আদিবাসী বিকাশ মন্ত্রীর নাম দারুকেশ্বর মাহাতো। তাঁর পাশেই বসেছিলো জয়ি সম্বর্ধনা সভায়। তিনি এক ফাঁকে বললেন, অনিমেষবাবুর কাছে শুনেছি আপনার কথা। আদিবাসী বাচ্চাদের স্কুল করেছেন নাকি? সরকারি সাহায্য পান তো?
না, সরকারি সাহায্য নেই, আর দরকারও হয় না। একেবারে বাচ্চাদের স্কুল তো।
আরে, আজ বাচ্চাদের আছে, কাল বড়ো হবে। কতো বাচ্চাদের? কোন্ ক্লাস অবধি আছে?
ক্লাস-টাস নয়, গোটা চল্লিশেক বাচ্চাকে একসাথে বসিয়ে অ-আ-ক-খ, এ-বি-সি-ডি, এইসব পড়াই। তবে এখন একটা বাড়ি হয়েছে, একটু বড়ো স্কুল শুরু করার ইচ্ছে আছে।
অ-আ-ক-খ, এ-বি-সি-ডি পড়ান? অলচিকি-ফিকি নয় তো?
না না, অলচিকি শেখাবে কে?
এইটুকুই কথা। কয়েকদিন পর অনিমেষ ফোন করে। মন্ত্রী আপনার সাথে কথা বলে খুব খুশি। আপনি যদি চান তাহলে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিতে পারি।
অনিমেষ যে আদিবাসী বিকাশ দপ্তরের বড়ো অফিসার সে কথা জানতো না জয়ি। ওরা যখন বেড়াতে এসেছিলো শুধু শুনেছিলো ও সরকারি অফিসার। বললো, তাহলে দিন না একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে, ভালোই হবে। স্কুলবাড়িটা তৈরি হয়ে পড়ে আছে।
তবে ঠিক যে পড়ে আছে তা নয়। 'কনেক্ট বাংলা' যেদিন জয়িদের প্রোগ্রামটা দেখায় তার পরের দিন থেকে খুশিঝোরার টেলিফোন আর থামতেই চায়না। কোথা থেকে নম্বর জোগাড় করে এই লোকগুলো কে জানে ! আমরা আপনাদের ওখানে আসতে চাই, আমরাও আপনাদের কাজে যথাসাধ্য সাহায্য করতে চাই, গেলে থাকার জায়গা পাবো তো ম্যাডাম? – ইত্যাদি। জয়ি যতোই বোঝাক খুশিঝোরাতে থাকার জায়গার অভাব আছে, জায়গা যদি পাওয়াও যায়, কোন সার্ভিস দেওয়ার ব্যবস্থা নেই, এমনকী টয়লেট পরিষ্কার করার লোকও পাওয়া যাবে না, তবুও মানুষ নিরস্ত হয় না ! কী পরোপকার প্রবৃত্তি এই বাঙালিদের ! আমাদের দুদিন অন্তত থাকবার সুযোগ দিন ম্যাডাম, আমরা আপনার কাজে যেটুকু পারি সাহায্য করতে চাই, আমরা নিজেদের কাজ নিজেরাই করে নেব !
উৎপল বললো, এতো লোককে বারণ করছো কেন জয়িদি? লোকে এলে খুশি হয়ে কতো টাকা দিয়ে যায়, সেগুলো ছাড়ছো কেন?
ছাড়ছি কী আর সখ করে উৎপল ! আছে তো সাকুল্যে মাত্র চারখানা ঘর।
কেন, স্কুলবাড়িটা?
