ভাই পিংলা,
এতদিন পর্যন্ত তুই-ই আমাকে চিঠি লিখে এলি বরাবর। এবার জীবনে প্রথম আমার চিঠি পাবি তুই। আমি তো খামটা দেখে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলুম না তুই সোজাসুজি আমার বাড়িতে চিঠি পোস্ট করেছিস। তোর সঙ্গে শেষ দেখা হবার পর কতগুলো বাড়ি যে বদলালুম আমি! আমার ঠিকানা তোকে দিল কে!
তোর চিঠিটা পড়লুম। একবার নয়, বারবার। তোকে হিংসে হচ্ছে। সেই মহাভারতের যুগের পর সশরীরে আবার স্বর্গভ্রমণ, ভাবা যায়! তবে, তুই তো দেখি যুধিষ্ঠিরের চাইতেও বেশি ভাগ্যবান। এ-কথা বলছি এই জন্যে যে, যুধিষ্ঠিরের ব্যাপারটা ছিল শুধুই স্বর্গারোহণ। যদিও মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁকে, হেঁটেই পৌঁচেছিলেন, কিন্তু ফিরতে পারেননি আর। আর তা ছাড়া, যাবার পথে অন্তত নরকদর্শনের কষ্টটা তো পেয়েছিলেন। আর তুই? তুই তো এক স্বর্গ থেকে আরেক স্বর্গে দিব্যি ট্রেনে-ট্রামে-নৌকোয় পৌঁছিয়ে গেলি! গুরুদেব ডেকে বললেন ঘুরে আয়, তুই মনে মনে ভাবলি, 'স্বর্গ হইতে বিদায়' হচ্ছে তোর, কিন্তু দিব্যি পৌঁছে গেলি আর এক স্বর্গে! তারপর বেশ দেখেশুনে, ঘুরে-টুরে ফিরেও এলি আবার! লিখেছিস, অতুলবাবু স্যরের সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি পারিস কথা বলতে হবে। গুরুদেবের সঙ্গে নয় কেন?
তোর চিঠিতে লিখেছিস তোকে নাকি ফিরে এসে নিজের মুখোমুখি হতে হবে এবার। নিজের মুখোমুখি মানে কী? অতুলবাবু স্যর তো নিশ্চয়ই তোর গুরুস্থানীয়, স্থানীয়ই বা বলি কেন, গুরুই; তবুও নিজের মুখোমুখি হতে হলে তোকে আসতেই হবে এই শর্মার কাছে, কাজিদার। তোর ঠিকঠাক আয়না আমিই, আমার সামনে দাঁড়িয়ে সব কথা বল একবার যেন নিজেকেই বলছিস, তার পর কান পেতে শুনিস আমার রিফ্লেকশন, তাতেই হবে তোর আত্মদর্শন, বুঝলি হাঁদা? সেই কতদিন আগে করাচির ব্যারাকে এক চৌকিতেও শুয়েছি দুজন, তারপর থেকেই তো তোর সঙ্গে দেখা হওয়াটাই একটা উৎসব। অনেক দিন ধরে ভাবছিলুম তোকে একবার আসতে বলব। সেই যে শেষ এসেছিলি যেদিন ওরা আমাকে সম্বর্ধনা দিল, মনে আছে? একটা রাত্তিরই ছিলি তখন, পরের দিন গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমে কয়েকঘন্টা! অবিশ্যি তোর না-আসার কারণটা আমি বুঝতে পারি, তোর বন্ধু বুলবুলই তো উড়ে গেছে কত দিন হল। তুই জানিস, ঘোরতর অসুস্থতার মধ্যে, ততদিনে ওর চোখেও গুটি বেরিয়েছে, তারই মধ্যে আমি ওকে বললুম একদিন, তুই ভালো হয়ে যাবি তার পর আমরা সবাই মিলে গাড়িতে চড়ে বেড়াতে যাব; ও বলল সবাই নয়, শুধু তুমি আর আমি আর জ্যাঠামশাই আর পিংলা কাকু!
