হাওড়া থেকে ফিরেইছিল নজরুল প্রায় মাতাল হয়ে। বাড়ি ফিরে ফকিরদাসের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে কে জানত! ভীমের কাছে যা শুনে এসেছে না বলতে পেরে পেট ফুলে যাচ্ছিল তার, কতক্ষণে মুজফ্ফরকে বলে হালকা হতে পারবে! করাচি থেকে ফিরে বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রীটে যখন থাকতে এল প্রথম, মুজফ্ফর তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ভবিষ্যতে সে রাজনীতিতে যোগ দিতে চায় কিনা। না-ই যদি চাই তাহলে সেনাদলে নাম লিখিয়েছিলুম কেন? – ছিল নজরুলের জবাব।
সেনাদলের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক?
পরাধীন দেশে তো রাজনীতির একটাই অর্থ হতে পারে, স্বাধীনতার জন্যে লড়াই। আর লড়াই-ই যদি করতে হয়, তাহলে শত্রুর কাছ থেকেই তা শেখা ভাল, তাই তো লড়াই শিখতে গিয়েছিলুম।
মুজফ্ফর হাসে, এ কথার সরাসরি কোন জবাব দেয় না।
জবাবের তোয়াক্কাও করে না নজরুল, বলে, শিয়ারশোলে আমাদের রাজ ইশকুলে মাষ্টারমশাই ছিলেন নিবারণচন্দ্র ঘটক। স্যর ছিলেন যুগান্তর দলের কর্মী। বিদেশ থেকে রদা কম্পানীকে পাঠানো বন্দুকের কনসাইনমেন্ট ইন্টারসেপ্ট করে অনেক রিভলভার লুটে নিয়ে এসেছিলেন স্যর, বাঘা যতীনের ভাবনায় উদ্দীপ্ত হয়ে। আমাকে ভালবাসতেন। ছেলেবেলা থেকেই আমার বিপ্লবী হওয়ার স্বপ্ন। ফার্স্ট ক্লাসে যখন পড়তুম তখন যদি না অ্যারেস্ট হয়ে যেতেন স্যর তাহলে হয়তো আমি দীক্ষাও পেতুম স্যরের কাছে। দীক্ষা শেষ পর্যন্ত পাইনি ঠিকই, কিন্তু বন্দুক চালানোটা শিখে এসেছি, বেয়নেট চালাবার ট্রেনিংও নিয়েছি। যাদের কাছ থেকে পেয়েছি ট্রেনিং, তাদের বুকে বেয়নেট চালাতে হাত কাঁপবে না।
বুড়ি-বালামে বাঘা যতীন শহীদ হবার পর থেকে আপাতত বিপ্লবী দলে রিক্রুটমেন্ট বন্ধ, বলে মুজফ্ফর, আমি তাই একটু অন্যরকমের বিপ্লবের কথা ভাবছি। একটা খবরের কাগজ বের করব। নতুন রকমের লেখা, নতুন ভাষা। প্রতিবাদের ভাষা, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবার ভাষা। এই হবে আমাদের বিপ্লবের বিউগ্ল্-ধ্বনি, রাজি?
হেসে ফেলে নজরুল, চালাও পানসি বেলঘরিয়া!
এই আলোচনা হয়েছিল ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি, আর ঠিক ছ' মাস পরে বেরোল দৈনিক নবযুগের প্রথম সংখ্যা, বারোই জুলাই। এই ছ' মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে মুজফ্ফর, নজরুল তার সহকারী। নানা ঘাটে জল খেয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছে বিখ্যাত উকিল আবুল কাসেম ফজলুল হকের কাছে। কী আশ্চর্য যোগাযোগ, হক সাহেবের একটা পুরোনো ছাপাখানা ছিল, কোন কাজে লাগাতে পারছিলেন না। তিনিও প্রায় লুফেই নিলেন মুজফ্ফরের প্রস্তাব। রাজনীতিতে যোগাযোগ ছিল হক সাহেবের; কংগ্রেস, খিলাফৎ কমিটি, এমনকি মুসলিম লীগের সঙ্গেও। তিনি বললেন, বাংলা কাগজ বের করতে চাও, কর। কিন্তু শ্রমিক-কৃষকের কথা লিখতে হবে তোমাদের। একটাই তাঁর চিন্তা, মুসলমানের ছেলেরা কি ভালো বাংলা লিখতে পারবে? ততদিনে নজরুলের গল্প-কবিতা এমনকি উপন্যাসও ধারাবাহিক ভাবে ছাপা হতে শুরু হয়েছে নানা পত্রপত্রিকায়, একটু-আধটু পড়লেন তিনি, শেষ পর্যন্ত হলেন রাজি।
নামেই ছাপাখানা, কিন্তু তার হাল দেখে মুজফ্ফরের তো চক্ষুস্থির! তবু, দমে যাবার তো প্রশ্নই নেই। এটা-ওটা কিনে নানারকমের জোড়াতাড়া দিয়ে অভিজ্ঞ একজন কম্পোজিটার যোগাড় করে কাজে লেগে গেল মুজফ্ফর-নজরুল জুটি।
প্রথম দিনের প্রথম সংখ্যা থেকেই হৈ হৈ। যে সব অঞ্চলে বিক্রি হয়েছিল প্রথম দিন, দ্বিতীয় দিন থেকেই সেখানে মোড়ে মোড়ে জনতার ভিড়, কাগজ নিয়ে হকার ঢুকলেই শুরু হয়ে যায় টানাটানি, মুহূর্তেই সব কাগজ উধাও। যদিও কাগজে ছাপা হয় না নজরুল বা মুজফ্ফরের নাম – প্রধান পরিচালক হিসেবে শুধু হক সাহেবের নামই থাকে – তবুও বত্রিশ নম্বরের বৈকালিক আড্ডায় নজরুলদের অভিনন্দিত করতে ভিড় বাড়তেই থাকে রোজ বিকেল থেকে, হাইকোর্টের বড় বড় উকিলরা এমনকি জজসাহেবরাও ফজলুল হককে জানাতে ভুল করেন না যে তাঁরা নবযুগ পড়ছেন। আফশোষ শুধু মুজফ্ফরের, ছাপাখানাটার স্বাস্থ্য যদি ভাল হত আর একটু! আর কয়েকটা বেশি যদি ছাপা যেত কাগজ!
