এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • সীমানা - ২৫

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৮ মার্চ ২০২৩ | ২৪৯৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ছবি: সুনন্দ পাত্র


    ২৫

    অন্য রাজনীতি?



    হুগলি থেকে বহরমপুর জেল। এখানে পরিস্থিতি অনেকটাই অন্যরকম। কাজির কেমন যেন মনে হল এখানকার বন্দীরা অনেকে আগেই খবর পেয়ে গিয়েছিল কাজি নজরুল এখানে আসছে। অভ্যর্থনার জন্যে মনে মনে তৈরি ছিল না সে, কিন্তু তবুও তারই রচিত এ কোন পাগল পথিক ছুটে এল বন্দিনী মা'র আঙিনায় গেয়ে কয়েকজন বন্দী তাকে অবাক করে দেয়। অবাক করে দেয় ঠিকই, কিন্তু সেই সমবেত সঙ্গীত শেষ হতে-না-হতেই প্রায় সকলেরই একই সঙ্গে প্রস্থান! বেশ কিছুক্ষণের জন্যে একজনকেও দেখতে পাওয়া গেল না!

    জেল-এ নতুন এলে অনেকরকমের নিয়ম আছে। সেই সব নিয়ম; অনেক জায়গায় আঙুলের ছাপ, সই-সাবুদ, হুগলি জেলে জমা-রাখা টাকা-পয়সা বই-কাগজপত্র যা এবার আবার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে কাজি বহরমপুরে, সেগুলো জমা দেওয়া – এ সবই করতে হল। এমনকি সন্ধ্যের পর যে যার সেল-এ ফিরে যাবার আগে গুন্‌তি – সব বন্দী হাজির আছে কিনা তা মিলিয়ে নেওয়া – তা-ও হল। পরের দিন সকালে কিন্তু গুন্‌তির পর পরিবেশটা হঠাৎই বদলায়। বন্দীরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে, বারণ করার কেউ নেই। একজন নিজে থেকেই বলল, আমি একটা গান শোনাব এখন, তার পরের গানটা কিন্তু আপনিই গাইবেন কাজি সাহেব। একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি উদাত্ত কণ্ঠে গাইল সে, পরে কাজি শুনেছে এই বন্দী গায়কের নাম পূর্ণ দাস, ঘনিষ্ঠতাও হয়েছে তার সঙ্গে। কাজি নিজে গাইল রবীন্দ্রনাথের গান, এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন। গান-কবিতা আবৃত্তিতে জমজমাট। হুগলি জেলের পর এখানে এসে কাজি সত্যিই অবাক। বন্দীদের মধ্যে একজন ছিলেন জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি নজরুলকে বললেন, তোমার কাছে দুটি বিষয়ে অনুমতি চাই; এক, তুমি সম্ভাষণ আর দুই, কাজি নামে ডাকা।

    কাজি বলে, অনুমতি লাগে নাকি এর জন্যে?

    জিতেন্দ্র বলেন, এই জেলের বিষয়ে তোমাকে একটু ধারণা দিই। এখানে আমরা জেলের নিয়ম-কানুন থেকে অনেকটাই ছাড় পাই। প্রায় মুক্ত বিহঙ্গের মতোই থাকি আমরা। জেলের যিনি সুপার, বসন্ত ভৌমিক, অনেক উদার মনের মানুষ। নিজে বলেন না ঠিকই, আমাদের কিন্তু মনে হয় রাজবন্দীদের সম্বন্ধে বিশেষ সহানুভূতি আছে ওঁর। জেলের নিয়মকানুনের চেয়েও আমাদের সুখ-সুবিধের দিকেই ওঁর নজর বেশি। কিন্তু এতটা সুবিধে পাই বলেই আমাদের বিশেষ ভাবে সতর্ক থাকতে হয়। এমন কিছু যেন আমরা না করে বসি যে উনি অসুবিধেয় পড়ে যাবেন। সতর্ক বলতে আমি কী বোঝাতে চাইছি তা তুমি এখানে থাকতে থাকতেই বুঝে যাবে।

    কাজি বলল, অনেকটা এর মধ্যেই বুঝে গেছি। হুগলি জেলের পর এখানে – এ তো নরক থেকে স্বর্গে বদলি!

    কয়েকটা দিন ভালোই কাটল। এখানে বন্দী যারা কাজির বিদ্রোহী আর ভাঙার গান তারা প্রায় সবাই পড়েছে বা শুনেছে। ভাঙার গান লেখা হয়েছিল গান হিসেবেই, কিন্তু ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই সুর দেবার সময় পায়নি কাজি। সুর অবিশ্যি দেওয়া হয়েছে পরে, কুমিল্লায় অসহযোগ আন্দোলনের সময় প্রভাত-ফেরীতে গাওয়াও হয়েছে, কিন্তু সে-সুর কুমিল্লার বাইরে কাজি নিজে ছাড়া জানেনা এখনো প্রায় কেউই। পূর্ণকে একদিন কথায় কথায় বলে কাজি, একটা হারমোনিয়ম পেলে ভারী ভালো হত। ভাঙার গানে একটা সুর দিয়েছিলুম কুমিল্লায়। হারমোনিয়ম পেলে সবাইকে সুরটা শেখাবার চেষ্টা করা যেত।

    হারমোনিয়মও জুটে গেল কয়েকদিন পর। কে জুটিয়ে দিল, কীভাবে জুটল, সে বিষয়ে কোন আলোচনা নেই। জেলের ভেতরেই, কিন্তু নিজে যে সেলে থাকে তার বাইরে কোথাও ছিল কাজি, ফিরে এসে দেখে কেউ একটা কাঠের বাক্স রেখে গেছে ও যে চৌকিতে শোয় তার ওপরে, সেটার ওপর সাঁটা একটা কাগজ, তাতে লেখা হারমোনিয়ম। তালা-টালা কিছু দেওয়া নেই, বাক্সটা খোলে কাজি, ভেতর থেকে বের করে আনে হারমোনিয়মটা, তারপর এটা-ওটা রীড টিপতে টিপতে মনে মনে খুশিই হয়, বেশ ভালোই হারমোনিয়ম! চোখ বুজে প্রায় নিজের অজান্তেই সে গাইতে থাকে ভাঙার গানের কয়েকটা লাইন: কারার ওই লৌহ-কপাট / ভেঙে ফেল, কররে লোপাট / রক্তজমাট / শিকল-পূজার পাষাণবেদী। আর তারপর, পুরোটাই।

    এর মধ্যে হারমোনিয়মের শব্দ আর ওর গলার আওয়াজ পেয়ে কেউ কেউ উঁকি দিয়ে গেছে, গভীর মনোযোগের সঙ্গে ওকে হারমোনিয়মে ব্যস্ত দেখে বেরিয়ে গেছে তারা। উল্লসিত কাজি যখন পুরো গানটা উদাত্তকণ্ঠে গাইতে শুরু করল তখন কোথা থেকে যেন খবর পেয়ে এক দল এসে জোটে কাজি আর তার হারমোনিয়মকে ঘিরে। আর তারপর
    গান গাওয়া-গান শেখা – মস্ত হৈ হৈ! এরই মধ্যে জিতেন্দ্রলাল এসে হৈ হৈ থামান একটু: মনে রাখতে হবে আমরা জেলখানার বন্দী। সুপার সাহেব ভালোবেসে যে স্বাধীনতা দিয়েছেন আমাদের, সেটার অপব্যবহার শুধু যে তাঁরই ক্ষতি করবে তা নয়। আর-পাঁচটা জেলের কয়েদীর মতো আমাদেরও কিন্তু দুর্দশা হবে তাতে।

    অতএব, জিতেন্দ্রলালের এই সাবধানবাণীর পর এখন যে ঘটনা ঘটে জিতেন্দ্রলাল তার নাম দিয়েছেন উচ্ছ্বাসবিরতি। সকলেই কয়েক মিনিটের জন্যে চুপচাপ। তারপর একজন জিজ্ঞেস করে কাজিকে, হারমোনিয়মটা জোটালে কোথা থেকে? কাজি কোন কথা না বলে পূর্ণকে দেখিয়ে দেয়। পূর্ণ বলে, আমি নই। কোথা থেকে হারমোনিয়ম এসেছে আমার ধারণাই নেই। কথায় কথায় কাজি বলছিল একদিন, একটা হারমোনিয়ম পেলে ভালো হত। সেই কথাটাই আমি বলেছি অনেককে। সেই অনেকরাই হয়তো আবার বলেছে অন্য অনেককে। একটা কিছু যোগাযোগ ঘটে গেছে, এসে গেছে একটা হারমোনিয়ম, ভালোই তো।