বুলবুল চলে যাবার পর ওই বাড়িতে টিকতে পারিনি আমরা আর, পরের দিনই জেলেটোলায় নলিনীদার বাড়িতে চলে এসেছিলুম। সেখানে কয়েকদিন থেকে তারপর আর একটা বাড়ি। এইভাবে বাড়ি বদলাতে বদলাতে এখন এইখানে থিতু হয়েছি, যেখানে তুই চিঠিটা পাঠিয়েছিস।
কিন্তু তোকে যে লিখছি, বাড়ি থেকে নয়। বাড়িতে তোর চিঠিটা পেয়েছিলুম যেদিন, সেদিনই শৈলজার সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছি। কোথায় এসেছি জানিস? আমার আর শৈলজার ছেলেবেলার জায়গায়। রানিগঞ্জে। এখানে ক'দিন থাকব। শৈলজা পাতালপুরী নামে একটা সিনেমা বানাচ্ছে। গল্পটা ওর নিজেরই লেখা, চিত্রনাট্য যাকে বলে সেটারও রচয়িতা ও-ই। আমাকে গানের ব্যাপারটা দেখতে হবে।
পাতালপুরী আর রানিগঞ্জ শব্দদুটো কাছাকাছি দেখে আন্দাজ করতে পারছিস সিনেমার গল্পটা কী বিষয়ে? কয়লাখনি। সেই কতদিন আগে হক সাহেবের নবযুগ পত্রিকায় – আরে, হক সাহেব বলছি কেন? তুই তো নিজেই ওই পত্রিকার সোল সেলিং এজেন্ট ছিলি, মনে নেই? – কয়লাখনির শ্রমিকদের শোষণের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখেছিলুম একটা। এখন আবার এসেছি ওদের সঙ্গে মিশতে; সারা দিনের ডিউটির পর ওদের বস্তিতে গিয়ে ওদের সঙ্গে সময় কাটাতে, কী ধরণের অবসর ওরা কাটায় তাই বুঝতে। এই সব বুঝে তারপর গান লিখব, সুর দেব তাতে। আরও কয়েকটা কাজ করব, শৈলজাকে বলা আছে।
আমি তো গোটাকয়েক সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করলুম এর মধ্যে। সঙ্গীত পরিচালকের কাজ কী? এখানে সবাই মনে করে গানে সুর দেওয়া, আর যারা গাইবে তাদের শেখানো। ইংরিজিতে ওরা বলে মিউজিক ডিরেক্টর। আমার কিন্তু মনে হয় সিনেমার ক্ষেত্রে মিউজিকের অর্থ শুধু গান নয়, সমস্ত সিনেমার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ধ্বনির একটা বিশেষ প্রয়োগ, যা মূল বক্তব্যের পরিস্ফুটনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। সে ধ্বনি, বাংলা ব্যাকরণে যাকে বলা হয় শব্দ, সুরেলা কণ্ঠে তার প্রয়োগ হতে পারে, হতে পারে সঙ্গীতযন্ত্রের মূর্ছনা, এমনকি অন্য ধরনের শব্দও; যেমন বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বৃষ্টির শব্দ, বজ্রপাতের কড়্কড়্কড়াৎ অথবা বেড়ালের মিউ মিউ! (সাউণ্ড-রেকর্ডিঙের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি তা-ও তো প্রায় বছর ছ-সাত হয়ে গেল; এতদিনে এটা বুঝেছি, একটা বিশেষ ইমোশনের শব্দের ভাব ফোটাতে হলে সত্যিকারের শব্দের চেয়েও অনেক বেশি কাজ হতে পারে সঙ্গীতযন্ত্রে, অবিশ্যি যদি সেটা ঠিকঠাক বাজানো যায়! অনেকগুলো সঙ্গীতযন্ত্রের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না-থাকলে, আর