দিন চারেক সওগাতের অফিসে শুয়ে থাকবার পরও অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি। মোহম্মদ নাসিরুদ্দিন ছিলেন না কলকাতায়, কাজিই প্রস্তাব দিল সে কৃষ্ণনগরে ফিরে যাবে। কাজিকে একা ছাড়তে সাহস পেল না ওখানকার কর্মচারীরা। একজন কৃষ্ণনগর অবধি সঙ্গে এসে পৌঁছিয়ে দিয়ে গেল তাকে।
এই চারদিন দুলি আর গিরিবালার কীভাবে কেটেছে খোঁজ নিয়েছিল কি কাজি? আর নিয়েই বা কী সে করতে পারত! তখনো তার গায়ে জ্বর। প্রবল জ্বর। ডাক্তারবাবুকে একবার খবর দিতে পারলে ভালো হত, মনে মনে ভাবে দুলি; কিন্তু ডাক্তারের বাড়ি সে চেনে না। গোলাপটিতে রোজই পাড়ার ছেলেরা আসত, প্রয়োজন পড়লে তাদেরই কেউ-না-কেউ বেরিয়ে খুচরো কাজ থাকলে করে দিত নিজের থেকেই, এখানে এসে অবধি সে আড্ডাও নেই, ছেলেরাও সব কোথায় গেছে কে জানে! কিন্তু ডাক্তার না দেখিয়ে বিনা-চিকিৎসায় আর ফেলে রাখতে চায়না দুলি।
অবশেষে গিরিবালা নিজেই বেরোলেন। একে-ওকে জিজ্ঞাসা করে ঠিকই পৌঁছিয়ে গেলেন ডক্টর জে-এন দে-র ডাক্তারখানায়। সব শুনে ডাক্তার বললেন এক ঘন্টার মধ্যেই তিনি আসবেন; সঙ্গে একটা ছেলেকে দিয়ে গিরিবালাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন তিনি।
ভালো করে কাজিকে পরীক্ষা করার পর দুলিকে বলেন ডাক্তার, একটু জল ফোটাতে হবে মা, তোমাদের কি একটা স্টোভ-টোভ কিছু আছে? দুলি ঘাড় নাড়ায়, নেই।
তাহলে একটা সসপ্যান বা ছোট ডেকচি-ফেকচি কিছু লাগবে, বলেন ডাক্তার, বিশেষ কিছু না; একটা ছুঁচ গরম জলে ফোটাতে হবে। ফোটাতে হবে, শুধু গরম করা নয়, বুঝলে তো? – বলে দুলির হাতে একটা ছুঁচ দেন ডাক্তার।
একটু পর, ফুটন্ত জলের মধ্যে ডোবানো ছুঁচটা সমেত একটা ডেকচি গরম কাপড়ে ধরে নিয়ে আসে দুলি। ডাক্তার তাঁর ব্যাগ থেকে বের করেন একজোড়া নতুন গ্লাভ্স্। পরেন সে দুটো, তারপর একটা ইঞ্জেকশন দেন কাজিকে। আর তার পরেই হঠাৎ বেদম ধমক লাগান তাকে, লজ্জা করে না আপনার, এতদিন ধরে বারবার জ্বরে পড়েও আমাকে জানাননি, আর এইটুকু মেয়েটাকে ফেলে রেখে হিল্লীদিল্লী করে বেড়াচ্ছেন! আপনাকে না আমি রিপিট ডোজের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম? একটা ওষুধও খাননি! আত্মহত্যা করতে চান তো আমাকে বললে আমিই বাৎলে দিতাম রাস্তাটা।
কাজি অসহায় মুখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ডাক্তারের মুখের দিকে। দুলির দিকে ফিরে ডাক্তার বলেন, একটা ছেলে এসে আজ বিকেলে ওষুধ দিয়ে যাবে। একটা শিশিতে, আর একটা পাউডার। দশটা করে ডোজ, আজ দুটো করে, কাল-পরশু তিনটে করে, আর তার পরের দিন আবার দুটো করে। ভালো হয়ে যাবে। কাল থেকে পর পর চার দিন সকালে আসবে ওই ছেলেটাই, ইঞ্জেকশন দিতে, আজকের মতোই জল ফুটিয়ে দিও। কোন আলাদা পথ্য নয়, যা মুখে ভালো লাগে তা-ই খাবে।
ব্যাগ গোছাতে গোছাতে এবার ডাক্তার বলেন, ভালো হয়ে যাবার পর আমি আবার আসব, কী ভাবে চলতে হবে, কী ওষুধ কবে খেতে হবে, আমার চেম্বারে আবার দেখাতে যেতে হবে কখন কবে, সব আমি তোমাকে বুঝিয়ে দিয়ে যাব। বলেই, কাজির দিকে তাকিয়ে ডান হাতের তর্জনীটা তুলে বললেন, ও যা বলবে অক্ষরে অক্ষরে শুনবেন, বোঝা গেল? এবার দুলির দিকে আবার তাকিয়ে বলেন, আর শোন, চিকিৎসার খরচ নিয়ে ভাবতে হবে না তোমায়। যা যা আমি বলছি, ঠিক ঠিক মত হওয়া চাই। আমার টাকা আমি এই লোকটার গলায় গামছা দিয়ে পরে আদায় করে নেব। বেরোবার জন্যে ডাক্তার উঠে দাঁড়ান, তাঁকে হতচকিত করে হঠাৎ এগিয়ে এসে দুলি তাঁকে প্রণাম করে পায়ের ধুলো নেয়। এই রে, বলেন ডাক্তার, ঠিক বেরোবার মুখে বাধা দিলে তো মা, বলে, দুলির মাথায় একবার হাতটা রেখে বেরিয়ে যান তিনি। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যায় দুলি, কথা বলে না।
দ্বিতীয় ইঞ্জেকশনের পরেই জ্বরটা কমতে শুরু করে, ঠিক তৃতীয় দিনের রাত থেকে জ্বর উধাও। গরম দুধ আর পাঁউরুটি ছাড়া আর কিছু খেতে ভালো লাগে না কাজির, এই কদিন সে তাই খেয়েই আছে। আজ সকালে জ্বর আর নেই, থার্মোমিটার মুখে দিয়ে দুলি দেখে নিয়েছে। এখন সে বলে, মাছওয়ালা এসেছিল, গোটাকয়েক কই মাছ দিয়ে গেছে, লাফাচ্ছে। বেশ বড় বড় মাছ, সর্ষে-বাটা দিয়ে রাঁধব? খাবে?
