ওভারব্রিজের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই শীতল দেখল ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ঢুকছে, প্রাণপণে দৌড় লাগাল, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝল আবারও হয়ে গেছে। কাল রাত্তির থেকে কম করে জল খাওয়া, বেরোবার আগে বারবার বাথরুমে গিয়ে পেচ্ছাপদানি খালি করে আসার চেষ্টা, কিচ্ছু কাজ করেনি। তলপেটে ঝাঁকুনি লাগতেই ফোঁটায় ফোঁটায় বেরিয়ে এসেছে পেচ্ছাপ। দুই পা শক্ত করে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল, কিন্তু আজ ঠিক সময়ে না গেলে চাকরি রাখা মুশকিল হবে। এমনিতেই ট্রেন দাউন্দ ঢুকতে ঢুকতে পৌনে এগারোটা বাজিয়েই দেবে, সাড়ে এগারোটার আগে অফিসে ঢোকার সম্ভাবনা কম। তবে স্টেশান থেকে বেরোতে বেরোতেই যদি অটো পেয়ে যায় অথবা অফিসের কারোর সাথে দেখা হয়ে যায়, তো সোয়া এগারোটার মধ্যে ঢুকে যেতে পারবে। মালিক ঢোকে বেলা বারোটার দিকে। তবে বলা যায় না, আজই হয়তো এগারোটায় চলে এল। তাহলেই বকাবকি গালিগালাজ।
ট্রেনে এখন বসার জায়গা মোটামুটি পাওয়াই যায়। এখনো খুব কম লোকই ট্রেনে উঠছে। সিটে গুছিয়ে বসতে গিয়ে আবার থমকে গেল শীতল, বসলেই সালোয়ার ভিজবে, উঠে দাঁড়ালেই ভেজা ছাপ ফুটে উঠবে। থাক, বরং দুইদিকের দরজার মাঝে সিটের পেছনে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো যাক। অফিস মানে এটা আসলে গুদাম, একটা ভারতজোড়া বৈদ্যুতিক বাণিজ্য সংস্থার গুদাম। ‘কম্ফিকার্ট’ নামের এই সংস্থা শুরু হয়েছিল পুণে থেকে সোলাপুর পর্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্নরকম মোবাইল ফোন সরবরাহ করার লক্ষ্য নিয়ে। দেশে ও বিদেশে উৎপন্ন বিভিন্ন সংস্থার মোবাইল অনলাইনে অর্ডার নিয়ে আনিয়ে ঠিকানামাফিক পৌঁছে দেবার কাজ বছর পাঁচেক বিশেষ সাফল্যের সাথে করার পর আস্তে আস্তে আরো নানান জিনিস বিক্রি করতে শুরু করে। ব্যবসাও বাড়তে বাড়তে গোটা ভারতেই প্রায় ছড়িয়ে পড়েছে। বাজারের চাহিদা আন্দাজ করে অগ্রিম জিনিসপত্র এনে জমা করে রাখতে দরকার হয়েছে গুদাম।
কলেজ পাস দিয়ে শীতল একটা বাচ্চাদের ইস্কুলে ঢুকেছিল পড়াতে। জিলাস্কুলে চাকরি লেগে গেলে জিন্দেগিটা সেট হয়ে যাবে, রাজ্যওয়াড়ি পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিল। ইস্কুলেই একদিন বাচ্চাদের পিটি ক্লাস করানোর সময় টের পায় – দৌড়ালে, লাফালেই বিন্দু বিন্দু পেচ্ছাপ বেরিয়ে আসছে, কোনভাবেই চেপে নিতে পারছে না। শাড়ি পরতে হত ওখানে, ব্যাপারটা তেমনভাবে ধরা পড়েনি কারো সামনে। তারপর এই বদ বিমারি এল, ইস্কুল বন্ধ হয়ে গেল। দুই মাস পেরোবার আগেই সেক্রেটারি স্যার ফোন করে বলে দিলেন, ইস্কুলে কামাই নেই, বাচ্চারা মাইনে দেয়নি, ওকে আর রাখতে পারবেন না। পাওনাগণ্ডা ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তা সেসব আর একবছরেও আসেনি। দুই-একবার ফোন করেছে সেক্রেটারি, হেডমিসকে – সব নাম্বার স্যুইচড অফ, নয়তো নেটওয়ার্কের বাইরে। লকডাউনের মধ্যেই বড়েভাইয়া বিয়ে করে ভাবীকে নিয়ে সোলাপুরে চলে গেল। প্রথম একমাস টাকা পাঠিয়ে আর পাঠায়নি।