হোম ডিপার্টমেন্টের তৎপরতা সত্ত্বেও ভালই আছে নজরুল-মুজফ্ফর – গরম গরম লেখে নজরুল, যথাসম্ভব
ঝাঁঝ-কমানো সম্পাদনা করে মুজফ্ফর – শেষ অবধি দুবের সৌজন্যে পিংলার একটা ব্যবস্থাও তো হল – এমন সময় সব কিছু উল্টোপাল্টা করে দিল হাওড়ার তেলেভাজার দোকানের ভীমদা! ঘুমের মধ্যে নিবারণবাবু স্যরকে স্বপ্ন দেখে নজরুল, মন খারাপ হয়ে যায় তার। আফজালুল হক-এর মোসলেম ভারত পত্রিকায় তখন ধারাবাহিক ভাবে বেরোচ্ছে নজরুলের উপন্যাস বাঁধন হারা, চিত্তরঞ্জন দাশের নারায়ণ পত্রিকা সেই সময় চালাচ্ছিলেন বারীন ঘোষ ৪/এ মোহনলাল স্ট্রীট থেকে। এই পত্রিকায় উচ্ছ্বসিত সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে বাঁধন হারা থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি ছাপা হচ্ছিল নিয়মিত। ভালই লাগছিল নজরুলের, যদিও এতদিন তা নিয়ে নিজে সে কোন উচ্ছ্বাস দেখায়নি। এবার তার মনে হল বারীন ঘোষের সঙ্গে একবার আলাপ করে আসবে। পবিত্র গাঙ্গুলি ওই উত্তরের দিকেই থাকে, তার হাত দিয়ে কবিতায় লেখা একটা চিঠি পাঠায় নজরুল বারীন ঘোষের উদ্দেশে:
অগ্নি-ঋষি অগ্নি-বীণা তোমায় শুধু সাজে;
তাই তো তোমার বহ্নি-রাগেও বেদন-বেহাগ বাজে।
দহন-বনের গহনচারী
হায় ঋষি কোন বংশীধারী
নিঙড়ে আগুন আনলে বারি
অগ্নি-মরুর মাঝে।
সর্বনাশা কোন বাঁশি সে বুঝতে পারি না যে।
দুর্বাসা হে! রুদ্র তড়িৎ হানছিলে বৈশাখে
হঠাৎ সে কার শুনলে বেণু কদম্বের ঐ শাখে।
বজ্রে তোমার বাজল বাঁশি,
বহ্নি হল কান্না-হাসি,
সুরের ব্যথায় প্রাণ উদাসী
মন সরে না কাজে।
তোমার নয়ন-ঝুরা অগ্নি-সুরেও রক্তশিখা রাজে।
চিঠি পড়ে বারীন বলেন পবিত্রকে, নজরুল আমার গাল দিল নাকি হে?
নজরুল বলল, একবার দেখা করে আসি। গাল দিলুম না কী করলুম বুঝতে পারবেন তখন।
মোহনলাল স্ট্রীটের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ। একটা-দুটো জানলা একটু আধখোলা গোছের থাকলেও ভেতরে আলো জ্বলছে না, অন্ধকারে বোঝাও যাচ্ছে না কেউ সেখানে আছে কিনা।
প্রথমে মৃদু টোকা দেয় নজরুল দরজায়। সাড়াশব্দ নেই। মৃদু টোকা ধীরে ধীরে প্রবল প্রবলতর হতে থাকে, আর তার সঙ্গে জোড়ে নজরুলের জোর-কণ্ঠস্বর। আশপাশের কোন কোন বাড়ি থেকে উঁকি-ঝুঁকিও দিতে দেখা যায়
কাউকে-কাউকে। অবশেষে দরজা খোলে।
বারীন্দ্রকুমার ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে চাই, বলে নজরুল।
ওঁর তো এখন দেখা করায় অসুবিধে আছে, আপনি কোথা থেকে আসছেন?
আমার নাম কাজি নজরুল ইসলাম, উনি যদি থাকেন তবে দেখা করেই যাব।
ওঃ, আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি দেখছি। অপেক্ষা করুন একটু।
আহ্বান ছাড়াই ভেতরে ঢুকে আসে নজরুল। গোটা দুয়েক টেবিল, চেয়ার কয়েকটা, দুটো বন্ধ আলমারি। আলমারি দুটোর একটায় কাঠের দরজা, অন্যটায় কাচ লাগানো। কাচ লাগানোটা বইয়ে ঠাসা। একটা খালি চেয়ারে বসে পড়ে সে, বলে, ঠিক আছে, অপেক্ষা করছি।
ভেতরের দিকে একটা দরজা। নজরুলের সঙ্গে কথা বলছিল যে, সে ভেতরে চলে যায়। একটু পর ফিরে আসে লোকটি, তার পিছনে অন্য একজন; এসো ভায়া, বলতে বলতে ঢোকেন তিনি।
নজরুল উঠে দাঁড়ায়। প্রণাম করে আগন্তুককে, বলে, আর তো দেখা করার অসুবিধে নেই?
