এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • সীমানা - ২২

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ | ২৭৮১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ছবি: সুনন্দ পাত্র


    ২২

    অন্তর কাঁদে অবিরাম



    কিরণশঙ্কর নজরুল-মুজফ্‌ফরের বাসস্থান চেনেন না। তিনি কুত্‌বুদ্দিন আহ্‌মদকে অনুরোধ করে পাঠিয়েছেন ওদের একটু খবর পাঠাতে, সামান্য ব্যক্তিগত প্রয়োজন আছে। কুত্‌বুদ্দিনের বাড়িতে ভাড়া থাকে কলকাতা মাদ্রাসার ছাত্র যে কয়েকজন ছেলে, দায়িত্বটা তাদেরই দিলেন কুত্‌বুদ্দিন। তালতলায় নজরুল-মুজফ্‌ফরের ডেরা চেনে না এই ছেলেরাও, তারা বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রীটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার অফিসে খবর দিয়ে দিল। পরের দিন সকালেই মুজফ্‌ফর-নজরুল হাজির কিরণশঙ্করের বাড়িতে।

    স্বাভাবিক সমিষ্টান্ন আপ্যায়নের পর কিরণশঙ্কর বলেন কাজিকে, আপনাকে বলেছিলাম বাংলা কবিতার খোল-নলচেই আপনি বদলিয়ে দিয়েছেন, এবার বলব বাংলা কবিতায় নতুন দিগন্তও খুলে দিলেন আপনি। বিদ্রোহী আর ভাঙার গান দুটোই পড়লাম। সম্পূর্ণ নতুন অনুভূতি। এমন অনুভূতি যাতে সারা কলকাতা পাগল এখন, যেখানেই যাই শুনি আপনার কবিতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, আমাদের ন্যাশনাল কলেজেও তো দেখি মাষ্টার-ছাত্র কয়েকজন এক জায়গায় হলেই বিদ্রোহী নিয়ে আলোচনা। অথবা কারার ওই লৌহকপাট ভেঙে ফেল, কর রে লোপাট!

    জবাব দেয় না কাজি, নীরবে হাসে।

    কিরণশঙ্কর বলেন, তাই ভাবছিলাম আপনাকে একটা সম্বর্ধনা দেওয়া যায় কিনা।

    মুজফ্‌ফর কোন কথা না-বলে চুপচাপ বসেছিল এতক্ষণ। এবার বলে, কোথায় দেবেন সম্বর্ধনা? আপনাদের ন্যাশনাল কলেজে?

    না না, ন্যাশনাল কলেজ নয়, ওখানে তো সব সিদ্ধান্তই, বুঝলেন কিনা, ন্যাশনাল! এমন জায়গায় সম্বর্ধনা দিতে চাই আমি, যেখানে আমার ওপর কথা বলবার কেউ নেই। আমাদের একটা পারিবারিক জমিদারি আছে, জানেন তো?

    সে তো অনেক দূর, পূর্ব বাংলায়। কী যেন নাম বলেছিলেন আপনি আগের বার গ্রামটার, এখন ভুলে গেছি।

    পূর্ব বাংলায় ঠিকই, বলেন কিরণশঙ্কর, তবে দূরটা অনেক কিনা সেটা যে যাবে তার উৎসাহের ওপর নির্ভর করবে। ঢাকা থেকে মাণিকগঞ্জ; আমাদের বাসস্থান আর জমিদারির অঞ্চলটা ওই মাণিকগঞ্জের মধ্যেই, শিবালয় নামে খ্যাত। গ্রামের নাম তেওতা। সেখানে আমাদের কাছারি বাসভবন পুকুর-টুকুর সবই আছে, পাশেই যমুনা। এ-ছাড়া আছে নবরত্ন মঠ, প্রতি বছর সেখানে দোলের সময় উৎসব হয়। ভাবছিলাম আপনাদের নেমন্তন্ন করব আমাদের গ্রামে আসতে। সেখানেই কবি নজরুল ইসলামকে সম্বর্ধনা দেব আমরা শিবালয় অঞ্চলের সব মানুষরা মিলে। আমি জানি গেলে আপনাদের নিশ্চয়ই ভালো লাগবে, কয়েকদিন ওখানে কাটিয়ে আসতে পারবেন।

    মুজফ্‌ফর বলল, শুনে খুবই লোভ হচ্ছে, কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমি কয়েকটা জরুরি ব্যাপারে আটকে পড়েছি, কলকাতা ছেড়ে যাওয়া আমার পক্ষে এখন একেবারেই অসম্ভব। তবে কাজির তো কোন অসুবিধেই নেই, সত্যি-সত্যিই কলকাতা ছেড়ে কয়েকদিনের জন্যে কোথাও যেতে ওর ইচ্ছেই করছিল, আমার মনে হয় ও উৎসাহের সঙ্গেই যাবে।

    নজরুল সাহেবের উৎসাহটা আমি তাহলে বাড়িয়েই দিই একটুখানি, বলে নজরুলের দিকে তাকান কিরণশঙ্কর, আপনি অনুমতি দিলে বীরেনকেও আমি নেমন্তন্ন করব, ও রাজি হলে ওদের বাড়ির সবাইকেই। ওই সেনগুপ্ত পরিবারই তেওতায় আমাদের একেবারে নিকটতম প্রতিবেশী, অনেকদিন দেখাও হয়নি ওদের সঙ্গে, এই সুযোগে একটা রিইউনিয়নও হয়ে যাবে।

    নজরুল আর কিরণশঙ্কর পৌঁছবার আগের দিনই পৌঁছিয়ে গেছে প্রায় গোটা সেনগুপ্ত পরিবার। ওদের বসতবাড়িটা জমিদার বাড়ির প্রায় লাগোয়া। বেশ কিছুদিন অব্যবহৃত থাকায় পুরোনো বাড়িটা বাসযোগ্য করে তুলতে বীরেন আর জমিদার বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দেওয়া কয়েকজনের বেশ পরিশ্রমই হল। ইন্দ্রকুমার আসেননি, উনি থেকে গেলেন কান্দিরপাড়ে। পুত্রবধূ কমলিনীও শ্বশুরমশায়ের অসুবিধে লাঘব করবার জন্যে থেকেই গেল। কিরণশঙ্কর একজন বন্ধুকে নিয়ে আসছেন এ-খবর আগেই পেয়েছিল জমিদারির কর্মচারিরা, কাজেই ওঁদের জন্যে প্রস্তুতি ছিলই, তবুও সেনগুপ্ত পরিবারের মহিলাদের অনুরোধে তাঁদের বাড়িতেই দিনের বেলার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হল কিরণশঙ্কর আর নজরুলের। বিকেলে গানের আসর জমিদার বাড়িতে। গ্রামের আশপাশের বাড়ি থেকেও অনেকে এল গান শুনতে। প্রায় ঘন্টা তিনেক নজরুল গাইল একাই। কিরণশঙ্কর দুলিকে ডেকে বসালেন নিজের পাশে, বললেন, আশালতা, আজকের অনুষ্ঠানে একটা বড় দায়িত্ব তোকে দিচ্ছি। শুনেছি, দু-তিনটে গানের পরে-পরেই কাজি সাহেবের পান খাওয়ার দরকার হয়। গান শুনতে শুনতে তুই পানও সাজবি। আর এই রূপোর রেকাবিতে পান সাজিয়ে ঠিক সময়ে পৌঁছে দিবি কাজি সাহেবের কাছে। পৌঁছে দিবি মানে দিতেই থাকবি দিতেই থাকবি। পারবি তো?

