এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • সীমানা - ৩৬

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৫৯৫ বার পঠিত
  • ছবি: সুনন্দ পাত্র


    ৩৬

    দার্জিলিঙে



    ফার্স্ট ক্লাসে দুজনের কূপে। ফিরপোজ থেকে লাঞ্চ প্যাক এনেছে মনোরঞ্জন, পথিমধ্যে কেলনারও আছে; গরম চা, টুকিটাকি খাবার, অর্ডার দিলেই এসে যায়। শিলিগুড়ি থেকে ছোট রেলগাড়ি – টয় ট্রেন – শুনেই ছেলেমানুষের মতো উত্তেজিত কাজি।

    তিনধরিয়া ছাড়াবার পর নজরুলকে আর ট্রেনে প্রায় আটকিয়ে রাখা যায় না। ছোট ছোট ঝর্ণা ডাইনে-বাঁয়ে, তারই মাঝখান দিয়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে উঠছে ট্রেন। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কখনও দেখা যায় পিছনের কয়েকটা কামরা অনেক নীচে, প্রায় কান্নার মতো শব্দে যেন টেনে-হিঁচড়ে ঘষটাতে ঘষটাতে ছোঁয়ার চেষ্টা করছে সামনের কামরাগুলোকে আর ইঞ্জিনটাকে। আর পরের মুহূর্তেই যেন সামনের কামরাগুলো গোত্তা খেয়ে নীচে নেমে গেল অনেকটা। কয়েক মুহূর্তের জন্যে আর দেখা যায় না পেছনের কামরাগুলোকে। তার পরেই হঠাৎ সম্বিত ফেরে কাজির। এক লাফে উল্টোদিকের জানলায় পৌঁছিয়ে দেখে, নীচে ছিল যেগুলো সেই কামরাগুলো এখন ওপরে! দার্জিলিঙে আগে কখনও আসেনি মনোরঞ্জনও, সে-ও অবাক, কিন্তু কাজির এত উচ্ছ্বাস দেখাটাও তার পক্ষে একটা নতুন পাওনা!

    বাতাসিয়া লূপে এসে রেলগাড়িটা দাঁড়িয়ে যায়। বিস্তৃত বৃত্তাকার ভূমিতে কেয়ারি-করা বাগানে নানা রঙের ফুলের মেলা। এতক্ষণ নাম-না-জানা রকমারি রঙের পাহাড়ি ফুল দেখছিল, এবার প্রকৃতি আর মানুষের প্রতিযোগিতা যেন। পাহাড়ে বেড় দিয়ে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে এতটা ওপরে উঠে যেন শ্রান্তি অপনোদনের জন্যে দাঁড়িয়েছে গাড়িটা। অত বড় লূপে রেলগাড়িটা যেন কতই ছোট। আর তার পেছনেই বিস্তৃত পাহাড়কে ছাড়িয়ে নিজের মাথাটা দেখাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। এই বর্ষার দিনেও হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে কী তার রঙের ছটা! গাঢ় বেগুনী থেকে নীল সবুজ হলুদ গেরুয়া লাল রঙের অবিশ্রান্ত মিশ্রিত ঝলকানি আর ছড়িয়ে-পড়া রং বাকরোধ করে শুধু কাজি কেন – সে তো কবিই! – বাকি সব যাত্রীরই।

    কলকাতা থেকেই দার্জিলিঙে একটা ছোটখাটো বাংলো ভাড়া করে রেখেছিল মনোরঞ্জন। দার্জিলিঙের ইস্টিশানে গাড়ি দাঁড়াতে লাল-গাল বেঁটেখাটো ফুটফুটে একটা ছেলে এসে ওদের মালগুলো তুলে নেয়। এমন মালবহনও কখনও দেখেনি কাজি। দু-কাঁধে দু'খানা ব্যাগ, আর বড় স্যুটকেস দুটো একটা চওড়া-পটি বেল্টজাতীয় কিছু-একটার সঙ্গে বেঁধে পটিটা কপালে তুলে নেয় ছেলেটা। স্যুটকেস দুটো মনে হয় পরম নিশ্চিন্তে ওর পিঠ দিয়ে ঝুলছে। কাজি বলে বাংলায়, আর একজনকে ডেকে নাও, এতগুলো তুমি পারবে না, কষ্ট হবে। ছেলেটা হেসে বলে, আরও দু-চারখানা দিলে তা-ও নেব। হেঁটে হেঁটে ছেলেটার সঙ্গে ওরা পৌঁছিয়ে যায় ওদের বাংলোয়।

    দার্জিলিঙে যেন বইয়ে-পড়া বিলিতি আবহাওয়া। বাতাসিয়া লূপে অত ভালো অত উজ্জ্বল কাঞ্চনজঙ্ঘার পর বাংলোয় ঢুকতে-না-ঢুকতেই ঝর ঝর ঝরিছে বারিধারা। বাংলোয় ওদের দেখাশোনার জন্যে একটা ছেলে আছে, সে গরম চা খাওয়াল। চা শেষ হল, কিন্তু বৃষ্টি শেষ হবার কোন লক্ষণ নেই। ওরা কী খাবে শুধোয় ছেলেটা।

    তোমার ভাঁড়ারে কী আছে? – জিজ্ঞেস করে কাজি।

    ভাঁড়ারে কিছুই নেই, যেমন খাবেন তেমনই আনব।

    আনবে কোথা থেকে? বাজার কোথায়?

    বাজার নীচে, ট্যাক্সিস্ট্যাণ্ডের কাছে, বেশি দূর নয়।

    খিচুড়ি রাঁধতে জানো? – জিজ্ঞেস করে মনোরঞ্জন, এমন বাদল দিনে খিচুড়িই জমে যাবে, কী বলেন কাজিসাহেব? কাজি বলে, তা জমবে ঠিকই, যদি গরম গরম পাতলা খিচুড়ি দিতে পারে। কী, পারবে? – আরে, তোমার নামটা যেন কী? সেটাই তো জানা হয়নি, কাজি বলে।

    নরবাহাদুর বিশ্বকর্মা, ছেলেটার উত্তর। ও বলে, এখন বাজার করে এনে তারপর রান্না করতে করতে তো অনেক বেলা হয়ে যাবে। এখান থেকে খানিকটা নামলেই একটা হোটেল আছে, সেখানে গরম রুটি পাওয়া যায়, আর ডাল। চাইলে  কয়েকটা ডিমও ভেজে দেবে তার সঙ্গে। বাবুরা যদি রাজি থাকে, তাহলে এ-বেলা তা-ই খাওয়া হোক, ওদের খাইয়ে-দাইয়ে তার পর খিচুড়ির বাজার করে আনবে নরবাহাদুর। সেটা যদি রাতে খাওয়া হয়, বাবুরা কি রাজি?

    প্রস্তাব মন্দ নয় – একমত ওরা দুজনেই – সময় নষ্ট না করে টাকাপয়সা নিয়ে বেরিয়ে গেল নরবাহাদুর বিশ্বকর্মা। আধ ঘন্টার মধ্যেই টেবিল রেডি। ন্যাপকিন-ট্যাপকিন সমেত। বড় একটা প্লেটে চমৎকার করে সাজিয়ে-দেওয়া স্যালাডও। কাজি বলে, এই স্যালাড খেলেই পেট এবং মন, দুটোই ভরবে। তারপর ছেলেটাকে বলে, তোর বিশ্বকর্মা নাম সার্থক রে। ওই নরসুন্দর না বাহাদুর কী যেন বললি, ওটা তোর নাম নয়। তোর নাম বিশ্বকর্মাই। বিশ্বকর্মা না হলে পাড়ার হোটেলের খাবারকে ফিরপোজের খাবার বানিয়ে দেওয়া যায় নাকি? কী মনোরঞ্জনদা, শুরু করুন।

    কাজির প্রশংসাবাণীর জোরেই হোক অথবা বিশ্বকর্মার যত্নআত্তির স্বাভাবিক অভ্যেসের ফলে, খাওয়া শেষ হবার আগেই গরম চা-ও এল। এতক্ষণের বৃষ্টিতে দার্জিলিং বেশ ঠাণ্ডা এখন, বিছানা-কম্বল রেডি করে রেখে দিয়েছে বিশ্বকর্মা, দিবানিদ্রার এমন সুযোগ ছাড়ল না ওরা।