সেই সময় ব্যাঙ্কের খাতা খালি হয়ে আসছে প্রতি সপ্তাহে, ইস্কুলবাসের ড্রাইভার আমিনের সাথে দেখা হয়ে গেল একদিন বাসডিপোয়। আমিনই খবর দিয়েছিল – কম্ফিকার্ট লোক নিচ্ছে ওদের দাউন্দ গুদামে। পরেরদিনই কপাল ঠুকে চলে গেছিল ওখানে। পুনা থেকে রোজ রোজ আপ ডাউন করবে কী করে ভেবে মালিক একটু দোনামোনা করছিল। আবার বিকম পাস মুলগি অনেক কম টাকায় পাওয়া যাচ্ছে ভেবে ঠিক না করতেও পারছিল না। মালিকের অ্যাসিস্টেন্ট বুদ্ধি দিল – ছয়মাস ট্রেনিং করে নিতে, আরো পাঁচশ’’ টাকা কম মাইনে। ছ’মাস পরে কাজে খুশি হলে এক বছরের কন্ট্রাক্টে নেবে, পাঁচশ’ টাকা বাড়বে। গুদামে নতুন আসা মাল কমপিউটারে তোলা, কোনটা কোথায় যাচ্ছে সাইট থেকে ঠিকানা মিলিয়ে প্যাকেটের গায়ে লেবেল মারা, মাল বেরিয়ে গেলে ফাইল আপডেট করা – এই মোটামুটি কাজ। তাতেই সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা অবধি ঘাড় তুলতে পারে না।
ফেরার সময় আর ট্রেনের ভরসায় থাকতে হয় না। আমিনের সাথে ওর ডেলিভারি ভ্যানে চেপেই ফেরে। যেদিন টিফিন খাওয়ার সময় পায় না, সেদিন ওই ভ্যানে বসেই নিজে খায়, আমিনকেও দেয়। দিনের ডিউটির সবকজনই আমিনের ভ্যানে আসে। লোনি আর উরুলিতে দু’জন নামে আর দু’জন হাদপসর। একদম শেষে একটু ঘুরে খারকি স্টেশানের সামনে শীতলকে নামিয়ে আমিন চলে যায়। তা নামতে নামতে রোজই রাত দশটার এদিক ওদিক হয়। ওখানে অটো থাকলে ভাল, না হলে তেলুগুদের মশলার দোকানের গোল-চক্কর অবধি হেঁটে এসে দাঁড়ায়। এখান থেকে পিএমটি বাস, অটো, কখনো ওদের মহল্লার কারো গাড়ি, কি স্কুটি – কিছু না কিছু পেয়েই যায়। এই কাজটা নেবার পরে কিছুদিন ভালই ছিল, অফিস থেকে বেরোবার সময় বাথরুম সেরে বেরোত আর সোজা বাড়ি গিয়ে আবার। একদিন রাতে বাস দেখে দৌড় দিল, বাসটা পেয়েও গেল। বাসে উঠেই খেয়াল হল, হেল্পার ওকে দেখছে হাঁ করে।
সিগনাল হলুদ হতে, কষে ব্রেক চেপে, লাইনের এধারেই বাইক দাঁড় করিয়ে, একপায়ে ভর দিয়ে, মোবাইল বের করে সময় দেখে নেয় গিরীশ। এখনো কুড়ি মিনিট আছে, কোথাও ফেঁসে না গেলে, আর দশ বারো মিনিটের মধ্যে ডেলিভারি দিয়ে আজকের মত ফ্রি হয়ে যাবে। আজ দু’টো এক্সট্রা ডেলিভারি নিতে পেরেছে, সাতশ’ টাকা বেশি পাবে। রোজ যদি এমন দু’টো তিনটে করে এক্সট্রা নিতে পারে, তাহলেই আঠার-কুড়ি হাজার এক্সট্রা টাকা আসে হাতে। তাই দিয়ে একটা ভাল ফোন নেবে গিরীশ। এই ফোনটায় মুভি দেখে আরাম হয় না, ফাইটিঙের সিনে, নাচের সিনে সব কেমন জড়িয়ে রঙে রঙে মিলে যায়। নার্সারিক্লাসে যেমন পাতলা প্লেটে সব রঙ সাইড বরাবর একটু একটু করে ঢেলে গুলে নিত, তারপর ব্রাশ চালাতে চালাতে সব কেমন মিলেমিশে একটাই জবরদস্ত কালার হয়ে যেত, অমনি হয়ে যায়। আহ, আবার যদি ইস্কুলে ফেরত যাওয়া যেত! এবার তাহলে ও মন দিয়ে পঢ়াই করত ঠিক।
আর ৬ সেকেন্ড পরে সিগনাল সবুজ হবে, হেলমেটটা ঠিকঠাক করে পা তুলে বাইকে রেডি হয়ে বসতে বসতেই গিরীশ খেয়াল করে, একটা মেয়ে কেমন থ্যাপ থ্যাপ করে দৌড়ে আসছে সামনে ডানপাশে দাঁড়ানো পিএমটি বাসটার দিকে। আহ যন্ত্রণা! এখন বাঁদিক থেকে স্পিডে বেরিয়ে যেতে পারবে না এ মেয়ে বাসের দরজায় না পৌঁছানো অবধি। সিগনাল সবুজ হয়ে গেল, মেয়েটা এখনো বাসের সামনের দরজা অবধি পৌঁছাতে পারেনি। পেছনের দরজা দিয়ে তুলে নিতে পারত কন্ডাকটারকাকা, কিন্তু নাহ, এটা সরকারি বাস, করবেই না। একটু আগে আসতে কি হয় এদের! দাঁত আর জিভের ফাঁকে ছিঁক করে বিরক্তিসূচক শব্দ করে গিরীশ। হেলমেট আর মাস্কের ভেতরে সেই শব্দ ওরই ঠোঁট আর গোঁফে লেপটে থাকে, বিরক্তিটাও। মেয়েটার পায়ে কোন সমস্যা আছে নাকি? কেমন অদ্ভুতভাবে থ্যাপ থ্যাপ করে দৌড়াচ্ছে দেখো! আসলে জোরে জোরে হাঁটছে বলাই ভাল। অথচ মেয়েটা বেশ রোগা পাতলা।