    জমিদার বাড়ির দোতলার যে ঘরে নজরুলের শোয়ার ব্যবস্থা, তার জানলায় দাঁড়িয়ে অদূরেই যমুনার কালো জল দেখতে পায় সে। দোলপূর্ণিমার আর দু-তিন দিন মাত্র বাকি। আলো-আঁধারিতে কালো জলে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। কিরণশঙ্কর বলেছিলেন ওঁদের নবরত্ন মঠে দোলের উৎসব হয় ঘটা করে। নজরুল ঠিক করে দোলের সময়টা এখানেই কাটিয়ে যাবে।

    ভোরবেলা ঘুম ভেঙে নীচে নেমে আসে কাজি। বাইরেটা এখনও একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। সূর্য দেখা যাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু আকাশ আর অন্ধকার নেই। নবরত্ন মঠের সামনের বিরাট পুকুরটার একেবারে শেষ দিকটা মনে হল আকাশের সঙ্গে মিশে গেছে। পুকুরের জল একেবারেই শান্ত, কিন্তু ছলাৎ ছলাৎ শব্দটা কাজিকে ছাড়ছে না যেন। একটু পেছন ফিরে খানিকটা হেঁটে সে পৌঁছোয় যমুনার পারে। ছলাৎ-শব্দের রহস্যটা বোঝা যায় এবার। নদীর পারে একা একা খানিকটা হাঁটাহাঁটি করতে করতে জলে লালের ছোঁয়া দেখতে পায় সে, পুবের আকাশও এখন লালের নানা বর্ণসমন্বয়ে রাঙা হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এই গ্রামের সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত কিরণশঙ্কর অনেক চেষ্টা করেও গ্রামের সম্পূর্ণ সৌন্দর্য ঠিক ঠিক বর্ণনা করতে পারেননি মনে হয়। একটা অজানা পাখির প্রথম কণ্ঠস্বরও এখানে শোনে কাজি। হাতে-ধরে-থাকা বাঁশিটায় পাখির কণ্ঠস্বরের খানিকটা জবাবই দেবার চেষ্টা করে বোধ হয়। বাঁশিটা বাজাতে বাজাতেই আবার নবরত্ন মঠের দিকে ফেরে সে। ডান দিকে শান-বাঁধানো ঘাটের ওপর একটা বকুল গাছ। তারই নীচে বসে পড়ে কাজি। সুর তোলে তার বাঁশিতে।

    যেমন স্বভাব, চোখ বুজেই বাঁশি বাজাচ্ছিল সে। এবার চোখ খুলে দেখে সামনে বসে কমলা আর দুলি, ওদের পেছনে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে বীরেন।

    কাজি হেসে বলে, জটু কোথায়?

    ঘুমিয়ে কাদা, জবাব দেয় কমলা।

    এখানে সকালটা কান্দিরপাড়ের চেয়েও ভালো, কাজি বলে, ঘুম ভাঙতে ভাঙতে রোদ্দুর উঠে গেলে মিস করবে তো।

    কান্দিরপাড়ে ওদের সাঁতার শিখতে দেওয়া হয়নি, বলে দুলি, কাল বিকেলে দাদার সঙ্গে রাখাল আর ও পুকুরে নেমেছিল। অনেকক্ষণ ছিল; সেই যে সন্ধ্যের পর ঘুমিয়েছে দুজনে এখনও ওঠেনি।

    বীরেন বলল, এই তেওতা গ্রামেই দুলির জন্ম, জ্যাঠামশাই যখন ত্রিপুরা এস্টেটে নায়েব ছিলেন জ্যাঠাইমা এখানেই থাকতেন। আমরাই বরং এখানে থাকিনি বেশি। বাবা কুমিল্লায় চাকরি করতে গেলেন যখন তখন থেকেই বাবা কুমিল্লার লোক, আমার জন্মও তো কুমিল্লাতেই। মাঝে মাঝে দুয়েকদিনের জন্যে বাবা তেওতা গ্রামে আসতেন, বেড়াতে আসার মতো। কখনো কখনো হয়তো আমরাও আসতাম সঙ্গে। দুলি কিন্তু এখানকার স্কুলে পড়েওছে, তেওতা অ্যাকাডেমি। জ্যাঠামশায়ের হঠাৎ মৃত্যুর পর জ্যাঠাইমা আর দুলিকে বাবা নিয়ে এল কুমিল্লায়, তারপর থেকে এখানে আসা একেবারেই কখনো-সখনো। কলকাতায় তোমার কিরণশঙ্করের সঙ্গে পরিচয় না হলে সবাই মিলে এই তেওতায় হয়তো আসাই হত না কখনো।

    এসে কেমন লাগছে? – জিজ্ঞেস করে কাজি।

    বীরেনের বদলে দ্বৈত জবাব দেয় কমলা আর দুলি, দারুণ ভালো। তারপর কমলা বলে, সবাই মিলে এখানে থেকে গেলেই ভালো হত, ওখানেও তো স্কুলে যাইনা, এখানেও যাব না।

    দুলি বলে, উঁহুঁ উঁহুঁ, এখানে থাকলে স্কুলে যেতেই হবে, তেওতা অ্যাকাডেমি তো আর সরকারি স্কুল নয়।

    এই সব কথার মধ্যেই এসে পড়েন কিরণশঙ্কর, বলেন, বাঃ, নরক তো গুলজার দেখছি। পুচকে দুটো কোথায়?

    ওরা দুজনেই ঘুমিয়ে। কাল এত হুটোপুটি করেছে!

    বেশ তো, করবেই তো হুটোপুটি, সেই জন্যেই তো এখানে আসা। ঘুমোক। এখন তোমরা সবাই যখন এখানে আছ, আজ সন্ধ্যের প্রোগ্রামটা এখনই ঠিক করে ফেলা যাক। সন্ধ্যের প্রোগ্রাম মানে কবি নজরুলের সম্বর্ধনা। নজরুল সাহেবের সামনেই হোক আলোচনা, আমার মনে হয় তাতে কোন ক্ষতি নেই। বরঞ্চ ভালোই হবে। কোন ব্যাপারে আপত্তি যদি থাকে, কবি নিজেই বলতে পারবেন।

    হোক তাহলে, নজরুল বলে, চলুক পানসি বেলঘরিয়া।

    বীরেনকে কিরণশঙ্কর বলেন, তুমি নজরুলের বন্ধু। বাল্যবন্ধু নও, পরিণত মনের কবিকে তুমি খুব কাছ থেকে কবিরূপেই দেখেছ। শুধু কবি নয়, সঙ্গীতশিল্পী, স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর যোদ্ধা, আর পরিবারের সবায়ের সঙ্গে মিশে-যাওয়া খোলামেলা পারিবারিক মানুষ। অতএব, সভাটা শুরু করবে তুমিই। কবির একেবারে ঠিকঠাক বাস্তব একটা চেহারা সবায়ের সামনে তুলে ধরে সভারম্ভের ঘোষণা করবে। এর পর আমাদের আশালতা আ্রর কমলার দ্বৈতকণ্ঠে উদ্বোধন সঙ্গীতের পর গ্রামের প্রবীণতম মানুষ স্বরূপানন্দ দাশের নাম সভাপতি হিসেবে প্রস্তাব করবে তুমি। তুমি প্রস্তাব করবে, আমি সমর্থন করব। উনি পণ্ডিত মানুষ, এখানকার ইশকুলে হেডমাষ্টারি করেছেন অনেকদিন।

    এই পর্যন্ত বলার পর দুলির দিকে আরেকবার চোখ পড়তেই কিরণশঙ্কর বলেন, বললাম তো উদ্বোধন সঙ্গীত, কিন্তু সঙ্গীতটা কী? কী গান? কী গান গাইবে তোমরা?

