কোন রাস্তা?
ঠিক জমে ওঠার মুখেই আসরটা ভেঙে যাওয়ায় সকলেই বিমর্ষ। দুয়েকজন অবিশ্যি নজরুলকে অনুরোধ করছিল গান চালিয়েই যেতে, কিন্তু যে মেয়েটি উঠে গেল, অপমানিতা সেই মেয়েটির সকলের মধ্যে থেকে নীরবে চলে যাওয়ার দৃশ্য অগ্রাহ্য করতে পারে না নজরুল। বলে, আর একদিন হবে।
চল, তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি, নজরুল বলে শচীকে। শচীর সঙ্গে পিংলাও ওঠে, ওরা হাঁটতে থাকে হাওড়া ময়দানের দিকে। তোমার গল্পটা শুনি, নজরুল বলে, বাবার ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে কোথায় যশোর আর কোথায় শিবপুর!
জমিদারবাবুদের স্কুলে পড়তাম নড়ালে, শচীনন্দন শুরু করে তার গল্প, আমাদের একজন স্যার ছিলেন শিবপদ বাবু, শিবপদ ধর, বিপ্লববাদীদের সঙ্গে স্যারের যোগাযোগ ছিল। যুদ্ধ লাগল যখন, তখন বিনা বিচারে ধরপাকড় শুরু হল বিপ্লবীদের, আমাদের যশোর জেলায় অনেক ছেলেই ধরা পড়ল। আমরা যখন তার প্রতিবাদ করছি, কংগ্রেস তখন যুদ্ধকে সমর্থন করছে। স্যার আমাদের বললেন, কংগ্রেস যে যুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থন জানাচ্ছে তা-ই শুধু নয়, এমনকি উনিশশো চোদ্দ থেকে উনিশশো সতের পর্যন্ত কংগ্রেসের প্রতিটি বার্ষিক অধিবেশনে প্রাদেশিক লালমুখো গভর্নররাও যোগ দিয়েছেন।
স্যার তো ঘোরতর কংগ্রেস বিরোধী, কিন্তু আমাদের মতো ছেলেরা, যারা সরাসরি বিপ্লবী আন্দোলনে নামিনি, কিন্তু উত্তেজনায় অস্থির, তারা বুঝতে পারছি না কী করব। এমন সময় দেশে ফিরলেন গান্ধিজি, সবরমতি আশ্রমে ডেরা বাঁধলেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর অহিংস আন্দোলনের জয়ধ্বনি শোনা গেল চম্পারনে নীলকরদের বিরুদ্ধে, গুজরাতের খেড়ায় কৃষক আন্দোলনে আর আহ্মদাবাদের শ্রমিক আন্দোলনে। এর মধ্যে খিলাফত আন্দোলনের নেতারাও গান্ধিজির নেতৃত্ব মেনে নিয়েছেন। রাওলাট অ্যাক্টয়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন গান্ধিজি, সর্বাত্মক অসহযোগ লড়াইয়ের ডাক দিলেন। আমাদের মধ্যে নতুন উত্তেজনা, স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে নানা মিছিল-মিটিংয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করলাম। হঠাৎ একদিন অবাক হয়ে দেখলাম নেতা হয়ে গেছি। শুধু আমাদের নড়ালেই নয়, এমনকি কলকাতার কাগজেও ‘যশোহরের বালক বীর শচীনন্দন চট্টোপাধ্যায়’ ক্যাপশন দিয়ে আমার ছবি ছাপা হয়ে গেল।
এরপর যা হবার তাই। বাবা গেল খেপে। বলল, প্রতিদিন যে স্কুলে যাচ্ছ, তার প্রমাণ দিতে হবে প্রত্যেক সন্ধেবেলা। আর আমার সামনে বসে পরের দিনের হোমওয়র্কও করতে হবে।
শিবপদবাবু স্যারকে ধরলাম। স্যারই বলুন, কী আমার করা উচিত। স্যার বললেন, দেখ্, গান্ধিগিরি যদি করিস, তার থেকে স্কুলে ফিরে যাওয়াই ভাল। স্বরাজ কোনোদিনও গান্ধির রাস্তায় আসবে না। এত বড় ভারতবর্ষটা ভিক্ষে হিসেবে ফিরিয়ে দেবে না ইংরেজ। রাস্তাটা কী, সেটা বাঘা যতীনই দেখিয়ে গেছেন। নিজে জীবন দিলেন তবু এবারটা হল না, কিন্তু হবে। সারা ভারতবর্ষ বাঘা যতীনের রাস্তাতেই হাঁটবে। গান্ধির তো এত বড় বড় বক্তৃতা শুনিস, জালিয়ানওয়ালাবাগের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড ত্যাগ করার পর তো কংগ্রেস অধিবেশনও হল। একটা কথাও বলল কেউ? তোর গান্ধি তো ভাব দেখাল কিছুই হয়নি। সে তো আত্মসমালোচনায় মুখর! তোষণ করে হবে স্বাধীনতা?
বললাম, তাহলে কী করব স্যার?
স্যার বললেন, স্কুলে ফিরে আসতে না চাস, তাতে কিছু যায়-আসে না। পড়াশোনাটা করতেই হবে, স্কুলে গেলেও, না গেলেও। কিন্তু চিন্তা করে দেখ্। দেশের জন্যে শহিদ হতে রাজি আছিস, নাকি আমার মতো মুখেন মারিতং জগৎ? এক সপ্তাহ সময় নে, তারপর আসিস আমার কাছে।
এক সপ্তাহ পর ফিরে গেলাম স্যারের কাছে। বললাম, আমাকে রাস্তা দেখিয়ে দিন স্যার। স্যার একটা ঠিকানা লিখে দিলেন। বললেন, এই জায়গাটা হাওড়ায়, শিবপুরে। হাওড়া জানিস?
জানি। কলকাতার ওপারে।
ঠিক আছে। ঠিকানাটা যাঁর, তাঁর নাম ননীগোপাল সেনগুপ্ত। এটুকু জানাই তোর পক্ষে যথেষ্ট। জেনে রাখিস, তিনি এই শিবপদ ধরের মতো কাপুরুষ আর বোকা ন’ন। তোকে বাজিয়ে নেবেন। যদি তোর এলেম থাকে, উনি যদি বোঝেন, উনিই ব্যবস্থা করে দেবেন। আর, উনি যদি রাজি না হন, সোজা বাড়ি ফিরে আসবি। বাবার পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে কান্নাকাটি করে ইশকুলে ফিরে যাবি। যা ভাগ।
ননীগোপাল সেনগুপ্তও আমার ছবি দেখেছেন কাগজে। বললেন তুমি তো যশোহরের বালক বীর। যশোহর ছেড়ে আবার শিবপুরে কেন? আমার যা বলার বললাম আমি। উনি বললেন, তুমি যদি বাড়ি ছেড়ে এসে স্বাধীনতার লড়াইয়ে জীবন দিতে চাও সেটা তোমার সিদ্ধান্ত। মা আছেন? আমি বললাম, না। বললেন, তোমাকে আমি চিনি না। যিনি তোমাকে আমার ঠিকানা দিয়েছেন, তাঁকে অবিশ্যি চিনি। কাজেই, তুমি চোর-ছ্যাঁচোর নও, সেটা বুঝতে পারছি। আপাতত কিছুদিন থাকো আমার বাড়িতে। বাচ্চাদের পড়াবে। তার জন্যে কোন মাইনে পাবে না কিন্তু। খাওয়া-দাওয়া আর থাকা। ঠিক আছে? তারপর বললেন, এসো আমার সঙ্গে।
বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। দু’জন মহিলা। যিনি বৃদ্ধা, তাঁকে দেখিয়ে বললেন, আমার মা। ঠাকুমা বলে ডাকতে পার। দ্বিতীয় জনকে দেখিয়ে বললেন, কাকিমা না জ্যাঠাইমা সেটা তুমিই ঠিক করে নিও। তারপর আমাকে দেখিয়ে দু’জনকেই বললেন, বিপ্লব করবে বলে বাড়ি ছেড়ে এসেছে। ঝন্টু-মন্টু-রিন্টুকে পড়াবেও। বাইরের ঘরটায় ব্যবস্থা করে দিও। চাবিও দিয়ে দিও। যখন ইচ্ছে ঢুকবে, যখন ইচ্ছে বেরোবে, বিপ্লবী বলে কথা!
কোনও নেতা নেই, কেউ কোনও নির্দেশ দেবারও নেই। কী করব জানি না, এইভাবে একা-একা চলে এসে স্বাধীনতা সংগ্রাম করার কথা ভেবেছি বলে নিজেকেই কেমন যেন বোকা-বোকা লাগতে শুরু করল। যে বাড়িতে থাকি তার দু-তিনটে বাড়ির পরেই একটা ছোট্ট ফাঁকা জায়গায় একতলা একটা এক-ঘরের বাড়ি। বাড়িটার গায়ে লেখা ‘দশে দশ’। যাতায়াতের পথে আমারই বয়সী দুয়েকজনকে ঢুকতে-বেরোতে দেখেছি। একদিন সাহস করে ঢুকে পড়লাম সেই এক-ঘরের বাড়িতে। ডন-বৈঠক দিচ্ছে কয়েকটা ছেলে। কথাবার্তায় বোঝা গেল, ওটা একটা ব্যায়াম সমিতি। আমাকে ওদের মধ্যে কেউ কেউ লক্ষও করেছে, জানে আমি ননী জেঠুর বাড়িতে থাকি। যাক, অবশেষে কথা বলার মতো কিছু মানুষ পেলাম। শুধু মানুষ নয়, মনের মতো মানুষ। ওদের মধ্যে অনেকেই যুগান্তর দলের কর্মী। ওদের সূত্রেই চিনলাম ওদের বন্ধুদের, চিনলাম শিবপুর পাবলিক লাইব্রেরি, ভীমদার তেলেভাজার দোকান, নানা আড্ডার জায়গা, ছোটখাটো বোমা তৈরির প্রাক্তন কারখানাও দুয়েকটা। প্রাক্তন কেন? গান্ধিজির উপর খুব একটা ভরসা নেই ওদের কারো, কিন্তু বড়রা বলেছেন, এখন কিছুদিন চুপচাপ থাকো। গান্ধি বলেছেন এক বছরের মধ্যে স্বরাজ আসবে, এক বছর সময় দাও গান্ধিকে। কাছেই থাকেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কংগ্রেসের জেলা সভাপতি হলেও যুগান্তরের ছেলেদের সঙ্গে খুবই সদ্ভাব তাঁর। তিনিও ওই একই কথা বলেছেন।
সত্যি কথা বলি কাজীদা, আস্তে আস্তে কেমন ভালই লেগে গেল শিবপুরকে। ননী জেঠুর অনুমতি নিয়ে আরও দুয়েকটা বাচ্চাকে পড়াই, হাতখরচের টাকা উঠে যায়। নানা মানুষের সঙ্গে মিশি, সাহিত্য সভায় যাই, লাইব্রেরিতে কিছু কাজের দায়িত্ব পাই, গান্ধি বিফল হলে যে লড়াই লড়তে হবে, তার আঁচ গায়ে লাগে, মিছিল-মিটিংয়েও যাই। পিংলার সঙ্গে তো সেইভাবেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল একদিন। করাচির কথা, আপনার কথা সব শুনেছি। একদিন বলল আপনার ‘নবযুগ’-এর কথা। মাঝেমধ্যে গঙ্গা পেরিয়ে ‘নবযুগ’ কিনেও আনে। সেই ‘নবযুগ’ পড়িয়েছি একজনকে। আপনার সঙ্গে তিনি আলাপ করবেন। কাল আসবেন একবার?