আরে না না, হেসে বলেন আগন্তুক, কাজি নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করতে বারীন ঘোষের আপত্তি? তোমার বই টুকলি করে নারায়ণ চালাচ্ছি না?
নজরুল বলে, পবিত্রকে দিয়ে একটা চিঠি পাঠালুম আপনাকে, আপনি নাকি বলেছেন, নজরুল কি গাল দিল আমাকে?
আজকাল তো দেয় অনেকে, বলে, এক কালের বিপ্লবী এখন কলম পিষছে, ভাবলুম তুমিও হয়তো সেই দলের,
দুর্বাসা-টুর্বাসা যেমন লিখেছ। পরে পড়ে মনে হল, নাঃ গাল দাওনি বোধ হয়। এখন বল, কীভাবে আপ্যায়ন করি তোমায়। চা-সরবত নাকি গান?
চা সরবত এবং গান, তিনটেই। গান দিয়ে শুরু হতে পারে। কে গাইবে, আপনি?
আমি? – হাসেন বারীন। আমি তো শুধুই রাসভ রাগিণী গাই; গাইবে এ, যে দরজা খুলেছিল তাকে দেখিয়ে বলেন, একে চেনো তো? এর নাম নলিনী, নলিনীকান্ত সরকার, বিজলী পত্রিকার সম্পাদক, আবার দাদাঠাকুরের শিষ্যও, গান শিখেছে তাঁরই কাছ থেকে।
দাদাঠাকুরের গান? শুনবই তো, বলে নজরুল।
নলিনী লজ্জা পায় না, কোন সঙ্কোচ নেই, আলমারির পেছন থেকে একটা হারমোনিয়ম বের করে টেবিলে রাখে, রেখেই ধরে গান:
একদা গ্রামগঞ্জে ছিল অনেকরকম শিয়াল,
নীলবর্ণ শিয়াল আর যে ছিল খ্যাঁকশিয়াল।
কে জানত এই শহরেও আছে অনেক শিয়াল
দিচ্ছি হিসাব সেই শিয়ালের আমরা কে কোন শিয়াল।
ট্রামে বাসে ছুটছি যখন সেটা অফিশিয়াল
পাচ্ছি বেতন করছি যে সই সেটা ইনিশিয়াল।
টাকা-কড়ি ঝুট-ঝামেলা সেটা ফিনানশিয়াল
ব্যবসা-বাণিজ্য যখন সেটা কমার্শিয়াল।
মামলা জিতুন মোকদ্দমা, সেটা জুডিশিয়াল,
দরকারি সব কাজকম্মো, সেটা এসেনশিয়াল।
আরেক শিয়াল বলব নাকো, কনফিডেনশিয়াল।
হা হা করে হাসে নজরুল, বলে, লিখে নিতে হবে গানটা, আগে কখনো শুনিনি, বলেই উঠে দাঁড়ায়। কেউ কিছু বলার আগেই হনহন করে হেঁটে নলিনীর কাছ থেকে নিয়ে নেয় হারমোনিয়মটা, তারপর বলে, দাদাঠাকুরের পর এবার রবি ঠাকুর। গেয়ে ওঠে:
আঃ বেঁচেছি এখন শর্মা ও দিকে আর নন।
গোলেমালে ফাঁকতালে পালিয়েছি কেমন।
লাঠালাঠি কাটাকাটি ভাবতে লাগে দাঁতকপাটি,
তাই, মানটা রেখে প্রাণটা নিয়ে সটকেছি কেমন–
আহা সটকেছি কেমন।
আসুক তারা আসুক আগে, দুনোদুনি নেব ভাগে,
স্যান্তামিতে আমার কাছে দেখব কে কেমন।
শুধু মুখের জোরে, গলার চোটে লুট-করা ধন নেব লুটে,
শুধু দুলিয়ে ভুঁড়ি বাজিয়ে তুড়ি করব সরগরম–
আহা করব সরগরম।
হাসতে হাসতে বারীন বলেন, এই নজরুলটাকে নিয়ে আর পারা যাবে না, খালি ভয় হয়। চিঠি লিখলেও ভয় হয়, গান গাইলেও হয়। বেছে বেছে রবি ঠাকুরের গান বের করেছে দেখেছ! নজরুল দৌড়িয়ে এসে বারীনের পায়ের উপর মাথা রাখে, ও কথা বলবেন না দাদা, শুধু আপনার পায়ের ধুলো নেবার জন্যে এতটা পথ এসেছি আজ।
হঠাৎ পায়ের ধুলোর দাম এতটা বাড়ল কী করে? – জিজ্ঞেস করেন বারীন।
হাওড়ায় গেসলুম, শিবপুরে, বলে নজরুল, সেখানে একজনের সঙ্গে আলাপ হল, বাঘা যতীনের খুব কাছের মানুষ। তার কাছে আপনাদের কথা, আপনাদের বোমার কারখানার কথা, আলিপুর মামলার কথা, সব শুনলুম। ফিরে এসে অবধি আপনার আশীর্বাদ নিতে আসতে ইচ্ছে করছে, তাই পবিত্রকে দিয়ে ওই চিঠিটা পাঠিয়েছিলুম। আশা ছিল আপনি ওকে বলবেন আমাকে পাঠিয়ে দিতে আপনার কাছে। সে তো হলই না, পবিত্র বলল, আপনি নাকি জিজ্ঞেস করেছেন আমি আপনাকে গাল দিলুম নাকি!
আরে, ওসব মজা করে বলা, হেসে বলেন বারীন। নারায়ণ পড়ে বুঝতে পার না আমি তোমার একজন ভক্ত? প্রতি সংখ্যায় মোসলেম ভারত থেকে তোমার লেখার কতটা তুলে দিই নারায়ণে?