প্রয়োজনে মনে-ভেবে-রাখা শব্দটা যন্ত্রে প্রয়োগ করে বের না করতে পারলে আর মিউজিক ডিরেক্টর কিসে!) আমার নিজের তো মনে হয় সিনেমা একটা কম্পোজিট আর্ট, যার অনেকটাই আমরা এখনো বুঝিইনি। ইদানিং শৈলজা প্রেমেন আর প্রেমাঙ্কুর আতর্থী এই আর্টটা ভালো ভাবে বোঝবার চেষ্টা করছে। প্রেমেন একদিন বলছিল, সিনেমার আসল ভাষাটা এডিটরের দখলে। ও একটা প্রয়োগের নাম বলল, মন্তাজ; ব্যাপারটা ঠিক যে বুঝেছি তা নয়, স্টুডিওয় যেখানে এডিটর কাজ করে সেখানে ঢুকিইনি কখনো; কিন্তু এখন চেষ্টা করব ঢুকতে, আর ব্যাপারটা বুঝতে। তবে শৈলজাকে বলে দিয়েছি, আমি শুধু গান লেখা সুর দেওয়া আর গান শেখানোর মিউজিক ডিরেক্টর হতে পারব না, মিউজিকের যে-অর্থ আমি বুঝি সেভাবে যদি ডিরেক্টরি করতে দিস তাহলে রাজি আছি। বুঝতেই পারছিস ও রাজি হয়েছে, আর আমি তাই সময়ে-অসময়ে কখনও ঢুকে পড়ছি খনিতে, কখনও খনিশ্রমিকদের বস্তিতে। এখন মনে হচ্ছে শৈলজার এই সিনেমাটার নাচগানে হয়তো ঝুমুর গানের কিছু প্রভাব পড়তে পারে।
এখানে থাকব আরও সাত-দশ দিন। তারপর কলকাতায় ফেরা। তোকে এখন থেকে জানিয়ে রাখলুম, যাতে তৈরি থাকতে পারিস ওই সময়ে আসবার জন্যে। মানসিক ভাবে তৈরি হবার জন্যে তোকে আরও দুয়েকটা কথা বলে রাখি।
আগের বার যখন তুই কলকাতায় এসেছিলি, আমরা পানবাগানে থাকতুম যখন, তুই আমার সঙ্গে পরের দিন সকালবেলায় গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমে গিয়েছিলি, মনে আছে? যারা আমার সঙ্গে সেদিন ছিল, গান লিখে আর শিখে নিচ্ছিল আমার কাছ থেকে, তারা গ্রামোফোনের জুনিয়র আর্টিস্ট, অন্তত গ্রামোফোন কম্পানীর পরিভাষায়। সেদিন হয়তো তারা সত্যিই জুনিয়র ছিল। কিন্তু আজ, সাধারণ মানুষ, মানে রেকর্ডের শ্রোতা যারা, তাদের কাছে এখন এদের মধ্যে অনেকেই যথেষ্ট জনপ্রিয়, এদের গানের রেকর্ড বিক্রি হয় ভালোই। সেই বিক্রি থেকে প্রচুর লাভ করতে কম্পানীর কোন সঙ্কোচ নেই, কিন্তু এদের পারিশ্রমিক দেবার ব্যাপারেই যত কার্পণ্য! এদের মধ্যে কয়েকজনের নাম বললেই বুঝতে পারবি, এরা কেউই ফেলনা নয় – যেমন ধীরেন দাস, কানন দেবী, হীরেন বসু ইত্যাদি। এদের হয়ে আমিও গ্রামোফোন কম্পানীকে অনুরোধ করেছিলুম এদের পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দিতে, খানিকটা লড়াইও যে হয়নি তা-ও নয়। কম্পানী কোনমতেই রাজি হল না। তখন এই সব শিল্পীদের নিয়ে আমিও বেরিয়ে এলুম গ্রামোফোন কম্পানী থেকে।
