একবিংশ শতক পড়ার বছরকয়েক আগে যোগ দিলাম এক গ্রামের কলেজে। আশেপাশে নগরায়ন শুরু হয়েছে বটে, তবু মফস্বল বলা যাবে না, কারণ ঠিকানাটা পঞ্চায়েত। আমি মহানগরিনী। সারাদিনে বেশ কয়েকঘণ্টা উজিয়ে যেতে হয় কলেজে, ট্রাফিক জ্যাম, ঘেমেনেয়ে একশা হই। তবু কলেজে পৌঁছে গেলে ভারি তৃপ্তি। গাছগাছালির হাওয়া, পাখির ডাক তো আছেই, তার ওপর ক্লাসঘরে কখনও মুখ বাড়ায় কাঠবিড়ালি, তো কখনও বেজি, পাশে ছোট নদীতে ভেসে বেড়ায় কী ওগুলো? ছোট ছোট কুমীর নাকি? প্রবীণ সহকর্মী বলেন, ‘দূর পাগল! ও হল গোসাপ’। তবে কলেজের সব কিছুর চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হল ক’টি উৎসুক মুখ – যারা বসে আছে এই ভেবে, ‘মেডাম কখন আসবেন?’ হায় কপাল, এ কলেজে ভূগোল বিভাগে আমি প্রথম ফুল টাইমার। সকাল থেকে তিনটে ক্লাস নিয়ে ওদেরই বলে খেতে আসি। কলেজে মহিলা অধ্যাপিকাদের শৌচাগার নেই। আসলে অধ্যাপিকা ছিল না, তাই প্রয়োজনও ছিল না। ছাত্রীরা সঙ্গে করে নিয়ে আসে, ‘মেডাম, এই আমাদের বেসিন আর এইটা টয়লেট’। খেয়েদেয়ে মাঠে প্র্যাকটিকাল ক্লাস শুরু হয়। ভৌগোলিকের জন্য এই পৃথিবীটাই ল্যাবরেটরি। ট্রানসিট থিওডোলাইট শেখাতে শেখাতে কানে আসে ফিস ফিস স্বর – ‘এ জানে মনে হচ্ছে রে সাহিনা, আগের জন এত ভালো জানত না।’ আগের জন মানে হয়তো কোনো স্টপগ্যাপ অতিথি শিক্ষক, যাঁকে আমি চিনি না। নানা ঘষামাজা, পরীক্ষানিরীক্ষা করতে করতে হঠাৎ একদিন বর্ষশেষের পরীক্ষা চলে আসে। এক একটা থিয়োরি পরীক্ষার দিন আসে, আর মেডামের বুক ধুকপুক বেড়ে যায়। পরীক্ষা শেষ হলে বাড়ি এসে ওদের ফোন করতে বলে দিয়েছি। সবার বাড়িতে তো ফোন নেই। ঐ এক-আধজন – যাদের বাড়িতে ল্যান্ড ফোন আছে – তাদেরই এই দায়িত্ব। শেষপর্যন্ত এসে যায় ফাইনাল প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার দিন। এটায় ভালো করতে পারলে মার দিয়া কেল্লা। সেন্টার পড়েছে ঐ জেলার এক নামজাদা কলেজে। সে কলেজে আছেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ এক টিউশন-সম্রাট, যিনি কোচিং ক্লাসে প্রায়ই ঘোষণা করেন – আমাদের বিভাগে সব ভুল শেখানো হয়। ছাত্রছাত্রীরাই বলে আমাকে। কিন্তু এ কী? থিয়োরি পরীক্ষার পরে কণ্ঠগুলি যেমন উজ্জ্বল থাকত, প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার পরে এমন ম্রিয়মাণ হল কেন? আমি ঘোষণা করি, পরের দিন সক্কলে কলেজে আসবে। ক্লাসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বার বার জিজ্ঞাসা করি,
- কী হয়েছে? তোমরা কোনটা করতে পারনি?
- সব পেরেছি মেডাম, কিচ্ছু ছাড়িনি।
- তাহলে? ভাইভা কেমন হয়েছে? কে ভাইভা ধরেছেন, কোনো ম্যাডাম নাকি স্যার?
- একজন স্যার, একজন মেডাম – দু’জন মিলে ভাগ করে।
- যিনি ভাইভা ধরছিলেন, তিনি ঐ কলেজের ইন্টারনাল নাকি এক্সটার্নাল, সেটা জেনেছ?
- সেটা জানি না মেডাম, বুঝতে পারিনি।
- কী জিজ্ঞেস করেছিলেন? তোমরা কি ভালো করে উত্তর দিতে পারনি? মুখগুলো কেমন ভারভার ঠেকছে।
(এবার সমস্বরে)
- উত্তর কী দেব মেডাম? দু’জনের কেউ তো ভূগোলের প্রশ্ন তেমন করলেনই না।
- সে কী! তাহলে কী ভাইভা হল?
- বলছেন, তোমাদের কলেজে অনার্স আছে? কবে হল? কতজন টিচার? টিচার কোন কলেজ থেকে পাশ করে এসেছে? নাম কী? সে কোথায় থাকে? – এইসব।
- অ্যাঁ!
