গোপালপুর গ্রামটা ছত্তিশগড়ের বিলাসপুর -কোরবা স্টেট হাইওয়ের উপর একটা মাঝারি জনপদ; কাঠগোড়া মহকুমা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। সেখানে বছর পাঁচ হল একটা ব্যাংক খুলেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের একটা ছোট শাখা।
মায়ের শরীর খারাপের খবর পেয়ে সাতদিনের ছুটি নিয়ে ভিলাইনগরের বাড়িতে গিয়েছিলাম। মা দ্রুত সেরে ওঠায় পাঁচদিনের মাথায় ফিরে এসে আজ ব্যাংকে ডিউটি জয়েন করেছি। আজ মঙ্গলবার। আজকে আমি উপোস করেছি, এখন বিকেল নাগাদ বড্ড খিদে পাচ্ছে।
আমি সপ্তাহে দু-দিন উপোস রাখি—মঙ্গলবার বজরংবলির উপোস, শনিবার শংকর ভগবানের। তবে এই সব উপোসে চা এবং ফল খাওয়া যায়; অন্ন, মানে ভাত-রুটি-তরকারি, না খেলেই হল। সাধারণতঃ আমি কাঠগোড়া বাসস্ট্যান্ডে সিন্ধি ভদ্রলোকের একটা বড় ফলের দোকান থেকেই কিছু কলা, আপেল, সফেদা ও মুসম্বি কিনে নেই। আজ সেটা হতে পারে নি।
ওখানে বিলাসপুর কোরবার বাস অন্ততঃ দশ মিনিট দাঁড়ায়। ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, খালাসিরা চা-জলখাবার খায়। কিছু যাত্রীও বাদ যায় না। ফলের দোকানের পাশেই গুপ্তা হোটেল। সেখানে চা খেয়ে সবাই পাশের গলিতে যায় তলপেটের চাপ হালকা করতে।
এসব নিত্যিকর্ম সেরে পাশের ফলের কিওস্কের দিকে এগোচ্ছি এমন সময় একটা চিৎকারে সবাই চমকে উঠল।
--ভোঁসরিওয়ালে! মাদর--! আজ তেরি তো –
-- হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোর মুরোদ জানা আছে। ঢোঁড়া সাপ কোথাকার!
ভিড় জমে গেছে ফলের দোকানটার পাশে।
বুড়ো দোকানদারের জোয়ান ছেলেটা চেঁচিয়ে গাল পাড়ছে একটা হাফপ্যান্ট পরা বাচ্চা ছেলেকে, যে হয়ত ওদের দোকানে ফাই-ফরমাস খাটে।
বাচ্চাটা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ওর মুখে মুখে জবাব দিচ্ছে, ছেলেটাকে তাতাচ্ছে। মোড়ের যত দোকানি আর বাসস্ট্যান্ডের নিকম্মা আমোদগেঁড়ের দল বিনিপয়সায় তামাশা দেখছে। আমার বাসের ড্রাইভার -কন্ডাকটারও এই দলে সামিল।
--দেখলি? সাহস বটে বাচ্চাটার। ভয় পায় নি, কেমন মুখে মুখে জবাব দিচ্ছে।
--এত মুখ চালানোও ভালো নয়। এরপর এখানকার কোন দোকান ওকে কাজে নেবে?
চেনা দোকানদার। আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করি কেসটা কী? ক্যা লফড়া হ্যায়?
বুড়ো জবাব না দিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকে।
--আমার ছেলেটাকে কত বোঝাই যে দিনকাল পাল্টেছে। চাকরবাকরকেও আগের মত বকাঝকা করা যায় না। ওর রক্ত গরম, বুড়ো বাপের কথা শুনতে বয়ে গেছে।
আমি পাতি ঝামেলায় মন না দিয়ে ফল বাছতে থাকি। এসব হঠাৎ শুরু হয়, আবার আচমকা থেমেও যায়--অসময়ে এক পশলা বৃষ্টির মত।
ইতিমধ্যে বাচ্চাটা আবার কিছু বলেছে বোধহয়।
গর্জে উঠেছে জোয়ান ছোকরা—অব তেরি মাঁ কো—দুঙ্গা সালে! তু দেখতে রহনা।
বাচ্চাটা সামান্য নড়ে, যেন স্প্রিন্টার রেডি স্টেডি শুনে পিঠটা একটু বাঁকিয়েছে।
এইবার। মায়ের সম্মান রক্ষার্থে এক সাহসী বাচ্চার ঝাঁপিয়ে পড়া।
কিন্তু এইটুকু বাচ্চা কি পারবে ওই গুন্ডা-মত ছেলের সঙ্গে? প্রচণ্ড মার খাবে।
ভিড় উৎকণ্ঠিত, এবার কি তামাশা দেখা ছেড়ে যুযুধান দুই পক্ষের মাঝখানে গিয়ে শান্তি কমিটি করতে হবে?