    এক ঘন্টাও হয়নি ওরা ঘুমিয়েছে, যখন চোখ মেললো, মনে হল আলোয় যেন ঝলসে যাচ্ছে চোখ। একটা জানলার কাছে টুল পেতে বসে আছে নরবাহাদুর বিশ্বকর্মা। আসলে, বৃষ্টিটা কমে গেল ওরা ঘুমিয়ে পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। দার্জিলিঙে যেমনটা হয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত মেঘ ফর্সা। বিশ্বকর্মা জানে, আর একটু পরেই আকাশ-ভরা আলো দেখা যাবে। এই বাংলোটা যে-রাস্তার উপর সেটা নীচের ট্যাক্সি-স্ট্যাণ্ড থেকে সোজা উঠে গেছে মল পর্যন্ত। চড়াই রাস্তা, যতই জোরে বৃষ্টি পড়ুক, বৃষ্টি থামার কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুরোপুরি শুকিয়ে যায়, কিছুক্ষণ আগেই যে বৃষ্টি পড়ছিল বোঝা যায় না তা একেবারেই। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা-বন্ধ-করা বৃষ্টিবন্দী পর্যটকরা আনন্দের কলধ্বনি তুলে হাঁটতে থাকবে চড়াই ধরে মলের দিকে। এই যে কলকাতার বাবু দুজন ঘুমিয়ে পড়ল, ওরা তো এই আনন্দটা আজ পেলই না।

    ওদের ঘুম ভাঙিয়ে তুলে দিলে কেমন হয়! – ভাবে বিশ্বকর্মা। নাঃ, সেটা ঠিক হবে না, নিজেই এই সিদ্ধান্তে আসে সে।তার চেয়ে এক কাজ করা যাক। পর্দাগুলো টেনে কাচের সার্সি সব ঢেকে দেওয়া হয়েছে, তাই আলো আসছে না ঘরে। সমস্ত পর্দা সরিয়ে দেয় ও, ঘর একেবারে আলোয় আলোময়। জানলার বাইরে রাস্তার দিকে তাকায় তার পর, দলে দলে লোক বেরিয়ে পড়েছে। এবার একটা টুল টেনে জানলার পাশে সে বসে, তাকিয়ে থাকে রাস্তার দিকে। মনে মনে আশা, এত আলোয় ঘুমোতে পারবে না বাবুরা!

    হলও তাই, চোখ দুটো দুহাতের পেছন দিতে ঘসতে ঘসতে উঠে বসে ওই ঝাঁকড়া চুলের বাবুটা, এত আলো এল কোথা থেকে? বিশ্বকর্মা উঠে দাঁড়ায়, জল-পড়া তো বন্ধ হয়ে গেছে বাবু, রাস্তায় এত লোক!

    তাই নাকি?– বলতে বলতে উঠে বসে মনোরঞ্জনও, তাহলে তো বেরোলেই হয়।

    বাথরূমটা এ-ঘরের সঙ্গে সংযুক্ত। তারই লাগোয়া একটা ঘর, সেখানে আয়না আছে বড়োসড়ো, আলমারি-আলনা। ওদের স্যুটকেস-ব্যাগ সবই সেখানে গুছিয়ে রেখেছে বিশ্বকর্মা। ওরা তৈরি হয়ে নেয় অতি দ্রুত। বেরোবার আগে বিশ্বকর্মা বলে, টুপি নিও বাবু, আর মাফ্‌লার; দার্জিলিঙে হঠাৎ কখন ঠাণ্ডা পড়ে যাবে কেউ জানে না।

    রাস্তায় বেরোতেই – আরে, কে এখানে? অখিল না? টুপি-মাফলারের আড়াল যতই দাও, তোমার চাঁদবদন ভুলি কেমনে?

    কাজিদা? – উচ্ছ্বসিত অখিল নিয়োগী এগিয়ে আসতে আসতেই তার সঙ্গে যোগ দিল অবনী ও মন্মথ রায় – কবে এলে দার্জিলিঙে?

    আজই তো, মনোরঞ্জন উত্তর দিতে দিতে অবনীর মাথা টপকিয়ে আরও নীচে কাজি দেখতে পায় প্রবোধ গুহকে, তিনি নীহারবালার সঙ্গে একমনে কথা বলতে বলতে এগোচ্ছেন। তাঁদের পিছনে আরও তিন-চার জন; মুখচেনা, সরাসরি আলাপ নেই কাজির সঙ্গে।

    কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওরা সবাই পৌঁছে গেল মলে। অখিল মন্মথ আর অবনী এসেছে গতকাল, পরশু দিন এসেছে প্রবোধ তার নাটকের দলকে নিয়ে, নীহারবালাও তাদের সঙ্গে। আর আজ এল কাজি আর মনোরঞ্জন; তিনটে দল, কেউ অন্যের প্রোগ্রাম জানত না। অখিল বলে, সবাই মিলে এক জায়গায় থাকলেই হয়, জমে যাবে। সবাই? হাসেন মন্মথ রায়। মানে রবীন্দ্রনাথকেও সঙ্গে নিতে চাও? তাঁর পুরো দলবলকে নিয়ে?

    রবীন্দ্রনাথও এসেছেন নাকি? – শুধোয় কাজি।

    হ্যাঁ, সবান্ধব সপরিবার। মল পেরিয়ে জিমখানা ক্লাব পেরিয়ে আছে বিরাট এক বাংলো, মন্মথ বলে, সেখানে উঠেছেন গুরুদেব, সঙ্গে পুত্র রথি, পুত্রবধূ প্রতিমা, প্রশান্ত আর রানি মহলানবিশ, আর তা ছাড়াও সুরেন দাশগুপ্তর মেয়ে মৈত্রেয়ী।

    আপনি জানলেন কীভাবে? গিয়েছিলেন নাকি?

    যাইনি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, যেতে সাহস পাইনি। কিন্তু এসেছেন। কোথায় আছেন, এসব খবর পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথ এসেছেন দার্জিলিঙের মতো ছোট জায়গায়, সে খবর কি আর চাপা থাকে? কিন্তু দার্জিলিঙে আছি আমরা আর ঠিক এই সময়েই গুরুদেবও আছেন, জানতুম তাঁর সঙ্গে দেখা করার একটা সুযোগ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। দেখলেন তো, আপনি হাজির। এখন আর আমাদের রোখে কে?

    এখন সন্ধ্যে প্রায় নামছে, ঠিক হল ওরা সবাই মিলে কবির সঙ্গে দেখা করতে যাবে পরের দিন সকালে। অতএব, সবাই মিলে হাঁটতে হাঁটতে আবার ফেরা। যে বাড়িতে উঠেছিল অখিল-মন্মথরা, সেখানেই জমল আড্ডা।

    পরের দিন ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গেল নজরুলের। পাশের খাটে অকাতরে ঘুমোচ্ছেন মনোরঞ্জন। জানলার পর্দা সরিয়ে সোনালী রোদ্দুর দেখা গেল উল্টো দিকের বাড়িটার কাচের সার্সিতে প্রতিফলিত। আর কি বসে থাকা যায় ঘরে? মনোরঞ্জনকে ডাকে নজরুল, বাইরে রোদ্দুর, বেরোবেন নাকি? কম্বলটা টেনে কান ঢাকতে ঢাকতে মনোরঞ্জন বলে, আর একটু ঘুমোব আমি, আপনি বেরিয়ে আসুন।

    বাইরের ঘরে ঘুমোচ্ছিল বিশ্বকর্মা, তাকে জাগিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যায় কাজি। মলে এরই মধ্যে বেশ ভিড়, দার্জিলিঙে এসে ঘোড়ায় চড়ার সাধ মিটিয়ে নেয় কলকাতার মধ্যবিত্ত মানুষ। ঘোড়াওয়ালারা বাচ্চাদের ঘোড়ার পিঠে তুলতে ব্যস্ত, তাই নিয়ে হৈ হৈ। প্রতিটি যাত্রীর জন্যে একটা করে ঘোড়া গছাতে চায় ঘোড়াওয়ালারা, এত ছোট আমাদের টাট্টু ঘোড়া একজনের বেশি ভার নিতে পারবে না। এক মা তার ছেলেটাকে একা ছাড়বে না কিছুতেই। ঘোড়াওয়ালা বোঝায়, প্রতিটি ঘোড়ার পাশে-পাশে একজন করে আমার নিজের লোক হাঁটবে, কোন ভয় নেই। মা'র তাতেও প্রবল আপত্তি। অবশেষে মাকেও একই ঘোড়ায় চাপতে দেওয়া গেল। শাড়ি-পরা মায়ের ঘোড়ায়-চড়া নিয়ে অশেষ দুর্গতি! আর, তাই নিয়ে সবায়ের হাসাহাসি। কাজি দেখছিল এতক্ষণ, হঠাৎ চোখ পড়ে ওর বাঁ-দিকে নীচের রাস্তা দিয়ে শাল-গায়ে এক ভদ্রলোক উঠে আসছেন, সঙ্গে মেমসাহেবদের মতো খাটো ঝুলের স্কার্ট-পরিহিত একটি মেয়ে। চেনা-চেনা লাগে। আরে, ঢাকায় আলাপ হয়েছিল না? ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের প্রিন্সিপাল সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র আর তাঁর মেয়ে নোটন না?

