কাল কোথায় গিয়েছিলে বত্তিরিশ থেকে?– ঘুম থেকে উঠেই প্রথম প্রশ্ন মুজফ্ফরের।
গতকাল বাড়ি ফিরে নজরুল দেখে মুজফ্ফর ঘুমিয়ে পড়েছে। ওপরে লোকজন থাকায় এ বাড়িটা খুব নিরাপদ। একেবারে সদর দরজা যেটা, সেটায় তালা পড়ে না। যে ঘরটায় ওরা থাকে সেটা রাত্তিরে অবিশ্যি ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়, কিন্তু নজরুল না-ফেরায় দরজাটা ভেজিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মুজফ্ফর। একটা চেয়ারের উপর থালা দিয়ে চাপা দেওয়া আছে ডেকচি গোছের একটা পাত্র। থালাটা তুলে নজরুল দেখে তিনখানা রুটি, আর আলু আর ডিম দিয়ে রান্না একটা তরকারি গোছের। নজরুল খেয়ে নেয়, তারপর বাইরে বাথরূমে গিয়ে ডেকচি আর থালাটা ধুয়ে শুয়ে পড়ে।
নজরুলের যখন ঘুম ভাঙলো, মুজফ্ফর ততক্ষণে চান-টান সেরে দাড়ি কামিয়ে নতুন দিনের জন্যে প্রস্তুত। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে মুজফ্ফরের প্রশ্নটা শুনতে পায় ও, বলে, তুমি জানলে কী করে?
কাল আমি গিয়েছিলাম বত্তিরিশে এখানে ফেরবার আগে, বলে মুজফ্ফর, কেমন জানি মনে হচ্ছিল তোমাকে ওখানেই পাওয়া যাবে। আফজাল বলল, পবিত্র এসেছিল, তার সঙ্গেই তুমি বেরিয়েছ গোলদীঘিতে বসবে বলে। আমি ফিরে আসছি দেখে বলল, একটু বসেই যান, হয়তো আশপাশেই কোথাও গেছে চা-টা খাওয়ার জন্যে। তাহলে একসঙ্গেই ফিরতে পারবেন দুজন। বিকেলের ডাকে বত্তিরিশে তোমার একটা চিঠি এসেছে, তুমি বেরিয়ে যাবার পরে পরেই পোস্টম্যান এসেছিল। চিঠিটা নিজের বালিশের তলা থেকে বের করে মুজফ্ফর, এই নাও।
খামের ওপরে লেখা ঠিকানায় হাতের লেখাটা দেখে নজরুল বুঝতে পারে চিঠিটা পিংলার। খাম থেকে চিঠিটা বের করে সে।
শান্তিনিকেতন, ১১ই আগস্ট, ১৯২১
প্রিয় কাজিদা,
তুমি যে ছাই কোথায় আছ! মে মাসে তোমাকে চিঠি লিখেছিলুম কোন জবাব পাইনি। অবিশ্যি জবাব দেবেই বা কোথায়? আমার ঠিকানাই বা পাবে কোথায় তুমি? গত সপ্তাহে হাওড়ায় গিয়েছিলুম। নগুয়াদা বললো, দৈনিক সান্ধ্য নবযুগ নাকি বন্ধ হয়ে গেছে। তাহলে তুমি কোথায়? করছটা কী? এই চিঠিটাও বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রীটের ঠিকানাতেই পাঠাব। আজ হোক কাল হোক তোমার হাতে নিশ্চয়ই পৌঁছবে।
কাল থেকে একটা ঘোরের মধ্যে আছি। সেই ঘোরটা এখনও কাটেনি। কালকেই লিখতুম, কিন্তু তখন ভাবলুম একটু উত্তেজনাটা কমতে দি'। কমেনি বিশেষ। তুমি যদি সামনে থাকতে, তোমাকে বলতে পারলে, একটু কথোপকথনের পর, হয়তো হালকা হওয়া যেত খানিকটা। লিখে তো ততটা হবে না। তবুও লিখি।
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে কয়েকবারই মাত্র দেখেছি। তোমাদের সঙ্গে যখন প্রথমবার শান্তিনিকেতনে এসেছিলুম তখনই প্রথমবার। সেইবারই, তোমরা চলে যাবার পর, অতুলবাবু স্যরের সঙ্গে পতিসরে যাওয়াটা যখন ঠিক হয়ে গেল, তখন আরেকবার। পতিসরে এসে শুনলুম উনি বিদেশে চলে গেছেন। সেই থেকে পতিসরেই তো ছিলুম। জুলাইয়ের শেষের দিকে স্যর বললেন, গুরুদেব ফিরেছেন। এখন বোধ হয় কিছুদিন থাকবেন। স্যরের গুরুদেবের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলার প্রয়োজন, আগস্টের গোড়ার দিকেই তাই তিনি শান্তিনিকেতনে যাবেন, কিছুই বলা যায় না এরপর ব্যস্ত হয়ে গুরুদেব কোথায় কখন থাকবেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই আসবি নাকি আমার সঙ্গে?