ঠিকই তো, স্কুলবাড়িটা ! বাপনদারা শূটিং শেষ করে চলে যাওয়ার পর থেকে খালিই যখন পড়ে আছে, খানিকটা কাজে তো নিশ্চয়ই লাগানো যায় ওটাকে। যতদিন না বড়ো একটা স্কুল শুরু করা যায় ততদিন তো বটেই। আর তাছাড়া, কোনই তো অসুবিধে নেই ওখানে, অনেকগুলো টয়লেট-বাথরূম আছে, কয়েক ডজন ক্যাম্প-খাট তো ফেলে রেখে গেছে বাপনদারাই।
খুশিঝোরা কিছুদিনেই ভরে ওঠে কলকাতা আর তার আশপাশ থেকে আসা মানুষে; সোমবার থেকে শুক্রবারের মধ্যে যারা আসে তাদের মধ্যে বাচ্চাদের পড়ানোর জন্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা, ছুটির দিনে আসে যারা জয়ি তাদের যথেষ্ট কাজ দিতে পারে না। কাজ করতে চায় তারা, কী কাজ করবে? জয়ি বলে, গাছ লাগান, রাস্তার দুধারে লাগান না। সব-সমস্যার-মুশকিল-আসান জলধর জোগান দেয় নানান গাছের চারা।
আজকাল আর একটা নতুন কাজ হয়েছে জয়ির। সন্ধ্যেবেলা যখন চা-জলখাবার দেওয়া হয় ডাইনিং রূমে, জয়ি এসে বসে সেখানে। জয়ির সাথে কথা বলে ধন্য হয় ভালো-কাজ-পিপাসু মধ্যবিত্ত বাঙালি ! জঙ্গলে আদিবাসীদের সাথে কতদিন কাটিয়েছে জয়ি? সেখানেও কী ছবি-আঁকা শিখিয়েছে আদিবাসীদের? পড়িয়েছে? কতো গাছ পুঁতেছে জয়ি এই শুকনো জমিতে? পাঁচ লাখ? সাত লাখ? কতো? আচ্ছা, এতোদিন তো এইসব শুকনো জমি এখানে পড়েইছিলো, গাছ লাগানোর কথা ভাবেইনি কেউ, আপনি কী করে আদিবাসীদের বোঝালেন গাছের উপকারিতা? এই যে ওদের করম পুজো করলো ওরা এখানে বন বাড়ানোর আকাঙ্ক্ষায়, এই আইডিয়াটা কী ওদের মাথাতেই এসেছিলো? না কী আপনিই দিয়েছিলেন? ম্যাডাম, আপনি তো শিল্পী, কবি তো ন'ন, তবুও এতো ভালো ভালো আইডিয়া আপনার মাথায় আসে কী করে? মানুষের বর্জ্য গাছেদের ভোজ্য – এই অসাধারণ শ্লোগান আপনি কীভাবে ভাবলেন? আচ্ছা জয়িদি, ছবি আঁকা শিখেছেন কোথায়? কী করে শিল্পের জগতে এলেন জয়িদি? আপনার প্রিয় শিল্পী কে? এতো বড়ো আর্টিস্ট আপনি, বোম্বেতে তো আপনার কতো নামডাক, ইচ্ছে করলেই বলিউড থেকে কতো টাকা আয় করতে পারতেন, কতো খ্যাতি হতো পৃথিবী জুড়ে, সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে আদিবাসীদের উন্নয়নে জীবন উৎসর্গ করলেন কেন? কোন্ প্রেরণায়?