জানেন দাদা – আপনাকে দাদা-ই বলি – বলে নজরুল, আসানসোলের স্কুলে আমার মাষ্টারমশাই ছিলেন নিবারণচন্দ্র ঘটক। স্যর আমাকে বিপ্লবের দীক্ষা দেবেন বলেছিলেন। কিন্তু দেবার আগেই অ্যারেস্ট হয়ে গেলেন। দেশের জন্যে প্রাণ দেবার শপথ ছিল আমার। সে তো হল না, এখন ভাবি, আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকব। আপনার বোমার কারখানাটা একবার দেখতে ইচ্ছে করে আমার।
বোমার কারখানা? কোথায়? মানিকতলা? মুরারিপুকুরে? সে তো কবেই পুলিশ গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
তা তো জানি, আমি বলছিলুম দেওঘরেরটা।
এবার হা হা হাসির পালা বারীনের। বললেন, সে কি আর আছে? সে সব তো মাঠ হয়ে গেছে এতদিনে।
ওই মাঠের ধুলোয় একবার গড়াগড়ি দেব দাদা, ওই ধুলো মাথায় মাখব আবিরের মতো, ওই মাঠ তো আমাদের তীর্থভূমি।
হাসতে হাসতে বারীন বলেন, ছেলেটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে রে নলিনী, ওকে এবার একটু সরবত খাওয়া, মাথাটা ঠাণ্ডা হোক।
নলিনী ভেতরে চলে যায়। বারীন গম্ভীর হয়ে বলেন, তোমার আবেগটা আমি বুঝি নজরুল, কিন্তু দেশের মানুষের আবেগ এখন আর বিপ্লবী আন্দোলনে নয়, মঞ্চে এখন গান্ধী। অহিংসা আর উপবাসেই তিনি ইংরেজের মন ভোলাবেন! বলেছেন, এক বছরের মধ্যে এনে দেবেন স্বরাজ। আমাদের যুগান্তরের ছেলেরাও তো চুপচাপ বসে বসে গান্ধীকে দেখছে, দেখতে পাচ্ছো না! মা কালীর দিন আর নেই রে ভাই, এখন নিরিমিষ্যি বোষ্টম আন্দোলন! আর আমিই বা কী করছি বল, সেল্যুলার জেল-এ বসে বসে বৈষ্ণব কবিতাই তো লিখেছি। আমার দীপান্তরের বাঁশি তুমি তো বাপু পড়েছ নিশ্চয়ই, না হলে তোমার ওই কবিতার চিঠি তো আমাকে লিখতে না।
কিন্তু আমি যে শুনলুম, বলে নজরুল, বিদেশে যারা গিয়েছিল তাদের আস্থা এখনও বিপ্লবেই। ভূপেন দত্ত শুনেছি এসেছিলেন ঋষি অরবিন্দর সঙ্গে দেখা করতে। তিনিও নাকি বলেছেন ওসব অহিংসা-টহিংসা গান্ধীর একটা ফেটিশ, বাঘা যতীনের রাস্তাই আসল রাস্তা!
দাদা যা বুঝেছেন, অকপটে তা-ই বলেছেন; কিন্তু যোগ নয়, হঠযোগেই গড়পড়তা ভারতবাসীর বিশ্বাস, এটা জেনে রেখো। বারীনের কথা শেষ হতে-না-হতেই সরবত নিয়ে ঘরে ঢোকে নলিনী, আরও কিছুক্ষণ এটা-ওটা নানা আড্ডার পর উঠে দাঁড়ায় নজরুল, বলে, আজ এবার আসি দাদা। আবার প্রণাম করে বারীনকে, তারপর তাকে অবাক করে দিয়ে নলিনীকে হঠাৎ বলে, চল্ নলিনীদা, আমাকে একটু এগিয়ে দিবি।
নলিনী অবাক হয় না, ওর ভাব দেখে মনে হয়, নজরুলের কাছ থেকে 'তুই' সম্বোধনটাই স্বাভাবিক ছিল। উঠে দাঁড়ায় সে-ও, বলে, চল্।
বত্রিশ নম্বরে পৌঁছোয় যখন ওরা, আড্ডা তখন জমজমাট। দেখা গেল, বিজলী পত্রিকার সম্পাদক নলিনীকান্তকে চেনেন কেউ কেউ, যাঁরা চেনেন না তাঁরাও নাম শুনেছেন অনেকেই। নজরুল অবিশ্যি নলিনীকে পরিচয় করিয়ে দেয় দাদাঠাকুরের শিষ্য এবং তাঁর গানের অফিশিয়াল কাস্টোডিয়ান হিসেবে, এবং পরিচয় করাতে করাতেই আফজালুলের তক্তপোশের তলা থেকে টেনে সে বের করে আনে হার্মোনিয়মখানা, টেবিলে তুলে দেয় সেটা, এবং শুরু হয় দাদাঠাকুরের গান। একটার পর একটা। ঘরের এক কোণে বসে ছিল মুজফ্ফর, সে কানে কানে কিছু বলে নজরুলকে, নজরুল মাথা নাড়ায়। ঘন্টাখানেক পর আসর ভাঙে, বিদায় নেয় নলিনী, পদব্রজে টার্ণার স্ট্রীটের বাড়ি ফেরার পথে নজরুল আর মুজফ্ফর পৌঁছিয়ে যায় ফজলুল হকের বাসস্থানে।
এমনিতে হক সাহেব খুশিই ওদের দুজনকে নিয়ে, দৈনিক নবযুগের লেখা-টেখার বিষয়ে অনেক উৎসাহব্যঞ্জক কথা তিনি শুনেছেন বন্ধুবান্ধবের কাছে। তা ছাড়া, যে বিপুল কাজ ওরা যে পারিশ্রমিকে করে, হক সাহেব জানেন, সেটা একেবারেই নগণ্য। শুধু নিজেদের ভালোবাসা আর আদর্শের তারণাতেই কাজ করে ওরা। প্রায় বিনা-বেতনেই।
সরবত শেষ হলে হক সাহেব বলেন, আজ জাস্টিস টিউনান আমাকে ডেকেছিলেন তাঁর চেম্বারে। বললেন, জানোই তো আমি বাংলা জানি, তোমার নবযুগ পড়ছি নিয়মিত। ইদানিং দেখছি তোমার কাগজের লেখাগুলোয় একটু বেশি ঝাঁঝ, একটু কেমন বেশি গরম মনে হচ্ছে। তোমার এডিটররা বোধ হয় ঘুমুচ্ছে!