পরের দিন শিবপুরের ট্রাম টার্মিনাসে ওদের অপেক্ষা করবার কথা ছিল সকাল সাড়ে আটটায়। ওরা যখন পৌঁছল, নজরুলের ঘড়িতে তখন আটটা বেজে পঁচিশ মিনিট। শচী দাঁড়িয়েইছিল, ওদের বলল, কাল যে তোমরা সিঙাড়া-জিলিপির ব্রেকফাস্ট করেছিলে ওটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। হাওড়া-কলকাতায় যত মিষ্টির দোকান আছে প্রায় সবাই তারা সকালবেলা সিঙাড়া-জিলিপি ভাজে। আজ তোমাদের খাওয়াব তেলেভাজা। এ একেবারে হাওড়ার নিজস্ব। এসো আমার সঙ্গে।
মিনিট দশ-পনের এমন সব রাস্তা দিয়ে ওদের হাঁটাল শচী যে নজরুলের ধারণাও ছিল না রাস্তা এরকম হতে পারে। পাশাপাশি দু’জনের বেশি হাঁটতে পারে না এমন একটা গলি দিয়ে খানিকটা হাঁটার পর ওরা বেরোল যে রাস্তায় সেটা দিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি আর একটা মানুষ হয়তো টেনেটুনে হাঁটতে পারবে একসঙ্গে। মিনিট খানেক এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে আবার আগের সরু রাস্তাটার মতো একটা রাস্তায় ঢোকবার আগেই একটু দূরে আরও একটা একই রকমের সরু গলির দিকে আঙুল দেখিয়ে শচী বলে, ওই রাস্তাটায় কে থাকেন জানো? শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আমরা অবিশ্যি ওটায় ঢুকছি না। এই রকম নানা প্রস্থের নানা রাস্তার গোলকধাঁধা দিয়ে দশ-পনের মিনিট হেঁটে ওরা পৌঁছল একটা অপেক্ষাকৃত চওড়া রাস্তার উপর প্রায় ভগ্নদশার এক দোতলা বাড়ির সামনে। বাড়িটার সামনে একটা পুরোনো টিনের সাইনবোর্ড। অতি দুর্দশাগ্রস্ত সাইনবোর্ডে বহু জায়গায় রং-চটা অক্ষরে লেখা ‘ভীমদার তেলেভাজা’। সাইনবোর্ডের নিচে একটা ঘর। দেখে মনে হয় এক সময়ে চওড়া একটা দরজা ছিল ঘরটার বাইরের দিকে, সেটাকে খুলে নিয়ে, সেই জায়গায় রাখা হয়েছে একটা তেলচিটে কাচের শো-কেস, এবং সেই শো-কেসে সাজানো নানারকমের তেলেভাজা। শো-কেসটার পিছনেই গেঞ্জি পরিহিত মাঝবয়সী একজন বসে আছে, মনে হয় মালিকই হবে। একটু পিছনে একটা উনুন, তাতে একটা কড়া চাপানো। মেঝেতে নানারকমের খাদ্য-উপাদান। একটা গামলায় বেসন গোলা, এটা-ওটা নানা মশলা নানা টুকিটাকি ছড়িয়ে ছিটিয়ে। উবু হয়ে বসে বঁটি পেতে এক যুবক অনেক রকমের সবজি ফালা-ফালা করে কেটে কয়েকটা বারকোশে সাজিয়ে রাখছে। উনুনের সামনে বসে একজন লোক কাটা সবজি একটা একটা করে বেসনে ডুবিয়ে কড়ায় গরম তেলে ছাড়ছে সেগুলো। মালিকের সামনে গিয়ে শচী বলল, আমরা এসে গেছি ভীমদা।
চওড়া হাসি ভীমদার মুখে, বলে, দু’জনের মধ্যে নজরুল সাহেব কোন জন?
হেসে হাত তুলে নমস্কার করে নজরুল, আমিই।
বেশ বেশ, ভীমদা প্রায় বিগলিত। বলে, সে আপনাকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, চেহারায় জ্যোতিই অন্যরকমের। তারপর শচীকে বলে, ওঁদের নিয়ে দোতলায় চলে যাও, আমি আসছি।
দোকানটার পাশেই একটা প্যাসেজের মতো। আসুন কাজীদা, বলে প্যাসেজটা দিয়ে খানিকটা হেঁটে বাড়ির প্রায় শেষ প্রান্তে যে সিঁড়িটা, সেটা দিয়ে সোজা উঠে যায় শচী, পিংলা আর নজরুল পিছনেই। উঠেই একটা বারান্দা, ইংরিজি ‘এল্’- এর আকারে। রেলিং দেওয়া। এই সকালবেলার রোদ্দুর দেখে বোঝা যাচ্ছে বারান্দার একটা দিক পুবের দিকে খোলা, যেদিকটায় ওরা দাঁড়িয়ে এখন, অন্যটা দক্ষিণে। ‘এল’-এর দুটো দিকেই দু’খানা করে ঘর। প্রথম ঘরটা, ওদের ঠিক বাঁ-দিকে যেটা, সেটাতে একটা বড় তালা। তার পাশের ঘরটায় ওরা ঢোকে শচীর পিছন পিছন।
বেশ বড়সড় ঘর, বেশিটাই ফাঁকা। একটা তক্তপোশ, তার উপর তেল চিটচিটে একটা বালিশ। নিচে একটা শতরঞ্জি, তার উপর তোষকে মোড়া একটা বিছানা। তার মানে এ ঘরটায় রাত্তিরে শোয়া হয়, তারপর বিছানাটাকে রাখা হয় গুটিয়ে। নজরুল মেঝেতে পা রেখে তক্তপোশে বসে, পিংলা আর শচী নিচে।
এই বাড়িতে কে থাকে? আর পাশের ঘরটায়? যেটাতে তালা দেওয়া দেখলুম?
আপনার প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি, কিন্তু দেওয়া যাবে না। ভীমদা দেবে। ওই উত্তরটুকু দেওয়া ভীমদার কাছে অনেক বড় ব্যাপার।
ঠিক আছে, উত্তরটা না হয় ভীমদার কাছ থেকেই আমরা পরে শুনব, বলে পিংলা। আপাতত এটা তো বল, তুমি যেখানে থাক সে জায়গাটা এখান থেকে কত দূরে।
আমি কাছেই থাকি, এখান থেকে আট-দশ মিনিটের রাস্তা। বলেইছি তো ননী জেঠুর বাড়িতে তিনটে বাচ্চাকে পড়াই। তিনটে বাচ্চা, ক্লাস থ্রি, ফোর, ফাইভ।
শচীর কথা শেষ হতে না হতেই যে ছেলেটি বঁটি দিয়ে সবজি কাটছিল, সে একটা বারকোশের নিচে এক হাত এবং অন্য হাতের আঙুল দিয়ে বারকোশটার একটা কানা ধরে ঘরে ঢোকে। তার পিছনে হাসিমুখে ভীমদা। বারকোশটার উপর আটখানা ঠোঙা – চারটে বড়, চারটে ছোট। তক্তপোশে নজরুলের ঠিক পাশে বারকোশটা রেখে ছেলেটা বেরিয়ে আসবার জন্যে পা বাড়ায়। ভীম হেঁকে বলে, একটু পর এক কেটলি চা আর গোটা আট-দশ মাটির খুরি রেখে যাস।
ছোট ঠোঙাগুলোয় ছিল মুড়ি, আর বড়গুলোয় রাজ্যের তেলেভাজা।
দেখেশুনে নজরুল বলে, এতগুলো তেলেভাজা কে খাবে?
কেন, আমরা সবাই, ভীমদার জবাব।
এতগুলো তেলেভাজা, পেটে ধরবে? আপনার তো দেখছি উলটো ব্যবস্থা। কোথায় ছোট ঠোঙায় তেলেভাজা থাকবে আর বড়টায় মুড়ি, তা না হয়ে দু’চার কণা মুড়ি আর গাদাগুচ্ছের তেলেভাজা! এমনটা হয় নাকি?
হয় যে, সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। পেটে ধরবে কিনা বললেন তো, শুনুন, পেটের কথায় পরে আসছি। আগে জিভ। তেলেভাজাগুলোর যে-কোন একটাতে একটা কামড় লাগিয়ে তো দেখুন, জিভ যদি রাজি থাকে, পেট না ধরিয়ে যাবে কোথায়? আসলে ব্যাপারটা কী জানেন তো, হাওড়া-মেদিনীপুরে আমরা মুড়ি দিয়ে তেলেভাজা খাই, আপনাদের মতো তেলেভাজা দিয়ে মুড়ি নয় – জবাব দেয় ভীমদা।
আর তা ছাড়া, যা জ্যোতি আপনার চেহারার, সেটা ফুটিয়ে তুলবে তো পেটই, ফুট কাটে শচী।
নজরুল একটু হাসে, তারপর একটা বেগুনিতে কামড় লাগিয়ে বলে, আহা, তারপর পিংলাকে উদ্দেশ্য করে বলে, এই সব থাকতে হাওড়ার লোক ভাতরুটিও খায়!
খাবারকে কেন্দ্র করেই আড্ডাটা শুরু হল ঠিকই, কিন্তু এক ফাঁকে শচী বলে ভীমদাকে, কাজীদা জিজ্ঞেস করছিল, এ বাড়িতে কারা থাকে। আর পাশের ঘরটাতেই বা তালা কেন জানতে চাইছিল।
ভীমদা বললো, এখন আমি একাই থাকি, আগে আমার বউও থাকত। সে সব বলব আপনাকে, আগে জলখাবারটা খেয়ে নিন, তারপর পাশের ঘরে নিয়ে যাব আপনাদের।
পাশের ঘরে স্বপ্নিল চোখের এক যুবকের ছবি, সাদা কলার, কালো কোট, খোপ কাটা একটা চাদর তার উপর। চোখে কিন্তু শুধুই স্বপ্ন নয়, মানুষটি যে দৃঢ়চেতা এবং অমিত স্বাস্থ্যের অধিকারী তার চোখ আর মুখাবয়ব সে কথাও বলে দেয়। ছবিতে একটা নতুন মালা, মনে হয় আজই পরানো হয়েছে। মিষ্টি একটা গন্ধ ঘরে, মনে হল ধূপ জ্বালানো হয়েছিল, সেটা শেষ হয়ে গেছে এখন। ছবিটা দেখিয়ে জোড়া হাত দুটো কপালে ঠেকিয়ে ভীমদা বললো, আমার একমাত্র দেবতা। এই ঘরেই থাকতেন। সকালবেলায় এই ছবিতে একটা মালা পরিয়ে একটা ধূপ জ্বালিয়ে, তারপর চা খাই। এরকমটা চলছে গত পাঁচ-ছ বছর। কার ছবি চিনতে পারছেন?
শচী নীরব থাকে, নিশ্চয়ই ছবিটা তার চেনা, কিন্তু কথা না বলার অঙ্গীকার তার। নজরুল অথবা পিংলা – কেউই চিনতে পারে না ছবিটা।
চিনলেন না তো, আসলে খুব বেশি মানুষ চিনতে পারবে না এই মানুষটাকে। মানুষটা চাইতও তাই, তাকে যেন কেউ চিনতে না পারে। ইনি বাঘা যতীন।
বাঘা যতীন? আর আমরা চিনতেও পারলুম না! দুর্ভাগা আমরা, বলে পিংলা, বালাসোরে বাঘা যতীনের মৃত্যুর পর টেগার্ট সাহেব বলেছিলেন, বাঘা যতীন যদি ইংল্যান্ডে জন্মাতেন তাহলে ইংল্যান্ডবাসী ট্র্যাফালগার স্কোয়ারে নেলসনের মূর্তির পাশে তাঁর মূর্তি তৈরি করে রাখত।
হতে পারে, ভীম বলেন, কিন্তু বাঘা যতীন নিজেই চাইতেন না কেউ তাঁকে চিনতে পারুক, কারণ তাঁর নিজের কাজে বাধা পড়ত তাহলে। আর চিনত না বলেই তিনি এই বাড়িতে উনিশশো দশে লুকিয়ে থাকতে পেরেছিলেন।
কিন্তু এ বাড়িতে বাঘা যতীন এলেন কেন? কীভাবে এলেন?
কীভাবে এলেন? শুনবেন সেই কাহিনি? বলতে থাকে ভীমদা, আমার বাড়ি কিন্তু আসলে হাওড়ায় নয়, আমরা সুন্দরবন অঞ্চলের লোক, গোসাবার। গোসাবা বলছি বটে, কিন্তু গোসাবার লোকও ঠিক নই আমরা, গোসাবায় এসেছিলুম মেদিনীপুর থেকে। সেই থেকে মেদিনীপুরে আর ফিরিনি, গোসাবারই লোক হয়ে গেছি।
মেদিনীপুর থেকে গোসাবায় এলেন কেন? – পিংলা প্রশ্ন করে।
যে কারণে মানুষ তার পুরোনো জায়গা, পিতৃপুরুষের জায়গা, চিরকালের মতো ত্যাগ করে চলে যায় অন্য দেশে। নিজের জায়গায় অন্নবস্ত্র জুটছে না, তো অন্য জায়গায় যাও, যেখানে গেলে হয়তো জুটতেও পারে! আচ্ছা, আপনারা ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জি নামের কোন সাহেবি সদাগরি প্রতিষ্ঠানের নাম শুনেছেন?
