থাকে থাকে মোহর-ভর্তি কলসী, আর সেই ঘরেই বাস। এমনটা যার হয়, অর্থোপার্জনের জন্যে সে বাইরে যাবে কেন? এমন দশাই বোধ হয় হয়েছে কাজির। গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমেই কেটে যায় তার দিবসরজনী।
তাহলে কি নিজের আনন্দের জন্যে কাজ আর করে না কাজি? সবটাই এখন অর্থোপার্জন? আর অর্থোপার্জন করে কেন মানুষ? অর্থের তো একমাত্র গুণ বিনিময়যোগ্যতা। অতএব অর্থ থাকলেই বিনিময়ের ইচ্ছে বাড়ে। বিনিময়ের ইচ্ছে যত বাড়ে একটা-একটা করে ঢাকা-কলসীর মুখ খুলতে হয়; এবং, কে জানে, এমনও দিন হয়তো আসে যখন অবশিষ্ট কলসী আর একটাও থাকে না। সেই ভয় যখন তাড়া করে কলসীর অধিকারীকে তখন শুধু কাজ আর কাজ, নতুন করে কোন কিছু শেখবার সময় নেই। আর সব কাজই তো শেষ পর্যন্ত অভ্যেস। অভ্যেসের নীচে চাপা পড়ে ইচ্ছেও।
কী কাজ করে কাজি নজরুল ইসলাম? কাজ করতে করতে যা-কিছু সে সৃষ্টি করে কে তার গ্রহীতা? এখনও তো কাজির প্রধান পরিচয় কবি হিসেবে; বাঙালি তাকে জাতীয় কবি নামে ডেকেছে, সেই নামের ছাপ তো নজরুল নামক ব্যক্তির ব্যক্তিত্বতেই, হয়তো তার অস্তিত্বতেই। আর, কাজির কবিতা মানেই তো বিদ্রোহ, জাতীয় এই কবি তো জন্মবিদ্রোহীই। অতএব, অর্থ-উৎপাদনকারী যে কাজ, তার বাইরেও নজরুলের যে চাহিদা জনসাধারণের কাছে, সেই চাহিদার দাবিতে সে প্রায় অনবরতই নিমন্ত্রণ পায় নানা সভায়; যেতেও হয় তাকে, আর ইদানিং প্রতিটি সভাতেই সে যে বক্তৃতা দেয় তার বক্তব্য একটাই: কবিতারচনায় তার বর্তমান অক্ষমতার জন্যে সে ক্ষমাপ্রার্থী। ফরিদপুর জেলা মুসলিম ছাত্রসম্মেলনীতে সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে সে স্পষ্টতই বলে, “......আমি বর্তমানে সাহিত্যের সেবা থেকে, কওমের খিদমতগারি থেকে অবসর গ্রহণ করে সঙ্গীতের প্রশান্ত সাগরদ্বীপে স্বেচ্ছায় নির্বাসন দণ্ড গ্রহণ করেছি। ......কওমের জন্য, জাতির জন্য, দেশের জন্য কতটুকু আমি করেছি – তবু তার প্রতিদানে অতিকৃতজ্ঞ জাতি যে শিরোপা আনে, তাতে শির আমার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে চায়।..... ফরিদপুরের তরুণ ফরিদ দলের নেতৃত্ব করার অধিকার নেই এই সংসারের চিড়িয়াখানায় বন্দী সিংহের – যে সিংহ আজ হিজ মাস্টার্স ভয়েসের ট্রেডমার্কের সাথে এক গলাবন্ধে বাঁধা পড়েছে। আমার এক নির্ভীক বন্ধু আমাকে উল্লেখ করে একদিন বলেছিলেন, 'যাকে বিলিতি কুকুরে কামড়েছে তাকে আমাদের মাঝে নিতে ভয় হয়।' সত্যি, ভয় হবারই কথা। তবু কুকুরে কামড়ালে লোকে নাকি ক্ষিপ্ত হয়ে অন্যকে কামড়াবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আমার কিন্তু সে শক্তিও নেই, আমি হয়ে গেছি বিষ-জর্জরিত নির্জীব।”
এই-যে বক্তৃতা যা মূলত আত্মসমালোচনামূলক, অথচ অপরিমিত বিরুদ্ধ-সমালোচনায় আহতর বেদনাও যাতে
ভরা-সঙ্কোচসহ ব্যক্ত, সেই বক্তাকে বাধ্য হয়েই ফিরে আসতে হয় ওই হিজ মাস্টার্স ভয়েসের রিহার্স্যাল রূমেই। যে বিলিতি সঙ্গীত-ইণ্ডাস্ট্রীকে প্রায় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পুরোনো স্বাদেশিকতার রাস্তায় দেশি পুঁজির জয়ধ্বনি দিতে দিতে কলগীতি প্রতিষ্ঠা করল কাজি, সেই কলগীতিকে বাঁচাতেই। পিংলা যখন নির্মীয়মাণ কলগীতি দেখতে গিয়ে খানিকটা ভীত হয়েই, একটু আমতা-আমতা করে বলেছিল, ধর, লোকসানই হল, টাকাটা ডুবেই গেল তোমার, তখন কী করবে তুমি? কাজি জবাব দিয়েছিল, গানের থেকেই আয় করে নেব আবার। আরও বলেছিল, কিন্তু, আমি তো ঠিক ব্যবসা করে বড়লোক হয়ে যাব মনে করে এই ব্যবসাটায় নামছি না। বলেছিল, এটা একটা আন্দোলন, আন্দোলনটা শুরু করতে চাইছি আমি। আর যথাসর্বস্বই যদি পণ না করি, তাহলে আমার কথা শুনবে কেন লোকে?
কাজির নিজস্ব কয়েকটা ধারণা ছিল কীভাবে এই ব্যবসাটাকে বড় করে বাঙালি ব্যবসায়ীদের অনুপ্রাণিত করা যেতে পারে, যাতে এই ধরণের স্বদেশী দোকান খুলতে আরও কেউ কেউ এগিয়ে আসে। আর, সীরিয়স ব্যবসাদাররা যদি এগিয়ে আসে সত্যিই, হিন্দুস্থান আর মেগাফোনের সঙ্গে কথা তো হয়েই গেছে, ওরা ওদের রেকর্ড আর ভবিষ্যতে যদি যন্ত্রপাতিও তৈরি করে ওরা, সেগুলোও – লং টার্ম ক্রেডিট বা দীর্ঘ সময়ে শোধযোগ্য ঋণ হিসেবে তাদেরও দেবে।
নিজে ব্যবসায়ী নয় বলেই হয়তো, যে হিসেবটার কথা কাজির মাথায় একবারের জন্যেও আসে নি তা হল এই যে, দশটা যদি গানের রেকর্ড বিক্রি হয় একটা দোকান থেকে, তাহলে গড়ে তার সাতখানাই হয় এইচ-এম-ভির, বাকি তিনখানা হয়তো সব দেশি কম্পানী মিলিয়ে। কারণ, এইচ-এম-ভির এত রকমারি রেকর্ড, সারা ভারতের নামী যত ওস্তাদ, হিন্দুস্থানী বা কর্ণাটকী যা-ই হোন না কেন, আর ফিল্মী সঙ্গীত প্রায় সব ভাষারই, যা শুনতে চায় মানুষ সেরকম প্রায় সব রেকর্ডই তো ওই কুকুর-ছাপ কম্পানীর। অর্থাৎ, যে কম্পানীর কাছ থেকে ধারে মাল পেলে সত্যি-সত্যিই সুবিধে হবে দোকানগুলোর, তা মেগাফোন বা হিন্দুস্থান নয়, সে কম্পানীর নাম হিজ মাস্টার্স ভয়েস!