কিন্তু বাচ্চাটা একগাল হাসে। তারপর বলে—আমার মাকে করবি তো? চল, আমার বাড়ি চল। দেখি, তোর খ্যামতা!
এই উত্তরের জন্যে তৈরি ছিল না কেউ। এক সেকেন্ডের সন্নাটা! তারপর ভীড় হেসে ওঠে, এক সমবেত —হো-হো-হা-হা।
কেউ কেউ বলে সাবাস বেটা! বচ্চে কা গাঁড় মেঁ দম হ্যায়, মান না পড়েগা।
জোয়ান ছেলেটা টের পায় যে ভিড়ের সহানুভূতি বাচ্চাটার দিকে আর সবাই ওকে লুজার বা হেরো ভাবছে।
বাচ্চাটা আবার হাত নেড়ে ডাকে-- আয় না, আয়! কী হল তোর?
আর সয় না। ছেলেটা ‘আজ তু খল্লাশ’! বলে এক রণহুংকার দিয়ে চেনছেঁড়া কুকুরের মত দ্রুতবেগে তাড়া করে যায়।
বাচ্চাটা বোধহয় তৈরিই ছিল। ও খরগোশের মত পড়িমরি করে দৌড়য়, পেছনে ডালকুত্তা। ও সারি সারি দোকানের পেছনের গলিঘুঁজি দিয়ে এঁকেবেঁকে পালায়। ওরা দু’জন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওই ভুলভুলাইয়ায় গায়েব হয়ে যায়। ভিড় হালকা হয়।
ড্রাইভার গিয়ে স্টিয়ারিং-এ হাত রাখে। কন্ডাকটার চেঁচায় –সবাই উঠে পড়ুন, জলদি! গাড়ি ছাড়ল বলে।
সন্ধ্যের মুখে ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছি এমন সময় স্থানীয় প্রাইমারি হেলথ সেন্টারের ড্রেসার ছেলেটি এসে হাসিমুখে বলে- ডাক্তার সাব আপনার অপেক্ষায় বসে আছেন, সঙ্গে করে নিয়ে যেতে বলেছেন।
আমি একগাল হেসে বলি—তুমি যাও, আমি এই এলুম বলে।
এটা একটা ছোট প্রাইমারি হেলথ সেন্টার, সরকারি ভাষায় মিনি হেলথ সেন্টার।
আছে একজন সদ্য পাশ করা এম বি বি এস ডাক্তার যাকে তিন বছরের জন্য গাঁয়ে পাঠানো হয়েছে, ডাংগুলির খাটান নেওয়ার মত। আর আছে একজন মালয়ালি নার্স ও একজন ড্রেসার। লাগোয়া দু-কামরার কোয়ার্টার।
এখানে ডাক্তার রোগী দেখেন সকাল দশটা থেকে সূর্য ডোবা পর্যন্ত। গাঁয়ের লোকে দূর থেকে আসে একজন দু-জন করে। কখনও কখনও চার-পাঁচজন। ইন্ডোর ওয়ার্ড নেই। এমার্জেন্সিতে কয়েক ঘন্টার জন্যে পাশের কামরায় একটা চৌকিতে শুইয়ে রাখা হয়। তারপর রোগীর আত্মীয়দের বলা হয় মহকুমা সদরে নিয়ে যেতে।
আমি ব্যাংক ম্যানেজার চন্দ্রকান্ত খারে আর উনি ডাক্তার মহাকালেকর – আমরা হলাম ‘দো পঞ্ছি এক ডাল কে’ – দুজনেই রায়পুর ইউনিভার্সিটির স্নাতক, দু-জনের চোখেই গাঁয়ের জীবন একটা পানিশমেন্ট, ডাক্তারের ভাষায় ‘কালাপানি কা সাজা’।
তবে ডাক্তারের কপাল ভাল। এই আদিবাসী বহুল ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে আড়াই-তিন বছর কোন রকমে কাটানোর পর ও পোস্টিং পাবে কোন ব্লক হেড কোয়ার্টারে, আধা শহর। ভাল কোয়ার্টার, ওষুধের দোকান, প্যাথো ল্যাব। সিভিল লাইন্সের সরকারি অফিসারদের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন ও রামি খেলা। আর রোগী দেখতে কারও ঘরে গেলে ভিজিট নেওয়া।