    ভালো তো নিশ্চয়ই, এবার কথা বলেন আর একজন বন্দী, এঁর নাম বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, গান তো আমরা গেয়েই থাকি, এখন থেকে রোজ আমরা হারমোনিয়ম সহযোগে গাইব। এটা যাঁরই কীর্তি হোক, হারমোনিয়মটা যিনি এই জেলখানার ভিতর পাঠাবার বন্দোবস্ত করেছেন – তিনি নিশ্চয়ই কোন ক্ষমতাবান ব্যক্তি – তাঁর বাসনা নিশ্চয়ই এই যে হারমোনিয়মটা বাজুক। অতএব এখন থেকে আমাদের হারমোনিয়ম সহযোগেই গাইতে হবে।

    বিজয়বাবুর সঙ্গে বন্দীরা একমত, অতএব সমবেত হাততালি। এমন সময় ঢং ঢং ঘন্টা পড়ে, জেলখানায় এখন মধ্যাহ্নভোজের সময়। বন্দীরা আপন আপন সেল-এ ফিরে যায় দ্রুত। এমন সময় একজন ওয়ার্ডার নজরুলের কাছে গিয়ে চাপা স্বরে বলে, হারমোনিয়মের বাক্সে একটা খাম আছে। বলেই, অতি দ্রুত যেদিক দিয়ে এসেছিল তার উল্টোদিকে হেঁটে ফিরে যায় লোকটা।

    অচেনা ওয়ার্ডারের ফিসফিস বার্তাজনিত খানিকটা বিচলিত খানিকটা হতবাক অবস্থা থেকে ধাতস্থ হতে নজরুল একটু সময় নেয়। এর মধ্যে খাবার পরিবেশন শুরু হয়ে যায়, লাইনে দাঁড়িয়ে কাজিও খেয়ে নেয়, তারপর হারমোনিয়মের বাক্সটা খুলে একেবারে নীচে একটা বন্ধমুখ সাদা খাম দেখতে পায়। বেশ ভারী মোটাসোটা খাম। খামটা খুলে দেখা গেল একটা চিঠি। পিংলার লেখা! চিঠিটা খুলে সঙ্গে সঙ্গেই পড়তে শুরু করে কাজি :


    শান্তিনিকেতন,
    ১৬ই আগস্ট, ২০২৩


    প্রিয় কাজিদা,

    ঠিক দু'বছর পর তোমাকে চিঠি লিখছি। তোমার গ্রেপ্তারের খবর, কারাবাস এবং হুগলি জেলে অনশনের খবর, এসব আমরা সবাই খবরের কাগজ পড়ে জেনেছি। এখন যে তুমি বহরমপুরের জেলে, সে খবরও কাগজ মারফৎই পাওয়া গেছে। তোমাকে এতদিন কোন চিঠি লেখবার চেষ্টা যে করিনি তার কারণ, শুনেছি চিঠি তোমার নামে গেলে সম্ভবত তা তোমাকে দেওয়াই হবে না। শান্তিনিকেতনে এখন সকলেই জানে, তোমার অনশন যখন চলছিল সেই সময় এমনকি অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধ করে রবীন্দ্রনাথের পাঠানো টেলিগ্রামও তোমাকে দেওয়া হয়নি, অ্যাড্রেসী নট ফাউণ্ড-এর অজুহাত দেখিয়ে সেই টেলিগ্রাম ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে কবির কাছে। এই চিঠি যদি তুমি আদৌ পাও তাহলে কখন কীভাবে পাবে জানি না। সুধাকান্তদাদা আমাকে বলেছেন এখন বহরমপুরের জেলে যিনি সুপার, রাজবন্দীদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি আছে, সুধাকান্তদাদা নাকি শুনেছেন তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার স্বত্বাধিকারীদের আত্মীয় এবং তাঁর হাতে যদি চিঠিটা পড়ে তাহলে তেমন কিছু অসুবিধে না-থাকলে চিঠিটা তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা তিনি নিশ্চয়ই করে দেবেন। আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে খামটা আঠা দিয়ে ভালো করে এঁটে দিতে, খামের ওপরে প্রেরক বা প্রাপক কারো নাম থাকবে না, এবং ডাকটিকিট লাগানো চলবে না। ভেতরের চিঠিতে প্রাপককে নির্দেশ দিয়ে দিতে হবে যে, চিঠিটা পড়া হয়ে গেলেই ওটাকে যেন নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। প্রতিটা নির্দেশ মেনেই এবার চিঠিটা এবং খামটা তৈরি করলুম। সুধাকান্তদাদাকে দিয়ে দেব। তুমি যদি শেষ পর্যন্ত চিঠিটা পাও তাহলে পড়া হয়ে গেলে তোমাকে কী করতে হবে বুঝতেই পারছ।

    আমার শেষ চিঠিটা তোমাকে লিখেছিলুম শান্তিনিকেতন থেকেই, ১০ই আগস্ট রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার মিলনের পাঠ শুনে যে ঘোর তৈরি হয়েছিল মনে, সেই ঘোরেরই মধ্যে। তারপর আগস্টের মাঝামাঝি পতিসরে ফিরে গেছি, অতুলবাবু স্যরের সঙ্গেই। যথারীতি ব্রতীবালকদের সঙ্গে কাজ করছি। নভেম্বরের গোড়ার দিকে স্যর বললেন, পতিসরে তোর ছুটি হয়ে গেল। ছুটি হয়ে গেল? – খানিকটা অস্পষ্টতার মধ্যেই মনটা কেমন যেন হু হু করে উঠল, জিজ্ঞেস করলুম, কেন স্যর? স্যর বললেন, গ্রামোন্নয়নের কাজে এতদিন সরাসরি লেগেছিলি তুই, সত্যিকারের অভিজ্ঞতা ভালোই তৈরি হয়েছে তোর। গুরুদেব এখন তোকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দিতে বলেছেন। শান্তিনিকেতন থেকে মাইল দুয়েক দূরে সুরুল গ্রামে লর্ড সিন্‌হাদের কাছ থেকে একটা খামারবাড়ি গুরুদেব কিনেছিলেন বছর দশ-বারো আগে। ওই খামারবাড়িকে কেন্দ্র করে সুরুল-শান্তিনিকেতন অঞ্চলে নতুন করে একটা গ্রামোন্নয়ন উদ্যোগের পরিকল্পনা করছিলেন গুরুদেব গত কয়েকবছর ধরেই। এই নভেম্বরেই একজন সাহেব আসছেন বিলেত থেকে এই উদ্যোগের দায়িত্ব নিতে। এই কাজে গুরুদেব তোকে লাগিয়ে দিতে চান। ভাল করে যদি ওখানে শিখতে পারিস তাহলে তোকে দিয়ে হয়তো অন্য কোন বড় কাজ করাবার কথা ভাবছেন গুরুদেব। তাই এখানে তোর ছুটি। কালীমোহনবাবুকে তো তুই চিনিসই। তোকে এখানে নিয়ে আসবার আগে আমরা কালীমোহনবাবুর সঙ্গে কথা বলেছিলুম, মনে আছে তোর? সেই কালীমোহনবাবুর সঙ্গেই তুই কাজ করবি ওখানে। আমিও তোর সঙ্গে যাব। কালীমোহনবাবুর হাতে তোকে সঁপে দিয়ে ফিরে আসব আমি।

    পতিসর জায়গাটার ওপর একটা টান তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ওখানকার মানুষদের সঙ্গে প্রায় আত্মীয়তা। মনটা একটু খারাপ হলেও খোদ শান্তিনিকেতনে গিয়ে থাকা আর কাজ করার সুযোগ কতটা দুর্লভ এতদিনে আমি তা বুঝে গেছি। স্যরকে জিজ্ঞেস করলুম, কবে যেতে হবে স্যর?