আর, হিজ মাস্টার্স ভয়েসও জানত সে কথা। কাজেই, কাজির ভাষায় তিন-মাথার মোড়ের দোকান যেগুলো, কুকুর-ছাপের রেকর্ডও ধারে পেতে অসুবিধে হল না তাদেরও। অসুবিধে হল না এমনকি কাজির কলগীতিরও। এইচ-এম-ভি সে ব্যবস্থা করে ফেলল অতি চটপট।
পাঁচজন বন্ধু টাকা দিয়েছিল কলগীতিতে। তাদের পাঁচজনকেই অংশীদার করে নিয়েছে কাজি। কাজির সময় কোথায় দোকান দেখবার?– ওই পাঁচজনই যে সবকিছু দেখাশোনা করবে এ তো প্রথম থেকেই স্থির। প্রথম প্রথম কয়েকমাস সন্ধ্যের মুখে কাজির ক্রাইসলারটাকে দোকানের বাইরে বিবেকানন্দ রোডের ওপর দেখা যেত প্রায়ই। কাজি নিজেই তো দর্শনীয় বস্তু। ক্রাইসলার দেখেই লোকে কাজির উপস্থিতি বুঝত; পিলপিল করে আসত মানুষ, গান শুনত, চা খেত, কাজিদার সঙ্গে খানিকটা গল্পসল্প করে চলে যেত তারা। কিছুদিন পর পাঁচ বন্ধুই আলাদা আলাদা করে একই নালিশ করে কাজির কাছে। সে এলে দোকানে ভীড় হয়, চায়ের খরচ বাড়ে, কিন্তু বিক্রি বাড়ে না। কাজি নিজেও বোঝে, কোন মানুষকেই টাকাপয়সার বিনিময়ে কিছু কিনতে বলতে তার অস্বস্তি হয়। এক বছর পর কাজি প্রথম খবর পায়, দোকান চলছে না ভালো।
কাজির পাঁচ অংশীদার এবারও আসে একজন একজন করে এক-একদিন। প্রত্যেকেরই অভিযোগ বাকি চারজনের নামে। এখনো পর্যন্ত ধারে কেনা হয়েছে যা, তার কোন ধার শোধ হয়নি। প্রত্যেকেই বাকি চারজনের নামে অভিযোগ করে, ধারে অন্যরা বেচছে দোকানের মাল, টাকা-পয়সা আদায় হচ্ছে না। দোকান নির্মাণের সময় শৈলজানন্দ বলেছিল কাজিকে, তোর যা ক্যাপিটাল, তার খানিকটা ফেরৎ এলে, তারপর আবার ক্যাপিটাল ঢোকাবি, তার আগে নয়।
ক্যাপিটাল তবুও আবার ঢোকাতে হয় কাজিকে, এবং তা একটুও ক্যাপিটাল ফেরৎ আসবার আগেই।
কাজির যা সঞ্চয় ছিল, কলগীতিতে চলে গেছে সব। ওর পাঁচ অংশীদার মনে করে, টাকার কী অভাব! অত বড় গাড়ি, বাড়ির বাইরে দারোয়ান, শোনা যায় বালিগঞ্জে জমিও কিনেছে কাজি, এত ব্যস্ত সঙ্গীতশিল্পী সে, চাইলেই টাকা আসবে!
এরপর যখন আবার টাকা চাওয়ার সময় আসে, কলগীতি তখন ঋণে জর্জরিত। শুধু দেশি কম্পানীর ঋণ নয়, ঋণ হিজ মাস্টার্স ভয়েসেরও! কলগীতি নিলামে ওঠে, কাজি বোধহয় বেঁচে যায়! থাকে থাকে সাজানো তার মোহরের কলসী সবই উধাও, সে আবার মুক্ত! সকাল থেকে রাত অবধি গানের জগতেই সে আবার বাঁধা, সেই বন্ধনই বোধ হয় তার মুক্তি। যথাসর্বস্বই সে পণ করেছিল, প্রায় যথাসর্বস্ব দিয়েই সে মুক্ত হল!
বাইরে থেকে বিশেষ কিছু জানল না কেউ। সকাল থেকে রাত অবধি হিজ মাস্টার্স ভয়েসের রিহার্স্যাল রূমেই তাকে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে ততদিনে সবাই, কাজেই কারো কিছু জানবার প্রয়োজনও হল না। ওই রিহার্স্যাল রূমের বাইরে তাকে এতদিন ধরে সিনেমা-নাটকের রিহার্স্যাল রূমে অথবা মঞ্চেও দেখতে অভ্যস্ত যে পরিচিতরা, তাদের চোখে এখনো সেই রূটিনই চলছে। সিনেমার আসল কাজ, যা শিখতে গেলে, কাজির ধারণায়, তাকে সময় দিতে হবে স্টুডিওর এডিটিং টেবিলে, সে সময় কোথায় তার? পিংলা তো পরিকল্পনা অনুযায়ীই চলে গেছে গোসাবায়, যাবার বছরখানেক পর চিঠি লিখে সে জানিয়েছে সে ভালোই আছে, তার অভিজ্ঞতা অর্জন চলছে পুরোদমে, যেদিন মনে হবে সে তার অধীত বিদ্যা প্রয়োগের উপযুক্ত হয়েছে তখনই ফিরবে সে, তার আগে নয়।
এর মধ্যে নরেশ মিত্র নামে এক চিত্র-পরিচালক রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করলেন। এই চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছে কাজি। কাজ মোটামুটি শেষ, ছবির সাফল্যের ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহই নেই, অগ্রিম প্রচার শুরু হয়ে গেছে, এমন সময় বিনা মেঘে হঠাৎ বজ্রপাত। চিঠি দিয়েছে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড, বিনা অনুমতিতে রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করা হয়েছে এই ছবিতে, এ যে সম্পূর্ণ বেআইনী শুধু তা-ই নয়; অভিযোগ, ব্যবহৃত রবীন্দ্রসঙ্গীতের পরিবেশনে অনেকগুলোই ত্রুটিমুক্ত নয়। অতএব, রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় গান বাদ দিতে হবে।
প্রযোজক-পরিচালকের মাথায় হাত। সকলেই জানেন কবিগুরু নজরুলকে বিশেষ স্নেহ করেন; যেহেতু সেই নজরুলই বেছে বেছে পাঁচখানা রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করেছে ছবিতে, সকলেই নিশ্চিন্ত ছিলেন। কাজি বলল, আমি নিজে গিয়ে গুরুদেবের সম্মতি নিয়ে আসব। জোড়াসাঁকোয় খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কবি তখন শান্তিনিকেতনে।
ছবির একটা প্রিন্ট আর প্রোজেক্টর গাড়িতে তুলে প্রযোজক পরিচালক আর নজরুল তখন সোজা শান্তিনিকেতনে। কাজি এসেছে খবর পেয়ে কবি তো মহাখুশি। সব ঘটনা শুনে বললেন, কী কাণ্ড! তুই নিজে শিখিয়েছিস আমার গান, তার আবার ভুল ধরা!