জয়ি মনে মনে বোঝে এই ফানুস ফেটে যেতে বেশি সময় লাগবে না, একটা কিছু দেখাবার মতো সত্যিকারের ভালো কাজ করতেই হবে যতো তাড়াতাড়ি পারা যায়। স্কুল বাড়িটা আছে, একটা অবৈতনিক স্কুল শুরু করতেই হবে।
অনিমেষের ব্যবস্থা মতো দারুকেশ্বর মাহাতোর অফিসে দেখা করে জয়ি। নিপাট ভদ্রলোক। যথেষ্ট আপ্যায়ন করেন জয়িকে, খুঁটিয়ে জেনে নেন ইনফ্রাস্ট্রাকচার কেমন আছে ওদের। সব শুনে বলেন, আপনাদের স্কুলের ফার্নিচার, চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চ-ব্ল্যাকবোর্ড ইত্যাদির জন্যে একটা এককালীন গ্রান্টের ব্যবস্থা আমি এখনই করে দিতে পারি, সেটা আমার হাতেই, আদিবাসী বিকাশ মন্ত্রকের বাজেট অ্যালোকেশন আছে। কিন্তু রেকগনিশনের জন্যে স্কুল এডুকেশন মিনিস্ট্রির সাথে কথা বলতে হবে। হয়ে যাবে, অনিমেষবাবুর কাছেও শুনেছি আর সেদিন আপনার সাথে কথা বলেও বুঝেছি আপনি ফেলো ট্র্যাভ্লার, কিন্তু আগে স্কুলটা চালু করুন, তারপর হবে। জঙ্গলমহলে আদিবাসী ছেলেমেয়েদের বাংলা-ইংরিজি পড়াবেন, এর চেয়ে ভালো কাজ কী হতে পারে? চালু করে দিন, আমি সি-এম-এর সাথেও কথা বলবো, পুলিশ আপনার – কী যেন নাম বললেন, খুশিঝোরা সমিতি? – হ্যাঁ, পুরো এস্ট্যাবলিশমেন্টটাকেই প্রোটেকশন দেবে।
মন্ত্রীর ঘর থেকে বেরোতেই একজন বললো, জয়েন্ট সেক্রেটারী আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আসুন আমার সাথে, ভদ্রলোক সঙ্গে করে জয়িকে নিয়ে গেলেন অনিমেষের ঘরে।
কেমন হলো? – হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে অনিমেষ।
জয়ির কাছে সব শুনে বলে, ভালোই তো। আমার মনে হয় একটা ফর্মাল অ্যাপ্লিকেশন করতে হবে আপনার, টাকা-পয়সার ব্যাপার আছে তো, সব ফর্মালিটি মানতে হবে। আমি মন্ত্রীর সি-এর সাথে আর ফিনান্সের সাথে কথা বলে, সব কাগজপত্র বগলদাবা করে সবান্ধব খুশিঝোরা পৌঁছোচ্ছি সামনের শনিবার। আপনার কাছে গত বছরের অডিটেড অ্যাকাউন্টস সব আছে তো? লেটেস্ট ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট? সব কাগজপত্র রেডি করে রাখবেন, সোমবারেই যাতে কাজটা চালু করে দিতে পারি। সরকারি কাজ, বোঝেন তো, যতই বলি তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে, সময় খানিকটা লাগবেই।
জয়ি বলে, কাগজপত্র সব খুশিঝোরাতেই আছে, আর আছে জলধর। কোন অসুবিধে হবে না, যা যা চাই সবই ঠিক মতো দিয়ে দেওয়া যাবে অনিমেষকে।
আর একটা কথা বলি, বলে অনিমেষ। আপনাদের ফাণ্ডের অবস্থা কেমন?
ফাণ্ডের অবস্থা মানে?
সরকারি কাজে কোন অ্যাডভান্স টাকা পাবেন না। খানিকটা কোরে কাজ করবেন, খরচের যাবতীয় ডকুমেন্ট সাবমিট করবেন, টাকা পাবেন। এইভাবে চলতে চলতে কাজ যখন শেষ হবে তখন ফাইনাল পেমেন্ট। মন্ত্রীরা এসব খবর রাখেন না, তাঁরা বলেন বাজেটারি অ্যালোকেশন আছে, অমুক অফিসারকে বলে দেবো, টাকা পেয়ে যাবেন।
জয়ি হাসে। বলে, ফাণ্ড নিয়ে ভাববেন না। আপনি গ্রীন সিগনাল দিলেই কাজ শুরু করে দেবো, আমার তাড়া আছে।
ট্যুরিস্টরাই এখন বাচ্চাদের পড়ানোর কাজটা চালিয়ে দেয়, জলধর যখন আসে তখন খেয়াল রাখে শেখানোটা এলোমেলো না হয়ে ঠিক ঠিক ক্রমে হচ্ছে কিনা। বাচ্চারাও রোজ রোজ নতুন নতুন মাষ্টার মাষ্টারনী পেয়ে খুশি। কাজেই উৎপলের হাতে প্রচুর সময়। একটা কথা ভাবছিলাম জয়িদি, বলে উৎপল, পুকুরটার পাড় ধরে একটু চাষবাস করলে হয় না?