    দুয়েকদিনের মধ্যেই যাব। মনে মনে তৈরি থাকিস।

    নভেম্বরের মাঝামাঝি যখন শান্তিনিকেতনে পৌঁছোলুম আমরা, তখনও সাহেব আসেননি। কিন্তু যে-ব্যাপারটা গিয়েই লক্ষ্য পড়ল তা হল শান্তিনিকেতনের পরিবেশের হঠাৎ-পরিবর্তন। তুমি তো জানই, ওই সময়টায় গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন একেবারে তুঙ্গে। আর, জানবে না-ই বা কেন, তুমি নিজেও তো অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলে। কুমিল্লায় প্রথম গিয়েছিলে নতুন করে বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেবে বলে, ফিরে এলে গান্ধী-শিষ্য অসহযোগী হয়ে! কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ যে যথেষ্ট আশাবাদী ন'ন সে তো আমরা এতদিনে প্রায় সবাই জানি, তবুও এখানকার – এই শান্তিনিকেতনের – ছাত্র এবং শিক্ষকদের মধ্যে একটা দল অসহযোগ ছাড়া আর কিছুই ভাবছেন না তখন। কয়েকদিন পরেই ব্রিটিশ যুবরাজের কলকাতায় আসবার কথা; সারা বাংলায় হরতাল হবে, তারই প্রস্তুতি চলছে। আমাকে অবিশ্যি কেউ কিছু বলতে আসেনি, কিন্তু দূর থেকে গান্ধীপন্থীদের উত্তেজনার আঁচ যে আমার গায়েও পৌঁচোচ্ছে না তা নয়। ফিসফাস শুনতে পেলুম, এক দল ছাত্র নাকি কলেজের ক্লাশ করছে না, গান্ধীজী আর তাঁর চেলাদের বোধ হয় সেরকমই নির্দেশ। তারা এবং এখানকার কোন কোন শিক্ষক আর কর্মচারি গ্রামবাসীদের
    আইন-না-মানা অসহযোগ বোঝাবার আশায় কাছাকাছি কোন গ্রামে কিছুদিন ডেরা বেঁধেছিল। ম্যালেরিয়ায় ভুগতে ভুগতে ফিরে এসেছে তারা। দেশের কাজ করতে চায় এরা, এখন সাহেব এলেই কবি এখন এই ছেলেদেরও সত্যিকারের গ্রামোন্নয়নের কাজে লাগাতে চান। সুরুলের খামারবাড়িতে নাকি গ্রামকেন্দ্রিক শিক্ষার ইশকুলও হবে। আমি মনে মনে ভাবছি আমার কী হবে। আমাকেও কি এই ইশকুলে ভর্তি করতে চান গুরুদেব?

    ব্যাপারটা একদিন পরিষ্কার করে দিলেন কালীমোহনবাবু স্যর। বললেন, তোর কাজ আপাতত আমাদের সঙ্গে থাকা। শুধুই সঙ্গে থাকা, কী কী আলোচনা হচ্ছে শোনা, আর বোঝবার চেষ্টা করা। চেষ্টা করলেই বুঝে যাবি। একুশ তারিখে সাহেবের আসার কথা, উনি এলেই ওঁর নির্দেশ মতো আমরা কাজে লেগে পড়ব। এই যে আমরা আমরা বলছেন স্যর, এই আমরা কারা? একজন হচ্ছেন গুরুদেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর; গুরুদেব নিজে, ওঁর সমবয়েসীরা আর বড়রা ওঁকে রথি বলে ডাকে। একজন গৌরগোপাল ঘোষ, ডাকনাম গোরা, মোহনবাগানের টীমে নাম-করা ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন এক সময়, ব্যাক; স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে পাশ করে অঙ্কের ডিগ্রী পেয়েছেন, এখানকার ইশকুলে অঙ্ক শেখান। এর পর সন্তোষ মজুমদার, কবির বন্ধুপুত্র, শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয়ের প্রথম দিকের ছাত্র, আমেরিকায় এগ্রিকালচার পড়ে এসে এখানকার ইশকুলে শিক্ষক আপাতত, এবং অবশ্যই কালীমোহনবাবু স্যর নিজে। একদিন হেঁটে হেঁটে সুরুলের খামারবাড়িটা দেখে এলুম, এখানেই সম্ভবত ভবিষ্যতে গ্রামোন্নয়নের শিক্ষার কেন্দ্র খোলা হবে। একদিন জানতে পারলুম সন্তোষ মজুমদার স্যরের একটা নিজস্ব খামার আছে। হাঁস-মুরগী এবং মৌমাছি পালন, গবাদি পশু কয়েকটা। সেটাও দেখা হল। আমার মনে হল, সুরুলের কাজ পুরোপুরি শুরু হয়ে গেলে এই খামারের আর আলাদা অস্তিত্বের প্রয়োজন হবে না।

    সাহেবের নাম এল্‌ম্‌হার্স্ট। একুশ তারিখে সকালের ট্রেনে তিনি আসেননি, রাত আটটা নাগাদ টেলিগ্রাম পাওয়া গেল সকালের ট্রেন ধরতে পারেননি তিনি, রাতের ট্রেনে আসছেন। রথীন্দ্রনাথ আর কালীমোহন স্টেশনে যাবেন সাহেবকে আনতে, আমাকেও সঙ্গে নিলেন। একটা গাড়ি ছিল সঙ্গে, বিশেষ কোন অসুবিধেই হল না; আসতে আসতে সাহেব বললেন, সকালে তিনি গিয়েছিলেন শিবপুরের বটানিকাল গার্ডেন দেখতে, জলপথে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে বোলপুরের ট্রেন ছেড়ে গেছে। খুবই ক্লান্ত ছিলেন, তাড়াতাড়ি ঘুমোতে চলে গেলেন।

    শান্তিনিকেতনে এসে এল্‌ম্‌হার্স্ট সাহেব মহা খুশি। গীতাঞ্জলি-মুগ্ধ এল্‌ম্‌হার্স্টের প্রথম-যৌবনের স্বপ্ন ছিল ভারতের কোন-একটা গ্রামে গ্রামোন্নয়নের কাজ করবেন, আর তা-ও, সম্ভব হলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে! উনিশশো কুড়িতে কবি যখন আমেরিকা গিয়েছিলেন, তখন একটা টেলিগ্রামে ন্যূয়র্কের হোটেলে তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে পরের দিনই তাঁর সঙ্গে ভারতে রওনা হবার আহ্বান জানান রবীন্দ্রনাথ (কেন ওঁকেই, কার কাছ থেকে ওঁর কথা শুনেছিলেন কবি, এল্‌ম্‌হার্স্ট জানতেন না তখন)। কর্ণেল য়্যুনিভার্সিটিতে, যেখানে সাহেব অ্যাগ্রোনোমি শিখছিলেন, সেখানে আরও এক বছর পড়া বাকি ছিল তাঁর। কবিকে সে-কথা জানিয়ে তিনি পরের বছর আসবেন বলে জানান, আর সেই এক বছর বিশেষ করে ভারত-কেন্দ্রিক কৃষিবিদ্যাই শুধু মজ্জাগত করেন তা-ই নয়, এখানে এলে প্রয়োজন হবে এমন সব বইপত্তর আর বিশেষ বিশেষ সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে শুরু করেন। এখানে পৌঁছিয়ে তাই স্ফুর্তি তাঁর সীমাহীন। শান্তিনিকেতনের আবাসিক-ছাত্র-শিক্ষক-কর্মী সবায়ের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব, সবায়েরই তিনি ছাত্র সব সময়ই কিছু-না-কিছু শিখছেন! আমি অবাক হয়ে দেখি এত অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় সবায়েরই উপর তাঁর প্রভাব। ফুটবল-ক্রিকেট-টেনিসেও সাহেব সিদ্ধহস্ত। এইখানে একটা কথা বলে রাখি তোমাকে। সাহেবের পাল্লায় পড়ে টেনিস খেলতে শিখেছি আমিও। আমাদের হাওড়ার গঙ্গার ঘাটের কাছে একটা টেনিস-কোর্ট ছিল। সেখানে সুবেশ মানুষদের (প্রধানত সাহেব) দূর থেকে খেলতে দেখেছি। শান্তিনিকেতনে এসে সে-খেলাও শেখা হয়ে গেল।

    জানুয়ারিতে কবি একদিন সাহেবকে ডেকে বললেন, এবার কাজে লাগো, আমার তাড়া আছে। সন্তোষ-রথি-কালীমোহন-গোরার সঙ্গে বসে সংক্ষিপ্ত প্ল্যান তৈরি কর একটা। আমরা সবাই মিলে বসে সেটা আলোচনা করব। আর কতো তাড়াতাড়ি শান্তিনিকেতন থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে সুরুলে থিতু হবে সেটা ভাবো। আর একটা কথা কবি বললেন এল্‌ম্‌হার্স্ট সাহেবকে। সাহেব এসেই এখানে বাংলা শিখতে শুরু করেছিলেন। শান্তিনিকেতনে তুমি যখন এসেছিলে কবি তখন তোমাকে বলেছিলেন দিনু বাবুর সঙ্গে গান গাইতে, মনে আছে তোমার? সেই দিনু বাবুর মা – এখানে সবায়ের বড়মা – তাঁর কাছে বাংলা শিখছিলেন সাহেব। কবি সাহেবকে বললেন, বাংলা তুমি একেবারেই শিখবে না। শিখলেই, এখানে গ্রামের লোকের সঙ্গে তোমার বাংলায় কথা বলার ইচ্ছে হবে। তোমার সঙ্গে যারা কাজ করবে, আমাদের এখানকার দশজন ছাত্র, পিংলা, এবং অন্য সহযোগী যারা, সবাই ইংরিজি জানে। তুমি সব সময় সঙ্গে এদের রাখবে। কথোপকথনের জন্যে এদের দোভাষী হিসেবে ব্যবহার করবে। তাহলে কীভাবে তুমি কথা বল, তোমার ভাবনা কী, এদের প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দিতে হবে, ছেলেরা এসব তোমার কাছে শিখতে পারবে। কথা দিয়েই এদের শিক্ষা শুরু হোক।