ভাত দিয়ে খাওয়া, না মাছও পাঁউরুটি দিয়ে? – জিজ্ঞেস করে কাজি।
তুমি যা চাও, বলে দুলি, ডাক্তারবাবু তো কিছুই বারণ করেননি; এ-ক'দিন তুমিই পাঁউরুটি চাইছিলে দুধের সঙ্গে তাই পাঁউরুটি দিচ্ছিলাম, আজ ভাত চাইলে ভাতই দেব।
তাহলে দিও, ভাত খাব আজ।
দুপুরে তৃপ্তি করে কই মাছ দিয়ে ভাত খায় কাজি। মাছটা শেষ হলে বলে, ভারী ভালো মাছ। আর আছে?
দুলি বলে, আর বেশি না হয় না-ই খেলে আজ, সকালে সবে জ্বর ছাড়ল, শরীর এখনো দুর্বল...
ডাক্তার তো বলেই গেল, দুলিকে বাধা দিয়ে বিরক্ত গলায় বলে কাজি, যা মুখে ভালো লাগে তা-ই খাব।
কোন কথা বলে না দুলি, নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত কাজির মুখে চেয়ে, তারপর হেঁটে চলে যায় রান্নাঘরের দিকে। ফিরে আসে কিছুক্ষণ পর, ছোট একটা থালায় একটা কই মাছ আর গেলাশে খানিকটা জল। কাজি আগ্রহের সঙ্গে খায়, দুলি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। খাওয়া হয়ে গেলে জলটা দেয় কাজিকে, সে চুমুক দিয়ে কুলকুচো করে জলটা গিলে নেয়। দুবার। তারপর বাটিটা জলে ভর্তি করে কাজির সামনে রাখে দুলি। হাত ডুবিয়ে বাটিতেই হাত ধুয়ে নেয় কাজি। খালি হয়ে যাওয়া থালা গেলাশ আর বাটিটা তুলে নিয়ে দুলি ফিরে যায় রান্নাঘরের দিকে। রান্নাঘরে গিরিবালা ছিলেন একা; তিনি বিধবা, নিরামিষ খান। ভাত, খানিকটা শুকনো মুগডাল সেদ্ধ, সর্ষের তেল আর নুনলঙ্কা দিয়ে চটকিয়ে খান রোজই। কাজি যখন থাকে না অথবা অসুস্থ হয়ে থাকে, দুলিও তখন মায়ের সঙ্গেই খায়, তার নাকি অপূর্ব খেতে লাগে এই ভাত। আজও সে তা-ই খাবে, কিন্তু ভেবেছিল কই মাছও খাবে একটা, দুটো মাছ সে রান্না করেছিল। কিন্তু কাজি আজ খেয়ে তৃপ্ত, দুলিরও তৃপ্তি হয়তো তাতেই।
কাজি কি জানে এসব?
অনেক দিন পর সেই সন্ধ্যেতে কাজি লিখল আর একটা গজল, গুন গুন করে সুরটাও ভাঁজল কিছুক্ষণ। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল দুধ আর পাঁউরুটি খেয়ে।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে মন খারাপ কাজির। এখন? – সে নিজেকেই প্রশ্ন করে, চলবে কীভাবে? উত্তর খুঁজে পায় না কাজি, তার মনে পড়ে সে শুনেছিল এ-বছর সওগাতের বার্ষিক সম্মেলনে নাসিরুদ্দিন সাহেব কাজির জন্যে একটা চ্যারিটি শো-এর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সে একটা চিঠি লেখে সওগাতের মোহম্মদ মঈনুদ্দীনকে: “স্নেহভাজনেষু মঈন, বহুদিন তোকে আর পত্র দিতে পারিনি। আবার জ্বরে পড়েছিলাম। কাল জ্বর-শয্যা ছেড়ে উঠেছি। …...হ্যাঁ, ভ্যারাইটি এন্টারটেনমেন্টের কি কতদূর করলি জানাবি। যত তাড়াতাড়ি হয় ততই ভালো আমার পক্ষে। কেননা, আমার অবস্থা ক্রমেই শোচনীয় হয়ে উঠছে। আর সপ্তাহখানিকের মধ্যে কি পারবিনে? নাসির সাহেবকে জিজ্ঞাসা করে জানাস। আমি সেইরূপভাবে প্রস্তুত হব। আশা করি ভালো আছিস। অবশ্য খবর দিস। স্নেহাশিস নে। ইতি শুভার্থী নজরুল।”
চিঠিটা পাঠিয়ে গ্লানিতে মন ভারাক্রান্ত হয় কাজির, এ তো লাজলজ্জাহীন ভিক্ষাবৃত্তি! কী করবে সে! কী করতে পারে!
পাশের ঘর থেকে দুলি আসে এবার, হেসে বলে, গূড মর্ণিং! জবাবের অপেক্ষায় না থেকে সোজা সে কাজির কপালে আর বুকে হাত দিয়ে জ্বর আছে কিনা বোঝবার চেষ্টা করে, তারপর খুশি হয়ে বলে, সেরে গেছ তো, গা তো একেবারেই ঠাণ্ডা।
একেবারে ঠাণ্ডা হলে তো বেঁচেই যেতুম দুলি, হচ্ছে কোথায় একেবারে ঠাণ্ডা!
মানে? – ধমক দেয় দুলি, এমন কথা কখনও বলবে না।
বলব না কেন বল, বলে কাজি, পকেটে একটা পয়সাও নেই, এভাবে চলতে পারে?