- মেডাম, রোকেয়া আপনাকে কিছু বলবে।
- বল, কই রোকেয়া কোথায়?
জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকিয়ে থাকি। রোকেয়া একপাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। বন্ধুদের শত অনুরোধেও সে মুখ খোলে না। শেষে বিশ্বজিৎ বলে একটি ছেলে এগিয়ে এসে বলে,
- মেডাম, আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি, ও যেটা বলতে পারছে না, সেই কথাটা।
- বল।
- রোকেয়ার ভাইভা ঐ স্যারের কাছে পড়েছিল। আমাদের খাতায় তো এজ-সেক্স পিরামিড ছিল। স্যার সেটা দেখিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করেছেন, বলতো, ‘হোয়াট ইস সেক্স?’
আচমকা কথাটা শুনে চকিতে রগ দপদপিয়ে ওঠে। ভ্রূ কুঁচকে বলি, “তুমি চোখে চোখ রেখে উত্তর দিতে পারতে রোকেয়া – ইট ইস বায়োলজিকাল টাইপ অফ হিউম্যান বিয়িং। তুমি কী উত্তর দিয়েছ?”
রোকেয়া ধীরে ধীরে উত্তর দেয়, “আমি কিছু বলতে পারিনি মেডাম”।
সনৎ বলে আর একটি ছেলে বলে, “মেডাম আর একটা কথা আছে”।
এরপরে আরও কথা আছে? মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করে আমার। মনের অস্থিরতা লুকিয়ে শান্তভাবে বলি, “বলো”।
- মেডাম আমরা মাঠে নেমে যখন ইনস্ট্রুমেন্ট সার্ভে করছিলাম, তখন যে নন-টিচিং স্টাফেরা রেঞ্জিং রড, মিটার স্টাফ, মেজারিং টেপ ধরছিলেন, তাঁরা নিজেদের মধ্যে গল্প করছিলেন। একজন বলছে, “দেখ দেখ, এই কলেজের ছেলেমেয়েরা একটাও কথা বলছে না, চুপচাপ কাজ করছে।” তখন আর একজন উত্তর দিচ্ছে, “কিন্তু নম্বর এরাই কম পাবে দেখবি, কলেজের নামটা দেখেছিস?”
মাথায় বজ্রপাত হয় আমার। ভাইভা ব্যারাকিং, স্লেজিং – কী নামে ডাকব এইসব আচরণ? মানসচক্ষে নিজের ফেলে আসা ছাত্রীজীবনে কলেজের ক্লাস দেখতে পাই। ডিপার্টমেন্টাল হেড বলছেন, ব্রেবোনাইটদের লড়াই শুধু প্রেসিডেন্সিয়ানদের সঙ্গে। আর কোনো কলেজের ক্ষমতা নেই তোমাদের পাশে দাঁড়ানোর। শুনে বুক ফুলে উঠত আমাদের। মনটা পুরো শতাব্দী এক্সপ্রেস হয়ে আরও পিছনে ছোটে। ইস্কুলের বড়দি বলছেন, তোমরা রামকৃষ্ণ সারদা মিশনের ছাত্রী, তোমাদের দেখে বাকিরা শুধু মুগ্ধ হবে, সেই পারফেকশনে নিয়ে যেতে হবে নিজেদের। চিরকাল শুনে এসেছি – ও আপনি ঐ কলেজের ছাত্রী, তুমি ঐ স্কুলের ছাত্রী, তবে তো কোনো কথা হবে না। সেই স্তুতি, গর্ব দিয়ে তৈরি হওয়া এক ফোঁপরা আত্মবিশ্বাস আজ খানখান হয়ে লুটিয়ে যায় পালিশহীন এবড়োখেবড়ো কলেজের মেঝেয়। এডুকেশনাল এলিটিজম – তারই ফসল আমি। কোনওদিন ভেবে দেখিনি এর উল্টো পিঠে কী আছে। আজ আমার সামনে দাঁড়ানো, অপমানে কালো হওয়া মুখগুলো দেখে বুঝি এলিটিজমের পরিণাম। এও বুঝতে পারি আজ থেকে আমার জীবনের উদ্দেশ্য কী? – যাকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে চিনি, সেই আভিজাত্যকে আজ থেকে প্রান্তিক হয়ে চ্যালেঞ্জ করব আমি।
মুখে হেসে বলি, এ আর এমন কী কথা, কর্মক্ষেত্রে কত কী বাধার পাহাড় আসবে। এটুকু অভিজ্ঞতা না হলে চলবে কেন? যারা বলেছিল, তারা রেজাল্ট বেরোলেই বুঝতে পারবে। মাসকয়েক পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল বেরোয়। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সত্যি সত্যি ফলের তালিকায় ভূগোলে কলেজের প্রথম ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছাত্রের নাম জ্বলজ্বল করে – মুজিবর রহমান। সেকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া বড় সহজ কথা ছিল না। তাই সারা কলেজে, এমন কি এলাকাতেও খুশির হাওয়া বয়ে যায়। আর খুশির ঈদের কয়েকদিন আগে একটি ছাত্র এসে বলে, “আপনি ক্যাংড়া খান মেডাম? এবার ছুটিতে বাড়ি গিয়ে পুকুর থেকে ধরে আনব তবে।”