপেক্ষা করতে পারে না, অতএব তার সফরসূচি বদলায়, মার্চের পাঁচ তারিখে রওনা দিয়ে ছ' তারিখের দিনাজপুরের সম্মেলনে অংশ নেয় সে, তারপর সেখান থেকে আর কৃষ্ণনগরে না ফিরে সোজা ফরিদপুর।
মাদারিপুরের মৎস্যজীবী সম্মেলন চমক লাগায় কাজির মনে; এত উদ্যম, সম্প্রদায়ের শোষণমুক্তির জন্যে ধীবর সম্প্রদায়ের সর্বাত্মক এই লড়াইয়ের প্রাণখোলা প্রতিজ্ঞা– অনুপ্রাণিত করে কাজিকে। সঙ্ঘশক্তির উজ্জীবক কাজির উদ্বোধন সঙ্গীত মাতিয়ে দেয় সভা, দলে দলে প্রতিনিধিরা আসে কাজির সঙ্গে কথা বলতে, অভিনন্দন জানাতে। আসাম প্রদেশের এবং উত্তর-পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিরা স্বতন্ত্রভাবে দেখা করে কাজির সঙ্গে, বলে, আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন, এখানকার এই সম্মেলনের পর শুরু হবে আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধি সভা। আপনি উপস্থিত থাকলে প্রতিনিধিরা উৎসাহিত হবে।
এইসব অনুরোধ জাদুর কাঠি। কাজি আর স্থির রাখতে পারে না নিজেকে। তার মনে পড়ে না কৃষ্ণনগরে কে তার অপেক্ষায় দিবসযাম! লামডিং গৌহাটি বদরপুর কুলাউড়া চাঁদপুর হয়ে আরও দু' সপ্তাহ পর কাজি ফেরে দুলির কাছে। কোন অভিযোগ করে না দুলি।
বাইশে মে প্রদেশ কংগ্রেসের অধিবেশন, একই সঙ্গে ছাত্র অধিবেশন ও যুব অধিবেশনও। কৃষ্ণনগরে ফিরে কাজির নিশ্বাস নেবার অবকাশ নেই। তার ভলান্টিয়ার বাহিনী তৈরি হচ্ছে, সে নিজে ফিল্ড-মার্শালের পোশাকে নেতৃত্ব দেবে তাদের, প্রস্তুতি চলছে। এরই মধ্যে, কলকাতায় রাজরাজেশ্বরী মন্দিরে কোন ধর্মীয় মিছিলকে উপলক্ষ করে শুরু হয়ে গেল হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। কৃষ্ণনগর পর্যন্ত ছড়ায়নি দাঙ্গা ঠিকই, কিন্তু কলকাতার সঙ্গে কাজির নিত্য-যোগাযোগ, দাঙ্গার খবরে বিপর্যস্ত সে। এবারের সম্মেলন উপলক্ষে সে যে উদ্বোধন সঙ্গীত রচনা করল – পরে সেই সঙ্গীত বিশ্বখ্যাত হয়েছে, সুভাষচন্দ্র সদর্পে বলেছেন, আমরা জেলেই থাকি বা জেলের বাইরে, এই গান আমাদের সব সময় উদ্দীপিত করবে, সব সময় এই গান আমরা গাইব – সেই গান সে লিখল এই সময়। লিখেই তার বন্ধু দিলীপ রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে, একটা গান লিখেছি, স্বরলিপি পাঠাচ্ছি তোমায়। এখনকার এই দাঙ্গার সময়ে, এই গান আমরা দুজনে একসঙ্গে গাইব এবারের প্রদেশ কংগ্রেসের উদ্বোধনে:
দুর্গম গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার।
* * * * *
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ,
কাণ্ডারী আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ!
'হিন্দু না ওরা মুসলিম?' ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানু্ষ, সন্তান মোর মা'র।
দাঙ্গার জের টেনেই হোক বা যা-ই হোক কারণ, এবারে প্রদেশ কংগ্রেসেও হিন্দু-মুসলমান সঙ্ঘর্ষের রেশ; চিত্তরঞ্জন নেই, তাঁর নেতৃত্বে যে হিন্দু-মুসলমান প্যাক্ট হয়েছিল তিন বছর আগে, এবারের প্রদেশ কংগ্রেসে সেই প্যাক্ট বাতিল হয়ে গেছে। নজরুলের যতই ক্ষোভ থাকুক, “সন্তান মোর মা'র” বলার লোকরা হয়ে গেছে সংখ্যালঘু!
সম্মেলন শেষ হতে-না-হতেই কৃষ্ণনগর শহরে পুলিশের তৎপরতা বাড়ল হঠাৎ, প্রমোদ আর তারক সমেত অনেক যুবককে গ্রেপ্তার করল পুলিশ। এদিকে সম্মেলনের কাজের প্রবল চাপ বোধ হয় নিতে পারছিল না কাজির শরীরও; লাঙল পত্রিকার প্রধান পরিচালক সে, মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের নাম যতই থাক সম্পাদক হিসেবে সম্পাদনার মূল দায়িত্ব সামলাতে হয় তাকেই, কৃষ্ণনগরে বাস করে কলকাতার পত্রিকার কাজে যথেষ্ট সময়ও দিতে পারছিল না সে, ফলে লাঙলও বন্ধ হয়ে গেছে। কাজির শরীরের অবস্থা দেখে ডক্টর দে পরামর্শ দিলেন ঘিঞ্জি গোলাপটি ছেড়ে আর একটু খোলামেলা জায়গায় বসবাসের। ঘনিষ্ঠরা হয় গ্রেপ্তার হয়ে বন্দী, অথবা কৃষ্ণনগরের বাইরে। শেষ পর্যন্ত ধর্মে ক্রিশ্চান ডক্টর দে নিজেই তাঁর অপেক্ষাকৃত গরীব রোগীদের সহায়তায় স্টেশন রোডের কাছাকাছি গরীব ক্রিশ্চান আর মুসলমান শ্রমজীবীদের এক মহল্লায় খোলামেলা একটা বাড়ি যোগাড় করে দিলেন। চাঁদ-সড়ক নামে পরিচিত এই মহল্লা; বিরাট খোলা জায়গার মাঝখানে চওড়া বারান্দাওয়ালা আম-কাঁঠালের গাছ-ঘেরা একতলা বাড়িটাকে একটা বাগান-বাড়ির মতো দেখতে। নাম গ্রেস কটেজ, বাড়ির মালিক এক ক্রিশ্চান মহিলা।
