মহেশেরই শো !
খানিকটা মন খারাপ কোরেই ফিরলো জয়ি কলকাতায়। চারটে মাত্র ছবি বিক্রী হয়েছে মোট আড়াই হাজার টাকায়, অথচ কত টাকা যে খরচ করলো মহেশ এগজিবিশনটার পিছনে ! কত টাকা কে জানে ! ও বলবেও না কত টাকা খরচ হয়েছে, নেবেও না এক পয়সা ! ওর মতে, মন খারাপ করার মতো কিছুই হয়নি, প্রথম এগজিবিশনে এর বেশি আবার কী হবে ! বোম্বের প্রায় সব কাগজেই খবর বেরিয়েছে, একটা সাপ্তাহিক আর দুটো দৈনিকে ছবি বেরিয়েছে জয়ির, প্রায় সারা দেশেই বিক্রী হয় এমন একটা কাগজে ছাপা হয়েছে এগজিবিশনের তিন-চারটে ছবি, এ ছাড়াও একটা দৈনিকে প্রায় পাঁচ-ছ ইঞ্চির রিভিয়্যু। এ সবের কোন মূল্য নেই নাকি !
কিন্তু এ সবই তো মহেশের জন্যে, সবটাই মহেশের গুডউইল, জয়ি তো উপলক্ষ্য শুধু, মহেশেরই শো !
শুনে হাসলেন ভূদেবদা, মহেশ কী তোমার প্রতিপক্ষ নাকি? শো তো গ্যালারি-ওনারেরই, আর্টিস্ট সব সময়ই উপলক্ষ্য। ভেবে দেখো তোমার কলকাতার এগজিবিশনটায় কী হয়েছিলো। প্রেস কভারেজ পাওনি, তুমিই বলছো দর্শকও পাওনি, ছবি বিক্রীর তো কথাই ওঠে না। নতুন আর্টিস্ট, কেউ সীরিয়সলি নেয়ইনি তোমাকে। অথচ কত ফুট ফল হয়েছে বোম্বেতে।
ফুট ফল হয়েছে, কিন্তু দর্শক তো রিজেক্ট করলো আমাকে ! এতদিন ধরে এত কাজ, এত পয়সা খরচ মহেশের, তারপর বিক্রী মাত্র চারটে ছবি !
ছবি বিক্রীটা অনেক জটিল ব্যাপার জয়মালিকা, শুধুমাত্র এগজিবিশনের ফুট ফল অথবা খবরের কাগজের রিভিয়্যু এর উপর সেটা নির্ভর করে না। যে সব সাধারণ মধ্যবিত্ত উৎসাহী দর্শক এগজিবিশনে ভীড় জমায়, ছবি কেনার পয়সা কোথায় তাদের? এ কী কবিতার বই নাকি, যে কুড়ি টাকা খরচ করলেই হাতে পাওয়া যায় ! তাদের ঘরে ঘরে যদি পৌঁছোতে চাও তাহলে ফোটোকপি বিক্রী করো, ঐ কুড়ি টাকাতেই হয়ে যাবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তোমার অরিজিনালটা বিক্রীর সমস্যা হবে, নিতে চাইবে না কেউ। বাডিং আর্টিস্টের ছবি তো ইনভেস্টররা কিনবে না, স্রেফ ভালো লেগে গেছে বলেই যারা কিনবে তারা হয় পয়সাওয়ালা কলেক্টর – যদিও তারাও বার্গেনের ধান্ধায় থাকে – আর হয়তো কিছু ইণ্ডাস্ট্রি হাউজ। কিন্তু সে সব কী প্রথম এগজিবিশনেই হয় ! আর তোমার ক্ষেত্রে আরও একটা ব্যাপার আছে। তুমি তো শুধুই ড্রয়িং করছো, ঠিক পেইন্টিং নয়। এক্সক্লুসিভলি ড্রয়িং-ই যাঁরা করেন, সাধারণভাবে তাঁদের কাজ একটু দেরিতেই বিক্রী হয়, খানিকটা বয়েস-টয়েস হলে আর কী !
একটু ইতস্তত কোরে আবার কথা বলেন ভূদেবদা, কিছু কিছু পেইন্টিং করছো না কেন, অভ্যেস কোরে দেখোই না !