আমার বন্ধু জিতেন ঘোষ ঠিক সেই সময়ই হ্যারিসন রোডে মেগাফোন কম্পানী নামে এক রেকর্ডের কম্পানীর ব্যবসা খুলেছে। আমি নিজে তো বটেই, এমনকি আমার যত চেলা সবাইকে নিয়ে গ্রামোফোন কম্পানী ছেড়ে চলে এলুম মেগাফোনে; স্বদেশী মেগাফোন কম্পানী, এখানে আমরা সবাই আমাদের গান রেকর্ড করব। কুকুর-ছাপ এইচ-এম-ভি এ-দেশে ব্যবসা চালু করেই বড়লোক হয়ে গেছে; আমরাই গান গেয়েছি আমরাই শুনেছি – পয়সা পিটেছে ওরা, তা পাঠিয়েছে বিদেশে। অথচ সেই ঘোরতর স্বদেশী আন্দোলনের যুগেই – উনিশশো ছ' সালে – এইচ বোস –
কুন্তলীন-দেলখোশ খ্যাত এইচ বোস, স্বদেশী রেকর্ড কম্পানী তৈরি করেছিলেন। প্রথম রেকর্ড করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে। কী রেকর্ড, তা উদ্ধার করতে পারিনি, জানিনা কবির নিজের মনে আছে কিনা। উদ্ধার করবই বা কীভাবে, স্বদেশী আন্দোলনে সহানুভূতি থাকার অপরাধে তাঁর “টকিং মেশিন হল” খানাতল্লাশির নামে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে পুলিশ; ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে উনিশশো দশেই।
তা সত্ত্বেও অনেকদিন পর্যন্ত বাঙালি ব্যবসায়ীরা চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু এরা প্রায় সবাই ছোট ব্যবসায়ী, পুঁজি কম, বেশিদিন ব্যবসা চলেনি। এদিকে, আঠেরোশো পঁচানব্বই সালে ধর্মতলায় মতিলাল সাহা নামে এক ভদ্রলোক হারমোনিয়ম তৈরির ব্যবসায়ে নামেন। বছর দশেক পর তিনি নিকোল কম্পানীর রেকর্ড আর নিকোলফোন যন্ত্রের একমাত্র খুচরো ও পাইকারি পরিবেশনের দায়িত্বও গ্রহণ করেন। এ-ছাড়াও অন্য গ্রামোফোন-সামগ্রীও বিক্রি করতেন তিনি, এবং এই ব্যবসা করে সেই কাজে সাফল্য ও প্রচুর অর্থোপার্জনও করেন। তাঁর পুত্র চণ্ডীচরণ সাহা জর্মনীতে গিয়ে রেকর্ডিং ও আধুনিক শব্দযন্ত্রের কলাকৌশল শিখে কলকাতায় অক্রুর দত্ত লেন-এ হিন্দুস্থান মিউজিকাল প্রডাক্টস ভ্যারাইটি সিণ্ডিকেট নামে এক প্রতিষ্ঠান পত্তন করলেন। এই স্বদেশী প্রতিষ্ঠান প্রথম থেকেই সঙ্গীত-রেকর্ডিঙের ক্ষেত্রে গ্রামোফোন কম্পানীর প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সমকক্ষ।
পিংলা, এই পর্যন্ত লিখেই আমি দিব্যদৃষ্টিতে তোর কপালের কুঞ্চন দেখতে পাচ্ছি: এ কী ইতিহাস শুরু করল কাজিদা! আগেই তো বলেছি, মানসিক ভাবে তৈরি হবার জন্যে তোকে কয়েকটা কথা বলব। সেই কথাই এই ইতিহাস! শুনতে শুনতে মানসিক ভাবে তৈরি হতে শুরু কর। কীসের জন্যে? ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর।
এর পর উনিশশো একত্রিশের শেষের দিকে চণ্ডীবাবু একবুক আশা নিয়ে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন। জর্মনীতে তাঁর সঙ্গীত-রেকর্ডিঙের বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি শিক্ষা এবং আপাতত স্বদেশী রেকর্ডিং কম্পানী গড়ে তোলার প্রকল্প গুরুদেবকে জানিয়ে প্রথমেই কবির কণ্ঠ রেকর্ড করবার বাসনা প্রকাশ করেন তিনি। সেই মুহূর্তে গুরুদেবের এইচ বোসের কথা মনে পড়েছিল কিনা জানিনা, কিন্তু তবুও, তিনি রাজি হয়ে গেলেন। অবশেষে উনিশশো বত্তিরিশের পাঁচুই এপ্রিল কবি পৌঁছলেন হিন্দুস্থান মিউজিকাল প্রডাক্টসের স্টুডিওতে, রেকর্ড করা হল তাঁর আবৃত্তি আর সঙ্গীত। রেকর্ডের একদিকে “আমি যখন বাবার মতো হব”, অন্যদিকে “তবু মনে রেখ”। যাত্রা শুরু হল হিন্দুস্থানের।
