মুজফ্ফর আহ্মদ বললেন, আপনি কীভাবে জানলেন নজরুলকে এখানে পাওয়া যেতে পারে?
এটাই তো বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার অফিস? বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রীট, তাই না?
হ্যাঁ, ঠিকই, কিন্তু নজরুল তো এখানে থাকে না, কাজও করে না এখানে। তাকে এখানে পাবেন কীভাবে?
বলেছিল এখানে থাকবে।
আজ এখানে থাকবে বলেছিল? কবে বলেছিল আপনাকে?
না, ঠিক আজকেই থাকবে বলেনি। বলেছিল, কলকাতায় এলে এখানেই থাকবে। তা-ও প্রায় সপ্তা' তিনেক হয়ে গেল। আমি শুনলুম কলকাতাতেই এসেছে। তাই ভাবলুম এখানে এলে পাওয়া যাবে। ঠিক আছে, আমি তাহলে আজ যাই।
না না, এসেছেন যখন বসুন। চা-টা খান, বিশ্রাম করুন একটু। আপনি আসছেন কোথা থেকে?
এখন আসছি হাওড়া থেকে। আসলে আমি থাকি করাচিতে, যেখানে কাজিদা থাকে।
যেখানে কাজিদা থাকে? মানে, আপনিও ফর্টি নাইন বেঙ্গল ব্যাটালিয়ান?
হ্যাঁ, খানিকটা তা-ই।
খানিকটা? ঠিক আছে, আপনি বসুন একটু, আমি এই আসছি। এই মিনিট পাঁচেক, কোথাও যাবেন না। আমি যাব আর আসব।
ঘরের কোনায় একটা কাঠের র্যাকের ওপরের তাকে একটা কেটলি। সেটা নিয়ে তড়িৎ-গতিতে বেরিয়ে গেলেন মুজফ্ফর আহ্মদ। আগন্তুক যুবকটি সামনের টেবিলে রাখা এলোমেলো কাগজপত্রের মধ্যে থেকে একটা বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা নিয়ে খানিকটা অন্যমনস্ক ভাবে পাতা ওলটাতে ওলটাতে ওলটাতে হঠাৎ কী মনে করে নিজের হাতে-তখনও-ধরে-থাকা চটের ব্যাগটা হাঁটকাতে হাঁটকাতেই ফিরে এলেন মুজফ্ফর আহ্মদ। এসেই টেবিলটার ওপর রাখলেন একটা শালপাতার ঠোঙা। তাতে চারখানা ছোট ছোট শিঙাড়া। র্যাকটার মাঝামাঝি একটা তাক থেকে দুটো কাপ বের করে চা ঢাললেন। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন এটুকুই পাওয়া গেল, খেয়ে নিন। দুপুরে আমরা একসঙ্গে ভাত খাব। তার আগে আপনার “খানিকটা” বেঙ্গল ব্যাটালিয়ানের ব্যাপারটা বুঝতে চাই।
আসলে আমি সেপাই নই, কিছুই নই, কিন্তু তবুও কাজিদাদের সঙ্গে একসাথে থাকি। করাচির ক্যান্টনমেণ্টে ফর্টি নাইন বেঙ্গল ব্যাটালিয়ানের সাত হাজার সেপাই থাকে, আমি সেই সাত হাজারের কেউই নই।
আপনার গল্প দশ মিনিটে শেষ হবার নয় বুঝতে পারছি, বলেন মুজফ্ফর আহ্মদ, আপনি বরং চা-শিঙাড়াটা শেষ করুন আগে, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, তারপর শুনব আপনার কথা।
হাবভাবে সঙ্কোচটা স্পষ্ট, তবুও যুবকের খাওয়া দেখে বোঝা গেল, সকাল থেকে সে অভুক্তই ছিল। ধীরে ধীরে, যুবকের চা-শিঙাড়া শেষ হবার আগেই নিজের চা যেন শেষ না হয়, সেই গতিতে চা খেতে থাকেন মুজফ্ফর আহ্মদ। তারপর দুজনেরই খাওয়া শেষ হলে গলায় মৃদু খাকারি দিয়ে বলেন, আপনি সেপাই ন'ন, সেপাইদের কেউ ন'ন, তবুও কাজিদাদের সঙ্গেই থাকেন আপনি, কেউ আপত্তি করে না? মিলিটারির লোকরা থাকতে দেয়?