এবারের প্রাদেশিক সম্মেলনে কাজি নজরুল ইসলাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভ্যপদে নির্বাচিত হয়েছে। ফলত রাজনৈতিক দায়িত্বও তার বেড়েছে। সারা বাংলায় তাকে এখন দেখা যাবে নানা সভা-সম্মেলনে। এমনিতেই মাথায় খাটো বহরে বড় গড়পরতা বাঙালির তুলনায় তার উজ্জ্বল হলুদ বসনে গাত্রবর্ণের বর্ধিত জৌলুস, আকর্ষক পৌরুষ স্বাস্থ্যের দীপ্তি, তাম্বুলরসে রঞ্জিত ওষ্ঠাধর, ঈষৎ-ভাঙা কিন্তু দরাজ গলার গান, হো হো অট্টহাসি এবং বাচনভঙ্গীর নাটকীয়তা নারী-তরুণ-যুবক নির্বিশেষে সকলের চোখের সামনে এমন মায়াজাল সৃষ্টি করে যে তার উপস্থিতির সম্ভাবনার সংবাদ পেলেই তাকে শুধুমাত্র দেখার জন্যেই প্রতিটি সমাবেশে জনসমাগম বেড়ে যায়। সে যখন কথা বলে, উল্লাসে ফেটে পড়ে সভাকক্ষ। একটা গান শোনালে আরও আরও গানের অনুরোধ আসে। এবং এ-আকর্ষণ উভমুখী। তাকে কেন্দ্র করে জনতার এই উচ্ছ্বাস ভালোবাসে কাজি নিজেও। গানের পর গান শোনানো, কবিতার পর কবিতা আবৃত্তি – বিরামহীন পারফর্মেন্স! অতএব কাজির জনসংযোগ বাড়তেই থাকে, আরও বেশি বেশি জনসভায় দেখা যায় তাকে।
বাড়ি-বদলের কাজ কোনরকমে শেষ করে কাজি বেরোয় শ্রীহট্ট আর চট্টগ্রামের উদ্দেশে। দুটি জেলা থেকেই আমন্ত্রণ এসেছে জেলাস্তরীয় সম্মেলনের জন্যে। আমন্ত্রণ তো দু' জেলাতেই এক-একটাই মাত্র সম্মেলনের, কিন্তু একবার গিয়ে পড়লে একটা-মাত্র অনুষ্ঠান কি ধরে রাখতে পারে কাজিকে? নানা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় তাকে, ছোট বড় মিলিয়ে অজস্র অনুষ্ঠানের সে নায়ক, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মানুষ তাকে সম্বর্ধনা দেয়। চট্টগ্রামে তার প্রথম সমুদ্রদর্শন, একই জলরাশির নানা রূপে অভিভূত কাজি এখানে লেখে তার দীর্ঘ কবিতা সিন্ধু, “সিন্ধুর যে তিন রূপ কল্পনা করা হইয়াছে – বিরহী বিদ্রোহী ও বুভুক্ষু – সিন্ধুর এরূপ সুন্দর কল্পনা বাংলার আর কোন কবিই কল্পনা করিতে পারেন নাই” – লিখল সওগাত পত্রিকা তাদের কবিতা পরিক্রমায়। চট্টগ্রামে নানা অনুষ্ঠানের ফলে ক্লান্ত, ঈষৎ অসুস্থ নজরুল কয়েকদিনের জন্যে শরীর সারাতে আশ্রয় নেয় গুবাকসারি পরিবৃত এক পুকুরপারে ভাইবোন হবিবুল্লা বাহার আর শামসুন নাহারের তামাকুমণ্ডির কুটিরে। কয়েকদিনের বিশ্রামের পর এবার ফেরার পালা।
কিন্তু সোজা চট্টগ্রাম থেকে কৃষ্ণনগর? শুধুমাত্র দুটো জেলা কি ধরে রাখতে পারে কাজিকে? নোয়াখালি ফেনি যশোর খুলনা বাগেরহাট দৌলতপুর হয়ে সেপ্টেম্বরের ন' তারিখে কাজি ফেরে কৃষ্ণনগরে। সেদিনই এক পুত্রসন্তান প্রসব করেছে দুলি!
পুত্রসন্তান! বুকের অতলে চাপা-দেওয়া একটা পাথর যেন নিঃশব্দে সরে যায়। এক-বুক নিশ্বাস নেয় কাজি, পুত্রসন্তান! দু'বছর আগে কৃষ্ণমহম্মদ যখন ছেড়ে যায় তাদের, তার পর থেকেই নিঃসঙ্গতা দুলির সর্বক্ষণের সঙ্গী। যতই কাজি বারবার মনে করে আরও আরও বেশি সময় সে দেবে দুলিকে, বাড়িতে থাকবে সর্বক্ষণ, বহির্জগতের আহ্বান কিছুতেই তার পিছু ছাড়ে না। এবার দুলির সারাদিনের ভালোবাসবার পুতুল এল। প্রায় দৌড়িয়ে দেখতে যায় সে মা আর সন্তানকে। ক্লান্ত, খানিকটা শীর্ণ, অথচ চোখেমুখে কেমন-যেন একটা স্বর্গীয় দীপ্তি নিয়ে শুয়ে আছে দুলি, পাশে চোখ-বুজে ঘুমন্ত শিশু। কাজিকে দেখতে পেয়ে মলিন হাসি দুলির মুখে; কাজি একটু এগোতে যায়, পাশেই দাঁড়িয়ে ধাই বাধা দেয় তাকে, এখনই গায়ে হাত দিও না বাবু!