বুঝতেই পারছ আমি তো একপায়ে খাড়া। গুরুদেবকে প্রণাম করার আর একটা সুযোগ যে পাব শুধু তাই-ই তো নয়, পতিসরে আসবার আগে মাকে যে একবার বলেও আসিনি সেই অন্যায়টা খানিকটা হলেও শুধরে নেওয়া যাবে। পরে যদিও চিঠি লিখে জানিয়েছি, এবার গেলে একবার মায়ের সঙ্গে দেখাও তো হবে। গুরুদেব আমাকে চিনতে পারবেন আমি ভাবিইনি, কিন্তু শান্তিনিকেতনে পৌঁছলুম রাতের বেলা, তার পরের দিন সকালে যখন প্রণাম করতে গেলুম গুরুদেবকে (মনে রেখ, আমার সঙ্গে স্যর ছিলেন না তখন), আমাকে দেখে হেসে বললেন, কেমন আছিস পিংলা? পতিসরের কাজ ভালো লাগছে তো? আমি কি জবাব দিয়েছিলুম জানিনা, আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল, গলার স্বরও বোধ হয় বন্ধ হয়ে গেছিল। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ, নোবেলবিজয়ী বিশ্ববন্দিত রবীন্দ্রনাথ, প্রথম দর্শনে যাঁকে ভগবান মনে করে যাঁর পা-জোড়া তুমি ছাড়তেই চাওনি সেই রবীন্দ্রনাথ, আমার পিংলা নামটাও মনে রেখেছেন! কবি একটু অপ্রস্তুত মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, এখনই চলে যাস না, তোর স্যর অতুলবাবুও আসছেন, জলখাবার খেয়ে যাবি।
সেই দিনই শুনলুম ১০ই আগস্ট এখানে শিক্ষার মিলন নামে তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধ কবি পাঠ করবেন। প্রথমে ভেবেছিলুম কবির প্রবন্ধপাঠ – নিশ্চয়ই এখনকার অধ্যাপকরা আর মানীগুণী নানা মানুষই শুধু উপস্থিত থাকবেন সেখানে। অতুলবাবু স্যর আমাকে বললেন, তুই তো মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবি বলছিলি। তাড়াতাড়ি ঘুরে আয়, দশ তারিখে কবির প্রবন্ধপাঠ, শুনবি না?
পিয়ার্সন আর অ্যাণ্ড্রুজ সাহেব থাকেন যে বাড়িতে, যার দোতলায় কলাভবনের ক্লাস হয়, সেই যেখানে গুরুদেবের সঙ্গে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল – মনে আছে তোমার? – সেই ঘরেই বক্তৃতার আসর। সময় দেওয়া আছে সকাল এগারটা, সমস্ত ঘর জুড়ে কয়েকটা জাজিম পেতে বসবার বন্দোবস্ত, ঘরের এক কোণে – যেখান থেকে সমস্ত ঘরটা একসঙ্গে দেখা যায় – একটা ছোট চৌকি পাতা। চৌকির উপর একটা আসন, আসনের সামনে আর একটা ছোট চৌকি। আমি যখন ঢুকলুম ঘরে, একে একে সবাই আসছেন। সামনের দিকে, চৌকির কাছাকাছি, বসবার জায়গা খালি ছিল অনেকটাই। আমি সাহস করলুম না, অনেকটা পিছনে গিয়ে বসলুম। মিনিট দশেকের মধ্যে পুরো ঘর ভর্তি হয়ে গেল, অল্পবয়েসী কয়েকজন ছাত্র এমনকি দাঁড়িয়েও রইল একেবারে পিছনে। যথাসময়ে কবি ঢুকলেন, অনেকেই উঠে দাঁড়াল, কবি চৌকিতে গিয়ে বসলেন, তাঁর হাতে একটা খাতা, সামনের চৌকিতে রাখলেন সেই খাতাটা। তারপর সামনের সারিতে বসে-থাকা কোন একজনকে দেখে কিছু একটা রসিকতা করলেন, অনেকেই হেসেও উঠলেন, আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলুম না।
মিনিট দু-তিন পর পুরো ঘরটায় একবার চোখ-বুলিয়ে হাত জোড় করে নিঃশব্দে নমস্কার করলেন গুরুদেব। তারপর বললেন, একটু দীর্ঘ প্রবন্ধ। আমার হাতের লেখায় প্রায় পঞ্চাশ পৃষ্ঠা। আশা করি আপনাদের ধৈর্য থাকবে। আমি একটানা পড়ে যাব। পড়া হয়ে গেলে কিছুক্ষণ প্রশ্নোত্তরও চলতে পারে। এবার খেয়াল করলুম, সামনের ছোট চৌকিটার পাশে একটা রূপোর গেলাশ, মুখ চাপা দেওয়া। চাপাটা সরিয়ে একটু জল খেলেন গুরুদেব।
তারপর যা হল তোমাকে আমি বোঝাতে পারব কিনা জানিনা। গুরুদেব প্রথম লাইনটা পড়লেন: “এ কথা মানতেই হবে যে, আজকের দিনে পৃথিবীতে পশ্চিমের লোক জয়ী হয়েছে।” সামনাসামনি কথা তো বলেছি কবির সঙ্গে, কিন্তু এমন কণ্ঠস্বর শুনিনি কখনো। এ কি একটা গদ্যের লাইন না সঙ্গীত! কী যে একটা সুর আছে সে কণ্ঠস্বরে, তুমি থাকলে হয়তো বুঝতে পারতে। আর কী স্পষ্ট সে কণ্ঠস্বর পৌঁচচ্ছে বোধ হয় সবার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে যে ছেলেটা তারও কানে। আর আমার? কী যে একটা অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক বদল চলছে আমার শরীরে তা বোধ হয় শুধুই উপলব্ধির, বলবার নয়। একেবারে শারীরিক উপলব্ধি, কাজিদা! কিন্তু এর ফল কী হল? কয়েক মুহূর্ত পর আমি খেয়াল করলুম, কবি অনেকটাই এগিয়ে গেছেন, আমি শুনিনি। নিজেকে শাসন করলুম, এতটা আবেগ ঠিক নয়, শারীরিক এবং মানসিক দুরকমেরই সংযম না থাকলে এই সভায় থাকবার যোগ্যতাই নেই আমার।