    দেখতে পেয়ে সুরেন্দ্রনাথই কথা বলেন প্রথম, কী ব্যাপার কাজিসাহেব, দার্জিলিঙে একা-একা কী করছেন?

    বন্ধুদের নিদ্রাদেবীর আরাধনা শেষ না হলে একা-একা ছাড়া কী আর করি বলুন।

    এলেন কবে?

    গতকাল এসেছি। আপনারা?

    আমাদের তো সপ্তাখানেক হয়ে গেল। আরও কিছুদিন থাকবার ইচ্ছে আছে, বলতে থাকেন সুরেন্দ্রনাথ, গতকাল জিমখানা ক্লাবের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নোটন লক্ষ্য করে ক্লাবে টেনিস খেলা হচ্ছে। দেখেই ওর খেলবার ইচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, ক্লাবের মেম্বার আর রেসিডেন্ট ছাড়া অন্যদের খেলতে দেওয়া হয় না। ওর পারসুয়েজনে পেরে না-উঠে এক ভদ্রলোক বলেছেন আজ সকালে আসতে; ওই সময় মেম্বাররা থাকে না, চেষ্টা করবে ওকে খেলবার সুযোগ করে দিতে।

    ওর র‍্যাকেট কোথায়? – জিজ্ঞেস করে কাজি, র‍্যাকেটও দেবে?

    দেয় যদি, তাহলেই খেলতে পারবে, র‍্যাকেট তো আনেনি সঙ্গে।

    ওদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কাজিও ঢোকে জিমখানা ক্লাবে। টেনিস-কোর্টে নেট লাগানোই আছে, একটিমাত্র কমবয়েসী ছেলেকে দেখা গেল নীচু হয়ে মাটিতে কিছু-একটা করছিল। কেউ এসেছে বুঝতে পেরে সে মুখ তুলে তাকায়, তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে ওদের দিকে, কেয়া মাংতা?

    সা'ব কহাঁ? – বেশ চটপটে উত্তর দেয় নোটন, মনে মনে তারিফ করে কাজি একটু দূর থেকে।

    কোন্‌সা সা'ব?

    ইয়ে টেনিসবালা সা'ব।

    নীরবে নোটনের দিকে তাকায় ছেলেটা। তারপর, মনে হয় একটু জরিপ করল সুরেন্দ্রনাথ আর কাজিকে। তারপর বলে, এক মিনিট।

    একটু দ্রুত হেঁটে কোর্ট ছাড়িয়ে সামনের পর্দা-টানা কাঠের বাড়িটায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে ভেতরে চলে যায় ছেলেটা। বাইরে ওরা দাঁড়িয়েই থাকে, নির্বাক। কিছুক্ষণ পর ছেলেটার পিছনেই ড্রেসিং গাউন পরা এক ভদ্রলোককে দেখা যায়। নোটনকে দেখে হাসেন ভদ্রলোক। বলেন, আপনি খেলবেন কার সঙ্গে? কাজি এবং সুরেন্দ্রনাথের দিকে তাকান তারপর। ওঁরা তো খেলবেন মনে হচ্ছে না।

    আমি ভেবেছিলুম অন্য প্লেয়াররাও থাকবেন কেউ কেউ, একটু ম্রিয়মাণ শোনায় নোটনের গলা।

    না নাঃ, ওরা কেউ এত সকালে আসে না।

    আমি বুঝতে পারিনি, নোটনের গলায় প্রায় কান্না।

    সিঁড়ি দিয়ে উঠেই যে বারান্দাটা সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন ভদ্রলোক। নেমে এসে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা শুনছিল ছেলেটা। তার দিকে চোখ পড়ে ভদ্রলোকের। বলেন, বলবয়ের সঙ্গে খেলুন না। ভালোই খেলে। ওরাই তো বিগিনারদের কোচ।

    বিগিনার? কথাটায় একটু খোঁচ লাগে নোটনের। সে জবাব দেয় না, দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নীচু করে। বলবয় দৌড়িয়ে কোথা থেকে একটা র‍্যাকেট নিয়ে নোটনের সামনে আসে। র‍্যাকেটটা দেয় তার হাতে। তারপর দৌড়িয়ে চলে যায় কোর্টে। নোটন আসতে আসতে তিনখানা বল সে সার্ভ করে পাঠিয়ে দেয় কোর্টের বাইরে।

    নেটের পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ খেলা দেখেন সুরেন্দ্রনাথ আর কাজি। খেলা হয় মিনিট পনের-কুড়ি, তারপর নোটন এসে বাবাকে বলে, চল।

    জিমখানা ক্লাব থেকে বেরিয়ে আসে ওরা তিনজন। কাজি জিজ্ঞেস করে, আপনারা উঠেছেন কোথায়?

    আপনি আসছেন তো আমাদের সঙ্গে, আসুন না, কোথায় উঠেছি স্বচক্ষেই দেখবেন, বলেন সুরেন্দ্রনাথ। কথা বলে বোঝানো মুশকিল হবে, মল ছাড়া এখানকার ল্যাণ্ডমার্ক তো কিছুই চিনি না।

    বাগান-টাগান সমেত বেশ বড় বাংলো। নোটনের রাগ খানিকটা পড়ে গেছে এতটা হেঁটে আসার পর; কাজিকে সে বলে, ব্রেকফাস্ট করবেন তো?

    উঁহুঁ, আজ নয়, বলে কাজি, আমার বন্ধু নিশ্চয়ই আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।

    ঠিক আছে, ভেতরে আসুন, এক কাপ চা তো অন্তত খেয়ে যান।

    ভেতরে ঢুকতেই বসবার ঘরটায় সোফা-টোফা ছাড়াও একটা পিয়ানো। পিয়ানোটা দেখতে পেয়েই তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় কাজি। নোটন বলে, এটার জন্যেই আপনাকে ডাকলাম।

    এটা এখানে পেলে কোথা থেকে? – জিজ্ঞেস করে কাজি।

    এবার কথা বলেন সুরেন্দ্রনাথ। আমরা যে হঠাৎ পেয়ে গেলাম, তা নয়। আগে থেকে চিঠিপত্র দিয়ে পিয়ানো সমেত এই বাড়ি খালি আছে জানলে তবেই আমরা দার্জিলিঙে আসি। প্রত্যেকবার। টেনিসটা আগে কখনো ভাবিনি, কাল ওর চোখে পড়ল তা-ই টেনিসের ইনসিডেন্টটা ঘটল আজ।

    বাবা, নোটন বলে, তোমরা কথা বল, আমি চা নিয়ে আসি।

    এটা-ওটা কথা বলতে বলতে একটা ট্রেতে টি-পট এবং চায়ের নানা সরঞ্জাম আর এক প্লেট বিস্কুট নিয়ে ঢোকে নোটন। চা তৈরি করে এক-একজনকে কাপ এগিয়ে দিতে দিতে কাজিকে বলে, বিস্কুট খাবেন তো?

    খাব।

    নোটন বলে, রোজ সকালে এখানে ঘুম থেকে উঠে পিয়ানো অভ্যেস করি। জিমখানা ক্লাবের ভদ্রলোক কাল আশা দিয়েছিলেন আজ টেনিস খেলার সুযোগ পাওয়া যাবে, তাই এক কাপ চা খেয়েই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। আপনি পিয়ানো বাজাবেন?

    বাজাইনি কখনো, বলে কাজি; পল্টনে ছিলুম যখন, আমাদের ব্যারাকে একটা অর্গ্যান ছিল। সেটা এক-আধবার বাজাবার চেষ্টা করেছি। আমার এক বন্ধু ছিল সে ভালো অর্গ্যান বাজাত, বলেছিল আমাকে শেখাবে। যুদ্ধ থেমে গেল, পল্টনও ভেঙে গেল। আমারও অর্গ্যানটা শেখাটা হল না। কিন্তু, এতটা এলুম, তুমি একটা কিছু বাজাও না ছোটখাটো।

    সে তো বাজাতে নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু ছোটখাটো বললেন কেন? ভাবছেন, ভালো বাজাব না?