ঘরের বাইরে এসেই প্রথম কাজির মনে হয়, এখন তার টাকা চাই। নিজেদের জন্যে না-হলেও চলে, কিন্তু নতুন অতিথি এই শিশু যেন কষ্ট না পায় জীবনে।
প্রদেশ কংগ্রেসের সম্মেলনের পর পুলিশ যে গ্রেপ্তার করেছে অনেকের সঙ্গে প্রমোদ আর তারককেও সে খবর শুনেইছিল কাজি। যে-কথা তার মাথায় আসেনি তখন, তা হল, তারকের কয়লার দোকান হয়তো বন্ধই হয়ে যাবে। এবং বন্ধ হবে তারকের দোকানের কর্মচারিরও প্রতি সকালে কাজির বাড়ি থেকে লিস্ট সংগ্রহ করে প্রতিদিনকার বাজার পৌঁছিয়ে দেওয়া। কীভাবে এতদিন সংসার চলেছে খবর নেয়নি কাজি, কার কাছে কত টাকার ঋণ হয়েছে এর মধ্যে, সে খবরও রাখে না সে। এখনই সে চিঠি লিখতে বসে বর্মন পাবলিশিঙের ব্রজবিহারী বর্মনকে: “আমিও আজ সকালে ফিরে এলাম যশোর খুলনা বাগেরহাট দৌলতপুর প্রভৃতি ঘুরে। টাকার বড্ড দরকার। যেমন করে পার পঁচিশটি টাকা আজই টেলিগ্রাফ মণিঅর্ডার করে পাঠাও। তুমি তো সব অবস্থা জান। বলেও এসেছি তোমায়...। ভুলো না যেন। টাকা কর্জ করেও পাঠাও।”
“টাকা কর্জ করেও পাঠাও” – লিখতেও আর বোধ হয় সঙ্কোচ করে না কাজি, অন্যের কথার খেলাপে আর তেমন অসন্তুষ্ট হয় না সে; এই তো এই চৈত্রেই যখন ছোটদের জন্যে লেখা তার নতুন কবিতার বই ঝিঙে ফুল বেরোল, যা প্রকাশের ব্যাপারে সে ওরিয়েন্টাল প্রিন্টার্সের মোজাম্মেল হককে কথা দিয়েই দিয়েছিল প্রায়, শেষ মুহূর্তে দেড়শো টাকা হাতে হাতে পেয়ে তার কপিরাইট অবলীলায় সে দিয়ে দিল ডি-এম-লাইব্রেরির গোপালদাস মজুমদারকে!
এতদিন ধরে আসা চিঠিগুলো নিয়ে কাজি বসে দুপুর বেলায়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকেও এসেছে চিঠি, লিখেছে শামসুর নাহার। সে চিঠির উত্তর লিখতে লিখতে সময়ের ঠিক থাকে না, কত বড় হয়ে যায় তার চিঠি, সে কি জানে? প্রাণ উপুড় করে মন ঢেলে সে লেখে, “...অরূপাকে মায়া-নিদ্রা হতে জাগাবার দুঃসাহসী রাজকুমার আমি। আমি সোনার কাঠির সন্ধান জানি – যে সোনার কাঠির ছোঁয়ায় বন্দিনী উঠবে জেগে, রূপার কাঠির মায়ানিদ্রা যাবে টুটে, আসবে তার আনন্দের মুক্তি। যে চোখের জল বুকের তলায় আটকে আছে, তাকে মুক্তি দেওয়ার ব্যথাহানা আমি। মানস-সরোবরে বদ্ধ জলধারাকে শুভ্র শঙ্খধ্বনি করে নিয়ে চলেছি কবি আমি ভগীরথের মতো।...” কাজি কি সেই ছোটবেলার হারিয়ে-খুঁজে-পেয়ে-আবার-হারানো-মাথার কাঁটার খোঁজ করতে বেরোল আবারও!?
দারিদ্রের লজ্জা এতদিনে বোধ হয় কেটে গেছে তার, বহু কষ্টে আদায়ীকৃত প্রাপ্য টাকাও যেন এখন তার ভিক্ষালব্ধ ধন, ঋণের নামে ভিক্ষাতেও তার সঙ্কোচ কমেছে অনেক, কাজেই ব্রজবিহারী বর্মনের টেলিগ্রাফে পাঠানো টাকা হাতে পাবার আগেও কোনরকমে জোড়াতাড়া দিয়ে খুঁড়িয়ে সংসার তার চলেই। এরই মধ্যে কংগ্রেসমহল থেকে খবর আসে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের জন্যে সংরক্ষিত দুটি আসনের নির্বাচন। যদিও কংগ্রেস এ নির্বাচনে কোন প্রার্থী দেবে না, কংগ্রেসের স্বরাজ্য দল হয়তো তাকে সমর্থন করতে পারে। পুর্ব বাংলায় পরপর কয়েকবার ঘুরে এসে কাজি বুঝেছে সেখানে তার কী বিপুল জনপ্রিয়তা। সে কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথাবার্তা বলল, এবং মনে মনে ভাবাই ছিল যে সিদ্ধান্ত, নিয়ে ফেলল সেটাই। দুটি আসনের একটিতে সে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবে।
সে সময়ের এই নির্বাচন সাধারণ নির্বাচন নয়। এই নির্বাচনে ভোট দেবার অধিকার শুধুমাত্র সম্পত্তির অধিকারীদের। যাদের দেখে নজরুল নিজেকে জনপ্রিয় বলে মনে করে, তারা প্রায় কেউই নির্বাচক নয়, ভোট দেবার অধিকারই নেই তাদের। তবুও তার ঘোর বিশ্বাস, নিজে যদি সে ভোটপ্রার্থী হয়ে প্রচারে বের হয় তার জয় সুনিশ্চিত।
লাঙল পত্রিকা বন্ধ হয়েছে এপ্রিলে, আগস্টে লাঙলকে অঙ্গীভূত করে মুজফ্ফর আহ্মদের সম্পাদনায় বেরিয়েছে গণবাণী। গণবাণীই এখন বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের মুখপত্র। সাঁইত্রিশ নম্বর হ্যারিসন রোডের অফিস এখন মুজফ্ফর আর আবদুল হালীমের বাসস্থানও। নজরুল তো এ-বছর কংগ্রেসের প্রদেশ কমিটির সভ্য, ভোটে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত নেবার পর একদিন কলকাতায় আসে সে কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে তার নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা করতে। নেতারা কেউই তার সঙ্গে আলোচনায় উৎসাহী ন'ন, তাঁরা তাকে পাঠিয়ে দেন বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে। বিকেলে যখন বিধানবাবুর বাড়ি পৌঁছোয় কাজি, তিনি তখন রোগী দেখতে ব্যস্ত। ডাক্তারির কাজ শেষ হলে কাজির সঙ্গে দেখা করেন তিনি। বলেন, ভোটের ব্যাপারে কিছুই তিনি জানেন না। তাঁর সেই বিকেলের ডাক্তারির ফীজ-থেকে-পাওয়া কিঞ্চিদধিক তিনশো টাকা তিনি কাজিকে দিয়ে বিদায় করেন তাকে।