    কী গান? – প্রশ্নের উত্তর দেয় দুলি, রবীন্দ্রনাথের গান, সফল কর হে প্রভু কেমন হবে?

    কিরণশঙ্কর বলেন, এক্কেবারে ঠিক গান; তাহলে কমলা আর আশালতা, তোমরা আজ সারাদিন প্র্যাকটিস করবে গানটা, মনে রেখ কবি নজরুল শুধু কবি ন'ন, অতি উচ্চাঙ্গের সঙ্গীতশিল্পীও।

    যাই হোক, বলতে থাকেন কিরণশঙ্কর, আসন গ্রহণ করে সভাপতি কবিকে অনুরোধ করবেন তাঁর জন্যে নির্দিষ্ট আসনে বসতে। জটু তারপর কবিকে পরাবে চন্দন আর মালা দেবে রাখাল। কবির জন্যে গরদের ধুতি-পাঞ্জাবি আর একটা শাল এনেছি আমি, ধুতিপাঞ্জাবি উপহার দেবেন শ্রীমতি বিরজাসুন্দরী দেবী আর শালটা শ্রীমতি গিরিবালা।

    সবই তো সেনগুপ্ত পরিবার করবে, তুমি তাহলে করবেটা কী? – বীরেন বলে কিরণশঙ্করকে।

    এই অ্যারেঞ্জমেন্টটাই এক্কেবারে অ্যাপ্ট, আমি ভেবে দেখেছি, বলেন কিরণশঙ্কর। নজরুলের সম্বর্ধনার সুযোগে নিজেদেরও সম্বর্ধিত করবে সেনগুপ্ত পরিবার। নজরুলের প্রতিভা তো তর্কাতীত, কিন্তু আমি পাঁচজনের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝেছি, এই প্রতিভার বিকাশে সেনগুপ্ত পরিবারের গৌরবও বেড়েছে, এ যেন বাড়ির ছেলের সাফল্যে সবায়েরই সাফল্য। আমরা শুভার্থীরা সেই গৌরবের অংশীদার হবার সুযোগ নিচ্ছি।

    কাজির বোধ হয় এ সব শুনতে মজাই লাগছিল, চুপচাপ বসে ছিল সে এতক্ষণ। এখন কিরণশঙ্করের উদ্দেশে বলল, সবই এমন সাজিয়ে-গুছিয়ে দিচ্ছেন ঠিক কিসের পর কী; এবার একটু আগেভাগেই সাবধান করে দিই, বলে বসবেন না, এরপর নজরুলের বক্তৃতা।

    বক্তৃতায় আপনার আপত্তি থাকে তো কেউ তাতে আপত্তি করবে না, বলেন কিরণশঙ্কর, আপনি না-হয় দু' কলি গেয়েই দেবেন।

    নজরুল হাসতে হাসতে ধরে,


    এসেছি কি হেথা যশের কাঙালি কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি
    মিছে কথা কয়ে, মিছে যশ লয়ে, মিছে কাজে নিশিযাপনা!
    কে জাগিবে আজ, কে করিবে কাজ কে ঘুচাতে চাহে জননীর লাজ–
    কাতরে কাঁদিবে, মায়ের পায়ে দিবে সকল প্রাণের কামনা?


    তারপর ফিরে যায় গানের গোড়ায়:


    আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না।
    এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছে কথা ছলনা।
    এ যে নয়নের জল, হতাশের শ্বাস, কলঙ্কের কথা, দরিদ্রের আশ,
    এ যে বুক-ফাটা দুখে গুমরিছে বুকে গভীর মরমবেদনা।
    এ কি শুধু হাসি-খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছে কথা ছলনা।


    কিরণশঙ্কর হাসতে হাসতে বলেন, নাঃও, সামলাও তোমাদের কবিকে!

    অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে এবার বীরেন বলে, তোমাদের এই পুকুরটায় আগের মতো মাছ আছে, কিরণ? মনে আছে একবার বাবার সঙ্গে এসে তোমাদের পুকুরে মাছ ধরেছিলাম।

    তা আছে বৈকি, কিরণশঙ্কর জবাব দেন, গ্রামের লোকরা এসে ধরে তো। তবে ওই একটাই নিয়ম, আমাদের পূর্বপুরুষের আমল থেকেই চলে আসছে যে নিয়ম, ছিপ-বঁড়শি দিয়ে যত পার ধর কেউ বারণ করবে না, কিন্তু জাল ফেলা চলবে না।

    ছিপ-টিপ তো নেই, তোমাদের এখানে পাওয়া যাবে কারো কাছে? পেলে, আজই বসতাম একটু, চেষ্টা করে দেখতাম ধরতে পারি কিনা, কালই তো চলে যাব।

    কাল যাবে? কাল?– আহত কণ্ঠ কিরণশঙ্করের, পরশু আমাদের এখানে দোলের উৎসব, থাকবে না?

    বাবাকে রেখে এসেছি, কমলিনীও থেকে গেল সেইজন্যে...

    কমলিনী যখন থেকেই গেলেন তখন আর ইন্দ্রকাকুর অসুবিধে কী? আমার তো মনে পড়ে না তুমি কখনও আমাদের নবরত্ন মঠের দোলের উৎসব দেখেছ।

    খুব ছোটবেলায় দেখেছিলাম একবার, তবে মনে নেই কিছু।

    আমি তাহলে কাকিমাদের সঙ্গে কথা বলি, বলেন কিরণশঙ্কর, তোমাদের যাওয়াটা আরও দু'দিন পিছিয়ে দেবার জন্যে বলি। পরশু দোল, তার পরের দিন যেও তোমরা।

    সন্ধ্যেবেলার নজরুল-সম্বর্ধনা ভালোই জমল, যেমনটা কিরণশঙ্কর বলেছিলেন। কিন্তু তা-ই শুধু নয়, নজরুলের “এ কি শুধু হাসি-খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছে কথা ছলনা” শেষ হতেই সভাপতি স্বরূপানন্দ বললেন, এত ভালো অনুষ্ঠান হল, আমাদের দুই ছোট্ট বন্ধুর প্রার্থনা শুনে প্রভু আজকের সভা সফলই করিয়ে দিলেন, কিন্তু ছোট্ট একটা খুঁত রেখে সভাটা আমি ভঙ্গ করতে চাই না। দু'খানা গান হল, দুটোই রবি ঠাকুরের গান। রবি ঠাকুরের গান তো নিশ্চয়ই ভালো, কিন্তু আজকের দিনটায় সভার শেষে কবি নজরুল ইসলামের কণ্ঠে তাঁরই একটা গান হলে এই সভা সুসম্পূর্ণ হত না?