ততক্ষণে কবি পড়ছেন, “ড্রাইভারটার মাথায় বাড়ি দিলেই যে এঞ্জিনটা তখনই আমার বশে চলবে, এ কথা মনে করা ভুল।” একটু শুনে বুঝলুম কবি বলছেন এঞ্জিনটা চালাবার বিদ্যে রপ্ত করার প্রয়োজনের কথা।
তারপর থেকে আমি নিজেকে যতটা পারি আবেগমুক্ত করে মন দিয়ে বক্তৃতাটা শুনে বুঝতে চেষ্টা করেছি। এই যে অসহযোগ আন্দোলনের ছুতোয় গান্ধিজী স্কুল-কলেজ থেকে ছেলেদের টেনে আনতে চাইছেন তাঁর নিজস্ব প্রাচ্যচেতনার ধাঁধায়, আর হ্যামলিনের সেই বাঁশিওয়ালার জাদুতে আচ্ছন্ন ইঁদুরছানার মতো ছেলেরাও যে দৌড়োচ্ছে তাঁর পিছু পিছু, তারই সারবত্তাহীনতার কথা বলছেন রবীন্দ্রনাথ। বহু চেষ্টায় বহু ত্যাগে পশ্চিম যে আজ প্রকৃতির ব্যবহারিক সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছে, সুযোগ পেয়েও তার ভাগ না নেওয়াটা, কবি বলছেন, সেটা খুব একটা যে স্রষ্টার অভিপ্রেত তা নয়। তাঁর আর্গুমেন্ট, বিশ্বরাজ্যে বিধাতা আমাদের স্বরাজ দিয়ে বসে আছেন। সেই স্বরাজের অর্থ হচ্ছে এই, প্রথম সুযোগেই বিশ্বের নিয়মকানুন যে পার, যতটা পার, যত আগে পার, শিখে নাও। যে শিখবে না, স্বরাজের, স্বাধীনতার, সুযোগটা সে নিলই না। যে আগে শিখল তারই লাভ। তারপর যদি মনে হয় কোন কোন নিয়ম বদলাতে পারলে ভালো হয়, তাহলে বদলাও। মেনে নিও না। তোমার শিক্ষা তোমাকে এই বদলানোর বুদ্ধি আর সাহস দুটোই দিয়েছে। মানুষ ইঁদুরছানা নয় যে মুখ বুজে সবই মেনে নেবে। বাইরেটায় মানুষকে যথেষ্ট দুর্বল করেই তৈরি করেছেন বিধাতা, কিন্তু বিশ্বপৃথিবীর নিয়মগুলো এত ভালো করে শেখার বুদ্ধি দিয়েছেন তাকে, যাতে করে তার বাইরের দিকের দৌর্বল্য যেটা, সেটা কোন বাধাই নয়। কবি বলছিলেন নখ-দাঁতের কথা। নখ-দাঁতের শক্তিতে মানুষকে কুপোকাত করার মতো প্রাণীর তো কোন অভাব নেই। কিন্তু প্রথম সুযোগেই আগুন-জ্বালা চকমকি পাথর ঘসে ঘসে সে নিজের জন্যে নখদাঁতের এমন বিকল্প তৈরি করল যে নখদাঁতের জোরে যে-প্রাণী প্রবল, সে দাঁড়াতেই পারল না মানুষের সামনে। শুধু চোখের সামনে পড়ে-থাকা চকমকি পাথর নয়, মাটির তলার গভীর থেকে বিশ্বপৃথিবীর নিয়মকানুন-শেখা-মানুষ তুলে এনেছে লৌহ-আকরিক, আর নিজের জ্বালানো আগুন দিয়ে সে আকরিক থেকে তৈরি করে নিয়েছে লোহা, যার সামনে দাঁড়াতে পারে এমন নখদাঁত কোথায়!
তোমাকে তো বলেইছি, গুরুদেবের প্রবন্ধটা দীর্ঘ ছিল, একবার শুনেই সে প্রবন্ধের সব কথা আমার বোঝা হয়ে গেছে এমনটা ভাবার মতো মূর্খ আমি নই। ওপর-ওপর একটু-একটু যা বুঝতে পেরেছিলুম বলে মনে হচ্ছিল তারই কিছু কিছু তোমাকে বলবার চেষ্টা করছি। গুরুদেব শুরুতেই বলেছিলেন তাঁর পড়া হয়ে গেলে প্রশ্নোত্তর চলবে। কিন্তু প্রশ্ন করতে গেলেও তো যতটুকু শুনেছি তার অনেকটাই মনে রাখতে হয়। এমন সময় খেয়াল করলুম, আমার আশপাশে যাঁরা বসে আছেন তাঁরা অনেকেই তাঁদের সঙ্গে খাতা-পেনসিল নিয়ে এসেছেন। তাঁরা শুনছেন এবং মাঝে-মাঝেই তাঁদের খাতায় কিছু কিছু কথা লিখে নিচ্ছেন। আমি বুঝলুম, এঁরাই প্রশ্ন করবেন। গুরুদেব প্রশ্নোত্তরের স্বাধীনতা দিয়েছেন। যে স্বাধীনতা গুরুদেব সেদিনের সভায় উপস্থিত সবাইকেই দিয়েছিলেন আমার ক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতা কোন কাজেই লাগল না। আমি তো তৈরি ছিলুম না, সুযোগ হারালুম।
কিন্তু প্রশ্ন করার সুযোগ যাঁরা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন বললেন, কিছুদিন আগেই বোম্বাই শহরে বিদেশী বস্ত্র পোড়ানোর একটা প্রায়-উৎসব হয়ে গেল, মহাত্মা গান্ধি স্বয়ং সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কাপড়গুলোয় অগ্নিসংযোগ করছিল যারা তাদের উৎসাহ দিয়ে গান্ধিজী বললেন, অপবিত্র কাপড়ে অগ্নিসংযোগ করায় একটি পবিত্র কাজ সম্পন্ন হল। গুরুদেব, আপনি তো মানবেন, বিধাতাপ্রদত্ত বুদ্ধির অভাব মহাত্মা গান্ধির নেই। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য দুরকমের শিক্ষাই তাঁর যথেষ্ট আছে। উভয় শিক্ষায় শিক্ষিত মহাত্মার বক্তৃতাকে আপনি কী বলবেন?