সেই টাকা পকেটে ক্লান্ত কাজি হাজির সাঁইত্রিশ নম্বর হ্যারিসন রোডে। সে রাত্রি সে মুজফ্ফর-হালীমের সঙ্গেই কাটায়। মুজফ্ফর তাকে বোঝায়, মাত্র তিনশো টাকার সঙ্গতি নিয়ে এই নির্বাচনে দাঁড়ানো নেহাৎই পাগলামি, ঢাকা ফরিদপুর বাকেরগঞ্জ আর ময়মনসিংহ যুক্ত করে এই বিরাট ঢাকা বিভাগ, মাত্র আঠের হাজার ভোটার, প্রচারের সময় তাদের প্রত্যেকের কাছে পৌঁছোনই যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ; অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের একজন ঢাকার নবাব-বাড়ির মানুষ, দুজন জমিদার; হাজার হাজার টাকা তারা খরচ করবে প্রচারে, সেখানে এই অসম লড়াইয়ে কাজি যেন না যায়।
মুশকিলটা হল মুজফ্ফরের কথায় শুধুই থাকে যুক্তি, সেখানে আবেগের জায়গা নেই; কাজি তার একেবারেই বিপরীত, তার শুধুই আবেগ! মুজফ্ফরের যুক্তির সামনে সে প্রতিদ্বন্দ্বীতা থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু ফিরে গিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে লড়াইয়ে।
যথাসর্বস্ব, এমনকি জামানতটাও, খুইয়ে অবশেষে ক্ষান্ত হয় কাজি।
ক্ষান্ত হয়, খানিকটা স্থিরচিত্তও হয় বোধ হয় সে। এখন আর আঁতুড়ঘরে নয়, শক্তপোক্ত হতে শুরু করেছে নবজাতক। কাজি তার নাম দিয়েছে অরিন্দম খালেক, ডাক-নাম বুলবুল। নাম-ধরে ডাকলে সে হাসে, কোলে নিতে চাইলে খলবল করে হাতও বাড়িয়ে দেয়। মায়ের সঙ্গে তো তার সময় কাটবেই, বাবার সঙ্গেও সময় কাটে অনেকটাই। বিশেষ কোন কাজ না থাকলে ঘন্টার পর ঘন্টা বাড়িতে কাটায় কাজি, গান শোনায় অতটুকু ছেলেকে।
কাজি জানে না জন্মের ঠিক কত পরে জীবনের প্রথম গানটা গেয়েছিল সে, যে-বয়েসের কথা সে মনে করতে পারে সেই বয়েস থেকেই সে গান গাইছে। আর, মানুষকে শোনাবার জন্যে গেয়েছে তার আট-ন' বছর বয়েস থেকেই, লেটোর দলে। গানে সুর দিতে হাতে-ধরে কেউ তাকে শেখায়নি। লেটোর দলে গান শুনতে শুনতে, লিখতে লিখতে, গাইতে গাইতে, হারমোনিয়ম-বাঁশি-খোল বাজাতে বাজাতে, কখন যেন গানে সুর দিতেও শিখে যায় সে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত সারা জীবনই গান বাঁধছে সে, গাইছেও। এমনকি ছোট বেলার লেটোর দলে বাঁধা কোন কোন গান ঘষামাজা করে নতুন করে সুরে বেঁধে সে বন্ধুবান্ধবদের শুনিয়েওছে কখনও কখনও। কয়েকবছর আগে তেওতার জমিদারবাড়িতে আসরও তো বসিয়েছিল তার লেখা পুরোনো গানের।
আসলে, গান আর কবিতার মধ্যে বিশেষ কিছু তফাৎ দেখে না কাজি। গানে প্রকাশভঙ্গিটা আগের থেকেই ঠিক করা থাকে, সেটাই সুর। কবিতায় স্বাধীনতা পাঠকের; সে নিজের মতো আবৃত্তি করে কবিতা। গত কয়েকবছর ধরে বেশ গোটাকয়েক গান সে লিখেছে, নানা পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে সেগুলো, কিন্তু সুর দেয়নি কাজি। বছর পাঁচ-ছয় আগে আফজালুলের মোসলেম ভারত পত্রিকায় হাফিজের এক গজলের ছায়ায় প্রতিটি স্তবকে ছ'-লাইনের মোট পাঁচটি স্তবকে 'বোধন' নামে কবিতা লিখেছিল একটা:
দুঃখ কি ভাই হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে
দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুন হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে। ইত্যাদি,
কিন্তু নিজে কোন সুর দেবার চেষ্টাই করেনি, নির্দেশ দিয়েছিল ডি-এল-রায়ের “যেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিলে জননী ভারতবর্ষ”-র সুরে গাইতে হবে এ গান/কবিতা। সেই সময়টায় গান/কবিতা বেশ কয়েকটা লেখে কাজি, মোসলেম ভারত পত্রিকার পরপর কয়েকটা সংখ্যায় লেখে কয়েকটা গান, কিন্তু তখন তো সুরের কথা ভাবেইনি। আজ শিশুপুত্রকে গান শোনাতে গিয়ে গানের সুরের কথা মাথায় আসে তার।