কেন? চলতে কী অসুবিধেটা হচ্ছে শুনি, দুলির গলায় কৃত্রিম ক্রোধ, বাড়ি বয়ে এসে সবাই সব কিছু দিয়ে যাচ্ছে। বেকারীর মালিক নিজে এসে পাঁউরুটি দিয়ে যায়, সব্জীওয়ালা সব্জী, দুধওয়ালা দুধ, মুদির দোকানের ছেলেটা
চাল-ডাল-তেল সব নিজে পৌঁছিয়ে দিয়ে যায়। সবাই দিয়েই চলে যায়, পয়সা চায় না কেউ। সকলেই জানে, তোমার এখন শরীর খারাপ, শরীর ভালো হলে তুমি নিজেই পয়সা দিয়ে দেবে। ডাক্তারবাবুও নিজে এলেন, ওষুধপত্র ইঞ্জেকশন সব দিলেন, পয়সা চাইলেন কি?
সে তো ওয়র্ণিং দিয়েই গেলেন, আমি সেরে উঠলেই গলায় গামছা দিয়ে সব পয়সা আদায় করবেন।
কত ভালো মানুষ বল তো।
ভালো তো বলবেই, আমার গলায় গামছা দিলে তোমার কী!
চোখ বড় বড় করে তাকায় দুলি, তারপর বলে, গরম জল করে দেব, চান করবে? নাকি এ-ক'দিনের মতো ঠাণ্ডা জলে মাথা ধুইয়ে গরম জলে গা মুছিয়ে দেব? নিজেই বলে তারপর, নাঃ থাক, আজ চান করে আর কাজ নেই, মাথাটাই ধুইয়ে দি' – বলতে বলতেই সে দ্রুত পায়ে চলে যায় রান্নাঘরের দিকে।
একটু পরেই ফিরে আসে দুলি, বোঝা যায় উনুনে সে জল বসিয়েই এসেছিল, হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় তাড়াহুড়ো করে চলে গিয়েছিল। এসেই সে জানলা-দরজা বন্ধ করতে শুরু করে, কাজিকে বলে, জামাটা খোল। মাথা-ধোয়ানো গা-মোছা হয়ে গেলে একটা চেয়ারে কাজিকে বসিয়ে বলে, এবার মুড়ি আর দুধ দেব তোমাকে। খেয়ে, তারপর বসে বসে কবিতা লিখো।
কবিতা?
ওই, তোমার গজল গান আর-কি! অন্তত তিনটে লিখবে দিনে। এক-একটায় দশ টাকা তো? দেখো, দিন কয়েকের মধ্যেই টাকা আসতে থাকবে তোমার কাছে। ভাবনা কী?
অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে দুলির দিকে তাকায় কাজি, এটা তো ঠিক বলেছ, গজল তো এখন অর্ডারী মালের মতো, ইচ্ছে করলেই লিখতে পারি; যত খুশি পারি, একবার শুধু টাকাটা আসতে শুরু করলেই পর পর আসবে। বাঃ!
খানিকটা সুস্থ তো হয়েইছে, তবুও বাড়িতেই থাকে কাজি আজকাল। গজলের পর গজল সে লিখছে, প্রায় প্রতিদিনই একাধিক পত্রিকায় পাঠাচ্ছে সেগুলো। অনেকদিন বুলবুলকে সময় দেওয়া হয়নি, আবার সে বুলবুলকে কোলে নিতে শুরু করে, হাঁটুর ওপর তাকে বসিয়ে রোজকার লেখা গজলগুলো গেয়ে গেয়ে শোনায় তাকে। একটু দীর্ঘ একটা কবিতা লেখার কথা ছিল নাসিরুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে; তা-ও লেখা হয়। সেই কবিতা পাঠিয়ে দেবার কয়েকদিনের মধ্যেই বেশ দীর্ঘ এক চিঠি আসে নাসির সাহেবের কাছ থেকে। বড় ভালো চিঠি, কাজিকে অনেকটা চাঙ্গা করার পক্ষে ঠিক এই সময়েই এই চিঠিরই বুঝি প্রয়োজন ছিল।
কাজির স্বাস্থ্যের দ্রুত উন্নতি কামনা করে চিঠির শুরু। কিন্তু পড়ে মনে হয়, দীর্ঘদিন বাংলা-ভাষার পত্রিকা জগতের অনেক ওঠা-পড়া, অনেক পলিটিক্স্, অনেক মহত্ত্ব এবং ক্ষুদ্রতা দেখতে দেখতে এই বয়েসে পৌঁছিয়ে একটা স্থির দিকনির্ণয় করতে পারছেন নাসির সাহেব, বিশেষ করে মুসলমান বাংলা পাঠক আর লেখকদের জন্যে। জনসংখ্যায় গরিষ্ঠ হলেও বাংলা সাহিত্যে মুসলমান পাঠকের সংখ্যা হিন্দুদের তুলনায় অনেক কম, লেখকের সংখ্যা তো বটেই। বহুদিনের অশিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক চৈতন্যহীনতা নব্যশিক্ষিত বাঙালি মুসলমানকে খানিকটা হীনমন্যতার শিকারে পরিণত করেছে। কাজি নজরুল ইসলামের মতো প্রগতিশীল মানসিকতার কবি তাই আজ তার স্বধর্মের
লেখক-পাঠকের কাছে তার প্রাপ্য সম্মান তো পায়ই না, তার লেখায় ইসলামি সংস্কৃতির তথাকথিত অনুপস্থিতি এদের প্রথমে বিরক্ত এবং ধীরে ধীরে পরে রাগান্বিত করে; শেষ পর্যন্ত নজরুল-বিরোধীতাই এদের উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই নজরুলের কাব্যে হিন্দু পুরাণাশ্রিত রূপকল্পই এদের চোখে পড়ে, বাংলা ভাষায় আরবী ফার্সি এবং নানা ইসলামি শব্দ বা কল্পনার প্রয়োগ – যা প্রায় একা নজরুলেরই অবদান – এদের চোখেই পড়ে না।