    হুটোপাটি কাজ শুরু হয়ে গেল। ইনস্টিট্যুট অব রুরাল রিকন্সট্রাকশন। জমি সংগ্রহ, থাকবার ব্যবস্থা সমেত। সে সবের বিস্তারিত বিবরণ তোমাকে দেব না। এমনিতেই এ চিঠি যথেষ্ট বড় হয়ে যাবে মনে হচ্ছে, সব কিছু লিখতে গেলে আস্ত একটা বইই হয়ে যাবে হয়তো। সতেরই ফেব্রুয়ারি (উনিশশো বাইশের) একটা ফোর্ড লরিতে আমরা বামাল পৌঁছলুম সুরুলে পাকাপাকি ভাবে। চারজন চারজন করে থাকবার জন্যে খড়ের চালের ছোট ছোট বাড়ি তৈরি হয়েছিল। এই বাড়ি তৈরি হবার সময় থেকেই নানাভাবে আমাদের কাজে লাগানো হচ্ছিল, সে সব কথা বিশদে লিখছি না। প্রত্যেক বাড়ির সঙ্গে খানিকটা করে বাগানের ব্যবস্থা। এই বাগানের ফলন থেকে আবাসিক শিক্ষার্থীরা কিছু কিছু আয়ও করতে পারবে। এই বাগান থেকেই আমাদের কৃষি-শিক্ষা শুরু।

    এল্‌ম্‌হার্স্ট সাহেব বললেন, মাটি আমাদের চিরকাল খেতে দেয়। কিন্তু মাটির কাছ থেকে এই খাদ্য সারা জীবন ফিরে পাবার একটাই শর্ত। মাটির কাছ থেকে যা নেব সেটা আমাদের ফিরিয়ে দিতে হবে মাটিকেই। কৃষির ক্ষেত্রে ফিরিয়ে দেবার সহজতম পথ হচ্ছে আমাদের প্রাতঃকালীন বর্জ্য এবং যাবতীয় অন্য জৈব বর্জ্যও – যেমন সব্জীর খোসা, মাছের কাঁটা, মাংসের হাড়, আগের দিনের উদ্বৃত্ব খাদ্যসামগ্রী ইত্যাদি – নিয়ম করে মাটির কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়া। অতএব, আমরা প্রত্যেকেই এখন বাড়ির সামনে একটা করে ট্রেঞ্চের মতো জায়গা খুঁড়ব। খুব গভীর নয়, মোটামুটি চোদ্দ ইঞ্চি। খুঁড়ে-পাওয়া মাটিটা তারপর রেখে দেব বাগানেরই এক পাশে। খোঁড়া হয়ে গেলে আমাদের বর্জ্য জমা পড়বে ওই ট্রেঞ্চেই। জায়গাটা যদি আমরা চাপা দিয়ে রাখি তাহলে মাছি এবং অন্যান্য পোকামাকড় আমাদের বাসগৃহে ভাগ বসাতে পারবে না, যদিও মাটি তার সার উপাদানে দিনে দিনে আরো আরো সম্পদশালী হয়ে উঠবে। আশা করি তোমরা সবাই আমার সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত হবে। যা বলেন, সেটাকে বেশ গল্পের মতো মনোরঞ্জক করে বলা এল্‌ম্‌হার্স্ট সাহেবের স্টাইল। বললেন, তিনি শান্তিনিকেতনে এসে প্রথম প্রথম প্রতি সকালেই হাতে একটা করে ঘটি নিয়ে ছেলেদের খোয়াই-এর দিকে হেঁটে যেতে দেখেছেন। ব্যাপারটা বুঝতে তাঁর সময় লেগেছে। যখন বুঝতে পারলেন ঘটনাটা কী, তখন এই অঞ্চলে মানুষের এত দূষণজনিত রোগের কারণটাও তিনি বুঝতে পারলেন। শুধু তা-ই নয়, খোয়াইয়ে যারা যায় না, নিজেদের বাসগৃহেই যাদের বর্জ্যত্যাগের ব্যবস্থা আছে, তাদের বর্জ্য মনুষ্যবাহিত হয়ে মাঝে মাঝেই প্রকৃতিকে এবং প্রাকৃতিক জলাশয়কে দূষিত করে। আমাদের খেতে দেবার উপকারের বিনিময়ে আমরা প্রকৃতিকে এভাবেই শাস্তি দিয়ে থাকি, শাস্তি পাইও দূষণজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে। যে ব্যবস্থা আমরা এখানে তৈরি করছি তা হল প্রকৃতিকে তার খাদ্য ফিরিয়ে দেওয়া এবং নিজেরাও অকারণ আক্রান্ত না-হওয়া।

    এবার ঝোলা থেকে বেড়াল বের করেন সাহেব। প্রতিটি বাসগৃহের জন্যে একটা করে আলকাতরা মাখানো বালতি। আমাদের কাজ হবে প্রতি সকালে ওই বালতিতে বহে-আনা বর্জ্য ট্রেঞ্চে ঢেলে দেওয়া, বালতিটা তারপর ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখা, এবং দিনের শেষে ওই ট্রেঞ্চে মাটি চাপা-দেওয়া।

    অনেকেই মুখ চাওয়া-চায়ি করে। এ-কাজটা তো ময়লা পরিষ্কার করবার জন্যে নিয়োগ-করা লোকরাই করতে পারত! সাহেব কিন্তু মানেন না। কৃষিবিদ্যার এটাই প্রথম পাঠ! নিজের হাতে 'মাদার আর্থ'কে খাওয়ানো!

    এখানে একটা কথা বলে রাখি তোমাকে। সাহেব বললেন মাদার আর্থ, আমিও লিখলুম তা-ই। নিজের হাতে জমির ম্যানিওরিং এখানে যখন আমাদের সকলের অভ্যেস হয়ে গেল কবি তখন শিলাইদহে। খবর পেয়ে সাহেবকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখলেন কবি। এই চিঠিতে আফশোষও ছিল। এই কাজ যখন সুরুলে তুঙ্গে, তিনি তখন উপস্থিত থাকতে পারলেন না, নিজের হাতে 'মাদার ডাস্ট'কে খাওয়াতে পারলেন না তিনি। মাদার আর্থ নয়, মাদার ডাস্ট!

    এল্‌ম্‌হার্স্ট সাহেব নিজে আর আমি প্রথম দিন থেকেই ট্রেঞ্চে বর্জ্য ফেলতে শুরু করলুম। প্রথম দিনে এই কাজটার সময় আমার কেমন একটা মজাই লাগছিল। আগস্ট মাসে এসে যখন আমার মাইয়ার সঙ্গে দেখা করি, ঠিক কী ধরণের কাজ আমি করি পতিসরে, বোঝাচ্ছিলুম মাইয়াকে। শুনে মাইয়া খুশি খুব, শুধু একটা কাজেই তো মাইয়ার আপত্তি, যে-কাজ মাইয়া নিজে করে! তাও, কাজটাকেই যে খারাপ বলে মাইয়া মনে করে সেরকমটা তো নয়, এ-কাজ তো মাইয়ার জাত-ব্যবসা, কিন্তু আমার দাদু মাইয়াকে বলে গিয়েছিল এ-কাজ যেন আমাকে করতে না দেওয়া হয়, নোংরা কাজ! সাহেবের ছেলে আমি যেন সাহেবের কাজই করি। মাইয়াকে বলা হয়েছিল ওই জাত-ব্যবসাটাই নোংরা কাজ, ওটা ছাড়া আর যে-কোন কাজই ভালো কাজ, সাহেবের ছেলের উপযুক্ত কাজ! আজ যদি মাইয়া নিজের চোখে দেখত আর এক খাঁটি সাহেবের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে মাইয়ার ওই জাত-ব্যবসার 'নোংরা কাজ'টাই আমি করছি পরমানন্দে, কী ভাবত মাইয়া তাহলে!