আপনাকে বললুম সাত হাজার সেপাই থাকে ক্যান্টনমেন্টে, এই সাত হাজারই যাকে এক নামে চেনে, সাত হাজারই যার যে কোন কথা দ্বিধা ছাড়াই মেনে নেয়, তার নাম কাজি নজরুল ইসলাম। সেই কাজিদা আমাকে থাকতে দিয়েছে ওখানে, সবাই আমাকে আপন করে নিয়েছে।
কাজিদা থাকতে দিল কেন? আপনাদের কি চেনাশোনা ছিল আগেই? কী নাম আপনার?
আমার নাম পিংলা।
পিংলা? সেটা তো ডাকনাম। আসল নামটা কী?
পিংলাই আমার আসল নাম। অন্য আর কোন নাম নেই আমার। কাজিদার সঙ্গে পরিচয় করাচীতেই।
এবার একটু থামে যুবক। কয়েক সেকেণ্ডের বিরতি। তারপর গলা খাকারি দেয় একটু, বলে, আসলে আমরা জাতে মেথর। আমাদের নাম এরকমই হয়।
সামান্য কুঞ্চনে চোখের ওপরের ভুরু দুটো একটু কাছাকাছি হয় মুজফ্ফর আহ্মদের, বোঝা যায় কাহিনীটাতে তাঁর কৌতূহল একটু বেড়েছে, বলেন, জাতে মেথর হলেও আপনাকে দেখে তো মনে হয় ঠিক মেথরের কাজ করেন না আপনি। কথাবার্তায় শিক্ষার ছাপ স্পষ্ট, স্কুল-কলেজেও পড়েছেন নিশ্চয়ই, কাজেই শুধুমাত্র পিংলা নামে চলেনি সেখানে। পদবী-টদবী কিছু একটা দিতে হয়েছে।
যুবক হাসে। বলে, কলেজে নয়, স্কুলে পড়েছি খানিকটা। কিন্তু শেষ পরীক্ষাটা দেওয়া হয়নি। চাকরি বাকরি বা অন্য কোন কাজ করিনি কখনও, হাওড়ায় যখন থাকতুম, আমাদেরই বস্তিতে আর পাঁচজন মেথরদের বাচ্চাদের পড়িয়ে কিছু টাকা আয় করতুম তখন। তারপর তো...
তারপর তো কী? করাচি গেলেন কেন?
আপনাকে কাজিদা আমার কথা কিছু বলেনি?
বলবে কী করে? আমার সঙ্গে তো কাজির আলাপ শুধুই চিঠিপত্তরে। আমাদের পত্রিকায় ও লেখে-টেখে, সেই সূত্রেই যতটুকু কথা চিঠিপত্তরে হয়। কিছুদিন আগে লিখেছিল, যুদ্ধ শেষ, ব্যাটালিয়ানও ভেঙে যাবে এবার। আমরাই তখন ওকে বলেছিলুম কলকাতায় এসে আমাদের সঙ্গে থাকতে। সপ্তা' দুয়েক আগে হঠাৎ একবার এল। দিন তিনেক ওর এক বন্ধুর সঙ্গে থেকে চলে গেল চুরুলিয়া। বললো, সেখানে তিন-চার দিন থেকে সোজা ফিরে যাবে করাচিতে। ওখান থেকেই। যখন আবার ফিরবে, ফিরবে পার্মানেন্টলি। তখন এখানেই থাকবে। কেন, আপনি এসব কিছু জানেন না?
কলকাতায় আপনাদের সঙ্গে থাকবে বলেছিল আমাকেও। এই হঠাৎ চলে আসাটা মনে হচ্ছে হঠাৎই হয়েছে, বলার সময় পায়নি। কাউকেই কিছু না জানিয়ে চলে এসেছে। আসলে ওখানে এখন ডামাডোল চলছে, কে কোথায় যাবে সেটাই সবায়ের ভাবনা।
আপনার কী ব্যবস্থা হবে? কাজির সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা হয়নি আপনার?