চাষবাস? পুকুরের পাড়ে? – অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে জয়ি।
আমাদের বিনপুরেও একটা ঐরকম শুকনো জায়গা আছে; আমাদের নয়, আমাদের যেখানে বাড়ি সেখান থেকে একটু দূরে, ভূবন টুডুদের জায়গা। ওরা ওদের পুকুরের ধার দিয়ে লাউ লাগিয়েছিলো একবার, কী যে ফলন হয়েছিলো কী বলবো ! এখন তো শুধু লাউ নয়, কুমড়ো-টুমড়ো অনেক রকমের সবজির চাষ করে ওরা পুকুরের পাড় ধরে। ওদের দেখাদেখি এখন অনেকেই করছে। ভাবছিলাম, আমরা করলে কেমন হয় ! তোমাদের কলকাতার লোকদের দেখার মতো আরও একটা জায়গাও হবে !
শুকিও লেগে যায় উৎপলের সাথে মহা উৎসাহে।
উৎপল জানতো পলিথিনের ব্যাগে লাউয়ের বীজ থেকে চারা তৈরি করতে হয়, নিজের হাতে আগে করেনি কখনো। গোয়াল থেকে পচা গোবর নিয়ে এলো শুকি, মাটি আর বালির সাথে সেটা মিশিয়ে তৈরি হলো জমি, বীজ বপন করা হলো তাতে। জলধর বললো ব্যাগের নীচে ফুটো করে দাও দু-তিনটে, ওখান থেকে জল ঝরে যাবে। বীজ থেকে চারা, তারপর সুস্থ সবল চারাগুলোকে মাটিতে পুঁতলো ওরা। পুকুর-পাড়ের মাটি তো শুকিয়েই গিয়েছিলো এতদিনে, সেই মাটিকে একটু ঝুরঝুরে করে নেওয়া হলো, দেখতে দেখতে চারাগুলো বেড়ে উঠলো বেশ খানিকটা। এবার শুকির কাজ, চারাগুলোর গায়ে গায়ে কঞ্চি বেঁধে দেওয়া। চারা আর একটু বড়ো হলে কঞ্চির ওপর মাচা, মাস দুয়েকের মধ্যেই ফল! জয়ি ভাবে এতদিন এটা মাথায় আসেনি কেন! কলকাতা থেকে এখন বেড়াতে আসে যারা পুকুরপাড় থেকে সদ্য তুলে আনা লাউ খেয়ে তারা বড়োই খুশি! ঠিকই বলেছিলো উৎপল, পুকুরপাড়টা এখন কলকাতার মানুষদের নতুন একটা দেখার জায়গা!
এদিকে অতি দ্রুত এগিয়ে চলে স্কুলের চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চি তৈরির কাজ। সুকান্তদা দেখেশুনে বলে একদিন, স্কুলটা করছিস, ভালোই। কিন্তু ভালো একটা রেভেন্যু জেনারেশনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে তো স্কুলটা হলে। এতই যখন হচ্ছে, ঐ হলঘর দুটোর উপরে আরও চার-পাঁচটা ঘর তুলে নে না, একটু বেটার-ফার্নিশ্ড্ ঘর। গেস্ট হাউজের ঘরগুলোর জন্যে এখন পাঁচশো টাকা নিচ্ছিস, এগুলোর থেকে হাজার নিবি !