কিন্তু, নাসির সাহেব বলছেন, এতে ভেঙে পড়লে চলবে না। আর ভেঙে-না-পড়ার চেয়েও যেটা বড় কথা তা হল নজরুলের নেতৃত্বে কলকাতার সওগাত, ঢাকার শিখা এবং সমমনস্ক আরও যে কয়েকজন কবি ও তরুণ লেখক নানা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন তাঁদের সবাইকে নিয়ে একটা নতুন লেখকগোষ্ঠী তৈরি করতে হবে, যে গোষ্ঠী ইসলামের উদারনৈতিকতা সম্পর্কেও খানিকটা সচেতন থাকবে, কিন্তু হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব “বাংলাভাষীদের”-ই জন্যে জন্ম নেবে তাদের সৃষ্টি। শুধু মুসলিম বা শুধু হিন্দুর জন্যে নয়। নাসির সাহেব লেখেন, এই ব্যাপারে আমি পবিত্র, নৃপেন, নলিনীকান্ত, প্রেমেনদের সঙ্গেও আলোচনা করেছি। আমাদের প্রথম পরিচয় যদি বাঙালিত্ব হয়, তাহলে হিন্দুদেরও ভাবতে হবে কীভাবে সাধারণ মুসলমানদেরও দলে টানা যায়, নিশ্চেষ্ট থাকলে তারা যাদের খপ্পরে গিয়ে পড়বে তাদের কথা না বলাই ভালো।
চিঠিটা পড়ে উল্লসিত কাজি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লিখতে বসে তার উচ্ছ্বসিত জবাব। সে নাসির সাহেবকে মনে করিয়ে দেয়, সারাটা জীবন তার লড়াইয়েই কেটেছে। আট বছর বয়েসে সে পিতৃহারা, শুধুমাত্র খেতে পাওয়ার জন্যে লড়াই শুরু করে তাতেই সে ক্ষান্ত হয়নি। লড়াই করেছে মাঠে-ময়দানে, লেটোর দলে, রানিগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ, ময়মনসিংহ থেকে শিয়ারশোল, শিয়ারশোল থেকে করাচি। আর করাচির পর আজকের জীবন – সবটাই তো তার লড়াই। আজ যদি নাসির সাহেব তাকে ডাকেন বাংলা সাহিত্যে নতুন ঝড় তোলার লড়াইয়ে, বুটজোড়া তার পরাই আছে, ডাকলেই সে দৌড়োবে। অবিশ্যি পরের প্যারাগ্রাফেই রহস্য করে সে; বলে, সে এই চিঠিতে যা লিখছে এখন, তার সবটাই চুপিচুপি; সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন ছাতা হাতে ডাক্তারবাবু, উঠে বেরোতে গেলেই ছাতার বাঁট দিয়ে তার গলা পাকড়িয়ে টেনে আনবেন। ডাক্তারবাবুর বিদায় পর্যন্ত তাকে অপেক্ষায় থাকতেই হবে, ছাড়া পেলেই দৌড়িয়ে সে পৌঁছিয়ে যাবে সওগাতের অফিসে!
কয়েকদিন বুলবুলকে নিয়েই কেটে গেল। তার অন্নপ্রাশনে কত হৈ হৈ হবে, কত লোক আসবে, কেমন হবে
খাওয়া-দাওয়া, এমনকি কী কী খাওয়ানো হবে তার লিস্টও তৈরি হয়ে গেল। দুলিও যোগ দেয় এই জল্পনায়, মাঝে মাঝে গিরিবালাও আসেন। এবং, কী যেন একটা না-বলা বোঝাবুঝির ফলেই বোধ হয়, কোথা থেকে খরচের এত টাকা আসবে সে ব্যাপারে তিনজনই নীরব থাকে।
এমন সময় একটা চিঠি আসে ঢাকা থেকে। লিখেছেন ঢাকার একজন অতি-পরিচিত মানুষ, মুসলিম সমাজের অন্যতম প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে তাঁর পরিচয়, আবুল হোসেন। ফেব্রুয়ারির শেষ দু'দিন ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠান। কাজিকে আসতেই হবে।
বাইরে যাবার নামেই যার বুক ছলকে রক্ত ওঠে সেই কাজিই মুষড়ে পড়ে চিঠিটা পেয়ে। কলকাতায় না-হয় আজ না হলে কাল যাওয়া যায়, ঢাকার এই অনুষ্ঠান তো আর রোজ হবে না! তবুও, এবারটা যে যেতে পারছি না, সে কথা জানাতেই হবে ওদের:
“আপনার সাদর আমন্ত্রণ-লিপি নব ফাল্গুনের দখিন হাওয়ার মতই খুশ-খবরি নিয়ে এসেছে। আমার শরীর জ্বরের উপর্যুপরি আক্রমণে জর্জরিত হয়ে উঠেছে। তাই মন আমার এই আনন্দবার্তা পেয়ে যত হালকাই হয়ে উঠুক, শরীর হয়তো তেমন হালকা হয়ে উঠতে পারছে না। আর শরীর যদি এমনি ভারী হয়ে থাকে আর কিছুদিন, তাহলে এর ভার কোনও রেলগাড়িই বইতে সমর্থ হবে না। আমার বর্তমান অভিভাবক জ্বর, তারই আদেশের প্রতীক্ষা করছি। ......”
ঘরে ঢুকে দুলি দেখে কাজি একমনে কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়ে লিখছে একটা কিছু।
নতুন কবিতা? – জিজ্ঞেস করে দুলি।
কবিতাই বটে, কাজির মুখে করুণ হাসি।
দুলি এগিয়ে এসে পড়ে চিঠিখানা, আর পাশে-রাখা আবুল হোসেন সাহেবের চিঠিটাও। এ কী! – তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে স্বতস্ফূর্ত, যাবে না কেন? ফেব্রুয়ারির শেষ, এখনো তো অনেকদিন বাকি। কয়েকদিন ঘুরে এলে ভালোই তো। আর কত সম্মান করে লিখেছেন তোমাকে, বাণীও চেয়েছেন। আমার তো মনে হয় ওই সময় তুমি যেতেই পার, যাওয়াই উচিত।
বলছ? – বলে কাজি, তাহলে তা-ই লিখে দিই, শরীর ভালো থাকলে যাব।
চিঠির যেটুকু লেখা হয়েছিল সেটাকে আরও অনেক বড় করে কাজি, শেষের লাইনে লেখে, “... আপনারা যদি নেহাৎ না ছাড়েন যেতেই হবে।...”