প্রণাম করে কাজি বলল, আমি তো জানতুমই গুরুদেব, আপনি কোন আপত্তি করবেন না, কিন্তু আপত্তি যখন উঠেছে একবার, আপনার লিখিত অনুমতি ছাড়া ছবি মুক্তি পাবে না। আমরা ছবির প্রিন্ট আর প্রোজেক্টর সঙ্গে নিয়ে এসেছি, আপনি নিজে ছবি দেখুন, তারপর আপনার যা মনে হয় লিখে দিন।
প্রজেক্টর সঙ্গে এনেছিস? তাহলে দেখা ছবি। সবাই দেখুক, দেখব আমিও। তোরা তার আগে একটু খাওয়াদাওয়া করে নে। আর কাগজপত্র তোদের সঙ্গে কী আছে দে, সইটা তো আমি করে দিই।
আশপাশে যারা ছিল তাদের একজনকে কবি বললেন, হ্যাঁরে, পিংলা এসেছে না পরশু? ও কাজির বন্ধু আর ছোটভাইও, ওকে ডেকে দে, ও-ও দেখুক।
কবি নিজে ছবিটা দেখবেন এমন আশা মনে মনে কাজিও করছিল, পিংলার কাছে ও তো ইদানিং সিনেমার ব্যাপারে কবির উৎসাহের কথা শুনেইছে। কিন্তু পিংলাও পরশুদিন এসেছে, আর এই সুযোগে তার সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে এমনটা কাজি জানতোও না, ভাবেওনি আগে।
ওরা সবাই যখন খেতে বসেছে তখন খবর এল, পিংলা এসেছে ঠিকই, কিন্তু ওকে নিয়ে অতুলবাবু সকালবেলাই বেরিয়ে গেছেন, বলে গেছেন ফিরতে ফিরতে রাত হতে পারে।
পরের সপ্তাহে অবিশ্যি পিংলা নিজেই এসেছিল কাজিদার সঙ্গে দেখা করতে। কবি যদিও পিংলাকে আগেই বলেছিলেন, শান্তিনিকেতনে ও ফিরে যদি আসে, ওর কাজ ওরই থাকবে, বাইরে কোথাও কাজ খোঁজবার দরকার নেই ওর, তবুও ও মনে মনে আশা নিয়ে ফিরেছিল, নিজের পছন্দের কাজ নিজের যোগ্যতায় ও নিজেই জোগাড় করে নেবে। পিংলা বলে কাজিকে, অতুলবাবু স্যর জিজ্ঞেস করলেন, তোর নিজের যোগ্যতা কী? কী কাজ করতে চাস তুই?
সে তখন তার পরিকল্পনা খুলে বলে স্যরকে। কোন কৃষিপ্রধান গ্রামে কারিগরি বিদ্যার একটা স্কুল গোছের খুলতে চায় সে। ছোট চাষীদের ছেলেমেয়েরা সাধারণত যায়ই না স্কুলে; যারা যায়ও একেবারে নীচের ক্লাসে কিছুদিনের জন্যে, তারাও আরব্ধ বিদ্যে ভুলতে শুরু করে প্রায় শেখার সঙ্গে সঙ্গেই। আর না ভুললেও বড় হয়ে কোন-একটা অর্থকরী কাজে
সে-বিদ্যে যে লাগাতে পারে না তাতে তো কোন সন্দেহই নেই। তাই চাষার বেটা এই বাংলায় চিরকালই চাষা। অর্থাৎ সীনিয়র চাষার যদি সামান্য কিছু জমি থাকেও, ভাগাভাগিতে তার সন্তানদের প্রত্যেকের ভাগে যেটুকু জমি পড়ে থাকে তাতে চাষ করে পেট ভরে না। অতএব, বড় জোতদার বা জমিদারের ক্রীতদাসের জীবনের বিকল্প প্রায় কিছুই এদের নেই। পিংলা মনে করে, এই ছেলেমেয়েদের সাধারণ গণিত এবং ভাষা শেখাবার উপযুক্ত উচ্চ-প্রাথমিক স্কুলের সঙ্গে চামড়ার কাজ, বয়ন-শিল্প, ফলিত-বিজ্ঞান ভিত্তিক কৃষিবিদ্যা, দর্জির কাজ, রোগীর সেবা ইত্যাদি মিলিয়ে শিক্ষা দেবার মতো স্কুল প্রয়োজন। আপাতত একটা গ্রামে একটাই মাত্র স্কুল খুলতে চায় সে।
স্যরের সঙ্গে পতিসরে কাজ করেছে পিংলা, স্যর তাকে ভালোই চেনেন। তিনি মনে করিয়ে দিলেন, এই বাংলায় যে-গ্রামেই সে কাজ করতে যাক, ঠিক গুরুদেবের মতো জমিদার পাওয়া খুব সুলভ হবে না, এবং জমিদারবাবু যদি সক্রিয় সাহায্য না করেন, তাহলে কোন গ্রামে গিয়েই ঠিক এ-ধরনের কাজ সহজে করা যাবে না। অনেক আলোচনার পর স্যর বললেন, জমিদারের প্রভাব কম আছে এমন গ্রাম খুঁজে বের করা দরকার। ইদানিং দেশি এবং বিদেশি ব্যবসায়ীরা নানারকমের কারখানা খুলছে নানা জায়গায়। যেহেতু এই ধরনের কারখানায় অশিক্ষিত অপটু অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়, অতএব আশপাশের গ্রাম থেকে কর্মঠ শ্রমিক যোগাড় করে এরা। এরা সম্পদশালী, এবং যে-অঞ্চলে কারখানা সেই অঞ্চলে অনেকটা জমিও এরা কিনে নেয়। সাধারণত কোন একজন দাপুটে জমিদারের গ্রাম এগুলো নয়। যদি কোন দাপুটে জমিদার থেকেও থাকে কখনও, ওই বড় কারখানা তাদের চরিত্র বদলিয়ে দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে স্যর হাওড়া জেলার কথা বলেন। বলেন, হাওড়ার কথা বলছি, এখানে গঙ্গার পার ধরে অনেক কারখানা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তবুও, এমনকি এখানেও, এই ধরনের গ্রাম খুব বেশি দেখতে পাবি না। তবে হ্যাঁ, ওই দাপুটে জমিদার যাদের বলছিলুম তাদের সংখ্যা খানিকটা হলেও কমেছে যে হাওড়ায়, এ-ও ঠিক। স্যর তো নিজে বাগনানের প্রধান শিক্ষক ছিলেন অনেকদিন, বললেন, তোকে আমি বাগনান থেকে খুব বেশি দূর নয়, এমন একটা গ্রামে নিয়ে যেতে পারি। শ্যামপুর নাম। ওই গ্রামের বেশ কিছু ছেলে আমার ইশকুলে পড়ত, এখনও যোগাযোগ খানিকটা রাখে। এরা যে সবাই অশিক্ষিত চাষাদের বাড়ি থেকেই আসতো তা নয়, কিন্তু এমনটাও নয় যে জমিদারের বাড়ি থেকে আসতো। জমিদারের ছেলেরা সাধারণত গ্রামের ইশকুলে পড়ে না। যাদের কথা বলছি, বাড়ির বেশ খানিকটা জমি থাকলেও জমির আয়ই এদের বাড়ির একমাত্র আয় নয়। তুই যদি চাস, আমি তোকে এদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে পারি, তুই কথা বলে দেখ, তোর কী মনে হয়। সঙ্গে এরা থাকলে তোর হয়তো কাজের সুবিধেই হবে।