    যাই হোক, ধীরে ধীরে একজন একজন করে সবাই যখন রাজি হচ্ছে এল্‌ম্‌হার্স্ট সাহেবের “প্রথম” পাঠে, তখন নতুন একজন যোগ দিল সুরুলে, ইনস্টিট্যুট অব রুরাল রিকন্সট্রাকশনে। এর নাম সত্যেন, সত্যেন বোস। এ চরম গান্ধীপন্থী, শান্তিনিকেতনের লাইব্রেরিতে কিছুদিন কাজ করেছে। কাজ নামেই, শুনেছি এর প্রধান 'কম্মো' ছিল শান্তিনিকেতনে অসহযোগিতার বার্তা পৌঁছনো আর কর্মী সংগ্রহ। কবি একে বুঝিয়ে-বাজিয়ে গ্রামোন্নয়নের কাজে শিক্ষিত হবার জন্যে সুরুলে পাঠিয়ে দিলেন। যখন এল, খুব যে অনাগ্রহ নিয়ে ও এসেছে তা নয়। কিন্তু ট্রেঞ্চ খোঁড়া এবং প্রতি সকালে বালতিতে বহে-আনা বর্জ্য ওই ট্রেঞ্চে ঢেলে বালতিটা তারপর ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখা – এ-কাজটা একেবারেই মেনে নিতে পারছিল না সত্যেন। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সাহেবের যুক্তি মানতেই হল তাকে, এবং প্রাথমিক আপত্তির পর পরপর কয়েকদিন আর-সবায়ের সঙ্গে প্রাত্যহিক এই কাজে যোগ দিল সে বিনা আপত্তিতেই। কথায় কথায় একদিন সাহেব বললেন, তোমাদের এই বাসগৃহের দেয়ালে দেয়ালে তোমরা এখন লিখে দিতে পার স্বরাজ। এখান থেকেই আমাদের স্বরাজের জয়যাত্রা।

    স্বরাজ? কিরকম? – প্রশ্ন করে সত্যেন।

    সাহেব বললেন, তোমাদের জন্যে এই যে ছোট ছোট বাগান তৈরি হচ্ছে – তৈরি করছ তোমরা নিজেরাই – সে বাগানে যখন শাক-সব্জী ইত্যাদি ফলানো হবে, ফলাবেও তোমরাই, সেগুলো বিক্রি করে কিছু কিছু টাকা-পয়সাও আয় করবে তোমরাই। অর্থাৎ তোমরা এখন থেকে পুরোদস্তুর কৃষক। গতকাল তো দেখলে, এখানে সমবেত সব কৃষকরা মিলে একটা কৃষক-ইউনিয়ন তৈরি হল। আমাকে তারই চেয়ারম্যানের আসন দিলে তোমরাই। এদিকে কবিও আবার এই ইনস্টিট্যুটের ডিরেক্টর নির্বাচিত করেছেন আমাকেই।

    সে না হয় হল, কিন্তু এখন, এই যে বাড়ি, এই হল আমাদের বাগানবাড়ি। এবং এই বাগানবাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখা, এখানে ঠিকঠাক ফলন হওয়া, এবং, সেই ফলনের সূত্রে ভবিষ্যতে কিছু আয় করাও, এর সবই যদি আমাদেরই দায়িত্ব হয় তাহলে এই কি আমাদের স্বরাজ নয়? তোমরা ক'জন, এল্‌ম্‌হার্স্ট সাহেব বললেন, মানে আমাদের শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই, কতকালের সংস্কারের থেকে মুক্ত হয়েছ আজ; মুক্ত হয়ে যে কাজ তোমরা নিজের হাতে করছ, সে কি সাধারণ কথা? বহুযুগের পরনির্ভরতার অভ্যেস থেকে নিজেদের মনের জোরে মুক্তি পাওয়াই তো স্বরাজ। আর এই মুক্তির যা সুফল সবাই মিলে তা ভাগ করে নেওয়াই হবে আমাদের পুরষ্কার। আর আমাদের সবচেয়ে বড় পুরষ্কার হল, এখন থেকে কোন কাজই আমাদের পক্ষে কঠিন বা অকরণীয় রইল না। মনের দিক থেকে সব বাধা আমরা অতিক্রম করলাম। তোমাদের আবার বলছি, কবি যে আমাকে এই প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর নির্বাচিত করেছেন আর তোমরা যে বেছেছো আমাকে তোমাদের কৃষক-ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাজ করার জন্যে, তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে সকলের উপর যে দায়িত্ব প্রযোজ্য সে দায়িত্ব কেবলমাত্র আমারই নির্দেশে হবে। আমাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তসমূহ – কোন কোন বিরল ক্ষেত্রে সম্মিলিত না হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত – সকলেরই পালনীয় হবে। কোন একজন যদি সেই সিদ্ধান্তের বিরোধী হয়, সে তর্ক করবে, অন্যদের নিজের মতে আনবার চেষ্টা করবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তকেই আমরা সবাই মিলে আমাদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত বলে মেনে নেব। এই আমাদের স্বরাজ।

    কাজিদা, গান্ধীজী আর গুরুদেবের জোড়াসাঁকোর বাড়ির আলোচনার কথা তুমি তো জানই, গান্ধী তখন তাঁর অসহযোগিতার উপযোগিতা রবীন্দ্রনাথকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অনেক কম বয়েসে জমিদারি চালাবার কাজ নিয়ে কবি যখন শিলাইদহে যান তখনই তিনি আমাদের দেশের গ্রামীণ দুর্দশার কারণ সম্যক বুঝেছিলেন। সেই কারণটাই তিনি বুঝিয়েছিলেন এল্‌ম্‌হার্স্ট সাহেবকে: এক, গ্রামের মানুষ এখন হারিয়েছে তার আত্মবিশ্বাস, সে নিজেই বিশ্বাস করে না যে তার বর্তমান দুর্দশার পরিবর্তন সম্ভব; আর দুই, তাদের বর্তমান অবক্ষয় রুখে দিয়ে প্রগতির পথে তাদের ফিরিয়ে আনতে হলে ফাঁকা রাজনৈতিক শ্লোগানে কাজ হবে না; দুর্দশার প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সাহায্যে দুর্দশার মূল কারণ নির্ধারণ করে একমাত্র প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির প্রয়োগই এই দুর্দশা বদলাতে পারে।

    সুরুলের এই কেন্দ্র থেকে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সঙ্গে নিয়ে এল্‌ম্‌হার্স্ট সাহেব এই অঞ্চলের কৃষিজীবী ও অন্যান্য প্রধান সম্প্রদায়ের মানুষ – বাগদি বাউড়ি হাড়ি ডোম – এ-ছাড়াও জনজাতির মানুষরা, বিশেষত সাঁওতাল – এদের সবায়ের সঙ্গে কাজ করেছেন। সমবায় প্রথায় কাজ, অর্থবন্টন, স্বাস্থ্যরক্ষা, ধর্মগোলা সংগঠন ও সংরক্ষণের কাজ এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষি ও পশুপালন শিখিয়েছেন। প্রায় আড়াই বছর এখানে কাজ করে এল্‌ম্‌হার্স্ট সাহেব তাঁর নিজের দেশে ফিরে গিয়ে, শুনেছি গুরুদেবেরই আদর্শে, বিলেতের ডেভনশায়ারে ডার্টিংটন হল নামে এক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন, যদিও এখনও শান্তিনিকেতন-সুরুলের বিষয়ে তাঁর ঔৎসুক্য এবং উৎসাহ কমেনি।