    সভাপতি মশায় যা বললেন, উঠে দাঁড়িয়ে বলেন কিরণশঙ্কর, আমি তা সমর্থন করি। আমি আসছি এখন কলকাতা থেকে, সেখানে কবির ভাঙার গান – কারার এই লৌহকপাট – এখন প্রবলভাবে জনপ্রিয়। কবি যদি সেই গানটি আমাদের শোনান তাহলে এই সভা সার্থক হবে।

    নজরুল বলে, একটা শর্ত আছে। পুরো গানটা আমি গাইব একবার। কিন্তু শেষ স্তবকটা গাইব তিনবার। চতুর্থবার এই সভার সমস্ত দর্শক-শ্রোতারা আমাকে সঙ্গ দেবেন। কুমিল্লায় আমাদের প্রভাত-ফেরী যাঁরা দেখেছেন অথবা শুনেছেন, তাঁরা জানেন এই ভাবেই কুমিল্লার সমস্ত মানুষ গান গেয়ে প্রভাত-ফেরীতে যোগ দিয়েছেন। আপনারা রাজি?

    উপস্থিত মানুষেরা হাততালি দিয়ে এবং স্বকণ্ঠে তাঁদের ঐকমত্য জানান। নজরুল গান ধরে। শেষ স্তবকটি বোধ হয় তেওতা গ্রামের সীমানার বাইরেও শোনা যায়।


    নাচে ঐ কালবোশেখী
    কাটাবি কাল বসে কি?
    দে রে দেখি
    ভীম-কারার ওই ভিত্তি নাড়ি!
    লাথি মার্‌ ভাঙরে তালা!
    যত সব বন্দীশালায় –
    আগুন জ্বালা
    আগুন জ্বালা, ফেল্‌ উপাড়ি।


    আগুন জ্বললো পরের দিন, সম্পূর্ণ নতুন আবহে। এমনটা কাজি দেখেনি আগে; দোলের আগের দিন, সন্ধ্যে পেরিয়ে তখন রাত অনেকটাই। পরের দিন পূর্ণিমা, আজই আকাশ ভেসে যাচ্ছে আলোর বন্যায়। নানারকমের কাঠকুটো যোগাড় করে গ্রামের ছেলেরা এসে জমিদারবাবুর প্রাঙ্গনে আগুন জ্বালাল। ছেলের দল বলল নেড়াপোড়া, কিরণশঙ্কর বললেন চাঁচর। তারপর বললেন, ওদের নেড়াপোড়া কথাটাও কিন্তু বেশ যুক্তিযুক্ত। ধানকাটা হয়ে গেছে, পিঠেপায়েসের উৎসবও শেষ। এখন নতুন করে জমিতে কাজ শুরু হবে, তার আগে ক্ষেতে পড়ে-থাকা শস্যস্তম্ব, মানে, শস্য কেটে নেবার পর ক্ষেতে পড়ে থাকে যেটুকু, যাকে গ্রাম্য ভাষায় নেড়া বলে, তা পোড়ানো হবে। খেয়াল করে থাকলে দেখেছেন হয়তো, যেসব কাঠকুটো ওরা পোড়াচ্ছিল তার মধ্যে বেশিটাই ছিল ওই নেড়া। তাই নেড়াপোড়া। নজরুল একদৃষ্টে তাকিয়েছিল আগুনের দিকে, হঠাৎ গেয়ে উঠল


    আগুনে হল আগুনময়।
    জয় আগুনের জয়।
    মিথ্যা যত হৃদয় জুড়ে এইবেলা সব যাক-না পুড়ে,
    মরণ-মাঝে তোর জীবনের হোক না পরিচয়।

    আগুন এবার চলল রে সন্ধানে
    কলঙ্ক তোর কোনখানে যে লুকিয়ে আছে প্রাণে।
    আড়াল তোমার যাক রে ঘুচে, লজ্জা তোমার যাক রে মুছে,
    চিরদিনের মতো তোমার ছাই হয়ে যাক ভয়।


    চমকিত হয়ে কিরণশঙ্কর বলেন, এটাও কি রবি ঠাকুর?

    মনের যে-কোন আবেগ প্রকাশ করতে হলে ওই রবি ঠাকুরের গান ছাড়া আর আমাদের কী আছে বলুন।

    আপনি রবি ঠাকুরের গান কত জানেন? – প্রশ্ন করেন কিরণশঙ্কর।

    সব।– নজরুল জবাব দেবার আগেই বীরেন বলে, সব গান। ওর বন্ধু আছেন মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ। উনি আমায় বলেছিলেন উনি নাকি নজরুলকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের হাফিজ বলেন। সমস্ত কুর-আন যাঁর মুখস্থ তাঁকে নাকি হাফিজ বলা হয়। আমাদের বন্ধু কাজি নজরুল ইসলাম হলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের হাফিজ।

    চোখ-পাকিয়ে তাকায় কাজি, এরকম? ঠিক আছে, এ-যাত্রায় আর রবীন্দ্রনাথের গান নয়। যত গান এখন থেকে শুনবে সব এই শর্মার।

    চুরুলিয়ায় ওদের গ্রামে ছোটবেলায় কাজি দেখেছে দোল মানেই রঙ আর কাদামাটির ছোড়াছুড়ি। ওর অবিশ্যি তাতে আপত্তি নেই, যে-কোন হুল্লোড়েই ও স্বচ্ছন্দ। পরের দিন সকাল বেলায় নেমে এসে দেখে পুরোহিত-চেহারার একজন মানুষ নবরত্ন-মঠের একেবারে নীচের তলার বড় ঘরটাতে একটা মঞ্চের ওপর রাধাকৃষ্ণের এক যুগল মূর্তিতে
    মালা-টালা পরিয়ে সাজাচ্ছেন। শ্বেত-পাথরের মেঝেতে বসে চন্দন বাটছে একজন, আর-একজন ফুল-টুল সাজাচ্ছে। এরই মধ্যে আর একজন মানুষ নানা মিষ্টান্ন আর ফলমূল কয়েকটা রূপোর রেকাবিতে সাজিয়ে রাখছে। স্থানীয় মিষ্টির মধ্যে এক রকম আছে যার নাম মঠ। কাজি ভাবে, নবরত্ন মঠের আদলে গড়া নাকি?