    কাজির একবার মনে হল আজ যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করবার কথা আছে, এবং সেই কারণেই সে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে চায়, সেটা বলেই দেবে। কী ভেবে কিন্তু বিরত থাকল সে, কথাটা চাপাই থাক। বলল, আমি যখন বেরিয়েছি আজ সকালে, আমার বন্ধু যে আমার সঙ্গে আছে, ঘুমোচ্ছিল তখনও। সে ঘুম থেকে উঠে আমাকে দেখতে না-পেয়ে ভাবিত হবে একটু, অন্য একদল বন্ধুর সঙ্গে একটা প্রোগ্রাম আছে আজ। অথচ পিয়ানোর সামনে তোমাকে দেখেও না-শুনে চলে যাব, মন মানবে না। তাই কম্প্রোমাইজ। আজ ছোট একটা কিছু। যদি কাল সকাল থেকে জিমখানায় না যাও তাহলে প্রতি সকালেই কয়েক কাপ চায়ের সঙ্গে তোমার পিয়ানোবাদন শুনতে চাই। দার্জিলিঙে যে-কদিন আছি। এবং যতগুলো তোমার ইচ্ছে। অ্যাপ্রুভ্‌ড্‌?

    এবার কথা বলেন সুরেন্দ্রনাথ, মোস্ট ওয়েলকাম কাজিসাহেব, তবে এরই মধ্যে মাঝে-সাজে এক-আধ চাল দাবাও তো চলতে পারে।

    অবশ্যই চলতে পারে, বলে কাজি, তারপর নোটনের দিকে ফিরে বলে, এবার ধর।

    হিসেব-টিসেব করে দশটার একটু আগে যে-বাংলোতে রবীন্দ্রনাথ উঠেছেন সেখানে ওরা হাজির হল। কথায় কথায় পিংলা একবার বলেছিল, গুরুদেব চান-টান সেরে সকালের জলখাবারের পাট আটটার মধ্যেই সেরে ফেলেন। সেই হিসেবে, কাজি বলে, জলখাবার সেরে একটা কবিতা বা নিদেনপক্ষে একটা গান লেখারও সময় তো দেওয়া গেল, কী বল? এবার আমরা নিশ্চয়ই যেতে পারি।

    কবি সম্ভবত এতজন শিল্পী-সাহিত্যিকের একসঙ্গে দর্শনের জন্যে তৈরি ছিলেন না, কিন্তু খুশিই হলেন মনে হল। আগের থেকেই বলে রেখেছিল অখিল নিয়োগী, প্রথম প্রণামের সুযোগ তাকেই দিতে হবে, সে-ই বয়েসে সবার চাইতে ছোট। ওর চেয়েও ছোট একজন ছিল প্রবোধের নাটকের দলে, তাকে বোধ হয় হিসেবেই নিল না।

    হাসিমুখে সবায়েরই প্রণাম নিলেন রবীন্দ্রনাথ, তারপর বললেন, তোমরা এত দেরি করে এলে কেন? সকালের জলখাবার খেয়ে এসেছ? তারপরেই ঈষৎ গলা তোলেন, বৌমা ও বৌমা, দেখ এতগুলো ছেলে না-খেয়েই এসেছে নিশ্চয়ই, দেখ, কী খাওয়াতে পার ওদের।

    উচ্চকিত কণ্ঠ শুনে ঘরে ঢোকেন রথি এবং প্রতিমা, প্রতিমা বলেন, আমি আধ ঘন্টার মধ্যেই ব্যবস্থা করছি।

    কাজি উঠে দাঁড়ায়, বলে, গুরুদেব অযথাই উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। না বলে কয়ে আসছি, আমরা জলখাবার খেয়েই এসেছি। শুধু চা পেলেই আমাদের চলবে।

    শুধু একটাই আপত্তি, বলে ওঠে নীহারবালা, গুরুদেবও দেখছি মেয়েদের দেখতে পান না। বললেন, এতগুলো ছেলে না-খেয়েই এসেছে। আমি যে একটা মেয়েও এসেছি, গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করলুম, তবুও দেখতে পেলেন না!

    মনে হল কবি একটু অস্বস্তিতেই পড়েছেন; বললেন, রাগ কোরো না ভাই, দেখেছি। তোমাকে না-দেখে কি পারি? তু্মি এত নাম-করা অভিনেত্রী আর গায়িকা! তবে হ্যাঁ, তোমার অভিযোগটায় যে যথেষ্ট সারবত্তা আছে এ-ও আমি মানি, কিন্তু দোষটা সবটা আমার নয়। এ আমাদের ভাষার দোষ। বয়েসে ছোট হলে সবাই ছেলে। খুব কম বয়েসের কথা বলতে হলে আমরা ছেলেবেলা বলি, কই, মেয়েদের ক্ষেত্রে মেয়েবেলা তো বলি না। নাঃ, এর একটা সুরাহা করতেই হচ্ছে। তুমি একটা কাজ কর ভাই, একটা গান শুনিয়ে দাও আমাদের, গানে গানেই সব দুঃখ সবাই ভুলে যাক।

    আমি আপনার গানও সাহস করে একটু-আধটু গাই, তবে আপনার সামনে সে সাহস করব না। নজরুল সাহেবের গান গাই একটা, নজরুল সাহেব নিজেই আমাকে শিখিয়েছেন। ভুল-টুল কিছু হলে দায় উনিই নেবেন।

    একটু সোজা হয়ে বসে গলা খাঁকরি দিয়ে তৈরি হচ্ছে নীহারবালা, এমন সময় তাকে থামায় রথি, বলে, হারমোনিয়ম একটা আছে, নিয়ে আসব? বলেই ভেতরে চলে যায় সে, একটু পর একটা হারমোনিয়ম নিয়ে এসে বসিয়ে দেয় একেবারে নীহারবালার সামনে।

    চোখ বুজে গান ধরে নীহার:


                                    তিমির বিদারী অলখ বিহারী
                                                    কৃষ্ণ মুরারি আগত ঐ।
                                    টুটিল আগল নিখিল পাগল
                                                    সর্ব্বসহা আজি সর্ব্বজয়ী।।
                                    বহিছে উজান অশ্রু যমুনায়
                                    হৃদি-বৃন্দাবনে আনন্দ ডাকে যায়
                                    বসুধা-যশোদার স্নেহ-ধার উথলায়
                                                    কাল্‌ রাখাল নাচে থৈ তাথৈ।।
                                    বিশ্ব ভরি ওঠে স্তব নমো নমঃ
                                    অরির পুরীমাঝে এল অরিন্দম।

                                    ঘিরিয়া দ্বার বৃথা জাগে প্রহরীজন,
                                    কারার মাঝে এল বন্ধ বিমোচন,
                                    ধরি অজানাপথ আসিল অনাগত
                                    জাগিয়া ব্যথাহত ডাকে, মাভৈঃ।।


    গান শুনতে পেয়ে এক-এক করে ঘরের ভেতরে ঢুকে আসে মৈত্রেয়ী আর রানি-প্রশান্ত। রবীন্দ্রনাথ বলেন, এ-সব তো কারার ভেতরে ঘটছে, তাই বলে আমরাও কেন কারাবন্দী থাকি, বাইরের বাগানে গিয়ে বসলে কেমন হয়?

    সকলেই যখন উৎসাহের সঙ্গে বাগানে যাবার জন্যে প্রায়-প্রস্তুত, কবিই থামান সবাইকে, যাব তো বললুম বাগানে, কিন্তু গান-টান শুনে গোটা দার্জিলিং জেনে যাবে না তো, আর সেই থেকে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস? আর এই যে কিছুক্ষণ পর বৌমা তোমাদের জন্যে চায়ের সঙ্গে কিছু টা-ও নিশ্চয়ই নিয়ে আসবেন, সে খবরও কি চাপা থাকবে নাকি? আচ্ছা, নজরুলের দিকে চেয়ে বলেন কবি, এই যে আমি চুপচাপ দার্জিলিঙে এসে বসে আছি কাউকে না-জানিয়ে, তোমরা কীভাবে জানলে বল তো আমি এখানে? কাগজে পড়েছিলে?