এটাই ভাবছিলো জয়ি, কতক্ষণে এই কথাটা আসবে। অভ্যেস ! অনুশীলন !
ডিসগাস্টিং !
নতুন খবর পাওয়া গেলো বাড়ি ফিরে একটা। সেই যে কত বছর আগে বাবা চলে গিয়েছিলো জয়ি চাকরি পাবার পর, আর কোন যোগাযোগ রাখেনি। জয়ির ভাবাই ছিলো এটা। বাবা আর আসবে না, বোন্টিও নয়। জয়ির একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাওয়া অবধিই ছিলো বাবার চিন্তা। সেটা যখন হয়ে গেলো, চাকরি পেয়ে গেলো জয়ি, বাবা চিন্তামুক্ত, আর কারোর ব্যাপারে কোন দায় নেই যেন ! সেই বাবা একজনকে পাঠিয়েছে, জয়িকে সঙ্গে কোরে সে নিয়ে যাবে বাবার কাছে। জয়ি এতদিন বাড়িতে ছিলো না, এর মধ্যে দু বার এসে ফিরে গেছে সে। আবার আসবে বলে গেছে, জয়ি যেন অফিসে বলে-টলে রাখে।
রঘুনাথ হেমব্রম এর নাম। বললো, আজই যেতে হবে আমার সাথে, বেশ খানিকটা দূর।
জায়গাটা পুরুলিয়া জেলায়, বিহারের সীমানায়। পৌঁছোতে পৌঁছোতে বিকেল হয়ে গেলো। শেষের দিকটায় গাড়ি ভাড়া নিয়েছিলো ওরা, গাড়ীটা দাঁড়ালো একটা পিচ রাস্তার ওপর পাঁচিল-ঘেরা কম্পাউণ্ডের বাইরে, বড়ো একটা গেটের সামনে। বন্ধ গেটটা খুলে যেতে গাড়িটা ঢুকে গেলো ভেতরে। খানিকটা দূর পর্যন্ত গাড়ি যাওয়ার রাস্তাটা ভেতরে চলে গেছে, তার শেষ মাথায় খুঁটি পুঁতে অ্যাসবেস্টসের চাল লাগানো, মনে হয় গাড়ি রাখার ব্যবস্থা। বোঝা গেলো ভেতরে গাড়ি ঢোকাবার রেওয়াজ আছে। যারা এখানে আসে, গাড়ি নিয়েই আসে। হেমন্ত বসে ছিলো একটা বেতের চেয়ারে, হেসে বললো, আয়।
বেশ সাজানো-গোছানো ভেতরটা। বড়ো হলঘরের মতো দুখানা ঘর, বাবা বললো গুদাম। বাঁ দিকে একটা টানা বারান্দাকে সামনে রেখে চারখানা ঘর, একটাতে হেমন্ত থাকে, পাশের ঘরটা খালি, দুটো ঘরে ছোট ছোট টেবিল-চেয়ার গোটা কয়েক, দেখে মনে হয় অফিস গোছের। একটা রান্নাঘর, তার উল্টোদিকে বাথরূম। বাইরে অনেকটা ফাঁকা জায়গা, বড়ো বড়ো গাছ লাগানো হয়েছে সেখানে। শাল আছে, ছাতিম আছে, আর আছে য়্যুক্যালিপটাস-সোনাঝুরি জাতীয় বেশ কয়েকটা গাছ, সারি দিয়ে লাগানো। এ ছাড়াও একটা কেয়ারি করা বাগান, নানা রকমের ফুল-টুল ফোটানো হয়েছে। খালি ঘরটা দেখিয়ে হেমন্ত বললো, ঐ ঘরটায় আজ রাত্তিরে থাক, তোর সাথে অনেক কথা আছে।
এটা আসলে একটা লাক্ষার কারখানা ছিলো, বললো হেমন্ত। কারখানা মানে এমন কিছু নয়, সোজা জঙ্গল থেকে নিয়ে এসে এখানে জমা করতো লোকজন, তারপর রোদ্দুরে দেওয়া, ধোয়া, শুকোনো টুকোনো, এই সব। এক্সপোর্ট হতো, লাভও হতো ভালোই। কম্পানির মালিক মারোয়াড়ি, সে লোকও ভালো। আমার সাথে যখন আলাপ হলো তখন মনে হলো ও বেঁচে গেছে। পুরুলিয়া শহরে আর কলকাতায় ওদের নানা রকমের ব্যাবসা আছে, এখানকার ব্যাবসায় সময় দিতে পারছিলো না। সে দায়িত্বটা নিলাম আমি। কিন্তু শুধু সেটাই নয়, কারখানা দেখাশোনার জন্যে