মোড় পেরিয়ে স্পিড বাড়ালো গিরীশ। নাহোক, এক দুই মিনিট দেরি হয়ে গেল বেকার। এই ঠিকানাটা অবশ্য চেনা, পরিহার চওক পেরিয়েই, ডানদিকের মহল্লার গলিতে ঢুকে, তিনটে বাড়ি পরেই ঠিকানা। গেটে সিকুরিটিকাকারাও এমনি ভাল, মুখে মুখে ফ্ল্যাট নম্বর শুনে নিয়ে নিজেরাই সিস্টেমে এন্ট্রি করে ছেড়ে দেয়। বারোতলায় যেতে যেতেই সিকুরিটিরা ফোন করে দেয়, ম্যাডাম দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে, কোনোদিন বা ওদের দশ বছরের ছেলে। প্যাকেট নিয়ে থ্যাঙ্কু বলে, কোনোদিন টিপস যোগ করে দেয় অ্যাপে। অনলাইন পেমেন্ট করাই থাকে, রেটিঙও হয় ৪ নয় ৫ দেয় এই ফ্যামিলিটা। স্যার খুব একটা সামনে আসে না, হয় বসে টিভি দেখে, নয়তো ল্যাপটপ নিয়ে কিছু করে। খোলা দরজা দিয়ে দেখেছে গিরীশ। দেখে বেশ সুখী পরিবার মনে হয়। হাতে পয়সাও আছে, সপ্তাহে অন্তত দুইদিন গিরীশদের ‘নাস্তা বোলে তো’ অ্যাপ দিয়ে কাছের দূরের নানা রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার অর্ডার করে। এরকম একটা সংসার চাই ওর।
স্পিডে যেতে যেতে হঠাৎ খেয়াল করে, পরের সিগনালের চৌমাথার বেশ একটু আগে ওই বাসটা সাইড নিচ্ছে। আরে আরে, এখানে স্টপ নেই তো, বাস দাঁড়াচ্ছে কেন? স্পিড কমিয়ে ব্রেকটা ছোঁয় গিরীশ। ওদিকে বাসে উঠেই শীতল টের পায়, দু’পায়ের ফাঁকে গরম স্রোত নেমে আসছে কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে। ‘আরে আরে মুতনা হ্যায় তো টয়লেট কিঁউ নেহি গ্যয়ে? বদতমিজ আওরত তু ঝল্লি হ্যায় কা?’ কন্ডাকটারের কর্কশ চিৎকারে সারা বাসের লোক ঘুরে ওকে দেখতে থাকে। কয়েকজন হেসে ওঠে, এক মহিলা এসে পিঠে খোঁচা মেরে বাস থেকে নেমে যেতে বলে। বাসের বেশিরভাগ লোক সায় দিয়ে গলা মেলায়। বাস ততক্ষণে পরের সিগনালে। কে যেন জলের বোতল খুলে জল ছুঁড়ে দেয় গায়ে, বাসের মধ্যে হুরডা পার্টি শুরু হয়ে যায়। হেল্পার দুই থাবড়া মেরে বাস থামিয়ে ওকে হাত ধরে টেনে নামিয়ে দেয়। ওকে নামিয়ে দিয়ে হোঃ হোঃ করে হাসতে হাসতে বাসটা চলে যায়।
এই সিগনালের চারকোণে কোন বাসস্ট্যান্ড নেই, অটো নেই। দাঁড়ানো কিছুই নেই, সব বেরিয়ে যাচ্ছে সাঁ সাঁ করে, হরিণের মত দৌড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। মুলানদীর মত তরতরিয়ে বয়ে যাচ্ছে পিচের রাস্তা।
~ তুলা নাম কায়?
~ শীতল লোখান্ডে
~ ইথে কায় করতআহে?
কামিজের খানিকটা ছেটানো জলে ভেজা, সালোয়ার ভেজা, বুকের কাছে জাপটে ধরা ব্যাগ – শীতল ভয়ে ভয়ে চোখ একটু তোলে। একটা বাইক সামনে দাঁড়িয়েছে, এক পা নামিয়ে বাইকওলা প্রশ্ন করছে। ‘নাস্তা বোলে তো’ অনলাইন খাবার ডেলিভারি চেনের লোগো আঁকা ব্যাগ, টিশার্ট। যাক পুলিশ নয়। এখানে স্টপ নেই, বাসটা তাও সাইড করে প্রায় টেনে জাপটে একটা মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল দেখে খানিক কৌতূহলেই এগিয়ে এসেছে। হয়তো মাতাল কি গ্যাসখোর, আজকাল মেয়েগুলোও এইসব খেয়ে টাল হয়ে পাবলিকে আসে। কিন্তু মেয়েটাকে দেখে কথা শুনে টাল্লি বলে তো ঠিক মনে হচ্ছে না।