পি-সি রায়ের ছাত্র তো আমি, শুনে মনে মনে খুশিই হলুম। কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে বিকেলে একটা ফোন পাই, রাইটার্স থেকে, হোম ডিপার্টমেন্ট। বললো, গত কয়েকদিন ধরেই নাকি আমাদের কাগজে অবজেকশনেব্ল্ সব লেখা-টেখা বেরোচ্ছে, ওয়ার্ণিংও দিয়েছে ওরা, লাভ হয়নি। ওই যে নজরুল যেটা লিখেছিল – মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে? – ওটাতেই ওদের বিশেষ আপত্তি। অফিশিয়াল ওয়ার্ণিং যে দিয়েছে সে তো আমি জানতুমই। কিন্তু এখন বলল, আমাদের যে হাজার টাকা জামিন আছে সেটা ওরা বাজেয়াপ্ত করছে। খবরটা শুনে মনে হল তোমাদের একটু জানাই। অফিসে দেখলুম তোমরা নেই, তাই বিশুকে বললুম তোমাদের খবর দিতে। কোথায় ধরল তোমাদের?
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে ছিলাম আমি, মুজফ্ফর বলে, বিশু ওখানেই এসেছিল। বললো, স্যর বলেছেন বাড়ি ফেরার পথে একটু স্যরের সঙ্গে দেখা করে যাবেন।
হুঁঃ! এখন কী করবে বলতো?
মুজফ্ফরকে একটু চিন্তিত দেখায়। বলে, টাকাটা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে যদি বলে থাকে, তাহলে বিনা বিচারে শাস্তিটা তো হয়েই গেছে। কী আর হবে, আমার মনে হয় আর একবার বোধ হয় নিতে হবে জামিন।
কাগজ বন্ধ করে দেবে না তো? – উদ্বিগ্ন মনে হল হক সাহেবকে।
বন্ধ করবে বললেই হল! – নজরুলের উত্তপ্ত কণ্ঠস্বর।
বললে তো হলই, হেসে বলেন হক সাহেব, আইনের কাজ করি তো, যা বলছি বুঝেই বলছি। দেখ, দেশটা আমাদের পরাধীন, দেশের মানুষের মান-সম্মানও তাই পরাধীন। এ অবস্থায় মাথা ঠাণ্ডা রেখেই যা করার তা করতে হবে।
মুজফ্ফর তার বসবার চেয়ারটা একটু বাঁকিয়ে নজরুলের মুখোমুখি বসে। বলে, আজ আর এখনই বাড়ি যাওয়া চলবে না কাজি। কালকের এডিশনটা ফাইনাল করে প্রেস-এ চাপিয়ে যেতে হবে। কাল সকালের মধ্যেই মার্কেটে পাঠিয়ে দিতে হবে কাগজগুলো। তারপর জামিনের টাকা জমা দেবার ব্যবস্থা। জমা একবার দিয়ে দিলে আর বন্ধ করবে কী করে!
কাছাকাছি একটা হোটেল থেকে পরোটা-কাবাব আনিয়ে দিলেন হক সাহেব, বিশুকে পাঠিয়ে দেওয়া হল কম্পোজিটর নুটবিহারী রায়ের বাড়িতে। নুটবিহারীবাবুর ডিউটি ভোরবেলা থেকে, উনি কম্পোজ করে দিলে কাগজ ছাপা হয়ে যায় বেলা বারটার মধ্যে। আজও উনি সকালে কাজ করে বাড়ি ফিরে গেছেন। মুজফ্ফর বিশুকে বুঝিয়ে দিল নুটবিহারীবাবুকে ঠিক ঠিক কী বলতে হবে। আজ রাত এগারটার মধ্যে উনি যেন নিশ্চয়ই আসেন। কম্পোজ করা শেষ হলেই সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে কাগজ ছাপা।
নুটবিহারীবাবু এলে তাঁকে সব বুঝিয়ে-সুজিয়ে রাত বারটায় বাড়ি ফেরে মুজফ্ফর-নজরুল।
পরের দিন সকাল সাতটায় আবার বিশু হাজির। ঘুম থেকে তুললো। থানা থেকে এক ছোট দারোগা আর বড় দারোগা এসেছিল। কাগজ ছাপা শুরুও হয়ে গিয়েছিল, বন্ধ করে দিয়ে গেছে। নতুন করে নাকি ডিক্লারেশন দিতে হবে আবার। এক হাজার নয়, জামিন এবার দু' হাজার টাকা! শাস্তি পেয়েছে দৈনিক নবযুগ!