বোঝা গেল ওরা নাম শোনেনি।
খুব বড় ব্যাবসা। জাহাজে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় মাল পাঠানো, মানুষজনকে পাঠিয়ে দেওয়া, এই সব এদের ব্যাবসা। সে আমলে বিলেত আমেরিকা বা দূর দেশে যেত যারা, তাদের সবাইকেই টিকিট কিনতে যেতে হত ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জিতে। আর, সে-আমলই বা বলি কেন, এখনও তো প্রায় তা-ই! স্কটিশ কোম্পানি, এদেশে কলকাতা আর বোম্বাইতে এদের মস্ত অফিস। যে সময়ের কথা বলছি তখন এই কোম্পানির মালিকদের মধ্যে একজন ছিলেন হ্যামিলটন। স্যার ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিলটন। বাংলা সরকারের কাছ থেকে উনিশশো তিন সালে তিনি নানা দ্বীপ মিলিয়ে মোট দশ হাজার একর জমি কেনেন সুন্দরবনে বাঘের দাপট যে-সব জায়গায়, সেই অঞ্চলে। আর এই দশ হাজার একরকে বাড়াতে লাগলেন তিনি জলাভূমিকে নানান কায়দায় বাড়িয়ে। তাঁর ইচ্ছে, বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে রাজি যারা তাদের নিয়ে তৈরি করবেন তাদেরই রাজত্ব। সেই সময় মেদিনীপুর হাওড়া আর খুলনা থেকে নতুন করে জীবন শুরু করতে চায় এমন বেশ কিছু সাহসী কর্মঠ মানুষ আর তাদের পরিবার তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে এখানে স্থায়ীভাবে বাস করতে আসে। গোসাবা রাঙাবেলিয়া আর সাতজেলিয়া এই সব দ্বীপেরই অংশ। মেদিনীপুর থেকে যারা এসেছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিল পাণ্ডু লস্কর আর তার পরিবার। পরিবার মানে তার স্ত্রী রমা, আর পাঁচ ছেলে যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল আর সহদেব। পাণ্ডু গোসাবায় এসেই তার বুদ্ধি আর পরিশ্রমের ক্ষমতার জোরে সাহেবের চোখে পড়ে যায়।
এর মধ্যে মুড়ি-তেলেভাজা শেষ, ভীমদার নির্দেশ অনুযায়ী এক কেটলি চা এবং কয়েকটা মাটির খুরিও হাজির। সবাইয়ের খুরিতে খানিকটা করে চা ঢেলে নিজের খুরির চা এক নিশ্বাসে শেষ করে খুরিটা আরেকবার ভরে নিয়ে আবার কথা বলতে শুরু করে ভীমদা। শুরুর আগে শুধু শচীকে বলে, চা কমে এলেই নিচে গিয়ে একবার বলে আসবে, এসে যাবে। নিজের খুরিতে আরেকবার চুমুক দিয়ে ভীমদা বলে, ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকীর নাম তো সবাই শুনেছ। ওরা মেরেছিল কাকে?
পিংলা বলে, মজফ্ফরপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি ভেবে ভুল করে ওরা অন্য একটা গাড়িতে বোমা মারে। তাতে কেনেডি নামের একজন ব্যারিস্টারের মেয়ে আর স্ত্রী আহত হয়। মারাও গেছিল তারা।
এই কেনেডি কেমন লোক ছিল জানা আছে?
মুখ চাওয়াচায়ি করে শ্রোতা তিনজন।
ভারতপ্রেমী, বলে ভীমদা। ‘ত্রিহুত ক্যুরিয়র’ নামে একটা ইংরিজি কাগজ চালাত সে। ত্রিহুত বুঝলে? যুক্তপ্রদেশের বর্ডার থেকে বাংলার বর্ডার পর্যন্ত, মানে ছাপড়া থেকে দ্বারভাঙা/মিথিলার শেষ অবধি বিহারের যে অঞ্চল, তার নাম ত্রিহুত। সেই ত্রিহুতের পুরো প্রশাসন চলে যেখান থেকে, সেই শহরের নাম মজফ্ফরপুর। বুঝতেই পারছ, সাহেব-সুবোর ভিড় গজগজ করে সেখানে। ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকীর ঘটনার অনেক আগে থেকেই ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনা ছিল এই শহরের এই খবরের কাগজটির প্রধান উপজীব্য। তা-ও আবার চালাতেন এক সাহেব ব্যারিস্টার! তবে যে খবরটা অনেকেরই জানা নেই তা হল, এই সাহেবের সেক্রেটারি যে ছিল, তখন তার নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তখন টাইপ মেশিন এ দেশে নতুন এসেছে, শর্টহ্যান্ড জানা লোকও বেশি ছিল না। যে গুটিকয়েক লোক জানত শর্টহ্যান্ড, যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তাদের অন্যতম। কলেজে পড়তে পড়তে এই বিদ্যেটাও শিখেছিল বাঘা যতীন। কেনেডি সাহেবের প্রভাব যতীনের উপর আজীবন ছিল। সাহেবের উৎসাহে সে মজফ্ফরপুরে ফুটবল এবং শরীরচর্চার ক্লাব তৈরি করে স্থানীয় তরুণদের সংগঠিত করে। এ সব অবিশ্যি ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকীর ঘটনার অনেক আগের।
যতীন যখন মজফ্ফরপুরে, তখন তার মা দেশের বাড়ি ঝিনাইদাতে কয়েকজন কলেরা রোগীর সেবা করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। খবর পেয়ে যতীন ফিরে যায় দেশে। ততদিনে তার মা আর নেই। তারপর আর মজফ্ফরপুরে ফিরে আসেনি যতীন। বাংলা সরকারের ফিনান্স সেক্রেটারি তখন হেনরি হুইলার, তিনি কেনেডি সাহেবের বন্ধু, সাহেব তাঁর কাছে যতীনের নাম সুপারিশ করেন। ফিনান্স সেক্রেটারির ব্যক্তিগত সচিবের কাজ পেয়ে যায় সে।
এই সময়টায় যতীন কুস্তি শেখে, অরবিন্দের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়, এবং এ যাবৎ বাংলায় যে ধরনের সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী সংগঠন গড়ে উঠেছিল নানা জায়গায়, তাদের কর্মকাণ্ডে সে উৎসাহী হয়ে পড়ে। সারা বাংলায় নানা নামে ভিন্ন ভিন্ন নানা পরিচয়ে অনুশীলন সমিতির নানা শাখা-সংগঠন গড়ে তোলার কাজে নিজেকে সে নিয়োজিত করে। এই কাজ করতে করতেই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই ধরনের সংগঠনের উপযোগিতার বিষয়ে তার মনে অনেক রকমের প্রশ্ন আসতে শুরু করে। অনেক দ্বিধা, অনেক দ্বন্দ্ব। স্বাধীনতার লড়াই একটা লড়াই, একটা যুদ্ধ, এবং যে কোনও যুদ্ধে জয়লাভের জন্যে সংগঠনের যে প্রস্তুতি লাগে, স্বাধীনতার যুদ্ধেও তার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। অস্ত্র চাই, অস্ত্রশিক্ষা চাই, ভিন্ন ভিন্ন স্তরের সেনাদল চাই, এবং বিভিন্ন স্তরে দেশের সাধারণ মানুষের এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ চাই, খানিকটা গেরিলা যুদ্ধের মতো। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মতো বৃহৎ শক্তির মোকাবিলা করতে হলে আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং সামরিক সাহায্যও চাই। শুধু তা-ই নয়, ব্রিটিশ সেনাদলে যে ভারতীয় সৈন্যরা আছে, তাদের একটা অংশকেও দেশের মুক্তির এই লড়াইয়ে টেনে আনতে হবে। এ ছাড়াও যুদ্ধে আহত যারা হবে, অথবা প্রিয়জনকে যাদের পরিবার হারাবে, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করাও চাই।
গোপনে এবং প্রকাশ্যভাবে অনেক রকমের কাজে জড়িয়ে পড়ে বাঘা যতীন। সবটা না জানলেও হুইলার সাহেব জানতেন তাঁর এই তরুণ সচিবটি নানা সমাজসেবামূলক কাজে জড়িত। প্লেগের রোগীর সেবা থেকে নৈশ বিদ্যালয় চালানো – যে কাজেই সে লাগতে পারে সেখানেই সে দৌড়োয়। খুবই স্নেহ করতেন তিনি তাকে। এমনকি, তাকে ডেকে একবার তিনি বললেন যে তার কিছু কিছু ভাল কাজের তিনি নিজেও অংশীদার হতে চান। বাঘা যতীন হুইলার সাহেবকে বললেন, আমি কিছু ছেলেকে চিনি যারা অত্যন্ত মেধাবী, বিদেশের ভাল ভাল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে তারা দেশের অনেক ভাল কাজ করতে পারবে, অনেককে সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু এরা এতই গরিব যে এখানকার পড়াশোনার খরচ চালাবার জন্যেই এদের স্থানীয় বন্ধুবান্ধবদের সাহায্য নিতে হয়। এরা নিজেদের যোগ্যতাতেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে, কিন্তু অর্থাভাবে এদের মেধা কোন কাজেই লাগবে না। আপনি কি এদের কয়েকজনের জন্যে কিছু স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন?
কিছুক্ষণ আগেই যে স্যার ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিলটনের কথা বলছিলুম, এই হ্যামিলটন সাহেব ছিলেন ফিনান্স সেক্রেটারি হেনরি হুইলারের বিশেষ পরিচিত। সাহেব বললেন, আমাকে কয়েকদিন সময় দাও। কয়েকমাসের মধ্যেই হ্যামিলটন সাহেবের বদান্যতায় প্রথমে তারকনাথ দাস, তারপর সত্যেন সেন আর শৈলেন ঘোষ এবং আরও কিছু ছেলের স্কলারশিপের ব্যবস্থা হল। বিদেশে গেল ছেলেরা পড়তে, ভাল করে লেখাপড়া তো করতেই হবে, সঙ্গে আরও নির্দেশ, যেখানে যে পড়তে যাচ্ছে সেখানেই তাকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বার্তা পৌঁছে দিতে হবে, সহানুভূতি আদায় করতে হবে, আর বিশেষ চেষ্টা করে শিখে আসতে হবে বিস্ফোরক প্রস্তুতির কায়দাকানুন।
এই সময়েই হ্যামিলটন সাহেবের কাছ থেকে খানিকটা জমি লিজ নিয়ে যতীন তৈরি করলেন Young Bengal Zamindari Urban Cooperative; যাঁদের পুনর্বাসনের কথা বলছিলুম, জমিনদারি কোঅপারেটিভ তাঁদের থাকা, আর চাষবাসের ব্যবস্থা করল। মূলত ধানের চাষ আর মাছ ধরা। শুধু তা-ই নয়, তৈরি হল স্কুল। ঠিক নাইট স্কুল নয়, শেষ দুপুরে শুরু হত ক্লাস, চলত ঘণ্টা দুয়েক। ছোট-বড় সবাইকেই বুঝিয়ে-বাজিয়ে ভর্তি করে নিলেন যতীন। একই ক্লাসে ছোটদের সঙ্গে বড়রাও পড়ে। মাস্টাররা শুধু বদলিয়ে যায়, একটানা বেশিদিন যতীন থাকতে দিতেন না কোন মাস্টারকে, এক দল আসত আর এক দল যেত। বুঝতেই পারছ এই মাস্টার কারা?