গেলও শেষ পর্যন্ত। অনুষ্ঠানে স্বরচিত উদ্বোধনী সঙ্গীত বা খোশ আমদেদ গাইবার অনুরোধ ছিল আবুল হোসেনের, কাজির মাথায় তখন ভরপুর গজল। ফেব্রুয়ারির সাতাশ তারিখে স্টীমারে বসেই সে লেখে ফার্সি গজলের আবহে সেই গান – আসিলে,/ কে গো অতি/থি উড়ায়ে/ নিশান সোনালী। ঢাকার সেই সময়কার পত্রিকা থেকে জানা যায়, নজরুলের সে গান মাতিয়ে দিয়েছিল সভা। কিন্তু কাজির নিজের কাছে এই অনুষ্ঠানে কয়েকজন স্থানীয় তরুণ কবি-সাহিত্যিকের বক্তৃতাই ছিল সবার চাইতে আকর্ষক। তার মনে পড়ছিল নাসির সাহেবের চিঠিটার কথা। সেই কথাগুলোই যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল এই বক্তাদের গলায়। নজরুলকে উদ্ধৃত করে স্থানীয় পত্রিকাটি লেখে, “শেষ দিন কবি সাহেব একটি ক্ষুদ্র বক্তৃতায় 'অভিযান শুরু হল বলে' ঘোষণা করিলেন। পূর্বে নাকি তিনি একাই কাফের আখ্যা পাইয়াছিলেন। এখন হইতে অনেক সঙ্গী পাইলেন ইত্যাদি বীরত্বব্যঞ্জক বাক্য উচ্চারণ করিতেও কবিবর বিরত হয়েন নাই।...”
শিখা পত্রিকার চৈত্র সংখ্যায় এ-বিষয়ে কাজিকথিত বাক্যগুলো সম্পূর্ণ: “আজ আমি এই মজলিশে আমার আনন্দবার্তা ঘোষণা করছি। বহুকাল পরে কাল রাত্রে আমার ঘুম হয়েছে। আজ আমি দেখছি এখানে মুসলমানের নূতন অভিযান শুরু হয়েছে। আমি এই বার্তা চতুর্দিকে ঘোষণা করে বেড়াব। আর একটি কথা – এতদিন মনে করতাম আমি একাই কাফের, কিন্তু আজ দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম যে, মৌলানা আনোয়ারুল কাদির প্রমুখ কতকগুলি গুণী ব্যক্তি দেখছি আস্ত কাফের। আমার দল বড় হয়েছে এর চেয়ে বড় সান্ত্বনা আর আমি চাই না।”
দু'দিনের নাম করে যাওয়া, কিন্তু ঢাকায় গেলে কি দু'দিনেই ফেরা যায়? এই ক্লাব, ওই সমিতি, এর বাড়িতে গান শোনানো, ওর বাড়িতে শুধুই আতিথেয়তা – বুদ্ধদেব বসু তো বলেছেন য়্যুনিভার্সিটির সিংহদ্বারে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বাসা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন কাজি সাহেবকে তাঁদের প্রগতির আড্ডায়!
তেরই মার্চ বুলবুলের অন্নপ্রাশন। কৃষ্ণনগরে ফেরার পর হাতে আর দশটা মাত্র দিন। নিমন্ত্রিতদের আপ্যায়ণের যে খাদ্যতালিকা তৈরি করেছিল কাজি দুলি আর মাসিমার সঙ্গে বসে, সেটা নিয়ে সে বেরিয়ে গেল, ফিরল ঘন্টাদুয়েক পর। ফিরে এসে বলল, সব ঠিক আছে।
কথা ছিল, কৃষ্ণনগরে এসে কয়েকদিন থেকে যাবে মুজফ্ফর আর হালীম; ওরা জানিয়েছে দশ তারিখে আসবে, সকালের ট্রেনে।এর আগেও ওরা একবার এসেছিল গত বছর অক্টোবরে, সেইদিনই বিকেলে এক টেলিগ্রামে ওরা হালীমের দাদা শামসুদ্দীন হুসয়নের প্রবল অসুস্থতার খবর পেয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়, থাকা হয়নি ওদের। তের তারিখে বুলবুলের অন্নপ্রাশনের খবর পেয়েও ওরা যখন দশ তারিখে আসতে চেয়েছে, কাজি ভাবল, কাজি একা মানুষ, ওরা নিশ্চয়ই তাকে খানিকটা সাহায্য করতেই চায়, তাই অনুষ্ঠানের তিন দিন আগেই আসছে। দুলি কাজিকে বলেছিল, অন্নপ্রাশনই যখন হচ্ছে, একজন মামা চাই। শিশু প্রথম ভাত খায় মামার হাতে। মুজফ্ফরের দশ তারিখে আসবার খবর পেয়ে উৎফুল্ল দুলি, মুজফ্ফরের সঙ্গে তার দাদা-বোনের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। দেখেছ তো, দুলি বলে কাজিকে, বুলবুলের বড়মামা নিজেই হাজির থাকবে।
সকাল-সকালই পৌঁছোল মুজফ্ফর-হালীম। এবং, তখনই জানা গেল, চোদ্দ তারিখে দিল্লীতে একটা জরুরী মীটিং আছে ওদের, তাই তের তারিখে ওরা থাকতে পারবে না। ওরা দশ-এগার থাকবে কৃষ্ণনগরে, বার তারিখ সকালেই ফিরে যাবে কলকাতায়। সেখান থেকে দিল্লী।
কেঁদে ফেলে দুলি। মামার হাতে বুলবুলের ভাত খাওয়ার পরিকল্পনাটা সে বলে; সে ভাবতেই পারেনি ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত এরকম দাঁড়াবে!