আর সেই রাতেই কাজির প্রবল জ্বর। করাচির বাঙালি ব্যাটেলিয়নের সেনানিবাসে এক পঞ্জাবী মৌলভির কাছে কাজি শিখেছিল ফার্সি ভাষা, হাফিজ-ওমরখৈয়াম তাঁর কাছেই পড়েছিল সে। মৌলভিসাহেব গায়ক ছিলেন না, কিন্তু মুখস্থ গজল আবৃত্তি করার সময় বিশেষ একটা সুর স্বাভাবিক ভাবেই এসে পড়ত তাঁর গলায়। সেদিন রাত্তিরে ছেলেকে নিজের মায়ের হেপাজতে রেখে প্রায়-বেহুঁশ কাজির জ্বর কমাবার জন্যে মাথা ধুইয়ে দিচ্ছিল দুলি; সেই অবস্থায় আপাত-অচেতন কাজির গলা থেকে থেমে-থেমে, কেটে-কেটে, গানের সুরের মতো কিছু-একটা শোনে দুলি। ঠিক কোথায় শুনেছে মনে করতে না পারলেও সুরটা কেমন-জানি তার চেনা চেনা লাগে, কে জানে হয়তো কাজিই কখনও গেয়েছে কিছু এই সুরে! পরের দিন সকালে জ্বর যখন নেমে গেল, কাজি সুস্থ বোধ করছে খানিকটা, তখন এই সুরের কথা কাজি কিছুতেই মনে করতে পারে না।
কিন্তু জ্বরটা যে ম্যালেরিয়ার পালাজ্বর সে কথা ভালো ভাবেই জানে সে। ডক্টর দে একই ওষুধের একটা করে কোর্স কয়েকমাস অন্তর – জ্বর না থাকলেও – খাওয়ার যে নিদান দিয়েছিলেন এবং কেন সেটার প্রয়োজন তা-ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন – সবই জানে কাজি – কিন্তু তবুও তো সে ডাক্তারের কথায় গুরুত্ব দেয়নি। প্রোটিন-রিচ যে ডায়েটের কথা ডাক্তার বলেছিলেন তা-ই বা টানাটানির সংসারে কে কতটুকু পায়! তাই মাঝে-মাঝেই এই জ্বর তাকে কষ্ট দেয়, আর কষ্ট যে দেবে তা-ও যেন মেনে নেয় কাজি। আবার হয়তো কয়েকদিন পরেই সে ভুলে যায় জ্বরের কষ্টের কথা।
এবার কিন্তু যা হল তা প্রায় শাপে বর। জ্বরের রেশ তখনও আছে, সকাল থেকেই ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা অঘ্রাণের হাওয়া, একটু একটু কাঁপুনি যেন, আবার জ্বর আসবে নাকি! বিছানায় শুয়ে একটা বই পড়ছিল কাজি, কিন্তু নাঃ, কিছুতেই যেন মন লাগছে না। বিছানার পাশে একটা খাতা-পেনসিল সে রাখেই, বইটা পাশে রেখে উপুড় হয়ে খাতায় লিখতে শুরু করে সে। কোন ভাবনা-চিন্তা নয়, পেনসিলটা হাতে ধরতেই খসখস করে লেখা হয় একটা লাইন:
আসে বসন্ত ফুলবনে সাজে বনভূমি সুন্দরী
এবার উপুড় অবস্থায় পেনসিলটা পাশে এবং করতল বিছানায় রেখে হাতের উপর ভর দিয়ে সে উঠে বসে বিছানায়। মাথা নাড়তে থাকে সে তালে তালে এবং তার নাসারন্ধ্র দিয়ে নিঃসৃত হয় অর্ধস্ফূট শব্দ, হুঁ হুঁ হুঁ, এবং খাতায় সে লিখতে থাকে:
চরণে পায়েলা রুমুঝুমু মধুপ উঠিছে গুঞ্জরি।।
ফুলরেণু মাখা দখিনা বায় বাতাস করিছে বনবালায়
বনকরবী নিকুঞ্জ-ছায় মুকুলিকা ওঠে মুঞ্জরি।।
কুহু ডাকে আজ মুহুমুহু পিউ-কাঁহা কাঁদে উহু উহু
পাখায় পাখায় দোঁহে দুহুঁ বাঁধে চঞ্চর-চঞ্চরী।।
বেশ একটা তৃপ্তির অনুভূতি এখন। পেনসিলটা হাতেই ধরা, লাইনগুলোর উপর চোখ রেখে ওই হুঁ হুঁ হুঁ শব্দেই একটা সুর ভাঁজতে থাকে কাজি, সুর ভাঁজতে ভাঁজতেই ঘরের চারদিকে চোখ বোলায় সে। কেউ নেই ঘরে। হয়তো অনেকক্ষণই নেই কেউ, কিন্তু কে জানে, কেমন-জানি মনে হচ্ছিল আশপাশে ঘুরঘুর করছে দুলি। গায়ের থেকে কম্বলটা সরিয়ে বিছানা ছেড়ে 'দুলি দুলি' ডাকতে ডাকতে পাশের ঘরে ঢুকে যায় কাজি, সেখানে দোলনায় ঘুমন্ত বুলবুলের পাশে একটা চেয়ারে বসে ছুঁচ-সুতো দিয়ে এক টুকরো কাপড়ে কিছু একটা করছে দুলি। এটা শুনে যাও তো, বলে কাজি, তারপরেই দ্রুত হেঁটে ফিরে আসে নিজের বিছানায় রাখা খাতাটার পাশে, দুলি ওর পিছনেই। খাতাটা তুলে হাতে নেয় কাজি। কয়েক মুহূর্তের হুঁ হুঁ শব্দের পর গানটা গায় সে। পুরোটাই, একটানা। দুলি শোনে, বলে, এটাই তো, এই সুরটাই। কাল রাত্তিরে মাথা ধোয়াবার সময় এই সুরটাই গাইছিলে তুমি।
গজল, বলে কাজি, বাংলা গজল। একটু থেমে তারপর আবার বলে, গজল নজরুলী!
দুলি হেসে ফেলে। বলে, বেরোতে পারছিল না তাই তরাসে বোধ হয় এত জ্বর হল তোমার। তারপর এগিয়ে এসে কপালে আর বুকে হাত দেয় কাজির, এই দেখ, জ্বর নেই আর এক্কেবারে। এখন একবার চা খাবে?
সেই দিন সন্ধ্যেবেলা কাজি বলে দুলিকে, কাল ভোরবেলা উঠতে হবে, কলকাতায় যাব।
অ্যাঁ, বল কী, আঁতকে ওঠে দুলি, আজ সকালেও জ্বর ছিল তোমার, কাল ভোরবেলায় তুমি এই শরীর নিয়ে কলকাতা যাবে?
তরাসের জ্বর, হেসে বলে কাজি, তুমিই তো বললে। এখনো তো ঠিক ঠিক বেরোতে পারেনি, আবার যদি জ্বর হয়, তাই আবার তরাসের আগেই বের করবার ব্যবস্থাটা পাকা করে আসি!
ঠিক ঠিক বেরোতে পারেনি মানে? কী চমৎকার গাইলে তুমি ও বেলায়। আবার ঠিক ঠিক কী?
যতক্ষণ না ছেপে বেরোচ্ছে, কাজি বলে, কবিতা বা গান যতক্ষণ না ছাপা হচ্ছে, ততক্ষণ আর বেরোল কোথায়? সবায়ের কাছে পৌঁছলে তবে না বেরোনো। আর গান তো, গান যতক্ষণ না গাওয়া হচ্ছে ততক্ষণ তার কি বেরোনো হল? স্বরলিপি করতে হবে। দিলীপকে পাঠাতে হবে স্বরলিপি, তবে না! কাল কলকাতায় যাব ছেপে বের করে দেবার জন্যে। নাসিরুদ্দিন সাহেবের কাগজ – সওগাত – সেখানে বের করব। ব্যস, নিশ্চিন্ত! তারপর দিলীপ।
স্বরলিপিটা হোক...