বলেইছি, সেই সময়টায় গ্রামোফোন কম্পানীর সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় আমি মেগাফোনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছি। সে খবর তো জানে সবাই, তবুও চণ্ডীবাবু নিজে একদিন আমার বাড়িতে এসে তাঁর স্টুডিও এবং আনুসঙ্গিক ব্যবস্থা দেখবার জন্যে আমাকে নেমন্তন্ন করে গেলেন। ফেব্রুয়ারির কোন একটা দিনে – ঠিক ঠিক দিনটা খেয়াল নেই এখন – আমি গেলুম। দেখেই আমার মনে হল এই একটা স্বদেশী কম্পানী তৈরি হল লড়ে যাবার জন্যে, উঠে যাবার জন্যে নয়। আমাদের ঘরের টাকা সমুদ্দুর পেরিয়ে যতটা যাচ্ছে, তার খানিকটা তো অন্তত বন্ধ করতে পারবেই এরা। মেগাফোনের সঙ্গে আমার অবস্থানের কথা জানাই ছিল চণ্ডীবাবু্র। সেই সময়ে আমার প্রায় সব গানই রেকর্ড করছে মেগাফোন, গুলবাগিচা বইয়ের শুধু এক-আধটা গানেরই রেকর্ড হয়নি, বাকি সব গানেরই রেকর্ড মেগাফোনই করেছে, তবুও আমি চণ্ডীবাবু্কে কথা দিয়ে এলুম, হিন্দুস্থানকে আমি যতটা সম্ভব সাপোর্ট দেব, স্বদেশবাসী হিসেবে এ আমার কর্তব্য। শুধু যে নিজে গাইব তা-ই নয়, আমার বন্ধু যারা, ছাত্রছাত্রী যারা, তাদেরও ধরে নিয়ে আসব হিন্দুস্থানে রেকর্ড করাতে। করেওছিলুম। ওই বছরেই – হিন্দুস্থানের ব্যবসার একেবারেই গোড়ার দিকে – উমাপদকে দিয়ে – উমাপদকে জানিস তো, উমাপদ ভট্টাচার্য, আমার গানের দিনুবাবু, সব স্বরলিপি ও-ই লিখে দেয় – আমার দু'খানা গান হিন্দুস্থানে রেকর্ড করাই: “কুচবরণ কন্যা রে তোর” আর “তোমার আঁখির কসম সাকী।”
রাগ করে ছেড়েছিলুম গ্রামোফোন কম্পানী, কিন্তু কয়েকদিন পর থেকেই বুঝতে পারলুম বড় পুঁজির ব্যবসাদারদের সঙ্গে পুরোপুরি লড়াইয়ে নামা আমাদের মতো লোকের সাধ্য নয়। শুধু তো স্টুডিওয় গান রেকর্ড করা নয়, বেশ কিছুদিন হল আমি নাটক আর সিনেমার সঙ্গেও যুক্ত হয়েছি। নাটকের গানগুলো আলাদা করে রেকর্ড করা যায় – সে হিন্দুস্থান বা মেগাফোন থেকে ইচ্ছেমতো করতে পারি – কিন্তু সিনেমায় তো তা চলবে না। সিনেমার প্রযোজক যারা, তাদের পছন্দ এবং সুবিধে মতো তারাই ঠিক করে কোন রেকর্ডিং কম্পানীর সঙ্গে তারা কাজ করবে। আমাদের মেগাফোন বা হিন্দুস্থানের পরিচিতি প্রধানত এই বাংলাতেই। গ্রামোফোন কম্পানী কিন্তু সারা ভারতেই পরিচিত, তাদের রেকর্ডের বিক্রি সারা ভারত জুড়ে। ইদানিং তো সিনেমার শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে বোম্বাইতে। কাজেই সিনেমার প্রযোজকরা গ্রামোফোন কম্পানীর সঙ্গেই কাজ করতে উৎসুক, ওদের সঙ্গেই প্রযোজকরা চুক্তি করে। সে ক্ষেত্রে সঙ্গীত পরিচালক বা এমনকি শুধুই গায়ক বা গানের লেখক হিসেবে আমি তো তার বিরোধীতা করতে পারি না, করলেও কোন লাভ হবে না। এদিকে গ্রামোফোন কম্পানীও চাপ দিচ্ছিল। যখন ছেড়েছিলুম তখনকার কোন কোন দাবি মেনে নিতেও ওরা রাজি হল। ওদের ওখানে থাকতে থাকতেই আমি নতুন-প্রতিষ্ঠিত বেতারেও কাজ করছিলুম একটু-একটু। ওদের সঙ্গে যখন কাজ শুরু করি তখনও কলকাতায় বেতার ছিল না, ফলে চুক্তিতে বেতারের প্রসঙ্গও আসেনি। কিন্তু ওদের পছন্দ ছিল না আমার বেতারের কাজ। এবার সেটাও ওরা লিখিতভাবে মেনে নিল। অতএব, খুব উৎসাহ না-থাকলেও শেষ পর্যন্ত গ্রামোফোনে আবার ফিরেছি। গত বছর।
মনে মনে কিন্তু গানের ব্যবসায়ে আরও বেশি বেশি দেশি পুঁজি আমি দেখতে চাই, স্বদেশী ব্যবসা। কিন্তু, চাই বললেই কি হবে? পুঁজি কোথায়? তখন একটা অন্য কথা ভাবলুম। কেউ ভালো একটা স্টুডিও তৈরি করে রেকর্ডিং করে প্রথম শ্রেণীর, কেউ সেই রেকর্ডিঙের প্রতিস্থাপন ডিস্কে করতে পটু, কেউ বা হাজার হাজার ডিস্ক্ ছাপাতে পারে যন্ত্রে; যতগুলো ইচ্ছে ছাপাও, একই মানের সব। এই যে প্রধানত তিনটে কাজের কথা বললুম, এই দিয়ে তিনখানা আলাদা আলাদা কম্পানী হতে পারে। হয়তো দেশি পুঁজিতে এরকম ছোট ছোট কম্পানী কিছু হতেও পারত। কিন্তু এইসব মিলিয়ে-মিশিয়ে একটাই মিউজিক কম্পানী: কুকুর-ছাপ। কম্পানী যেমনই হোক, তা বেঁচে থাকে বিক্রির জোরে। কার কাছে বিক্রি? তোর-আমার মতো সাধারণ মানুষের কাছে। সাধারণ মানুষ কেনে কোথায়? সাহেব-পাড়ার সাজানো-গোছানো মিউজিক স্টোর্সে কেনে কেউ, কেউ বা পাড়ার মধ্যে তিন-মাথার মোড়ের দোকানটায়। যেখান থেকেই কিনুক, দোকানের একটা বিক্রি মানে কম্পানীরও বিক্রি। যদি তিনটে কম্পানী হত, বিক্রির মুনাফাটা তিন ভাগ হত। তিনটের মধ্যে একটাও যদি হত স্বদেশী কম্পানী, তাহলে ওই তিনভাগের এক ভাগ তো স্বদেশী কম্পানীটাই পেত! আর, ভাগ শুধু তিনটেই নয়, আরও একটা ভাগ আছে। সেটা হল ওই দোকানী, যার কাছ থেকে রেকর্ডখানা কিনছি আমি বা তুই, তার ভাগ। সেটা হতে পারে একটা ছোট ভাগ, কিন্তু যতই ছোট হোক, তা তো পাবে ওই দোকানের মালিক। দোকানটা যদি স্বদেশী ব্যবসা না-হয়ে হয় ওই সাহেব পাড়ার, আর তিনটে মিলিয়ে একটাই কম্পানী হয় কুকুর ছাপ, তাহলে পুরো ব্যবসাটার পুরো চার ভাগ মুনাফাই গেল বিদেশে। স্বদেশী দোকান হলে খানিকটা তো অন্তত থাকবে দেশেই। আর, মনে রাখতে হবে, যে ভাগটাকে ছোট বলছি, সেটা যদি সত্যি-সত্যিই খুবই ছোট হত, তাহলে ওই সাহেব পাড়ার দোকানের মালিক অত পয়সা খরচ করে চালাত কি ব্যবসাটা?