আমার অত টাকা নেই, দিতে পারব না দুহাজার টাকা, রেগে বলেন হক সাহেব। পি-সি রায়ের ছাত্রের আগের রাতের দেমাকটা মনে হল এখন কেমন এক নিমেষেই নস্যি! মুজফ্ফর বোঝায়, কাগজের এখন ফুল স্টীম, সরকার তো চাইবেই আমরা কয়েকদিন বন্ধ রাখি। আমার কিন্তু এখন এক মুহূর্তও দেরি করা ঠিক মনে হয় না। এই যে আমাদের কাগজটা বন্ধ করলো, অপরাধটা কি? মুহাজিরিন হত্যা প্রবন্ধটার জন্যে তো ওয়ার্ণিং আগেই দিয়েছিল। তাহলে এতদিন পর আবার বন্ধ কেন? তার পর তো আর তেমন কিছু লেখা বেরোয়নি। আসল কারণটা অন্য। গতকাল ওই যে খিলাফৎ কমিটির নোটিশটা ছাপানো হয়েছিল, সেটার জন্যেই বন্ধ করল কাগজটা, রাগ আর সামলাতে পারল না। আপনি কি লক্ষ্য করেছেন ওই নোটিশ কাল বসুমতীতেও বেরিয়েছে? কই, তাদের তো বন্ধ করেনি। কিন্তু, সে যাই হোক, করেছে, ভালোই হবে। আজকের কাগজের জন্যে যে এডিটরিয়ালটা লিখেছিলাম – দুর্যোগের পাড়ি – সেটা মোসলেম ভারতে ছাপিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছি। নবযুগকে আজ জুলুম করে বন্ধ করার খবরটা নিশ্চয়ই বেরোবে দুয়েকটা অন্য কাগজেও। যারা এতদিনেও নবযুগ পড়েনি, বাংলা খবরের কাগজের সেই পাঠকদেরও নবযুগের ব্যাপারে কৌতূহল বাড়বে। এখন যতদূর তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের কাগজটা আবার বের করা চাই। আমার তো মনে হয় একটু কষ্ট করে হলেও ওই দুহাজার টাকা আজই জমা দিয়ে দেওয়া উচিত।
তুমি তো উচিত বলেই খালাস, অসন্তুষ্ট হক সাহেব বলেন, আমাকে একটু ভাবতে দাও, দেখি কোথা থেকে টাকাটা জোগাড় করা যায়।
হক সাহেবের বাড়ি থেকে যখন বেরোয় ওরা, নজরুলের অসন্তুষ্টিতে কোন আড়াল নেই তখন। বলে, ভালো লাগছে না আহ্মদ ভাই। জাহান্নামে যাক নবযুগ, আমি আর কোন খবরের কাগজের মধ্যে নেই।
নজরুলের কাঁধে একটা হাত রাখে মুজফ্ফর। বলে, এখন তোমার মাথা গরম, ছেড়ে দাও ও আলোচনা। চল, তোমাকে কলকাতার একটা নতুন দিক দেখতে নিয়ে যাই।
হাঁটতে হাঁটতে ধর্মতলার ট্রাম টার্মিনাসে পৌঁছোয় ওরা, খিদিরপুরের ট্রামে ওঠে। ময়দান কেটে চলে ট্রাম; ডাইনে সবুজ, বাঁয়ে সবুজ, নীচে সবুজ, ওপরে বর্ষাশেষের আকাশে বদলে-বদলে যাওয়া নীলকালোর ঘনঘটা। নজরুল বলে, যা-ই বল আহ্মদ ভাই, শহর হতে পারে, কিন্তু আমাদের কলকাতা ভারী সুন্দর।
ঠিকই বলেছ, মুজফ্ফর জবাব দেয়, ঠিকই বলেছ, তবে এতটা সুন্দর আর লাগবে না কিছুক্ষণ পর, অপেক্ষা কর চমকটার জন্যে।
ময়দান শেষ হবার পর ডানদিকে ঘোরে ট্রাম, একটু পর একটা বড় কালভার্ট, সেটা পেরিয়ে বাজার অঞ্চলে পৌঁছোতেই নজরুল হাসে। বলে, ঠিকই, আবার সেই ঘিঞ্জি কলকাতাতেই এলাম, কিন্তু সবুজের মধ্যে এতটা ভ্রমণ, তাই বা মন্দ কী!