আমার মতো লোক ও হয়তো আরও পেতে পারতো। ওর সমস্যা ছিলো অন্য জায়গায়। এই যে কম্পাউণ্ডটা, প্রায় বিঘে চল্লিশ জমি, এই জমিটা ওর নিজের নয়। এটা ট্রাইবাল ল্যাণ্ড। আইন অনুযায়ী এই জমিটা ও নিতে পারছিলো না। লোকটা আমাকে খুবই বিশ্বাস করে। ওকে আমি যখন আমার শিডিউল্ড্ ট্রাইব স্টেটাসের কথা বললাম, ও যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেলো। জমিটা ও কিনে নিলো আমার নামে।
লাক্ষার ব্যবসা ভালোই চলছিলো একটা সময় পর্যন্ত, কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে এর চাহিদা কমে গেছে, এখন অনেক সস্তায় কেমিকাল পাওয়া যায়। লাক্ষা বন্ধ করে কয়েক বছর সাবান কারখানা চালানোর চেষ্টা করলো মালিক, সেটাও তেমন জমলো না। এখন ও সমস্ত জায়গাটা বেচে দিতে চায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কিনবে কে, ট্রাইবাল ল্যাণ্ড তো!
এদিকে দেখ্, আমারও বয়েস হয়েছে, মনে হচ্ছে আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না। আমি তাই একটা অন্য কথা ভাবছিলাম। লাখ দুয়েক টাকা আমি জমিয়েছি, ভেবেছিলাম আমি মরলে এই টাকাটা তোকে দিয়ে যাবো। এখন মনে হচ্ছে আরও লাখ পাঁচেক টাকা যদি জোটানো যায়, চল্লিশ বিঘে জমি আর এই সব ঘরবাড়ি, সবই কিনে ফেলা যায়। মালিক বলেছে সাত লাখ টাকা পেলে সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে ও চলে যাবে। তুই কী বলিস, তুই ম্যানেজ করতে পারবি টাকাটা?
জয়ি জানে অত টাকা ওর নেই, কিন্তু কোন কিছুই ঠিক ঠিক মতো চাইলে করা যাবে না তা-ও বিশ্বাস করে না ও। ও জানে উপায় একটা হবেই। বাবাকে বলে, একটু ঘুরে-টুরে দেখি, যদি মনে হয় জমিটা নেব তাহলে ভাবতে হবে টাকাটা জোগাড় করবো কোথা থেকে।
আরও দুদিন থেকে গেলো জয়ি। বাবার সাথে ঘুরে দেখলো সমস্ত জায়গাটা আর আশপাশের অঞ্চল। যেটুকু পাঁচিল-ঘেরা, কম্পাউণ্ডটার সেটাই কিন্তু শেষ নয়। বড়ো গেটটা থেকে গাড়ি যাওয়ার রাস্তাটার শেষে আর একটা ছোট দরজা, সেটা পেরিয়ে গেলে পুরো জায়গাটাই খোলা মাঠ। এত বড়ো জায়গার পুরোটায় পাঁচিল দেওয়া সম্ভব হয়নি, সীমানার ধারে ধারে ছাড়া ছাড়া পাঁচিল আর কিছু লম্বা গাছ লাগিয়ে জমিটার মালিকানা বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে বাবার সাথে আশপাশে ঘুরতে বেরোলো জয়ি। মেন গেট থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই একটা তিরতিরে ছোট নদী গোছের। নদীর মাঝে মাঝে ছোট-বড়ো বোল্ডারে লেগে বয়ে আসা জলে একটু ঘুরপাক, সামান্য ফেনা। এইটুকুতেই নির্জন জায়গাটায় মৃদু শব্দ শোনা যায়, বুঝি বা কোন কিশোরীর অনুচ্চ গুণগুণানি। কী নদী, বাবাকে জিজ্ঞেস করেও জানা যায় না, এখানে জনবসতি নেই কোন, আশপাশে কোন গ্রাম নেই, কাজেই নদীটার অস্তিত্ব প্রায় অজানিতই থেকে যায়, নাম জোটে না কপালে।
নদীটা পেরিয়েই বাঁদিকে চলে গেছে একটা পায়ে-চলা পথ, বাবা বললো এই রাস্তায় মাইলখানেক হাঁটলেই একটা গ্রাম, ডাংলাজোড়া। সাঁওতাল-মুণ্ডা-ওরাওঁ-ভূমিজ ছাড়াও তন্তুবায় জাতের লোকের বসবাস। কাছাকাছি জনপদ এটাই। গ্রামটার দিকে খানিকটা হাঁটতে হাঁটতে ডানদিকে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। তার মাঝে একটা বড়সড় জলাশয়। জলাশয়টাকে বেড় করে কয়েকটা লম্বা তাল গাছ যেন পাহারা দিচ্ছে জলাশয়টাকে। আরও দূরে ডাইনে-বাঁয়ে যতদূর-চোখ-যায় ততটা বিস্তারের একটা পাহাড়। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে, মেঘ কেটে গিয়ে নীল পাহাড়, সবুজ প্রান্তর, টলটলে জলাশয় আর তাল গাছ মিলিয়ে যে দৃশ্য তৈরি হয়েছে মনে হয় তার চেয়ে সুন্দর পৃথিবীতে আর নেই বুঝি কিছু।
বাবাকে বলতে বাবা বললো পেছন ফিরে দেখ্ একবার। পেছনে ফিরতে প্রান্তরের শেষে আবার ঐ রকম নীল পাহাড়ের যাদু। বাবা বললো, যদি বৃষ্টি পড়ে যায় হঠাৎ রাত্তিরে, তাহলে ভোরবেলা আমাদের গুদামের ছাদের চিলেকোঠায় দাঁড়ালে দেখতে পাবি এই জায়গাটার চারদিকই এ রকম পাহাড়ে ঘেরা। আর দিন দশ-পনেরো পর পলাশ আর শিমুল ফুটতে শুরু করবে। তখন এই মাঠের সবুজ, পাহাড়ের নীল, আর শিমুল-পলাশের লাল মিলিয়ে যে অপরূপ দৃশ্য তৈরি হবে তা ছেড়ে আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করবে না।
রাত্তিরে বৃষ্টি হয়নি। ভোরবেলায় ঘুম ভাঙতে বাইরে বেরিয়ে জয়ি দেখে বাবা বসে আছে একটা চেয়ারে, যেন ওরই অপেক্ষায়। ওকে দেখে বললো, হাতমুখ ধুয়ে চানটান করে তৈরি হয়ে নে। রঘুনাথ পরোটা ভাজছে তোর জন্যে। খেয়ে, ওর সাথে বেরো। আমি আজকাল আর মোটর সাইকেল চড়তে পারি না। রঘুনাথ তোকে মোটর সাইকেলে চড়িয়ে মাইল চারেক দূরে একটা জায়গায় নিয়ে যাবে, দুয়ারসিনি। শাল-মহুয়ার জঙ্গল, ছোটবড়ো পাহাড়, আর সাতঘুরুং নামের একটা নদী মিলিয়ে অপরূপ জায়গাটা। ভালো লাগবে। ওখান থেকে ঘুরে আয়।
দুয়ারসিনিতে সেদিন হাট বসেছে। ফেরবার পথে হাটে অনেকক্ষণ সময় কাটালো জয়ি। মেয়েরা সারি সারি বসে আছে হাঁড়িয়া নিয়ে, তাদের সামনে বসেই পানরত মেয়েপুরুষের দল। ভাজাভুজির দোকান অনেক, জামাকাপড়ও বিক্রী হচ্ছে, আর শাকসবজি। গৃহস্থালীর ছোটখাটো উপকরণ, বেলুন-চাকি, বঁটি, নানা মাপের শিশিবোতল, এমনকি গুঁড়ো মশলা পর্যন্ত। এক ধারে বসেছে মোরগ লড়াইয়ের আসর, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো জয়ি। এর মধ্যে রঘুনাথ কিনে এনেছে খানিকটা মুরগীর মাংস আর পাহাড়ি ঝর্ণার ছোট মাছ।
খাওয়ার সময় বাবাকে জিজ্ঞেস করে জয়ি, জায়গাটা তো খুবই সুন্দর, ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু এতটা জমি নিয়ে এখানে কী করবো আমি?