আমাকে বলেছিল তুই ভাবছিস কেন, যতদিন আমি আছি ততদিন তুইও আছিস। আমার সঙ্গে তুইও যাবি কলকাতায়, এখন দে গোরুর গা ধুইয়ে, বলেই হা হা করে অট্টহাসি।
মুজফ্ফর আহ্মদ একটু সোজা হয়ে বসেন, মনে হয় হাসিটা চেপেই গেলেন, বলেন, আপনি তো বললেন এখন হাওড়া থেকে আসছেন। আপনার বাড়ি হাওড়ায়?
আমার মা আর ছোট ভাই মেথর বস্তিতে থাকে ওখানে। আমিও ওখানেই আছি।
এবং, করাচি যাবার আগে পর্যন্ত ওখানেই থাকতেন, তাই তো?
যুবক কোন উত্তর দেয় না, তার শারীরি ভাষায় বোঝা যায় মুজফ্ফর আহ্মদ ঠিকই বলছেন।
কিন্তু আমি যেটা বুঝতে পারছি না, বলতে থাকেন মুজফ্ফর, তা হল হঠাৎ আপনি করাচি যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন। আপনার সঙ্গে কথা বলে আমি যা বুঝলুম তা হচ্ছে এই যে, করাচিতে আপনার চেনা-পরিচিত কেউ ছিল না। কাজেই, হঠাৎ কেন করাচি! কেন অত দূরে! কী আশায় গিয়েছিলেন?
আপনার যদি শোনার ধৈর্য থাকে তাহলে আমি বলতে পারি।
দেখুন ভাই, আপনি এতক্ষণ যা বলেছেন তাতে এটা বুঝেছি যে আপনি কাজির প্রিয় মানুষ। কাজি যদি আপনাকে কথা দিয়ে থাকে তাহলে আপনিও কলকাতাতেই থাকবেন। ও, আর ওর বন্ধু হিসেবে আমরা, দায়িত্ব নেব। কিন্তু, কিছু মনে করবেন না, তার আগে বোঝা দরকার আপনি কে।
তাহলে আমার নামটা থেকেই শুরু করা যাক, বলতে থাকে যুবকটি। আপনাকে বলেছি আমি জাতে মেথর এবং আমার নাম পিংলা। আপনি জানেন কিনা জানি না, আমাদের মতো নীচু অস্পৃশ্য জাতে কিন্তু হিন্দু-মুসলমান নেই। আমরা শুধুই মেথর, শুধুই অস্পৃশ্য। হিন্দু হলেও তাই, মুসলিম হলেও তাই। যেখানে আমরা থাকি, সে অঞ্চলে মুরুব্বি যারা, তাদের ধর্মই আমাদের ধর্ম। আপনি আমার কথাবার্তা শুনে আমাকে নিশ্চয়ই বাঙালি মনে করছেন। এখন আমি বাঙালি ঠিকই, কিন্তু আমার বাবা বাঙালি ছিল না। যুক্ত প্রদেশের বরেলিতে গঙ্গাপুর অঞ্চলে আমার পুর্বপুরুষরা থাকতেন। আমার বাবার বাবা সেখান থেকে আরও কয়েকজন জাতভাইয়ের সঙ্গে চলে আসেন হাওড়ায়। হাওড়া অনেক বড় শহর, এখানে এলে কাজ পাওয়া যাবে এই আশায়। ওঁরা নিজেদের মুসলমান বলেই পরিচয় দিতেন।আমার দাদুর নাম ছিল কাল্লু, সবাই কাল্লু বলেই ডাকতো, আর কালে কালে সেটাই হয়ে গেল ওঁদের পদবী। যখন এসেছিলেন, আমার বাবা তখন বেশ বড় হয়ে গেছে, সুখা নাম তার, চোদ্দ-পনেরো বছর বয়েস। হাওড়ায় ম্যুনিসিপ্যালিটি ছিল, খাটা পায়খানা ছিল, দাদু কাজ পেয়ে গেলেন। দাদুর সঙ্গে সঙ্গে সুখাও কাজ করতে শুরু করল। তখনকার দিনে যেমন হত, বিয়েও দিয়ে দিলেন ছেলের।
বস্তির আর পাঁচটা ছেলের চেয়ে সুখা কাল্লুর ভাগ্য যে ভাল ছিল সেটা বোঝা গেল কয়েকদিনের মধ্যেই। হাওড়ার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতে কাজ পেয়ে গেল সে। চাকরদের যে বিরাট বাহিনী ছিল সেই বাড়িতে, তার সবচেয়ে নীচের কাজটা। ঝাড়ুদার এবং মেথর। সাহেব-বাড়িতে একটা সুবিধে ছিল। যে অস্পৃশ্যতায় অভ্যস্ত ছিল সুখা, পরিষ্কার হয়ে, চান-টান করে কাচা জামা কাপড় পরার পর সেই অস্পৃশ্যতার নিয়ম ছিল না সে বাড়িতে। সে দিব্যি সাহেবের ছেলের সঙ্গে খেলাধুলো করত। আর তাদের ডাইনিং টেবিলের উদ্বৃত্ব খাবার খেয়ে খেয়ে স্বাস্থ্যও অনেক ভাল হল তার। বস্তিতে সে কমই ফিরতো, কিন্তু মায়ের কাছে শুনেছি, ফিরতো যেদিন সবাই দেখতে আসত তাকে। সাহেব-বাড়ির চাকর যেন নিজেও সাহেব!