আমরা দুজনেই ব্যাচেলর। ফলে আমাদের আড্ডায় নারীঘটিত প্রসঙ্গ একেবারে চেরি অন দ্য কেক। কিন্তু আমরা কেউ অল্পবয়সি মালয়ালি নার্স প্রমীলা মাধবনকে নিয়ে কোন ছ্যাবলামি করি না।
মেয়েটি চাকরিতে এসে এক সপ্তাহ পরে মহাকালেকরকে বলল—পেটের দায়ে নিজের দেশ ছেড়ে এতদূরে চাকরি করতে এসেছি। এখন আমার মানসম্মান সেফটি সব আপনার হাতে। এখানে বাড়িভাড়া পেতে যা যা কথা শুনতে হয়েছে সেসব আপনাকে বলতে পারব না।
ডাক্তার গম্ভীর হয়ে যায়, কিছু একটা ভাবে। তারপর নীচু গলায় বলে –কথা দিলাম, চিন্তা কোর না।
ডাক্তার এখনও বিয়ের কথা ভাবছে না। ওর স্বপ্ন এম ডি করা। তবে চান্স পাওয়া কঠিন। একবার এম ডি হয়ে গেলে সরকারি চাকরি ছেড়ে কোন ছোট শহরে নিজের চেম্বার খুলবে। সংসারধর্ম তারপরে।
তাই ও নিয়মিত রাত জেগে পড়াশুনো করে। ওর সকাল হয় বেলা আটটায়।
আমার কপাল খারাপ। ইংরেজিতে এম এ পাশ করে ব্যাংকের চাকরিতে ঢুকতে হল। তা’ও গ্রামীণ ব্যাংক। স্বপ্ন দেখতাম, কলেজে পড়াব, ভিলাই না হোক, ছত্তিশগড়ের কোন কলেজে। তবে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা প্রাইভেট কলেজে নয়। ওদের মাইনের ব্যাপারটা একটু গোলমেলে। কিন্তু তার জন্য চাই পি এইচ ডি, নিদেনপক্ষে এম ফিল।
বাবা নেই, বিধবা মায়ের শরীর ভাল না। মা ছিলেন ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টের স্কুলের লাইব্রেরিয়ান। এক বছর আগে রিটায়ার করেছেন। সস্তা কোয়ার্টার ও সস্তা বিজলি ছেড়ে এখন ভাড়ার বাড়ি।
এই চাকরিতে দশটি বছর কোন অজ পাড়াগাঁয়ে কাটানো আমাদের ভবিতব্য। অধিকাংশ ব্রাঞ্চই গাঁয়ে। আর শহর বা জেলা সদরে পোস্টিং তো হাতে গোনা। আর আমি নেহাতই এলেবেলে। মাথার উপরে কোন রাজনৈতিক কেষ্টবিষ্টু বা বড়োলোক আত্মীয়ের বরদ হস্ত নেই।
মহাকালেকর গেয়ে ওঠে –উই আর ইন দ্য সেম বোট ব্রাদার। হ্যাঁ, ওর গানের গলা ভাল। মদ খেলে ইংরেজি গান বেশি গায়। আমার পছন্দ হিন্দি ফিল্মের গান।
ওর ড্রেসার বয় ভালই রান্না করে। ডাক্তার নিজে কফি আর ওমলেট বানাতে পারে। মেডিক্যাল হোস্টেলে শিখেছে। আমি দুধে চা পাতা ফুটিয়ে ভাল কড়িমিঠি চা বানাতে পারি। ডাক্তার চুমুক দিতে দিতে সার্টিফিকেট দেয়—এক নম্বর! একেবারে রেলস্টেশনের ল্যাঙোট চা।
আমরা হেসে উঠি।
ওটা রেলস্টেশনের কালচে ন্যাকড়ায় পুঁটলি করে ছেঁকে বানানো চায়ের কোড নেম –ল্যাঙট ধোয়া চা। এসব ফ্রেজ ডাক্তারের কালেকশন, রায়পুর মেডিকেল কলেজের হোস্টেল জীবনের স্মৃতি।
কেরোসিনের জনতা স্টোভে রান্না হয়। একটু সময় লাগে।