ট্রাম পৌঁছোয় টার্মিনাসে। মুজফ্ফর বলে, চল, ট্রামের এই শেষ, এবার হন্টন।
হেঁটে পেরোতে হয় একটা পন্টুন ব্রীজ। হাওড়ার মতো অতটা চওড়া নয়, লম্বাও নয়, কিন্তু হাঁটাটা খুবই ভালো লাগে নজরুলের। হাওড়ার ব্রীজ থেকে জলের দূরত্ব অনেকটা, এটা জল প্রায় ছুঁয়ে যায়।
ব্রীজটা পেরিয়ে যেখানে ওরা পৌঁছোয়, সেটা একটা বস্তি অঞ্চল। শইফুল, আনোয়ার, বসন্ত, এরকম সব নামের কয়েকজন লোকের খোঁজ করে মুজফ্ফর, কিন্তু পাওয়া যায় না তাদের। মুজফ্ফর বলে, যাদের খোঁজ করছি এরা সব আমার দেশের লোক, সন্দ্বীপের। দেশে যে কাজ তাতে নগদ পয়সা নেই, এরা তাই জাহাজে কাজ করে। যেমন-তেমন কাজ পেলেই চড়ে বসে জাহাজে, যতদিন না জাহাজ ফিরছে ততদিন খাওয়া-থাকার খরচ নেই, এমনকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেও জাহাজেই ডাক্তার আছে। যে টাকা সঙ্গে নিয়ে ফেরে, তাতে অনেক টাকা পাঠাতে পারে বাড়িতে। তোমার সঙ্গে এদের একটু আলাপ করিয়ে দেব ভেবেছিলাম। মাঝে মাঝেই আমি আসি এখানে, কিন্তু যখনই আসি, তখনই যে সবাইকে পাই এমন নয়, কোন-না-কোন জাহাজে বেরিয়ে যায় বেশির ভাগই। তবে একেবারে কারো সঙ্গেই দেখা হল না, এরকমটা হয়নি কখনও আগে। হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলছিল ওরা, সামনে একটা হোটেল গোছের দেখতে পেয়ে মুজফ্ফর বলে, চল, খেয়ে নিই কিছু, সকাল থেকে তো খাওয়া হয়নি।
হোটেলে ঢুকেই কোণের দিকে একটা টেবিলে একজন লোক বাঁ হাতের তর্জনী আর মুখনিসৃত ফুঁ-এর সহযোগে সর সরিয়ে এক মনে চা খাচ্ছিল। দেখেই মুজফ্ফর বললো, কী ইমরান সাহেব, কেমন আছেন? ইমরান বলল, আরে আহ্মদ সাহেব যে, কী খবর? অনেক দিন দেখিনি আপনাকে।
সময় পাই না আজকাল, অন্য কাজে ব্যস্ত থাকি, বলে মুজফ্ফর, অনেক দিন এদিকে আসা হয় না, আজ একটু ফাঁকা ছিলাম, আমার এই বন্ধুকে নিয়ে এলাম।
বেশ বেশ, বলে ইমরান, কিন্তু আপনার দেশোয়ালিদের পাবেন না তো আজ, তিন-চারদিন আগেই ওরা জাহাজ পেয়ে গেল একটা। শুনলাম আর্জেন্টিনা যাচ্ছে।
মুজফ্ফর নজরুলকে বলে, ইমরান সাহেব এখানকার খুব বড় লাত্তিলওয়ালা। তারপর ইমরানকে বলে, এ আমার বন্ধু নজরুল ইসলাম ইমরান সাহেব, যুদ্ধে গিয়েছিল, হাবিলদার হয়ে এখন ফিরে এসেছে।
লাত্তিলওয়ালা? – একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে নজরুল।
জাহাজ থেকে ফিরেই জাহাজিরা ইমরান সাহেবের মেহ্মান হয়ে যায় যতদিন না আবার পরের জাহাজটা ধরবে। উনি তখন হোস্ট, সাহেবরা বলে বোর্ডিং কীপার, জাহাজিদের ভাষায় লাত্তিলওয়ালা। তো ইমরান সাহেব, ইমরানকে জিজ্ঞেস করে মুজফ্ফর, সবাই চলে গেল? একজনও পড়ে নেই?
আছে, আব্বাস আছে, ওকে নিল না। ডাক্তার আটকিয়ে দিল।
কেন, কী হয়েছে ওর?
আমাদের চোখে কিছুই হয়নি, ডাক্তারও বললেন, তেমন কিছু নয়, কিন্তু এবারটা ওর না যাওয়াই ভালো। একটু বিশ্রাম নিক, পরের জাহাজে যাবে। চলে যাবে ঠিকই, রোজই ঘোরাঘুরি করছে।
মুজফ্ফর বলে, ও আছে কোথায়, ওকে ধরা যাবে এখন? আমার এই বন্ধুর সঙ্গে একটু আলাপ করিয়ে দিতাম।
আলাপ করাবেন? তা করান না। আপনারা তো খাবেন এখন, আমি দেখি কোথায় পাওয়া যায় ওকে। ইমরানের চা শেষ হয়েই এসেছিল, বাকিটা এক চুমুকে খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে আশ্বাস দিয়ে গেলেন, আপনারা খান ধীরে সুস্থে, আমি খবর লাগাচ্ছি।
ওরা খেতে খেতেই আব্বাস আসে। ছেলেমানুষ, আঠের-উনিশের বেশি বয়েস নয়, দেখে মন হয় আরও কম। মুজফ্ফর জিজ্ঞেস করে, কী হল, এবার তোমার যাওয়া হল না কেন?
যাচ্ছিলাম তো আহ্মদ ভাই, আব্বাস বলে, কিন্তু জাহাজে যেদিন উঠতে যাব, ডাক্তারবাবু আমাকেই আটকে দিলেন। আগের দিন একটু সর্দি জ্বরের মতো হয়েছিল, বুক-পেট টিপে দেখে বললেন, এবারটা থেকে যা আব্বাস, পনের-বিশ দিন পর এই কম্পানীরই জাহাজ যাবে আর একটা, সেটা ধরে নিস। এ ক'দিন একটু ভালো করে খাওয়া-দাওয়া কর। একটু সাবধানে থাকিস, বাসি খাবার খাবি না, যা খাবি টাটকা।
তুই খেয়েছিস কিছু?
হ্যাঁ, সকালেই তো খেলাম, গরম ভাত। ফ্যানাভাতে মাখন দিয়ে।
বাঃ, মুজফ্ফর বলে হেসে, তারপর নজরুলকে দেখিয়ে বলে, এ আমার বন্ধু, পল্টনে ছিল, এখন ফিরে এসেছে। পদ্য লেখে, গান গায়। তোদের সঙ্গে আলাপ করাতে নিয়ে এলাম।
নজরুল বলে, জাহাজে যেতে আমারও খুব ইচ্ছে করে। তুমি যখন যাবে পরের বার সঙ্গে নেবে আমাকে?