ক্রমে জন্ম হল আমার। বাবার অবিশ্যি খুব একটা টান বোঝা গেল না আমার ওপর। সাহেবের বাড়িতেই সুখা কাল্লু থাকত ভাল। সাহেবের ছেলে ছোটা সাহেবের সে প্রায়-বন্ধু।
একদিন শোনা গেল সাহেবের বদলি হয়েছে, কিন্তু ছোটা সাহেব সুখাকে ছাড়বে না। সিমলা টিমলা এরকম কোথাও হয়েছিল বদলি, মা ঠিক বলতে পারে না। বাবা হাওড়ায় প্রায় আসতই না আর, তবে মাঝে মাঝে দাদুর নামে টাকা আসত মানি অর্ডারে। আমার ছোট ভাই যখন হল, সেই টাকা কাজে লেগে গেল। দাদু যখন মারা গেল, দাদুর কাজটা পেল মা। মারা যাবার আগে দাদু বলে গিয়েছিল আমার মাকে, আমায় যেন ইশকুলে ভর্তি করে। নোংরা কাজ করতে আমাকে যেন না পাঠায়।
যুদ্ধ যখন শুরু হল আমি তখন ইশকুলে নীচু ক্লাশে। হাওড়ায় যেখানে আমাদের বস্তি সে জায়গাটার নাম টিকিয়াপাড়া। টিকিয়াপাড়া খুব ঘনবসতি এলাকা, কিন্তু আমরা যেখানে থাকতুম সে জায়গাটা রেল-লাইনের ধারে, অত ঘিঞ্জি নয়, সামনে বেশ বড় দুটো পুকুর। সেই পুকুরে অবিশ্যি আমাদের নামা বারণ ছিল, কিন্তু বিকেলে বেড়াতে বেড়াতে হাওড়া ময়দানে যাওয়ায় নিষেধ ছিল না। সেই ময়দানে তখন মাঝে মাঝেই মীটিং হত, বড় বড় নেতারা আসতেন। বাঙালি ছেলেদের যুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে না, তাই একজন নেতাকে একদিন খুব রাগারাগি করতে শুনলুম। যুদ্ধের কোন আঁচ আমরা সোজাসুজি পাচ্ছিলুম না ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধ যে একটা হচ্ছে সেটা আমাদের বস্তির লোকরাও বুঝত।
বছর দু-তিন পর এমন একটা কাণ্ড ঘটল যেটার জন্যে আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলুম না। যুক্তপ্রদেশের যে বরেলি থেকে আমার দাদু এসেছিল হাওড়ায়, সেখানকার দুজন লোক হঠাৎ একদিন আমাদের বস্তিতে হাজির। বাঙালিদের ঠিক ঠিক বিশ্বাস করত না সাহেবরা, তাই যুদ্ধে বাঙালিদের না নিলেও দেশের অন্য জায়গা থেকে ছেলেদের তারা সেপাইয়ের কাজে নিচ্ছিল। শুধু সেপাই-ই নয়, অন্য অনেক কাজের জন্যেই লোক সংগ্রহ করছিল তারা। বরেলির ওই জায়গা থেকে সাহেবরা এমনকি মেথরদেরও নিয়ে গেছে। সেপাইয়ের কাজের জন্যে নয়, কিন্তু মেথরের কাজ কোথায় নেই আর! যারা গিয়েছিল আগের বছর তাদের মধ্যে তিন চারজন ফিরে এসেছে। এই যে দুজন এসেছে আমাদের বাড়ি, এরাও সেই তিন-চারজনের মধ্যে ছিল।