    একটু পরে গরদের ধুতি-চাদরে হাজির হলেন কিরণশঙ্কর, আরও কেউ-কেউ চান-টান সেরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে হাজির। দেখা গেল বিরজাসুন্দরী আর গিরিবালাকেও। কিছু একটা ভাবল কাজি আপন-মনে, তারপর নীরবে নিজের ঘরে ফিরে গেল। আধ-ঘন্টাটাক পর সদ্য সম্বর্ধনায় পাওয়া গরদের ধুতি-পাঞ্জাবি পরা সদ্যস্নাত কাজি নেমে এল যখন, দেখল সেনগুপ্ত পরিবারের অন্য সদস্যরাও হাজির। তাকে দেখে সকলে চমকিত যতটা খুশি তার চেয়েও বেশি।

    পুজো বেশিক্ষণের নয়। মন্ত্রপূত সচন্দন পুষ্প নিবেদিত হল কিছুক্ষণের জন্যে, তারপর যুগল রাধাকৃষ্ণর পাদস্পৃষ্ট একটা রূপোর থালাভর্তি আবিরের থেকে একটু-একটু আবির নিয়ে সকলের কপালে ফোঁটার মতো লাগানো হল। মিষ্টান্ন এবং ফলমূলও পরিবেশিত হল উপস্থিত সবায়ের মধ্যে।

    সমবেত প্রসাদ ভক্ষণের সময়েই দূর থেকে শোনা গেল কৃষ্ণ-সংকীর্তন। গ্রামের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে এই জমিদার বাড়ির দিকেই এগিয়ে আসছে শব্দটা। কুড়ি-বাইশজনের একটা দল খোল-করতাল বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে ঢুকল নবরত্ন-মঠের অঙ্গনে। কিছুক্ষণ নানা কীর্তন-ভজন গাইল তারা, প্রসাদ দেওয়া হল তাদেরও, এবং কিছু নগদ টাকা। এই দল যেতে-না-যেতেই আর এক দলের আগমন, একই রকম কীর্তন-ভজন, এবং প্রসাদ ভক্ষণ ও আর্থিক পুরস্কারের পর বিদায়। এভাবে প্রায় আট-দশটা দল এল গেল। এরপর যা হল, মনে হল কিরণশঙ্কর এবং উপস্থিত কয়েকজনমাত্র ছাড়া আর সবাই তাতে চমকিত। শেষ দলটার গান-বাজনা চলতে চলতেই আগে এসে গান গেয়ে ফিরে গিয়েছিল যারা, একটি একটি করে সেই সবকটা দল ফিরে এল আবার। তার মানে প্রায় আধখানা গ্রাম এখন জমা হয়েছে নবরত্ন প্রাঙ্গনে। তখন সবাই মিলে কৃষ্ণ-সংকীর্তন। বোঝা গেল এটাই আসল উৎসব। জমিদার বাড়ির কর্মচারিরাও কেউ কেউ এই সংকীর্তনে যোগ দেয়, মাঝে মধ্যে কিছু কিছু হালকা মন্তব্যও ভেসে আসে। এই দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে খানিকটা খোল বাজাল কাজিও। সংকীর্তন শেষে একটা বিরাট ঝুড়ি থেকে মুঠো মুঠো আবির আকাশে ছুঁড়ে দিলেন কিরণশঙ্কর। কাউকে শঙ্কিত হতে হল না, কোন একজনকেও আলাদা করে আবির বা অন্য কোন রঙ দিল না কেউ, শুধু আকাশ হল রাঙা। এমন দোলের উৎসব কাজি অন্তত দেখেনি আগে।

    সকাল থেকে টুকটাক জলখাবার খাওয়া হয়েই গেছে। যখন বোঝা গেল নতুন কোন দল আর আসবে না, তখন চায়ের কথা পাড়লেন কিরণশঙ্কর। চা খেতে খেতে আড্ডা। এক সময় বীরেন বলে, আজ যা শুনলাম এই হচ্ছে আসল বাংলা গান; রবি ঠাকুর-কাজি নজরুল যতই গাও, এ-গানে বাঙালির শরীরে যে এক ধরণের মাদকতা আসে, তা বোধ হয় অন্য কোন গান আনতে পারবে না।

    কেন এই গান রবি-ঠাকুর নজরুল গাইতে পারে না?– নজরুল মন্তব্য করে। রবীন্দ্রনাথের গানে কথা আর সুরের বৈচিত্রের কি শেষ আছে? কালই আমি বলেছি এ-যাত্রায় আর রবীন্দ্রনাথের গান নয়। তবে কাজির গানই শোন। গান ধরে কাজি:


    খেলে নন্দের আঙিনায় আনন্দ দুলাল
    রাঙা চরণে মধুর সুরে বাজে নুপুর তাল।
    নবীন নাটুয়া বেশে নাচে কভু হেসে হেসে
    যশোমতীর কোলে এসে দোলে কভু গোপাল।
    ননী দে বলিয়া কাঁদে কভু রোহিণী কোলে,
    জড়ায়ে ধরে কত মধুর তমাল ডালে দোলে।
    দাঁড়ায়ে ত্রিভঙ্গ হয়ে বাজায় মুরলী লয়ে
    কভু সে জড়ায় ধেনু বনের রাখাল।


    গান শুনে বিস্মিত বীরেন বলে, কই, এ-গান তো শুনিনি কখনও। তোমার লেখা? তোমার সুর? এ যে অবিশ্বাস্য কাজি!

    অবিশ্বাস্য? কেন? এই গানই তো প্রথম শেখা, প্রথম লেখা। কাজি বলে, গান গাইতে আর লিখতে তো শিখেছি লেটোর দলে। সেখানে তো শুধুই রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের গল্প নিয়ে গান বাঁধা। এই সব গানই তো লিখতুম তখন। ছাপা নিশ্চয়ই হত না, কারণ কয়েকটা পালার পরেই আবার নতুন গান লেখা হবে। আর তা ছাড়া, লেটোর দলের গানের কানাকড়ি মূল্যও সত্যি-সত্যিই আছে কি? একটু বড় হয়ে যখন রবীন্দ্রনাথ পড়তে শিখলুম তখন বুঝলুম সত্যিকারের গান কাকে বলে। পল্টনে গিয়ে তো দেশ-বিদেশের রাগ-রাগিণী আর নানারকমের সঙ্গীতযন্ত্রে হাতে খড়ি হল। কিন্তু ছেলেবেলার এ-গান কি ভোলা যায়? কখনো কখনো একটু কাটাকাটি করি, সুর-তাল বদলাই। কে জানে, একদিন হয়তো ছাপাবও, গাইবও সবায়ের মধ্যে।

    একদিন নয় একদিন নয়, কথার মধ্যে বলে ওঠেন কিরণশঙ্কর, আজই গাইবেন। আজ সন্ধ্যেবেলা। বাছাই-করা দুয়েকজনকে ডাকব গ্রাম থেকে, আর থাকব আমরা সবাই। আপনি গাইবেন এক ঘন্টা, শুধু রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গান। কী, হবে তো?

    জমিদার মশায়ের আদেশ, সে তো শিরোধার্য, বলে কাজি, তবে ওই এক ঘন্টাই, তা-ও আমাকে তৈরি হতে হবে। আপনাদের আড্ডা চলুক, আমি একটু কাগজ-পেনসিল-হারমোনিয়ম নিয়ে বসি। নজরুল উঠে পড়ে, চলে যায় তার জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে।

    কাগজে কিছু লিখছে, হারমোনিয়মে কিছু-একটা বাজাচ্ছে, সঙ্গীতে সম্পূর্ণ নিমগ্ন কাজি। এমন সময় তার ঘরে ঢোকে দুলি। একা।

    কাজি বসেছিল ঠিক দরজাটার দিকে মুখ করেই, একটু সন্ত্রস্ত ভঙ্গি দুলির, কাজি হেসে মুখ তোলে, তার চোখ চলে যায় দুলিকে পেরিয়ে দরজা পেরিয়ে পেছনের বারান্দাটা পর্যন্ত। একা?– প্রশ্ন করে কাজি।

    হুঁ, ওই সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতেই একটু এগিয়ে আসে দুলি, তার হাতে একটা কাগজের ঠোঙা। তোমার জন্যে আবির এনেছিলাম, বলে দুলি, তারপর দেখি এখানে কেউ আবির নিয়ে কারো সঙ্গে খেলে না, শুধু আকাশে ছুঁড়ে ছুঁড়েই দেয়। সবাই চলে গেলে আমি তাই চুপি চুপি উঠে এসেছি।

    আবির নিয়ে? একা? কেউ যদি দেখে ফেলে তোমাকে বকবে না?

    কেউ দেখবে না, বলে দুলি, দেব আবির?

    তুমি দিলে তো আমিও দেব।

    দাও না, আমি কি বারণ করেছি?

    তুমি ছেলেমানুষ দুলি, তোমার কোন বুদ্ধিই হয়নি এখনো। আমাকে যদি আবির দাও তুমি, আমি নীচে নামব যখন চান টান সেরে, কেউ বুঝতেই পারবে না কিছু। কিন্তু তুমি এখান থেকে আবির মেখে নামলে কী হবে?

    কী হবে?

    তোমাকে আবির-মাখা অবস্থায় দেখলে কেউ কিছু বলবে না? কেউ জিজ্ঞেস করবে না কে দিল আবির? কখন দিল? কীভাবে দিল? আমার নাম শুনলে কেউ বলবে না কিছু?

    কথার কোন উত্তর দেয় না কেউ। হয়তো এতক্ষণে কিছু বোঝে দুলি। তার মুখে কেমন একটা ভয়ের ছাপ, চোখে জল। তার শুকনো ঠোঁট-জোড়া কাঁপতে থাকে।

    আমারই দোষ, কাজি বলে, তুমি বড্ড ছেলেমানুষ দুলি, বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় সে, একেবারে দুলির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দুলির হাত থেকে আবিরের ঠোঙাটা নেয় নিজের হাতে। কাজি অনেকটা লম্বা, তার বুকের সামনে দুলির মুখ, এক মুহূর্তে কী যে হয়ে যায়, কাজির বুকে মুখ চেপে ধরে দুলি, বাঁধ-ভাঙা তার চোখের জলে কাজির পাঞ্জাবি ভিজে যায় অনেকটা। ডান-হাতটা দুলির মাথায় রাখে কাজি, বাঁ-হাতটাতে আবিরের মুখ-বন্ধ ঠোঙাটা চেপে ধরে বুড়ো আঙুলটা দুলির শুকনো ঠোঁটে বুলিয়ে দেয় কয়েকবার। হঠাৎ ফুঁপিয়ে ওঠে দুলি।

    আবিরের ঠোঙাটা একটু নীচু হয়ে হারমোনিয়ামটার ওপর রাখে কাজি, দুলির কাঁধ-দুটোয় আলতো চাপ দেয়, তারপর দু-হাত দিয়ে দুলির চোখ মুছিয়ে বলে, এখন তুমি যাও দুলি। আবির এখানে থাক, আমরা পরে খেলব।

    বিকেলে চা-খাওয়ার সময় গিরিবালা বলেন, ভাবছি দুলি আর আমি আর-কয়েকদিন থেকে যাই। এতদিন পর এলাম, আবার কবে আসা হবে কে জানে, গ্রামের সবায়ের সঙ্গে তো দেখাও হল না।

    কিরণশঙ্কর যেন লাফিয়ে ওঠেন, এটাই হল কথার মতো কথা। আমি তো নজরুল সাহেবকে বলেই এসেছিলাম এখানে বেশ কয়েকদিন থাকা হবে। এত তাড়াতাড়ি সবাই চলে যাবে ভেবে আমার মন খারাপ হচ্ছিল। তারপর বীরেনকে বলেন, তোমাদের যদি যেতেই হয় কাল, তোমরা যাও। নজরুল সাহেবের সঙ্গে কাকিমা আর আশালতাকে কয়েকদিন পর আমি পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করব।

    গান-গল্প মিলে প্রায় ঘন্টা দেড়েকের অনুষ্ঠান সন্ধ্যেবেলায়। ঠিক ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে ভজন-কীর্তনগুলো রচিত হয়েছে এমনটা যে নয়, অনুষ্ঠানের শুরুতেই কাজি কবুল করে এ-কথা। রাড় বাংলা – বিশেষত বর্ধমান-বাঁকুড়া-বীরভূমের – লেটো গান নামে পরিচিত লোকশিল্পে ছেলেবেলায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে প্রায় বিনা প্রস্তুতিতে লিখে গাওয়া হয়েছে এই গানগুলো। পরে কিছু পরিমার্জন হয়েছে, সময় পেলেই এখনো এগুলো নিয়ে বসে কাজি খানিকটা
    পরিবর্তন-পরিমার্জনার চেষ্টায়। আজ সকালে বোধ হয় দোলযাত্রা উপলক্ষে গাওয়া সংকীর্তনগুলো শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছে কাজি, তারই ফলে এই গান। মোট খান-দশেক গান গাওয়া হল, এ-গ্রামে বোধ হয় অনেকেই কৃষ্ণ ভক্ত, শেষ গানের পর চোখে জল নামে অনেকেরই, অবাক হয়ে কাজি দেখে সামনের সারিতে বসা দুলির চোখেও জল: 


    শুকসারী সম তনুমন মম
    নিশিদিন গানে তব নাম।
    শুকতারা সম ছলছল আঁখি
    (তোমারই) পথ চেয়ে থাকি ঘনশ্যাম।
    হে চিরসুন্দর অধরাতে আসি
    বল বল কে শুনায় আশার বাঁশি,

    কেন মোর জীবন মরণ সকলই
    (বঁধু) তব শ্রীচরণে সঁপিলাম।

    কেন গোপন রজনীর যমুনায় জোয়ার আসে
    কেন নবনীরদ মায়া হেরি হৃদি আকাশে
    দেখা যদি নাহি দিবে কেন মোরে ডাকিলে
    (বঁধু হে) কেন অনুরাগ-তিলক ললাটে আঁকিলে
    কেন কুহু-কেকা সম বিরহ অভিমান
    অন্তরে কাঁদে অবিরাম।


    জীবনে বোধ হয় এই প্রথম, সে রাতে চোখে ঘুম আসে না কাজির। সেই যে বছর খানেক আগে নার্গিসের বাসর থেকে রাত্রিবেলা উঠে এসে কান্দিরপাড়ে রওনা দিয়েছিল বীরেনের সঙ্গে, আর তারপর ভয়ানক অসুস্থ হয়ে নিজের শরীরের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিল মা বিরজাসুন্দরী আর দুলির হাতে, তার পর থেকে গভীর রাতের নির্জনতায় কোন নারীর মুখ ভেসে আসেনি স্বপ্নেও। কারো কথা ভেবে ঘুমের অসুবিধেও হয়নি কখনো। আজ সারা রাত ধরে বিছানায় শুধু এপাশ-ওপাশই হচ্ছে, ঘুম আসছে না। দুলির কান্না-আক্রান্ত দুটো মুখ বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে। সেই দুপুর বেলার আতঙ্ক আর আবেগ মিশ্রিত ভরা-জল চোখদুটো, যা পরম মমতায় মুছিয়ে দিচ্ছিল কাজি, সেই যে ভয়-পাওয়া শুকনো ঠোঁটে নিজের আঙুল বুলিয়ে দিয়েছিল একেবারে স্বতঃস্ফূর্ত – কিছু না ভেবেই – সেই মুখ একবার, আবার পরক্ষণেই সন্ধ্যেবেলার গানের আসরে চোখের জলে ভেসে-যাওয়া মুখটা। কারো দিকে তাকিয়ে ছিল না দুলি। চোদ্দ বছর বয়েস মাত্র; সেই বয়েসের মেয়ের দূরনিবদ্ধ এক জোড়া চোখে এত অনর্গল জল আসছিল কোথা থেকে?

    ভালো-লাগার কষ্টে ঘুম আসে না কাজির।

    বিরজাসুন্দরীকে যখন প্রণাম করে মাথা তুলল সে আজ বিদায়ের সময়, ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মাথায় হাত রেখে উদ্বিগ্ন মুখে বললেন তিনি, তোর শরীর ভালো আছে তো? ঋতু পরিবর্তনের এই সময়টা ঠাণ্ডা-গরমের, একটু সাবধানে থাকিস।

    গ্রামের সমবয়েসী বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবার উত্তেজনায় যেন অনেক বয়েস কমে গেছে গিরিবালার। সকালেই কিরণশঙ্কর বলে দিয়েছেন, আজ থেকে শুধু নজরুল নয়, গিরিবালা এবং আশালতাও তাঁর অতিথি। রাতে যদি শোবার জন্যে নিজেদের বাড়িতে তাঁরা ফিরে যেতে চানও, খাওয়া-দাওয়া, সকালের চা থেকে একেবারে রাত পর্যন্ত, আজ থেকে কিরণশঙ্করের বাড়িতে। তারপর কী ভেবে গিরিবালাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার খাবার কি আমাদেরই মতো না অন্য কিছু? না বাবা, গিরিবালা বলেন, আমিষ চলবে না আমার।

    আমিও সেরকমই ভাবছিলাম, একটু সঙ্কুচিত হয়ে বলেন কিরণশঙ্কর।

    সকালেই গিরিবালা বেরিয়ে গেলেন দুলিকে সঙ্গে নিয়ে। তাঁর মেয়ে কতো বড় হয়ে গেছে; কী সুন্দর দেখতে হয়েছে সে, যারা দেখেনি অনেকদিন, তাদের দেখিয়ে একেবারে অবাক করে দেবেন।

    পুকুরের সামনে বকুল গাছের নীচে বড় একটা চায়ের পট নিয়ে বসলেন কিরণশঙ্কর কাজিকে নিয়ে। কথায় কথায় পলিটিক্স এসে পড়ে। এর আগের বার কুমিল্লায় এসে গান্ধীকে নিয়ে গান বেঁধেছিল কাজি, প্রভাত-ফেরীতে দিনের পর দিন গাওয়া হয়েছে সেই গান। গান্ধী আর দেশবন্ধুর ছবি সঙ্গে নিয়ে মিছিল করেছে ওরা, সরকারি পরামর্শ মেনে যারা বাড়ির সামনে কলাগাছ পুঁতে যুবরাজকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল তাদের কলাগাছের কাণ্ডের ওপর গান্ধী আর দেশবন্ধুর ছবি লাগিয়ে দিয়েছিল ওরা, অহিংস অসহযোগ মেনে নিয়ে সঙ্গীত ছাড়া অন্য কোন ভাষায় প্রতিবাদও জানায়নি, অথচ স্বয়ং মহাত্মা কী করলেন? তিনি তো নিজেই বলেছিলেন এক বছরের মধ্যে স্বাধীনতা এনে দেবেন, তাঁর কথায় এমনকি অনুশীলন-যুগান্তরের ছেলেরাও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিল। আজ এক বছর পর শুধু চৌরিচৌরাই দেখলেন মহাত্মাজী, যে-দেশে জালিয়ানওয়ালাবাগ হতে পারে সে দেশে একটা চৌরিচৌরা এমন কী ব্যাপার?

    ঠিকই, কিন্তু একটা কথা আমাদের বুঝতে হবে, বলেন কিরণশঙ্কর। মহাত্মাজীকে যাঁরা পছন্দ করেন না, সারা দেশ থেকেই তাঁরা তাঁকে এক বছরের মধ্যে স্বাধীনতা পাইয়ে দেবার কথা তুলে দোষ দিচ্ছেন। কিন্তু নাগপুর কংগ্রেসে তিনি স্পষ্ট করেই তো এই স্বাধীনতার সংজ্ঞা দিয়ে দিয়েছিলেন, এ-কথাটা কেউ বলছে না।

    কী সংজ্ঞা?

    গান্ধীজি বলেছিলেন অসহযোগ আন্দোলন মানেই স্বাধীনতা। উনি তো স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, স্বাধীনতা কেউ দেয় না, স্বাধীনতা নিজের মনেই। উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিলেন মহাত্মাজী তখন, এই যে স্কুল-কলেজ বয়কট করার কথা বলা হল, বয়কট মানে সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার বয়কট, শিক্ষার বয়কট তো নয়। ওদের স্কুল-কলেজে যাব না বলে আমরা তো বসে নেই। এই-যে আমরা ন্যাশনাল কলেজ খুলেছি, শিক্ষা তো বন্ধ করিনি। শিক্ষায় আমরা স্বাধীন হয়েছি। সরকারি ব্যবস্থা ত্যাগ করেছি, কিন্তু একই সঙ্গে স্বাধীনভাবে শিক্ষা দিচ্ছি তো ছেলেদের। এটাই স্বাধীনতা। গান্ধীজি আইনজীবীদের বলেছেন সরকারি আদালত ত্যাগ করতে, কিন্তু তার বদলে –

    যেখানে ওরা বসেছিল হঠাৎ নায়েবমশাই এসে পড়েন সেখানে। বয়স্ক মানুষ, একটু অসহায় মুখ করে বলেন, আপনাকে বিরক্ত করছি কথাবার্তার মাঝখানে।

    কেন, কী হল নায়েবমশাই?

    ওই হাটের গণ্ডগোলটার কথা বলছিলাম, দু-দলই সাক্ষীটাক্ষী নিয়ে হাজির।

    ও, তাই বুঝি?– উঠে দাঁড়ান কিরণশঙ্কর। এই দেখুন, নজরুলের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলেন তিনি, কেমন স্বাধীন ভাবে বিবাদ মেটাব আমরা দেখুন। সরকারের আদালতে যাব না, দু-দলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ঝগড়া মেটানো হবে। এই তো আমাদের স্বাধীনতা। আসবেন নাকি?

    নাঃ, ঝগড়া আপনিই মেটান, আমি একটু নদীর ধার থেকে ঘুরে আসি।

    নদীর ধারে একা-একা বেড়াতে বেড়াতে দুলির মুখই মনে পড়ে কাজির বারবার। সেই যে আগের বার কুমিল্লা থেকে ফিরে যাবার আগের দিন কাজি যখন নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিল ঠিক সেই সময়েই হঠাৎ দুলি একাই ঘরে এসে কাঠবেড়ালী কবিতাটার পরিষ্কার করে লেখা একটা কপি দিয়ে গেল, আর অসতর্ক মুহূর্তে গুম গুম করে তিনটে কিল কাজিকে মেরে পালিয়ে গেল, সেই কিল-এর মোহেই আবার কুমিল্লায় ফিরতে ইচ্ছে করছিল ওর। কাউকে
    এ-কথা বলতে পারেনি ও। মুজফ্‌ফরকে নয়, পবিত্রকেও নয়। ভেবেছিল, দুলির সঙ্গে দেখা হলে এই কিল-এর বোঝাপড়া হবে। কিন্তু ওর বুকে মুখ গুঁজে দুলির কান্না! আর কোন-কিছু-না-ভেবে চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে কী ভাবে যেন নিজের অজান্তেই দুলির ওষ্ঠ-অধরের স্পর্শ ওর আঙুলে!

    মাথা নীচু করে পদচারণা করতে করতে হঠাৎ একটা চিন্তা আসে কাজির মাথায়। দুলিকে কি ভয় পাইয়ে দিয়েছিল ও? হাতে আবিরের ঠোঙাটা নিয়ে ঝোঁকের মাথায় ওপরে উঠে এসেছিল দুলি। এইরকম ঝোঁকের সময় পৃথিবীতে আর কারো কথা মাথায় আসে না। কে দেখল, কে কী ভাবল সব ভুলে যায় মানুষ। কাজি নিজেই ওকে মনে করিয়ে দিয়েছিল আর সবায়ের অস্তিত্বের কথা। কেউ যদি ওকে দেখে ফেলে ওই সময়! হাতে আবিরের ঠোঙা! তাই কি দুলির ভয়? তাই কি কান্না? কিন্তু, সন্ধ্যেবেলার অনুষ্ঠানে চোখ ভরা জল নিয়ে প্রায় অসীমে নিবদ্ধ দৃষ্টিতে কাঁদছিল কেন দুলি? সে-ও কি ভয়? কার ভয়? কিসের ভয়?

    দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে গিরিবালা দুলিকে নিয়ে তাঁদের নিজেদের বাড়িতে গেলেন বিশ্রাম নিতে। কিরণশঙ্কর কাছারিতে। কাজি তার জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে। কাল রাতে ঘুম হয়নি ভালো, কাজি কিছুক্ষণ শোয়, ঘুম তবুও আসে না চোখে, তারপর উঠে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে যমুনায় চোখ রাখে। চোখ রাখে কাজি, কিন্তু দেখে কি কিছু? ওই যে মাঝনদীতে ছোট একটা নৌকো চলে যাচ্ছে, তা কি দেখতে পাচ্ছে কাজি? আর একটা নৌকো ঘাটে ভিড়েছে, সেখানে দুজন মাঝির একজনের হাত ধরে ধরে সাবধানে নৌকো থেকে নামছে নারী-পুরুষ-শিশু যাত্রীর দল, কাজির কি চোখে পড়ছে সেই দৃশ্য? নদীর দিকে তাকিয়েই আছে সে, কিন্তু কাজির চোখের সামনে কোন নদী নেই, শুধু আছে চোদ্দ বছরের এক বালিকার মুখ; সেই মুখে কি কোন কষ্টের ছাপ, না হলে কোথা থেকে এত জল এসে সেই মুখকে ভিজিয়ে দিচ্ছে বারবার? জলভরা চোখ দুটোয় নির্দিষ্ট কোন দৃষ্টি দেখতে পায় না কাজি, জলই দেখে শুধু!

    কাজিদা! – অতি-পরিচিত গলায় স্পষ্টই কাজির নাম, পেছন ফিরে ঘুরে দাঁড়ায় কাজি।

    দুলি! তুমি?

    কোন কথা বলে না দুলি, মুখটা একটি নীচু করে দাঁড়িয়েই থাকে, তার চোখে জল।

    কাঁদছ কেন দুলি, কী হল তোমার?

    ধীরে ধীরে মুখটা তুলে জলের তুফান চোখ থেকে নামিয়ে কথা বলবার চেষ্টা করে দুলি, ওষ্ঠ আর অধরের মাঝখানে একটু ফাঁক হয়, বাষ্পীয় একটা বুদবুদ ফেটে মিলিয়ে যায় ওষ্ঠাধরের সেই ফাঁকে। দু-গালের দুপাশে কাজির জোড়া হাতের মাঝখানে দুলির মুখ এক মুহূর্তের জন্যে, তারপরেই ডান-হাতের তালু দিয়ে দুলির চোখ দুটোকে বন্ধ করিয়ে দেয় কাজি, কয়েক মুহূর্তের নিশ্চুপতা, ঈষদুষ্ণ একটা ভিজে বাতাসের মতো অনুভূতি দুলির নাক আর মুখের উপর, তারপর নরম একটা ভিজে অথচ উষ্ণ এবং দৃঢ় স্পর্শ ঠোঁট-জোড়ায়। কতক্ষণ জানে না দুলি, কতক্ষণ জানে না কাজি।

    কাজি যখন ধাতস্থ হয় দুলির শরীর তার নিজের ভার নিতে প্রায় অপারগ তখন। মাথাটা কাজির বুকে। শরীরের
    প্রায়-টলমল ঊর্ধ্বাংশের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যেন পদদ্বয়ের নেই আর। কাজি দুহাতে বেড় দিয়ে শক্ত করে ধরে থাকে দুলিকে। এতক্ষণে দুলিও সামলে নেয় নিজেকে।

    কাজির ঈষৎ লালচে মায়াবী চোখ জোড়া এখন স্পষ্টই দুলির চোখে নিবদ্ধ। দুলি, বলে সে, এবার স্থির হও। বোঝাপড়া তো হয়েই গেল আমাদের। কেঁদো না আর। কাউকে কিছু বলার দরকারও নেই। তুমি জানলে, আর আমি। আর যে ক'দিন এই তেওতা গ্রামে আছি, তুমি একা এই ঘরে আসবে না আর। নিয়ন্ত্রণ হারাবার ভয় আছে আমাদের দুজনেরই। তুমি বড় হয়েছ দুলি, বুঝতে পারছ?

    এবার পুজোয় যে লাল-ডোরা হলুদ শাড়ি দুলির জন্যে নিয়ে এসেছিল কাজি কলকাতা থেকে, সেই শাড়ি দুলির পরনে। তারই আঁচল দিয়ে মুখ মুছে নেয় দুলি। তারপর জমিদার বাড়ি থেকে নেমে যেখানে মা শুয়ে আছে সেই ঘরে পৌঁছয় সে। মা বাঁ-দিকে পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে। মায়ের পাশে শুয়ে পড়ে দুলি, ডান-পাশ ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বোজে সে। এখনো তার চোখ দিয়ে জল ঝরছে অবাধ অবিরাম।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ | ২৭৮১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল প্রতিক্রিয়া দিন