নাসিরুদ্দিন সাহেব কাজিকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, কেমন আছেন কাজিসাহেব?
ভালোই তো, বলে নজরুল।
ভালো? কিন্তু আপনাকে তো খুব একটা ভালো দেখাচ্ছে না কাজিসাহেব, চোখ-মুখ ফোলা লাগছে, কোথা থেকে এলেন এখন, কৃষ্ণনগর?
হ্যাঁ, কৃষ্ণনগর। আমার জ্বর হয়েছিল। সেই জ্বরের মধ্যেই একটা গজল লিখে ফেললুম, জ্বর একেবারে হাওয়া! আমার স্ত্রী বললেন, তরাসের জ্বর।
তরাসের জ্বর মানে?
তা জানিনা, তবে শব্দটা খুব ভালো লাগল। কোন কোন শব্দ আছে না, মানে বোঝার দরকার নেই, শব্দটা ঠিক জায়গায় বসলেই একটা মানের গন্ধ পাওয়া যায়? আছে না? সেই রকম শব্দ। আমার স্ত্রী বললেন, আর সঙ্গে সঙ্গেই মানেটা স্পষ্ট হয়ে গেল! তরাসের জ্বর! কাল গানের সুর আর লেখাটা একই সঙ্গে বেরোল। গানে-সুরে কম্পোজিট। গজল। গজল নজরুলী। ভাবলুম, আমার প্রথম গল্পটা সওগাত ছেপেছিল, প্রথম প্রবন্ধও। মনে আছে আপনার? তুর্ক মহিলার ঘোমটা-খোলা? তাই সওগাতই ছাপুক প্রথম গজল নজরুলী।
আর দুটো দিন আগে এলেই ভালো করতেন কাজিসাহেব, বলেন নাসিরুদ্দিন, অঘ্রাণ সংখ্যাটা দু'দিন আগেই বেরিয়ে গেল। ঠিক আছে, এটা পৌষেই বেরোক। কিন্তু কাজিসাহেব, এত সকাল সকাল কৃষ্ণনগর থেকে বেরিয়েছেন, একেবারে ভোরবেলাতেই বেরিয়েছেন তো? কী খেয়ে বেরোলেন?
দুধ-পাঁউরুটি, জবাব দেয় কাজি, গরম দুধ এক বাটি, আর ফ্রেশ পাঁউরুটি।
ফ্রেশ পাঁউরুটি, পেলেন কোথায়? কৃষ্ণনগরে পাঁউরুটি পাওয়া যায়? তা-ও ফ্রেশ?
কী ভাবেন আপনি নাসিরসাহেব কৃষ্ণনগরকে? আমাদের পাড়াতেই তো বেকারী আছে। আর, বেকারীর মালিক রোজ রাত্তিরে বাড়ি ফেরার পথে নিজে আমাদের ফ্রেশ পাঁউরুটি দিয়ে যায়।
বাঃ, চমৎকার। এখন চলুন, আমাদের পাশেই যে হোটেলটা আছে ওরা ভালো সুরুয়া বানায়, মুর্গির। চলুন, আপনাকে খাইয়ে আনি। অসুস্থ মানুষ, রাস্তাঘাটে যা হয় খাবেন না। আর তারপর আপনাকে আমি শেয়ালদা থেকে গাড়িতে তুলে দেব, এই শরীরে এখন সারা কলকাতা চরকিবাজি করবেন না, বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ান নাসিরুদ্দিন, তারপর বলেন, কী হল, লেখাটা দিন।
নজরুলের সঙ্গে একটা ব্যাগ ছিল, সেটা খুলে সে বের করে আনে কবিতাটা। নাসিরুদ্দিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পড়েন, তারপর পাশেই কাচের আলমারিটা খুলে একটা ফাইল বের করে সেটার মধ্যে রেখে দেন কাগজখানা। এবার পকেট থেকে একটা চাবি বের করে খোলেন একটা ড্রয়ার, একটা দশ টাকার নোট বের করে কাজিকে দিয়ে বলেন, আপনার ফী। কাজী টাকাটা পকেটে রাখে। ড্রয়ারটা খোলাই থাকে। নাসির এবার বলেন, এটা আপনার সাধারণ কবিতা বা গান নয় কাজি সাহেব, প্রথম গজল নজরুলী। এই প্রথমটা আমাদের দেবার জন্যে এটা আপনার প্রাপ্য, বলতে বলতে আরও একখানা দশ টাকার নোট বের করে এগিয়ে দেন কাজির দিকে। খানিকটা ইতস্তত করেও কাজি নেয় নোটখানা, পকেটেও রাখে।
আর একটা কথা, বলতে থাকেন নাসির সাহেব, আপনার প্রথম প্রবন্ধ আর প্রথম গল্প আমরাই ছেপেছিলুম আপনি মনে করিয়ে দিলেন। সেই একই সম্মান আপনি আবার দিলেন প্রথম গজল নজরুলী আমাদের দিয়ে। যে সম্মান আপনি আমাদের দিলেন কাজি সাহেব, টাকাপয়সা দিয়ে তার ঋণ শোধ হয় না। তবুও, ছোট পত্রিকা চালাই আমরা, কীই বা আর আপনাকে দিতে পারি!– ড্রয়ার থেকে আরও একখানা দশ টাকার নোট বের করে নাসিরুদ্দিন বললেন, এটা আপনাকে নিতেই হবে কাজিসাহেব।
অস্বস্তি হয় নজরুলের, সে বলে, না না না নাসির সাহেব; না, সত্যি কথা এই, যে আমার প্রাপ্য আপনি প্রথম যে দশ টাকা দিলেন, সেটুকুই। শুধুমাত্র সেটুকুই। তা-ও আরও দশ টাকা আপনি দিলেন, আমি নিয়েছিও। এই দশ টাকা আর দেবেন না। এটা আমার প্রাপ্য একেবারেই নয়।
আপনার যা প্রাপ্য সত্যি সত্যিই তা দেবার সাধ্য আমার নেই। আপনার মনে আছে কাজিসাহেব, করাচির সেনাব্যারাকে আপনি যখন ছিলেন তখন আমাদের নবজাত সওগাতের জন্যে বার জন গ্রাহক আমাদের আপনি যোগাড় করে দিয়েছিলেন? তখন আপনি আমাকে চিনতেনও না। মুখোমুখি পরিচয়ই ছিল না আমাদের। সেই সময়ে বার জন গ্রাহক! ভাবা যায়! আমরা ভাবতে পারছিলাম না কীভাবে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাব। অনেক ভেবে সওগাতেই আমরা একটা বিশেষ বিজ্ঞপ্তি ছেপেছিলাম। তাতে আপনার এই সপ্রণোদিত সাহায্যের উল্লেখ আমরা করেছিলাম। উপকার পেয়ে তা স্বীকার না করলে গুণাহ্ হয় কাজি সাহেব। আপনাদের সবায়ের সাহায্য পেয়েই আমরা চালিয়ে যাচ্ছি আমাদের পত্রিকা। আজ এই ক'টা টাকা আপনাকে না দিতে পারলে আমরা অপরাধী হব কাজিসাহেব। প্লীজ।