হ্যামিলটন সাহেব নজর রাখছিলেন যতীনের কাজকর্মের উপর। তিনি তো আগে থেকেই অনেককে আনিয়েছিলেন খুলনা, মেদিনীপুর, হাওড়া আর বিহার-টিহারের থেকেও, আমাদের পরিবারও এসেছিল তখনই। বলেইছি আগে, আমার বাবাকে সাহেবের ভারি পছন্দ। নতুন-আসা মানুষদের উপর বাবাকে নজরদারির দায়িত্ব দিলেন সাহেব।
জমিনদারি কোঅপারেটিভের বাসিন্দাদের সঙ্গে বাবার খুব ভাব হয়ে গেল। বাবা তো হ্যামিলটন সাহেবের নিজের লোক, সাহেব অনেক জমি দিয়েছে বাবাকে; অন্নের অভাবে নিজের দেশ ছেড়ে এসেছিল বাবা, সে অভাব সাহেব রাখেননি, কিন্তু ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা? আমার দাদা যুধিষ্ঠির তখন রীতিমতন জোয়ান, আমিও তাই। দাদার লেখাপড়ায় টান ছিল না কোনোদিনই, আমি কিন্তু মেদিনীপুরে পাঠশালার পড়া শেষ করে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলুম। তোমরা জানো কিনা জানি না, মেদিনীপুরে অনেক দিন ধরেই ভাল ভাল স্কুল আছে, সেখানকার মাস্টারমশাইরা ছেলে মানুষ করতে ওস্তাদ। বাবার আফসোস ছিল আমাকে আর ছোট তিনটেকে পড়তে পাঠাতে পারছে না কোথাও। জমিনদারি কোঅপারেটিভের স্কুল দেখে বাবা তো পাগল হবার জোগাড়। সাহেবকে বাবা বলল, তার ছেলেদের স্কুলে পড়ার ব্যবস্থা করে দিতেই হবে। বাবার সঙ্গে সাহেব একদিন এল স্কুল দেখতে, আর কপাল দেখো, সেদিনই সেখানে ছিল যতীন নিজে।
কোঅপারেটিভের ব্যাপারে যতীনের সঙ্গে অনেক কথা হল সাহেবের। সাহেব তো কোঅপারেটিভই গড়তে চায়। এখানে সে ধান-ভাঙার কল বসাবে, শুকনো মাছের কারখানা করবে, এমনকি নোনা জলের নুন কাটিয়ে মিষ্টি জল তৈরিও করবে। সে অপেক্ষা করছে দুটো কারণে। জমি আরও অনেক অনেকটা বাড়াতে চায় সে, যে দেশে কাজ করবার মানুষ আছে এত, সে দেশে জমির অভাব কি? এই অগাধ সমুদ্র আর জলা থেকে জমি বের করে আনা কোন কঠিন কাজই নয়। কিন্তু বাঘ? সাহেব বাঘ মারতে চায় না, ভয় পাইয়ে বাঘদের একটু দূরে পাঠিয়ে দিতে চায়। তাই, প্রায় প্রতিদিনই রাতের বেলা সে বন্দুক ফাটায়। সে একা নয়, তার লোকরাও তার সঙ্গে থাকে। ফাঁকা আওয়াজ করে তারা। ভয় পাইয়ে বাঘকে একটু দূরে যদি পাঠানো যায়! সাহেব যতীনকে বলল, তার টাকা আছে অগাধ, সে নিজে কোনো টাকা চায় না। তার এই জমিদারি হবে কোঅপারেটিভ জমিদারি। এখানকার মানুষই হবে এখানকার সব জমির মালিক।
শেষ পর্যন্ত পূর্ণ হল বাবার সাধ। আমরা চার ভাই-ই স্কুলে ভর্তি হলুম। ভর্তি হলুম ঠিকই, কিন্তু দুয়েকদিন পরেই বোঝা গেল ওখানকার স্কুলে তখন যা পড়ানো হচ্ছে, সে সবই আমার পড়া। বাঘা যতীন বললেন, তোকে স্কুলে আসতে হবে না, আমি যখন আসব, আমিই তোকে পড়াব তখন। তাতে একটা লাভ হল। বাঘা যতীন হয়ে গেলেন আমার যতীন দাদা। যতীন দাদা গোসাবায় এলেই আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমার মায়ের হাতে তেলেভাজা খেতে ভারি ভালোবাসতেন। মাকে ডাকতেন খুড়িমা, আর বাবাকে খুড়োমশাই। মাকে একবার বললেন যতীন দাদা, দেখ খুড়িমা, তোমার যুধিষ্ঠির তার বাপের ছেলে, খুড়োমশাই নিন তাকে। ছোট তিনটি, অর্জুন নকুল আর সহদেব থাকল তোমার। ভীমকে নিলুম আমি। কী খুড়িমা, দিলে তো?
বাঘ তাড়াবার জন্যে বন্দুক ছোঁড়ার কথাটা খুব পছন্দ হয়েছিল যতীন দাদার। এই সুযোগ, ছেলেদের বন্দুক ছুঁড়তে শেখাবার এত ভাল জায়গা আর পাওয়া যাবে না। সাহেব তো বন্দুক ছোঁড়েই, তার সঙ্গে ছেলেদের বন্দুকের আওয়াজও যদি হয়, কেউ ধরতেও পারবে না। একবার গোসাবায় এসে যতীন দাদা বলল, নুর খাঁ নামে কাউকে চিনিস? আমি চিনতুম না, সে কথাই বললুম। বলল, বাইরের লোক যারা আসে এখানে – অনেকেই তো আসে, তাই না? – কেউ মাছ-টাছ কিনতে আসে, কেউ বেচতে আসে কিছু, তাদের কাছে গোপনে খোঁজ নিস তো, বন্দুক-টন্দুকের কারবার করে লোকটা, কোথায় পাওয়া যায় তাকে।
শেষ পর্যন্ত নুর খাঁর খোঁজ পাওয়া গেল। কোথায় তাকে পাওয়া যায় জানলুম, জানালুমও দাদাকে। কিছুদিন পর, তখন যতীন দাদা এসেছে গোসাবায়, ঠিক সন্ধের মুখটায় একজন অচেনা লোক এল স্কুলে। তার সঙ্গে কোথাও গেল যতীন দাদা, বলে গেল পরের দিন ফিরবে। ফিরে এলও পরের দিন, কিন্তু কোথায় ছিল সে রাতে, বলল না কিছু। তারও পরের দিন আর একজন লোক একটা কাঠের বাক্স দিয়ে গেল স্কুলে এসে যতীন দাদার হাতে। এর পর থেকে শুরু হল একটা নতুন ঘটনা। স্কুলে যে মাস্টাররা আসে, তাদের নিয়ে যতীন দাদা চলে যায় অনেক দূরের একটা দ্বীপে। সেখানে প্র্যাকটিস করা হয় বন্দুক চালানো। আমাকেও কয়েকবার নিয়ে গেছে। বন্দুক ছুঁড়েছি আমিও।
যতীন দাদা এক কাজে বসে থাকার লোক নয়। আরও একটা কাজ যে চলছিল একই সঙ্গে সেটা জানতে পারলুম কয়েকদিন পর। যে সময়ের কথা তোমাদের বলছি, সেই একই সময়ে যতীন দাদার বড় ছেলে অতীন্দ্র মাত্র তিন বছর বয়েসে মারা গেছে। যতই শোক পান সে কথা কখনও প্রকাশ করেননি দাদা কারো কাছে। কিন্তু বাড়ির লোকের শোকটা তো অগ্রাহ্যও করা যায় না। স্বামী ভোলানন্দ গিরির পরামর্শে দিদি বিনোদবালা আর স্ত্রী ইন্দুবালাকে মনের শান্তি ফিরে পাবার জন্যে দেওঘরে রেখে এলেন একটা বাড়ি ভাড়া করে। ওই যে বললুম এক কাজে বসে থাকার লোক দাদা নয়। একই সময়ে দেওঘরে বারীন ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুললেন এক বোমার কারখানা। বোমা বানাবার কায়দাকানুন এখান থেকে খানিকটা শিখে, উনিশশো আট সালে ফ্রান্স থেকে বোমা তৈরির নানা কৌশল শিখে আসা হেমচন্দ্র কানুনগোকে সঙ্গে নিয়ে, মানিকতলার মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে বারীনের নতুন বোমা কারখানা তৈরি হল। পুলিশ তদন্ত করে জানল যে, মজফ্ফরপুরে ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকীর বোমা এই কারখানারই বোমা। কারখানা আক্রমণ করল পুলিশ। কয়েকদিন ধরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে কারখানায় লুকোনো যাবতীয় জিনিস উদ্ধার করা হল। সেই সময়ে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের নানা কর্মীর বিরুদ্ধে নানারকমের মামলা চালাচ্ছিল পুলিশ, সেই সব মামলা আর মানিকতলার ব্যাপারে যাদের গ্রেপ্তার করা হল, তাদের সবাইকে মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশজন বিপ্লবী তরুণের বিরুদ্ধে উনিশশো আট সালের মে মাসে শুরু হল বিখ্যাত আলিপুর বোমা মামলা।
আলিপুরের এই বিখ্যাত মামলা সম্বন্ধে তোমরা নিশ্চয়ই অনেক কিছু জানো, বলতে থাকে ভীমদা, আমি সে-সব কথা নতুন করে বলতে চাই না। এই মামলায় অরবিন্দ ঘোষ আর বারীন ঘোষকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানোর মতলব ছিল পুলিশের। অন্তত এই দু’জনকে ঝোলাতেই হবে, এই ছিল পুলিশের পণ। পুলিশের ধারণা হয়েছিল, অরবিন্দ ঘোষের ফাঁসি – এমনকি বারীনকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র অরবিন্দর ফাঁসিই – বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের উপর চরম আঘাত হানতে পারে। পুলিশের সেই আশা অবিশ্যি পূরণ হয়নি শেষ পর্যন্ত। চিত্তরঞ্জন দাশের মতো বাঘা ব্যারিস্টার বেকসুর খালাস করিয়েছিলেন অরবিন্দকে, বারীনের ফাঁসির হুকুমও রদ হয়ে দ্বীপান্তর হয়। অবিশ্যি এমনটা নয় যে কারোই ফাঁসি হয়নি। সত্যেন বসু আর কানাইলাল দত্তর ফাঁসি আটকানো যায়নি। কিন্তু পুলিশের আফসোস থেকেই গেল, অরবিন্দ-বারীনের উপর চরম আঘাতটা হানতে পারল না!
আলিপুর বোমা মামলা আরও একটা কারণে জরুরি। এই মামলার ফলে ব্রিটিশ সরকারের পা-চাটা এক ভারতীয় পুলিশের চরিত্রের উন্মোচন হয়। এর নাম ইনস্পেক্টর শামসুল আলম। আলিপুর মামলার সময় এ ছিল বাংলা পুলিশের ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট। ওই যে বললুম সত্যেন বসু আর কানাইলাল দত্তর ফাঁসি আটকানো গেল না, তার কারণ এই শামসুল আলম। মামলায় যত যুবক অভিযুক্ত হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন ছিল নরেন গোঁসাই। আদালতে মামলা চলাকালীন সে রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়ে যায়, অতএব অন্য অভিযুক্তদের থেকে আলাদা করে তাকে বিশেষ সুরক্ষা দিয়ে প্রেসিডেন্সি জেলেরই অন্য একটা অংশে রেখে দেওয়া হয়। এতে অভিযুক্ত বন্দিরা একটু অস্বস্তিতে পড়ে। নরেন এতদিন সবায়ের সঙ্গে কাজ করেছে, সে অনেক গোপন কথা জানে, অনেককে চেনে। তার সাক্ষীতে অরবিন্দ-বারীনের বিপদ বেড়ে যেতে পারে। অতএব সত্যেন আর কানাই ঠিক করে তারাও পুলিশকে জানাবে যে তারা রাজসাক্ষী হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে পুলিশ তাদেরও সুরক্ষা দেবার জন্যে সবাইয়ের থেকে সরিয়ে নরেনের সঙ্গেই তাদের থাকার ব্যবস্থা করবে। সেই সুযোগে নরেনকে গুলি করে মারবে তারা। যে কথা সে-ই কাজ। জেলখানার এক কর্মচারীকে ঘুষ দিয়ে বারীন একটা রিভলভার আনাল জেলের মধ্যে। নরেনের সেলে থাকবার জন্যে যখন সদ্য-রাজসাক্ষী হতে রাজি হওয়া সত্যেন আর কানাইকে নিয়ে যাওয়া হল, কানাই তখন গুলি করে নরেনকে। লক্ষ্য ব্যর্থ হয়। ড্রেনে পড়ে যায় আহত নরেন। তার পিছনে দৌড়োতে থাকে কানাই-সত্যেন। কারারক্ষীদের হাতে ধরা পড়ে তারা।
পরে আদালতে পেশ করার জন্যে এই মামলাটি গুছিয়ে সাজায় শামসুল আলম। কানাই-সত্যেনের ফাঁসি হয়।
মজফ্ফরপুরের বোমার মামলায় ধরা পড়বার পর ক্ষুদিরামের ফাঁসি হল। ক্ষুদিরামকে গ্রেপ্তার করেছিল যে পুলিশ ইনস্পেক্টর, তার নাম নন্দলাল ব্যানার্জি। পরে এই নন্দলালকে গুলি করে হত্যা করেন বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র পাল কলকাতার সার্পেন্টাইন লেনে। শ্রীশচন্দ্রের বিরুদ্ধেও মামলা সাজিয়ে তাকে ফাঁসিকাঠে চড়ায় এই শামসুল আলম।
তাহলে এই শামসুল আলমের কী শাস্তি চাই? বাঘা যতীন ঠিক করলেন, শামসুলকে মরতে হবে।
এই পর্যন্ত বলার পর ভীমদা খেয়াল করে, কেটলিতে আর চা নেই। খুরিতে ঢালতে গিয়েই খেয়ালটা হল। কাউকে কিছু বলতে হল না, শচী কেটলিটা নিয়ে নিচে চলে গেল।
এই সুযোগে কথা বলে নজরুল, আপনি তো বিপ্লবী আন্দোলনের ব্যাপারে অনেক কিছু জানেন। এই অনেক কিছুর সবটাই তো আপনার গোসাবার অভিজ্ঞতা নয়।
গোসাবার অভিজ্ঞতা নয় যদি বলেন, বলব ঠিকই বলছেন। আবার ঠিকই যে বলছেন তা-ও কিন্তু নয়।
কীরকম?