কী করবি, তা তো আমি জানিনা। আমার মনে হলো এতটা জমি যদি কষ্ট কোরেও কিনতে পারিস তুই, আখেরে কাজ দেবে। তোর একটা মস্ত সম্পত্তি হবে। ট্রাইবাল ল্যাণ্ড না হলে অনেকদিন আগেই অনেক বেশি দামে বিক্রী হয়ে যেতো সম্পত্তিটা। তোর এস-টি স্টেটাসে তুই যেমন কিনতে পারবি, বেচতেও তো পারবি ছোট ছোট প্লটে। আজ হোক কাল হোক, এ সব জায়গাতেও জনসংখ্যা বাড়বে, জমির চাহিদাও বাড়বে সেই অনুযায়ী। অনেক রকম ভাবে কাজে লাগানো যাবে তখন।
মোটর সাইকেলে মানবাজার পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিলো রঘুনাথ।
জুঁইদির খুব উৎসাহ জমিটার ব্যাপারে, পুরো চল্লিশ বিঘে একটা প্লটে, বলিস কী জয়ি! একটা ফার্মহাউজ হয়ে যায় তো। অনলাভ ভুবনেশ্বরে থাকে আজকাল, কিন্তু আসে, ছুটি-ছাটায়। জুঁই বললো সামনের রোববারে আসবে ও। অতএব রোববারে রাঁচি থেকে আসার জন্যে খবর পাঠানো হলো শ্যামলিমা আর অরুণিমাকে, টেলিফোনে তুলির সাথেও কথা বললো জয়ি। জমির ব্যপারে দেখা গেলো কারোর উৎসাহই কম নয়। মাসখানেক পর আসবে তুলি, ঠিক হলো সবাই মিলে একবার যাওয়া হবে পুরুলিয়ায়।
যাওয়া হলো। একটা বড়ো গাড়ি ভাড়া কোরে ওরা সবাই মিলে পুরুলিয়ায় পৌঁছোলো। যাওয়ার পথে তুলি বললো নিলীন মিত্র নামে এক ভদ্রলোক জয়ির খোঁজ নিচ্ছিলেন। ভদ্রলোক মেদনীপুরের বিদ্যাসাগর য়্যুনিভার্সিটিতে অ্যানথ্রোপলজি পড়ান। য্যুনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে বোম্বের একটা খবরের কাগজে তিনি জয়ির এগজিবিশনের কথা পড়েছেন। তারপর অনেক খোঁজ করে মহেশের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন তিনি। মহেশকে তিনি অনুরোধ করেছেন জয়ির সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে।
মেদনীপুর যাবি? এই গাড়িটা নিয়ে? এখান থেকে কত দূর আর, তুলি বলে পুরুলিয়ার জমি-টমি দেখা হয়ে যাবার পর।
হেমন্ত বললো, বেশি নয়, মাইল ষাট-সত্তর হবে।
নিলীন মিত্রকে ওদের চেয়ে বয়েসে কিছুটা ছোটই মনে হলো, সে বোধ হয় খানিকটা হকচকিয়েই গেছে এতজন মানুষকে একসাথে দেখে। প্রথম কথা বললো তুলিকা, মহেশের সাথে ওর কথোপকথন মনে করিয়ে দিয়ে। আপনিই জয়মালিকা দেবী? – জিজ্ঞেস করে নিলীন।
আমি নই, ও; জয়িকে দেখিয়ে বলে তুলি।
নিলীনের পি-এচ-ডি-র গবেষণা খাড়িয়া উপজাতিকে নিয়ে। সেই গবেষণাপত্র এখন একটু বাড়িয়ে-টাড়িয়ে, নতুন কিছু তথ্য যোগ কোরে বাংলায় ছাপা হবে। ছাপবে কলকাতার নাম করা এক প্রকাশক। জয়ির প্রদর্শনীর যে ছবি বোম্বের খবরের কাগজটাতে বেরিয়েছিলো সেগুলো দেখে নিলীনের মনে হয়েছে ওর বইটাতে জয়ির কিছু ছবি দিতে পারলে বইটার আকর্ষণ বাড়ানো যেত। জয়ি কী রাজি আছে?
রাজি না থাকার কোন কারণ নেই, কিন্তু জয়ি একটু ভাবতে চায়। সুদেশের সাথে – এমনকি সম্ভব হলে – ভূদেবদার সাথেও, একটু আলোচনা করতে পারলে ভালো হতো।
সেটাই ঠিক হলো। নিলীনও ওর প্রকাশকের সাথে কথা বলে নেবে। তারপর জয়ির সাথে যোগাযোগ কোরে কলকাতায় একদিন বসা যাবে।
ভোরবেলায় বেরিয়েছিলো পুরুলিয়া থেকে, আবার ফিরবে সেখানেই। দুপুরের খাবারটা নিলীনই খাইয়ে দিলো ওদের।
রাতের খাবার খেতে খেতে হেমন্ত জিজ্ঞেস করে, তাহলে কী ঠিক হলো? প্রপার্টিটা কিনছো কী তোমরা?
ঠিক ঠিক কতো দাম পড়ছে কাকু? – জিজ্ঞেস করে অনলাভ, সাত লাখ?
সাত লাখই বলেছে মালিক, তবে কথা বলে মনে হলো কিছু হয়তো কমাতেও পারে। আমার মনে হয় সাত লাখ ধরেই এগোও তোমরা, রেজিস্ট্রেশনেরও খরচ আছে একটা। কিন্তু একটা কথা তোমাদের জেনে রাখা ভালো। সবাই মিলে কেনোও যদি তোমরা, টাইট্ল্ তো সবাই পাবে না; এটা ট্রাইবাল ল্যাণ্ড, জমিটা আপাতত আমার নামে আছে, সবটাই শুধুমাত্র জয়ির নামেই ট্রান্সফার করতে পারবো আমি। আইনত নন-ট্রাইবালরা এ জমি কিনতে পারে না।
সে তো জয়ি বলেইছে আমাদের, বললো জুঁই, সে সব নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। জয়ির নামেই কেনা হবে, কিন্তু এটা আসলে হবে শাম্বর প্রপার্টি।
এবার কথা বলে অরুণিমা, আচ্ছা কাকু, একটা কথা বলি। শাম্ব তো এখনই এখান থেকে বেরোবে না, যতদিন না আমরা কেউ কেউ এখানে এসে পাকাপাকি থাকতে শুরু করি ততদিন শাম্ব যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। আমার মনে হয়না আমরা কেউই এখানে এসে থাকতে পারবো এখন। আপনাদের এই লাক্ষা বা সাবান যা-ই হোক্, সে কারখানাটাও তো বন্ধ হয়ে যাবে জমিটা বিক্রী হয়ে গেলে। জমিটা কী ফাঁকাই থাকবে? কে থাকবে এখানে এখন?
কেন, কাকু থাকবেন, বলে তুলিকা।
হ্যাঁ, কাকু থাকবেন, সমস্বরে বলে ওঠে সবাই।
আমি তো থাকবোই, হেসে বলে হেমন্ত, কিন্তু আমি আর কতদিন ! আমার পর?
সে দেখা যাবে, আবার সমস্বরে জবাব।
বাবার কাছ থেকে দু লাখ টাকা পাবে জয়ি। পরের দিন সকালে ফেরার আগে জয়ির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নম্বর-টম্বর জেনে নেয় হেমন্ত। টাকাটা ওর অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিতে হবে। কথা হয় মাস ছয়েক পর ওরা সবাই মিলে আসবে আবার। কেনাবেচা-রেজিস্ট্রেশন, সব করা হবে তখন।
খুব ভালো লাগছে। আপনার লেখার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি।
খুব ভালো