    কাজির বদলে জবাব দেয় প্রবোধ। সে বলে, দার্জিলিঙে পৌঁছিয়েই একটা টেলিগ্রাম পেলুম এক বন্ধুর কাছ থেকে। সে লিখেছে, রবীন্দ্রনাথ এখন সপরিবার ছুটি কাটাচ্ছেন দার্জিলিঙে। খবর পেয়েছি। পার তো একটা প্রণাম করে এস।

    ওই তো, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, বলেন গুরুদেব। কলকাতায় খবর পাওনি, কিন্তু তোমরা কলকাতা ছাড়ার পরেই তোমার বন্ধু খবর পেয়ে গিয়েছে। সাধারণত কলকাতায় এ-সব খবর চাউর করে প্রশান্ত, তাই ওদের দুজনকে এবার সঙ্গে নিয়ে এলুম, তবুও আটকানো গেল না।

    কবির এই মন্তব্য শুনে সবাই হেসে ওঠে, প্রশান্ত-রানি সহ। কবি বলেন, নাঃ, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে আর সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না। আমরা ঘরেই থাকি। সেই আগের বার নজরুল শান্তিনিকেতনে এসেছিল শহীদুল্লাহ্‌ সাহেবের সঙ্গে। তখন শুনেছিলুম সারা রাস্তা ও রেলগাড়িতে সবাইকে গীতাঞ্জলির সব গান শোনাতে শোনাতে এসেছে। যখন শান্তিনিকেতনে পৌঁছল, তখন আমাদের কপালে তার ছিটে-ফোঁটাও জুটল না। আজ এখানে ওর গান শুনব।

    কাজি বলে, আমি তো তৈরিই আছি। তবে গীতাঞ্জলি নয়, আজ মায়ার খেলা।

    সবটাই? মুখস্থ আছে?

    মুখস্থ আছে গুরুদেব, গান তো মনে রাখা সহজ, কয়েকবার গাইলেই মুখস্থ হয়ে যায়। কিন্তু সবটাই গাইব না আজ, খান তিনেক গাই?

    গাও না গাও, যতগুলো তোমার ভালো লাগে, গাও।

    চোখ বুজে হারমোনিয়ম কিছুক্ষণ বাজায় কাজি, তারপর শুরু করে, ভালোবেসে যদি সুখ নাহি/ তবে কেন–/ তবে মিছে কেন ভালোবাসা।/ মন দিয়ে পেতে চাহি।/ ওগো কেন,/ ওগো কেন মিছে এ দুরাশা।/ হৃদয়ে জ্বালায়ে বাসনার শিখা,/ নয়নে সাজায়ে মায়ামরীচিকা,/ শুধু ঘুরে মরি মরুভূমে।/ওগো কেন,/ ওগো, কেন মিছে এ পিপাসা।/ আপনি যে আছে আপনার কাছে/ নিখিল জগতে কী অভাব আছে।/ আছে মন্দ সমীরণ, পুষ্পবিভূষণ,/ কোকিলকুঞ্জিত কুঞ্জ।/ বিশ্বচরাচর লুপ্ত হয়ে যায়,/ একি ঘোর প্রেম অন্ধ রাহুপ্রায়/ জীবন যৌবন গ্রাসে।/ তবে কেন–/ তবে কেন মিছে এ কুয়াশা।

    রবীন্দ্রনাথের মুখে মৃদু হাসি, দু'চোখ বোজা। কয়েক মুহূর্ত চোখ বুজেই রইলেন কবি, তারপর চোখ খুলে বললেন, ভারী ভালো গেয়েছ। আর, শুধু তাই নয়, অমর অশোক আর কুমার তিনজনের মনের কথা একই গানে – তিনজনেরই গান, সেই গান বেছে নিয়েছ তুমি। মায়ার খেলা শুরুটা যথাযথ হয়েছে, এবার দেখি কী গাও।

    কাজি কথা বলে না, মনে হয় তার ভাবাই ছিল; সে গায়,


                                    এ তো   খেলা নয়, খেলা নয়।
                                    এ যে    হৃদয়দহনজ্বালা সখী।
                                    এ যে    প্রাণভরা ব্যাকুলতা, গোপন মর্মের ব্যথা,
                                    এ যে    কাহার চরণোদ্দেশে জীবন মরণ ঢালা।
                                    কে যেন সতত মোরে    ডাকিয়ে আকুল করে,
                                    যাই যাই করে প্রাণ – যেতে পারি নে।
                                    যে কথা বলিতে চাহি    তা বুঝি বলিতে নাহি –
                                    কোথা যে নামায়ে রাখি    সখী,    এ প্রেমের ডালা।
                                    যতনে গাঁথিয়ে শেষে    পরাতে পারি নে মালা।


    গুরুদেব হাসেন, এরপর কী গাইবি শুনি। কাজি ধরে: এরা  সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না।/ শুধু সুখ চলে যায়।/ এমনি মায়ার ছলনা।/ এরা  ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়।/ তাই কেঁদে কাটে নিশি, তাই দহে প্রাণ,/ তাই মান অভিমান।/ তাই এত হায় হায়।/ প্রেমে সুখ দুখ ভুলে তবে সুখ পায়।/ সখী চলো, গেল নিশি স্বপন ফুরাল,/ মিছে আর কেন বল।/ শশী  ঘুমের কুহক নিয়ে গেল অস্তাচল।/ সখী, চলো।/ প্রেমের কাহিনী গান  হয়ে গেল অবসান।/এখন  কেহ হাসে, কেহ বসে ফেলে অশ্রুজল।

    বাঃ, চোখ খুলে কবি বলেন, তুই তো তিনখানা মাত্র গানে মায়ার খেলার সবটাই বলে দিলি, চমৎকার! মায়াকুমারীদের সঙ্গে তোর তো আলাপ আছে মনে হল।

    আলাপ হয়ে গেল গুরুদেব, কয়েকবার পড়তে পড়তে গাইতে গাইতে আলাপ হয়ে গেল। তবে আমি ওদের মায়াকুমারী নামে ডাকি না, আমি বলি আলেয়ার আলো।

    এতজন গান শুনছিল, প্রতিমা সেখানে ছিলেন না। এবার তিনি আসেন, বলেন, আপনাদের সবাইকে একটু ভেতরে আসতে হবে। সামান্য জলযোগের আয়োজন করেছি।

    মৈত্রেয়ী আর রথির পেছন পেছন সবাই যখন প্রবেশ করে ভেতরে, আসন পেতে খাবার তখন বেড়ে দিচ্ছেন প্রতিমা। কাজি দেখে বলে, পরোটা নাকি?

    পরোটা আপনার মনে হতেই পারে দেখে, তবে গুজরাতিরা একে বলে বেসনের রুটি, বলেন প্রতিমা।

    ততক্ষণে সবাই বসে পড়েছে। একটা টুকরো হাতে নিয়ে মন্মথ বলেন, রুটি? কিন্তু ঘিয়ে ভাজা মনে হচ্ছে।

    ঠিক ভাজা নয়, তবে ছোঁয়াচ আছে, বলেন রানি। আসলে, যাকে বলে শুকনো রুটি তা বাঙালিরাই খায়। উত্তর বা পশ্চিম ভারতে রুটিতেও একটু ঘিয়ের ছোঁয়াচ থাকে। কেউ গরম রুটিতে – ওরা ফুলকা বলে – এক পিঠে ঘি মাখিয়ে খায়, কেউ আটা মাখবার সময়েই খানিকটা ঘি দিয়ে দেয়। এটা তো বেসনের রুটি, আটার মতো ফুলবে না, তাই একটু ঘি মাখিয়ে সুদর্শন আর সুস্বাদু – দুটোই করা হয়।

    দার্জিলিঙের বাজারে বোধ হয় কড়াইশুঁটি এখনই পাওয়া যাচ্ছে। কড়াইশুঁটি আর স্কোয়াশ দিয়ে একটু টক-মিষ্টি তরকারি রেঁধেছিলেন প্রতিমা, চেয়েচিন্তে অনেকটাই খেল সবাই।

    চা-পানের সময় কবি বলেন, জাহানারার সঙ্গে দেখা হয়েছে তোমাদের?

    জাহানারা? এ ওর মুখের দিকে চায়। কাজি বলে, বর্ষবাণীর সম্পাদিকা?