শীতল সেদিন গিরীশের বাইকের পেছনে বসেই বাড়ি ফিরেছিল। ডেলিভারি শেষ করে, ওর আপত্তি সত্ত্বেও গিরীশ বাড়ির সামনেই নামিয়েছিল। ততক্ষণে জানা হয়ে গেছে শীতলের দিনরাতের চলাফেরার স্থানকাল। শীতলও জেনেছে ওর কামধান্দার খবর। খারকি অঞ্চলেই ডেলিভারি করে গিরীশ, তাই টুকটাক দেখা হয়েই যেতে লাগল। সে রাতে বাইকের সিট ভিজে যাওয়াটা গিরীশ খেয়াল করেছিল কিনা, এটা আর জিগ্যেস করে উঠতে পারেনি এখনও। করবে একদিন ঠিক। সকালে অফিস যাওয়াটা আমিনের সাথেই করার চেষ্টা করেছিল ওরা ক’জন। কিন্তু আমিন বেরোয় ভোর সাতটায়, বারোটা অবধি ‘আপলা মন্ডি’র হয়ে শাক সবজি, ফল, ফুল ডেলিভারি করে, তারপর কম্ফিকার্টের ডেলিভারিতে যায়। সময় বাঁচাতে অনেকসময় আগের রাতেই পরের দিন সকালের ডেলিভারির মাল গাড়িতে তুলে নেয়। মেট্রোর কাজ চলছে পুরোদমে, খারকি অবধি চালু হয়ে গেলে অনেকটা সুবিধে হবে, টাইমও বাঁচবে।
অনেককিছু খুলে গেছে, মানুষ তবু রেস্টুরেন্টে কম যায়, অর্ডার করে বাড়িতে আনায় বেশি। গিরীশের কাজের চাপ বেড়েছে ভালই, রোজগারও হচ্ছে বেশ। এর মধ্যে বাপটা ঘ্যান ঘ্যান করছে জমি কেনার জন্য। সেই কোন একশ’ বচ্ছর আগে ওর পরদাদা আরো সব কিসানদের সাথে মিলে খেতিজমি বাঁচাতে লড়েছিল। ওর দাদা তখন পাঁচ বছরের মুলগা। টাটা কোম্পানি মুলানদীতে বাঁধ দিল, কি না, ইলেকট্রিসিটি তৈরি হবে, মুলশি লেক তৈরি হবে। সেখানে সব বড়লোকরা বেড়াতে আসবে। খানাপিনা মৌজমস্তি। তাতে ওর পরদাদাদের খেতিজমি নিয়ে নিচ্ছে, কী খাবে কী করবে কিসান? তখন পাণ্ডুরঙ বাপতেজি ডাক দেয় মুলশি সত্যাগ্রহের। ভারতে তখন ব্রিটিশরাজ, জমি বাঁচাতে পারেনি বটে, তবে বদলি জমি পেয়েছিল মুলশি লেকের পশ্চিমপাড়ে। পরদাদা, দাদা, বাপও সেই জমিতে চাষ করেছে এই তিরিশ বচ্ছর আগে পর্যন্ত। তারপর কর্পোরেটাররা এলো খোকার পেটি নিয়ে।
তা বাপটা পেয়েছিল পাঁচলাখ কম এক খোকা, তার থেকে সরপঞ্চের বেটাকে দিতে হল সত্তর লাখ। সেও নাকি আরো ভাগ হবে, মিনিস্টারের ঘর অবধি যাবে টাকা। তবু হাতে যা ছিল, তাও ওরা জন্মে চোখে দেখেনি কখনো। বাপ কামধান্ধা ছেড়ে মদ আর জুয়ায় মেতে রইল সালভর। তবু মা জোর করে বাড়িটা পাকা করে দোতলা করে নিয়েছিল আর বাড়ি রেখেছিল নিজের নামে। সরপঞ্চ সাহায্য করেছিল খুব, নাহলে সমস্ত টাকাটাই নেশার পেছনে উড়ে যেত। পাঁচ বছর পর, হাতের টাকা পুরো ফুরিয়ে যাবার পরে, বাপের মাথায় ঢুকল আবার জমি কিনে খেতি করবে। প্রথমে ভাগে নিল জমি। নেশা ততদিনে মাথায় চড়েছে, শরীর হয়েছে দুবলা। বেশি খাটতে পারে না খেতে, নেতিয়ে পড়ে আর চাঙ্গা হতে গিয়ে জোটে মার্কেটের পিছে দারুকোঠিতে। ভাগের জমি চাষ হয় না পুরো, দেনা বেড়ে যায়। কোনওবার বর্ষা আসতে দেরি হয়, বীজ মাটিতেই শুকায়। ছেড়ে দিতে হল জমিটা।
শীতল এসব কথা শুনলে কেমন অবাক হয়ে যায়। চাষবাস, খেতিজমি এইসব ওদের পরিবারে ছিল না কোনোকালে। বড় পোস্টাপিসের পিওন ছিল ওর বাবা। ওর দাদাজিও পিওন ছিল, সরকারি চাকরিতে তখন ছেলেকে ঢোকানোর সুবিধে ছিল। তাতেই ওর বাবা দশক্লাস পাশ দিয়ে চাকরি পেয়ে যায়। তা চলে যাচ্ছিল, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেষ করিয়ে রিটায়ার হবে ভেবে রেখেছিল। কিন্তু কয় বছর আগে হঠাৎই একদিন নোটিশ আসে, সরকারের হাতে অত লোকের অতদিন ধরে মাইনে দেবার মত পয়সা নেই, তাই ওদের আগে আগেই রিটায়ার হয়ে যেতে বলছে। প্রথমে ওরা বিশ্বাস করেনি, তেমন গা’ও করেনি। সরকার অমন কত নোটিশ জারি করে, ক’টা আর ঠিকঠাক মানে লোকে। কিন্তু সত্যিই নয়মাসের মাথায় ওদের একদম বসিয়ে দিল। বেশ কিছু টাকা হাতে পেয়েছিল বটে। তার অর্ধেকের বেশিটা খরচ হয়ে গেল বড়বোনের বিয়েতে। বাবা তেমন চিন্তা করেনি, ছেলে বড় হয়েছে, কামাবে।