ডাক্তার আবার দুজনের গেলাসে হুইস্কি ঢালে, ম্যাকডাওয়েল। আমরা ওল্ড ট্যাভার্ন, ক্যারু এসব খাই নে। একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে না ? তবে এই মাইনেয় ওর বেশি ওপরের ব্র্যান্ডের দিকে তাকানো যাবে না।
আমরা স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন। জীবন তো সবে শুরু হয়েছে। এখনও অনেক পথ চলা বাকি। তাই তিন পেগের বেশি খাই নে। আবার প্রথম পেগের পর থেকে জল মেশানোর মাত্রা বাড়ে। তিন নম্বরে পৌঁছে খানিক পরে গেলাসের দিকে তাকালে মদের সঙ্গে জল, নাকি জলের সঙ্গে মদ বোঝা মুশকিল হয়ে যায়।
এই সময় ডাক্তারের দুঃখ উথলে ওঠে। ওর সঙ্গে ডাক্তারি পড়া তামিল মেয়েটি বিয়ের পর আমেরিকা চলে গেছে। ডাক্তার অবশ্য আমেরিকা না বলে স্টেটস বলে। জড়ানো গলায় বলে—অপর্চুনিস্ট! আরে যদি বিদেশে গিয়ে বরের পয়সায় বাড়িগাড়ি করবি তাহলে ডাক্তারি পড়তে কেন এলি? টেল মি! কাওয়ার্ড, দেশদ্রোহী!
আমার গলায় হাসির আভাস, ও চটে যায়।
--দিস ইজ নো জোক। ইন্ডিয়া হ্যাজ লস্ট এ ডক্টর। ওর জায়গায় কোন ছেলে চান্স পেলে দেশের লাভ হত। দিস ইজ বিট্রেয়াল! এ গ্রেট বিট্রেয়াল। মেয়েরা বিট্রে করে। দে আর বিট্রেয়ার্স বাই নেচার। বাট গড অলমাইটি তাই ওদের পানিশমেন্ট দিয়েছেন।
তারপর ও একটা বহুবার বলা পিজে ফের শোনাতে চায়। আমি অন্যমনস্ক হবার ভান করি। হাতের গেলাসের দিকে তাকিয়ে থাকি। ও আবার চটে ওঠে।
--দিস ইজ ব্লাডি ইনসাল্টিং ম্যান, ড্যাম ইনসাল্টিং । আমি যখন তোমাকে কিছু বলছি, তুমি শুনবে। আমার চোখের দিকে তাকাবে। তোমার হাতের গেলাসের দিকে নয়। শোন এবার।
আমাকে শুনতে হয়, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
ও সম্পন্ন ঘরের ছেলে, কোনও পারিবারিক দায়িত্ব সামলাতে হয় না। আমার মত প্রতিমাসে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয় না। ওর মাইনেও আমার চেয়ে বেশি। তাই বেশির ভাগ দিন মদের বোতল ওই আনিয়ে দেয়।
ও বলতে শুরু করে।
--একবার সমস্ত মেয়েরা মিলে দেবী পার্বতীর কাছে ডেলিগেশন নিয়ে গেল। বলল, এ তো মহা অন্যায়! ছেলেরা খালি মজা লুটবে, তারপর কিছু হয়ে গেলে ভালোমানুষের মত মুখ করে সটকে পড়বে। পাপ করে ধরা পড়বে না। আর আমরা গর্ভ হলে লুকোতে পারি না, পাপের ভাগী হই।
এছাড়া এটাও দেখুন, সন্তানের জন্ম দিতে আমাদের জীবন সংশয় হয়। অনেকবার সার্জারি লাগে। আর স্বাভাবিক ডেলিভারিতেও কী কষ্ট!
কিন্তু ছেলেরা কেন একতরফা মজা লুটবে? এটা আপনাদের একচোখোমি।
--হুম্। এটা তো ঠিকই। তা তোমরা কী চাও?
--আপনি দেবাদিদেব মহাদেবকে বলুন নিয়মটা পালটে দিতে।
--মানে? ছেলেরা গর্ভধারণ করবে? সেটাই চাও? কিন্তু সেটা কী সম্ভব?