    ঠিক ধরেছ, বর্ষবাণী। ও কোথা থেকে খবর পেয়েছে জানিনা, যেদিন আমরা এসেছি, তার পরের দিনই দেখা করে গেল। বলল, ওদের একটা বাড়ি আছে দার্জিলিঙে, আবার এলে আমাকে ওখানেই উঠতে হবে।

    একটু অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রথি। সে বেশ কয়েকবার ভেতরে গেছে, আবার এই ঘরে এসেছে। ঘড়ি দেখেছে মাঝে মাঝে। এবার জাহানারাকে নিয়ে আলোচনা আর এগোতে না দিয়ে একটু অসহায় মুখ করে সে বাবাকে বলে, বারটা কিন্তু বেজে গেছে, সোয়া বারটা প্রায়।

    কাজি বলে, আমরা এগোই গুরুদেব। আপনার খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। যদি সময় পাই আর একবার এসে প্রণাম করে যাব।

    বেসনের রুটি খাবার পর দুপুরে আর কিছু খেতে হল না ওদের। প্রবোধের অনুরোধে সবাই মিলে প্রবোধরা যেখানে আছে সেখানেই গেল। গল্প-গুজবে আর গান গেয়েই কেটে গেল ঘন্টার পর ঘন্টা। কাজি থামে তো ধরে নীহার। তার পর আবার কাজি। এ ছাড়াও হাস্যকৌতুক, নানা নাটকের ছোট ছোট দৃশ্য, ভ্যারাইটি এন্টারটেনমেন্ট যাকে বলে!

    ওদের দার্জিলিঙে আসার উদ্দেশ্যটা রাত্তিরে একবার মনোরঞ্জন মনে করিয়ে দেয় কাজিকে। কাজি বলে, আপনি কিছু ভাববেন না মনোরঞ্জনদা, কাল থেকে একেবারে রুটিনমাফিক চলা। সকালে ঘুম থেকে উঠে একটু বেড়িয়ে আসব। ততক্ষণে আপনি ঘুম ভেঙে রেডি হয়ে নেবেন, আমি ফিরে এসে বসে যাব লিখতে। আপনি এর মধ্যে আমাদের বিশ্বকর্মাকে নিয়ে বাজার-টাজার সেরে আসবেন। দুপুরে খাওয়ার পর বিশ্রাম একটু, তারপর বিকেলে একটু বেড়ানো, ফিরে এসে আবার লিখতে বসা। তারপর খাওয়া এবং ঘুম।

    হেসে ফেলে মনোরঞ্জন। অতটা ভালো ছেলে আপনাকে আমি হতে বলিনি কাজিসাহেব। আপনার এতগুলো বন্ধু একই সঙ্গে আছে দার্জিলিঙে; তাদের সঙ্গে আড্ডা হবে না একটুও, গান-বাজনা বন্ধ থাকবে, এসব আমি বলিনি, চাইও না। সবই হোক, কিন্তু একটু একটু করে লেখার কাজটাও চলতে থাকুক। তাহলেই দেখবেন, আপনার মূড এসে যাবে, লেখাও দিব্যি এগোবে।

    যেমন কথা, তেমনই কাজ। পরের দিন সকালে বেড়িয়ে ফিরে এসে টেবিল-চেয়ারে বসে কাজি। তার চা এবং জলখাবার ওই টেবিলেই খায় সে। চা খায় বার চারেক, কিন্তু টেবিল-চেয়ার ছেড়ে নড়ে না। দুপুরে মুরগীর রোস্ট রান্না করেছিল বিশ্বকর্মা, কাজি চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল; কোন কথাবার্তা নয়, গভীর ভাবে কিছু চিন্তা করছে মনে হল, আবার বসল লিখতে। তিনটে নাগাদ যখন চা দেওয়া হল, চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উঠল কাজি; মনোরঞ্জন শুয়ে ছিল, তার কাছে গিয়ে বলল, কতটা লিখলুম দেখে আসুন।

    মনোরঞ্জন এসে দেখে একটা খোলা খাতা, মাঝখানে কাজির ফাউন্টেন-পেনটা ঢাকনা খোলা অবস্থায় রাখা। দু-তিনটে লাইন লেখা হয়েছে একটা কাগজে, তারপর কেটে দেওয়া হয়েছে সেগুলো। দু-দিকের মার্জিনে ছোট ছোট অজস্র ছবির মতো: গাছ, পাহাড়, রেলগাড়ির ইঞ্জিন, কোন মহিলার মুখের আদল, একটা মাছের মুড়োর ছবি, এবং আরো কত কী!

    এটা কেমন হল? – বলে মনোরঞ্জন।

    এমনই, কাজি বলে, লেখা আসছে না।

    আসছে না তো আসছে না, মনোরঞ্জন বলে, যখন আসবে আপনিই আসবে। চা-টা শেষ করে চলুন ঘুরে আসি।

    হাঁটতে হাঁটতে মনোরঞ্জন বলে, আপনি কখনও এইভাবে চেয়ার-টেবিলে বসে লিখেছেন কিছু?

    হুঁ, ইশকুলের পরীক্ষার সময় লিখেছি তো।

    সে লেখা ছাড়ুন, আপনার কবিতা গান গল্প, এসব?

    এসব লিখি যখন লেখায় পায়। আর পায় যখন, তখন কোথায় আছি, কীভাবে আছি, তা কেয়ার করি না। হাতের সামনে যা পাই তাতেই লিখি। চেয়ার-টেবিলে বসে সম্পাদনা করা যায়, লেখাগুলো ঠিকঠাক করা যায়, কিন্তু লেখার বেগটা না এলে কিছু হবে বলে মনে হয় না।

    দেখুন কাজিসাহেব, আপনি ভুলে যান আমি আপনার মাথার ওপর বসে আছি, চাপ দিচ্ছি আপনাকে। আপনাকে লেখবার জন্যে কোন রুটিন তৈরি করতে হবে না। ওই যে আপনি বললেন বেগ, ওটা আসতে দিন। এ-যাত্রায় দার্জিলিঙে যদি না-ও আসে, কোন ক্ষতি নেই। পরে হয়ে যাবে।

    কাজি হাত চেপে ধরে মনোরঞ্জনের। নীরবে। মনোরঞ্জন হাসে। সে-ও কথা বলে না। হাঁটতে হাঁটতে অখিলরা যেখানে আছে পৌঁছিয়ে যায় ওরা।

    বেশ রাত হয়ে যায় ওদের ফিরতে ফিরতে। এসে দেখে, সাহেবি পোশাক-পরা এক যুবক অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে। ওদের দেখেই উঠে দাঁড়ায় যুবক, বলে, আদাব।

    আদাব, বলে কাজি। আপনি?

    আমার নাম আলতাফ, আলতাফ চৌধুরি।

    সে তো বুঝলাম, কিন্তু আপনি কখন এসেছেন, কতক্ষণ অপেক্ষা করছেন? এলেন কোথা থেকে? – এতগুলো কথা বলে উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করে না কাজি, বিশ্বকর্মাকে বলে, চা খাইয়েছিলি ভদ্রলোককে?

    আলতাফ নিজেই বলে ওঠে, চা খাইয়েছে, খাইয়েছে ওমলেটও।

    বেশ, বলে কাজি, আদাব যখন বললেন, বোঝা গেল আপনি আমারই কাছে এসেছেন। আমারই নাম কাজি নজরুল ইসলাম – আর, মনোরঞ্জনকে দেখিয়ে বলে – ইনি মনোরঞ্জন চক্রবর্তী, আমার বন্ধু।

    আপা পাঠিয়ে দিল আপনাদের ধরে নিয়ে যাবার জন্যে, বলল, বসে থাকবি যতক্ষণ না দেখা হয়।

    আপা বলল? কে আপনার আপা?

    জাহানারা চৌধুরি। আমরা ক'দিন আগেই এসেছি দার্জিলিঙে। আপনাদের আসবার খবর আজই পেয়েছে আপা।

    আর আমরা আছি কোথায় সে খবর পেলেন কোনখানে?