শান্তিনিকেতনে ফিরে সিনেমার রীল আর প্রোজেক্টর নিয়ে কাজিদার সেখানে আসার খবর শুনে আফশোষ হয়েছিল পিংলার। আবার যেদিন শ্যামপুরে আসবে সেদিনই শ্যামপুর থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে কাজিদার সঙ্গে একবার দেখা করে আসতে হবে ভেবেছিল। কিন্তু স্যরের সঙ্গে শ্যামপুরে আসাটাও যে কাজের হয়েছে সন্দেহ নেই। পরের দিন গুরুদেব ওকে আর অতুলবাবুকে ডেকে ওদের শ্যামপুর অভিযানের খোঁজ-খবর নিয়েছেন। পিংলাকে বলেছেন, যা আপাতত বুঝছি, শ্যামপুরে তোকে অনেকবারই যেতে হবে। লেগে থাক। তবে এখনই কয়েকটা কথা আমি তোকে বলে দিই। মনে রাখবি, তোর আর অতুলবাবুর সুবাদে শ্যামপুর এখন আমাদের শান্তিনিকেতনেরই প্রজেক্ট, আর সেই প্রজেক্ট সামলাচ্ছিস তুই। তুই শান্তিনিকেতনের প্রতিনিধি হিসেবেই শ্যামপুরে কাজ করতে যাচ্ছিস। অতএব, তোর যাতায়াতের এবং সারাদিনের খরচ শান্তিনিকেতনের। আমি বলে দেব, তুই ভাউচারে সই করে পেমেন্ট নিয়ে নিবি। আর এখান থেকে মাসিক যে-বেতনটা তুই পাস, সেটাও চলবে। মনে রাখবি, গরীব মানুষদের সঙ্গে কাজ করতে যাচ্ছিস। যতদূর সম্ভব ওদের সম্মান বাঁচিয়ে ওদের পয়সা-খরচ যেন না-হয় সেটা দেখতে হবে। খাওয়া-দাওয়াও হয়তো ওদের বাড়িতে কখনো কখনো তোর করতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে – তুই বুদ্ধিমান ছেলে – ঠিক কী উপায়ে ওদের আর্থিক দায়টা নিজে নিতে পারিস সেটা তোকেই ঠিক করতে হবে। আর একটা কথা, কোন অবস্থাতেই ওদের কারো বাড়িতে রাত কাটাবি না। যদি কোন কারণে বোলপুরে ফিরে আসা সম্ভব না হয় – তোর তো হাওড়াতেই বাড়ি শুনেছি – সেখানেই চলে যাবি। স্যর তখন বললেন, ওর বাড়ি হাওড়া সহরে, শ্যামপুর থেকে সন্ধ্যের পর হাওড়ায় ফিরে যাবার কিছু পাওয়া খুব সহজ হবে না। যাই হোক, স্থানীয় চাষাদের বাড়িতে রাত্তিরে না থেকে, প্রয়োজন হলে বাগনানে বা শ্যামপুরে অন্যরকম ভাবে যাতে রাতে ও থেকে যেতে পারে সেটা আমি দেখে নেব। বোঝা গেল, শ্যামপুরে গিয়ে পিংলা মোটামুটি উৎসাহ পেয়েছে, এরই মধ্যে দিন-তিনেক একাই ও শ্যামপুর থেকে ঘুরে এসেছে, মানুষজনের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেছে।
কাজিদার সঙ্গে দেখা করতে আসবার আগেই পিংলা সুধাকান্তদাদাকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দিয়েছিল। শান্তিনিকেতনে যখন গোরা দেখানো হয়েছিল তখন যারা দেখেছে তাদের যে খুবই ভালো লেগেছে এই সিনেমা, তা কাজিদাকে জানায় সে। রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়াও কাজিদার নিজের একটা গানেরও প্রয়োগ তাদের অনেকেরই খুবই ভালো লেগেছে, এ-খবরও ও জানিয়ে দিল। সে-গানের দু'লাইন বলেও দিল পিংলা, মুখে মুখে শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে তার: ঊষা এল চুপি চুপি রাঙিয়া সলাজ অনুরাগে / ভীরু নববধূ সম তরুণ অরুণ বুঝি জাগে।
নিজের সিনেমা করার প্রসঙ্গটা তুলতে চাইছিল না কাজি, পিংলার ইচ্ছে অনুযায়ী ওর সিনেমার কাজ যে এগোয়নি তা শুনতে পিংলার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে না। কলগীতির কথাটাও উঠল না – কাজি খুশিই হল তাতে।
এবং আবার গ্রামোফোন কম্পানীর রিহার্স্যাল রূমে ফিরে যাওয়া কাজির, তা-ছাড়া নাটক আর সিনেমার গান। কিছুদিন পরেই মুক্তি পেল দেবদত্ত ফিল্ম্সের গ্রহের ফের, পরিচালনা করেছেন চারু রায়, সঙ্গীত পরিচালনা কাজির, এবং যথারীতি প্রধান সঙ্গীতকারও সে। এই সিনেমার সংলাপ লিখেছে কাজির বন্ধু প্রেমেন, ওর সঙ্গেই কথায়-কথায় নাটক আর সিনেমার সংলাপের পার্থক্য নিয়ে আড্ডা হল অনেকক্ষণ। নিজের রচিত সংলাপের নাটকীয় বিকল্প মুখে মুখে বানিয়ে শোনায় প্রেমেন; সত্যিই তো, সিনেমার সংলাপ নাটকীয় হলে সিনেমাটা যাত্রা-যাত্রা মনে হয় – এই কথাটা হৃদয়ঙ্গম করল কাজি। চার রকমের দৃশ্যকাব্য – নৃত্য যাত্রা নাটক আর সিনেমা – এর প্রত্যেকটার আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা জমে উঠল ওদের। প্রেমেন কথা দিল ওর পরের ছবির সম্পাদনা যখন হবে, তখন কাজিকে খবর দেবে ও, কাজি সঙ্গে থাকলে সম্পাদনার মান যে ভালো হবে সে-বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই প্রেমেনের।
এরই মধ্যে একদিন সকাল দশটা-সাড়ে দশটায় একে-ওকে জিজ্ঞাসা করতে করতে রেকর্ড কম্পানীর রিহার্স্যাল রূমে হাজির বীরেন। বীরেন? বীরেন সেনগুপ্ত? – তাকে দেখতে পেয়ে খুশি কিন্তু বিস্মিত কাজি জিজ্ঞেস করে – কী খবর? এখানে কীভাবে এলে?