অনেক কষ্টে প্রায় উদ্গত অশ্রু সংযত করে কাজি, টাকাটা সে নেয়।
সেদিন মুর্গির সুরুয়া খাইয়ে একটা রিকশয় বসিয়ে কাজিকে শেয়ালদায় নিয়ে আসেন নাসির। আসবার পথে একটা ফলের দোকানে রিকশ দাঁড় করিয়ে কিছু আপেল আঙুর আর খেজুর কেনেন তিনি। ট্রেনে কাজিকে উঠিয়ে বলেন, পথে আপনার খিদে পাবে। হকারদের কাছ থেকে কিছু কিনে খাওয়া আপনার ঠিক হবে না, মনে রাখবেন। এই ফলগুলো কিনেছি সেই কথা ভেবেই। খিদে পেলে এর থেকেই খাবেন।
ট্রেন ছেড়ে যাওয়া অবধি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েই থাকেন নাসির।
আবেগতাড়িত কাজি চুপচাপ বসে থাকে বেশ অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে। কোন কিছুই বোধ হয় ভাবতে পারে না সে। তারপর কোন এক সময়ে রেলগাড়ির ঝাঁকানি আর অশক্ত দেহ তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। ঘুম ভাঙলে ব্যাগ থেকে কাগজ বের করে সে লেখে দ্বিতীয় গজল নজরুলী:
নিশি ভোর হল জাগিয়া পরাণ পিয়া
ডাকে পিউ কাহাঁ পাপিয়া, পরাণ পিয়া।
ভুলি বুলবুলি সোহাগে, কত গুলবদনী জাগে।
রাতি গুলশনে যাপিয়া, পরাণ পিয়া।
জেগে রয় জাগার সাথী
দূরে চাঁদ, শিয়রে বাতি
কাঁদি ফুলশয়ন পাতিয়া পরাণ পিয়া।
গেয়ে গান কে কাহারে
জেগে রোস কবি এপারে
দিলি দান কারে এ হিয়া
পরাণ পিয়া।।
কৃষ্ণনগরে বাড়ি ফিরে এবার বোধ হয় গজলের বান ডাকে। প্রতি মাসে কোন-না-কোন পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে গজল নজরুলী। পৌষের সওগাতে 'আসে বসন্ত ফুলবনে'-র পর মাঘের কল্লোলে 'বাগিচায় বুলবুলি তুই', ফাল্গুনে আবার 'দুরন্ত বায়ু পুরবৈয়া' সওগাতেই। প্রতিটি গানে দশ টাকা, চাইলে স্বরলিপি বোনাস! নানা সভা-সমিতিতে দিলীপ রায় গাইছেন এই গান, সমস্ত বাংলায় মাত্র মাস দু'তিনেকের মধ্যেই যেন ঝড় উঠল! একের পর এক লেখা হচ্ছে 'কার নিকুঞ্জে রাত কাটায়ে', 'কে বিদেশী বন-উদাসী', 'ভুলি কেমনে', 'আমারে চোখ ইশারায়'-এর মতো গান যা পরের একশো বছরেও পুরোনো হবে না এ-কথা নিশ্চিত বলা চলে! বিত্ত-বিদ্যা-শহর-গ্রাম-স্ত্রী-পুরুষের সমস্ত ব্যবধান ঘুচিয়ে দিল নজরুলের গজল! বাংলায় গানের জগতের পরিধিও গজলের জনপ্রিয়তার জেরে ফুলে-ফেঁপে বাড়তে শুরু করল। মুসলিম-হিন্দু নির্বিশেষে গোঁড়া বাড়ির জানলার ফাঁক-ফোকর-ঘুলঘুলি দিয়েও কোন এক ফাঁকে ঢুকে পড়ল 'কাজিদার গান!' বিপ্লব!!
অবিশ্যি গজল নজরুলী বলে না কেউ; ছোট-বড়, বয়েস নির্বিশেষে সব বাঙালির গলায় 'কাজিদার গান'!
কিন্তু দুলির তরাসের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে আবারও জ্বরে পড়ে কাজি প্রায় রোজই। এ-বেলা ভালো থাকলে ও-বেলা জ্বর। এরই মধ্যে ওই প্রতি গানে দশ টাকার টান! জ্বর-গায়ে বিছানায় উপুড় হয়েও গান লেখা! বুলবুলকে কোলে নেওয়া হয়নি কতদিন! তাকে গান শোনাতে গিয়েই তো গজলের জন্ম হল কাজির কলমে। ভেবেছিল, খুব ঘটা করে বুলবুলের একটা অন্নপ্রাশন দেবে, কিন্তু, শরীরের এই অবস্থায় দুটো বাড়তি টাকা আয় করার চেষ্টা করাও অসম্ভব। কালিকলমের মুরলীধর বসুকে লেখে সে তার কান্নাভরা চিঠি: “আমি এবার এত দুর্বল হয়ে পড়েছি এবং চারিদিক দিয়ে এত বিব্রত হয়ে পড়েছি যে, এবার বুঝি সামলানো দায় হবে এই ভেবেছিলুম প্রথমে। অবশ্য সামলে যে উঠেছি তাও নয়। নিত্য অভাবের চিত্তক্ষোভ আমায় আরো দুর্বল করে তুলেছে। এখনো বাড়ি ছেড়ে বেরোবার সাধ্য নেই।– তোমার এ-সময় সময় নেই; তবু একটা কাজ দিচ্ছি। আমি শুয়ে শুয়ে কয়েকটা গান লিখেছি উর্দু গজলের সুরে। তার কয়েকটা সওগাতে দিয়েছি। দুটো তোমার কাছে পাঠাচ্ছি – বঙ্গবাণীতে দিয়ে আমায় তাড়াতাড়ি কিছু নিয়ে দেবার জন্য। অন্য সব জায়গায় দশ টাকা করে দেয় আমায় প্রত্যেকটা কবিতার জন্য, একথা ওদের বলো। গান দুটি পেয়েই যদি ওরা টাকাটা দেয় তাহলে আমার খুব উপকারে লাগে।–আমাদের আর মান-ইজ্জত রইল না, মুরলীদা – না, অর্থাভাব বুঝি মনুষ্যত্বটাকেও কেড়ে নেয় শেষে...