মন্দ আইডিয়া নয়, কিন্তু আরেকটা কাজ আছে। স্কুলবাড়িটার প্রায় পাশেই এখন গোয়াল ঘরটা। ওটাকে সরাতে হবে, কিন্তু সরাবে কোথায়?
পুকুরের উত্তর দিকটায় খানিকটা খোলা জমি। খাঁ-খাঁ শুকনো, একটু ঘাসও নেই জমিতে, কেউ আসেও না সেদিকে। শুকির সাথে ধরাধরি করে ডিজেল পাম্পটা একদিন পুকুর পাড়ে নিয়ে আসে উৎপল। পরপর তিনদিন জল দিয়ে ভাসিয়ে দেয় জমিটা, তারপর শুকোতে দেয় কয়েকদিন। শুকিয়ে যাওয়ার পর মাটিটা কোপায় দুজনে মিলে, তারপর পচা গোবর আর বালি ঢেলে সেটাকে ছড়িয়ে দিয়ে জল ঢেলে আবার শুকোয়। শুকিয়ে গেলে মাটি কুপিয়ে ঝুরঝুরে করে মাটিটাকে। জয়িকে একদিন ডেকে আনে উৎপল জমিটার কাছে।
এখানে লাউ ফলাবো জয়িদি, বলে উৎপল।
এখানে? কিন্তু এ জমি তো আমাদের নয়, জানো নাকি কার?
কেউই জানেনা কার। এ জমিতে ফলন হতে পারে ভাবে না কেউই। যার জমি সে খবরই রাখে না। আমি তৈরি করেছি জমিটা। বীজ ফেললেই লাউ হবে।
লাউ হলে যার জমি সে তো দখল চাইবে।
সে আগে জানুক, তারপর চাইলে দেখা যাবে। কার জমি সেটা তো জানবো তখন, তারপর দরকার হলে কিনে নেব।
কাজটা কী ঠিক হবে উৎপল?
বেঠিক কেন? এতো জমি পড়ে আছে, কোন্ জমিটা ট্রাইবাল, কোন্টা কার, কেউ খবর রাখে না, সবাই মনে করে পতিত জমি। আমরা যদি ফসল ফলাই এতে, কেউ লক্ষ্যও করবে না। করেও যদি, আমরা কিনে নেবো। তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও, কাউকে বোলো না এখন। প্রথমবার লাউটা তো হোক।
শুকি-লকি দু বোন বেশি কথা বলে না, কাজ করে নীরবে, অষ্টমীর সাথে ফিরে যায় রাতে। ইদানিং লাউ চাষে কাজ করতে গিয়ে শুকি একটু কথাবার্তা বলছে উৎপলের সাথে। এতো লাউ দেখে একদিন মনের কথাটা বলেই ফেললো শুকি। খুশিঝোরায় ঢোকার গেট যেখানটায়, তার ঠিক উল্টো দিকে যে জমিটুকু পড়ে আছে, বিঘে তিন-চার হবে, সেই শুকনো জায়গাটা দেখিয়ে বলে শুকি, এখানে লাউ করলে হবে? কুমড়ো? ধান?
সহজে হবে না, বলে উৎপল, তবে চেষ্টা করলে হবে না কেন? দেখলি তো পুকুরের ওইদিকটায় কেমন শুকনো জমিতে লাউ ফলালাম ! এতো শুকনো জায়গায় জয়িদির লাগানো এতো গাছ তো বেঁচেছে।
সে তো অন্য জমিতে। এখানে হবে? এই জমিটায়?
চেষ্টা করলে ঠিকই হবে।
হঁ, এটুকুই বলে শুকি, তারপর আবার নিজের কাজে লেগে যায়।
রহস্যের গন্ধ পায় উৎপল, কথাটা জানায় জয়িকে।
দুদিন বাদে এলো জলধর, স্কুলে সিমেন্টের ব্ল্যাক-বোর্ড হবে, বান্দোয়ানের স্কুলে করেছিলো যে মিস্ত্রী তাকে নিয়ে এসেছে। মিস্ত্রীর সাথে কাজ শেষ হলে তাকে বলে জয়ি শুকির কথাটা। ঐ বিশেষ জমিটায় ফলন নিয়ে শুকির এত কৌতূহল কেন?
জলধর বিশেষ আমল দেয় না, বলে, সাধারণ প্রশ্ন, এতদিন ধরে উৎপলের সাথে কাজ কোরে লাউ-কুমড়ো ফলালো, কৌতূহল হয়েছে, জিজ্ঞেস করেছে !
হতে পারে, কিন্তু বিশেষ করে ঐ জায়গাটার কথাই বললো কেন?
আমরা যখন গাছের চারা পুঁতলাম, ঐটা ছেড়েই তো শুরু করেছিলাম, সরকারবাবুরা বলেছিলো ওটা ট্রাইবাল ল্যাণ্ড, মনে আছে? অথচ রাস্তার ওপারে যেতে হলে ঐ জায়গাটা দিয়েই আমরা শর্ট কাট করি, তাই হয়তো ওটাই চোখে পড়ে বারবার, তাই ওটার কথাই জিজ্ঞেস করেছে।
ট্রাইবাল ল্যাণ্ড বলেই কথাটা বললাম তোমাকে। এমন তো হতে পারে ওটা ওর কোন চেনাজানা লোকের। সে রাজি হলে আমি কিনে নিতে পারি, আমাদের গোয়ালটা তাহলে কম্পাউণ্ডের বাইরে বের করে নেওয়া যায়।
সে তো ওকে জিজ্ঞেস করলেই হয়, বলে জলধর।
অষ্টমীর সাথেই যাতায়াত করে শুকি-লকি, ওদেরই গ্রামের মেয়ে। অষ্টমীরা তন্তুবায়, কিন্তু একই গ্রামে পাশাপাশি বাস করে সাঁওতালরাও। শুকি-লকিরা সাঁওতাল। অষ্টমীকেই ডেকে বলে জয়ি, ওদের ডেকে নিয়ে একসাথে এসো, কথা বলবো।
প্রথমে জিজ্ঞেস করায় গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দু বোন, কথা বলে না। অষ্টমী একটু একটু করে কথা বলতে শুরু করার পর যোগ দেয় ওরাও। ওদের বাড়ির কথা। ওদের জীবনের কথা। কম বয়েসে বিধবা হয়ে পর পর দু বোনকেই ফিরে আসতে হয়েছিলো বাপের বাড়ি। বাপের বাড়িতে ছিলো শুধু বাপ আর দাদু, মা মারা গিয়েছে কবে ওরা তা মনেও করতে পারেনা। প্রথমে বিধবা হয় লকি, তারপর শুকি। শুকি ফিরতে-না-ফিরতেই বাপও মারা গেলো। দাদুর সাথেই থাকতো দুই বোন, দাদুই কোনমতে আজ এখানে কাল ওখানে যা পারে কাজ কোরে তিনটে পেট চালিয়ে নিতো। দাদুই ওদের বলেছিলো জমিটার কথা। এখানে যখন মারোয়াড়ি বাবু কারখানা করে, সে পুরুলিয়া শহর থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে তার কারখানার ঠিক উল্টোদিকের জমিটুকু কার। খোঁজ কোরে কোরে ওর দাদুর খবর বের করে সে, একদিন ডেকে পাঠায় তাকে। বলে, তোমার জমির কাগজটা দিয়ে দাও আমাকে, আমি তোমাকে চাকরি দেবো আমার কারখানায়। দাদু রাজি হয়নি, টাকা চেয়েছিলো। বলেছিলো, আমি বুড়ো মানুষ, আজ আছি কাল নেই। আমি মরে গেলে আমার নাতনী দুটোর কী হবে? টাকা দেয়নি মারোয়াড়িবাবু। বলেছিলো তোর ঐ টাঁড় জমির দাম আছে কিছু ! থাক পড়ে !
এদিকে গ্রামের দুচার ঘর সাঁওতাল জানে ওদের এই জমিটার কথা। তন্তুবায়রাও জানে অনেকে। সবাই তো লোক ভালো নয়, এতো কম বয়েসে সব আত্মীয়স্বজন মারা গেছে যাদের, সবাইকে খেয়েছে এই বদনাম দিয়ে সেই দুই বোনকে ডাইনি বানিয়ে তাদের জমি কেড়ে নিতে সময় লাগবে না। তাই ঐ জমির কাগজের কথা কাউকে বলতে মানা করে ওদের বুড়ো দাদু মারা গেছে। টাঁড় জমি শুনেছে ওরা ছোট বেলা থেকে, পাশেই এতো লাউ হচ্ছে দেখে কৌতূহল আর চাপতে পারেনি।
জয়ি বলে, কাগজটা কোথায় রেখেছিস?
জবাব দেয় লকি, দাদুর একটা লোহার বাক্স ছিলো, দাদু রাখতো তার মধ্যে, সেখানেই আছে।
তোদের বিপদে যদি ফেলতে চায় কেউ, গোটা বাক্সটা নিয়ে যেতে অসুবিধে কোথায়?
চুপ করে থাকে দু বোন, কথা বলে না।
তোদের এখানে কাজ করতে ভালো লাগে? – জিজ্ঞেস করে জয়ি।
কথা না বলে হাসি হাসি মুখে চুপ করে থাকে বোন দুটো। মাথা নীচু, তাকায় না কারো দিকে।
জয়ি বলে, না, চুপ করে থাকলে হবে না। বলতে হবে তোদের।
জয়িকে ভালোই চেনে অষ্টমী, সে একটা খোঁচা লাগায় লকির পিঠে।
লকি মুখ তুলে জয়ির দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে।
হাসে জয়িও। বলে, তুই, শুকি? ভালো লাগে তোর?
হঁ।
তাহলে শোন্। তোদের ঐ কাগজটা আমার কাছে দিয়ে যাস। আমি যত্ন করে রেখে দেবো। তোরা তো এখানেই কাজ করবি, বিপদে-আপদে আমরাই দেখবো। আমাদের কাছে কাজ করলে দেখিস কেউ তোদের পেছনে লাগবে না। ডাইনি বলার সাহস হবে না কারো। বুঝতে পারলি? মানিস এ কথা?
দুই বোন একসাথে তাকায় জয়ির দিকে। ওদের মুখে ভরসার ছাপ, চোখে জল।
তোদের জমিটায় লাউ ফলাবো, অন্য সবজিও। ঐ সবজির মালিক তোরা। নিয়ে যেতে চাইলে নিয়ে যাবি। আমাদের যদি দিতে চাস আমরা দাম দিয়ে কিনবো। আর একপাশে বানাবো একটা গোশালা। আরও অনেক গোরু-মোষ কিনবো আমরা। এখানকার গোয়ালটা আর রাখবো না। সব গোরু ওখানে থাকবে। ঠিক আছে?
যাওয়ার আগে একটা কথা বলে অষ্টমী। আমার ছেলে বুধন এখন তোমাদের ইশকুলে পড়ছে। বুধবারে হয়েছিলো তাই বুধন নাম, পাড়ার লোকরা সবাই ওকে বুধিয়া বলে ডাকে। ছেলে এখন বড়ো হয়েছে। উৎপলদাদাকে বলে দেবে আমাকে যেন বুধিয়ার মা বলে ডাকে !
দারুণ