জবাবে গুরুদেব বললেন, মহাত্মার বক্তৃতাকে কিছু বলা আমার কাজ নয়, আমি কিছুই বলব না। যা বলবার তিনিই বলবেন। আমি শুধু বলব, যেমন আমার প্রবন্ধে বলেছি, পবিত্রতা-অপবিত্রতা বস্তু-পৃথিবীর বিষয়ই নয়, এ আধ্যাত্মিকতার বিষয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে বস্ত্র – তা সে বিদেশীই হোক বা স্বদেশী – কীভাবে আধ্যাত্মিক বস্তু হয়ে ওঠে সে বিষয়ে আমার কোন ধারণা নেই। কাজেই আমি বলব একটি বস্ত্রখণ্ড পরিষ্কার বা অপরিষ্কার হতে পারে, তার পক্ষে পবিত্র-অপবিত্র হওয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি না। আমার মতে, অপরিষ্কার বস্ত্র ত্যাজ্য, পরিষ্কার বস্ত্র গ্রহণীয়, অতএব তা পরিধেয়। এখন, পরিষ্কার-অপরিষ্কারের একটা গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা থাকা চাই। তার জন্যে কোন কোন সময় এমনকি বিশেষজ্ঞের মতও প্রয়োজন হতে পারে। যে পোশাক আমি এখন পরে আছি তা হয়তো মোটের ওপর পরিষ্কার, আজকের এই সভায় সেটা পরা চলতে পারে; কিন্তু অপারেশন থিয়েটারে একজন শল্য-চিকিৎসক তা বাতিল করতে পারেন, অপবিত্রতার কারণে নয়, যথেষ্ট স্টেরাইল নয় বলে।
সেদিনকার সভা নিয়ে আর কিছু লিখব না, কারণ যতটুকু আমি লিখতে পারতুম তা লেখা হয়ে গেছে। কবিগুরুর এই প্রবন্ধ তো নিশ্চয়ই ছাপা হবে । তখন তার এক কপি সংগ্রহ করে বারবার পড়লে হয়তো সবটা বুঝব। আমার কিন্তু একটা স্বপ্ন আছে, সেইটে তোমাকে বলি। ছাপা প্রবন্ধটার একটা কপি আমার হাতে, খোলা অবস্থায়। আমার সামনে বসে আছেন গুরুদেব, তাঁরও হাতে একটা কপি। ঠিক গতকালের মতোই গুরুদেব পড়ে চলেছেন তাঁর নিজস্ব ভঙ্গীতে, সামনে বসে তাঁর পড়ার সঙ্গে মিলিয়ে আমিও নিঃশব্দে পড়ে চলেছি আমার কপি থেকে।
ভালো থেক।
তোমার স্নেহের
পিংলা
চিঠিটা পড়া হয়ে গেলে নিঃশব্দে কাজি চিঠিটা দেয় মুজফ্ফরকে, পড়ে দেখ। বাথরূমে চলে যায় সে, একেবারে
চান-টান সেরে ফেরে পনের-কুড়ি মিনিট পর। ফিরে এসে দেখে মুজফ্ফর তখনও পড়ছে চিঠিটা। কাজিকে দেখে হাসে একটু, বলে, তৃতীয় বার পড়ছি।
এতবার কেন?– প্রশ্ন করে কাজি।
ভাবছি কী স্বচ্ছ দেখবার চোখ রবীন্দ্রনাথের, বলে মুজফ্ফর, শুধু অগ্ন্যুৎসবের আড়ালে অপেক্ষমান বোম্বাইয়ের
মিল-মালিকরা অপবিত্র বস্ত্রের দহনযজ্ঞে যে দেওয়ালীর উৎসব দেখছিল, এটুকু মুখে বললেন না। সেটা তাঁর স্বাভাবিক শিষ্টাচার। জান তো, দেওয়ালী পশ্চিম ভারতে লক্ষ্মীর উৎসব? এবার একটু থামে মুজফ্ফর, বলে, আমার নিজের একটা কথা বলব। এবার কাগজ বের করলে পিংলাকে আমরা সঙ্গে নেব।
চেষ্টা করে দেখতে পার। ও আসবে না, বলে কাজি।
এ কথা কেন বলছ?
ও রবীন্দ্রনাথের গ্রাম স্বরাজ-আন্দোলনের পদাতিক। ওই টান ও ছাড়তে পারবে না। একটু সময় নিয়ে কাজি এবার বলে, তোমার আবদুর রেজ্জাক খানের খোঁজ পেলে?
পেলাম। এবং কাল কথাও বলে এলাম। কুত্বুদ্দিন আহ্মদকে জিজ্ঞাসা করার সঙ্গে সঙ্গেই বলে দিলেন। ওই যে হোটেলের বাবুর্চি-খানসামাদের য়্যুনিয়নের কথা দাউদ সাহেব বলছিলেন, সেই য়্যুনিয়নে কুত্বুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে রেজ্জাকও আছে। পার্ক সার্কাসে ভাড়া থাকে, ওদের বাড়ি আসলে ডায়মণ্ড হারবারে। কুত্বুদ্দিন সাহেব ঠিকানা দিয়ে দিলেন, সোজা ওর বাড়ি গিয়ে দেখা করে এলাম। দেখাটা হয়ে খুব ভালো হল। ঠিক যেমন আমরা কয়েকজন উৎসাহী সোশ্যালিস্টদের খুঁজে বেড়াচ্ছি, ও-ও ঠিক তেমনই খুঁজছে। এবার মনে হচ্ছে আমরা সবাই মিলে কাজ শুরু করার মতো একটা ছোটখাট সোশ্যালিস্ট কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারব। ও হ্যাঁ, দাউদ সাহেব দেখা গেল ভুল বলেননি। রেজ্জাকও দেখলাম খিলাফতি সোশ্যালিস্ট!
যে কেন্দ্র গড়বে সেই কেন্দ্রের কাজ কী হবে?
সেটা সবাই মিলে ঠিক করতে হবে, বলে মুজফ্ফর, তবে আমার মনে হয় আপাতত আমাদের প্রধান কাজ হবে একটা আন্তর্জাতিক যোগাযোগ তৈরি করা। রাশিয়ায় তো একটা বিপ্লবই ঘটে গেল, আর কোথায় কোথায় কী কী হচ্ছে? আদর্শটা যেখানে আন্তর্জাতিক, সেখানে সবায়ের একটা কমন ম্যানিফেস্টো, অ্যাকশন প্ল্যান আর নিয়মিত যোগাযোগ থাকার বন্দোবস্ত দরকার, তাই না?
ঠিক আছে, কাজি বলে, কিন্তু আমাদের আগে-থেকে-ভেবে-রাখা আজকের সকালের প্রথম কাজ হচ্ছে কিরণশঙ্কর রায়ের কাছে যাওয়া, তোমার প্রস্তাবিত ন্যাশনাল জর্ণাল্স্ লিমিটেড-এর ডিরেক্টর হতে উনি রাজি হবেন কিনা সেইটা দেখা, খেয়াল আছে তো?
তাই তো সকাল থেকে চান-টান সেরে দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে প্রস্তুত হয়ে তোমারই অপেক্ষায় আছি ভাই।
ও, তাহলে তো দেখছি কালপ্রিট আমিই। ঠিক আছে, দশ মিনিট, বলতে বলতে একটা বাটিতে জল ঢালতে ঢালতে দাড়ি কামাবার প্রস্তুতি নেয় নজরুল।
হাসি হাসি মুখে মুজফ্ফর বলে, খালি পেটে যাবে?
সে প্রশ্ন এখন করে লাভ কী? কলকাতায় কচুরির দোকানের অভাব তো নেই। পূর্ণ পেটেই যাব।
এই ঘরটার একটা দেয়ালে সিমেন্টের তৈরি কয়েকটা তাক আছে, উঠে দাঁড়িয়ে একটা তাক থেকে খবরের কাগজের একটা ঠোঙা নামায় মুজফ্ফর। বলে, আমি চিন্তা করে দেখলাম সকালে যে ধরণের জলখাবারে আমরা অভ্যস্ত, তা প্রায়শই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। অথচ প্রায় একই খরচে অনেক স্বাস্থ্যকর জলখাবার আমরা খেতে পারি। ঠোঙাটা থেকে গুনে গুনে চারখানা ডিম বের করে সে, তাররপর ঠোঙাটা আবার রেখে দেয় পুরোনো জায়গাতেই। বলে, কাল সন্ধ্যেবেলা ফেরবার সময় আমি বৌবাজার থেকে এক ডজন ডিম কিনে এনেছি। চলবে?
চলুক, বলে কাজি।
গরম জলে ওই চারখানা ডিম সেদ্ধ করতে বসিয়ে দেয় মুজফ্ফর।
য়্যোরোপীয়ান অ্যাসাইলাম লেনে কিরণশঙ্কর রায়ের বাড়ি খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। অনেক সোফা-কৌচে সাজানো আরামে গল্প করবার মতো বেশ বড়সড়ো একটা ঘরে বসানো হল ওদের। মিনিট পাঁচেক পর খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত কিরণশঙ্কর নমস্কারের ভঙ্গীতে হাত জোড় করে ঢুকলেন ঘরে। বললেন, আপনারা?
উঠে দাঁড়ায় ওরাও, নমস্কার করে হাত জুড়ে। নাম বলে নিজেদের।
কিরণশঙ্কর বলেন নজরুলকে, আরে, আপনি তো বিখ্যাত লোক। আপনার কবিতা পড়েছি। বাংলা কবিতার
খোল-নলচেই তো বদলে দিয়েছেন আপনি।
শুধু কবিতাই নয়, অনেক কিছুই লেখে ও, বলে মুজফ্ফর। আপনি দৈনিক নবযুগ পড়েছেন?
দৈনিক নবযুগ? মানে, ফজলুল হক সাহেবের কাগজ? মাঝে মধ্যে পড়েছি, কিন্তু এখন তো শুনি বন্ধ হয়ে গেছে।
ঠিকই শুনেছেন, কাগজখানা আমরাই চালাতুম।
হুঁ, বেশ গরম গরম লেখা বেরতো। আপনারাই লিখতেন?– প্রশ্ন করেন কিরণশঙ্কর, তা, বন্ধ হল কেন? হকসাহেবের সঙ্গে বনিবনা হল না আপনাদের?
আমাদের সঙ্গে বনিবনার অভাব ছিল না, বলে নজরুল, মনে হয় গাভ্মেন্টের চাপ নিতে পারলেন না উনি।
গাভ্মেন্টের চাপ না-নিতে পারার লোক ফজলুল হক নয়, বলেন কিরণশঙ্কর, কোন্ চাপটা নেবে কোনটা নেবে না সেই সিদ্ধান্ত নিতে নিতে একটা খবরের কাগজ অবিশ্যি বন্ধ হয়ে যেতেই পারে। একসঙ্গে দু-তিনটে নৌকোয় চাপে তো।
একজন পরিচারক গোছের লোক ঘরে ঢোকে এমন সময়, চিনেমাটির দুখানা প্লেটে বেশ কয়েকটা সন্দেশ, গেলাশে সামান্য অস্বচ্ছ চেহারার পানীয়, তা ছাড়া সুদৃশ্য একটা কাচের জগে জল। নীরবে সামনের নীচু টেবিলটায় সেগুলো নামিয়ে দিয়ে চলে যায় সে। কিরণশঙ্কর বলেন, আমি আশুবাবুর ভক্ত, তাঁর ছাত্রস্থানীয়ও। আজকাল বাড়িতে ভীম নাগ ছাড়া আর কারো খাবার ঢোকাই না। সন্দেশগুলো সবই খেতে হবে আপনাদের। তার আগে, ওই গেলাশ দুটোয় আছে ডাবের জল, খেয়ে নিন, এই ভাদ্রের গরমে বাইরে থেকে ঘামতে ঘামতে এসেছেন, ডাবের জল শুকনো গলা মসৃণ করবে, পাকযন্ত্রে নামতে কড়াপাকের অসুবিধে হবে না। খাওয়া হয়ে যাক, তারপর কথা শুরু করব। আপনারা নিশ্চয়ই কোন বিশেষ কাজে এসেছেন, আমার যথাসাধ্য আমি থাকব আপনাদের সঙ্গে। এখন একটু মিনিট দশেক পরে আসি? ওদের প্রতিক্রিয়া দেখবার জন্যে অপেক্ষা না করেই নিষ্ক্রান্ত হন কিরণশঙ্কর।
ফিউডাল আতিথেয়তা কথাটার অর্থ বুঝলে?– বলে মুজফ্ফর, ফিউডাল আতিথেয়তা পার্সনিফায়েড, দেখলে তো? দেখা মানেই বোঝা।
এবং শেখা। মুজফ্ফরের বাক্যের পাদপূরণ করে কাজি। কোন অস্বস্তি ছাড়া সবগুলো সন্দেশ যাতে গলাধঃকরণ করতে পার, তার জন্যে নিজে থাকলেন না, দশ মিনিট সময় দিয়ে গেলেন; আমি দশ মিনিট পর আসছি, তার মধ্যে আপনারা সময়, সুযোগ এবং ক্ষুধার সদ্ব্যবহার করুন! বলেই হেসে ফেলে নজরুল, যদিও আজ ক্ষুধার ব্যাপারটা একটু কম্প্রোমাইজ্ড্, তোমার কল্যাণে আজ সকালেই দু-দুটো ডিমসেদ্ধ ঈচ। ঠিক আছে, আজকের দিনটা না হয় প্রোটিন দিবস হিসেবেই পালন করা যাক।
ওদের খাওয়া শেষ হবার একটু পরেই আগের পরিচারকটি আবার হাজির হয়, মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে নমস্কার করে ওদের, তারপর প্লেট গেলাশ ইত্যাদি নিয়ে বেরিয়ে যায়। আর তার পরেই আসেন কিরণশঙ্কর।
যে কথা চলছিল তারই রেশ টেনে কিরণশঙ্কর বলেন, হক সাহেব তো কাগজ বন্ধ করেই খালাস, আপনাদের কী প্ল্যান?
আর একটা কাগজ বের করা, বলে মুজফ্ফর।
আর একটা কাগজ, ওই নবযুগের মতোই, ইভ্নিং ডেইলী?– জিজ্ঞেস করেন কিরণশঙ্কর।
আর ইভ্নিং ডেইলী নয়, এবার জবাব দেয় নজরুল, আমরা এবার একটু বড় স্কেল-এ যাবার প্ল্যান করছি। নবযুগের সময় আমাদের নিজেদের সঙ্গতি ছিল না, কিন্তু প্রবল ইচ্ছে ছিল কাগজ বের করবার। শুধুমাত্র আদর্শ ছাড়া আর প্রায় সবকিছুতেই আমরা কম্প্রোমাইজ করতে রাজি ছিলুম তখন। হক সাহেবের নিজের বহু পুরোনো একটা অব্যবহৃত ছাপাখানা ছিল, মুজফ্ফর ভাই অনেক ঘোরাঘুরি অনেক চেষ্টাচরিত্র করে সেটাকে খানিকটা দাঁড় করাল, তাতে একটা ছোটখাট এক পাতার দৈনিকই বড় জোর বের করা চলত, তাতেই আমরা রাজি হয়ে গেলুম তখন।
ভালোই তো হল, বলেন কিরণশঙ্কর, আপনাদের হাতেকলমে অভিজ্ঞতা হয়ে গেল। এখন কী করবেন ভাবছেন?
মুজফ্ফর বলে, একটা নিয়মিত ডেইলী বের করবার ইচ্ছে আছে, ইভ্নিং ডেইলী নয়, সে ব্যাপারেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলাম।
খবরের কাগজের ব্যাপারে তো আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই, কিরণশঙ্কর বলেন, সে ব্যাপারে আমি কী পরামর্শ দেব?
মুজফ্ফর বলল, পরামর্শ আপনি দিতে পারেন অনেক ব্যাপারেই, আমরা কী ভেবেছি সে কথাটা আগে বলি, তখন আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন আপনার সাহায্য এবং উপদেশ কীভাবে আমাদের কাজে লাগতে পারে। আমাদের মাথায় আছে একটা মোটামুটি বড়সড়ো পরিকল্পনা। একটা আধুনিক প্রিন্টিং প্রেস, আন্তর্জাতিক নানা নিউজ এজেন্সীর সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা, যোগ্য কর্মঠ পেশাদারী সাংবাদিক এবং ছাপাই কর্মী। এসব ছাড়াও একটা এফিশিয়েন্ট সারকুলেশন নেটওয়র্ক।
এ তো প্রচুর টাকাপয়সার ব্যাপার। আপনাদের ফিনান্স করবে কে?
এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, বলে মুজফ্ফর। কোন একজন বা কয়েকজন ফিনান্সিয়ারের কথা আমরা ভাবছি না। তাতে অনেক অসুবিধে। যিনি টাকা ঢালবেন কাগজের দৃষ্টিভঙ্গীও তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী বা অন্যান্য ব্যবসায়িক ইন্টারেস্টের সঙ্গে না মিললে তিনি ঢালবেন কেন?
সেটাই। হক সাহেবের মতো কেউ ছোটখাটো একটা প্রজেক্টে টাকা লাগাতেই পারে। যেদিন পছন্দ হল না, বা আমার ব্যক্তিগত কোন অসুবিধে হল, দিলাম কাগজ বন্ধ করে। সে আর আপনাদের আমি কী বলব, আপনাদের নিজেদেরই তো সে অভিজ্ঞতা হয়েছে।
হ্যাঁ, বলতে থাকে মুজফ্ফর, আমরা তাই ভাবছি একটা জয়েন্ট-স্টক কম্পানী ফ্লোট করার কথা। ধরুন, ন্যাশনাল জর্ণাল্স্ লিমিটেড নামে একটা কম্পানী গঠিত হল। শেয়ার ছাড়া হল বাজারে, তার থেকে যে টাকা উঠবে তাই দিয়েই শুরু হবে আমাদের কাজ।
বড় বড় চোখ করে যথেষ্ট উৎসাহের সঙ্গে মুজফ্ফরের প্রস্তাব শুনছিলেন কিরণশঙ্কর। এখন বললেন, সাধু প্রস্তাব।
আইডিয়া এবং আইডিয়াল হিসেবে খুবই প্রশংসার যোগ্য। আপনারা খুবই ভেবেচিন্তে কথা বলছেন, কিন্তু যথেষ্ট শেয়ার বিক্রি যে হবেই তার কী গ্যারান্টি আছে?
গ্যারান্টি নিশ্চয়ই নেই। কিন্তু আপনি এ কথা তো মানবেন যে, যে ধরণের কাগজের কথা আমরা ভাবছি, বাংলা ভাষায় ঠিক সে রকমের কাগজ বাজারে আপাতত নেই। অথচ এমন তো নয় যে বাঙালিরা ভালো কাগজ পড়তে চায় না। এতগুলো কাগজ বাজারে চলছে তো? লোকে আজ এটা পড়ে, কাল ওটা পড়ে। আন্তর্জাতিক মানের একটা প্রগতিশীল কাগজ বেরোলে তার পাঠক জুটবে না? এই কথাটাই আমরা আমাদের প্রসপেক্টাসে লিখব, নানাভাবে প্রচারও করব। আমি যদিও নিজে ব্যবসায়ী নই, আমার ধারণা ভালো ডিরেক্টররা যুক্ত থাকলে শেয়ার বিক্রি হবেই।
ডিরেক্টর হিসেবে কাদের নাম ভেবেছেন আপনারা?
দেখুন, সব ডিরেক্টরের নাম তো এই প্রাথমিক অবস্থায় ভাবাও যাবে না বলাও যাবে না। আমরা আপাতত দুজনের কথাই শুধু ভেবেছি। দুজনেই শ্রদ্ধেয় মানুষ। সাধারণ বাঙালিরা তাঁদের বিশ্বাস করেন, তাঁদের নেতৃত্বে আস্থা রাখেন। এঁদের মধ্যে একজন হিন্দু, অন্যজন মুসলমান। আমাদের বিশ্বাস, এঁদের নামে যদি প্রসপেক্টাস প্রচারিত হয়, কম্পানীর যোগ্যতা ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সততার ব্যাপারে বাঙালি আশ্বস্ত হবে, এবং নিজের নিজের সাধ্য অনুযায়ী এই কম্পানীর সঙ্গে যুক্ত হতে কারো আপত্তি থাকবে না। আইডিয়াল কথাটা আপনিই আমার মুখে জুগিয়ে দিলেন। আমাদের কাগজ হবে একটা আইডিয়াল জয়েন্ট-স্টক কম্পানীর উদ্যোগ।
জয়েন্ট-স্টক এবং জয়েন্ট-স্টেক! – হাসেন কিরণশঙ্কর, মুসলিম যে ভদ্রলোকের কথা ভেবেছেন তাঁর নাম বলতে এই স্টেজে আপত্তি আছে?
মুজফ্ফর বলে, আমাদের সঙ্গে এই উদ্যোগে আছেন আমাদের আর এক বন্ধু, কুত্বুদ্দিন আহ্মদ। ইনি খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এবং মাওলানা আবুল কালাম আজাদের খুব ঘনিষ্ঠ। এঁর বাড়িতেই কলকাতা মাদ্রাসার ছাত্রদের উদ্যোগে চলে খিলাফতিস্ট উইভিং সেন্টার নামে চরকা এবং তাঁতের কল। আগে মিলিটারি অ্যাকাউন্টসে অডিটর হিসেবে কাজ করতেন, চাকরি ছেড়ে প্রথমে মাওলানা আজাদের পত্রিকা আল হিলাল এবং আল হিলাল সরকার বাজেয়াপ্ত করার পর আল বালাগ-এর ম্যানেজার হয়েছিলেন। একজন ডিরেক্টর হিসেবে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের নাম উনি প্রস্তাব করেছিলেন, আমরা রাজি হইনি। আজাদ সাহেবের নাম থাকলেই সরকার নানারকমের বিরোধিতা শুরু করবে। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছে মাওলানা আবুবক্র্কে উনি রাজি করাবেন। আর, আপনি হয়তো বুঝতেই পেরেছেন, হিন্দু ডিরেক্টর হিসেবে আমরা ভেবেছি আপনার কথা। আপনার আপত্তি হবে না নিশ্চয়ই।
মুজফ্ফরের 'আপত্তি হবে না নিশ্চয়ই'-কে এড়িয়ে কিরণশঙ্কর বলেন, একটু আগেই আপনি আপনাদের প্রস্তাবিত সংবাদপত্রের কথা বলতে গিয়ে একটা বিশেষ শব্দ ব্যবহার করলেন, 'প্রগতিশীল'! এই কথাটার এত ধরণের ব্যবহার আজকাল শুনছি যে একটু বিশদে আপনাদের কাছ থেকে বুঝতে ইচ্ছে করছে। আপনাদের পলিটিক্স্ কী?
পলিটিক্স্ তো এক-একজনের এক-এক রকমের হতে পারে। যেমন ধরুন আপনি নিজেই ন্যাশনাল কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ হয়েছেন। তার মানে তো এই নয় যে, সরকারী স্কুল-কলেজ যারা এখনও ছাড়তে রাজি নয় আপনি তাদের বিরোধী। মূল একটা ঐকমত্য থাকলেই সংবাদপত্রে এক সঙ্গে কাজ করা যায়, বলে মুজফ্ফর, সেখানেই আমাদের প্রগতিশীলতা। নানা মতকে একটা প্ল্যাটফর্মে এনে আলোচনায় কোন আপত্তি নেই আমাদের। নিজেদের একটা মত থাকতেই পারে, কিন্তু বিরুদ্ধ মতকেও যথেষ্ট শ্রদ্ধা দেখিয়ে সেই মত কাগজে ছাপতে কোন আপত্তি হবে না আমাদের। তবে হ্যাঁ, কৃষক শ্রমিক অভুক্ত অর্ধভুক্তদের কথা আমরা লিখব, লিখব পূর্ণ স্বাধীনতার কথা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ভয় পাব না। সংবাদপত্র কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের মুখপত্র এ কথা আমরা বিশ্বাস করি না, কিন্তু তাঁবেদারও নয় কারো।
বোঝা গেল, বলেন কিরণশঙ্কর, আপনার কথায় কোন অস্পষ্টতা নেই। কিন্তু আরেকটা প্রশ্ন। এই যে আপনি বলছেন, জয়েন্ট-স্টক কম্পানী তৈরি করবেন, শেয়ার বিক্রি করে ফাণ্ড সংগ্রহ করবেন কাগজের জন্যে, কিন্তু সে সব করবার জন্যেও তো খরচ আছে। আইনী পরামর্শ নিতে হবে, আপনাদের উদ্দেশ্য জানিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে হবে নানা জায়গায়, তা ছাড়া আরও আনুসঙ্গিক খরচ। সেটাও কম টাকা নয়। সে টাকাটা আসবে কোথা থেকে?
কুত্বুদ্দিন আহ্মদ সাহেব গোড়ার দিকের যাবতীয় খরচের দায় নিয়েছেন, না হলে আমরা এগোতে সাহস পেতাম না।
এক কাজ করুন না তাহলে। আমরা আর এক দিন বসি। কুত্বুদ্দিন সাহেবও থাকুন সেদিন। মীটিংটা আমার বাড়িতে হতে পারে, উনি চাইলে ওঁর বাড়িতেও আমরা সবাই বসতে পারি। আর একটু ডিটেল-এ আমরা আলোচনা করে ফাইনাল পজিশনটা ঠিক করব সেদিন, কী বলেন? এইটুকু বলেই কিরণশঙ্কর নজরুলের দিকে তাকান, নজরুল সাহেব দেখছি দিব্যি সুন্দর একটা খদ্দরের গেরুয়া চাপিয়েছেন কাঁধে, ওঁকে মানিয়েওছে সুন্দর, মুজফ্ফর সাহেবের কিন্তু সেই পুরনো অভ্যাস!
অনেকক্ষণ একটাও কথা বলেনি নজরুল, এবার বলল, ভুল বুঝলেন স্যর। চাদরটা আমার এক বন্ধুর উপহার। স্বেচ্ছায় খদ্দর আমি ধরিনি এখনও, সে আমার বাকি পোশাকেই বুঝবেন।
সেটাই তো ভাবছি, বলেন কিরণশঙ্কর, আবার আপনাদের খিলাফতি বন্ধুর নিজের বাড়িতেই শুনলাম খিলাফতিস্ট উইভিং সেন্টার! তবুও, এ কথা মানতেই হয় যে, মোটের ওপর বাঙালিরা কিন্তু মহাত্মাজীর খাদি-চরকা প্রোগ্রামটা নিল না অন্যান্য প্রদেশের মতো।
নজরুল বলে, অন্যান্য প্রদেশেও কি গরীব মানুষরা মিলের কাপড় ছেড়ে খদ্দর ধরেছে?
আমি মানি, বলেন কিরণশঙ্কর, মিলের কাপড়ের তুলনায় খদ্দর ব্যয়সাপেক্ষ। কিন্তু ধনী বাঙালিরা, ধরুন জমিদার জাতীয় যাঁরা, তাঁরাও কি ধরলেন?
গান্ধীজী তো রবীন্দ্রনাথকেও রাজি করাতে পারলেন না, মুজফ্ফর বলে।
দ্যাটস রাইট, য়্যু হ্যাভ হিট দ্য নেইল রাইট অন দ্য হেড। রবীন্দ্রনাথ কনভিন্স্ড্ ন'ন। অতএব শিক্ষিত বাঙালিও নয়। তবে মহাত্মাজী সেটা বুঝেছেন। উনি আসছেন কলকাতায় সামনের মাসে। কবিকে মীট করবেন উনি। হি'জ কামিং প্রিপেয়ার্ড!