--না না, আমরা এত অবুঝ নই। আমরা চাই জন্ম আমরা দেব, কিন্তু প্রসবযন্ত্রণা ছেলেরা ভোগ করবে, ব্যস্।
দেবী কনভিন্সড্ হয়ে বাবা ভোলেনাথের সঙ্গে দেখা করলেন।
ভোলেনাথ সব শুনে দু’দিকে মাথা নাড়লেন।
--এ হয় না। ব্রহ্মা অনেক ভেবেচিন্তে নিয়ম করেছেন। এটা পালটে দিলে অনর্থ হবে।
--আপনি চাইলে সব হয়, আপনার কথা ব্রহ্মা-বিষ্ণু কেউ ফেলতে পারেন না। একবার চান্স দিয়ে দেখুন, কোন অঘটন হবে না ।
--ঠিক আছে। একটা ট্রায়াল হোক। তারপরে রেজাল্ট দেখে তোমরা ফাইনাল যা বলবে। তথাস্তু।
সারা দেশে হৈচৈ। পেডিয়াট্রিক ক্রান্তি হতে চলেছে। প্রথম স্যাম্পল এক ধনী ব্যবসায়ীর বাড়িতে। নির্দিষ্ট তারিখে শেঠ ও শেঠানিকে পাশাপাশি দুটো খাটে শুইয়ে দিয়ে বেশ কজন ডাক্তার ঘড়ি দেখছেন।
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, লেবার পেইন শুরু হবার কথা। কিন্তু শেঠজি নির্বিকার। কোন পরিবর্তন নেই। এদিকে শেঠানির শরীরে সমস্ত লক্ষণ ফুটে উঠছে।
তবে কি দেবতার বর ব্যর্থ হবে।
এমন সময় নীচের তলা থেকে এক বিকট জান্তব চিৎকার। দেখা গেল খাটিয়ায় শুয়ে পুরনো দারোয়ান পেট চেপে গোঙাচ্ছে।
আমি উঠে পড়ি। মুখে টোকো স্বাদ।
চলে আসার সময় ডাক্তার আচমকা বলে –আরে, কাল একটা বিয়ের নেমন্তন্ন আছে। আমাদের দুজনকেই ডেকেছে। পরশুদিন থেকে তোমার কার্ড আমার কাছেই রয়েছে, তুমি তো বাড়ি গেছলে। এখন ঘরে গিয়ে খুলে দেখ, কেমন।
ইয়াদ রখনা, হম দোনোঁ চলেঙ্গে।
ঘরে ফিরে আলুসেদ্ধ ভাত আর একটা ডিমের বড়া খেয়ে শুয়ে পড়ি।
পরের দিন ঘুম ভাঙে একটু দেরি করে। ব্যাংকের চাপরাশি ঘর ঝাঁট দেয়, চা নিয়ে আসে।
--সা’ব, এই বিয়ের চিঠিটা আপনার খাটের পাশে মাটিতে পড়ে ছিল।
--কই দেখি।
হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে খামটা খুলতেই দেখি ওপরে লেখাঃ
“মঙ্গলম ভগবান বিষ্ণু, মঙ্গলম গরুড়ধ্বজ।
মঙ্গলম পুণ্ডরীকাক্ষম মঙ্গলায় তনো হরি”।।
ভেতরের পাতায় ‘পরম কারুণিক পরমপিতা পরমেশ্বরের অসীম কৃপায় আমার কনিষ্ঠা কন্যা সৌভাগ্যবতী ললিতার বিবাহ পেন্ড্রা গৌরেলা নিবাসী সদব্রাহ্মণ শ্রীকনকমণি পাঠকের জ্যেষ্ঠ পুত্র চিরায়ুষ্মান সম্রাটের সহিত স্থির হইয়াছে। আপনারা সবান্ধবে আসিয়া বরবধূকে আশীর্বাদ করিলে অনুগৃহীত হইব’।
একটা হাজার ভোল্টের শক! তখনই মনে মনে ভেবে নেই এই বিয়েতে আমি যাব না।
চাপরাশি বিজয় আমার মুখের ভাবে কিছু আন্দাজ করে।
--হ্যাঁ স্যার। সেই মেয়েটা, বয়সের দোষে যবনের উচ্ছিষ্ট হয়েছিল। এখন সব—
এক ধমকে ওকে থামিয়ে বলি—আমার সামনে থেকে সরে যা!
বিকেলের দিকে আমার ক্লার্ক জিজ্ঞেস করে –আজকে তিওয়ারি উকিলের মেয়ের বিয়েতে আমাদের ব্যাংকের সবাইকে নেমন্তন্ন করেছে। আপনি কখন যাবেন? ও, ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে?
হাতের ইশারায় বলি তোমরা যাও, আমি দেখব-খন।
সন্ধের অন্ধকার। সবাই চলে গেছে। ব্যাংক খালি, আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করছে না।
দু-বছর আগের কথা।
আমি তখন সদ্য গোপালপুরে জয়েন করেছি। সরকারের নির্দেশ এল যে গরিবদের জন্য স্বর্ণজয়ন্তী গ্রাম স্বরোজগার যোজনায় করা ঋণের আবেদনগুলো একটা ঋণ-মেলার আয়োজন করে হাতে হাতে স্যাংশন করতে হবে। তাতে পঞ্চায়েত প্রতিনিধি, ব্লক অফিসের সরকারি অফিসার, এলাকার সব ম্যানেজার মিলে একত্রে বসে ‘এটা ঠিক/ ওটা ভুল’ করে ফয়সালা করতে হবে।
গরিব মানুষের দু-শ আড়াইশ আবেদন ফেলে রাখলে চলবে না।
মহকুমার জনপদ ভবনে কাজ শুরু হল। বারান্দায় উৎসুক লোকের ভিড়। হলের মধ্যে আমরা সবাই। একটা একটা করে নাম ডাকা হচ্ছে আর ঋণপ্রার্থী এসে হাতজোড় করে দাঁড়াচ্ছে। দু-একটা প্রশ্ন। একে কত দেওয়া যায়?
পাঁচ হাজার? নাঃ দশ হাজার দিন। কিপটেমি করবেন না তো!
নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টায় কাজ এগিয়ে চলে। চা-নাস্তা আসে। ফের শুরু। খুব কম আবেদন ক্যানসেল করা হয়। বিশাল বান্ডিল হালকা হয়ে যায়।
আর বেশি বাকি নেই।
হঠাৎ সন্নাটা। পিন পড়লে শব্দ শোনা যায়। আমি কিছুই বুঝতে পারি নি।
ডাক শুনে হলের মধ্যে এসে একটি রঙচটা শাড়ি পরে আদ্দেক মাথা ঢেকে দাঁড়িয়েছেন এক মাঝবয়সি মহিলা। মুখে কথা নেই। চেহারায় অনন্ত বিষাদের ছাপ।
ফিসফিসানি।
কোন গ্রাম? ধনরাস। কোন ব্যাংক? ক্ষেত্রীয় গ্রামীণ।
সবাই আমার দিকে তাকিয়ে। আমি অ্যাপ্লিকেশনটি হাতে নিয়ে দেখতে থাকি।
ফরিদা বী। ফল দোকান। দশ হাজার টাকা চাই।
জিজ্ঞেস করি –আপনিই ফরিদা বী?
ওর মাথা আরও নুয়ে পড়ে। কোন শব্দ বেরোয় না।
ব্যাংকের উকিল নীরজ ব্যাস বলেন— হ্যাঁ হ্যাঁ, ইনিই। আমি আইডেন্টফাই করছি। আপনি দশ হাজার টাকা নগদ মঞ্জুর করুন।
-- সে কী?
-- আরে আমরা বলছি তো। পুরো কমিটি সাইন করবে, আপনি একা নন। চিন্তা কিসের? পরে সব বলব।
সন্ধ্যের পর ব্যাস উকিল আমাকে খুলে বলেন।
-- শুনুন , ওই বিধবা ফরিদা বী-র ছেলে হামিদ ক্লাস টেনে পড়ত। সহপাঠী ছিল ললিতা তিওয়ারি, আমাদের বন্ধু উকিল তিওয়ারির ছোট মেয়ে। দুজনের মধ্যে কবে থেকে যে প্যার-মুহব্বত চলছে বড়রা টের পায় নি।
মেয়েটির বিয়ে এক হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে প্রায় ঠিক। পাকা দেখা হয়ে গেছল। এমন সময় ওরা দুজন একসঙ্গে পালিয়ে গেল। ছেলেটি মায়ের সঙ্গে ফলের দোকান চালাত। মায়ের টিনের সুটকেস থেকে যা পারল নিয়ে গেল। মেয়েটিও কম নয়, ঘর থেকে কিছু গয়না সঙ্গে নিয়ে গেছল।
কিন্তু সাতদিনের মাথায় ধরা পড়ে গেল। কোথায় যাবে? মোল্লার দৌড় মসজিদ অব্দি, ব্যাস্।
পুলিশ গিয়ে রায়পুরের এক সস্তা হোটেল থেকে মাঝরাতে মেয়েটাকে উদ্ধার করল। সেই রেইডের টিমে মেয়েটির বাবার সঙ্গে আমিও সাক্ষী হিসেবে সামিল ছিলাম।
কী বলব মশাই! মেয়েটা যে ভাবে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল, আমাদের পায়ে ধরছিল –সে আর দেখা যায় না।
-- তারপর?
-- তারপর আর কী? ছেলেটার বিরুদ্ধে রেপ, অ্যাবডাকশন আর গয়না চুরির চার্জ লাগানো হল। কোন উকিল ওর জামিনের কেস করতে রাজি হল না। হবে কী করে? একে তো উকিলের মেয়েকে ফুঁসলেছে, তায় মুসলমান হয়ে হিন্দু ব্রাহ্মণের মেয়েকে এঁটো করেছে!
তিনমাস ধরে ছেলেটা এখানকার জেলে রয়েছে। পুলিশের আড়ং ধোলাইয়ে ওর হাড়গোড় আস্ত নেই। হাসপাতালে দিতে হয়েছিল। তবে ওই জাতটার কিছু শিক্ষে দরকার ছিল। যা হয়েছে তা একরকম ভালই হয়েছে।
-- তাহলে ওর মাকে দশহাজার টাকা লোন দিতে আপনারা অমন হামলে পড়লেন কেন?
-- বুঝলেন না? ওর মায়ের কী দোষ? ফল দোকানের পুঁজিপাটা যা ছিল তা তো ওই হারামজাদা নিয়ে পালিয়ে গেল। এখন ফরিদা বী খাবে কী? আরে আমাদেরও বিবেক বলে কিছু আছে।
সন্ধেবেলা ডাক্তার নিজে এল আমার আস্তানায় ।
-- তুমি যে যাবে না সে তো ধরেই নিয়েছিলাম। তা মেয়ের বাবা আমাদের জন্যে দু-বোতল ম্যাকডাওয়েল পাঠিয়ে দিয়েছে। বিয়েতে নাই গেলাম, মদের বোতলের গায়ে তো আর নাম লেখা নেই। নাও, শুরু করো।
ওই মেয়েকে পার করতে কী কম মেহনত হয়েছে? চারদিকে রটে গেছল –মুসলমানের এঁটো। তাই কয়েকশ কিলোমিটার দূরের গ্রামে সম্বন্ধ করতে হল। চিয়ার্স্ !
প্রথম পেগের পর আমি জিজ্ঞেস করি—আচ্ছা ডাক্তার, সত্যি কি রেপ হয়েছিল?
ডাক্তার ছাদের দিকে তাকায়, তারপর আমার দিকে।
-- পেনিট্রেশন হয় নি। আমিই পরীক্ষা করে রিপোর্ট লিখেছিলাম।
-- সে কী! তুমি তো রেপ লিখেছিলে। হ্যাঁ, লিখেছিলাম, কিন্তু কনফার্ম করি নি। আর পেনিট্রেশন লিখি নি। ইচ্ছে করে ফাঁক রেখেছিলাম যাতে ছেলেটা পরে জামিন পেয়ে যায়। আরে আমারও তো বিবেক বলে কিছু আছে।
-- জামিন কী করে হল?
-- তোমাদের ব্যাংকের ওই ব্যাস উকিল আমাকে জেরা করে ফাঁক দেখিয়ে দিল। আমিই ওকে চুপিচুপি বলে দিয়েছিলাম। ভারি সেয়ানা! ছেলের মায়ের থেকে পাঁচ হাজার নিয়েছিল।
-- তাই আমার লোনের এক পয়সা আদায় হয় নি! ফলের দোকান বন্ধ। মা-ছেলে কোথায় গেছে কেউ জানে না?
--উফ্ একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হতে হতে বেঁচে গেল-- কোথায় সেটা সেলিব্রেট করবে? না খালি লোন আদায়ের চিন্তা!