ব্যাপারটা কিন্তু শুধু ওই মুনাফাটুকুই নয়। ধর, তুই একজন খদ্দের। পাড়ার ছোট দোকানটায় গিয়েছিস কাজি নজরুল ইসলামের একটা গানের রেকর্ড কিনতে। কোন্ গানের রেকর্ড কিনবি তা তোর ঠিক করাই আছে, তুই চাইলি একখানা। দোকানদার রেকর্ডটা নিয়ে তোকে বাজিয়ে শুনিয়ে দিল; তুই তো ওই রেকর্ডখানা কিনতেই গিয়েছিলি দোকানে, তোর পছন্দই হল, তুই দাম দিলি, দোকানদার তোকে রেকর্ডখানা দিল, চলে এলি তুই।
কিন্তু ভেবে দেখ, ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক এরকম না-ও তো হতে পারত। তোর যখন পছন্দ হল নজরুলের রেকর্ডখানা, তুই ওটা কিনবি নিশ্চিত এ-কথা জেনেও দোকানদার তোকে বলতেও পারত, নজরুল সাহেবের একটা নতুন রেকর্ড সম্প্রতি বেরিয়েছে হিন্দুস্থান থেকে, সবাই খুব কিনছে, শুনবেন নাকি গান দু'খানা? এদিকে তুই তো গিয়েছিস তোর আগে-থেকে-ভেবে-রাখা রেকর্ডটা কিনতে। তুই কী বলবি? সম্ভবত বলবি, যেটা চেয়েছি ওটা তো দিন, তারপর দেখি কী করা যায়। দোকানদার তোর রেকর্ডটা প্যাক করল, তারপর হিন্দুস্থানের রেকর্ডের একটা দিক বাজিয়ে শুনিয়ে দিল তোকে। তুই শুনলি, ভালোই লাগল তোর, বললি, ও-পিঠটাও শোনাননা। শুনলি, তারপর বললি, ভালোই তো, কাজি সাহেবের গান যেমন হয়। দাম কত?
দাম তো সব রেকর্ডেরই সমান, বলল দোকানদার।
ঠিক আছে, ভেবে দেখি, বললি তুই। যেটা চাইলাম সেটা তো দিয়ে দিন।
এ-অবস্থায় দুটো ঘটনা ঘটতে পারে। এক, দোকানদারকে পয়সা দিয়ে রেকর্ডখানা নিয়ে তুই বেরিয়ে এলি। আর একটা সম্ভাবনা; দোকানদার তোকে বলল, আমার অনুরোধে আপনি শুনলেন কাজিসাহেবের হিন্দুস্থানের গান দু'খানাও। ভালোই লেগেছে আপনার, আপনার ভালো লাগবে জেনেই ও-দু'খানাও আমি বাজালুম। আমার কথায় যদি দুখানা রেকর্ডই এখন কেনেন আপনি, আমার তরফ থেকে আমি আপনাকে মোট দামের পাঁচ পারসেন্ট ছাড় দেব।
একটু ঝটকা খেলি তুই। ঝোঁকের মাথায় বললি, পাঁচ নয় দশ পারসেন্ট দিলে ভেবে দেখতে পারি।
ঠিক আছে স্যর, তবু তো আপনি আমার কথাটা রাখলেন, রেকর্ড দু'খানা প্যাক করতে করতে হেসে বলল দোকানদার।
গল্পটা আমি তোকে হিন্দুস্থান বলে বললুম, কিন্তু এমনটা তো হতে পারত সেনোলার একটা রেকর্ডের ক্ষেত্রেও। অথবা অন্য কোন স্বদেশী কম্পানীর রেকর্ডেও!
ভালোবাসা নিস।
কাজিদা
পুঃ - তোকে বলতে ভুলেছি একটা কথা। হিন্দুস্থান মিউজিকাল প্রডাক্টস ভ্যারাইটি সিণ্ডিকেটের যখন প্রতিষ্ঠা হয়, তার বোর্ড অব ডিরেক্টরস-এর সভাপতি কে ছিলেন জানিস? কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই কম্পানীর সেই বোর্ড অব ডিরেক্টরস-এর প্রথম সভা হয় উনিশশো বত্রিশের চব্বিশে জুলাই। কাজেই তোকে আমার 'কলগীতি'র উদ্বোধন করতে ডাকায় শান্তিনিকেতনের সঙ্গে স্বদেশী সঙ্গীত-বাণিজ্যের ধারাবাহিকতাই যে মেনে চলা হল সেটা তো বুঝলি?