আমি একে-ওকে জিজ্ঞাসা করে করে এসে গেলাম, কিন্তু খবর ভালো নয়, মা গত ছ' মাস ধরে অসুস্থ। তোমাকে দেখবার জন্যে ছটফট করছে।
কোথায় আছেন?
আমাদেরই এক আত্মীয়র বাড়িতে, কখন যেতে পারবে?
এখনই, বলে পাশের ঘরটায় ঢুকে কাউকে কিছু-একটা বলে বীরেনের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে কাজি, যেখানে অসুস্থ বিরজাসুন্দরী আছেন সেখানে পৌঁছতে বেশি সময় লাগে না।
মা-ছেলে – দুজনের চোখেই জল। কী হয়েছে তোমার, মা? – জিজ্ঞেস করে কাজি।
বীরেন এবং ইন্দ্রকুমার অবাক হয়ে অনেকদিন পর বিরজাসুন্দরীকে এমন ভাবে কথা বলতে দেখেন। দুলি কেমন আছে রে? আর দিদি?
ভালো আছে মা, ও-বেলা নিয়ে আসব ওদের।
সারাদিন ধরে গল্প হয় মা-ছেলের। মায়ের আদেশে গানও শোনায় কাজি, তারপর বলে, ওদের নিয়ে আসি, মা।
শয্যাশায়ী বিরজাসুন্দরীকে দেখে চোখে জল গিরিবালার, জল প্রমীলার চোখেও, দুলি যার আদরের নাম। বিরজা বলেন, এবার আমি শান্তিতে মরতে পারব। ছেলে আমায় কীর্তনও শুনিয়ে দিয়েছে। তারপর হাসেন, বলেন, অদ্যাপিও সংকীর্তন করে গোরা রায়, কোনো কোনো ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়। আমার ভাগ্য!
দুদিন পরেই দেহত্যাগ করেন বিরজাসুন্দরী, দুলি বাড়ি ফিরে বলে, আমার পায়ে কেমন যেন ঝিঁঝি ধরার মতো লাগছে।
পায়ে ঝিঁঝি ধরার মতো, ও আর এমন কী ব্যাপার!– দু'চার দিন এমনিতেই কেটে গেল। কয়েকদিন পর আর ঝিঁঝি ধরা নয়; দুলি বলে, পা কেমন যেন অবশ অবশ লাগছে, পড়েও গেল সে একবার। বাড়ির কাছাকাছি নরেন ডাক্তার, সে দেখে শুনে বলল, টাইফয়েড মনে হচ্ছে। ওষুধ দিল, দুবেলা টেম্পারেচার চার্ট, খাওয়াদাওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা। কেটে গেল সপ্তা' দুয়েক, পায়ের অসাড়তা মনে হয় বেড়েছে খানিকটা। সারাদিন শুয়ে থাকা। কষ্ট করে বিছানা ছেড়ে উঠতে গেলে দম বন্ধ হয়ে আসছে মনে হয়।
এদিকে শচীন সেনগুপ্তর সিরাজদ্দৌলা নাটকের রিহার্স্যাল চলছিলই, কয়েক সপ্তাহ পর নাট্যনিকেতনে তার উদ্বোধনী প্রদর্শন। এই নাটকের জন্যে অনেকগুলো গান লিখে দিয়েছে কাজি, সঙ্গীত-পরিচালনাও তার, রিহার্স্যালও চলছে জোর কদমে। নরেন ডাক্তার বলল, মনে হয় রোগনির্ণয় করতে পারিনি ঠিকমতো। এখন তো মনে হচ্ছে পক্ষাঘাতের দিকে যাচ্ছে, আপনি একটু বড় ডাক্তার দেখাবার ব্যবস্থা করুন। বড় ডাক্তারের নাম-ঠিকানাও লিখে দিল সে।
সিরাজদ্দৌলা খুব ভালো চলছে। গ্রামোফোন কম্পানী সুযোগ নিতে ছাড়ল না। সম্পূর্ণ নাটকের রেকর্ডও বেরিয়ে গেল বাজারে। খুব হৈ হৈ, কিন্তু এই হৈ হৈ-এ অংশ নিতে পারছে না কাজি; প্রমীলার কোন উন্নতি হয়নি, দিবারাত্র শুয়েই থাকতে হচ্ছে তাকে। এবং যার কোমরের নীচের অংশে কোন সাড়ই নেই, কোমরের ঠিক ওপরেই শরীরের পেছন দিকে তার একটা ফোড়ার মতো, অসহ্য যন্ত্রণা। ফোড়া বলছেন কেন? – বড় ডাক্তার প্রশ্ন করে, মুখ আছে? দেখতে হবে রোগীকে। নিয়ে আসতে পারবেন?