ধরুন, এই যে আলিপুর বোমা মামলার কথা বলছিলুম, এটা কি গোসাবাতে হচ্ছিল? তা তো নয়। কাজেই, গোসাবার অভিজ্ঞতা নয় বললে মেনে নিতে হবে। কিন্তু, আমি এত কিছু জানলুম কীভাবে? আসলে, এ সবই আমার যতীন দাদার কাছে শোনা। গোসাবাতে না গেলে দাদাকে পেতুম কোথায়? যতীন দাদাই আমার খবরের কাগজ, আমার অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস। এই যতীন দাদাই আবার আমাকে গোসাবা থেকে এই শিবপুরে নিয়ে এসেছেন। যতীন দাদা আমাকে বলতেন, তোকে দিয়ে বিপ্লব হবে না, যতই ভীম তোর নাম হোক, তোর মতো রোগাপটকাকে দিয়ে লড়াই হবে না। তাই, তুই থাকবি আড়ালে। যে-কোন লড়াইয়েই আড়ালে-থাকা মানুষরা একটা খুব দরকারি কাজ করে, সে কাজটা তোকে দিয়ে করাব।
আমি একজন আড়ালে থাকা মানুষের কথা জানি, তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল, বলে নজরুল।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, আমি ইশকুলে পড়তুম রানিগঞ্জের কাছে, শিয়ারশোল রাজ ইশকুল। আমাদের একজন মাস্টারমশাই ছিলেন, তাঁর নাম নিবারণচন্দ্র ঘটক। তিনি যুগান্তর দলের লোক। আমাদের দু-চারজনের সঙ্গে তাঁর খানিকটা ঘনিষ্ঠতা ছিল, কিন্তু কোনোরকম বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপে তিনি কখনও আমাদের ডাকেননি। আমি যখন ফার্স্টক্লাসে পড়ি, তখন তো বেশ বড় হয়ে গেছি, একবার স্যারকে বলেওছিলুম আমরা যুগান্তর দলের কাজে থাকতে চাই। স্যার বললেন, যেদিন লড়াইয়ে তোদের প্রয়োজন আছে বলে মনে হবে, সেদিন যদি প্রস্তুত থাকিস, তাহলে ঠিকই ডাক পাবি।
আমরা যখন স্কুলের শেষের দিকে, নজরুল বলতে থাকে, তখন পুলিশ স্যারকে গ্রেপ্তার করল। একই দিনে স্যারের সঙ্গে পুলিশ গ্রেপ্তার করে আরও দু’জনকে। একজনের নাম দুকড়িবালা চক্রবর্তী। তিনি স্যারের মাসিমা, অস্ত্র আইনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁরই সঙ্গে তাঁদের গ্রামের আরও একজন মহিলা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাঁর নাম সুরধুনী। সুরধুনী ছিলেন ওই গ্রামের মোড়লনি। বিচারে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হল স্যারের, মাসিমার দু’বছরের। সুরধুনী অবিশ্যি রাজসাক্ষী হয়ে ছাড়া পেলেন। অথচ মজাটা কী জানেন? মাসিমার বাড়িতে পুলিশ কিছুই পায়নি, পেয়েছিল সুরধুনীর বাড়িতে। এক ডজন পিস্তল। মাসিমার অনুরোধে সে নাকি রেখে দিয়েছিল পিস্তলগুলো।
এর মধ্যে চা নিয়ে এসেছে শচী। খুরিতে ঢেলে চায়ে একটা চুমুক দিয়ে ভীমদা বলে, হ্যাঁ, আলিপুর বোমা মামলার কথা বলছিলুম। এক বছর ধরে মামলা চলেছিল, উনিশশো আটের মে থেকে উনিশশো নয়ের মে পর্যন্ত, কিন্তু সে মামলা চালাবার খরচ তো আছে। বিরাট খরচ। সেই খরচ চালাবার জন্যে দু-দুটো ডাকাতিও করিয়েছিল যতীন দাদা, কিন্তু সে ডাকাতির ব্যাপারে কিছুই বলেনি আমাকে, আমি কিছুই জানি না। শুধু আমাকে একদিন ডেকে বলল, গোসাবার মেয়াদ ফুরিয়েছে তোর, আমারও। আমিও গোসাবা থেকে বিদায় নিচ্ছি, এখন এখানকার কাজ কীভাবে চলবে তোকে আর ভাবতে হবে না। তোকে এখন বিয়ে করতে হবে, আর বিয়ে করে বউকে নিয়ে থাকতে হবে হাওড়ায়, শিবপুরে।
এ তুমি কী বলছ দাদা, আমাকে এখন বিয়ে করতে বলছ? তোমরা সবাই দেশের জন্যে প্রাণ দেবে, আর আমি বিয়ে করে ঘর-সংসার করব?
ঘর-সংসার তোকে কে করতে বলেছে, ঘর-সংসার তো করবে তোর বউ। দেশের জন্যে কেউ প্রাণ দেয়, কেউ জেল খাটে, আর কেউ বিয়েও করে। তোর বিয়ে করাটাও দেশের জন্যেই করা, বুঝলি গাধা?
আমার রাগ-দুখ্যু দুটোই হল। বললুম, তুমি যখন ঠিক করেই ফেলেছ, আমার হাতে তো আর কিছুই নেই, যা তুমি বলবে, তা-ই হবে। এখন, বিয়েটা কাকে করতে হবে শুনি?
হুঁ, শখ তো আছে ষোল আনা, ভেংচিয়ে আমার কথাটাই আমাকে শুনিয়ে দিল, বিয়েটা কাকে করতে হবে শুনি! কনে ঠিক হয়ে গেছে, ইশকুলে পড়েনি কখনো, নাম সই করতেও শেখেনি। কিন্তু ভাল মেয়ে, মনের জোর আছে।
বাপ-মা নেই, আত্মীয়-স্বজন বলতে যা বোঝায় তেমনও কেউ নেই। যার কাছে থেকে মানুষ হচ্ছিল, সে এখন আর এদেশে থাকবে না। এখন থেকে তুই-ই ওর সব। তোর মা দেখেছে মেয়েকে, তোর সাথে যে বিয়ে দেবার কথা ভাবছি, এখনো শোনেনি সে কথা। কিন্তু তোর মার পছন্দ হয়েছে মেয়েকে। আজই তুই চলে যাবি শিবপুরে, আমি একটা নাম-ঠিকানা দেব, যার নাম দিচ্ছি, তার সঙ্গে দেখা করবি। সব ব্যবস্থা সে করে দেবে।
আমাকে একজনের নাম-ঠিকানা দিল যতীন দাদা, আর তার সঙ্গে হাজার দুয়েক টাকা। বলল, বিয়ের দিন পাকা হলে তোকে খবর দেব। বিয়েটা হবে এখানেই, তারপর বউকে নিয়ে চলে যাবি শিবপুর। আর শোন্, এই যে টাকা দিচ্ছি তোকে, এটা অনেক টাকা। এই একবারই টাকা দিলুম তোকে, আর কখনো পাবি না। বউকে খাওয়াবি-পরাবি কীভাবে, সেটা তোর চিন্তা।
এবার আমার রাগ হল। বললুম, কী পাপে আমাকে তুমি বিসর্জন দিচ্ছ বুঝতে পারলুম না। এখন একটা কোথাকার মেয়েকে গলায় ঝুলিয়ে দিতেও চাও। অথচ তুমি ভালভাবেই জানো দাদা, আমি এমন কোনো কাজ জানি না যে দু’পয়সা আয় করে বউকে খাওয়াব। কেন আমায় এমন শাস্তি দিচ্ছ দাদা?
যতীন দাদা গম্ভীর। বলল, তুই জানিস না আমরা সবাই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত? আমাদের দেশ আমাদের মা, আজ যখন এত বড় একটা দায়িত্ব দিচ্ছি, ভয় পাচ্ছিস কেন?
কী দায়িত্ব দিচ্ছ? দায়িত্ব তো দিচ্ছ একটা মেয়ের, অচেনা-অজানা একটা মেয়ের। দিচ্ছই যখন, আর দুটো দিন সবুর কর দাদা। তুমি তো পড়াচ্ছিলেই আমাকে, আমি কি মন দিয়ে পড়ছিলুম না? আর একটু লেখাপড়া শেখাও, যাতে একটা পাঠশালা-মাঠশালা চালিয়ে দুটো পেট অন্তত চালাতে পারি। এখনই আমাকে তাড়িয়ে দিও না দাদা।
তোকে আমি তাড়াচ্ছি? ওরে হাঁদা, তুই তাই বুঝলি? আগে শিবপুরে যা, তার পর বুঝবি কী দায়িত্ব তোকে দেওয়া হচ্ছে। আর, তুই না ভীম? একটা বাচ্চা মেয়েকে পুষতে যে ভয় পায় সে ভীম কীসে?
ভীম তো শুধু একটা নাম দাদা। আর প্রথম দিনেই তো তুমিই বলে দিয়েছ আমার মতো রোগাপটকার ভীম নামের কোনো মানেই হয় না।
আরে, ভীম কি শুধুই পালোয়ান? মহাভারত পড়িসনি? অজ্ঞাতবাসের সময় বিরাট রাজার কাছে কী কাজ করত ভীম? ভীম ছিল এক্সপার্ট রসুই, পাক্কা রাঁধুনি। তুইও সেই কাজই করবি। হাওড়ায় গিয়ে তেলেভাজার দোকান দিবি। গেলেই বুঝবি, হাওড়ার লোকে ভাতরুটি খায় না! স্রেফ তেলেভাজার উপর থাকে! যে মেয়েটার সঙ্গে তোর বিয়ে দিচ্ছি, তোর মাকে বলেছি তাকে এক্সপার্ট তেলেভাজা মেকার বানিয়ে দিতে। বিয়ের পর তার কাছ থেকে শিখে নিবি তুইও। দেখিস না তোদের দোকানে কেমন ভিড় হয়!
ভীমদার তেলেভাজার সেই দোকানই এই দোকান? – জিজ্ঞেস করে নজরুল।
সেই দোকানই, বলে ভীমদা, তো, আমি তো যতীন দাদার দেওয়া ঠিকানায় এলুম। এসে দেখি একটা ইশকুল। যাঁর নাম দিয়েছিলেন সেই সন্তোষ মিত্তির মশাই এই ইশকুলেরই মাষ্টারমশাই একজন। আমাকে বললেন, আপনার বাড়ি তো রেডি। মাসে দশ টাকা ভাড়া লাগবে।
তখন তো আমার পকেটে দু’হাজার টাকার গরম, বললুম, ছ’মাসের টাকা দিয়ে দিচ্ছি, বাড়িটা দেখিয়ে দিন। আজ থেকেই থাকতে শুরু করতে হবে।
মাস্টারমশাই বললেন, ছ’মাসের টাকা দিতে হবে না, এক মাসেরই দেবেন, তা-ও এখন নয়, মাস শেষ হলে। একটা বোধ হয় ক্লাস ছিল মাস্টারমশায়ের, আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে সেটা শেষ করে আমাকে নিয়ে এলেন এই বাড়িতে, বললেন, একটু পুরোনো বাড়ি, কিন্তু মনে হয় না আপনার অসুবিধে হবে।
ভীমদা এবার নজরুলকে বলে, এই যে চৌকিতে বসে আছেন আপনি, এইটা। এটাই আমাকে পাঠিয়ে দিলেন মাস্টারমশাই। বললেন, দাম দিতে হবে না, ওটা আমার বাড়িতে পড়েই ছিল, আপনার কাজে লেগে যাবে এখন। থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল, মাস্টারমশাই জিজ্ঞেস করলেন, খাওয়ার ব্যবস্থা কী করবেন? নিচের তলায় কোণের দিকের একটা ঘর দেখিয়ে বললেন, এটাকে রান্নাঘর বানিয়ে নিতে পারেন। কী ভেবে বললেন তারপর, শিবপুর বাজারে পাইস হোটেল আছে, একা মানুষ, রান্নার ঝামেলায় যাবেন কেন?
পাইস হোটেলটা চিনিয়ে দিলেন মাস্টারমশাই। খাওয়ার ব্যবস্থাও হয়ে গেল।
দিন সাতেক পর আবার মাস্টারমশাই হাজির, আপনার দোকান ঘরটা রেডি করতে হবে।
আমার দোকান ঘর?
হ্যাঁ, সেটাই ইনস্ট্রাকশন। নিচের তলায় ওই যে সামনের দিকের ঘরটা আছে, ওটার সামনের দরজাটা সরিয়ে ওখানে একটা মিষ্টির দোকানের মতো তৈরি করে দিতে হবে। মিষ্টির দোকান দেখেছেন তো, সামনেই একটা কাচের শো-কেস থাকে। ওই শো-কেসে মিষ্টিগুলো সাজানো থাকে। আর মালিক বসে শো-কেসের পিছনে। সেই ব্যবস্থাই হবে এখানে।
মাস্টারমশাই বললেন বটে মিষ্টির দোকান, কিন্তু আমি বুঝলুম তেলেভাজার দোকান। সেরকমই কথা ছিল। শো-কেসে মিষ্টির বদলে তেলেভাজা।
দোকান তো হল, এমনকি সাইনবোর্ডও লাগানো হল, ‘ভীমদার তেলেভাজা’। কিন্তু দোকান চালাবে কে? আমি মনে মনে ভাবলুম, তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি। একদিন বাজারের পাইস হোটেল থেকে ফিরছি, একটা ছেলে – চিনি তাকে – এই আমাদের শচীর ক্লাব আছে না, ‘দশে দশ’? – সেই ক্লাবের একটা ছেলের সঙ্গে রাস্তায় দেখা, বলল, বিকেলে আসছি তোমার কাছে, ঘরে থেকো। এল বিকেলে, সঙ্গে আরও দু’জন। এই দু’জনের দায়িত্ব দোকান চালু করার। দায়িত্ব কে দিয়েছে? জবাব দিল না। ওরা একটা উনুন গড়ল, আর একটা তোলা উনুন কিনে আনল। বাজার থেকে আনল হাঁড়ি-কড়া-থালা-বাটি, নানারকমের বাসন-কোসন। বলল, তেলেভাজা বিক্কিরি হবে সারা দিন। দুপুরে আর রাতে নিরামিষ তরকারি আর ভাত। ওরাই ব্যবস্থা করবে। দু’দিন সময় নিল ওরা। তারপর একদিন সকাল হতে-না-হতে দু’জনে অনেক বাজার করে আনল। বলল, আজ সব ক্লাবের ছেলেরা আসবে। সকাল থেকে তেলেভাজা বানানো চলছে, সে কী খাওয়ার ঘটা! খাচ্ছে, কিন্তু ফ্রি নয়, সবাই দাম দিচ্ছে। ক্লাবের ছেলেদের দেখাদেখি অন্য লোকেও আসতে শুরু করল, ওই প্রথম দিনেই যা বিক্রি হল, দোকান দাঁড়িয়ে গেল। আমাকেও হাত লাগাতে হল, যতটা পারি, ওদের সঙ্গে লেগে থাকলুম। একটু বেলা হতে বলল, আর তোমার হোটেলে যাবার দরকার নেই। এখানেই ভাত হবে, নিরামিষ ঝোলও। আমি খেলুম, ওরাও খেল। ক্লাবের দুয়েকজনও খেল। তারও দাম দিল।
দিন সাত-আট পর একদিন যতীন দাদা হাজির। সব দেখেশুনে বলল, ভালই তো আছিস। আজই চলে যা গোসাবা, তোর মা অপেক্ষা করছে তোর জন্যে। বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে আয়। বাবা-মাকে প্রণাম করে আসবি। বলে আসবি, আর হয়তো গোসাবায় ফেরাই হবে না কোনোদিন, তোকে আর তোর বউকে যেন আশীর্বাদ করে হাসিমুখে বিদায় দেয়, ছোট-মা হাসিমুখে যেন ছেলে-বউকে পাঠায় বড়-মার কাছে। সবার বড় মা, দেশমাতৃকা!
বিয়ের দিন সকালেই দেখি কোত্থেকে যতীন দাদা হাজির। সারাদিন কিছু খেল না, সন্ধেবেলা কন্যাসম্প্রদান করল নিজেই। এমনকি বিয়ের যাগযজ্ঞও। বলল, আমার মতো ব্রাহ্মণ পাবি কোথায়? প্রয়োজন ছাড়া মিথ্যে কথা বলি না!
আসার সময় মা কাঁদল খুব। বিয়ের সময় মেয়ের বাড়ির লোকদের কান্নাকাটি করার রেওয়াজ আছে জানতুম। মা কাঁদল কেন? আমার বউ ছেড়ে আসছে বলে? নাকি, ‘দেশের জন্য বলিপ্রদত্ত’ ছেলেকে দেশমাতৃকার কাছে চিরকালের জন্যে পাঠিয়ে দিচ্ছে বলে?
বউ নিয়ে অবিশ্যি একা একা ফিরতে হল না। যতীন দাদা এল সঙ্গে। বউকে রেখে এল মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে। বাড়ি ফিরে দেখি, এই যে চৌকিটা, যেটায় আপনি এখন বসে আছেন নজরুল সাহেব, সেরকমই আর একটা চৌকি এই ঘরে। পরের দিন ক্লাবের ছেলেরা ঘর সাজাল ফুলশয্যের জন্যে। রীতিমতো হৈ হৈ, কতো লোক যে খেল, কে জানে। কারা ব্যবস্থা করল, কে পয়সা খরচ করল, কিছুই বুঝলুম না।
অতএব শেষ অবধি মহাসমারোহে বিয়ে হয়ে গেল পাণ্ডুপুত্র ভীমের সঙ্গে কমলার। হ্যাঁ, ফুলশয্যের রাতেই নাম জানলুম বউয়ের। এবার সংসার। পাশের ঘরটায়, ওই যে যতীনদাদার ছবি দেখলেন যে ঘরে, যতীন দাদা বলল, এখন থেকে ওই ঘরের ভাড়াটে সে-ই। আমাদের ঘর তো ঠিক হয়েই আছে। অন্য ঘরগুলোয় কে আসবে কে থাকবে, এখনই আমার জানার দরকার নেই, বলল দাদা। যখন জানবার, ঠিকই জেনে যাব। নিজের হাতে তালা লাগিয়ে দিল সব কটা ঘরে, চাবিও রেখে দিল নিজের কাছেই।
আজ থেকে ‘ভীমদার তেলেভাজা’ দোকানের মালিক কমলা, ভীম তার অ্যাসিস্ট্যান্ট। যে ছেলে দু’জন দোকান চালিয়েছে এতদিন, থেকে গেল তারাও। তবে তাদের কাজটা গেল বদলিয়ে। শো-কেসের পিছনে শুধু তেলেভাজার দোকান নয়, বোমার কারখানাও। সবাই একই সঙ্গে বসে কাজ করে, সবাই মিলে যেন তেলেভাজার দোকানই চালাচ্ছে। আর দোকানে যত ভিড়, তাতে এতগুলো কাজের লোক মানিয়েও যায় বেশ। যতীন দাদা কখনও আসে, কখনও যায়। যেদিন থাকে, আমাদের সঙ্গে নিরামিষ ঝোল আর ভাত খায়। মাঝে মাঝে ওই বন্ধ ঘরগুলোর চাবি নিয়ে আসে কেউ কেউ, ঘর খুলে দরজা বন্ধ করে দেয়, চলে যায় কিছুক্ষণ পর। দোকানের আয় হয় অনেক, মাঝে মাঝে দাদাকে দিয়ে দিই টাকা। হাসে। নিয়েও নেয়। বলে, তোর বউ মা লক্ষ্মী, কমলা নাম সত্যিই সার্থক।
হঠাৎ যেন কী মনে পড়েছে, ভীমদা বলে শচীকে, হ্যাঁ রে শচী, এই যে আমরা দিব্যি আড্ডা মারছি, দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার কী হবে রে? তোর না হয় ননী জেঠুর হোটেল খোলা আছে চব্বিশ ঘণ্টা, নজরুল সাহেব আর তোর এই বন্ধুর দুপুরের খাওয়ার কথা চিন্তা করেছিস কিছু? বলেই, নজরুলের দিকে ফিরে হাত জোড় করে বলে ভীমদা, আমিষ ঢোকে না আমাদের বাড়িতে, কিন্তু নিরামিষে আপত্তি যদি না থাকে, ভীমদার তেলেভাজা এখানেই নিরামিষ ঝোলভাত খাইয়ে দিতে পারে আপনাকে।
নজরুল বলে, পিংলা আর শচীর কথা জানিনা, কিন্তু যত তেলেভাজা খেলুম, আমার মনে হয় দুপুরের খাওয়াটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে আজ।
সে কী কথা, না না, যা হোক দুটো এখানেই খেয়ে যাবেন। আমার কাহিনিটাও তো শেষ করতে হবে।
আবার কাহিনিতে ঢোকে ভীমদা, এই যে আপনাদের বলছিলুম আলিপুর বোমার মামলার কথা, প্রায় পঞ্চাশজন বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ, তখন এত লোক যে ধরা পড়ল, যতীন দাদা ধরা পড়ল না কেন? এ ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারলুম এই শিবপুরে এসে। যতীন দাদা কোত্থাও নেই, আবার সব জায়গাতেই আছে। আমাকে এখানে আনাবে, দেখুন, বাড়ি ঠিক করেছে একজন, আমাকে সে চেনেও না। দোকানও হল, আমাকে কিছু জানতেই হল না। এমনকি প্রথম দিন থেকেই দোকানে এত যে ভিড়, সে ব্যবস্থাও করা আছে। কোনখানে কোন ক্লাবের ছেলেরা, কোন ইশকুলে কোন মাস্টারমশাইরা, তাদের কাজ নিঃশব্দে করে চলেছে – ডান হাত কী করবে বাঁ হাতের জানার দরকারও নেই – এই হচ্ছে যতীন দাদার ব্যবস্থা। আবার দেখুন ধরা পড়ল না নিজে, কিন্তু বাইরে থেকে পুরো মামলার খবর রাখছে, আপনাদের বলেওছি আগে, খরচ চালাবার জন্যে দুটো ডাকাতিও হয়ে গেল। আবার শুনবেন? আমি পরে জেনেছি এটা, যাদের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে, তারাও এখন যতীন দাদার ভক্ত। তাদের বলে পাঠানো হয়েছে, দেশের কাজে তাদের টাকা লেগেছে। তাদের আছে, অন্যদের নেই। তাই তাদের থেকেই নেওয়া। দেশ যেদিন স্বাধীন হবে টাকা তাদের ফিরিয়ে দেবে সেদিন।
তো, আপনাদের বলেছিলুম, এই যে আলিপুরের মামলা, এই মামলায় একজন চিহ্নিত হল, মনে আছে? লোকটা হল বাংলা পুলিশের ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট শামসুল আলম, বলেছিলুম না?। এই লোকটার মৃত্যুদণ্ড যতীন দাদা ঘোষণা করেই দিয়েছিল। এখন বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত নামে এক বিপ্লবীকে দায়িত্ব দিল দাদা, লোকটাকে খতম করা চাই। উনিশশো দশ সালের চব্বিশে জানুয়ারি প্রকাশ্য দিবালোকে কলকাতা হাইকোর্টের বারান্দায় একেবারে সামনে থেকে রিভলভারের গুলিতে লোকটাকে হত্যা করলেন বীরেন। তারপর গুলি চালাতে চালাতে তটস্থ হাইকোর্ট থেকে বেরোতে গিয়ে ফুরিয়ে গেল ছ’খানা গুলিই। গ্রেপ্তার হলেন তিনি। বীরেনের কাছ থেকে কথা বের করবার অনেক চেষ্টা করল পুলিশ, অনেক লোভ দেখাল, বীরেন শুধু একটাই কথা বলে, আপনারা দেখেছেন গুলি করেছি আমি। শোধ নিয়েছি। আমি, একা আমিই দায়ী। এই ঘটনার তিন দিন পর পুলিশ আসে আমাদের এই বাড়িতে। বাঘা যতীনের খোঁজ নেয়। অযথা মিথ্যে কথা বলতে আমাদের শেখায়নি যতীন দাদা। পুলিশ এসেছে, বাঘা যতীনের খোঁজ নিয়েছে, দাদা যে এখানে থাকে সে খোঁজ নিয়েই এসেছে নিশ্চয়ই। আমরা বললুম, হ্যাঁ, এ বাড়িতেই থাকে, এখন নেই।
কোন ঘরে থাকে?
দেখালুম ঘর। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও নিয়ে যাবার মতো কিছুই পেল না। তালা দেওয়া ঘরগুলো এর মধ্যে লক্ষ করেছে পুলিশ। জিজ্ঞেস করলো, ওগুলোয়?
কেউ থাকে না। তালা দেওয়াই থাকে।
চাবি দাও।
আমাদের কাছে নেই।
পুলিশ তালা ভাঙল। ঘর খোলার পর আমরাও অবাক। ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার। কেউ যেন ধুয়ে মুছে রেখেছে এখনই। কোনো ঘরেই কোনোকিছু নেই। লাঠি দিয়ে মেঝেতে দেওয়ালে খানিক ঠকঠক করল পুলিশ। তারপর আমাদের দোকানে একটু উঁকি দিয়ে দেখে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল, বাঘা যতীন এলে খবর দিয়ে দিও। পরের দিন সকালে দেখি এক সেপাই বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে। সারাদিন দাঁড়িয়ে রইল। সন্ধে হতে সে চলে গেল, এল আর এক জন। এরকমই রোজ রোজ।
দোকানে বিক্কিরি কমে গেল? – জিজ্ঞেস করে পিংলা।
উঁহু। বাড়ল, বলে ভীমদা। লোকে আসে, কেনাকাটা করে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খায়ও অনেকে। পুলিশের সঙ্গে মসকরাও করে কেউ কেউ। এই রকম চলতে চলতে একদিন পুলিশ আসা বন্ধ হয়ে গেল। পরে খবর পেলুম উনত্রিশে জানুয়ারির মধ্যে নানা জায়গা থেকে পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশজন বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তার মধ্যে বাঘা যতীনও আছে। কাগজে লিখছে হাওড়া শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলা। কোর্টে মামলা উঠল মার্চের চার তারিখে। তার আগে একুশে ফেব্রুয়ারি ফাঁসিও হয়ে গেছে বীরেন দত্তগুপ্তর। কোনো সাক্ষী-প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি পুলিশ। বেকসুর খালাস হল তেত্রিশ জন।
এই যে তেত্রিশ জন ছাড়া পেল, এটা কিন্তু তেমন কিছু নয়। বুঝতেই তো পারছেন নজরুল সাহেব, দাদার “গলিতে গলিতে বিপ্লবী সংগঠন ছড়িয়ে দাও”-এর প্ল্যান-এ এত ছেলে যুক্ত যে, পুলিশ যখন-তখন কিছু ছেলেকে ধরতেই পারে, কিন্তু আদালতে দোষী প্রমাণ করতে পারে না তাদের, অতএব তারা ছাড়াও পেয়ে যায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু এবার যা হল তা ভারতবাসী দেখেনি কখনও। সাতই মার্চ বাঘা যতীন-সহ বাকি বিপ্লবীদের আদালতে তোলবার আগেই ভয়ঙ্কর কাণ্ড! কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে দশ নম্বর জাঠ রেজিমেন্টের কোর্ট মার্শাল হল।
কোর্ট মার্শাল? পুরো রেজিমেন্টের? কই, আগে তো শুনিনি, বিস্মিত নজরুল।
শুনবেন কী করে? খবরের কাগজগুলোকে তো কিছুই লিখতে দেওয়া হয়নি। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ব্রিটিশ সেনাদলের ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারত, সে তো বুঝতেই পারছেন। এই কোর্ট মার্শালে বেশ কয়েকজন জাঠ অফিসারের ফাঁসি হল, আর এতদিনের রেজিমেন্টটাও ভেঙে ফেলা হল। সত্যিকারের সিডিশন! ব্রিটিশ সিংহের হাত-পা সেঁধিয়ে গেল পেটের মধ্যে! সব ছেড়েছুড়ে মিন্টো সাহেব গেল দেশ ছেড়ে পালিয়ে।
আর, ঠিক এটাই ছিল যতীন দাদার প্ল্যান। বাইরে বিপ্লবী ছেলেরা লড়াই চালিয়ে যাবে। আর ভেতরে ভেতরে, দেখে যাদের মনে হয় শান্ত-শিষ্ট, কোনও ব্যাপারেই থাকে না, তারাও বিপ্লবের নানা কাজে চুপচাপ সাহায্য করে যাবে, আর একই সঙ্গে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ভারতীয় সৈন্যরা সরাসরি নেমে পড়বে ব্রিটিশ-শাসন উৎখাতের যুদ্ধে, যেমনটা হয়েছিল আঠেরোশো সাতান্ন সালের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধে। যতীন দাদা যখন আমাকে পড়াত, তখন বারবার বলত, মনে রাখবি, মিউটিনি নয়, আঠেরোশো সাতান্নর লড়াইটা স্বাধীনতার লড়াই, ইংরেজ শাসকরা আর তাদের চাটুকাররা লড়াইটাকে কয়েকজন বিপথগামীর মিউটিনি নামে চালাতে চায়, ইশকুলের বইয়েও শেখায় সেরকম, কিন্তু সেটাই প্রথম স্বাধীনতার লড়াই। আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতার লড়াইয়ে, মনে রাখিস, মিলিটারি ব্যারাকগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। আপনি বিশ্বাস করবেন নজরুল সাহেব, কোথায় কোথায় কত রকমের কাজ করে রেখেছে যতীন দাদা? জুলাই মাসে ওদের আদালতে পেশ করার আগে, এখন আমরা যে শিবপুরে বসে আছি সেখানেই ঘটেছিল আর একটা কাণ্ড। আমাদের শচীবাবু হয়তো জানে না সেটা, কিন্তু কাণ্ডটা ঘটেছিল শচীবাবু এখন যেখানে থাকে সেই বাড়িতেই।
নিখিলেশ্বর রায় মৌলিক আর নরেন চ্যাটার্জি – এঁদের নাম শুনেছেন? যতীন দাদার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রধান সহকারী দু’জন। খবর পেলুম এঁরা আসছেন ননীগোপাল সেনগুপ্তর – শচীর ননী জেঠুর – বাড়িতে। এলেন, কিন্তু শুধুমাত্র দু’জনেই নয়। এঁদের পরে পরে সাধারণ মানুষের পোশাকে একে একে এলেন আরও অনেকজন। এঁরা এলেন ফোর্ট উইলিয়ম থেকে। কয়েকটা রেজিমেন্টের অফিসার এঁরা। তিনদিন ধরে মিটিং হয়েছিল। আমি সে মিটিংয়ে থাকিনি, মিটিংয়ে যাবার কোনও নির্দেশ যতীন দাদার কাছ থেকে আমার কাছে পৌঁছোয়নি। তবে হ্যাঁ, এই তিন দিন মিটিংয়ের সবাইকে খাওয়াবার দায়িত্ব ছিল আমার। আমার যারা নিয়মিত খদ্দের, এমন কয়েকজন ছেলে তেলেভাজা নিয়ে গেছে, ভাত-রুটি আর নিরামিষ ঝোলও নিয়ে গেছে। তাদের মুখেই শুনেছি, ছক তৈরি হচ্ছে কেমন করে নানা রেজিমেন্টের সেনারা প্রকাশ্য লড়াইয়ে নামবে।
জুলাই মাসে আদালতে পেশ করা হল সাতচল্লিশের বাকি চোদ্দজনকে। কারো বিরুদ্ধে এবারও কোনো নির্দিষ্ট অপরাধের প্রমাণ দিতে পারল না পুলিশ। নতুন ভাইসরয় হয়ে এসেছেন লর্ড হার্ডিঞ্জ। হার্ডিঞ্জ প্রকাশ্যেই বললেন, আমাদেরই দোষ। কিংবা, দোষ নয়, বোকামি। একটি মাত্র মাথা হচ্ছে আসল অপরাধী। সে-ই সব ঘটনার স্পিরিট। তারই সাজানো ছকে পা দিয়ে পুলিশ আর প্রশাসন বুনো হাঁস খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাকে ধরো। বাকিরা সব বিপথগামী ছোকরা। পালানোর আগে স্পিরিটের নামটা বলে গিয়েছিলেন মিন্টো। যতীন স্পিরিট।
যতীন আর তার খুব কাছের এক সহকর্মী নরেন ভট্চাযের এক বছরের হাজতবাসের আদেশ হল। এক বছর অবিশ্যি কাটলো না। তার আগেই নরেনের মুক্তি, আর বাঘা যতীন গৃহবন্দী। এ বাড়িতে আবার ফিরে এল যতীন দাদা। ভেবেছিলুম, দাদা আবার আগের মতোই সারা বাংলা ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু না, দিনের পর দিন বাড়িতেই বসে থাকে দাদা। নিজের ঘরের দরজাটা ভেজানো থাকে। চা খাবার এসব যখনই দিতে যাই, দেখি কিছু একটা লিখছে। কখনো জিজ্ঞেস করিনি কী লিখছে, আমার জানবার মতো হলে নিজেই বলত আমাকে। প্রথম প্রথম পুলিশ আসত রোজ, এর পর কয়েকদিন ছাড়া ছাড়া, যখনই আসতো, দাদা হাজির। এমনকি ভদ্রতা করে চা-তেলেভাজাও খাওয়াত ওদের দাদা। মুখে বলত, আপনারাও আমাদের বন্ধু, পেটের দায়ে চাকরি করছেন, করুন। আমি নিশ্চিত জানি আসল দিনে আপনাদের সবাইকেই পাশে পাব। পুলিশের লোকরা হাসত একটু, তারপর নমস্কার করে চলে যেত।
এর পর হঠাৎ একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি, দাদা নেই। নিজের বিছানার উপর একটা কাগজে আমাকে একটা চিঠি লিখে গেছে। মামুলি চিঠি, শুধু আমরা চিন্তা যাতে না করি তাই লেখা। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কবে ফিরবে, আদৌ আর ফিরবে কিনা, কিচ্ছু লেখা নেই। লিখেছে, চললুম। আমার মা লক্ষ্মী কমলার যত্ন নিস। আর, শেষ লাইনে লিখেছে, কারো সঙ্গে গল্প করার দরকার নেই। যাদের যা জানবার, সমস্ত ব্যবস্থা আমি নিজেই করেছি। তুই শুধু এই চিঠিটা পড়েই পুড়িয়ে ফেলবি।
এরপর একটু চুপ করে থেকে আবার বলে ভীমদা, দাদার কথা আমি শুনিনি, অবাধ্য হয়েছি। কমলা পড়তে শেখেনি, চিঠিটা ওকে আমি পড়ে শুনিয়েছি। শোনার পর, কিছুক্ষণ একটু চুপ করে থেকে, কমলা একটা দেশলাই কাঠি জ্বেলে দিল আমার হাতে।
তিন দিন পর আবার পুলিশ এল। সকালে। বললুম, দাদা নেই।
কোথায় গেছে? ফিরবে কখন?
বললুম, জানি না। আজ ভোর থেকেই দেখতে পাচ্ছি না। ওরা দু’জন ছিল, একজন বলল, একটু অপেক্ষা করে যাই আমরা। এসে যাবে নিশ্চয়ই।
কমলা ঠোঙায় করে তেলেভাজা এনে দিল ওদের। চা-ও, খুরিতে। খেল ওরা। বলল, এখন যাই, আবার আসব।
ওরা চলে যাবার পর কমলা বলল, একটু ঘাট থেকে ঘুরে আসি। পাড়ায় একটা বড় পুকুর আছে, সবাই সেখানে চান করে। ছেলেদের আর মেয়েদের আলাদা আলাদা ঘাট। বললুম, এখনই কেন? তুমি তো দুপুরে যাও। বললো, না, আজ পুলিশের লোক আবার আসবে, তখন আমার থাকার দরকার হবে। তুমি একা মানুষ, কী বলতে কী বলবে! তার চেয়ে আমার নিজেরই থাকা ভাল, আমি একটা ডুব দিয়েই চলে আসব।
মিনিট দশেক পর মাথায় একটা হাঁড়ি চাপিয়ে, কোমরে গামছা বেঁধে, বেরিয়ে গেল কমলা। বেরোবার সময় জিজ্ঞেস করলুম, হাঁড়িতে কী? বলল, রান্নাঘরের জঞ্জালগুলোও ফেলে দিয়ে আসি, আজ পুলিশকে খাওয়াব। ওদের খুশি রাখতে হবে। যে দু’জন কাজ করে আমাদের সঙ্গে, তাদের আসবার সময় তখনো হয়নি। বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষা করলুম, কমলা ফিরছে না কেন এখনও? একটু পর, পাড়ার দু’জন ছেলে প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে এল আমার কাছে, বলল, ভীমদা, তুমি একবার এক্খুনি এসো আমাদের সঙ্গে। আমার মনটা এমনিতেই কেমন অস্থির অস্থির করছিল, গেলুম ওদের সঙ্গে। ঘাটের সিঁড়িতে পড়ে আছে কমলা, তার মাথা ফেটে তাকে চেনা যাচ্ছে না, হাঁড়িটা দু-আধখানা হয়ে ভাসছে জলে। কী করে কী হয়েছে সে তো আন্দাজের কথা, যে কমলা নেই তাকে তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। খবর পেয়ে কিছুক্ষণ পর ননী জেঠু এলেন, এল ‘দশে দশ’ ক্লাবের ছেলেরাও। ছেলেদের বললেন, হাঁড়িটা টুকরো টুকরো করে টুকরোগুলো জলে ফেলে দে, ডুবে যাবে। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, তোর দুঃখ তো কমাতে পারব না, কিন্তু থানা-পুলিশের ঝামেলা যাতে না হয় সেটা দেখতে হবে। আধ ঘণ্টার মধ্যেই ঘাট-ফাট সব পরিষ্কার। আমাকে শ্মশানে যেতে বারণ করলেন। ছেলেরাই গেল, সঙ্গে ননী জেঠু নিজে। সৎকার-টৎকার করে ফিরে এলেন যখন, ‘ভীমদার তেলেভাজা’ দোকানের সামনেটা তখন শুনশান। শিবপুরের এই গোটা পাড়াটার আজ অশৌচ।
এই পর্যন্ত বলার পর ভীমদা চুপ করে একটু। কোন কথা না বলে শচী নেমে যায় নিচে, একটা গ্লাস আর একটা আলাদা পাত্রে জল নিয়ে উঠে আসে উপরে। ওর হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে জল খায় ভীমদা। এতক্ষণ খুরিতে করে বারবার চা খেয়ে গলা ভেজাচ্ছিল সে, এবার প্রথম তাকে জল খেতে দেখা যায়।
পরের দিন সকালে পুলিশ এসেছিল যথারীতি, আবার বলতে থাকে ভীমদা, এবার থানার দারোগা নিজে, দাদা নেই শুনে একটাও কথা না বলে চলে গেল। কয়েকদিন আমি চুপচাপ থাকলুম। ননী জেঠু একদিন নিজে এলেন এই বাড়িতে, এই প্রথম। জিজ্ঞেস করলেন, আমি শ্রাদ্ধ-শান্তি করতে চাই কিনা। বললুম, চাই না। এ বিষয়ে আর কোনো কথা বললেন না। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর বললেন, সেদিন এখান থেকে বেরিয়ে যতীন গিয়েছিল জার্মান যুবরাজের সঙ্গে দেখা করতে, আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল। ওরা আমাদের অনেক অস্ত্রশস্ত্র দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আমার সঙ্গে আর কোনদিন যতীন দাদার দেখা হয়নি। কমলার জন্যে যে চৌকিটা সন্তোষ মিত্তির মাস্টারমশাই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, সেটা ফেরত পাঠিয়ে দিলুম তাঁর কাছেই। একটাই তো তফাৎ হয়েছিল এ বাড়িতে, একটাই, শুধু আর একটা চৌকি বেড়ে যাওয়া, সেটাও আর রইল না, আমাদের দোকান এখন আগের মতোই চলছে একইরকম ভাবে।
উনিশশো পনেরয় বুড়ি বালামের লড়াইয়ে বাঘা যতীন বাঘের মতো লড়াই করে মরেছে, এ তো আপনারা সবাই জানেন। একটু বোধ হয় দম নিয়ে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আবার কথা বলে ভীমদা। বলে, মারা যাবার পর মানুষ দেবতা হয়, যতদিন বেঁচে থাকে ততদিন কিন্তু হয় না। আমিও সেই থেকে আমার দেবতা দাদার একটা ছবিতে রোজ মালা দিয়ে আর ধূপ জ্বালিয়ে আমার দিন শুরু করি। আমাকে দাদা এই বাড়িতে এই ‘ভীমদার তেলেভাজা’ দোকানে বসিয়ে দিয়ে বলে গেল, এই আমার কাজ। দেশমাতৃকার জন্যে বলিপ্রদত্ত আমি এই তেলেভাজার দোকান চালিয়েই আমার শপথ রাখব। কিন্তু কীভাবে? কমলা থাকলে হয়তো ও একটা দিশা দেখাতে পারত। লেখাপড়া না জানলেও ওর মধ্যে একটা শক্তি ছিল, আমার তো তা-ও নেই। তাহলে কি দাদার কথা ব্যর্থ হবে?
শিবপুরের এই অঞ্চলটায় আমাদের এই শচীর মতো কতো ছেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারাও কিন্তু দেশের জন্যে মরতে প্রস্তুত। কিন্তু মরতে প্রস্তুত থাকাটাই তো সব নয় নজরুল সাহেব, আরও কিছু চাই। শুনেছি, যতীন দাদার মৃত্যুর পর অরবিন্দ বলেছিলেন: যে গেল সে সর্বকালের সেরা মানুষদের মধ্যেও একেবারে প্রথম সারির মানুষ, ক্ষমতা আর সৌন্দর্যের এই যুগলমূর্তি আর দেখিনি কখনও, সত্যিকারের বীর!
এখন আপনার কথা বলি নজরুল সাহেব, আপনাকে আমার কী প্রয়োজন। শচী যখন আমাকে প্রথম একটা ‘দৈনিক নবযুগ’ পড়াল, আমি পুরোটা প্রায় এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললুম। বাজারে চালু অন্য কাগজগুলোর তুলনায় অনেক অন্য রকম। সম্পাদকের নাম দেখলুম আবুল কাসেম ফজলুল হক। শচী বলল, ফজলুল হক আসলে কাগজের মালিকের নাম, সত্যিকারের কাগজ চালান কাজী নজরুল ইসলাম আর মুজফ্ফর আহ্মদ নামের দু’জন। এই নজরুল ইসলাম নাকি হাবিলদার নজরুল ইসলাম, করাচির ব্যারাকে থাকতেন, ফিরে এসেছেন যুদ্ধ করে। এবার পিংলার দিকে তাকায় ভীমদা, শচীর এই বন্ধু পিংলার কথা আমি আগেই শুনেছি। শচী বলল, আপনি নাকি ওর বাড়িতে আসবেন একদিন। আমি ওকে বলে রেখেছিলুম, নজরুল সাহেব এলেই এখানে নিয়ে আসবি। আমি নিজেও যেতে পারতুম পিংলার বাড়িতে। কিন্তু, তাহলে যতীন দাদার এই স্মৃতি, এই বাড়ি, এই ভীমদার তেলেভাজার দোকান, এ সব তো আপনার দেখা হত না।
অথচ আপনাকে এসব দেখাবার দরকার আমার নিজের। আপনি কবি, সাহিত্যিক, খবরের কাগজে লেখেন, জনমত তৈরি করেন। আপনার মতো একজনকে আজ আমার বড় দরকার। সেই যে শেষ এ বাড়ি থেকে যতীন দাদা চলে গেল, তারপর থেকে আমি যতীন দাদার ব্যাপারে নানা খবর সংগ্রহ করেছি, যারাই কিছু জানে দাদার সম্বন্ধে, অথবা দাদার নির্দেশে কোন কিছু করেছে, খবর পেলেই তাদের কাছে গিয়েছি, বোঝবার চেষ্টা করেছি কী করলে আমি, এই তেলেভাজার দোকানদার ভীম আমি, কীভাবে দেশমাতৃকার সেবায় নিজের জীবনদানের অঙ্গীকার আমি রাখতে পারব। শেষ পর্যন্ত বুঝেছি এই শচীদের মতো ছেলেদের কাছে যতীন দাদার পুরো ইতিহাসটা পৌঁছিয়ে দিতে হবে। কী তিনি করেছিলেন, কীভাবে করেছিলেন, কোন্ ভুলে তাঁর সারা জীবনের এত আত্মত্যাগ শেষ মুহূর্তে ব্যর্থ হল। এই যে আজ গান্ধি নামের এক গুজরাতি ভদ্রলোক এক বছরের মধ্যে অহিংসার পথে স্বরাজ এনে দেবেন বলছেন, আর কথায় কথায় বাঘা যতীনের পথেই তিনি হাঁটছেন বলে প্রচার করছেন, এই যে তিনি বারবার বলছেন বাঘা যতীনের শিষ্যরাই তাঁর অহিংস লড়াইয়ে নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে, আর বাঘা যতীনের শিষ্যরাও গান্ধির ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়ে এই যে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে আজ, এটা ঠিক হচ্ছে না নজরুল সাহেব। ভেবে দেখুন, বাঘা যতীন আর রাসবিহারী বোস সারা ভারতের সেনাবাহিনীকেও কতটা প্রভাবিত করেছিলেন। ভেবে দেখুন কার প্রভাবে দশ নম্বর জাঠ রেজিমেন্টের এতগুলো অফিসার হাসতে হাসতে উঠলেন ফাঁসির মঞ্চে, আর ইংরেজরা ভেঙে দিতে বাধ্য হল পুরো রেজিমেন্টটাকেই? কার প্রভাবে তার পরেও তিরানব্বই নম্বর বর্মা রেজিমেন্টের শিখ সৈন্যরা আর ষোল নম্বর রাজপুত রাইফেল্সের মনসা সিং আর অন্যরাও প্রস্তুত হয়ে রইলেন কবে ডাক পড়বে? শুধুমাত্র একজনের বিশ্বাসঘাতকতা নজরুল সাহেব, একজন কিরপাল সিং, তা না হলে চার হাজারের উপর গদ্দর সেনা তো আমেরিকা থেকে ফিরেই এসেছিল লড়াইয়ের জন্যে। ক্যালিফোর্নিয়ার কোস্ট থেকে অস্ত্রশস্ত্র তো ভারতের পূর্ব উপকূলের উদ্দেশে রওনা দিয়েইছিল প্রায়। নরেন ভট্চাযের পাঠানো অস্ত্রগুলো বাটাভিয়া হয়ে বালাসোরে তো পৌঁছিয়েওছিল শেষ পর্যন্ত। উনিশশো পনেরতে যা হতে পারত তা হতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে উনিশশো পঁচিশেও তা হতে পারবে না, নজরুল সাহেব!
আপনার কাছে আমার একটাই ভিক্ষে। আপনার কবিতায়, আপনার গানে, আপনার বক্তৃতায়, খবরের কাগজে আপনার লেখায়, এই বার্তা আপনি দিয়ে যান নতুন প্রজন্মের কাছে। যতীন দাদার সহকারীরা যারা বিদেশে আছে এখনও, আজও, তারা হাল ছাড়েনি নজরুল সাহেব, এই খবরটা আপনাকে আমি দিতে চাই। এই সেদিনও ভূপেন দত্তকে তাঁরা পাঠিয়েছিলেন শ্রীঅরবিন্দের কাছে। অরবিন্দ বলেছেন, গান্ধি নিজের মতো করে কাজ করছেন, করুন। অহিংসা তাঁর একটা ফেটিশ, একটা অবসেশন। আমাদের তাতে বিশ্বাস করবার প্রয়োজন নেই, যতীন তো রাস্তা আমাদের দেখিয়েই গেছে।