কিন্তু, এখানে কেন এসেছে এরা? এরা সুখা কাল্লুর খবর নিয়ে এসেছে। আরব দেশে যেখানে এদের নিয়ে গিয়েছিল সাহেবরা, সে জায়গার নামটাও ওরা বলতে পারল না। শুধু বলল, ওরা বিরাট বড় একটা জাহাজে অনেকটা গিয়ে তারপর দুবার নদী আর বড় একটা খাল পেরিয়ে সেখানে গিয়েছিল। সাহেবরা সব জায়গাকেই মেসপটমা বলে, ওই জায়গাটাও নাকি মেসপটমা। ওখানে এদেশের থেকে অনেক লোক গেছে, কেউ কেউ সেপাই, আবার অন্য কাজের জন্যেও গেছে অনেকে। ওরা বরেলি থেকে এসেছে শুনে একজন ওদের জিজ্ঞেস করে ওরা সুখা কাল্লুকে চেনে কিনা। যখন ওরা বললো ওরা চেনে, সুখা কাল্লুরই দেশের লোক ওরা, তখন ওদের জানানো হয় সুখা কাল্লুও ওখানেই ছিল। ওখানে নাকি মাটি খুঁড়ে – ওরা বলে ট্রেঞ্চ – সেই ট্রেঞ্চগর্তের মধ্যে থেকে অনেক লড়াই হয়েছিল। লড়াইয়ে যে ক্যাপটেন ছিল সুখা নাকি তাকে ছোটা সাহেব বলত। সেই ছোটা সাহেবের গায়ে গুলি লেগেছিল, তাকে বাঁচাতে গিয়ে সুখার গায়েও অনেকগুলো গুলি লাগে। যে মেড্কালরা ওখানে ছিল তারা পারল না। ছোটা সাহেব কী সব ব্যবস্থা করে ওকে জাহাজে বিলায়েতের হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে। তবে ওখানকার লোকরা খবর পেয়েছে, বিলায়েতেও সুখা কাল্লুকে বাঁচানো যায়নি।
খবর শুনে মা কাঁদল না, তবে পরের দিন আমাদের বস্তিতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হল। পেট পুরে খেল ওই দুজন লোক, তারপর চলে গেল। আমি ততদিনে সেকেণ্ড ক্লাশ, মানে ক্লাশ নাইন-এ উঠেছি। মা আমাকে বলল, আমাকে যুদ্ধে যেতে হবে। আর যেতে হবে মেসপটমা না কী বলে, সেই আরব দেশেই। শুধু আমাকে বলেই ক্ষান্ত হল না মা, বস্তির সবাই জানল পিংলাকে তার মা যুদ্ধে পাঠাবে। আমাদেরই বস্তির মাতব্বর গোছের একজন শুধু মাকে সাবধান করে দিল, এখনই কিছু কোরো না, কেউ যদি বলে দু পয়সা খরচ করলেই সে তোমার ছেলেকে যুদ্ধে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেবে, বিশ্বাস কোরো না তাকে। আঠের বছর অন্তত বয়েস না হলে যুদ্ধে নেয় না। আর তা ছাড়া সাহেবরা সব দেশের ছেলেদের নেয়, কিন্তু বাঙালিদের নেয় না যুদ্ধে। বাঙালিদের জন্যে শুধু ইশকুল আপিস আর কোর্টের কাজ, সাহেবরা বাঙালির হাতে বন্দুক দেবে না।
আমার ছেলে বাঙালি কোথায়? – মা রেগে বলে, ওর বাপের দেশ তো বরেলি।
চুপ করে এতক্ষণ শুনছিলেন মুজফ্ফর আহ্মদ। এবার বললেন, চলুন, আমরা খেয়ে আসি। খেতে খেতেই কথা বলা যাবে।
ভাতের হোটেলটা মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। একটা টেবিলের দুদিকে বসলেন ওঁরা দুজন। মুজফ্ফর আহ্মদ বললেন, মাছ খাবেন তো?