গাড়ি আছে যদিও, কাজি সাহস পায় না রোগীকে নড়াচড়া করাতে। ডাক্তারকে বাড়ি নিয়ে যায় সে। বেড সোর, বলে ডাক্তার, কীভাবে পরিষ্কার রাখতে হবে নির্দেশ দেয় সে গিরিবালাকে। বলে দেয়, এক ভাবে বিছানায় ফেলে রাখবেন না,
মাঝে-মাঝেই পাশ-ফিরিয়ে দেবেন। আরো বলে, মনে রাখবেন, বেড সোর-এর কোন চিকিৎসা নেই; প্রপার নার্সিং, ঠিকমতো রোগীকে পরিষ্কার রাখা, আর প্রতিদিন ভালো করে তার শরীরে এবং গায়ের চামড়ায় কী কী অসুবিধে হচ্ছে সেগুলো লক্ষ্য রাখাই বেড সোর-এর চিকিৎসা। যে-রোগীর বিছানা ছাড়া উপায় নেই তাকে ওই বিছানার কবল থেকে মুক্ত করাই আমাদের চেষ্টা। আপনি রোগীর মা, অনেকটাই এখন আপনার সেবার ওপর নির্ভর।
ধীরেন দাস নামে গ্রামোফোন কম্পানীর এক শিল্পী – সে আবার চাকরিও করে গ্রামোফোনেই এবং থাকেও সে শ্যামবাজারে প্রায় কাজির বাড়ির পাশেই; কাজির সে নিকটতম প্রতিবেশী, সে খবর দেয়, বেহালা ছাড়িয়ে ডায়মণ্ড হারবার রোড ধরে আরও মাইল আষ্টেক দূরে কদমতলা নামে গ্রাম আছে একটা, সেখানে এক ভূতসিদ্ধ সাধক আছেন। তিনি আশ্চর্য রকমের চিকিৎসা করেন, স্বয়ং ভূত এসে ওষুধ দিয়ে যায়, যাবেন নাকি একবার? এইসব ভূতসিদ্ধ সাধক, তান্ত্রিক, হাতবাঁধা বাবাজি-ফকিরদের কাজি তো ভক্ত স্কুলের সময় থেকেই। পরের দিন নলিনীদাকেও গাড়িতে তুলে ভূতসিদ্ধর বাড়িতে পৌঁছয় সে। সব শুনে, বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায় সাধক, বোধ হয় ভূতের সঙ্গে পরামর্শ করতেই যায় সে, বাইরে অপেক্ষা করে কাজিরা তিনজন। ঘন্টাখানেক পর সাধক বেরিয়ে আসে, দেখে বিরাট বড় গাড়িতে বসে থাকা অপেক্ষমান কাজিদের। সে ওষুধ দেয়, এবং যথারীতি ওষুধ স্পর্শ করার পরমুহূর্ত থেকেই নির্জলা উপবাস করে পরের দিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই ওষুধ প্রয়োগের নিয়মনীতিও বাতলায়। অনেক আশায় বুক বেঁধে বাড়ি ফেরে কাজি।
পরের দিন ভোরবেলা, অন্ধকার তখনও কাটেনি, ভূতসিদ্ধ হাজির কাজির বাড়িতে। ওষুধ-প্রয়োগ নিবারণ করে সে, এবং রোগীকে নিজে দেখতে চায়। দেখা শেষ হলে আগের-দিনের-দেওয়া ওষুধ সে ফিরিয়ে নেয়। সে বলে, এই ওষুধ প্রয়োগের আগে শরীরে ওই যে ক্ষত আছে – যেটাকে বেড সোর বলছেন আপনারা – সেটা নির্মূল করতে হবে। নতুন করে ওষুধ দেয় সে, এবং দশদিন পর তার সঙ্গে আবার দেখা করবার নির্দেশ দিয়ে ফিরে যায়। যাবার আগে সে বলে যায়, এই দশদিন একাসনে তাকে সাধনা করতে হবে; কোনমতেই, কোন অবস্থাতেই, কাজি বা তার প্রেরিত কেউ সাধকের সঙ্গে তার আগে যেন দেখা করার চেষ্টা না করে!
দশদিনও লাগল না, দিন সাতেকের মধ্যেই বেড সোর সম্পূর্ণ নির্মূল! বড় ডাক্তার যে-রোগের কথায় বলেছিলেন, এর কোন চিকিৎসা নেই, সেই রোগ সাতদিনেই উধাও! ঠিক মানুষটিকে দুলির চিকিৎসার জন্যে অবশেষে পাওয়া গেছে ভেবে অসম্ভব উত্তেজিত কাজি। ভূতসিদ্ধর নির্দেশ অনুযায়ী আরও তিনদিন অপেক্ষা করবার পর সকাল-সকালই সবান্ধব কাজি হাজির ভূতসিদ্ধর বাড়িতে।
সেদিন আপনারা ওষুধ নিয়ে চলে যাবার পরেই কেন জানি আমার মনে হল ভুল হয়ে গেছে কোথাও, বলে ভূতসিদ্ধ। এ তো সাধারণ অসুখ নয়, মানুষের মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে ভূতরা দেখতে আসে মৃত্যুপথযাত্রীকে। আপনারা যখন আপনার স্ত্রীর খুড়িমাকে দেখতে গিয়েছিলেন, তখনই, যে ভূতরা এসেছিল খুড়িমাকে দেখতে, তাদের একজন আপনার স্ত্রীর শরীরে প্রবেশ করে। ওই যেটাকে বেড সোর মনে করেছিলেন আপনারা, সেটা তারই কামড়ের চিহ্ন। আমি দেখেই বুঝেছিলুম, আর উপযুক্ত ওষুধও দিয়ে এসেছিলুম।
হঠাৎ অসম্ভব উত্তেজিত দেখতে লাগে কাজিকে। সে বলে, এমন সত্যিই হয়?
আপনার কি সন্দেহ হচ্ছে? – ভূতসিদ্ধ জিজ্ঞেস করে, বলে, তাহলে আপনি ডাক্তারের কাছেই যান।
আমি সে কথা ভেবে বলিনি, বলে কাজি, আমার শাশুড়ি ঠাকরুনও ক'দিন ধরেই খানিকটা ওরকমই বলছেন। তিনি বলছেন, ঘুমোলেই তাঁর মনে হয় তাঁর ছোট জা, অর্থাৎ আমার স্ত্রীর খুড়িমা, আমার স্ত্রীর কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছেন। কয়েকদিন আগে আরও একটা কথা বললেন। আমাদের বাড়িতে পাড়ার একটা মেয়ে কাজ করত। বেশিদিন করেনি, মাস দুয়েক। তারপর রাস্তায় তার একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়। বেলগাছিয়ার মেডিকাল কলেজে মেয়েটি মারা যায় তারপর। আমার শাশুড়ি একদিন বললেন, তিনি স্বপ্নে সেই মেয়েকে দেখেছেন। সে খোলা চুলে আমার স্ত্রীর সামনে নাচছে। তাকে নাচবার কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে নাকি বলেছে, সে বাবা তারকনাথের উপোস করছে।
ঠিকই বলেছেন আপনার শাশুড়ি, বলে ভূতসিদ্ধ। সম্ভবত ওই মেয়ের ভূতই ঢুকেছে আপনার স্ত্রীর শরীরে, আর খুড়িমা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন ওর আক্রমণ রুখতে। যাই হোক, বলতে থাকে ভূতসিদ্ধ, গত দশ দিনে ওকে – মানে ওই ভূতকে – আমি অনেকবার নামিয়ে আমার কাছে নিয়ে এসেছি। ওকে বুঝিয়েছি ও ভুল মানুষকে ধরেছে। তাকে ছেড়ে ওর চলে যেতেই হবে। ও রাজি নয়। অনেক ভয় দেখিয়েছি আমি, তবুও ছেড়ে যেতে ও রাজি নয়। এখন রাস্তা একটাই। ভূত তাড়াবার মহৌষধ একজন ভূতকে দিয়েই আমি তৈরি করিয়ে নেব। কিন্তু শুধু যে সময় লাগবে তাই-ই নয়, অনেক কষ্ট অনেক খরচ। পেরে উঠবেন আপনি? সময় ধৈর্য এবং খরচ, এ-চিকিৎসায় এই তিনটের কোনটাই কম হলে চলবে না।
খরচ নিয়ে আপনি ভাববেন না, বলে কাজি, আমার যা আছে সব আমি খরচ করতে রাজি আছি। আমার স্ত্রীকে ভালো করে দিন আপনি।
আপনি চিন্তা করবেন না, বলে ভূতসিদ্ধ, আপনাকে একটা শেকড় আমি দেব আজ। এটা বেটে যতটা হবে সেটা তিরিশ ভাগ করবেন, সেই ভাগ থেকে পনের দিন রোজ দুবেলা খাওয়াবেন, তারপর আমার সঙ্গে দেখা করবেন আবার।
টাকা-পয়সা নিয়ে আর একটাও কথা বলে না লোকটা। উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত দেয় কাজি; যত টাকা ছিল সঙ্গে সব বের করে আনে, বলে, আজ যা আছে সব দিয়ে যাচ্ছি।
গম্ভীর মুখে ভূতসিদ্ধ বলে, টাকাপয়সা আমাকে দেবেন না, টাকা আমি ছুঁই না। মেঝেতে একটা জায়গা দেখিয়ে বলে, ওখানে রেখে যান।
ফেরবার সময় নলিনী জিজ্ঞেস করে কাজিকে, কত টাকা দিলে?
কাজি বলে, বেশি নয়। তৈরি হয়ে আসিনি তো।
নলিনী বলে, এই লোকটিকে দিয়ে চিকিৎসা যদি চালাতেই চাও, বরদাবাবুর সঙ্গে তার আগে একবার পরামর্শ করে নিলে হয় না?
দেখ, বলে কাজি, দাদা মহাগুরু। তাঁর পরামর্শ সব সময়ই নেওয়া যায়, কিন্তু তিনি তো ঠিক ভূতের ওঝা ন'ন। তা ছাড়া, এই লোকটি তো – বেড সোরই হোক বা হোক ভূতের কামড়ই – সাত দিনের মধ্যে সারিয়ে তো দিল। অতো বড় ডাক্তার বলেছিলেন এর কোন চিকিৎসাই নেই! আমি তাই আপাতত অন্তত কিছুদিন এর ওপরেই ভরসা করতে চাই।
তিন মাস এবং মুঠো মুঠো টাকা খরচের পরেও যখন কোন উন্নতিই দেখা গেল না, কাজি তখন প্রায় ভেঙে পড়েছে। এর মধ্যে গুরু বরদাচরণকে চিঠি লিখে সবই জানিয়েছে সে। পোস্টকার্ডে জবাব এসেছে সেই চিঠির। তিনি লিখেছেন, কোন্ জন্মে কৃত কোন্ অপরাধের কী ফল কখন হয়, তা সাধারণ মানুষ আমরা কী জানি? যা ঈশ্বরদত্ত তা সুখেরই হোক বা কষ্টের, আমাদের মেনে নিতেই হয়। ঈশ্বরের বিধানের ওপর মানুষের কোন হাত নেই। ক্ষুদ্র মানবশিশু, আমরা চেষ্টা নিশ্চয়ই করে যাব। দূরে যে আলোকবর্তিকা দেখা যাচ্ছে তা যে আলেয়া নয়, এই বিশ্বাসটুকু নিয়েই আমাদের চলতে হবে। অ্যালোপ্যাথ হোমিওপ্যাথ কবরেজ বা যা-ই হোক, নিরাময় করা যার কাজ তার ওপর ভরসা না করে আমাদের উপায় নেই। ওই পোস্টকার্ডেই এক লাইনের একটি ছোট মন্ত্রও তিনি পাঠালেন। লিখলেন, একটি বিল্বপত্রে রক্তচন্দন দিয়ে মন্ত্রটি লিখে ওই বিল্বপত্রসহ সেটাও নিয়মিত খাওয়াতে হবে। নিরাশ না হওয়াই শ্রেয়, কিন্তু চূড়ান্ত ফলটি তাঁর নিজের বিবেচনা মতো দেবেন ঈশ্বরই।
কে যেন সেই সময় খবর দিল, বীরভূম জেলায় বেলে নামের কোন-একটা গ্রামে ধর্মঠাকুরের স্থানের মাটি এবং সংলগ্ন একটা ডোবায় জন্ম-নেওয়া একধরণের জলজ উদ্ভিদ নাকি প্রমীলার অসুখের অব্যর্থ ওষুধ। গ্রামটা কোথায়? অনেকেই এই গ্রামের নাম শুনেছে, বীরভূমে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রাম লাভপুর থেকে সেখানে যাওয়ার সুবিধে। তারাশঙ্কর তখনও ততটা বিখ্যাত হননি, কাজির নাম তিনি শুনেছেন, তার কবিতা এবং সঙ্গীতের খবরও তিনি রাখেন, কিন্তু মুখোমুখি পরিচয় দুজনের হয়নি। নলিনীর সঙ্গে অবিশ্যি আলাপ ছিল তারাশঙ্করের, শনিবারের চিঠির অফিসে পরিচয়। নলিনীই টেলিগ্রাম করে তাঁকে জানাল কবে কোন ট্রেনে তারা লাভপুর পৌঁছবে। নির্দিষ্ট দিনে এবং সময়ে তারাশঙ্কর স্টেশনে ওদের সঙ্গে দেখা করলেন, এবং জানালেন, সেই দিনই তাঁর এক পুত্রের মৃত্যু হয়েছে। তৎসত্বেও তিনি একখানা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন বেলে গ্রামে যাবার জন্যে, এবং ওদের আপত্তিতে কর্ণপাত না করে তাঁর বাড়িতেই রাতে ওদের আতিথেয়তা এবং শয়নের বন্দোবস্তও করলেন। ডোবায় নেমে উদ্দিষ্ট উদ্ভিদটি সংগ্রহ করে ওরা লাভপুরে ফিরল, পরের দিন স্থানীয় ফুল্লরা মন্দিরে প্রার্থনা করে এবং গ্রামের সমবেত মানুষদের গান শুনিয়ে কলকাতায় ফিরে এল ওরা।
জলজ ওষুধটির প্রয়োগও চলল, বরদাচরণ যা লিখেছিলেন তার থেকে কাজি বুঝেছিল আশু উপকার বোঝা যাক বা না-ই যাক, আরোগ্যের চেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে। ভূতসিদ্ধ লোকটি অন্তত বেড সোরের চিকিৎসাটা সাফল্যের সঙ্গেই করেছিল। কাজেই, অর্থদণ্ড যতই হোক, তার চিকিৎসা, এবং নানা মানুষের পরামর্শে আরও নানারকমের চিকিৎসাও চলতে লাগল। কাজি বরদাচরণের চরণে নিবেদন করে লিখল, আপনার নির্দেশ মতো বিল্বপত্রে রক্তচন্দনে লিখিত মন্ত্র আপনার বৌমাকে নিয়মিত খাওয়াচ্ছি। ভূতসিদ্ধের ওষুধ, বেলেগ্রামের জলজ চিকিৎসা, সবই চলছে, জানি না আপনার নির্দেশ ঠিকমত বুঝেছি কিনা। দুর্বল মানুষ এমনিই মতিচ্ছন্ন হয়।
অন্তত তিন-চারবার কাজি গুরু বরদাচরণকে লিখেছে, আপনি যদি একবার আপনার বৌমাকে নিজের চোখে দেখে যান; আপনি প্রত্যক্ষ শিব, আপনার পদধূলি যদি তার মস্তকস্পর্শ করে, আমাদের পরিবারের সকলের স্থির প্রত্যয়, তার চেয়ে ফলপ্রসূ চিকিৎসা আর কিছুই হতে পারে না। আপনি যদি অনুমতি দেন, আমি নিজে গিয়ে আপনাকে এবং ছেলেদেরসহ পূজনীয়া বৌদিকে নিয়ে আসতে পারি। আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে নিরাশ ভাববেন না, আমার শ্রীবরদাচরণ ভরসা।