    একটা কথা রবীন্দ্রনাথকে বারবার বলতে শোনা যায় – “আমি একলা সমস্ত ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিতে পারব না, আমি কেবল জয় করব একটি বা দুটি গ্রাম...।” কাজিদা, এখানে এসে অবধি প্রায়ই অনেকের মুখে কবির এই উক্তি শুনতে পাই। এখানে আমি চুপচাপ থাকি, বিশেষ কিছু বলি না; কিন্তু এখন তোমার সঙ্গে আমার নিজের একটা কথা শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে। আমি নিজে পতিসরে ঠাকুর বংশের জমিদারির কর্মচারি না হয়েও সেই জমিদারিতে কাজ করেছি। কী কাজ? পল্লীসংস্কার আর সংগঠনের কাজ। শুনেছি, আঠেরোশো নব্বইয়ের দশকে যখন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কবিকে জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে পাঠান, কবি তখন নিজে গ্রামের মানুষের আশাহীন সর্বাঙ্গীন দারিদ্র নিজের চোখে দেখে সেই অবস্থার আমূল পরিবর্তনের কাজ শুরু করেন। অতুলবাবু স্যরের কাছে শুনেছি শিলাইদহে যখন কবির অভিষেক হচ্ছিল তখন রাজা-উপাধিতে সজ্জিত জমিদার মশায়ের জন্যে সংরক্ষিত উচ্চাসনে বসার রেওয়াজ অগ্রাহ্য করে কবি নীচে নেমে এসে প্রজাদের জন্যে নির্দিষ্ট ফরাসের ওপর প্রজাদের সঙ্গেই বসেন। উনিশশো পাঁচের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে কবির সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। সেই সময় কংগ্রেসের প্রাদেশিক অনেকগুলো সভায় কবি অংশগ্রহণ করেন। সেই সব সভাতেও কবি বারবার তাঁর পল্লীসংস্কারের ভাবনা ব্যক্ত করেন এবং আলোচনা করেন। বস্তুত ঢাকা এবং পাবনার প্রাদেশিক সম্মেলনেই কালীমোহন ঘোষ – দেশের জন্যে নিবেদিতপ্রাণ তরুণ কালীমোহন – তাঁর কলেজের পাঠ উপেক্ষা করে এই সব সম্মেলনে ভলান্টিয়ারি করছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর তখনই আলাপ, এবং তাঁরই উপদেশে কালীমোহন রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারায় পল্লীসংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

    রবীন্দ্রনাথ নিজে কবি দার্শনিক কথাসাহিত্যিক নাট্যকার ও সঙ্গীতবিদ। গান্ধী রাজনীতিবিদ, তিনি নাটকের মানুষ ন'ন। কিন্তু নাটক গান্ধীর শারীরমানসের একটি অঙ্গ। অহিংসা তো আমাদের দেশের ঐতিহ্য। কিন্তু, গান্ধীপূর্ববর্তী কোন মনীষী অহিংসাকে কখনও নাটকের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেননি। গান্ধীর হাতে অহিংসা একটা নাটকীয় অস্ত্র হয়ে উঠেছে। এবং একই নাটকে যেমন নানা অবস্থায় নানারকমের আবেগের প্রয়োগ থাকে, রাজনৈতিক অহিংসার ক্ষেত্রে পাত্রভেদে হিংসারও নাটকীয় রূপান্তর হয়। অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপারে জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথ-গান্ধীজীর যে বিখ্যাত মত-বিনিময়ের কথা তুমি-আমি শুনেছি, সেই দিনের ঘটনা কবি নিজে এল্‌ম্‌হার্স্ট সাহেবের কাছে নিজেই গল্প করেছেন। সাহেব আমাকে বলেছেন, অহিংসার কথা যখন উঠল, কবি তখন গান্ধীজীকে তাঁর নিজের বারান্দায় নিয়ে আসেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির চত্বরেই তখন গান্ধীজীর সৈনিকরা বস্ত্রদাহন করছিল – রবীন্দ্রনাথকে একটু শিক্ষা দেবার প্রয়োজন তাদের ছিল! গান্ধীজী নিজচক্ষে তাঁর শিষ্যদের অহিংস আন্দোলন দেখলেন!

    শিক্ষার মিলন যেদিন কবি শান্তিনিকেতনে পড়েন, সেদিন পাঠান্তে প্রশ্নোত্তরের সময় বোম্বাইয়ে 'অপবিত্র' বিদেশী কাপড়ের গান্ধীর উপস্থিতিতে দাহন সম্বন্ধে একজন প্রশ্ন করেন। আমি বোধ হয় এই প্রসঙ্গটা আমার তোমাকে পাঠানো সেই সময়কার চিঠিতে লিখেছিলুম। কবি তাঁর উত্তরে বলেছিলেন পবিত্রতা-অপবিত্রতা একটি আধ্যাত্মিক প্রসঙ্গ। কাপড়ের ক্ষেত্রে আসলে প্রয়োজন পরিচ্ছন্নতার। কাপড়ের পবিত্রতার ব্যাপারে তিনি আর কথা বাড়াননি। আমার কিন্তু মনে হয়, ওই সময়ে ওই পবিত্রতার কথা বলাটা একমাত্র গান্ধীজীর পক্ষেই সম্ভব। বিষয়টায় পবিত্রতার আমদানি সমস্ত ঘটনাটায় নতুন একটা নাটকীয়তা সূচিত করে। সমস্ত আন্দোলনটাতেই এসে যায় কেমন একটা পুজো-পুজো ধম্ম-ধম্ম ভাব!

    তোমাকে এতগুলো কথা লিখছি আমার নিজের একটা ভাবনা তোমার সামনে তুলে ধরবার জন্যে। কবিকে অনেকটা কাছ থেকে দেখে এবং এল্‌ম্‌হার্স্ট সাহেবের সঙ্গে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠভাবে মিশে, আমার ধারণা হয়েছে কবির গ্রামোন্নয়নের ভাবনাটাও আসলে একটা রাজনৈতিক ভাবনা। একটু প্রচ্ছন্ন হলেও তা-ই। কবি যতই “একটি বা দুটি গ্রাম জয়” করার কথা বলুন-না-কেন, আসল ব্যাপারটা ওই “জয়” করাই। ওটা রাজনৈতিক জয়। ওই একটি বা দুটি গ্রাম এই রাজনৈতিক লড়াইয়ের লেবরেটরী। এবং কবি নিশ্চয়ই আশা করেন শিলাইদহ-কালীগ্রাম-পতিসরে যার শুরু, সুরুলে যা আরও সুসম্পন্ন, কবির সেই মানুষের-জন্যে-রাজনীতির ভাবনা সাধারণভাবে আমাদের দেশের রাজনৈতিক চেতনার কাছে আবেদন করবে। রাজনৈতিক সাফল্যের জন্যে যে নাটকীয়তার প্রয়োজন হয়, রবীন্দ্র-ভাবনার রাজনীতিতে তার অনেকটাই অনুপস্থিত, কিন্তু নাটকবিহীন সেই রাজনৈতিক সচেতনতাই, আমার মনে হয়, শেষ পর্যন্ত স্থায়িত্ব পাবে।

    এতগুলো কথা কেন ফাঁদলুম তোমাকে বলি। দেখ কাজিদা, তোমার চেয়ে আমি খুব বেশি ছোট নই, কিন্তু পিঠোপিঠি দু' ভাইয়ের ছোটজন তার দাদাকে যে-চোখে দেখে আমিও সে-ভাবেই দেখি তোমাকে। ইশকুলের পড়া ছেড়ে দিয়ে তোমাদের করাচির সেনা-ব্যারাকে তোমার কাছ থেকে যে লেখাপড়া শিখেছি তোমার সে ঋণ আমি কোনদিনও শোধ করার এমনকি আশাও করি না। আজ আমি এই যে শান্তিনিকেতনে এত বড় বড় লোকদের মাঝখানে আছি, সে-ও কি কোনদিন সম্ভব হত যদি তোমার ভাই না হতুম?

    আর, এই সব অধিকারের জোরেই তোমার ওপর আজ একটা অভিযোগ আনব। দেশপ্রেম তোমার কাছে ঠিক সাধারণ একটা আবেগ নয়; দেশের মঙ্গলের জন্যে, আমি জানি, তু্মি যে-কোন ত্যাগস্বীকার করতেই রাজি আছ। যে-সময়ে নবযুগ বন্ধ হতে চলেছিল, ততদিনের মধ্যে সম্পাদক হিসেবে এ বঙ্গভূমে তোমার যে প্রতিষ্ঠা তৈরি হয়েছে তাতে আর
    কোন-একটা প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় ইচ্ছে করলেই তুমি ঢুকে পড়তে পারতে। এ-কথা তো বাড়িয়ে-বলা নয়, তুমি নিশ্চয়ই এ-কথার সত্যতা জানো। তবুও, দেশপ্রেমের আবেগে সব ছেড়েছুড়ে তুমি চলে গেলে শিয়ারশোলে নিবারণবাবু স্যরের কাছে। সেখান থেকে দরিরামপুর হয়ে কুমিল্লা। যখন কুমিল্লায় পৌঁছলে তুমি, ততদিনে সারা বাংলায় গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ। আর সেই ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে শুধু কংগ্রেসিরা নয়, তোমার বিশ্বাস যে বিপ্লবী পন্থায়, সেই পন্থার বিপ্লবীরাও। অতএব তখন থেকেই তুমি গান্ধীপন্থারও সৈনিক। কলকাতায় ফিরে আসবার পর সুভাষবাবুর সঙ্গে আলাপ হল তোমার। সুভাষবাবু নিজে ঠিক কতটা গান্ধীবাদী জানি না আমি, কিন্তু কুমিল্লায় তোমার যাবার কথা আছে এমনটা জানতে পেরে তোমাকে তিনি সেখানকার গান্ধীবাদীদের একজন সেনাপতি বানিয়ে দিলেন। শেষ পর্যন্ত গান্ধীবাদে আস্থা তোমার টলতে বেশি সময় লাগেনি। চৌরিচৌরার ঘটনার পর দ্বিগুণ তেজে গান্ধী লড়াইয়ে নামবেন তুমি ভেবেছিলে। যেটা তুমি বুঝতে চাইলে না বা অন্ধ গান্ধীভক্তির ফলে বুঝলে না তা হল, রাজনৈতিক লড়াইয়ের হাইওয়েতে নিজের গতিপথকে টিকিয়ে রাখবার জন্যে তখন আর একটা নাটকের প্রয়োজন গান্ধীর, তাই অসহযোগ আন্দোলনকে চৌরিচৌরার অছিলায় মুলতুবি রেখে বার্দৌলি নামের ছোট্ট একটা জনপদকে লেবরেটরী বানিয়ে সর্দার প্যাটেলকে সঙ্গে নিয়ে একটা পরীক্ষায় নামলেন তিনি। ব্রিটিশ সরকার অবিশ্যি শেষ পর্যন্ত মুখরক্ষা করল তাঁর, গ্রেপ্তার করে নিল তাঁকে। তোমার মতো গান্ধীভক্তরা তখন কী করবে?