মুজফ্ফর কিন্তু হাসে, মামার হাতে প্রথম ভাত খাওয়া? খাবেই তো, কালই সকালে আমি নিজের হাতে ভাত খাওয়াব ওকে। এ-সুযোগ আর কি পাব এ-জীবনে?
দুলি চোখ মোছে। সে রাজি। হো হো করে হেসে কাজি হাঁকে, চালাও পানসি বেলঘরিয়া!
রাজসিক অনুষ্ঠান হল বুলবুলের অন্নপ্রাশনে। কৃষ্ণনগর আর কলকাতার কত মানুষ যে নিমন্ত্রিত হয়ে যোগ দিতে এল, কত খাওয়াদাওয়া কত গানবাজনা কত হৈ হৈ হাসি হল্লা! এ যেন ম্যাজিক দেখিয়ে দিল কাজি। মাত্র চব্বিশটা টাকা পাঠিয়েছিল ব্রজবিহারী বর্মন টেলিগ্রাফ করে; এটাই পুঁজি, কিন্তু কাজিদার অনুষ্ঠানে ঝাঁপিয়ে পড়ল কৃষ্ণনগরের
ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ীরা, অভাব হল না কোন কিছুরই!
অন্নপ্রাশন মিটে গেলে আবার গজল শুরু। এর মধ্যে কোন কোন পত্রিকা থেকে আসতে শুরু করেছে দশ-বিশ টাকা সাম্মানিক। সেদিন অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানেও গজল গাইল কেউ কেউ। কাজিও লিখে যাচ্ছে দেদার; মনে ভরসা, এই আর্থিক অনিশ্চয়তা কাটিয়ে সে উঠবেই। এরই মধ্যে বৈশাখের মাঝামাঝি একটা চিঠি আসে আফজালুল হকের কাছ থেকে – সপ্তাহখানেকের মধ্যে একবার আসতে পারবেন কলকাতায়? মেছুয়ার একটা বাড়ির ঠিকানা ছিল চিঠিতে। লিখেছে, পরের সপ্তাহের সোম থেকে শনিবার প্রত্যেক দিন দুপুরে সেখানে পাওয়া যাবে তাকে। খুব বড় একটা উদ্যোগ চলছে বাংলা পত্রিকা নিয়ে, কাজিকে সেখানে যুক্ত করতে চায় সে।
কোন আশার আলো দেখলেই তো দৌড়োয় কাজি, খোঁজ করে করে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে সে একদিন পৌঁছোল মেছুয়ার সেই ঠিকানায়। দোতলা বাড়ি। নীচের তলায় ছাপাখানা বসানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে, ওপরের তলায় অফিস। কাজির পূর্ব-পরিচিত ফজলুল হক সেলবর্সী – যিনি নবযুগে কাজির সঙ্গে কাজও করেছিলেন – এই উদ্যোগেও আছেন। প্রায় দশ-বার জন লোক নানা টেবিলে বসে কাজ করছে, জমজমাট অফিস একেবারে। পর্দা-টানা একটা আলাদা ঘরে কাজিকে নিয়ে গেল আফজালুল, বলল, খুব বড় একজন উদ্যোগপতি তাদের সঙ্গে আছেন, প্রচুর টাকা। যে পত্রিকা বের হতে চলেছে তার নাম ভাবা হয়েছে নওরোজ। একটু চাপা গলায় আফজাল বলে, যা আমাদের প্ল্যান, বছরখানেকের মধ্যে কলকাতায় আর বাংলা কোন পত্রিকা থাকবে না। হয় বন্ধ হয়ে যাবে, অথবা নওরোজেরই অংশ হয়ে টিকে থাকবে কোনমতে। আপনাকে আমি আমাদের সঙ্গে নিতে চাই। যদি টিকে থাকেন, অন্য কোন কাজের কথা ভাবতেও হবে না কখনো।
আপাতত, বলতে থাকে আফজাল, আপনাকে আমরা একটা বিশেষ চুক্তিতে আমাদের সঙ্গে নিতে চাই। নওরোজের প্রতি সংখ্যাতেই আপনার লেখা কিছু-না-কিছু থাকবেই। তা কবিতা গল্প প্রবন্ধ গান ধারাবাহিক রচনা – যা-ই হোক। কিন্তু একটা কথা, যতদিন আপনার সঙ্গে আমাদের চুক্তি থাকবে ততদিন আপনার কোন লেখাই অন্য কোথাও ছাপানো চলবে না। আর যা আপনি নওরোজে ছাপাবেন তার রচনাস্বত্ব সব নওরোজেই। রচনার সংখ্যা যা-ই হোক, এক বা দশ যা-ই হোক না কেন, প্রতি মাসে আপনি পাবেন একশো টাকা।
একশো টাকা!
কাজি আর আফজালুলের সম্পর্ক চিরকালই একশো টাকায় বাঁধা রইল, ভাবে কাজি! সেই কতদিন আগে, প্রথম প্রথম বঙ্গীয় মুসলমান সমিতির বাড়িতে যখন থাকতে এল কাজি, আফজালুলও থাকতো সেখানে; তার মোসলেম ভারতে কত লিখেছে সে তখন। সেই সময় আলি আকবর আর আফজালুল মাসে একশো টাকার বিনিময়ে তার সমস্ত রচনা কিনে নেবার প্রস্তাব দিয়েছিল! কুমিল্লা থেকে নিষ্কপর্দক ফিরেছে কাজি সাহিত্য সমিতিতে, তার প্রথম ছোটগল্প সঙ্কলনের গ্রন্থস্বত্ব কিনল আফজালুল সে-ই একশো টাকায়! কত না অসন্তুষ্ট হয়েছিল মুজফ্ফর এই সামান্য মূল্যে গ্রন্থস্বত্ব বেচে দেওয়ায়!
এখনও আবার সে-ই একশো টাকাই!