অবশেষে কয়েকমাস পরে বরদাচরণ এলেন। তবে কাজির বাড়িতে সোজা নয়, তাঁর ধনী ভক্ত কলকাতার ভবানীপুরে মল্লিকবাড়িতে। সেখানে অনেক জায়গা, ভক্তমণ্ডলীর যাতায়াতে গুরুসঙ্গে অসুবিধে হয় না। সারাদিনই সেখানে ধর্মালোচনা, তার ওপর দিলীপ রায় এবং নলিনীকান্ত সরকারের মতো ভক্তদের সঙ্গীতানুষ্ঠান। অবিশ্যি কাজির বাড়িতেও তিনি এলেন একদিন। তাঁকে প্রণাম করে হয়তো মানসিক শক্তি বাড়ল প্রমীলার, নজরুলেরও।
ঈশ্বর স্বয়ং যখন ভক্তের শারীরিক অবস্থার দায়িত্ব নিয়েছেন, তখন চিকিৎসার ফলের জন্যে অপেক্ষা করে লাভ কী? প্রমীলা সিদ্ধান্ত নিল, পক্ষাঘাতগ্রস্ত শরীরেই সে যথাসম্ভব স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে। ছোট একটা চৌকি হল তার সারাদিনের সঙ্গী। তার বিশ্রামের, তার সংসার পরিচালনার, এবং সংসারের প্রয়োজনে তার ঘরকন্না চালাবারও। সে সব্জী কাটে ওই চৌকিতে শুয়ে, মাছও কোটে। কাজি তার রান্না ছাড়া খেতে পারে না, চৌকিতে শুয়েই একটু পাশ ফিরে সে কাজির জন্যে রান্নাও করে দেয়।
আর কাজি? এতদিনে সে বালিগঞ্জের জমি হারিয়েছে। ক্রাইসলার গাড়ি সে কিনেছিল সুদ-আসল মিলিয়ে সম্পূর্ণ মূল্য মাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করার চুক্তিতে। প্রমীলা অসুস্থ হবার পর থেকে সেই কিস্তি মাসের পর মাস জমা পড়েনি, গাড়ি ফেরত চলে গেছে বিক্রেতা কম্পানীর কাছে। বাজারে আরও নানা খুচরো ধার, কাজি হিসেব করে দেখেছে তার পরিমাণ চার হাজার টাকার কম নয়।
ভক্তের মন খারাপ হলে গুরুর অজানা থাকে না তা। বরদাচরণ একদিন জিজ্ঞেস করেন তাঁর কাজিভায়াকে, বৌমা তো তার মনের জোর দেখিয়ে দিল। আমি হতচকিত হয়ে গেছি ওর মানসিক শক্তি দেখে। ও সাধারণ মেয়ে নয়, এরকম মেয়েরা আজও আছে, তাই আমরা তরে গেলাম। কিন্তু, তবুও তোমার মন খারাপ কেন, কাজিভায়া?
কাজি তার আর্থিক অবস্থার কথা খুলে বলে। শুনে, মিনিট কয়েকের জন্যে গম্ভীর মুখে চুপ করে বসে থাকেন বরদা। বলেন, আমি দায়িত্ব নিচ্ছি। ভরসা রাখ।
কলকাতার খ্য্যাতনামা সলিসিটর অসীমকৃষ্ণ দত্তর পুত্র অশোককৃষ্ণর প্রাইভেট ট্যুটর নলিনীকান্ত সরকার – তাদের বাড়িতেই অশোককে বাংলা পড়ায় নলিনী। অসীমবাবুর বাড়ির একতলায় সিঁড়ির মুখোমুখি একটা ঘরে অশোক-নলিনী পড়াশোনা করে। একদিন হঠাৎ পড়াতে পড়াতে নলিনীর চোখ পড়ল সিঁড়িতে। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ঊঠে যাচ্ছেন বরদাচরণ, সঙ্গে কাজি। নলিনী জানত, অসীমকৃষ্ণও বরদাচরণের একজন ভক্ত।
এ-ব্যাপারে কাজি কিছুই বলেনি নলিনীকে।
বেশ কিছুদিন পর জানা গেল গ্রামোফোন-কম্পানী প্রযোজিত কাজি নজরুল ইসলামের যাবতীয় রেকর্ড এবং তার লিখিত সমস্ত গ্রন্থের রয়ালটি বন্ধক রেখে অসীমকৃষ্ণ কাজিকে চার হাজার টাকা নগদে ধার দিয়েছেন। মাত্র চার হাজার টাকা!
আইন-অনুবর্তী এই ব্যবস্থাটার ব্যাপারে এমনকি বন্ধুমহলেও কাজি নীরব থাকায় এর প্রতিক্রিয়া বুঝতে সময় লাগল সবায়েরই। গ্রামোফোন কম্পানী এবং পুস্তক-প্রকাশনীর যাবতীয় রয়ালটির টাকা সোজা পৌঁছতে লাগল অসীমকৃষ্ণর
ব্যাঙ্ক-অ্যাকাউন্টে, কাজির ভাঁড়ার শূন্য! নতুন শিল্পীদের প্রশিক্ষণ-বাবদ কাজির জন্যে একটা মাসোহারা বরাদ্দ করেছিল গ্রামোফোন কম্পানী; শুধুমাত্র সেটুকুতেই সংসার কি চলবে? বেতারের কাজও বাড়াতে হল তাকে। গত কয়েকবছর বাদ দিলে অভাব তো কাজির চিরসঙ্গী, আর সেই সঙ্গে লাগামছাড়া ঋণ। উনিশশো চল্লিশের জুন মাসেও কোর্টের নির্দেশে মাত্র বারোশো চল্লিশ টাকার ঋণশোধ করতে প্রতি মাসে সাড়ে বাহাত্তর টাকার কিস্তি জমা দিতে হয়েছে কাজিকে ঈস্টার্ণ য়্যুনিয়ন ব্যাঙ্কে! এ দিকে অসীমকৃষ্ণর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কতদিন ধরে কত টাকা রয়ালটি বাবদ জমা পড়েছে তা কি কেউ জানে?
কিন্তু প্রায় সবাই যা জেনে গেল কিছুদিনের মধ্যে, তা হল, কাজি এখন প্রায় নিঃস্ব।