বড়েভাইয়ার ট্রান্সপোর্টের বিজনেস শুরু করতে বাকি টাকাটার অর্ধেক গেল। বাবা ততদিনে মারুঞ্জিতে এ-মার্টের দোকানে সিকুরিটি গার্ডের চাকরি পেয়ে গেছে। স্যার ম্যাডামদের ব্যাগ খুলে উঁকি মেরে দেখে, হাতে একটা লম্বা চ্যাপ্টা যন্ত্র ধরে খরিদ্দারের গায়ের উপর দিয়ে আলতো করে বুলিয়ে নেয়। কখনো পিঁক করে আওয়াজ হয়, কখনো হয় না। ডিউটি দিনে এগারো ঘণ্টা, মাস গেলে পগার আসে সাত হাজার। বড়েভাইয়ার ট্রান্সপোর্টের বিজনেস থেকেও আয় হচ্ছিল টুকটাক। একটা ছোট ট্রাক আর একটা টেম্পো ট্রাভেলার, মাল নিয়ে, পাসিঞ্জার নিয়ে চলে যায় নাসিক, মারগাঁও, ব্যাঙালোর ওদিকে গুজরাট, রাজস্থান। শীতলও স্কুলটায় পেয়ে গেল। তখনই বড়েভাইয়ার বিয়ে পাকা হল, সোলাপুরে এক ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীর বড় মেয়ের সাথে। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, এই বদবিমারিটা না আসা অবধি।
গুড়ি পড়ওয়ার একমাস আগে থেকেই চারপাশের হাওয়া কেমন থমথমে হয়ে উঠতে লাগল। মুলখের, সাংলি, গোদাম্বেওয়াড়ির গাঁওগুলো থেকে বিমারি আর মওতের খবর আসতে লাগল। কম্ফিকার্টের গুদামে সবাই বলাবলি করে, আবার লক ডাউন হবে। লক ডাউন হলেই ট্রেনও বন্ধ হবে, ভয়ে শীতলের হাত পা ঘামে, গলা শুকিয়ে আসে। গতবার দিওয়ালির পর বাবার জ্বর হল, সিকুরিটি গার্ডের চাকরিটা ফোনে ফোনেই কাটিয়ে দিল দোকান মালিক। নাকি খারাপ জ্বর, না হলেও হতে কতক্ষণ? আর কে না জানে, এই বিমারি অনেকের বডিতেই চুপচাপ লুকিয়ে থাকে, জ্বর-টর হলে বেরিয়ে এসে অন্য লোকের বডিতে চলে যায়। জেনেশুনে দোকানের লোককে বিপদে ফেলবে না মালিক। সেই থেকে শীতলের এই ক’টা টাকায়ই চলছে সংসার। বড়েভাইয়ার বিজনেসও নাকি খুব ডাউন যাচ্ছে, সংসার চালিয়ে কিছুই পাঠাতে পারে না। ওদিকে ভাবীর বাচ্চা হবে, তারও খরচ খরচা আছে।
গিরীশের মা কাছের একটা হাউসিঙে একটা ফ্ল্যাটে বাচ্চা দেখার কাজ করে, আর আশেপাশের বাচ্চাদের তেল দিয়ে ম্যাসাজ করে, মাস গেলে হাতে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার পাচ্ছিল। এক্সট্রা বাদ দিয়ে গিরীশও মোটামুটি হাজার কুড়ি পায়। বাপের ঘ্যানঘ্যানানিতে মা কিছু কিছু টাকা সরিয়ে রাখছিল ব্যাঙ্কে, যদি মুলখেরের দিকটায় কিছু খেতিজমি কিনে রাখা যায়। বাপটা অবশ্য এখনো মাসে এক দুইদিন মদ খেয়ে টাল হয়ে পড়ে থাকে, তবে রামিখেলাটা কমেছে। ওর বাপকে খেলার দিকে যেতে দেখলেই গাঁওওয়ালে কেউ না কেউ বাড়িতে খবর দেয়, মা গিয়ে চিল্লিয়ে খেলার ভুত ভাগিয়ে দেয়। গিরীশ শুনেছে, মেট্রোর জন্য সরকার জমি নিয়ে নিচ্ছে এদিক সেদিকে, বাপকে বলে – খেতিতে না লাগিয়ে বিল্ডারদের সাথে লাগালে লস যাবে না টাকাটা। বাপ তেড়ে ওঠে, বিল্ডাররাই ভুলিয়ে ভালিয়ে ওর জমি নিয়ে নিয়েছিল। পাণ্ডুরঙ বাপতেজির নাম করে কিরা কাটে, অভিশাপ দেয়।