কলাপাতায় ভাত এল, সঙ্গে ডাল, আলু ভাজা, তরকারি আর একটা বাটিতে মাছ। যুবকের খাওয়ার ভঙ্গি দেখে মুজফ্ফর আহ্মদ বুঝলেন, এ ছেলে কলাপাতায় খায়নি কখনও আগে, ডাল গড়িয়ে যাচ্ছে, এর পর মাছের ঝোলও গড়িয়ে যাবে। বললেন, আমার মনে হয় আমরা খেয়ে নিই আগে, একটু মন দিয়ে না খেলে আপনার ডাল-ঝোল সব গড়িয়ে পড়বে। আগে খেয়ে নিন, তারপর অফিসে ফিরে আবার কথা হবে।
ঘুম পাচ্ছে? – অফিসে ফিরে এই প্রশ্ন শুনে লজ্জা পায় পিংলা, বলে না না, কিন্তু আপনি কি ঘুমোবেন?
আমি দুপুরে ঘুমোই না, কাজেই আপনার কাহিনী চলুক।
এতক্ষণে মুজফ্ফর আহ্মদের কণ্ঠস্বরে স্নেহমিশ্রিত একটু প্রশ্রয়ের আভাস পায় পিংলা, সে বলতে শুরু করে, আমি মাকে বললুম, আমি আর ইশকুলে যাব না।
মা বলল, কেন? আমি বললুম ইশকুলে পড়ে তো ইশকুলেই কাজ করতে হবে, আর তা না হলে আপিসে। যুদ্ধেই যদি যাই তাহলে আর ঝুটমুট ইশকুল কেন? কাল থেকে আমি তোমার সঙ্গে কাজে বেরোবো। মা বলল, তা চলবে না। তোর দাদুর বারণ আছে, ওই কাজ করা তোর চলবে না।
ততদিনে আমাদের বস্তির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা অনেকে ইশকুলে যাচ্ছে, আমি ওদের পড়াতে শুরু করলুম। ওদের বাড়ি থেকে আমায় টাকাপয়সাও দিত। কিন্তু এতদিন মা আমাকে যে ভাবে বড় করেছে, বস্তিতে আমার বন্ধুবান্ধব বিশেষ হয়নি। সময় কাটাবার জন্যে বাংলা গল্পের বই কিনে পড়তুম, শরৎচন্দ্র যত বই লিখেছেন সব আমি পড়ে ফেলেছি, আর খবরের কাগজ।
উনিশশো আঠেরতে আমার আঠের বছর বয়েস হল। কাগজে পড়েছি ততদিনে বাঙালি ছেলেদেরও যুদ্ধে নিচ্ছে। খোঁজখবর করে একদিন মিলিটারিদের অফিসে গেলুম, বললুম, আমি যুদ্ধে যেতে চাই। কিন্তু যুদ্ধের রিক্রুটদের শেষ ব্যাচ নেবার কাজ তখন সদ্য হয়ে গেছে। ওরা বলল, সেই ব্যাচ কয়েকদিন আগেই পেশওয়ারে রওনা হয়ে গেছে। আর নতুন করে কাউকে নেওয়া হবে না।
পেশওয়ার কেন? – জিজ্ঞেস করলুম আমি।
বাঙালি পল্টনের ট্রেনিং হয় পেশওয়ারে। তারপর সেখান থেকে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ব্যাট্ল্-ফীল্ডে।
শেষ চেষ্টা করলুম আমি, বললুম আমি জাতে মেথর। সেপাইয়ের কাজ না হলে মেথরের কাজ করতেও রাজি আছি।
ওরা বলল, ওটা অন্য ডিপার্টমেন্ট। কলকাতায় ওদের অফিস নেই। ওদের নেবার নিয়ম অন্যরকমের। অনেক জায়গা থেকে লোক জোগাড় করে ওরা, অনেক সময় লোকাল রিক্রুটও নেওয়া হয়। তবে, বাঙালিদের নেবে না।
ফেরবার সময় শুধু একটা কথাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল, অনেক সময় লোকাল রিক্রুটও নেওয়া হয়! অনেক সময় লোকাল রিক্রুটও নেওয়া হয়! হাওড়া স্টেশনে গিয়ে অনেক খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, এখান থেকে ট্রেনে যেতে হবে লাহোর ছাড়িয়ে নৌশহরা পর্যন্ত। সেটাই শেষ রেলস্টেশন। সেখান থেকে অন্য কিছুতে পেশওয়ার। তিনদিন পর একটা ট্রেন ছাড়বে। টাকাপয়সা আমার নিজেরই ছিল। দু-আড়াই বছরে যা আয় করেছি, অনেক। মা জানল ছেলে যুদ্ধে যাচ্ছে।
নৌশহরায় পৌঁছোলেন? – প্রশ্ন করলেন মুজফ্ফর আহ্মদ।
পৌঁছোলুম। তারপর সেখান থেকে ঘোড়ার গাড়ি আর লরিতে পেশওয়ার। আমার ধারণা ছিল পেশওয়ারে পৌঁছোলেই মিলিটারি অফিস সহজেই খুঁজে পাব। কিন্তু, তা নয়। এক তো, ওখানকার লোকরা আমার ভাঙা-হিন্দী কিছুই বোঝে না, আর আমি তো একেবারেই বুঝি না ওদের ভাষা। শেষ পর্যন্ত অনেকের সঙ্গে কথা বলে পৌঁছোলুম এক বাঙালি ডাক্তারবাবুর বাড়ি, ডাক্তার চারুচন্দ্র ঘোষ। তিনি বললেন, পেশওয়ার নয়, নৌশহরাতেই বাঙালি পল্টনের ট্রেনিং হয়েছে। শেষ ব্যাচের ট্রেনিঙের পর মিলিটারির ট্রেনিং ক্যাম্প ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এখন বাঙালি পল্টনের ছেলেরা আছে করাচির ক্যান্টনমেন্টে। তবে, সেখানে গিয়ে কোনই লাভ নেই। রিক্রুটমেন্ট ওরকম ভাবে হয় না। অনেক সঙ্কোচে, অনেক ইতস্তত করে, শেষ পর্যন্ত আমার মেথরের কাজ খোঁজার মতলবটা বললুম। শুনে, উনি হেসে ফেললেন। বললেন, দেখ বাবা, ইণ্ডিয়ান লেবার কোর, মানে নন-কম্ব্যাটান্ট ফোর্সের, কিছু কিছু রিক্রুটমেন্ট স্থানীয় ভাবে হয় না যে তা নয়, বিশেষ করে তুমি যে ল্যাট্রিন ক্লীনার বা সুইপারের কাজের কথা বলছো, সেই কাজের ক্ষেত্রে হয়। সেটা কিন্তু ব্যাট্ল্ফীল্ডে। সেখানে তুমি পৌঁছোবে কীভাবে? তুমি কলকাতা থেকে এসেছ, এখন কয়েকদিন আমার বাড়িতে থেকে একটু বিশ্রাম করে, তারপর ফিরেই যাও। আমার মনে হয় না আর্মিতে তোমার বিশেষ সুবিধে হবে।
বুঝলুম ডাক্তার ঘোষ উদার চরিত্রের মানুষ, তবুও ওঁর বাড়িতে থাকলুম না। উনি প্রায় জোর করেই খাইয়ে দিলেন। কিছু টাকা দেবার প্রস্তাবও দিলেন। আমি নিলুম না। চলে গেলুম করাচি। ক্যান্টনমেন্ট খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। প্রথম দিনটা ভেতরে ঢুকতে সাহস পাইনি। বাইরে থেকে মাঝে মাঝে প্যারেডের শব্দ শুনেছি। দ্বিতীয় দিন বিকেলের দিকে তিনজন সেপাই, মিলিটারির পোশাকে, দেখলুম বাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে চলেছে। বাংলায় কথা বলছিল ওরা। ওদের কাছে গিয়ে নিজের সব কথা খুলে বললুম। কেনাকাটা যা করার ছিল সে সব করে-টরে ওরা আমাকে ব্যারাকের ভেতর নিয়ে গেল। সোজা যার কাছে নিয়ে গিয়ে হাজির করাল, সে-ই কাজিদা। তাকেও সব বললুম। এমনকি, বাবার কথাও। সব শুনে, আমাকে বলল, সত্যি সত্যিই ল্যাট্রিন ক্লীনারের কাজ করবি? প্রথম থেকেই 'তুই'। বললুম, করব। কী খেয়েছিস সকাল থেকে? একটা দোকানে রুটি আর ডাল খেয়েছিলুম, বললুম। বলল, তোর ব্যাগটা দেখা। দেখালুম ব্যাগ। সামান্য জামাকাপড় আর দুখানা বই। শরৎবাবুর চরিত্রহীন আর পল্লীসমাজ। বই দুটো ব্যাগের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল। তারপর যারা আমাকে নিয়ে এসেছিল তাদের মধ্যে একজনকে বলল, চা নিয়ে আয় ওর জন্যে। ওরা চা আনতে গেল, আর কাজিদা আমাকে নিজের বিছানায় বসাল। একটা কাগজের বাক্সে ছিল এক টুকরো কেক আর দুটো কমলালেবু। বাক্সটা আমার কোলে বসিয়ে দিল, বলল খেয়ে নে। ভয়ে লজ্জাও দেখাতে পারলুম না। ততক্ষণে একটা মগে চা এসে গেছে। একটা কাপ কোথা থেকে নিয়ে নিজেই ধুয়ে আনল, তারপর চা-টা ঢালল তাতে। আমার হাতে দিল, আমিও কোন কথা না বলে চা খেতে থাকলুম। চা খাওয়া হয়ে গেলে হঠাৎ জোরে একটা হাততালি দিল কাজিদা। ওই ঘরটায় যারা ছিল সবাই এসে জড় হল। কাজিদা সবাইকে শুনিয়ে জোরে জোরে বলল, এই যে ছেলেটা, এর নাম, এই কী নাম তোর?
আমি বললুম, পিংলা।
পিংলা কী?
কাল্লু। পিংলা কাল্লু।
ঠিক আছে, পিংলা কাল্লু, বলল কাজিদা। তারপর, সবায়ের সামনেই আমাকে জিজ্ঞেস করল, স্কুলের পরীক্ষা পাশ করেছিস? খুব তো শরৎবাবুর বই নিয়ে ঘুরছিস, পাশ করেছিস পরীক্ষা?
বললুম, না।
করেনি, ঘোষণা করল কাজিদা। তাহলে ওকে পাশ করতে হবে। আজ থেকে পিংলা কাল্লু দিনের বেলা আমাদের ব্যারাকের স্যানিটেশন ইনস্পেক্টর, আর রাতের বেলা আমাদের ছাত্র। মণিভূষণ মুকুজ্যে, শম্ভু রায় আর কাজি নজরুল ইসলাম হবে মাষ্টার, ঠিক আছে?
সমবেত জবাব এল, ঠিক আছে।
এবার কথা বললেন মুজফ্ফর আহ্মদ, কিন্তু আপনাকে স্যানিটেশন ইনস্পেক্টরের চাকরি কী করে দিল কাজি? এ কি দেওয়া যায়?
পিংলা বলে, আমিও অবাক হয়েছিলুম। পরে কাজিদাকে বলেওছিলুম সে কথা। কাজিদা বলেছে, এরকম একটা নিয়ম ছিল। নিজেদের ব্যারাক পরিষ্কার রাখবার জন্যে ব্যারাকে যারা থাকে সবাই মিলে চাঁদা করে একজন লোক রাখতে পারত। তার খাবার-দাবারের ব্যবস্থাও ব্যারাকেই হত। এমনকি তার থাকবার জন্যে একটা ঘরও ছিল নীচে। অবিশ্যি আমাকে সেখানে থাকতে হয়নি কখনো, কিন্তু প্রতি মাসে দশ টাকা করে আমাকে দিতও ওরা। আমি যখন ওখানে যাই, কাজিদা তখন হাবিলদার। ব্যাটালিয়ানের কোয়ার্টারমাস্টার। যাবতীয় স্টোরের দায়িত্ব কাজিশশদার। গোলাগুলি থেকে বন্দুক, জামাকাপড়, জুতো, বিছানাপত্তর, সব কিছু। আমার কখনও কোন কিছুর অভাব হয়নি। দেখুন না, সবায়ের সাথে ফটোও আছে আমার, বলেই কাপড়ের ব্যাগটা টেনে নেয় ছেলেটা।
এখন বুঝলুম, হেসে বলেন মুজফ্ফর আহ্মদ, কেন সাত হাজারের এক জনও না হওয়া সত্বেও আপনি ফর্টি নাইন বেঙ্গল ব্যাটালিয়ানেরই একজন ছিলেন। যথেষ্ট বলেছেন, এখন আর ছবি দেখতে চাই না, আর এক কাপ চা খাবেন?