মুখে মাপা হাসি আফজালের। স্থির তাকিয়ে আছে সে কাজির দিকে। ভেবে দেখুন কাজিসাহেব, বলে সে, আমরা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও কথা বলেছি, তাঁর নাম উল্লেখ করে আপনাদেরই গণবাণীর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় আমাদের বিজ্ঞাপনও বেরোবে, আপনি রাজি হলে সেই বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে আপনার নামটাও জুড়ে দেওয়া হবে, রাজি আপনি? ভেবে দেখুন।
কৃষ্ণনগরে কাজির অনেক ধার। আর ভাবতে পারে না কাজি। মাথা নাড়ায় সে! রাজি!
একটুও দেরি করে না আফজাল, হনহন করে পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে যায় সে, ফিরে আসে দশখানা দশ টাকার নোট আর একটা ভাউচার হাতে নিয়ে। সই নেয় কাজির। টাকাটা দেয় তার হাতে।
আষাঢ় থেকে নজরুলের কিছু কিছু গজল, দুয়েকটা কবিতা আর চারখানা গজল সমেত একটা নাটিকা ছাপা শুরু হল নওরোজে। ছাপা হল আষাঢ় শ্রাবণ ভাদ্র, তিন মাস। আশ্বিন থেকে নওরোজের আর কোন খবর নেই। মাসে-মাসে একশো টাকার প্রতিশ্রুতিও নীরব। নওরোজ কি তাহলে বন্ধ হয়ে গেছে? বন্ধ? কাজির খুব একটা মন খারাপ হয় না। মাসে মাসে একশো টাকা সে ক্ষেত্রে আসবে না আর। না আসুক, নওরোজ কেমন যেন গলা চেপে বসেছিল কাজির। মুক্তি!
কিন্তু তবুও, মাসে মাসে একশো টাকা, সে-ও তো বন্ধ!
অবিশ্যি এতদিন ধরে নানা পত্রিকায় ছাপা গজলের সম্মানমূল্য ধীরে ধীরে আসতে শুরু করেছে। বাংলা গজলের প্রবল লোকপ্রিয়তা। এমনকি ভারতবর্ষ বঙ্গবাণীর মতো পত্রিকা শুধু টাকা পাঠিয়েই ক্ষান্ত নয়, নতুন নতুন গজল চেয়ে পাঠাচ্ছে যখন, ঠিক সেই সময়েই বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলামের প্রবল কবিখ্যাতি প্রায় অস্বীকার করে তাকে 'গজল গানের লেখক' হিসেবে দেগে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টাও দেখা গেল। শনিবারের চিঠির নজরুল-বিরোধীতা মনুষ্যেতর উল্লম্ফনের পর্যায়ে প্রায়; জনপ্রিয় 'বাগিচায় বুলবুলি তুই'-এর প্যারডিই হল সজনীকান্তর লেখনীভূষণ:
জানালায় টিকটিকি তুই টিকটিকিয়ে করিসনে আর দিক
ও বাড়ির কলমিলতা কিসের ব্যথায় ফাঁক করেছে চিক।
বহুদিন তাহার লাগি রাত্রি জাগি গাইনু কত গান
আজি সে কারে জানি নয়না হানি হাসল কে ফিকফিক।।
আবার এগিয়ে এলেন নাসির সাহেব। কাজির নেতৃত্বে তরুণ প্রগতিশীল মূলত মুসলমান সাহিত্যিকদের একটা গোষ্ঠী তৈরির যে পরিকল্পনার কথা তিনি অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন, সেই কথাই তুললেন আবার। এবং একই সঙ্গে কাজির আর্থিক সমস্যার একটা সমাধান। কাজি যোগ দিক সওগাত-এ। এটা হোক রেওয়াজমাফিক একটা চাকরিই। মাসিক বেতন দেড়শো টাকা। সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে সে যা রচনা করবে সবই ছাপবে সওগাত, অন্য কোথাও তার রচনা ছাপা চলবে না। অবিশ্যি রচনাস্বত্বের কথা বললেন না নাসির সাহেব; স্বত্ব কাজিরই থাকল। তবে, কাজটা কিন্তু শুধু সওগাত-এর পত্রিকার জন্যেই নয়। প্রতি বিকেলে সওগাতের প্রস্তাবিত সাহিত্য মজলিশে উপস্থিত থাকতে হবে কাজিকে; নেতৃত্বের সেই কাজটাই আসল, কারণ, নাসির সাহেবের ভাষায়, “ধর্মের নামে যে সমস্ত ভণ্ড সমাজহিতৈষী কথায় কথায় বিরুদ্ধবাদীদের কাফের ও ইসলামের শত্রু আখ্যা দিয়ে সমাজের অশিক্ষিত জনসাধারণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছে, নানা তহবিলের সৃষ্টি করে যে সমস্ত প্রবঞ্চকের দল সে সব তহবিলের টাকা আত্মসাৎ করে সম্পত্তি ক্রয় করছে, ঐ সব ধর্মব্যবসায়ীদের ভণ্ডামির মূলোৎপাটনই সওগাতের উদ্দেশ্য।”
অর্থাৎ বুটজোড়া-পরে প্রস্তুত-থাকা কাজির এবার দৌড়ের সিগনাল এল। কাজি পৌঁছোল সওগাত-এ।