মার্চ, এপ্রিল, মে তিনমাস এদিকে মারাত্মক গরম পড়ে। প্রচুর জল, নিম্বুপানি না খেলে রাস্তায় হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। শীতল ব্যাগে একটা জলের বোতল রাখে, ভেতরটা শুকিয়ে গেলে দুই এক ঢোক খায়। সরকার আধা লকডাউন ডেকেছে, রাতে ফেরার জন্য অফিস থেকে ই-পাস বানিয়ে দিয়েছে। ন’টার পরে পুলিশ থাকে রাস্তায়, ধরে পাস চেক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রায়ই। রাত ন’টা থেকে ভোর ছ’টা কার্ফু, তবে পুলিশ থাকে রাত একটা অবধি। গিরীশ বলে, পুলিশদেরও কামাই কমে গেছে অনেক। এক বচ্ছর হল, রাস্তায় সেভাবে নাকা চেকিং হয়নি, তা কামাই হবে কোত্থেকে? আজকাল সকালেও অটো বা শেয়ারের টমটম পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই একমাস আগেও অটো না থাকলেও টমটম থাকত। একটু তাড়াতাড়ি বেরোলে, তিনবার বদলে ঠিক সময়ে স্টেশান পৌঁছানো যেত। মেট্রোরেল চালু হলে বাঁচা যায়, কিন্তু মেট্রোর কাজও ঢিলে তামালে চলছে।
অ্যাম্বুলেন্সের তীক্ষ্ণ আওয়াজে গিরীশ বাইকটা সাইড করে স্লো করল। লাল-নীল আলো জ্বেলে অ্যাম্বুলেন্স দ্রুত বেরিয়ে যাবার পর, স্পিড না বাড়িয়ে কী ভেবে বাইক স্ট্যান্ড করে শীতলকে নামতে বলল, নিজেও নামল। ফুটপাথে উঠে পায়ের কাছে ব্যাগ নামিয়ে, হেলমেট খুলে বেঞ্চিতে বসে গিরীশ। শীতল অবাক হয়ে দেখছিল, ইশারায় পাশে এসে বসতে বলে ওকে। ব্যাগের সাইড পকেট থেকে দুই লিটারের লিমকার বোতল বের করে ঢকঢক করে জল খায়, শীতলকে দেয়। বর্ষা আসতে এখনো দেড়-দুই মাস বাকি। গিরীশদের এলাকায় জলের সমস্যা খুব। একদিন অন্তর মিউনিসিপালিটির কলে জলে আসে আর সপ্তাহে তিনদিন সকালে ট্যাঙ্কার আসে, সব বাড়ি থেকে লাইন দিয়ে সারা দিনের জল ভরে নিয়ে যেতে হয়। এই বছরে ট্যাঙ্কারের ভাড়া বেড়ে হয়েছে ২৪০০/- টাকা। মহল্লার সবাই মিলে ভাগেও মাসে অনেকগুলো টাকা লেগে যায় জল কিনতে। গিরীশ তাই যতটা পারে, নিজের খাবার জল সিটি এলাকা থেকে ভরে নেয়।
শীতল এসব জানে, তাই জলটা নিতে ইতস্তত করে। ওর নিজের বোতলের জল অবশ্য ফেরার পথে গাড়িতেই শেষ হয়ে গেছে, এদিকে ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। গিরীশ ওর হাতে গুঁজে দেয় বোতলটা, শীতল মুখে জল ঢালতে ঢালতেই শোনে গিরীশ বলছে, একটু বসে নেওয়া যাক। তাছাড়া ওর কিছু বলারও আছে। গিরীশ আস্তে আস্তে বলে ‘নাস্তা বোলে তো’র ভেতরের অবস্থা খুব ভাল না। বেশ কিছু রাইডারকে বসিয়ে দিয়েছে এই মাসে। এছাড়া লোকের অর্ডার করাও কমে গেছে কিছুটা। শুক্র শনিবারে বাঁধা অর্ডার ছিল বেশ ক’টা পরিবারের, তার মধ্যে মাত্র দু’টো করছে তাও অনেক কম টাকার। ও তাই ‘ইটস ডান’ নামে আর একটা অ্যাপের ডেলিভারির কাজ নিয়েছে। এরা সবকিছুই ডেলিভারি করে, কিরানা জিনিসপাতি, রান্না করা খাবার, ওষুধ, কাগজপত্র এমনকি পান সিগারেটও। অর্ডার নিয়ে পয়েন্ট ট্যু পয়েন্ট প্যাকেজ পৌঁছানো কাজ। এই দুটো কাজই ও একসাথে করবে।
সাড়ে বারোটার পরে শীতলকে গুদামে ঢুকতে দেখে খিঁচিয়ে উঠল মালিক, এইরকম লেট হলে ওকে আর কাজে রাখা সম্ভব হবে না। আজকাল খরিদ্দার আশা করে সিস্টেমে দেখানো ডেলিভারি ডেটের বেশ খানিকটা আগেই যেন ডেলিভারি হয়ে যায়, সেখানে এন্ট্রিই লেট হলে ডেলিভারি আগে কী করে হবে? আর এ মাসে শীতল প্রায় রোজই লেট। গোটা গুদামের চিৎকার বকুনি শুনতে শুনতে শীতল, টের পায় চুড়িদারের থাইয়ের কাছে বিন্দু বিন্দু সিক্ততা। অকারণেই লম্বা কামিজটা হাত দিয়ে টেনেটুনে বাথরুমে ঢুকে যায়। ট্রেন থেকে নেমে আজ প্রাণপণে দৌড়েছিল, কিন্তু তাও বাসটা পায়নি। এখন বাসও কমে গেছে, ঘণ্টায় একটা আসে কি আসে না। ওদিকে আজ তিনদিন হল বড়েভাইয়াকে ধরেছে বদবিমারিটা। কাল রাতে খুব খারাপ অবস্থা গেছে, সোলাপুরে কোন হাসপাতালে বেড পায়নি। আজ সকালে শ্বাসের কষ্ট একটু কম। ওদিকে ভাবী এদিকে মা সমানে কাঁদছে, গণপতিকে ডাকছে।