    কী করবে? তুমি কী করলে আমরা জানি। আর একটা লড়াইয়ের জায়গা তৈরি করে নিলে তুমি। গান্ধী চেয়েছিলেন ডোমিনিয়ন স্টেটাস, ধূমকেতু প্রকাশ করে তুমি কিন্তু ব্রিটিশ সরকারকে একেবারে বোঁচকা পুটলি বেঁধে সাগরপারে পাড়ি দেবার ফতোয়া দিয়ে দিলে। তোমার চাই ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, পূর্ণ স্বাধীনতা। আর যে রাস্তায় তুমি পৌঁছে যাবে তোমার উদ্দিষ্ট গন্তব্যে, বাতলে দিলে সে রাস্তাটাও: আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা! তোমার হাজত-বাস আটকায় কে!

    তোমার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ আনব – এই বলে আগের প্যারাগ্রাফটা শুরু করেছিলুম। অভিযোগটা কী? অভিযোগ এই যে, যে-তুমি আজ বিপ্লববাদী, কালই সে-ই তুমি স্বচ্ছন্দে গান্ধীবাদী হয়ে যাও, আবার গান্ধীবাদ থেকে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রের রাস্তা হয়ে যুগান্তর-অনুশীলনের পথে ফিরে আসতে সময় লাগে না তোমার। নবযুগের সম্পাদক হিসেবে শ্রমিক-কৃষকের কথা লিখেছ তুমি, রানিগঞ্জ-আসানসোলের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় খনি-শ্রমিকদের ওপর মালিকের অত্যাচার এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের ফলে শ্রমিকদের অকালমৃত্যুর সমালোচনা করেছ তুমি, আবার সেই তুমিই ধূমকেতুতে একটি বারের জন্যেও শ্রমিক-কৃষকের কথা বলনি। আসলে কাজিদা, রাজনীতির বিষয়ে নির্দিষ্ট কোন মতবাদ তোমার গড়ে ওঠেনি; কখনো গান্ধীবাদ, কখনো বিপ্লববাদ, কখনো আন্তর্জাতিক সমাজবাদ – যখন তোমার বন্ধুরা যা বলেছে তা-ই হয়ে উঠেছে তোমার মতবাদ। একে হুজুগ ছাড়া আর কী বলতে পারি!

    অনেক দিন যখন তোমার খোঁজ-খবর পাচ্ছি না, তখন একদিন বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রীটে গেলুম। আমার ধারণা ওখানে গেলে তোমার খবর, খানিকটা হলেও, পাওয়া যাবে। সেখানে গিয়ে এক যুবকের সঙ্গে আলাপ হল, আবদুল হালীম। স্পষ্ট করে না বললেও তার কথাবার্তায় বুঝতে পারলুম, মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের রাজনৈতিক পথ এখন তোমার পথের থেকে খানিকটা দূরে, নিজেকে তিনি আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছেন, যদিও ব্যক্তিগত ভাবে তোমার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব এখনো অটুট। হালীম, স্পষ্টতই বোঝা গেল, মুজফ্‌ফরেরই পথে, কিন্তু হুগলী জেলে তুমি বন্দী থাকার সময় নানাভাবে সে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। মুজফ্‌ফর পারেননি, কারণ অনেক দিন পর্যন্ত তিনি গা-ঢাকা দিয়ে ছিলেন; কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি অভিযুক্ত, পুলিশ তাঁকে খুঁজছিল। সম্প্রতি তিনি ধরা পড়েছেন এবং আপাতত আলিপুরের জেলে। জানিনা, কতদিনে তাঁর সঙ্গে তোমার আবার যোগাযোগ হবে।

    রবীন্দ্রনাথ বহু পরিস্থিতিতে বারবার বলেছেন রাজনীতি তাঁর বিষয় নয়। অথচ তাঁর চিন্তায় রাজনীতি যে প্রায়শই প্রত্যক্ষ হয় তা আমরা সবাই লক্ষ্য করেছি। রাজনীতি তাঁর – চব্বিশ ঘন্টা কেন, এক মুহূর্তেরও – পেশা নয়, কিন্তু তাঁর নিজস্ব চব্বিশ ঘন্টা তাঁর যে রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা তাকে ঘিরেই। তিনি কবিতাই লিখুন বা নাটকের রিহার্স্যাল দিন, গভীর দার্শনিক চিন্তায় লিপ্ত থাকুন বা সঙ্গীতে, নিজস্ব রাজনীতি তাঁর চিন্তায় সজাগ থাকে সবসময়েই। এখানে সুরুলের একটা ঘটনা তোমাকে বলব, যেটা শুনলে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক সজাগতা এবং শৃঙ্খলা সম্বন্ধে তোমার ধারণা হবে। এই নাটকের প্রধান চরিত্র সত্যেন বোস, তোমাকে তার কথা আগেই বলেছি। আর একজন, সুবীর, তার কথা বলিনি আগে। এই সুবীর কবির মেজদা প্রয়াত আই-সি-এস সত্যেন্দ্রনাথের পৌত্র। একেও সুরুলে শিক্ষার্থী হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। সুবীরের বাবা সুরেন্দ্রনাথের স্পষ্টই অনুমোদন ছিল এই শিক্ষায়, সুবীরের নিজেরও উৎসাহ কম ছিল না। কিন্তু এখানে শিক্ষার্থীদের যে দৈনিক নিয়ম; থাকা-খাওয়ার যে ব্যবস্থা, ট্রেঞ্চ খনন এবং বর্জ্য-সম্পর্কিত প্রাত্যহিক কর্তব্য এবং প্রাত্যহিক সমবেত নৈশভোজনের জন্যে নির্দিষ্ট সময়ে প্রতি সন্ধ্যায় হাজির থাকা এবং রাত্রিবাস করা – এইসব নিয়ম মেনে চলা সুবীরের পক্ষে অসুবিধের কারণ হয়ে পড়ছিল, মূলত তার পিতামহী জ্ঞানেন্দ্রনন্দিনী দেবীর হস্তক্ষেপের ফলে। কবি সিদ্ধান্ত নিলেন, সুবীরকে সুরুলে রাখা চলবে না। তার পিতা সুরেনের সঙ্গে পরামর্শক্রমে তাকে কোন ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে ভর্তি করার ব্যবস্থা হল। এরই মধ্যে তেরই এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবস উপলক্ষে একদিনের ছুটির জন্যে সত্যেন সদলে আবেদন করল এল্‌ম্‌হার্স্ট সাহেবের কাছে। সেদিন শান্তিনিকেতনে সত্যেনের নেতৃত্বে কংগ্রেস-কর্মী ও অসহযোগীর দলের জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবস পালন করবার কথা। সুরুলের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেবে সেখানে, এমনটাই সত্যেনের ভাবনা। জালিয়ানওয়ালাবাগ কাণ্ডে কবি নিজে তাঁর নাইটহূড ত্যাগ করেছিলেন তা তো আমরা সবাই জানি, সেটা ছিল একটা ভয়ঙ্কর সহিংস ব্রিটিশ রাজনীতির নখদন্ত প্রদর্শন ও প্রয়োগ। কিন্তু প্রতি বছর সেই স্মৃতিতে কাজ বন্ধ করব কেন? এল্‌ম্‌হার্স্ট সাহেব সত্যেনকে বোঝালেন, গ্রামীণ মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গ্রামোন্নয়নের কাজ আমাদের স্বরাজের কাছাকাছি এনে দেবে, তার তুলনায় জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে শুধুমাত্র স্মরণ করা সময়ের অপব্যয়। এ যুক্তি পছন্দ হয় না সত্যেনের, তার কাছে সেই মুহূর্তে জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবস পালন করার চেয়ে বড় কিছুই নেই। সুরুলে কৃষিবিদ্যা শেখা দেশের কাজের সঙ্গে এমনকি তুলনীয়ও সে মনে করে না, দেশপ্রেমের জন্যে সুরুল ছাড়তেও সে এবং তার সহশিক্ষার্থীরা রাজি আছে।

    সব শিক্ষার্থীকে ডাকা হল। আগের থেকেই প্ল্যান ছিল সুরুলে যে লরীটা আছে তাতে সুবীরকে পরের দিন সকালে বোলপুর স্টেশনে নিয়ে গিয়ে হাওড়াগামী ট্রেনে তুলে দেওয়া হবে; সুরেন ঠাকুরের সঙ্গে ব্যবস্থা করা আছে, তাঁর সঙ্গে হাওড়া স্টেশনেই সুবীরের দেখা হবে। যদি অন্য কোন শিক্ষার্থী সুরুলে থাকতে না চায়, তাদেরও সেই লরীতে তুলে নেওয়া যেতে পারে। সুবীরের সঙ্গে একসাথেই তারাও কলকাতায় ফিরে যেতে পারবে। কে কে যেতে চায়?

    সত্যেন তো আছেই, তার সঙ্গে আরও দুজন। অতএব পরের দিন সকালে কালীমোহনবাবু স্যর আর এল্‌ম্‌হার্স্ট সাহেব লরীতে সুবীর এবং সত্যেনসহ চারজন শিক্ষার্থীকে সঙ্গে নিয়ে বোলপুরের দিকে রওনা দিলেন। সুরুল থেকে বোলপুরের একটা সোজা রাস্তা আছে যেটা ততটা ভালো নয়, ভাঙাচোরা খানিকটা। অন্য যে রাস্তাটা সেটা দিয়ে গেলে পথে পড়ে শান্তিনিকেতন। সত্যেন ভেবেছিল এই দ্বিতীয় রাস্তাটা ধরেই যাওয়া হবে, গাড়িটা শান্তিনিকেতনের কাছাকাছি পৌঁছলেই সে তার সঙ্গী দুজনকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে লাফ দিয়ে নেমে পড়বে। কিন্তু সে সুযোগ হল না। সংক্ষিপ্ত কিন্তু ভাঙাচোরা রাস্তাটাই বেছে নিলেন সাহেব এবং কালীমোহনবাবু। বোলপুর স্টেশনে নেমে যখন সুবীরের জন্যে টিকিট কেনা হচ্ছে, সত্যেনরা জানাল তাদের কলকাতায় ফিরে যাবার কোন বাসনা নেই, তারা স্টেশন থেকে শান্তিনিকেতনেই ফিরে যাবে।

    সুবীরকে ট্রেনে বসিয়ে সাহেব আর কালীমোহনবাবু লরীতে পৌঁছলেন শান্তিনিকেতনে। কবির সঙ্গে দেখা করে সমস্ত ঘটনা তাঁরা জানালেন কবিকে। কবি ডেকে পাঠালেন চার্লস অ্যাণ্ড্রুজকে, তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন বোলপুরের পথে। রাস্তাতেই সত্যেন এবং তার বন্ধুদ্বয়কে ধরে ফেরৎ পাঠিয়ে দিতে হবে, কোন অবস্থাতেই তারা যেন শান্তিনিকেতনে ঢুকতে না পারে। আর, তাদের যে ফেরৎ পাঠানো হল তারযোগে সে খবর জানিয়ে দিতে হবে তাদের অভিভাবকদের।

    কবি রাজনীতির মানুষ ন'ন, কিন্তু তিনি জানতেন তাঁর রাজনৈতিক ভাবনার যে পরীক্ষা চলছে সুরুলে, তা ব্যর্থ হলে চলবে না। বিজ্ঞানী যেমন তাঁর পরীক্ষার প্রতিটি ধাপ সবরকমের অবাঞ্ছিত প্রভাব থেকে মুক্ত করেন, সুরুলের ক্ষেত্রে কবিও তা-ই করেছেন। রাজনীতির মানুষ না-হয়েও তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্যে তিনি কোনমতেই ভ্রষ্ট হবেন না।

    তোমার মনে আছে কাজিদা, প্রথম যখন ডক্টর শহীদুল্লার সঙ্গে তুমি আর আমি শান্তিনিকেতনে এসেছিলুম, কবি তোমাকে শান্তিনিকেতনে থেকে যেতে বলেছিলেন? বলেছিলেন, তুই দিনুর সঙ্গে গান গাইবি আর ছেলেদের ড্রিল শেখাবি? কবির মাথায় কী ছিল আমি জানিনা। কিন্তু এখন আমার মনে হয়, তুমি তখন থেকে গেলে ভারী ভালো করতে। তোমার দেশপ্রেম যে কতটা নিবেদিত তা আমার চেয়ে বেশি কতজন জানে? দেশসেবার সুস্পষ্ট একটা অভিমুখ তুমি বোধ হয় কবির সান্নিধ্যেই পেতে। তোমার কবির মন সঙ্গীতের প্রতিভা আর দেশপ্রেম মিলেমিশে যা দাঁড়াত তাতে দেশবাসী অনেক বেশি পেত তোমার কাছ থেকে।

    এই পর্যন্ত লিখে ড্রিলের ব্যাপারটাও তোমাকে একটুখানি বলতে চাই। ড্রিলের কথাটা কিন্তু কথার কথা নয়, সম্ভবত ভেবেচিন্তেই কবি তোমাকে দেওয়া প্রস্তাবের মধ্যে ড্রিলের কথা বলেছিলেন। গত বছর শান্তিনিকেতনের দুই প্রাক্তন ছাত্রকে কবি মধ্যপ্রদেশে কোয়েকার ক্রীশ্চানদের পরিচালনায় একটা স্কাউট-নেতৃত্বের শিক্ষা-শিবিরে পাঠিয়েছিলেন। একেবারে প্রথম সারির শিক্ষালাভ করেছিলেন এঁরা। এত ভালো যে মধ্যপ্রদেশের গভর্ণর স্যর ফ্র্যাঙ্ক স্লাই শান্তিনিকেতনের এই প্রাক্তনীদের পারদর্শিতায় মুগ্ধ হয়ে বিশেষ করে কবিকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখেছেন। এঁদের একজন ধীরানন্দ রায় সুরুলের প্রশিক্ষণ এবং গ্রামোন্নয়নের কাজে সম্পূর্ণ সমর্পিত। অন্যজন মাসোজী। এঁরা দুজনেই শান্তিনিকেতনেই পড়াশোনা করেছেন, মাসোজী শিল্পী হিসেবে এখনই যথেষ্ট পরিচিত। আমি তো খুবই সক্রিয়ভাবে ব্রতীবালক সংগঠনে কাজ করেছি, ব্রতীবালকের কাজেও স্কাউট আন্দোলনের প্রভাব আছে। কাজেই তোমাকে ড্রিলের কথা বলায় কবির তোমাকে নিয়ে একটা বড়সড়ো ভাবনার কথাই বোধ হয় সূচিত হচ্ছে।

    কবির সঙ্গে তোমাকে নিয়ে আমার কখনো কোন কথাবার্তা হয়নি। কিন্তু তোমার ওপর কবির স্নেহধারা যে আছে, চোখ আছে এমন যে-কেউই তা দেখতে পাবে। কবির ষাট বছরের জন্মদিনে সাহিত্য পরিষদে তোমাকে ডেকে পাশে বসানো, ধূমকেতুর জন্যে অমন একটা আশীর্বাণী, বসন্ত নাটকের উৎসর্গ – এসব তো সাদা চোখে সবাই-ই দেখতে পায়!

    যা যা বললুম ভেবে দেখো। ছোট ভাই বলে প্রেসক্রিপশনটা অবজ্ঞা কোরো না।

    ভালো থেক।


    পিংলা



    ক্রমশ...

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৮ মার্চ ২০২৩ | ২৪৯৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ১৯ মার্চ ২০২৩ ২১:২০517611
  • চমৎকার ! তবে সামান্য একটা টাইপো--- সালটা ১৯২৩ হবে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন