কুমিল্লায় ফেরার আগে আরও যে ক'দিন তেওতায় ছিল ওরা, দুলি আর একা একা আসেনি কাজির ঘরে। তেওতায় কাজি এসেছিল কিরণশঙ্করের সঙ্গে, দুলি বুঝতে পারে না ও-ও কি যাবে কুমিল্লায় এবার, না সোজা জমিদারবাবুর সঙ্গেই ফিরবে কলকাতায়। অন্য কার কী মনে হয়েছে কাজি জানে না, কিন্তু যতবারই চোখ পড়ছে দুলির দিকে মনে হয় কেমন যেন থমথমে মুখ দুলির। কুমিল্লায় ফেরবার আগের দিন সন্ধ্যেবেলা আবার গানবাজনার আয়োজন করলেন কিরণশঙ্কর। দুলির সেই একই ডিউটি, পান সাজা আর মাঝে-মাঝেই কাজির কাছে পৌঁছে দেওয়া সেই পান। আজ দুলিকে দেখে মনে হয় একটু খুশি সে, এতক্ষণে দুলি বুঝেছে আগামী কাল কাজিও ওদের সঙ্গে যাচ্ছে কুমিল্লায়।
শেষ যে গানটা গাইল কাজি, সেটা একেবারে নতুন গান। শুনে কিরণশঙ্কর বললেন, দারুণ পার্টিং গিফট দিলেন মশাই, কোনরকমে চোখের জল আটকাল দুলি:
আমার কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী
এ কোন সোনার গাঁয়,
আমার ভাঁটির তরী আবার কেন উজান যেতে চায়।
কোন কূলে মোর ভিড়ল তরী এ কোন সোনার গাঁয়।।
আমার দুঃখেরে কাণ্ডারী করি
আমি ভাসিয়েছিলেম ভাঙা তরী
তুমি ডাক দিলে কে স্বপন-পরী নয়ন ইশারায়।
নিভিয়ে দিয়ে ঘরের বাতি
ডেকেছিল ঝড়ের রাতি
তুমি কে এলে মোর সুরের সাথী গানের কিনারায়?
সোনার দেশের সোনার মেয়ে
হবে কি মোর তরীর নেয়ে
ভাঙা তরী চল বেয়ে রাঙা অলকায়।
এর আগের বার কুমিল্লায় এসে অসহযোগ আন্দোলনে পুরোপুরিই অংশ নিয়েছিল কাজি। মুজফ্ফর কিন্তু বলেছিল এক বছরের মধ্যে স্বরাজ এনে দেবার প্রতিশ্রুতি আসলে গান্ধীজির একটা চালাকি। এবার তেওতায় কিরণশঙ্করের সঙ্গে তর্কাতর্কির পর কাজি আবার মুজফ্ফরের মন্তব্যটা ভাবতে শুরু করে। দু' বছর আগে কলকাতার কংগ্রেস অধিবেশনে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব যথেষ্ট চাপের মুখে ছিল। কংগ্রেস-সভাপতি মোতিলাল নেহ্রু মদনমোহন মালব্য অ্যানি বেসান্ট আর জিন্নাহ্-র বিরোধীতায় গান্ধীর প্রস্তাব প্রায় বাতিল হবার মুখে। সেই সময় এক বছরের মধ্যে স্বরাজ এনে দেবার প্রায়-অসম্ভব প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোনরকমে নিজের প্রস্তাবের অনুমোদন আদায় করে নিয়েছিলেন গান্ধীজি। তার পরে পরেই, ডিসেম্বর মাসেই, নাগপুরে গান্ধীজি নিজের প্রস্তাবটার একটা আশ্চর্য ব্যাখ্যা দিলেন। কিরণশঙ্কর নিজে গান্ধীবাদী এবং বাংলার কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে একজন। গান্ধীর মতো করেই গান্ধীজির প্রতিশ্রুতির ব্যাখ্যা দিলেন তিনিও সেদিন তেওতায়: অসহযোগ আন্দোলনের শুরু মানেই তো আসলে স্বরাজ!
চৌরিচৌরার ঘটনার পর গান্ধীর আন্দোলন প্রত্যাহার কাজি মেনে নিতে পারছিল না কোনমতেই। তারপরে আবার তিনি নিজেও গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন। কলকাতায় থাকতে থাকতে নভেম্বর-ডিসেম্বরেই দুটো কাজ শুরু করেছিল মুজফ্ফর আর কাজি। ন্যাশনাল জর্ণাল্স্ লিমিটেড-এর প্রসপেক্টসের মুশাবিদাই শুধু নয়, কয়েকটা বিজ্ঞাপনে ভবিষ্যৎ শেয়ারহোল্ডারদের কাছে অংশগ্রহণের আবেদনও জানানো হয়েছিল ডিরেক্টরদের নাম দিয়ে। শেষ পর্যন্ত তার ফল কী হল এখনও অবধি জানে না কাজি। এ-ছাড়াও সেই পুলিন গুপ্ত, সেই যে এম-এন রায়ের পাঠানো হয়তো-নকল কম্যুনিস্ট ইন্টার্ন্যাশনালের লোকটি! কে জানে, তার সঙ্গে এখনো কি টিঁকে আছে মুজফ্ফর? মোটের উপর কাজি যা চায়, সতত সক্রিয় একটা কাজ, সেটা দেশের জন্যে মাঠে নেমে লড়াইই হোক বা খবরের কাগজের পাতায় লিখেই হোক – তার তো ব্যবস্থা একটা প্রায় হয়েই গিয়েছিল। এমন সময় গান্ধীর আন্দোলন প্রত্যাহার তো প্রায় গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়া! এই যে এক বছরের মধ্যে স্বরাজের আশায় অনুশীলন-যুগান্তরের ছেলেরা তাদের ভেবে-রাখা অ্যাকশন পিছিয়ে দিয়ে সবাই মিলে সত্যাগ্রহে নেমে পড়ল, কী করবে তারা এখন? কাজি মনে মনে স্থির করল অতীন্দ্রর সঙ্গে সবিতা আশ্রমে যেতে হবে একবার। প্রবোধচন্দ্র সেন নামের যে ছেলেটির কথা বলেছিলেন অতীন দাদা সেই আগের বারেই – সেই যে আঠের সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নজরবন্দী ছিল এখন ফকিরচাঁদ কলেজে পড়ে – তার সঙ্গেও যোগাযোগ করা দরকার। কিন্তু সে তো আর কুমিল্লায় থাকে না, তার কলেজ যেখানে সেই সিলেটেই থাকে সে। অতীনদাদা বলেছেন কুমিল্লায় আসবে সে কয়েকদিনের জন্যে। এবার বিপ্লবী আন্দোলনে পুরোপুরিই নামবে কাজি, আর প্রবোধকে পড়াবে ওর বিদ্রোহী কবিতা। রবীন্দ্রনাথের প্রায় সব কবিতাই নাকি কণ্ঠস্থ প্রবোধের!
দুলির সঙ্গে কাজির সম্পর্ক নতুন যে বাঁকটা নিয়েছে, মনে হয় সেটা এখনো অবধি কান্দিরপাড়ের সেনগুপ্ত বাড়ির কারো চোখে পড়েনি। কাজির কিন্তু মনে হয় আগের তুলনায় হঠাৎ খানিকটা বড় হয়ে গেছে দুলি, একটু কম কথা বলে আজকাল। এখানে এলে যে-ঘরটায় কাজি থাকে সেটা যে একেবারেই আলাদা করে ওর থাকবার জন্যেই ব্যবহৃত হয় তা তো নয় – অন্যরাও ব্যবহার করে এই ঘর প্রয়োজন মতো – তবুও কাজির ব্যবহারের জন্যে একটা আলাদা চেয়ার-টেবিল, ওর জিনিসপত্র রাখবার জন্যে ওই ঘরেরই এক কোণে একটা নির্দিষ্ট জায়গা, এটুকু ব্যবস্থা আছে। আর সেগুলো দেখাশোনা করা, গুছিয়ে রাখা, এ সব কাজের দায়িত্ব দুলির। কাজি খেয়াল করে, দুলির দায়িত্বের কোন পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু এই-যে সপ্তা'খানেক হয়ে গেল ওরা ফিরেছে তেওতা থেকে, এর মধ্যে দুলির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতের কোন সুযোগ ঘটেনি। ঘরে বসে যতক্ষণ কাজ করে কাজি, গান-কবিতা লেখা একটু আধটু, তখন দুলি ব্যস্ত থাকে অন্য জায়গায়। কাজি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে ভিক্টোরিয়া কলেজের হোস্টেলের আর সবিতা আশ্রমের নতুন-গজিয়ে ওঠা আড্ডায়, কাজেই কান্দিরপাড়ে সারাদিন প্রায় থাকেই না সে, সবিতা আশ্রমে গেলে সেখানেই দুপুরে খেতে হয় তাকে, ফিরে আসে যখন তখন পারিবারিক আড্ডায় সবায়ের সঙ্গে সে-ও জমে যায়। ওই যে নতুন গানটা গেয়েছিল তেওতায়, সেটা লিখে যত্ন করে রেখে দিয়েছে দুলির জন্যে, তা-ও এখনো পর্যন্ত দেওয়া হয়ে ওঠেনি।
গতকাল অতীন দাদা খবর পাঠিয়েছেন, আজ প্রবোধ আসছে। কুমিল্লায় ফিরেই সে আসবে সবিতা আশ্রমে। বিদ্রোহী কবিতাটা প্রবোধকে আজ দেবে বলে কাজি ঠিক করেছিল। ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে চা খেয়ে ঘরে ফিরে আসে কাজি, কবিতাটা নকল করবে। এমন সময় দুলি ঢোকে ঘরে, হুকুমের সুরে বলে, ওই যে জামাটা পরে আছ, ওটা ছেড়ে দিয়ে যাবে আজ, গন্ধ ছাড়ছে ওটার থেকে। কাজি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়, তারপর বলে, এদিকে এসো একবার, এটা নিয়ে যাও।
কোন্টা? – বলতে বলতে এগিয়ে আসে দুলি। টেবিল-সংলগ্ন ড্রয়ারটা খুলে আমার কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী গানটা লেখা কাগজখানা বের করে দুলিকে দেয় কাজি, দুলি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, কাগজটা ভাঁজের পর ভাঁজ করতে করতে যতদূর সম্ভব ছোট করে শাড়ির আঁচলে বাঁধে সেটা, তারপর হঠাৎ অপ্রস্তুত কাজির টেবিলে-রাখা হাতের উল্টো পিঠে একটা চিমটি কেটে প্রায়-দৌড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় সে।
এক মুহূর্তের জন্যে হতচকিত কাজি পরের মুহূর্তেই যাবতীয় বিহ্বলতা কাটিয়ে হেসে ওঠে আপন মনে, একটা শ্বাস টেনে চোখ দুটো বুজে নিজেকে আশ্বস্ত করে: সব ঠিক আছে তাহলে।
এমনটা কিন্তু ভালো লাগে না কাজির, সে স্বভাবতই খোলামেলা চরিত্রের মানুষ, এই-যে দুলির সঙ্গে এমন একটা ঘনিষ্ঠতার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল সে, সেটাকে যে যথাসাধ্য গোপন করার চেষ্টা করতে হচ্ছে, এ তার ভালো লাগে না। কিন্তু গোপন না করেই বা কী উপায়? দুলি তো একেবারেই ছেলেমানুষ; নিজের ভালো যদি নিজে সে বুঝত! কাজির মতো একজন ছন্নছাড়া বিষয়আশয়হীন গৃহহীন অর্থসংস্থানহীন মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার অর্থ যদি সে বুঝত! বোঝে না, তাই কাজির দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়।
কিন্তু কাজির যে চিৎকার করে সারা পৃথিবীকে জানাতে ইচ্ছে করছে! ছন্নছাড়া হতে পারি, কিন্তু আমার মতো ভাগ্যবান কে আছে! এতটুকু একটা মেয়ে – কাজির চেয়ে অনেকটাই ছোট সে – তার হৃদয়ের সমস্ত আবেগ দিয়ে ভালোবেসেছে কাজিকে। ভালোবেসেছে, কিন্তু কাজিরই নির্দেশে সমস্ত আবেগকে ধমক দিয়ে থামিয়ে রেখে কেমন স্বাভাবিক ভাবেই ওর যা যা দায়িত্ব – রান্নাঘরে আর ঘর-গেরস্থা্লির কাজে মা-কাকিমাকে একটু-আধটু সাহায্য করা, জটুকে পড়ানো, কাজির জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা এমনকি জামাকাপড় নোংরা হলে কাজিকে না-জানিয়ে সেগুলোকে কেচেও রাখা – সবই করে যাচ্ছে নীরবে। কাজিই তাকে ভয় দেখিয়েছিল তেওতায়। বলেছিল, নিয়ন্ত্রণ হারাবার ভয় আছে আমাদের দুজনেরই। তুমি বড় হয়েছ দুলি, বুঝতে পারছ? এতটুকু মেয়ে, চোদ্দ বছরের কিশোরী সে, সে যা পারছে এই তেইশ বছরের বুড়ো-দামড়া কাজির তা করতে বুক ফেটে যাচ্ছে কেন? কাজির কেন চিৎকার করে সারা পৃথিবীকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করছে, দেখ, তাকিয়ে একবার দেখ আমার দিকে, আমার কপালে রাজটিকা!
কাজি লিখেই ফেলল একটা কবিতা:
হে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে
আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার তোমার চরণ-তলে এসে।
আমার সমরজয়ী অমর তরবারি
দিনে দিনে ক্লান্তি আনে, হয়ে ওঠে ভারী,
এখন এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি
এই হার-মানা হার পরাই তোমার কেশে।।
ওগো জীবন-দেবী!
আমায় দেখে কখন তুমি ফেললে চোখের জল,
এখন বিশ্বজয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল!
আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত রথের চূড়ে
বিজয়িনী! নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,
যত তূণ আমার আজ তোমার মালায় পুরে,
আমি বিজয়ী আজ নয়ন জলে ভেসে।।
কাজি ঠিক করে, এই কবিতা দুলির হাতে পড়ার আগেই এক কপি পাঠিয়ে দেবে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রীটের ঠিকানায় আফজালুল হকের নামে। আফজালের হাতে পড়া মানেই বন্ধু-বান্ধব প্রায় সবায়েরই হাতে পড়া। আর মনে যদি করে, মোসলেম ভারতে ছাপিয়েও দেবে আফজাল। নিজের এই এত গর্বের প্রেমে পড়ার কাহিনী একেবারে কাউকে না জানাতে পেরে আফশোষে হাসফাঁস করছিল কাজি, এবার জানবে সবাই, এবার শান্তি!
গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল খিলাফত আন্দোলনও। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এমনিতেই আন্তর্জাতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে খিলাফত আন্দোলনেও ভাঁটার টান। গান্ধীর গ্রেপ্তারের পর বোঝা গেল খিলাফত আন্দোলনের একেবারে অহিংস থাকায় অসুবিধে আছে। দক্ষিণ ভারতে সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে মোপলাদের সহিংস আন্দোলন এমনকি অন্যান্য প্রদেশেও হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির ওপর ছায়া ফেলল। এদিকে বাংলাতে কংগ্রেসের সাধারণ কর্মীদের কোন বিশেষ আন্দোলনের পরিকল্পনাই নেই; গান্ধী সত্যাগ্রহর কথা বলেছিলেন, সত্যাগ্রহই চলছিল। গান্ধীই সত্যাগ্রহ অসহযোগ বন্ধ করে দিলেন। বন্ধ হয়ে গেল সব বিরোধিতা। সুভাষবাবু আর দেশবন্ধু কারারুদ্ধ। অন্য নেতারাও জেলে; যেসব সত্যাগ্রহী-অসহযোগী-আন্দোলনকারী গ্রেপ্তার হয়েছিল ছাড়া পাবার পর তারা ইতিউতি ঘুরে বেড়ায়, দলবদ্ধ প্রতিবাদের কোন পরিকল্পনাই নেই। কিছু ছেলে ফিরে গেছে স্কুল-কলেজে, স্কুল-কলেজের বয়েস অথবা অবস্থা পেরিয়ে এসেছে যারা, যূথভ্রষ্ট সেই সব মানুষরা একেবারেই বেকার এখন।
তাহলে কুমিল্লায় কাজি করছেটা কী? ওই, ভিক্টোরিয়া কলেজ আর সবিতা আশ্রম! আশ্রমে যেসব ছেলেরা থাকে তারা সবাই বিপ্লবী আন্দোলনের জন্যে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত ছিল এক সময়। কিন্তু এতদিন সবিতা আশ্রমের আশ্রয় তাদের শুধুমাত্র প্রাণ-বাঁচানোর তালিমই দিয়েছে বোধ হয়। নিজের-নিজের এলাকার সঙ্গে কারো যোগাযোগ নেই, এখানে তারা মাছের চাষ করে, সব্জি ফলায়, মায়ের যত্নে ভালোই থাকে, কিন্তু আহার আহারের আয়োজন আর নিদ্রা ছাড়া আর কিছুই করবার আছে কি ওদের? ওদের সঙ্গে আড্ডা দিতে কাজির ভালোই লাগে, গান-বাজনা হৈ হৈ আর পুরোনো দিনের বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপের উত্তেজক নানা গল্প। ইদানিং নিজে কাজি অবিশ্যি অনেক বেশি লিখছে। কিন্তু এভাবে ক'দিন চলবে? প্রবোধ আসুক, তারপর দেখা যাবে।
অত যত্ন করে কাজির নিজের হাতে নকল-করা দীর্ঘ কবিতাটা দেখে হেসে ফেলল প্রবোধ। তারপর পাতাগুলো ভাঁজ করে পকেটে পুরতে পুরতে বলল, কবির হস্তাক্ষরটা কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করলাম; প্রবাসীতে পড়েছি আপনার বিদ্রোহী, মুখস্থও আছে, আমাদের কলেজের লাইব্রেরিতে প্রবাসী নিয়মিত আসে।
কিছু একটা বলবার প্রয়াসে মুখটা যখন একটুখানি ফাঁক করেছে কাজি, প্রবোধ বলে, বিদ্রোহী কবিতার আমার সবচেয়ে প্রিয় স্তবকটা আমার কণ্ঠেই শুনুন। প্রবোধ বলতে থাকে,
আমি চির-দুরন্ত দুর্মদ,
আমি দুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর-মদ।
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি!
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান!
আমি ইন্দ্রাণী-সূত হাতে-চাঁদ ভালে সূর্য,
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য।
আমি কৃষ্ণ-কণ্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধির!
আমি ব্যোমকেশ, ধরি' বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর –
চির উন্নত মম শির!
আশপাশের সবাই মুগ্ধ হয়ে এই আবৃত্তি শোনার পর প্রবোধ বলে, আপনার কবিতার অন্ত্য-মিলের কোন তুলনা নেই কাজিসাহেব, দুর্মদ-এর সঙ্গে ভরপুর-মদ মেলাবার ভাবনা আর ক'জন বাঙালি কবির মাথায় আসবে জানিনা।
আবার কলেজে ফিরে যাবার আগে সবিতা আশ্রমে রোজই আসে প্রবোধ; এই বয়েসে এমন পাণ্ডিত্য নজরুল ভাবতেই পারে না, সংস্কৃত ছন্দ থেকে উত্তর-ভারতীয় অন্যান্য ভাষার মধ্যে দিয়ে বাংলা ছন্দের উত্তরণের বিষয়ে একেবারে মৌলিক ভাবনা-চিন্তা তার; রবীন্দ্রনাথকেও সাহস করে চিঠি লিখেছে সে, দীর্ঘ উত্তর দিয়েছেন কবি। তাকে নিমন্ত্রণও করেছেন শান্তিনিকেতনে।
যোগ্য সমালোচককে নিজের কবিতা পড়াবার লোভ সামলাতে পারে না কাজি, প্রবোধ ফিরে যাবার আগেই সে লেখে আর একটি কবিতা – অথবা দীর্ঘ সঙ্গীত – প্রলয়োল্লাস – যা বাংলা কাব্যের ইতিহাসে নজরুলের নাম স্থায়ী করে দেবে ভবিষ্যতে। প্রবোধকে সে বলে, প্রবাসীতে পাঠিয়ে দিয়েছি কবিতাটা, যদি ছাপে ওরা আপনি কলেজের লাইব্রেরিতেই পেয়ে যাবেন।
কিছুদিন পর আফজালুল হকের হাতে লেখা একটা খাম এল পোস্ট-অফিস থেকে। নাম-ঠিকানা আফজালুলের হস্তাক্ষরে, কিন্তু ভেতরের চিঠিটা যিনি লিখেছেন তাঁর হাতের লেখা চিনতে পারে না কাজি:
প্রিয়বরেষু,
হাতের লেখা দেখে চিনতে পারবেন সে ভরসা করি না, কিন্তু আপনার সঙ্গে বছর দুয়েক আগে আলাপ হয়েছিল। টুকটাক একটু-আধটু লেখালিখি করতাম এক সময়ে, সাংবাদিকতারও যৎসামান্য অভিজ্ঞতা ছিল। ফজলুল হক সাহেবের সান্ধ্য-দৈনিক নবযুগ যখন বের হয় তখন ফজলুল হক সেলবর্সী আর মঈনুদ্দিন হুসয়ন সাহেবের সঙ্গে হক সাহেবের বাড়িতে আলোচনায় মুজফ্ফর আহ্মদ ও আপনার সঙ্গে আরও একজন ছিল, আপনার মনে আছে কি? বস্তুত নবযুগের ডিক্লারেশন সেই একজনের নামেই নেওয়া হয়েছিল, যদিও অন্য অসুবিধের দরুণ শেষ অবধি নবযুগে সে যোগ দিতে পারেনি। আমিই সেই ব্যক্তি।
দৈনিক সেবক নামে কোন বাংলা দৈনিক পত্রিকার নাম আপনি শুনেছেন? মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন যখন তুঙ্গে সে সময় সেবক খুব ভালো চলছিল। সত্যি কথা এই যে সেবকের সম্পাদকীয় অবস্থান ছিল খিলাফৎ ও অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থন। কাগজের স্বত্বাধিকারী এবং সম্পাদক ছিলেন মাওলানা মুহম্মদ আকরম খান। এখন তিনি রাজদ্রোহের অভিযোগে বন্দী। তাঁর কাজ চালাচ্ছি আমি। যদিও আমিই চালাচ্ছি কাজ, তবুও আপনাকে একটা সত্যি কথা বলি। আকরম খান সাহেবের সময় সেবকের যে চাহিদা ছিল আমি তা ধরে রাখতে পারিনি, হয়তো অসহযোগ আন্দোলনের বর্তমান পরিস্থিতি, খানিকটা ভাঁটার টান, এসবই এই দুর্দশার কারণ। কিন্তু আমরা আশা ছাড়িনি। আমার মনে আছে আপনি যখন নবযুগে ছিলেন – সে যতই অল্পদিনের জন্যে হোক – তখন প্রকাশের দিনে নবযুগের ক্রেতারা লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকতেন পত্রিকা পাবার আশায়। শুনেছি আপনি এখন সরাসরি কোন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ন'ন। সেবকে আসবেন? সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে?
আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব যে ভালো তা নয়। প্রতি মাসে একশো টাকা আপনার সাম্মানিক হিসেবে আমরা আপাতত দিতে পারব। আপনি যোগ দেবার পর আমাদের আশানুযায়ী যদি সেবকের চাহিদা এবং আমাদের আয় আশানুরূপ বর্ধিত হয় তাহলে আপনার সাম্মানিকের পরিমাণও হয়তো আরও আকর্ষক হবে।
আপনি যদি সেবকে যোগ দিতে রাজি থাকেন তাহলে বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রীটের ঠিকানায় আফজালুল হক সাহেবের প্রযত্নে আমাদের জানাতে পারেন। আশা করব আপনি আমাদের নিরাশ করবেন না। শুভেচ্ছা সহ –
আপনার একান্ত অনুগত
মহঃ ওয়াজেদ আলি
ওয়াজেদ আলিকে মনে আছে কাজির। সে ভাবে, মাসে একশো টাকা মন্দ কী! কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ন্যাশনাল জর্ণাল্স্ লিমিটেড-এর ব্যাপারটা কী হল? সেখানে যদি কাজটা খানিকটা এগিয়ে থাকে তাহলে কয়েকদিনের জন্যে অন্য কোন পত্রিকার দায়িত্ব না নেওয়াই বোধ হয় ভালো। কাজি জানে না মুজফ্ফর এখন কোথায় আছে আর মুজফ্ফরও জানে না কাজি কোথায়। আফজালের কাছে চিঠি লিখে জেনে নেওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু কাজি ভাবল তাতে সময় নষ্ট। এমনিতেই কুমিল্লায় করবার মতো তার কোন কাজই নেই আপাতত, একাধিক বইয়ের কপিরাইট-বেচা যে টাকা-পয়সা নিয়ে কলকাতা থেকে বেরিয়েছিল সে, তা-ও তো প্রায় শেষ হবারই মুখে। এ অবস্থায় কলকাতায় যখন নিশ্চিত একটা কাজ অপেক্ষা করছে তার জন্যে, ফিরে যাওয়াই ভালো। ন্যাশনাল জর্ণাল্স্ লিমিটেড-এর কাজটা যদি খানিকটা এগিয়েই থাকে তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।
আফজালুল অথবা ওয়াজেদ আলিকে কোন চিঠি লিখল না কাজি। তিন দিন পরের সকালের ট্রেনে টিকিট পাওয়া গেল। এবার যাবার পালা। এক দিক থেকে কুমিল্লা ছেড়ে যেতে তার মন খারাপ হচ্ছে না, একেবারেই নিষ্কর্মার মতো ছিল এখানে, কলকাতায় গিয়ে আবার সাংবাদিকতার জগতে ফেরা যাবে। দুলির সঙ্গে যে দেখা হবে না বেশ কিছুদিন সেটা ভেবে একটু মন খারাপ লাগে। কিন্তু, এখানেই বা দেখা হচ্ছিল কতটুকু? তবুও, সবিতা আশ্রম বা ভিক্টোরিয়া কলেজের হোস্টেল থেকে আড্ডা দিয়ে ফিরে যখন টেবিলটার সামনে বসে, যখন দেখে ঝাড়পোঁছ করে পরিষ্কার করে রাখা টেবিলটা, যখন টেবিলের ওপর গুছিয়ে রাখা কবিতার খাতা আর কয়েকটা নিত্য-প্রয়োজনীয় বইয়ে কল্পনায় দুলির হাতের ছাপ দেখতে পায়, তখন যে বিশেষ ধরণের আরাম বোধ হয় কলকাতায় ফিরে গেলে সেটা আর হবে না। এখানে রাতের খাবারের সময় একসাথে সবাই বসে, সেই সময়টা তো আসবে না কলকাতায়, কোন কোন দিন ঘর-গোছানোর অছিলায় কয়েক মুহূর্তের জন্যে দুলির হঠাৎ দেখা-পাওয়া – নাঃ, সে-ও হবে না! তবু উপায় কী? এমনকি দুলিকে একটা চিঠিও যে কলকাতা থেকে ও লিখতে পারবে না ও তা জানে, তবুও মেনে নিতে হবে সেটাও।
অতি ক্ষোভে হাসিও পায় কাজির। সে নাকি 'বিদ্রোহী' কবি, তার নিজের কবিতার ছত্রগুলো মনে পড়ে যায় তার: আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, / আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম-কানুন শৃঙ্খল! / আমি মানিনাকো কোন আইন, / আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন, / আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর, / আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর! / বল বীর – / চির উন্নত মম শির! / আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি / আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি'। / আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, / আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ!
মুক্ত জীবনানন্দ! – হাসি পায় কাজির। এই পৃথিবীতে 'মুক্ত' কেউ নয়। আইন মানতেই হয়, নিজেকে যতই বিদ্রোহী ভাবা যাক, যতই বলা যাক 'আমি মানিনাকো কোন আইন,' কাজির এই বুকের পাটা নেই যে কলকাতা থেকে চিঠি লিখে দুলিকে বিপদগ্রস্ত করবে সে!
অবশেষে একটা সমাধান মাথায় আসে কাজির। যে-গান শুনে তেওতায় কিরণশঙ্কর বলেছিলেন, দারুণ পার্টিং গিফট দিলেন মশাই, সেই গান শুনেই কোনরকমে চোখের জল আটকিয়েছিল দুলি। কুমিল্লায় ফিরে এসে সেই গানই কাগজে লিখে দুলিকে দিয়েছিল কাজি, তার বদলে দুলি কাজির হাতে দিয়েছিল অপার ভালোবাসার চিহ্নস্বরূপ একটা ছোট্ট চিমটি! কাজি যা বলতে চায় দুলিকে, এখন থেকে বলবে গানে-কবিতায়। ছাপা হবে সেগুলো। যার যা বোঝবার সে তা-ই বুঝবে!
এই যে 'হে মোর রাণী' লিখে পাঠিয়েছে আফজলের কাছে, এ যখন ছাপা হবে তখন তো দুলি, এমনকি সবায়ের সামনে বসেও, পড়তে পারবে সে কবিতা। সে কি চিঠির চেয়ে কম?
মুজফ্ফর বলেইছিল এবার কাজি যদি কলকাতার বাইরে আসে, ও ছেড়ে দেবে তালতলার ঘর। কোথাও-না-কোথাও রাতটুকু কাটাবার ব্যবস্থা হয়েই যাবে। কাজি তাই সোজা পৌঁছয় বত্তিরিশে। আফজাল কোথাও বেরোচ্ছিল, কাজিকে দেখেই জিজ্ঞেস করে, সোজা?
হুঁ, সোজাই তো, জবাব দেয় কাজি, কলকাতায় অন্য কোন ঠিকানা নেই তো আমার।
হ্যাঁ, শুনলাম মুজফ্ফর সাহেব তালতলার বাসাটা ছেড়ে দিয়েছেন।
এমনটাই কথা ছিল, জবাব দেয় কাজি, কাজেই আপাতত কয়েকদিন এখানেই আশ্রয় নেব ভাবলুম।
ওয়াজেদ আলির চিঠিটা পেয়েছিলেন?
পেয়েই তো আসছি।
সেবকে জয়েন করছেন তাহলে?
আপাতত।
আফজালের কাছ থেকে সেবক পত্রিকার অফিসে যাবার নির্দেশ ভালো করে বুঝে নেয় কাজি। আফজাল বলেছিল, বাইরের কাষ্ঠফলকে মোহাম্মদী পত্রিকার নাম লেখা থাকে। সেটা দেখে যেন ঘাবড়াবেন না। একই অফিস। ওয়াজেদ আলি ছিলেন অফিসে। বললেন, ভালোই হল আপনি আসতে রাজি হয়েছেন। অফিশিয়ালি কিন্তু আমাদের কাগজে সম্পাদক হিসেবে আকরম খানেরই নাম ছাপা হবে। সেই হিসেবে কাগজ-পত্রে আপনি সহ-সম্পাদক, যদিও আসল সম্পাদক আপনিই। কাগজ সাজানো, কী লেখা হবে, কোন নতুন বিভাগ খুলতে চান কিনা, সব ব্যাপারেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন আপনি। কেউ হস্তক্ষেপ করবে না। আপনার ওপরে আমাদের পূর্ণ ভরসা, সেই কথাই বলেছিলাম মুজফ্ফর আহ্মদ সাহেবকে। উনি বললেন, অবাধ স্বাধীনতা পেলে কাজি নজরুল ইসলাম অসাধ্য সাধন করতে পারে।
মুজফ্ফর আহ্মদের আমি প্রিয়তম বন্ধু, বলে কাজি, অতএব আমার ব্যাপারে ওর সুপারিশ সব সময় মেনে চলাটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
সে ঠিক আছে, বলেন ওয়াজেদ আলি। আমরা শুধু ওঁরই সুপারিশ দেখেছি এমনটা ভাববেন না। আপনার ওই বিদ্রোহী কবিতার রিপ্রিন্ট ছেপে ছেপে কত পত্রিকা সার্কুলেশন বাড়িয়ে নিল তা-ও তো দেখলাম।
কোন স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়াই নজরুলের হঠাৎ দু-তিন মাসের মধ্যে আবার কুমিল্লায় যাবার প্রস্তাব শুনে মুজফ্ফর আহ্মদ বিরক্ত হয়েছিল। দুজনে মিলে একসঙ্গে আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সম্বন্ধে খোঁজখবর নেবে, এবং আদর্শগত ভাবে কম্যুনিস্ট ভাবধারার সঙ্গে একমত যদি হতে পারে এবং সুযোগ যদি পায়, তাহলে কম্যুনিস্ট আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দেবে, এমনটাই ঠিক ছিল। পুলিন গুপ্ত – সে যতই চালবাজ আর মিথ্যেবাদী হোক না কেন, তারই সূত্রে এম-এন-রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটছিল, তারই সূত্রে কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিক আন্দোলনের সম্বন্ধে খানিকটা ধারণাও তৈরি হচ্ছিল – এরকম অবস্থায় ভাঙার গান বিদ্রোহী ইত্যাদি প্রকাশের পর বাংলা পত্রপত্রিকার প্রবল হৈ হৈ কাজিকে একরকমের ঘোরের মধ্যে এনে ফেলেছিল বলে মুজফ্ফরের বিশ্বাস। কাজী সশস্ত্র আন্দোলনে বিশ্বাস করতেই ভালোবাসে। শ্রমিক-কৃষকের সশস্ত্র মুক্তি-আন্দোলন আর যুগান্তর-অনুশীলনের সন্ত্রাসবাদী সশস্ত্র বিপ্লবপন্থায় তার আবেগ একই রকমের উদ্বেলিত হয়; অথচ অসহযোগী সত্যাগ্রহীদের পথে পরাধীন জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্খারও সে স্বতঃস্ফূর্ত শরিক; ফলত সত্যি-সত্যিই কোন একটি নির্দিষ্ট আদর্শবাদের সীমানার মধ্যে সংযত এবং সুশৃঙ্খল সৈনিক হওয়া কি কাজির চরিত্রে খাপ খায়? মাঝে মাঝেই কাজিকে নিয়ে কী করবে মুজফ্ফর বুঝতে পারে না। সে নিজে অত্যন্ত স্থিরচরিত্র দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষ। কাজিকেও সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। কিন্তু কাজিকে একটা সহজ বার্তা সোজা রাস্তায় দেবার প্রয়োজন আছে। সেটা করতে হলে কাজির সঙ্গে একই ঘরে থাকা বন্ধ করতে হবে, ভাবে মুজফ্ফর। দুজন মানুষ – বিশেষ করে তারা যদি সত্যিই ঐকান্তিক বন্ধু হয় – একসঙ্গে থাকলে এমন সব নিতান্ত পারস্পরিক ব্যক্তিগত অবস্থানে বোধ হয় অভ্যস্ত হয়ে যায় তারা, যে দুজনেই দুজনকে আস্কারা দেবার অভ্যেস তৈরি করে ফেলে! নাঃ, ঠিকানা এবার সত্যি সত্যিই বদলালো মুজফ্ফর।
তাহলে আপনাদের পত্রিকা আমাকে নেবে এটা স্থির? – বলে কাজি।
আমরা স্থির, ওয়াজেদ আলি বলেন, কবে থেকে কাজে আসবেন?
একটা ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান করতে হবে, কাজি বলে, আমি এতদিন মুজফ্ফরের সঙ্গে একই জায়গায় থাকতুম। পল্টন থেকে ফিরে আসবার পর থেকেই এই ব্যবস্থা চলছিল। কিন্তু এতদিনে মুজফ্ফর আমাকে ডাইভোর্স দিয়েছে। নিজের বাসস্থানটার একটা ব্যবস্থা করে ফেলি। তারপর যোগ দেব সেবকে। বেশি সময় লাগবে না। এই সপ্তাহটা সময় নিচ্ছি। সামনের সোমবারের থেকে আসতে পারব আশা করছি।
রাত্তিরে ফিরল আফজালুল। আফজালুল এখন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির একটা গোটা ঘরে একাই থাকে। ঘরখানা সাহিত্য সমিতি সাবলেট করেছে তাকে। সে বলল, আমার ঘরে আপনি স্বাগত।
স্বাগত যে, সেটা আপনি না বললেও আমি জানতুম। কিন্তু কথা হচ্ছে একশো টাকা মাইনে পাব, অতএব –
অতএব, আপনি কিছু দেবেন, এই তো?– বলে আফজাল, নিশ্চয়ই দেবেন। আমি আপত্তি করব কেন? লাভটা আমারই; ঘরে আপনাকে পাব, আবার আপনাকে সাবলেট করে বাড়িওয়ালা না হই ঘরওয়ালা বা অন্তত একটা তক্তপোশওয়ালা তো হবই হব।
পরের দিন সকালেই আফজালুল বেরিয়ে গেছে। কলেজ স্কোয়ার ঈস্ট-এর মোসলেম পাবলিশিং হাউস ওর কর্মস্থল। দুপুরবেলা মির্জাপুরের এক পাইস হোটেলে খেতে গিয়েছিল কাজি। ফিরে এসে দেখে সাহিত্য সমিতির রিডিং রূমে তিনজন পাঠক। তিনজনের মধ্যে একটি ছেলে, কাজিরই সমবয়েসী প্রায়, একটু ছোটও হতে পারে, তিনখানা মডার্ণ রিভিয়ু নিয়ে বসেছে, পাশে বিরাট মোটা কয়েকখানা বই, দেখে মনে হল অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারীর কয়েকটা ভল্যুম। কাজিও আলমারি থেকে নিজের পছন্দমতো একটা বই বের করে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল।
ঘরের খোলা দরজা দিয়ে রিডিং রূমটা দেখা যায়। নিজের বইটা পড়তে পড়তে একবার চোখটা তুলে কাজি সরাসরি দেখতে পায় মডার্ণ রিভিয়ু পাঠরত ছেলেটাকে। তার পরণে একটা হাতকাটা জামা, সে পত্রিকাটা খানিকটা পড়েই ডিকশনারী খুলে কিছু দেখছে, তারপর পাশে-রাখা একটা খাতায় কিছু লিখছে। কাজি ছেলেটার একাগ্রতা লক্ষ্য করে। পত্রিকাটা পড়েই যখন সে দ্রুত পাতা ওলটাতে থাকে পাশের ডিকশনারীটার, তখন তার চোখমুখ দেখে মনে হয় সে প্রবল ক্ষুধার্ত, আর ওই ডিকশনারীটার পাতায় যা আছে তা ওর খাদ্য। খাদ্যটা আবিষ্কার করেই যেন সে গলাধঃকরণ করল এমন তার ভঙ্গি। খাতায় লেখা হয়ে যাবার পর তার মুখে অসাধারণ একটা তৃপ্তির ছাপ। কাজি তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। বেশ কিছুক্ষণ ছেলেটাকে লক্ষ্য করার পর কৌতূহল আর নিবারণ করতে পারে না সে। ঘর থেকে বেরিয়ে ছেলেটা যেখানে বসে আছে তার ঠিক পেছনে দাঁড়ায় সে। অতি ধীরে সে নিজের একটা হাত রাখে তার কাঁধে। ছেলেটা মুখ তুলে তাকায়। কথা বোলো না – এই ভঙ্গিতে অন্য হাতটার একটা আঙুল নিজের অধরোষ্ঠতে রেখে ইঙ্গিতে কাজি তাকে অনুসরণ করার নির্দেশ দেয়। দুজনে একসঙ্গে ঢুকে যায় কাজি আর আফজলের শোবার ঘরে।
এভাবে ডিকশনারী খুলে পত্রিকা পড়ছিলে?– জিজ্ঞেস করে কাজি।
ইংরিজি ভালো জানি না, এই ভাবে ইংরিজি শিখছি। পত্রিকার লেখাটাও পড়ছি, ইংরিজি শব্দটাও শেখা হয়ে যাচ্ছে।
তুমি কী কর? কী নাম তোমার?
আবদুল হালীম। এখন কিছুই করিনা, দু মাস আগে জেল থেকে ছাড়া পেলাম। সত্যাগ্রহ করে জেলে ছিলাম ছ' মাস। বেরিয়ে দেখি সব আন্দোলন বন্ধ, যাঁদের চিনতাম তাঁরা হয় এখনো বন্দী অথবা নিরুদ্দেশ।
কী করতে আগে? মানে অসহযোগ আন্দোলনের আগে?
খিদিরপুরে সিটি লাইনের একটা এজেন্সীতে কাজ করতাম, অসহযোগ আন্দোলনে চাকরি ছেড়ে যোগ দিলাম।
তার আগে কী করতে?
গ্রামে ছিলাম। ক্লাস নাইনে পড়া ছেড়ে কলকাতায় এসেছি। চাকরিও পেলাম, আবার খোয়ালামও, এক মুখ হাসি হালীমের মুখে।
স্কুলে ফিরে যাওনি কেন? তোমার মতো অনেকেই তো জেল থেকে বেরিয়ে স্কুলে ফিরে গেছে।
হালীম হেসে বলে, এই তো স্কুলের পড়া নিজে-নিজেই করে নিচ্ছি। এই পর্যন্ত বলার পর এবার বলে হালীম, আচ্ছা আপনি কি কাজি নজরুল ইসলাম?
কাজি অবাক, বলে, জানলে কী ভাবে?
মনে হচ্ছিল। মুজফ্ফর আহ্মদের কাছে আপনার কথা এত শুনেছি যে চিনতে অসুবিধে হল না।
তুমি মুজফ্ফর আহ্মদকে চেন?
চিনি তো।
থাক কোথায়?
সারাদিন বাইরে বাইরে, রাত্তিরে চাঁদনীতে। গুমঘর লেনের একটা বাড়িতে মুজফ্ফর ভাইই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন? তিন নম্বর বাড়ি।
আজ দেখা হবে মুজফ্ফরের সঙ্গে?
হ্যাঁ, উনি তো এখানেই আসবেন বললেন। বললেন তুমি সাহিত্য সমিতির লাইব্রেরিতেই থেক যতক্ষণ না আমি আসি।
মুজফ্ফরের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে কাজি, আবদুল হালীমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সময় যে কোথা দিয়ে চলে যায় বুঝতে পারে না সে।