    আমি তো তা বলতে পারছি না। আমাকে বললেন, এখ্‌খুনি যা, ধরে নিয়ে আসবি। যদি গিয়ে না পাস, অপেক্ষা করবি।

    এ-ও দেখুন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস কিনা, প্রায় ফিসফিস করে বলে মনোরঞ্জন; কাজি মৃদু হাসে, কথা বলে না। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ, বোধ হয় রহস্য-ভেদের চেষ্টা করছে কোথা থেকে জাহানারা খবর পেল।

    মনোরঞ্জনই বলে তখন, ধরে যে নিয়ে যাবেন, কোথায়? থানায়? আপনাকে দেখে তো ঠিক পুলিশ মনে হচ্ছে না।

    না না, থানা-ফানা নয়, সঙ্কোচের হাসি হাসে যুবক, আমাদের বাড়ির কথা বলছি।

    বাড়িটা কোথায়? – নজরুলের প্রশ্ন।

    একটু দূর, বলে যুবক, স্টেশনের কাছে। দার্জিলিং স্টেশনের প্রায় উল্টোদিকেই রাস্তার বাঁ-দিক থেকে আর একটা রাস্তা নেমে গেছে, সেটা দিয়ে খানিকটা এগোলেই বর্ধমান মহারাজার প্যালেস, প্যালেসের ঠিক পাশেই আমাদের বাড়ি।

    নজরুল বলে, ঠিক আছে, জানা রইল। আজ এখন অনেক রাত হয়ে গেছে। কাল আমরা নিজেরাই পৌঁছিয়ে যাব। সকালে। আপাকে বলে দেবেন, আপনাকে পাঠাবার আর দরকার নেই। আমরা বুঝে গেছি, নিজেরাই যেতে পারব।

    আপা সে-কথা শুনলে তো, বেরোতে বেরোতে বলে যুবক, আমিই আসব সকাল দশটা নাগাদ, আপনারা একটু তৈরি হয়ে থাকবেন প্লীজ।

    জাহানারাকে চেনেন আপনি? – যুবক বেরিয়ে গেলে প্রশ্ন করে কাজি মনোরঞ্জনকে।

    নাঃ, চিনি বলা যায় না, তবে তবে..., একটু ইতস্তত করে বলে, নাম শুনেছি। আমাদের নলিনীদার কাছে। কাল আবার শুনলাম রবীন্দ্রনাথের মুখে। ওপর-মহলের লোক বোঝা যাচ্ছে, খবর কেউ না-দিলেও ঠিক খবর পেয়ে যান; রবীন্দ্রনাথের, নজরুলেরও।

    প্রকাশন জগতের মানুষ, নজরুল বিস্ময় দেখায়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী জাহানারাকে চোখে দেখেননি! বলেন কী! গল্প লেখেন, সেই গল্প ছাপানোর জন্যে কোন পত্রিকার সম্পাদককে ধরাধরি করেন না, নিজেরই পত্রিকা আছে। অসাধারণ সুন্দরী সে তো বললুমই, ধনীর দুলালী; মালদা থেকে বাংলার সমস্ত উত্তর দিক হয়ে পশ্চিমে বিহারের মিথিলা পর্যন্ত যে ভূমি, তার প্রধানতম জমিদার বংশ – জমিদার না বলে রাজবংশই বলা উচিত – তার সন্তান। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে হাল আমলের কল্লোলের লেখকগোষ্ঠীর অনেক লেখকের সঙ্গেই এঁর যোগাযোগ। সাধারণত থাকেন কলকাতায়। আপনার মতো আমিও চিনতুম না গত বছর পর্যন্ত। ওই নলিনীদা, যাঁর কথা আপনিও বললেন – গায়ক-লেখক নলিনীকান্ত সরকার – আমাকে একদিন নিয়ে গেলেন ওঁর কলকাতার বাড়িতে। আলাপ হল। অসাধারণ আতিথেয়তা, কিন্তু সাহস করে একা-একা আর যেতে পারিনি। নলিনীদার কাছে শুনেছি, যখন পত্রিকা শুরু করেন, রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিলেন নামকরণের জন্যে। কবি নাম দিলেন রূপরেখা। পরে অবিশ্যি নামটা বদলিয়ে বর্ষবাণী করে দিতে হয়েছিল; রূপ-রেখা নামে সিনেমার এক পত্রিকা নাকি বেরোতো বলে খবর পাওয়া গিয়েছিল।

    পরের দিন সন্ধ্যেবেলা যখন গাড়ির প্রস্তাব বহু চেষ্টায় প্রত্যাখ্যান করে হাঁটতে হাঁটতে জাহানারার বাড়ি থেকে নিজেদের ডেরায় ফিরছিল কাজি আর মনোরঞ্জন, মনোরঞ্জন বলল, আজ সকালে যখন আপনি আমাকে যেতে বলছিলেন আপনার সঙ্গে, আমি আপত্তি করছিলুম। কাল থেকে আপনি না-নিয়ে যেতে চাইলেও আমি জোর করে যাব আপনার সঙ্গে।

    মজে গেলেন নাকি? – জিজ্ঞেস করে কাজি।

    আমি যদি মজতে চাইও সেটা বিফল-মজা হবে। মহিলা তো বোঝা গেল কাজিতেই মজে আছেন। আপনার বাড়িতে যেদিন দার্জিলিঙের প্রস্তাব নিয়ে প্রথম কথা হল, বৌদি নিজে আসতে রাজি না হয়ে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন আপনার মাথার ওপরে থাকতে। মাথার ওপরে, মনে আছে? তার মানে, দার্জিলিঙে আপনার অভিভাবক হয়ে থাকতে নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি। আজ মনে হচ্ছে, এই নির্দেশের প্রয়োজন ছিল। মহিলাকে যা দেখলাম, আমি না থাকলে আপনাকে উনি ওখানেই রেখে দিতেন, ফিরে আসতে দিতেন না।

    হো হো করে হেসে ওঠে কাজি, দে গোরুর গা ধুইয়ে! – তারপর বলতে থাকে, আপনি-আমি যতই মজি না কেন, উনি তো মজে আছেন স্বয়ং গুরুদেব রবীন্দ্রনাথে, কাজেই আপনার-আমার, কারোরই সুবিধে হবে না। ভাইকে পাঠিয়ে ডেকে নিয়ে গেলেন আমাদের, গুরুদেবের বাংলোয় কিন্তু নিজে গিয়েছিলেন। গিয়ে, পরের বার থেকে দার্জিলিঙে এলে ওঁর বাড়িতে থাকবার নিমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছেন। বাড়িতে ওই রবীন্দ্রনাথের ছবি এবং সইসহ দুটো লাইন বাঁধানো দেখলেন? গত বছর আমি যখন নলিনীদার সঙ্গে কলকাতায় ওঁর বাড়িতে যাই, ওই ছবিখানা দেখেছিলুম। এবার দার্জিলিঙে আসবার সময় ছবিখানা খুলে নিয়ে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথকে দেখতে না পেলে এক মুহূর্তও ওঁর চলে না, বুঝলেন? কাজেই আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

    পরের দিন সকালে নজরুল গেল না নোটনের পিয়ানো শুনতে। মনোরঞ্জনকে বলল, চলুন, আলতাফ আসার আগেই আমরা পৌঁছিয়ে যাই। কালকের মতো গাড়ি নিয়ে আলতাফ আসবে, পাঁচজন চেয়ে চেয়ে দেখবে, ও আমার ভালো লাগে না।

    তাই বলে সকালের বেড়ানোটাও বন্ধ করবেন? ওই জাহানারা মেমসাহেবের বাড়ি গেলে তো সারাদিনই বসে কাটানো। দার্জিলিঙে কি সারাদিন বসে থাকবার জন্যেই এলাম?

    সেটা ঠিকই বলেছেন, বলে কাজি। আজ যাব কথা দিয়ে এসেছি, চলুন যাই; কাল থেকে আর নয়।

    আগের দিন আলতাফ গাড়ি নিয়ে এসেছিল সকাল সাড়ে ন'টায়। ওরা পৌঁছিয়ে ছিল পৌনে দশটা নাগাদ। আজ সাড়ে আটটায় পৌঁছল ওরা, জাহানারা কিন্তু অবাক হল না একটুও। ওদের বসিয়ে একটা অটোগ্রাফের খাতা খুলে নিয়ে এল মনোরঞ্জনের কাছে, বলল, আপনার একটা অটোগ্রাফ চাই।

    আমার? – প্রায় আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর মনোরঞ্জনের।

    হ্যাঁ, আপনারই। কেন, দিতে নেই?

    না না, একেবারেই দিতে নেই। আমি কে, যে আমার অটোগ্রাফ?– বলে মনোরঞ্জন – আপনার খাতায় সব বড় বড় বিখ্যাত লোকের অটোগ্রাফ, তার মধ্যে আমার অটোগ্রাফ থাকতে পারে নাকি?

    কে বলল থাকতে পারে না? আপনি এত বড় পাবলিশার, শুধু যে কাজি সাহেবের বই ছাপেন তা তো নয়, অন্য আরও কত লেখকের বই ছাপেন আপনি। প্রতিটি বইয়েই প্রকাশক হিসেবে আপনার নাম ছাপা হয়। তার মানে আপনার যে-কোন একজন লেখকের তুলনায় আপনার একার নাম ছাপা হয় অনেক বেশি বার। তবুও যদি বলেন আপনি বিখ্যাত ন'ন, তাই সই দেবেন না, তাহলে এই আমি রাখলাম কলমটা। জলখাবার এখনই আসছে আপনাদের জন্যে, আমারটা আমি বারণ করে আসছি। আমার কাজ নেই খেয়ে।

    মানে? এ তো প্রায় ব্ল্যাকমেল, অস্বস্তিতে বলে মনোরঞ্জন, তারপর কলমটা তুলে খাতাটার খোলা পাতায় সই করে দেয়।

    থ্যাঙ্ক্যু, মিষ্টি হেসে বলে জাহানারা, তারপর কাজির কাছে খাতাটা নিয়ে গিয়ে বলে, আপনার জন্যে কিন্তু শুধু সই নয়, একটা গান চাই – অপ্রকাশিত এবং অপ্রকাশ্য – শুধু আমার এই অটোগ্রাফ খাতার জন্যেই। তার নীচে সই।

    কাজি হাসে, সে তো জানাই ছিল, বলে সে, রাখুন খাতাখানা এখানে, দেখি লিখতে যদি পারি, মূড যদি আসে...

    জাহানারা কথা বলে না, একটা চাকা-লাগানো টেবিল ঠেলে জলখাবারের রাশিকৃত খাদ্য এবং পেয়ালা-পিরিচ-জলের গেলাস নিয়ে ঢোকে একজন, পেছনে আলতাফ। লোকটা সাজিয়ে দেয় চারজনের জলখাবার।

    দেয়ালে টাঙানো ছবিটা, যেটার কথা কাল বলছিল কাজি, খেতে খেতে সেটা দেখিয়ে মনোরঞ্জন বলে জাহানারাকে, এই যে ছবিটা, রবীন্দ্রনাথের বাণী আর সই আর তাঁর নিজের ছবি, নলিনীদার কাছে শুনেছি এইরকম একটা ছবি আপনার কলকাতার বাড়িতে আছে। এটা কি সেটাই? নিয়ে এসেছেন?

    ওটা কিন্তু বাণী নয়, বলে জাহানারা, আমার যে পত্রিকা আছে, তার প্রথম সংখ্যায় গুরুদেব একটা কবিতা লিখে দিয়েছিলেন, মূল্যশোধ নাম – তখন পত্রিকার নাম ছিল রূপরেখা – গুরুদেবেরই দেওয়া। বাণী যেটাকে মনে করছেন ওটা আসলে সেই কবিতারই একটা অংশ, ভালো করে দেখুন, পড়তে পারবেন।

    মনোরঞ্জন তাকিয়ে থাকে ছবিটার দিকে, জাহানারা পড়ে যায়:


                                            তোমার কালো চুলের বন্যায়
                                            আমার দুই পা ঢেকে দিয়ে বলেছিলে
                                                    তুমি আমার রাজা,
                                                    তোমাকে যা দিই –
                                            তোমার রাজকর যে তার চেয়ে অনেক বেশি।
                                            আরো দেওয়া হল না
                                            কেননা, আমার যে আর নেই...


    পড়া হলে জাহানারা বলে চলে, কবিতার এই অংশের ঠিক নীচে যে লাইনটা আছে, সেটা কিন্তু এই কবিতার অংশ নয়। এটা গুরুদেবের একটা চিঠির ছোট্ট একটা অংশ। আমার একটা চিঠির জবাবে কবি লিখেছিলেন, পড়ুন না:

    সেদিন তোমার কথা শুনে বড় আনন্দ পেয়েছি,... সেদিন তোমার কাছ থেকে আমি যেন সমস্ত বাংলাদেশের মেয়েদের হাতের অর্ঘ্য পেয়েছি।

    জাহানারা বলে চলে, ওই কবিতাটা আর ওই চিঠিখানা আমি কয়েকদিন আমার সঙ্গে রেখেছি, ঘুমোতে গেছি যখন তখনও বিছানায় আমার পাশে রেখেছি। তারপর একদিন এক শিল্পীকে ডেকে এই অংশদুটো ঠিক কবির হাতের লেখার মতো করে লেখালাম। পাশে কবির একটা ছবি, আর তার নীচে ওঁর হস্তাক্ষর। শিল্পীকে বললাম, ঠিক এরকম ভাবে তিনখানা আমাকে তৈরি করে দিন। তৈরি হয়ে গেলে ওগুলোকে ফ্রেমবন্দী করা হল। আমার তিনটে বাসস্থান। একটা মালদা, একটা কলকাতা, আর একটা দার্জিলিং। তিনটেতেই একটা করে টাঙিয়ে দিলাম। খুলে নিয়ে যাবার প্রয়োজন আর হল না। আমি যেখানেই থাকি না কেন, কবির আশীর্বচন সঙ্গে নিয়ে ঘুরি।

    আগের দিন কাজির সঙ্গে এসে মনোরঞ্জন প্রায় সারাদিনই চুপচাপ ছিল, আজ কিন্তু জাহানারার সঙ্গে ওর সম্পর্ক অনেক সহজ হয়ে এসেছে, অনেক গল্প করছে ওরা। এমনকি একবার মালদায় গিয়ে আম খাবার ইচ্ছেও প্রকাশ করল সে। আফশোষের সুরে জাহানারা বলে, এহে, একটু দেরি হয়ে গেল; আপনার সঙ্গে কয়েকদিন আগে যদি আলাপ হত তাহলে এবারের দার্জিলিঙের প্রোগ্রামটা পিছিয়ে দিয়ে আগস্টের পরে করা যেত। আগস্ট পর্যন্ত ল্যাংড়া আর মালদার নিজস্ব আম ফজলি, দুটোই প্রচুর পাওয়া যায়। ঠিক আছে, সামনের বছর হবে; তবে আপনার কলকাতার ঠিকানা যদি দিয়ে দেন তাহলে আমসত্ত্ব এবারেও পাঠাতে পারি।

    কাজির গান লেখা এখনও শুরু হয়নি। সে উসখুস করছে। একবার বাইরের বাগান থেকে ঘুরে এল। জাহানারা বলে, কয়েকটা পান সাজতে বলব? আর চা একপট?

    কাজি হাসে। আবার একবার বেরোয়, তারপর ফিরে এসে খাতাখানা টেনে নিয়ে লিখতে থাকে,


                            এলে কি     স্বপন মায়া      আবার আমায়    গান গাওয়াতে
                            নিদাঘের     দগ্ধ জ্বালা       করলে শীতল    পুব-হাওয়াতে।।
                            ছিল যে      পাষাণ-চাপা     আমার গানের     উৎস-মুখে
                            তারে আজ   মুক্তি দিলে      ওই রাঙা         চরণঘাতে।।
                            এলে কি     বর্ষারানী         নিরশ্রু মোর      নয়ন-লোকে
                            বহালে       আবার সুরের    সুরধুনী           বেদনাতে।।
                            এসেছে       ঘূর্ণি হাওয়া     হয়তো বা ভুল     এক নিমেষের
                            এসেছে       সঙ্গে নিয়ে      বজ্রভরা           ঝঞ্ঝারাতে।।
                            তবু ওই      ভুল যে প্রিয়     ফুল ফুটাল        শুষ্ক শাখে।
                            আকাশের     তপ্ত নয়ন        জুড়িয়ে গেল      ওই চাওয়াতে।।
                            তোমার ওই    সোনার হাতের  সোনার চুড়ির     তালে তালে
                            নাচে মোর     গানের শিখী     মনের গহন       মেঘলা রাতে।।


    পছন্দ? – জিজ্ঞেস করে কাজি, নীচে সই করে, তারিখ দেয় ২০শে জুন, ১৯৩১।

    উঁহুঁ, জবাব দেয় জাহানারা, গান তো, সুর কোথায়?

    সুর তো গলায় হবে, দেখতেই পাচ্ছেন গজল নজরুলী, ও সুর তো সবারই জানা।
    তাই বুঝি? হেসে ফেলে জাহানারা; বলে, সত্যি বলছি, আপনি না খুব ভালো, আমার চেয়েও।



    ক্রমশ...

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৫৯৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মধুশ্রী | 117.217.***.*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:৩১523814
  • বেশ ভালো লাগছে। লেখককে ধন্যবাদ। পরের পর্বগুলির জন্য অপেক্ষা করে আছি।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন