মুজফ্ফর বলল, এ-দেশে নন-খিলাফতি সোশ্যালিস্ট এখনো তৈরি হয়নি, মানো?
নন-খিলাফতি বা খিলাফতি বুঝি না, দাউদ সাহেব যা-ই বলুন না কেন, আমার মনে হয় না এ দেশে কোন রকমের সোশ্যালিস্ট আদৌ তৈরি হয়েছে, নজরুল তার মত জানায়। এক-আধজন লেখাপড়া জানা মানুষ হয়তো ঘরে বসে বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডায় সোশ্যালিজ্ম্ নিয়ে একটু-আধটু কথাবার্তা বলে, কিন্তু তারা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। আমার কথাই ধর, বলতে থাকে কাজি, আমাকে খিলাফতি বলবে? নাকি নন-খিলাফতি?
তোমার কথা আলাদা। তোমার সম্বন্ধে আমার একটা ক্ল্যাসিফিকেশন আছে, বলে মুজফ্ফর। সেটা একটু অন্যরকমের। পরে বলব। এখন দাউদ সাহেবের কথাটা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। খিলাফতি আর নন-খিলাফতি বলার সময় দাউদ সাহেব বলেছেন নন-খিলাফতি কংগ্রেসিরা, যারা স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত, তারা অন্তর্মুখী। এ ক্ষেত্রে অন্তর্মুখী মানে কী? ভেতরের দিকে তাকানো। দেশের ভেতরের দিকে। তাকিয়ে ততটাই দেখা যতটা দেখতে দর্শকের চোখ আপাতত প্রস্তুত। তার বাইরে আর কিছু নয়। আমার দেশকে তোমরা তোমাদের অধীন করে রেখেছ, আমি স্বাধীন করতে চাই। তোমাদের কাছে আর অন্য কোন দাবি নেই আমাদের। স্বাধীন হই, আমাদের দেশের বাকি ব্যাপার আমরা বুঝে নেব। এই হচ্ছে কংগ্রেসি। এই হচ্ছে অন্তর্মুখী হওয়া।
এদিকে খিলাফতিরা, কংগ্রেসিদের সঙ্গে যোগ দিয়েও, তারা কিন্তু অন্য কথাও বলছে। স্বাধীনতা ছাড়াও তাদের আরও দাবি আছে। কী দাবি? মক্কা-মদিনা, সে তো আমাদের দেশ নয়, তবু মক্কা-মদিনার ওপর বিদেশী রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বন্ধ রাখার দাবি। মেসোপটেমিয়া-আরব-সিরিয়া-প্যালেস্টাইনে খলিফার উপর খবরদারির চেষ্টা বন্ধ করার দাবি। সেই অর্থে, দাউদ সাহেব বলছেন, তারা অন্তর্মুখী নয়, তাদের গলায় প্যান-ইসলামিজ্মের সুর। এই 'প্যান' কথাটা বিশেষ করে খেয়াল কর কাজি। প্যান মানে এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকতা। প্যান-ইসলামিজ্ম্ মানে পৃ্থিবীর যেখানে যেখানে ইসলামের অনুসারীরা আছে – আমার নিজের দেশের বাইরে হলেও – তাদের নিয়ে মাথা ঘামানো। এটাই খানিকটা সোশ্যালিস্টদেরও দৃষ্টিভঙ্গীর ধরণ। শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা সোশ্যালিস্টরা ভাবে না। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সাধারণ শোষিত মানুষের অর্থনৈতিক শোষণের জন্যে দায়ী, সে যদি দেশীয় পুঁজিও হয়, তাহলেও সেই ব্যবস্থা বদলানোর দাবি সোশ্যালিস্টদের। অর্থাৎ তাদের শত্রু একটা বিশেষ ধরণের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থাটাই তাদের শত্রু। সে পৃথিবীর যেখানেই হোক না কেন। নিজের দেশে হলেও তা শত্রু, অন্য দেশে হলেও তাই। সেই ব্যবস্থার পেছনে দেশীয় বা বিদেশী – যে পুঁজিই থাকুক না কেন – তারা তার বিরুদ্ধে।
এই ভাবে দেখতে গেলে, মুজফ্ফর বলতে থাকে, দাউদ সাহেবের মতে, খিলাফতি এবং সোশ্যালিস্টদের মধ্যে এক জায়গায় একটা মিল আছে। দু' দলেরই চিন্তার অভিমুখটা আন্তর্জাতিক। আমি যেটা বুঝলাম তা হল, তিনি মনে করেন যেহেতু চিন্তার অভিমুখটায় খিলাফতি আর সোশ্যালিস্টদের মিল আছে, অতএব খিলাফতিদের পক্ষে সোশ্যালিজ্মের দিকে ঝোঁকটা নন-খিলাফতিদের তুলনায় বেশি হতে পারে। আমি বলছি না দাউদ সাহেবের কথা আমি পুরোপুরি মানি, কিন্তু ঘোরতর ন্যাশনালিস্টদের পক্ষে প্রথম দাবি সোশ্যালিজ্ম কোনমতেই হতে পারে বলে আমার মনে হয় না, তাদের ক্ষেত্রে দেশীয় পুঁজির বিরুদ্ধে যাওয়াটা সহজ হবে না।
তাহলে আমরা কী করব এখন, কাজি বলে, খিলাফতিদের মধ্যে সোশ্যালিজ্মের ঝোঁক কার কার মধ্যে আছে খুঁজে বের করব?
খুঁজতে খুব একটা হবে না, বলে মুজফ্ফর, একজনের সঙ্গে তো কালই কথা বলে এলাম, কুত্বুদ্দিন আহ্মদ। আর তিনি তো এখন আমাদের বন্ধু হয়েই গেছেন। আমাদের এখন চেষ্টা করতে হবে এমন দুয়েকজনকে চিনে নেওয়া যাদের মন শুধু দেশকে ভালোবাসায় সীমাবদ্ধ নয়, দেশভক্তি নামক ইনট্যাঞ্জিব্লের বাইরেও যারা দেশের অধিকাংশ মানুষ – গ্রামের কৃষক আর শহরে নানা কাজে যুক্ত শ্রমিক – অভুক্ত অর্ধভুক্ত যারা – তাদের দেখতে পায় এবং দেশের এই মৌলিক সমস্যার সমাধানের পথ দিয়েই পরাধীনতা থেকে মুক্তির পথে পৌঁছতে চায়। কাজটা যে খুব সহজ হবে তা নয়, কিন্তু কাজটা শুরু করতে চাই। আমি জানি, এই কাজে তোমাকে আমি সঙ্গে পাব।
নিশ্চয়ই পাবে, বলে কাজি, কিন্তু আমার সম্বন্ধে তোমার ক্ল্যাসিফিকেশনটা তো বললে না। সত্যি সত্যিই তোমার এই কাজে সাহায্য করার আমি যোগ্য কিনা সেটা তো বুঝতে হবে।
হেসে ফেলে মুজফ্ফর, বলে, সে তো বলবই, তবে তার আগে আমার নিজের সম্বন্ধে কী আমি ভেবেছি সেটা আগে বলি। দেখ, তোমার চেয়ে বয়েসে আমি অনেকটাই বড়। আমার কৈশোর থেকে যৌবনে বেড়ে ওঠার সময়টায় দেশে স্বদেশী আন্দোলন আর সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের নানান ক্রিয়াকলাপ। যে স্বদেশী আন্দোলনের কথা বলছি, যা শুরু হয়েছিল বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে, তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরে তিনি নিজেকে স্বদেশী আন্দোলন থেকে সরিয়ে নেন এবং তাঁর নিজের আদর্শের স্বদেশী-স্বরাজকে পারিবারিক জমিদারিতে রূপ দেবার কাজে নেমে পড়েন। তুমি বলছিলে পিংলা তোমাকে সেরকমই লিখেছে। পরে অবিশ্যি গান্ধী যে আন্দোলন শুরু করেন এবং মূলত আজকের কংগ্রেসিদের যে লড়াইটা, সেটা ওই স্বদেশী আন্দোলনেরই মহাত্মা গান্ধীকৃত রূপান্তর, যার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ একেবারেই একমত হতে পারেননি।
এদিকে দেখ, সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের আন্দোলনে যে রোম্যান্টিকতা ছিল তাতে আমার পক্ষে সে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়াই স্বাভাবিক ছিল। সেটা যে হল না তার কারণ ওই আন্দোলনের স্রষ্টা এবং প্রথম দিকের রূপকার যাঁরা, তাঁরা ইনট্যাঞ্জিব্ল্ দেশভক্তিকে ট্যাঞ্জিবিলিটি দেবার চেষ্টায় যা করলেন, সেটা। দেশমাতৃকা পর্যন্ত ঠিক ছিল – দেশ তো মায়ের মতোই – কিন্তু ওই মাতৃকার বিবরণ দিতে গিয়ে ওঁরা বললেন ত্বম হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী। দেশমাতৃকার এই বিবরণে কাজি নজরুল ইসলামের কোন অসুবিধে নেই আমি তা জানি, কিন্তু সন্দ্বীপের গ্রাম্য স্কুলের ছাত্র মুসলমান পরিবারের এক বালকের পক্ষে – এমনকি সে তখন প্রবাসীতে প্রবন্ধ লিখলেও – এই দেশমাতৃকার জন্যে মরণপণ করা কি সম্ভব ছিল? পাঁচ ওয়ক্ত না হলেও শুক্কুরবারে একবার অন্তত আমি নমাজ পড়তুম, আর রমজানেও তখন রোজা রাখতুম! এর পর কলকাতায় এসে আমার মধ্যে অনেক বদল এল। ঠাণ্ডা মাথায় নিজেকে বিশ্লেষণ করে ঠিক করলুম, হয় সাহিত্য নয় তো রাজনীতি, দুটোর মধ্যে একটা হবে আমার সারাদিনের কাজ। সুযোগ পেলেই সাহিত্যের আলোচনায় ঢুকি, কংগ্রেস বা খিলাফতি, সবায়েরই মীটিং-মিছিল-সভা-সমিতিতে ঘোরাঘুরি করি, কিন্তু কোথাও, যাকে বলে কমিট করা, তার মধ্যে ঢুকি না। এই করতে করতে এতদিনে আমি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারছি, ওই যাদের সম্বন্ধে বললাম অভুক্ত অর্ধভুক্ত খেটে-খাওয়া বেশির ভাগ মানুষ, তাদের রাজনৈতিক মদত দেওয়াই হবে আমার কাজ। খিলাফতিগিরি আমি করতে পারব না, কারণ কোন সাম্প্রদায়িক ধর্মেই আমার আর কোন মোহ নেই, কিন্তু সোশ্যালিজ্মের জন্যে লড়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল। আপাতত সেটাই আমার কাজ হবে। তাতে যদি খিলাফতিদের সাহায্য নিতে হয়, নেব।
আর আমি?– প্রশ্ন করে কাজি।
তুমি? তুমিই খানিকটা আমার প্রেরণা বলতে পার। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে যখন তুমি প্রথম কবিতা পাঠালে করাচি থেকে, আমি তখন সমিতির সহকারী সম্পাদক। তার আগে দুয়েকখানা চিঠিও তুমি লিখেছিলে। কিন্তু ক্ষমা নামে একটা কবিতা যখন পাঠালে, তা ছাপা হল। তোমার প্রথম ছাপা কবিতা। ছাপাবার সময় শুধু কবিতাটার নাম আমি বদলিয়ে দিয়েছিলাম, ক্ষমার বদলে মুক্তি। তুমি রাগ তো করলেই না, চিঠি লিখে ধন্যবাদ দিলে। এর পর প্রথমে হেনা আর তারপর ব্যথার দান – দুটো গল্প পাঠালে তুমি। সেগুলোও সাহিত্য পত্রিকায় ছাপা তো হলই, কিন্তু একই সঙ্গে আরও একটা ঘটনা ঘটল। আমি তোমার ভক্ত হয়ে গেলাম।
ভক্ত হয়ে গেলে? আগে তো কখনও বলনি? হলে কেন?
তোমার গল্পে শস্যশ্যামলা বঙ্গভূমি নেই কোথাও, দুটো গল্পেই ঘটনাগুলো ঘটছে বেলুচিস্তান আফগানিস্তান ককেশাসে। সীমান্ত পেরোতে হয়নি, করাচিতে গিয়েই তোমার কল্পনা তোমার মধ্যে আন্তর্জাতিকতা নিয়ে এসেছে। লাহোরের কলেজের ছেলেরা মূলত ধর্মীয় উন্মাদনায় সীমান্ত পেরিয়েছিল, তোমার ক্ষেত্রে সেই উন্মাদনার প্রয়োজন হয়নি, তোমার কল্পনাই তোমাকে সীমান্ত পার করিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, ব্যথার দান-এ তুমি নিজেই নিজেকে পৌঁছিয়ে দিয়েছ লালফৌজের কাছে। আর লালফৌজ নিয়ে কী তোমার কল্পনা? তারা যে শুধুই উৎপীড়িত বিশ্ববাসীর পক্ষে লড়ছে তা-ই নয়, মন-ভেঙে যাওয়া সয়ফুলই হোক, বা নিজের ওপর ক্ষুণ্ণ নূরন্নবী, লালফৌজের সংস্পর্শে মানসিক ক্লেদমুক্ত হয় দুজনেই।
রাশিয়ার প্রোলেটারিয়েট বিপ্লবের খবর আমরা একটু একটু পাই কলকাতায়, কিন্তু তাদের উল্লেখ করে বাংলা গল্প! ভাবা যায়! আমি অবিশ্যি একটা কাজ করলাম। তু্মি বৃটিশ ভারতের সৈনিক, আমাদের বৃটিশ প্রভুরা রাশিয়া থেকে প্রায় কোন খবর এ দেশে ঢুকতেই দেয় না। যাকে বলে বলশেভিজ্ম্, তাতে ওদের প্রবল ভয়। বিপ্লবের আগে পর্যন্ত মহাযুদ্ধে রাশিয়া আর বৃটেন সঙ্গী ছিল। বিপ্লবের পর সে অবস্থা বদলিয়ে গেছে, রাশিয়ার নামে ওরা জুজু দেখে এখন। যে গল্প তুমি পাঠিয়েছ সে গল্প তুমি – করাচির সেনাব্যারাকের অধিবাসী এক বাঙালি হাবিলদার – লিখেছ জানলে তোমাকে কি ছাড়বে ওরা? অথচ গল্পটা আমি ছাপাতে চাই। কাজেই, তোমাকে না জানিয়েই তোমার 'লালফৌজ' কথাটা আমি বদলিয়ে দিলাম, লালফৌজ হল মুক্তিসেবক সৈন্যের দল। আর, তার পরে পরেই যুদ্ধ থেকে ছুটি পেয়ে কলকাতায় এসে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে থাকবার আমন্ত্রণ জানিয়ে তোমাকে লিখলাম চিঠি।
দে গোরুর গা ধুইয়ে – চিৎকার করে চেয়ার ছেড়ে উঠে একটা আড়মোড়া ভেঙে বলে কাজি, বত্তিরিশ নম্বরে আমাকে থাকতে দেবার পেছনে এত গপ্পো আছে তা তো জানতুম না। চা খাবে?
মুজফ্ফরকে কিছু বলবার সুযোগই দেয় না কাজি, খানিকটা জল কেটলিতে ঢেলে হীটারটা চালু করে দেয় সে। মুজফ্ফরও ওঠে, চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। যখন ফেরে সে, চা ছাঁকছে কাজি। মুজফ্ফরের হাতে বিস্কুটের একটা ঠোঙা। একটা কাপ মুজফ্ফরকে দিয়ে নিজের কাপটায় একটা চুমুক লাগিয়ে বলে সে, তোমার কথার মাঝখানে কথা বলতে চাইনি। কিন্তু এবার বল, ত্বম হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণীতে তোমার অসুবিধে থাকলে আমার থাকবে না কেন?
এই প্রশ্নটা করাচি থেকে ফিরেই যদি উঠত তাহলে উত্তর দেওয়ার অসুবিধে ছিল। আজ আর কোনই অসুবিধে নেই, তোমার সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়ে গেছে আমার। এ পর্যন্ত যত মানুষ আমি দেখেছি – খুব কম যে দেখেছি তা তো নয় – তাদের মধ্যে সম্ভবত তুমিই একমাত্র মানুষ যাকে যদি বলা হয় একটুও না ভেবে একটি মাত্র স্বতস্ফূর্ত শব্দে নিজের পরিচয় দিতে, তা হলে যে শব্দটি তুমি উচ্চারণ করবে তা হল – বাঙালি। তোমার মাথাতে অন্য কিছু আসবেই না। তুমি চুরুলিয়ার ফকির আহ্মদ সাহেবের পুত্র, তুমি কবি, শিল্পী, গল্পকার, তুমি পরীক্ষায় ভালো ফল করার প্রায় নিশ্চিত সম্ভাবনা সত্ত্বেও স্কুল ছেড়ে হঠাৎ যুদ্ধের দলে নাম লেখানো রিক্রুট, অতি অল্প সময়েই সেপাই থেকে হাবিলদার হয়ে ওঠা সফল সৈনিক তুমি, তুমি মুসলমান, তুমি হিন্দু – কিন্তু হিন্দু-মুসলমান কোন কিছুই নও তুমি, তুমি বাঙালি।
এই যে মুসলমান আর হিন্দু দুটোই বললাম তোমাকে, তার মধ্যে কোন বিরোধ নেই কিন্তু। কেন তুমি দুটোই, সে কথায় পরে আসছি। কিন্তু খেয়াল করে দেখো, নিজের একটা ধর্মীয় পরিচয় দেওয়াটা আধুনিক মানুষের প্রায় মজ্জাগত। এতটাই মজ্জাগত যে নিজেকে নাস্তিক বলে পরিচয় দেয় যারা – তুমিও ইদানিং বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় চাল মেরে নিজেকে নাস্তিক বলে চালাতে চেয়েছ কখনো কখনো – তারাও জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়টা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারে না। অবচেতনের মুরুব্বিপনায় অসতর্ক মুহূর্তে তারাও বলে ফেলবে আমি হিন্দু আমি ক্রিশ্চান বা আমি মুসলমান! এর একমাত্র ব্যতিক্রম তুমি, তুমিই বোধ হয় আমাদের চেনাশোনাদের মধ্যে একমাত্র বাঙালি, যে বাঙালিই শুধু। এতটাই, যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলে কিছু যদি থাকে, আমি বলব, আমার চেনাশোনাদের মধ্যে তুমিই তাহলে একমাত্র খাঁটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী। তার মানে এই নয় যে তুমি নিজেকে ভারতীয় মনে কর না, খাঁটি ভারতীয়ও তুমি নিশ্চয়ই, এমনকি কখনো কখনো জাতীয়তাবাদী ভারতীয়ও, কিন্তু সব সত্ত্বা পেরিয়ে তোমার বাঙালি সত্ত্বাটাই সবচেয়ে বড়। দেখ, বাঙালিদের মধ্যে প্রধান ধর্ম দুটো, ইসলাম আর হিন্দু ধর্ম, তোমার দুটোতেই স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তোমার বাবা তোমার নাম দিয়েছেন নজরুল, তুমি বলেছ তোমার মা তোমাকে তারাখ্যাপা বলে ডাকেন। ছেলেবেলা থেকে লেটোর দলে তুমি রামায়ণ মহাভারত হিন্দু-পুরাণের নানা গল্প নিয়ে গান বেঁধেছ, আবার ইমামতিও করেছ মসজিদে। তখন থেকেই, সেই ছেলেবেলা থেকেই তু্মি ধর্মীয় গোঁড়ামির বাইরে একজন খাঁটি বাঙালি। ব্যাপারটা কেমন জান তো? ধর, একটা কাগজে দাগ কেটে পাশাপাশি দু' রঙে দুটো আলাদা ভাগ করলাম, একটা ভাগে ইসলাম আর একটায় হিন্দু ধর্ম। ওই দাগটাই দুটো ধর্মের সীমানা। তুমি কোথায় জান? ঠিক ওই দাগটার মাঝখানে। ডাইনে-বাঁয়ে যেদিকেই যাও তুমি সমান স্বচ্ছন্দ। তুমি হিন্দুও মুসলমানও, তুমি না-মুসলমান না-হিন্দুও। তুমি বাঙালি।
কাজি এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল, কথা বলছিল না একটাও। শুধু তার মুখমণ্ডলের আর শরীরের অভিব্যক্তিগুলো বদলিয়ে যাচ্ছিল ঘন ঘন। এবার সে কথা বলল অনেকক্ষণ পর, বলল, তোমার কথাগুলো কবিতার মতো শোনাচ্ছিল মুজফ্ফর ভাই।
কবিতাই তো, বলে মুজফ্ফর, প্রাণের কথা মনের কথা লিখতে লিখতে একজন কবি তো নিজেই কবিতা হয়ে ওঠেন। তাঁর সম্বন্ধে কথা বলতে গেলে তা-ও কবিতাই হয়ে ওঠে তাই। তোমাকে যে এত মানুষ এত সহজে ভালোবেসে ফেলে সে কি এমনি এমনি? রবীন্দ্রনাথের দিকে যখন তাকাও, তাঁর পাদস্পর্শ করলে যখন ছাড়তে পার না, সেও তো মনুষ্যরূপী ওই কবিতারই টান।
কথাবার্তায় এতটা আবেগ সচরাচর দেখা যায় না মুজফ্ফরের মধ্যে। এখন আবার সচেতন হয়ে যায় সে। একটু থেমে, তারপর একটু হেসে, সে বলে, তোমার বয়েস এখন অনেক কম। আমি কিন্তু নিশ্চিত জানি ভবিষ্যতে কোন এক দিন বাঙালি যদি কোন কবিকে বাঙালির জাতীয় কবির সম্মান দেয়, সে কবি হবে কাজি নজরুল ইসলাম।
কানে আঙুল দেয় কাজি, বলে, তুমি পাগল হয়ে গেছ মুজফ্ফর ভাই। রবীন্দ্রনাথকে ভুললে নাকি?
রবীন্দ্রনাথ?– বলে মুজফ্ফর। রবীন্দ্রনাথের কথা আলাদা। পৃথিবীর কোন জাতি তাঁকে তাদের জাতীয় কবির আখ্যা দিতে পারবে না আর কোনদিন। এসব ধরাবাঁধার অনেক বাইরে তিনি। তিনি সব জাতির ঊর্ধ্বে। তাঁর পরিচয় তিনি বিশ্বকবি।
এই সব কথাবার্তার মধ্যে নজরুল হঠাৎ বলে ওঠে, কথা তো অনেক হল, এখন কাজ। তুমি বলেছিলে কিরণশঙ্কর রায়ের কাছে যাবে, তাঁকে ডিরেক্টর হতে রাজি করাবে। যাবে নাকি?
হ্যাঁ, যাব, বলে মুজফ্ফর, তবে ভাবছি আজ যাব না। আজ আবার যাব কুত্বুদ্দিন সাহেবের কাছে। কাল থেকে একটা নাম মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, আবদুর রেজ্জাক খাঁ, চেনো তাকে?
উঁহুঁ, চিনতে পারলুম না।
তের সাল থেকে আমি কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা। সেই সময় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি তৈরি হল, কিন্তু কোন অফিস ছিল না। আকরম খাঁর কাগজ ছিল মোহাম্মদী, মোহাম্মদীর অফিসই তখন ছিল সাহিত্য সমিতিরও অফিস, মীটিং-ফিটিং সব সেখানেই হত। সেখানেই প্রথম দেখা হয়েছিল রেজ্জাকের সঙ্গে। সে আকরম খাঁর ভাতিজা-ভাগনা কিছু একটা হবে, কলকাতা মাদ্রাসায় পড়ত তখন। আঠের সালে যখন বত্রিশ নম্বরে উঠে এল সাহিত্য সমিতির অফিস, সেখানেও তখন কয়েকবার সে এসেছে। তখন ও ঘোরতর খিলাফতি, কিন্তু সোশ্যালিজ্মের কথাও বলতো। বহুদিন দেখিনি ওকে, কিন্তু মনে হয় ওকে দিয়ে কাজ হবে। তাই ভাবছি কুত্বুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করি একবার, ওর খবর কিছু দিতে পারেন কিনা।
ঠিক আছে, তুমি তাহলে কুত্বুদ্দিন সাহেবের কাছেই যাও, আমারও দুয়েকটা কাজ আছে, আমি সেরে আসি, বলে নজরুল। কাল যদি যাও কিরণশঙ্কর রায়ের কাছে, আমিও যেতে পারি।
কুমিল্লার জন্যে মন কেমন করছে নজরুলের কয়েকদিন ধরেই, যেতে হবে যত তাড়াতাড়ি পারে। কিন্তু আরও কিছু টাকা দরকার। একশো টাকা পাওয়া গিয়েছিল আফজালুলের কাছ থেকে, অনেকটাই খরচ করে ফেলেছে তার। টাকা আরো কিছু সংগ্রহ করতেই হবে। বত্তিরিশ নম্বরেই যাবে ঠিক করল নজরুল, আফজালুলই ঠিক ঠিক পরামর্শ দিতে পারবে কোন কোন লেখা থেকে আশু আয়ের বন্দোবস্ত হতে পারে।
আফজালুল যেন অপেক্ষাই করছিল নজরুলের জন্যে। বলল, সেদিন আমি কি আপনাকে শুধু ব্যথার দানের কথাই বলেছিলাম?
শুধু ব্যথার দানের কথা মানে?– নজরুল ঠিক বুঝতে পারেনি প্রশ্নটা, বলল, কী কথা ব্যথার দানের?
মানে, আপনার সঙ্গে যে কপিরাইটের কথা হল, আমি একশো টাকা দিলাম, তখন কি শুধুই ব্যথার দানের কপিরাইটের কথাই বলেছিলাম?
আমার তো সেরকমই মনে হচ্ছে, কেন, কিছু ভুল হল নাকি?
হ্যাঁ, ভুল হয়েছে, খুবই ভুল হয়েছে, পরে আমি ভেবে দেখলাম। ইন ফ্যাক্ট, বলে আফজালুল, আমি প্রিন্টারের সঙ্গেও কথা বলছিলাম। সে-ও তাই-ই বলল। বলল, ওইটুকু গল্পে বই দাঁড়াবে না।
দাঁড়াবে না তো কী হয়েছে?– বলে নজরুল, আর একটা গল্প দিয়ে দিন না। ধরুন, হেনা। হেনাও যদি দিয়ে দেন, দুটো গল্প মিলে হবে তো বই ঠিকঠাক? তবে হেনা দিলেও বইটার নাম ব্যথার দানই রাখব। প্রথম গল্পের নামে নাম, যেমন হয় অনেক গল্পের বইয়ে।
আপনাকে আমার বলতে লজ্জা করছে কাজিসাহেব, বলে আফজাল, আসলে সেদিন যখন কথা বলছিলাম আপনার সঙ্গে, তখন ব্যবসার বাস্তবিকতার চেয়েও আবেগ কাজ করেছিল বেশি। একটু বেহিসেবী হয়ে পড়েছিলাম। আমার মনে হয় শুধু হেনাও যথেষ্ট নয়, আরও কিছু একটা দিতে হয়।
আরে, আপনি এত সঙ্কোচ করছেন কেন আফজাল সাহেব, কোন কিছু লেখা-পড়া হয়নি, শুধুমাত্র আমার মুখের কথায় আপনি নগদ একশো টাকা দিয়ে দিলেন সেদিনই, বন্ধুবান্ধবের মধ্যে অত হিসেবের কী আছে! আর ক'খানা গল্প লাগবে আপনার? বাদল বরিষনে আর ঘুমের ঘোরে দিলে হবে?
আপনার কোন তুলনা হয় না কাজিসাহেব, আবেগাপ্লুত আফজাল বলে, আপনি মহানুভব!
বিকেলের দিকে আসে পবিত্র গাঙ্গুলি, এসেই অভ্যেস মতো কয়েকটা মাসিক পত্রিকা উল্টেপাল্টে দেখতে শুরু করে। নজরুল বলে, তোর কি ওই পত্রিকাগুলো এখনই না পড়লেই নয়?
কেন, কী বলতে চাইছিস তুই?
তুই যদি ফ্রী থাকিস, তাহলে গোলদীঘিতে গিয়ে বসতুম একটু। এখানে বড্ড প্যাচপেচে গরম। বাইরে এখন হাওয়াও আছে কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে না।
কলেজ স্কোয়ার বা গোলদীঘি, দুটো নামেই ডাকা হয় এই জলাশয় আর তার সন্নিহিত ঘাস বা বেঞ্চির বসার জায়গাটাকে। সেখানেই বসল ওরা। কীভাবে আফজালুলের কাছে ব্যথার দানের কপিরাইট বিক্রি করেছে পবিত্রকে বলে কাজি। আরও বলে, যত তাড়াতাড়ি পারে কুমিল্লায় আবার ফিরে যাবার জন্যে ওর প্রাণ আকুপাকু করছে। কিন্তু আগের বারের মতো ভিখিরি হয়ে এবারটা ও যেতে চায় না, তাই আরও দুয়েকটা লেখার কপিরাইট ও বেচবে। পবিত্র ছাড়া আর এমন কেউ নেই যাকে ও এ কথা বলতে পারে। পবিত্র কি সাহায্য করবে ওকে?
হেসে ফেলে পবিত্র, তোর ব্যাপারটা কী বল্তো। আবার কোথায় ফাঁসলি কুমিল্লায়? নাকি নার্গিসের জন্যে মন-কেমন করছে?
পবিত্রর কথার সরাসরি কোন জবাব দেয় না কাজি, বলে, আমার কমিটমেন্ট আছে।
দেখ নুরু, টেনশনে রাখিস না, বলে পবিত্র, নার্গিস ছাড়া তোর আবার কিসের কমিটমেন্ট, কার কাছে কমিটমেন্ট কুমিল্লায়? আর কোথাও ফাঁসিসনি তো ওখানে? বীরেনের শুনেছি তিনটে ছোট বোন আছে, কিন্তু তারা তো নেহাৎই শিশু। তাহলে কোথায় তোর কমিটমেন্ট?
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম কাজির। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে অনাবশ্যক চিৎকারে সে বলে, সবাইকে তুই চিনিস নাকি? প্রিন্স অব ওয়েল্স্ আসবে নভেম্বরে, তার প্রতিবাদ জানানো হবে না কুমিল্লায়? আর, তা ছাড়া, আমার মা নেই নাকি ওখানে?
হুঁ, তোর কমিটমেন্ট তো তোর ঘাম মোছা আর গলার আওয়াজ থেকেই বুঝতে পারলুম, পবিত্র বলে, না বলবি তো বলিস না। কিন্তু কপিরাইট বেচবি কেন? কপিরাইট বেচা তো ডিস্ট্রেস সেল, ওতে কতটা লোকসান হয় তোর ধারণা আছে? সারা জীবন ধরে তোর বই বেচে পয়সা লুটবে পাবলিশার, তোকে ক' পয়সা ঠেকাবে তুই জানিস?
আর্থিক ভাবে আমি তো ডিস্ট্রেসের মধ্যেই আছি, ডিস্ট্রেস সেল না করে উপায় কী?
কত টাকা তোর দরকার?
শ পাঁচেক, বলে কাজি।
আফজাল কত দিয়েছিল তোকে?
এর আগে মুজফ্ফরের সঙ্গে আলোচনায় নজরুল বুঝেছিল আফজাল ওকে যথেষ্ট টাকা দেয়নি। এবং, প্রথমে শুধুমাত্র ব্যথার দানের কথা বলে শেষ পর্যন্ত আজ মোট চারখানা গল্প নিয়ে নিল আফজাল। এ কথা ও কোনদিনই মুজফ্ফরকে বলতে পারবে না। পবিত্রকেও কি বলা ঠিক হবে? ও বলল, আফজাল বন্ধুবান্ধবের মধ্যে। ওর কাছ থেকে কমই নিয়েছিলুম আমি।
শোন নুরু, তোকে একটা কথা বলি, বলে পবিত্র। তুই কম নিয়েছিলি না তোকে কম দেওয়া হয়েছিল সেটা নিয়ে তর্ক করতে আমি এখন রাজি নই। টাকার অঙ্কটা জানতে পারলে নানা পাবলিশারের সঙ্গে দরাদরি করার সুবিধে হবে। পাবলিশাররা মোটামুটি কোথা থেকে শুরু করতে পারে সে বিষয়ে খানিকটা ধারণা থাকলে সেই অনুযায়ী নিজেদের একটা স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা যায়। আচ্ছা বল্তো, ঠিক কতদিনের মধ্যে টাকাটা তোর হাতে আসা দরকার। ঠিক ঠিক কবে তুই কুমিল্লায় পৌঁছোতে চাস?
পুজোর ছুটিতে যাব ভেবেছিলুম। তার মানে, লেটেস্ট বাই অক্টোবর।
তার মানে বেশি সময় নেই তো হাতে।
সেই সন্ধ্যেতেই কলেজ স্ট্রীট অঞ্চলের কয়েকজন পাবলিশারের সঙ্গে দেখা করল নজরুল আর পবিত্র। নজরুলের নাম শুনেছে তারা প্রত্যেকেই, আলাপ করেও খুশি তারা। অথচ আশ্চর্য এই যে, কপিরাইটে তেমন উৎসাহ দেখাল না কেউই। আপনাদের লেখা, বুঝলেন তো, ওই পত্রপত্রিকাতেই পড়ে নেয় উৎসাহী যারা, বই হিসেবে এসব চলা মুশকিল, বলল একজন। আর একজন পাবলিশারের মতে, বিক্কিরি হয় স্কুল-কলেজের বই। বই লিখে স্কুল-কলেজে 'পুশ' করুন, দেখবেন বিক্কিরি হয়ে যাবে হু হু করে। পবিত্র বলে, বই আগে ছাপা হবে তারপর তো 'পুশ'-এর প্রশ্ন। আপনারা ছাপান তো আগে, তারপর না হয় 'পুশ'-এর ব্যাপারে আমরাও চেষ্টা করব!
ফিরে এসে স্যাঙ্গুভ্যালিতে এক কাপ করে চা নিয়ে বসে ওরা।
আফজালের শুধু শুধুই বদনাম করিস তোরা, নজরুল বলে। দেখলি তো কম হোক বেশি হোক একটা অফারও দিল না কেউ। মাঝখান থেকে শুধু উপদেশ!
পবিত্র বলে, এরকমই হয় বন্ধু। তুমি পাবলিশারের দরজায় দরজায় ঘুরছ, গরজটা তোমার। বাড়িতে যখন ফেরিওলা এসে কিছু বেচতে চায়, কী করি আমরা? প্রথমেই ভাব দেখাই, ও যা নিয়ে এসেছে, ধর শান্তিপুরী ধুতি একখানা, আমার সে জিনিষের দরকারই নেই কিছু। আর কিনতে চাইও যদি, ও যে দাম চাইবে চেষ্টা করি তার অর্ধেক দিতে, তাই না? আর সেই আমিই, নিজে যখন যাই ধুতি কিনতে দোকানে, দোকানদার যা দাম চায়, তা-ই! কোন কথা নয়! ফিক্সড প্রাইস, বুঝলি! গরজটা যার! তোর ব্যথার দানের ব্যাপারে আফজাল তোকে যদি বলে থাকে একশো টাকা, গরজটা ওরই ছিল, তুই স্বচ্ছন্দে বলতে পারতিস, ভেবেছিলুম আড়াইশো নেব, তবে আপনি বন্ধু মানুষ, দুশোই দিন!
এইসব আলোচনা চলতে চলতেই স্যাঙ্গুভ্যালিতে ঢুকলেন ঝকঝকে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক। নজরুল চেনে এঁকে, মাখনলাল গাঙ্গুলি, ও যখন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে থাকত তখন প্রায়ই দেখত ওঁকে। কম কথা বলেন, বত্তিরিশে যতক্ষণ থাকেন কিছু-না-কিছু একটা পড়তেই থাকেন। সম্ভবত সাহিত্য সমিতির পরিচালন সমিতিরও উনি সভ্য, মীটিং-ফিটিঙে থাকতে দেখেছে ওঁকে নজরুল। শুনেছে, সমিতির রীডিং রূমে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের প্রায় সব বই উনিই প্রভাতকুমারের কাছ থেকে চেয়ে এনেছিলেন। পবিত্ররও মুখচেনা উনি, দেখেছে ওই রীডিং রূমেই, কিন্তু কথা হয়নি আগে।
ওদেরই টেবিলে বসতে বসতে নজরুলকে বলেন মাখনবাবু, ব্যাপারটা কী, দু-আড়াই ঘন্টা ধরে কলেজ স্ট্রীটে ঘুরপাক খাচ্ছেন দেখলাম। চক্রবর্তী চ্যাটার্জির দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলাম, ওদের খোলা দরজাটা দিয়ে বেশ কয়েকবারই দেখলাম আপনারা পশ্চিম থেকে পুবে যাচ্ছেন, আবার ফিরছেন পুব থেকে পশ্চিমে!
নজরুল পবিত্রর পরিচয় দেয় আগে, তারপর ওর স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে কোন কিছু রাখঢাক না করেই বলে, ঠিকই দেখেছেন স্যর, পাবলিশারদের কাছে ঘোরাঘুরি করছিলুম।
পবিত্রবাবুকে চিনতাম না আগে, কিন্তু নাম শুনেছি, আর ওঁর লেখা পড়েওছি দুয়েক জায়গায়, বিশেষ করে প্রমথ চৌধুরির সবুজপত্রে, আর আপনি নজরুল ইসলাম তো বিখ্যাত লেখক, আপনারা পাবলিশারদের কাছে ঘোরাঘুরি করছিলেন! পাবলিশারদেরই তো ঘোরাঘুরি করার কথা আপনাদের কাছে। কী ব্যাপার, রেয়ার কোন বই...? আমি সাহায্য করতে পারি?
নজরুল সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলে, চা খাবেন তো স্যর?
আপনার ব্যস্ত হবার দরকার নেই কাজিবাবু, মাখনলাল বলেন, আমাকে এখানকার ছেলেরা ঢুকতে দেখেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার লেবু-চা হাজির করবে। আপনারাও কি আর এক রাউণ্ড খাবেন? চা? লেবু দিয়ে না দুধ-চিনি?
সোজাসুজি মাখনবাবুর দিকে নয়, নজরুলের দিকে তাকিয়ে তার চোখের ভাষা পড়তে পড়তে পবিত্র জবাব দেয়, খাইই যদি লেবু দিয়েই খাই, আর তারপরেই বলে, কাজি কয়েকটা লেখার কপিরাইট বেচতে চায়, সেইজন্যেই পাবলিশারদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলাম আমরা।
বেশ জোরে কাউন্টারের ভদ্রলোকের উদ্দেশে মাখনবাবু বলেন, আমার চা আরও দু' কাপ পাঠাবেন। তারপর পবিত্রকে জিজ্ঞেস করেন, কিছু কথাবার্তা হল? ফাইনাল করতে পেরেছেন?
না, বলে পবিত্র, এরা তো কথাই বলতে চায় না। ভাবটা এই, যেন কোনই আগ্রহ নেই ওদের।
সেটাই তো করবে, বলেন মাখনলাল, নজরুল ইসলামের স্ট্যাণ্ডার্ডের কোন লেখক নেহাত বিপদে না পড়লে কপিরাইট বেচবার জন্যে পাবলিশারদের দরজায় দরজায় ঘুরবে না। ওরা ব্যবসাদার, ওরা এটা ভালোই বোঝে। আমি একটা উপদেশ দেব? কয়েকদিন বিরতি দিন, এখনই আর কোন পাবলিশারের কাছে যাবেন না। খবরটা যদি চাউর হয়, ওরাই কেউ আপনাদের খুঁজে বের করবে। না যদি করে, আমি আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব, তখন দেখব কী করা যায়। আমি লেখক নই, শুধুই পাঠক। কিন্তু বই যারা ছাপে তাদের অনেককেই চিনি।
চা এসে যায় এর মধ্যে, তিন কাপ চা, একটা ডিশে দু'খানা নিমকি; হাতে তৈরি, ময়দার উপর কালোজিরের ছিটে, নিপাট ভাঁজ। যে ছেলেটি নিয়ে এসেছে এগুলো, মাখনবাবু জিজ্ঞেস করেন তাকে, ওঁদের নিমকি?
আপনি তো বললেন আরও দুটো চা, নিমকি তো বলেননি, বলে ছেলেটা।
যেমন বুদ্ধি! যাঃ, দৌড়ে নিয়ে আয়। যতক্ষণ না তোর নিমকি আসছে, আমি চা-য়ে মুখ দিচ্ছি না।
ছেলেটা সত্যি সত্যিই দৌড়িয়েই নিয়ে আসে নিমকির ডিশ দুটো।
চা-য়ে একটা চুমুক, নিমকিতে একটা কামড়, আবার চা-য়ে একটা চুমুক। তারপর মাখনবাবু বলেন, আপনাদের বয়েস কম। দুজনেই তো মনে হচ্ছে বিলিতি মিলের জামাকাপড় পরেছেন। আপনারা খাদি বর্জন করেছেন নাকি?
মিল বর্জন করিনি, খাদিও ধরিনি, বলে পবিত্র।
আপনিও তো, হাসে নজরুল।
হ্যাঁ, আমি প্রাচীনপন্থী, বলেন মাখন, বিপিন পালের মতো আমিও যুক্তিতে বিশ্বাসী, যাদুতে নয়। এই গরীব মানুষের দেশে গরীব-গুর্বোর পরনের সস্তার বিদেশী মিলের ট্যানা কেড়ে নিতে আমার গায়ে লাগবে। বিবেকানন্দর উপদেশেই হোক আর আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখায় মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়েই হোক – গান্ধী অবিশ্যি নিজের অধোবাসের ঝুল কমিয়ে ফেলেছেন। গান্ধী কাদের শেখাচ্ছেন তিনিই জানেন। এদেশের গরীব লোক ওই ট্যানাটুকুই পরে, বরাবরই পরে এসেছে, তার বেশি এমনিতেই জোটাতেই পারে না। এখন যদি ওটা খাদির কিনতে হয় ওটুকুও জুটবে না।
চায়ের কাপে পলিটিক্স্। কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যায় বোঝাও যায় না।