বেলা চারটেয় শেষ ডেলিভারি লট নিয়ে আমিন বেরিয়ে যাবার পর মালিকও বেরিয়ে গেল। যাবার আগে আঙুল তুলে শীতলকে বলে গেল, এই মাসে আর একদিনও লেট হলে, এ মাসের মাইনে ও পাবে না, ওর জন্যই কম্ফিকার্টের রেটিং খারাপ আসছে। আমিন ফিরলে ওরা বেরোবে। ততক্ষণ আজকের হিসেব মিলিয়ে, রাত আটটায় যে মাল আসে, তার এন্ট্রি করে রাখবে। রাত দু’টো আর সকাল দশটার লট দু’খানার এন্ট্রি শীতলকে সকালে এসে একসাথে করতে হয়, তাই দেরি হলে ডেলিভারিও দেরি হয়। ও বোঝে সকাল ন’টা নাগাদ পৌঁছে যেতে পারলে ওরও সুবিধে আর মালিকও খুশি হয়। কিন্তু অত দূর থেকে দুই ঘণ্টা ট্রেনে, আবার এদিক ওদিক মিলিয়ে দেড় ঘণ্টার অটো কি বাসে করে আসতে গিয়ে ন’টার মধ্যে পৌঁছানো হয় না। মাঝে কয়েকদিন গিরীশ ওকে বাইকে করে একদম অফিস অবধি পৌঁছে দিচ্ছিল, তখন সাড়ে ন’টা কি দশটার মধ্যে ঢুকে যেত। তারপরই ‘ইটস ডান’এর কাজটা ধরে নিল। ব্যস, আবার লেট।
আটটার মালের গাড়িতে খবর এল, রাত দু’টোর গাড়ি আসবে না। কাল থেকে পুরো লকডাউন ডেকে দিয়েছে আবার গরমিন্ট। আজ রাতের সব ই-পাস ক্যান্সেল করেছে। কেউ যেন ন’টার পরে না বেরোয়। মালের গাড়ি বেরিয়ে যেতে, ওরা ক’জন বসে একটু হাসাহাসি করল। বিমারীর হাতে যেন ঘড়ি বাঁধা আছে, গণপতি যেন ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে অসুখ, মওত পাঠাবে! আজ মাল এসেছেও কম, ঝটপটই এন্ট্রি হয়ে গেল। বিকেলে একবার বাবা ফোন করেছিল, বলল, বড়ে ভাইয়ার শশুরাল থেকে ফোন এসেছিল, ওদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সোলাপুরে যেতে বলেছে। শীতল কাজের অজুহাতে ছেড়ে দিয়েছিল তখন, মনে পড়তেই বুকের ভিতরে কী যেন খামচে ধরল। লক ডাউনের মধ্যে যাবেই বা কী করে? চিন্তাগুলো তাড়াতে কম্পিউটারে চোখ রাখে ও। আজ একটা অদ্ভুত জিনিস এসেছে এক কার্টন, উপরে লেখা প্যান্টি লাইনার। অনেকটা স্যানিটারি প্যাডের মতই দেখতে। মনিটরটা নিজের দিকে একটু কোণাচে করে ঘুরিয়ে নিয়ে জিনিসটার বর্ণনা পড়তে থাকে। আরে এটাই তো ওকে বাঁচাতে পারে!
আমিন তাড়াতাড়িই ফিরল, জানাল বাইরে আবহাওয়া থমথমে গুমোট হয়ে আছে। লোকজন বিশেষ কেউ বাইরে নেই, গরমিন্ট থেকে মাইক নিয়ে সবাইকে ভেতরে থাকতে বলছে। আলিবাগ, মালভনে নাকি মাছুয়াদের সরিয়ে নিয়ে গেছে অন্য জায়গায়, এফএমে শুনেছে। কদিন ধরে শীতলের সাথে ভাল করে কথা বলে না, তাকায় না আমিন। ডেলিভারি একটু দেরি হওয়ায় ওর রেটিং খারাপ দিয়েছে কয়েকজন। আজও একটু দায়সারাভাবেই ডাকল ফেরার জন্য। শীতল গিরীশকে ফোনে বলছিল, আজ ওরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি ফোন ছেড়ে কুঁকড়ে গুটিয়ে গাড়িতে উঠল। গিরীশ হাদপসারে এসে তুলে নেবে ওকে। হঠাৎ মনে হয়, আচ্ছা গিরীশ কি কোনোদিন খেয়াল করেছে, টের পেয়েছে ওর অসুখটার কথা? স্যানিটারি প্যাডের বড্ড দাম, রোজ রোজ পরা পোষায় না। প্যান্টিলাইনার কিনতে পারলে গিরীশ আর টের পাবে না। কিন্তু সামনের মাসে মাইনে পাবে তো শীতল?