“হ্যাঁ, বঙ্গবাণীতে জিজ্ঞাসা করো, ওঁরা যদি স্বরলিপি চান তাহলে গজল দুটোর স্বরলিপি করে পাঠাতে পারি ২-১ দিনের মধ্যেই। বঙ্গবাণীর সঙ্গে বন্দোবস্ত করে দাও না মুরলীদা – ওঁরা প্রতি মাসে কিছু দেবেন, আমিও সেই অনুসারে লেখা দেব প্রতি মাসে।”
বঙ্গবাণীর সঙ্গে কোন মাসিক বন্দোবস্ত হয়নি শেষ পর্যন্ত, কিন্তু হয়তো হতে পারত কিছু ব্যবস্থা, যদি জানুয়ারির তের তারিখে কলকাতায় পৌঁছতে পারত কাজি। কাজির শারীরিক এবং আর্থিক অবস্থা নিয়ে সওগাতের বন্ধুরা খুবই চিন্তিত; সেই দিন সওগাতের প্রীতিসম্মেলন, সবাই আসবে, কাজিরও যাওয়ার কথা, কিন্তু সেদিনই সকাল থেকে কাজির আবার প্রবল জ্বর, সঙ্গে গলাব্যথা। বাড়ি থেকে বেরোনো গেল না কোনমতেই। বন্ধুরা আরও চিন্তিত। নাসিরুদ্দিন সাহেব প্রস্তাব দিলেন, নাচ-গান কৌতুক-নকশা মিলিয়ে একটা ভ্যারাইটি এন্টারটেনমেন্ট অনুষ্ঠান যদি করা যায় টিকিট বিক্রি করে, এককালীন কিছু টাকা তা হলে সংগ্রহ করা যায় কাজির জন্যে। এখন গজল গানের নামে সে খুবই জনপ্রিয়, তার নাম থাকলে লোকে টিকিট কিনবেই।
কৃষ্ণনগরে বসে বসেই কাজি কিছু কিছু খবর পায় সওগাতের আলোচনার। মনে মনে ধন্যবাদ দেয় সে তার বন্ধুদের।এই যে আগ্রাসী পুরুত-মোল্লারা সুযোগ পেলেই ধুন্ধুমার লাগায় তার নামে, বিশেষ করে শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানদের এক দল অনবরতই সুযোগ খোঁজে তার বদনাম করার, তারই মধ্যে সওগাতের বন্ধুরা – তারা তো প্রায় সবাইই মুসলমান – তারা তার জন্যে কত চিন্তিত! সে নিজে যেতে পারল না সওগাতের প্রীতি সম্মেলনে, তা সত্ত্বেও তার অসহায়তা নিয়ে আলোচনা করেছে বন্ধুরা, উপায় একটা বের করার চেষ্টাও তো করেছে! একটু জ্বর কমলেই সে যাবে কলকাতায়। কলকাতার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হলে তার চলবে কীভাবে!
এবং গেলও সে। কয়েকদিন পরেই। দুলির আপত্তি, কান্নাকাটি সত্ত্বেও। দুলিও জানে কলকাতায় গেলে যা-ই হোক, একটা-কিছু সাময়িক ব্যবস্থা না করে কাজি ফেরে না। এই তো, আগের বারেও কলকাতায় গিয়ে তিরিশ টাকা – পুরো তিরিশ – সে এনেছে। একটা দোকানের সব ধার শোধ করেও দশটা টাকা বেঁচেও ছিল! সব জানে সে, কিন্তু এই শরীর নিয়ে একা-একা – কিছু যদি হয়! আর ভাবতেও চায় না দুলি।
সঙ্গে চারখানা গজল নিয়ে গিয়েছিল কাজি, দুখানা কল্লোলের আর দুখানা সওগাতের জন্যে। শেয়ালদা থেকে হাঁটতে হাঁটতে পটুয়াটোলায় কল্লোলের অফিসে যাবে প্রথমে। ট্রেনে প্রায় সারাটা রাস্তাই কখনো আধো-ঘুম, একটু ঢুলে নেওয়া কখনও – এইভাবেই এসেছে। শীতের সকাল, রোদ্দুরও ছিল। মন্দ লাগছিল না প্রথমে। একটু হেঁটে, রিপন কলেজ পেরোবার পর মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করতে শুরু করে তার। কপালে আর গলায় একটু ঘামের অনুভূতি। আর তো কয়েক পা মাত্র! – নিজেকে বুঝিয়ে আস্তে আস্তে এগোতে থাকে কাজি।
কল্লোলের অফিসে ঢুকেই একটা বেঞ্চ। ছোট একটা ছেলে রোজ সকালে অফিস খুলে ঝাঁটপাট দিয়ে পরিষ্কার করে রাখে। এই বাড়িতে থাকেন কল্লোলের অন্যতম সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ।
নজরুল যখন ঢুকল বাচ্চা ছেলেটা ঘর পরিষ্কার করে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখছিল। কোন কথা না বলে কাজি কাঁধের থেকে ব্যাগটা নামিয়ে ঘরের কোণের বেঞ্চিটাতে রাখে। তারপর সেই বেঞ্চিতেই শুয়ে পড়ে সে। ছেলেটা ঢুকে আসে, বলে, দাদা – অর্থাৎ – দীনেশ দাশ – নেই, বেরিয়েছে। কোন কথা তবুও বলে না কাজি, আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে, একটু সুস্থ বোধ করলে উঠে বসে আধ ঘন্টাটাক পর। ব্যাগ থেকে কল্লোলের জন্যে আনা কবিতার কাগজ দুটো দেয় ছেলেটার হাতে। তারপর উঠে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটতে থাকে সওগাতের অফিসের দিকে।
সওগাতের অফিসে কোন বেঞ্চি নেই। কোনরকমে ঘরে ঢুকে, কারও খোঁজ করারও সময় পায় না সে। মেঝেতেই শুয়ে পড়ে। তার পর আর কিছুই জানে না সে।