হাসে আব্বাস, আমার সঙ্গে তুমি যেতে পারবে না। আমরা যে কাজ করি সে কাজ তোমার নয়। তোমরা পড়ালেখা জানা লোক, তোমাদের জন্যে অন্য কাজ।
তুমি কী কর? কী কাজ তোমাদের? – জিজ্ঞেস করে নজরুল।
আমাদের অনেক কাজ। কাছিও টানি, ডেকও পরিষ্কার রাখি, রান্নাঘরেও কাজ করি, ইঞ্জিন ঘরের কয়লাও ভাঙি যদি বলে।
এ কাজে তো অনেক পরিশ্রম, বলে নজরুল, তুমি তো ছেলেমানুষ, এত কম বয়েসে জাহাজে চলে এলে কেন, বাড়িতে কে কে আছে?
আছে সবাই। বাপ-মা, ভাই-বোন সবাই আছে, শুধু নাই টাকা। জমি-জিরেতও নাই।
আহ্মদ সাহেবের গ্রামের মানুষ নাকি?
পাশের গ্রামের। আহ্মদ সাহেবকে তো আমি এখেনে এসে চিনলাম। বসন্ত আছে আমাদের গ্রামের, সে এখেনে এই তিন-চার বছর জাহাজে কাজ করে। সে এসেছিল গ্রামে। বোনের শাদি করালো, অনেক টাকা নিয়ে গিয়েছিল। আসবার সময় আমারে কয়, কী রে আব্বাস আমার সাথে যাবি? জাহাজের কাজে অনেক টাকা। অনেক দেশও দেখবি। যাবি?
দেশে আর কখনও গিয়েছিলে এখানে আসবার পর?
নাঃ, এখনও যাই নাই। তবে টাকা পাঠাইছি। দু'বার।
পাঠালে কিভাবে?
শয়ফুল আছে আমাদের গ্রামের, সে একবার গেল। তার হাতে দিলাম টাকা। আর একবার তো মনিয়ডার করলাম। ইমরান সাহেবই শিখাই দিল।
তুমি যখন দেশে যাবে এরপর, সঙ্গে নেবে আমাকে? – জিজ্ঞেস করে নজরুল।
আমার যাবার কী ঠিক, কবে যাই ঠিক-ঠিকানা নাই, তুমি আহ্মদ সাহেবের সাথে ঘুর্যা আয়সো। আর তো দু মাস পর শরৎকাল, দুজ্ঞোচ্ছব। তহন বরিশাল থেইক্যা জাহাজ পাবে, সোজা সন্দ্বীপ।
মুজফ্ফর বলে, তুই তো বেশ কলকাতার মতো কথা বলতে শিখে গেছিস আব্বাস। এবার দেশে গেলে তোকে তো কেউ চিনতেই পারবে না।
লজ্জা পেয়ে যায় আব্বাস। বলে, এখন পারি একটু একটু। দেশের জবান তো ভুলেই যাব এবার।
হা হা করে হেসে ওঠে নজরুল, বলে, এরপর দেশে যাবে যখন আমাকে খবর দিও। আমি যাব তোমার সঙ্গেই।
টার্ণার স্ট্রীটের বাড়িতে ফেরে যখন, দুজনেই বেশ ক্লান্ত। নজরুল বলে, এক দিক থেকে ভালোই হল আহ্মদ ভাই। কাল থেকে আর অফিস যাবার তাড়া নেই, শুধু কবিতা লিখেই দিন কাটিয়ে দেব।
সে তুমি কাটিও, মুজফ্ফর বলে, আমি কিন্তু হক সাহেবের পিছনে লেগে থাকব। এরকম কাগজ এত সহজে বন্ধ করা চলবে না। দুহাজার টাকা এমন কী আর ব্যাপার।
মুজফ্ফরের আগ্রহ দেখেই হোক্ বা বন্ধুদের পরামর্শে, কয়েকদিন পর আবার ঘুম ভাঙাল বিশু, স্যর ডেকেছেন। অনিচ্ছুক নজরুলকেও টানতে টানতে নিয়ে গেল মুজফ্ফর।
আপ্যায়নের ত্রুটি নেই, নাস্তার ব্যবস্থা করেছিলেন হক সাহেব। খাওয়ার সময় বললেন, তোমরা হয়তো বিশ্বাস করনি, সত্যিই কিন্তু আমার টাকার টানাটানি চলছে। যাই হোক, আবদুর রহিম বখ্শ্ ইলাহীকে চেন?
টোবাকো মার্চেন্ট? – জিজ্ঞেস করে মুজফ্ফর।
আরে, তুমি তো দেহি চেননা এমন কেউ নাই কইলকাত্তায়। আমি চার বছর প্রেসিডেন্সীতে পড়লাম, তারপর ল-কলেজ, আশুবাবুর জুনিয়রশিপ করসি কতদিন, তারপর হাই কোর্টের প্র্যাকটিশ – তবুও আজও আমি হেই বরিশালের আবুল কাসেম ফজলুল হক! আর তুমি হেইদিন আসছ কইলকাত্তায়, কারে না চেন!
মুজফ্ফর হাসে। বলে, আপনার মতো লোকের তো তা-ই হওয়ার কথা স্যর। বরিশালে আপনাকে সবাই চেনে এক ডাকে, আমাকে কে চেনে নোয়াখালিতে বলুন। আমার তাই কলকাতার পরিচয়েই পরিচয়।
হুঁ, শোন। রহিম বখ্শের কাছে চলে যাও, বলা আছে। তোমাকে চেক দিয়ে দেবে একটা, বিয়ারার। সেটা ভাঙিয়ে, ক্যাশ টাকা জমা দিয়ে দিও চীফ প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে। আজই। এবারের ডিক্লারেশনটা তোমার নামেই হোক।