রাত ন’টা পেরিয়ে গেছে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক আগে, ই-পাস তো আজ রাতে ক্যান্সেল, গিরীশ তাই হাইওয়ে ছেড়ে ভেতরের শর্টকাট রাস্তায় বাইক ছোটায় হু হু করে। অন্যদিন ওদের দু’জনের মাঝখানে থাকে ডেলিভারির ব্যাগটা, আজ ওটা শীতলের পিঠে দিয়ে ওকে বলেছে গিরীশকে শক্ত করে ধরে বসতে। এই রাস্তাটায় লাইট তেমন নেই, বাইকের হেডলাইট ভরসা। মেট্রোর মাটি খুঁড়ে রাস্তার পাশে স্তুপ করে রেখেছে, জায়গায় জায়গায় মেট্রোরেলের সুড়ঙ্গের পাশের টিনের পার্টিশান দেয়াল খানিকটা ভেঙে কাত হয়ে রয়েছে, হেডলাইটের আলোয় মনে হচ্ছে মস্ত গহবর চলে গেছে পৃথিবীর কেন্দ্র অবধি। গিরীশ হেলমেটের সামনের ঢাকনিটা কপাল অবধি তুলে শীতলকে বলে, রেললাইনেরা আসলে এক অন্যের সাথে জোড়া থাকে। একটা রেলগাড়িতে চড়লেই আসলে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে চলে যাওয়া যেত, যদি না মানুষের রাজনীতি মাঝখানে সীমানা বসিয়ে রেললাইনটা টুকরো করে দিত।
তালেগাঁও যাবার মোড় ছেড়ে সোজা খানিক এগিয়েই গিরীশ টের পায়, পাশের পিছল আঠালো মাটি রাস্তায় এসে পড়েছে, বাইক পিছলাচ্ছে অল্প অল্প। গতিবেগ কমায় আর ওকে চমকে দিয়ে পিছনে বেজে ওঠে ‘ইয়ে দেশ কি ধরতি সোনা উগলে, উগলে হীরে মোতি, ইয়ে দেশ কি ধরতি, শীতলের মোবাইলের রিংটোন। গিরীশ জিগ্যেস করে, দাঁড়াবে কিনা? শীতল ততক্ষণে একহাতে ব্যাগ অল্প খুলে, দেখে নিয়েছে বাবার ফোন, থামতে না করে ফোনটা কেটে দেয়। ওরা আবার রেলের গল্পে, মেট্রোর গল্পে ডুবে যায়। শীতল বলে, শিবাজীনগরে মেট্রোয় চেপে যদি হরদোয়ার পৌঁছে যাওয়া যেত! গিরীশ বলে সে আর এমন অসম্ভব কী? মেট্রো তো ইন্টারসিটির স্টেশান অবধি যাচ্ছেই, সেখান থেকে মুম্বাই, মুম্বাই থেকে দিল্লী – রাজধানী এক্সপ্রেসের লাইন ধরে, ব্যস, সেখান থেকে সোজা হরদোয়ার। ওর বাঙালি পড়শি বলে ‘হরিদ্বার’, ভগবান হরির কাছে যাবার দরজা, সেখানে নাকি ভীষণ সুন্দর আরতি হয় গঙ্গার উপরে।
ঠিক ঝড় নয়, তবে হাওয়া দিচ্ছে এলোমেলো, নিঃশব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশের পুব থেকে পশ্চিম অবধি। গিরীশ বলে, এই যে আঠালো মাটি, এতে খেতি ভাল হয়, গন্না, গেঁহু। ‘ইয়ে দেশ কি ধরতি সোনা উগলে’ আবার বাজছে শীতলের ফোন, এবারে ওর বড়বোন। প্রচণ্ড ভয় করে শীতলের, আলতো করে ছুঁয়ে নীরব করে দেয় ফোনটা। এমন মাটির জন্যই পাণ্ডুরঙ বাপতে সত্যাগ্রহ করেছিল, বলে চলেছে গিরীশ। বলতে বলতেই হ্যান্ডেলের আয়নায় দেখে, পিছন থেকে বিরাট কালো কী যেন একটা তেড়ে আসছে ওদের দিকে, যার নীচের বাঁ দিকে মিটমিটে কিছু একটা জ্বলছে। ইস্কুলে পড়া একচক্ষু দানব সাইক্লপসের কথা মনে পড়ে। এটা কি কোন জানোয়ার? না কি হাইওয়ে থেকে পুলিশের ভয়ে শর্টকার্ট নেওয়া বেয়াইনি ট্রাক? গিরীশের শরীরে পাক দিয়ে মাথাটা ঘুরে ওঠে হঠাৎই, ক’দিন ধরেই শরীরে তেমন জুৎ নেই। ইতোমধ্যে আরো একটা অর্ডার ঢুকেছে ফোনে, শীতলকে নামিয়ে সেটা করে তবে বাড়ি।
নাহ, কাল থেকে আধা লিটার দুধ খাবে গিরীশ, শরীর ঠিক না হলে কামধান্ধা ঠিকঠাক হবে না; ভাবতে ভাবতেই বাইকটা আরেকটু সাইড করার চেষ্টা করে, এখানটায় মেট্রোর টিনশেড ভেঙে রাস্তায় চলে এসেছে অন্ধকারে দেখতে পায় নি, চাকায় ধাক্কা লেগে বাইক ছিটকে হেলে রাস্তার মাঝে চলে আসে। আর তক্ষুণি ওই একচোখো সাইক্লপস এসে ওদের দু’জনকে গিলে নেয় বাইকশুদ্ধ। কতক্ষণ পরে কে জানে, ট্রেনের আওয়াজে শীতল চোখ খোলে। আরে মেট্রোরেল কবে চালু হয়ে গেল? এই তো দিব্বি কেমন চকচকে আলোজ্বলা স্টেশন, বড় বড় কাচের জানলাওলা মেট্রো দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক যেমন ইউটিউবে দেখে। গিরীশকে টেনে তোলে, দু’জনে মিলে বাইকটা নিয়ে ঢুকে আসে প্ল্যাটফর্মে। ওদের সামনের দরজাটা দুইপাশে সরে গিয়ে খুলে হাট হয়ে যায়। সড়াৎ করে বাইকটা তুলে দুজনে উঠে পড়ে, এই কামরাটায় কেউ নেই, কেউ হয়তো জানেই না চালু হয়ে গেছে। সামনের কামরায় আছে মনে হচ্ছে, কিন্তু ঠিকমত দেখা যাচ্ছে না। ঝমাঝম করে ট্রেন সুড়ঙ্গে ঢোকে, দু’জনে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে পড়ে জানলার ধারে। জলকাদা নরম আঠালো মাটির মধ্যে থেকে শুধু বারেবারে বেজে ওঠে ‘মেরে দেশ কি ধরতি সোনা উগলে উগলে হীরে মোতি। মেরে দেশ কি ধরতি’।