কাজির নানা রচনায় সমৃদ্ধ যে হল সওগাত সে তো হবারই ছিল। কিন্তু এই সাহিত্য-মজলিশ বা অনেকের ভাষায় সওগাত ক্লাব তরুণ মুসলমানদের অনেককেই দেখাল নতুন দিশা। এই মজলিশ যে শুধু মুসলমানদেরই তা নয়, মজলিশে নিয়মিত উপস্থিত শৈলজানন্দ নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ প্রেমেন্দ্রর মতো প্রতিভারাও। বাংলা সাহিত্য পাঠের এক ধরণের বিপ্লবী অভিমুখ তৈরি করার চেষ্টা করল এই মজলিশ। যেমন লেখক, ঠিক তেমনই পাঠককেও ছুঁয়ে যাওয়াটাই উদ্দেশ্য। লেখার সময় লেখক যেমন মনে রাখবে না সে হিন্দু না মুসলমান, বৌদ্ধ না ক্রিশ্চান, তার পাঠকও পড়বে আনন্দের জন্যে, প্রেরণার জন্যে, এবং একটা অধরা দীর্ঘস্থায়ী প্রাপ্তির আশায়; সাহিত্য ধর্মগ্রন্থ যেমন নয়, তেমনি হিসাবশাস্ত্র বা কোন কিছুর নির্দেশনামা বা ম্যানুয়ালও নয়। “নজরুলের মনীষার উৎপ্রেরণা রোজ আমাদের মধ্যে দ্রুতগতিতে এমন সব দরজা খুলিয়া দিল এবং তার ফলে আমাদের মাথায় এত কথা গজগজ করিতে লাগিল যে, আমাদের আর মাসে একবার কথা বলিবার ধৈর্য থাকিল না। আমরা সপ্তাহে কথা বলিবার জন্য খেপিয়া গেলাম।” – লিখেছেন সেই সময়কার একজন উৎসাহী মজলিশী, আবুল মনসুর আহ্মদ।
অতএব, বেরোল সওগাত সাপ্তাহিকও।
সাপ্তাহিকের জনপ্রিয়তা অনেককে কয়েক বছর আগের সান্ধ্য নবযুগের কথা মনে করিয়ে দেয়। কাগজ যেদিন বেরোবে সে দিন অনেক আগের থেকেই পত্রিকার স্টলে স্টলে পাঠকদের ঘোরাঘুরি, নিঃশেষ হবার আগেই কিনে নিতে হবে নিজের কপিখানা! বাস্তবিকই, কয়েকমাসের মধ্যেই সাপ্তাহিক সওগাত সর্বাধিক প্রচারিত সাপ্তাহিকগুলোর মধ্যে একটা হয়ে দাঁড়াল। কাজির অনেক লেখাই থাকত সাপ্তাহিক সওগাত-এ, কিন্তু বিশেষ করে একটি বিভাগের – চানাচুর নাম ছিল এই বিভাগের – যা পরিচালনা করত কাজি নিজে – চাহিদা ছিল সবার থেকে বেশি। সেই সময়টায় মহাত্মা গান্ধী – পূর্ণ স্বাধীনতা নয় – ডোমিনিয়ন স্টেটাস পাবার আন্দোলন চালাচ্ছেন। বাংলায় সুভাষচন্দ্ররা তার বিরোধীতা করছেন, তাঁদের দাবি পূর্ণ স্বাধীনতা; এক বছর পরেই কলকাতা কংগ্রেসে সুভাষ এবং তাঁর অনুচরদের সঙ্গে মোতিলাল নেহ্রুর মতভেদ উচ্চকিত হয়ে উঠবে। ঠিক তখনই সাপ্তাহিক সওগাতের চানাচুর বিভাগে নজরুল লিখলেন এক টুকরো ফিচার:
“ভারতমাতা এতদিন পদদলিতা দাসী ছিলেন। শুনছি তাঁর পুত্রদের সেবায় পরিতুষ্ট হয়ে তাঁর প্রভু নাকি তাঁর
হাত-পায়ের কতক বাঁধন খুলে দিয়ে 'ডোমনি স্টেটাস'-এর (Dominion Status) তক্মা পরিয়ে দেবেন।
“ভারতমাতার বল-দ (বলদানকারী) পুত্রদের মধ্যে এই নিয়ে এরই মধ্যে মোচ্ছবের ধূম লেগে গেছে। চারিদিকে জয়ধ্বনি উঠছে 'মা ডোম্নি হবে রে, মা ডোম্নি হবেন।'
“মা-এর অবস্থা মা-ই জানেন। কিন্তু আমাদের মনে হচ্ছে তিনি বোধ হয় মনে মনে বলছেন 'এদের আঁতুড় ঘরেই নুন খাইয়ে মারিনি কেন?
“ডোম্নি ছেলেই বুঝি বা! হাতে যা বড়ো বড়ো ধামা!”
কৃষ্ণনগর থেকে ডেইলী প্যাসেঞ্জারি করে কাজি, এতটা ধকল তার শরীরের পক্ষে খুবই কষ্টকর। কৃষ্ণনগরের ডক্টর দে তাকে ধমকেছেন, দুলিকেও বলে গেছেন কাজির সাবধান হওয়া দরকার। তা-ছাড়া, কৃষ্ণনগরেই বা সে থাকে কোথায়? ভোরবেলা সে বেরিয়ে যায়, ফেরে গভীর রাতে। সংসারের যেন কেউই নয় সে। বুলবুল তো কিছুদিন পর তাকে চিনতেই পারবে না! সে সব ছাড়াও, পুরো সংসারের দায় সে কোন অধিকারে চাপাতে পারে দুলি আর তার বৃদ্ধা মায়ের ওপর?
নাসির সাহেব নিজেও একদিন কাজির সঙ্গে আলোচনা করলেন এ-সব কথা নিয়ে।
অথচ এ-কথাও তো ঠিক যে সওগাত খানিকটা স্থিতির অবস্থা দিয়েছে কাজিকে; তার প্রতিভা সুযোগ পাচ্ছে নিজেকে প্রকাশের। আর্থিক দিক থেকে খুব স্বচ্ছল না-হলেও গত কয়েক বছরের অসহায়তা সে বেশ খানিকটা কাটিয়ে উঠেছে সওগাতেরই দৌলতে। এ অবস্থায় কী করা?
দুলিকে বলে কাজি, ভাবছি রোজ কলকাতা-কৃষ্ণনগরটা বন্ধ করব। সওগাতের অফিসেই হোক বা জেলেটোলায় নলিনীদার বাড়িতে, কোথাও একটা সারা সপ্তাহ থেকে যাওয়াই ভালো হবে। ডাক্তারবাবুও সেদিন তা-ই বলছিলেন। ধর, এখান থেকে সোমবার গেলুম সকালে, আর ফিরলুম শনিবার রাতে। রোববারে তোমাদের বাজার-টাজারগুলো মোটামুটি করে দিয়ে যেতে পারব। তুমি কী বল?
আমি আর কী বলব? – বলে দুলি, সত্যিই তো, শরীরের ওপর চাপ পড়ছে, আবার যদি পড় ভালো হবে না।