এই শনিবার সুকান্তদা এলো। সুকান্তদার আসাটা একটু অনিয়মিত হয়ে গেছে আজকাল। প্লান্টের হাসপাতালটা আরও বড়ো হয়েছে, সুকান্তদা এখন হাসপাতালের সুপারিন্টেন্ডেন্ট। প্লান্টের এলাকা ছেড়ে বাইরে যেতে হলে বিশেষ কোরে অনুমতি নিতে হয়। অথচ রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে খুশিঝোরায়। একটা কিছু ব্যবস্থা করা দরকার।
আমাদের সঙ্গে মেডিকাল কলেজে পড়তো সেবাব্রত, বুঝলি জয়ি, সেবাব্রত গুপ্ত, বলে সুকান্তদা। খুব ভালো ছেলে ছিলো। আমরা যখন কলেজ থেকে পাশ কোরে বেরিয়ে কে বিলেত যাবে, কে দিল্লীতে পড়তে যাবে এসব কথা ভাবছি সেবাব্রত তখন চুপচাপ কলকাতার কাছেই একটা গ্রামে চলে গেলো। নিজে যেটুকু প্র্যাকটিস করতো সেটা করতো, কিন্তু ওর একটা অন্য প্ল্যান ছিলো মাথায়। আমরা মেডিকাল কলেজে হাউসম্যান ছিলাম যখন, তখন যে পেশেন্টদের দেখতাম, জিজ্ঞেস করলে জানা যেতো তাদের বেশির ভাগই আসে কলকাতা থেকে খানিকটা দূরের গ্রাম থেকে। এই ধর বাসন্তী, গোসাবা, গঙ্গাসাগর, আরামবাগ বা ঘাটালের ভেতর দিকের কোন গ্রাম, অথবা ঝাড়গ্রাম বা মুরশিদাবাদের প্রত্যন্ত জায়গা থেকে। সকলেই যে খুব সীরিয়স অসুখ নিয়ে আসতো তা নয়, অনেকেই আসতো ওদের গ্রামের কাছাকাছি তেমন ডাক্তার পাওয়া যেত না বলে। কাগজ-কলমে ছোটখাটো সরকারি হেল্থ্ সেন্টার ছিলো, কিন্তু সেখানে হয় ডাক্তার পাওয়া যেত না, আর নয়তো ডাক্তাররা তেমন সুবিধের ছিলো না। সেবাব্রত একটা অদ্ভুত কাজ শুরু করলো। ও ওর প্র্যাক্টিসে অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে গ্রামের ছেলেদের রাখতে শুরু করলো; এই ধর, ক্লাস এইট-নাইন পর্যন্ত পড়েছে এমন সব ছেলে। ওর অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করতে করতে ইনজেকশন দেওয়া, ব্লাড-প্রেশার মাপা, সাধারণ অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা এই সব ছোটখাটো জিনিস ছেলেগুলো মোটামুটি দু-তিন বছরের মধ্যেই শিখে ফেললো। আর একটা জিনিস শিখলো। কোন্ অসুখটা ওদের আয়ত্বের মধ্যে নয় সেটা বোঝা। সেবাব্রত তখন ওদের মোটিভেট করলো গ্রামে ফিরে গিয়ে কম পয়সায় সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করতে, আর নিজের আয়ত্বের মধ্যে নয় বুঝলেই কাছাকাছির মধ্যে যদি কোন কোয়ালিফায়েড ডাক্তার পাওয়া যায় তার কাছে পাঠিয়ে দিতে, আর নিতান্ত না পাওয়া গেলে সেবাব্রতর কাছেই পাঠিয়ে দিতে। ও আরও অনেক কাজ করছে, গরীব মানুষদের জন্যে হাসপাতাল-টাসপাতাল তৈরি করেছে একাধিক, কিন্তু সেটায় আমি আসছি না এখন। আমি শুনেছি, অনেক গ্রামে এবং অনেক সমাজসেবী প্রতিষ্ঠানে ও এইসব ছেলেদের পাঠিয়েছে, এবং ওরা যথেষ্ট মিনিংফুল মেডিকাল হেল্প দিচ্ছে মানুষকে। আমি ভাবছি একবার সেবাব্রতকে বলি। এখানে এখন মাসে একদিনের ডাক্তারে চলবে না। এখানে চাই রোজকার ডাক্তার। ডিফিকাল্ট কেসগুলো আমি মাঝে মাঝে দেখে দিয়ে যাবো। তেমন তেমন হলে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অপারেশন-টেশনও করা যেতে পারে। তুই কী বলিস?
তুমি যখন বলছো তখন আমার আবার কী বলার থাকতে পারে। তুমি কথা বলে দেখো।
এদিকে স্কুলটাও শুরু হয়ে গেলো।
১৫ই নভেম্বর বিরসা মুণ্ডার জন্মদিনে আদিবাসী বিকাশ মন্ত্রী দারুকেশ্বর মাহাতো বিরসা মুণ্ডার ছবিতে মালা পরিয়ে খুশিঝোরা উচ্চ-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উদ্বোধন করলেন, পড়াশোনা শুরু হবে জানুয়ারী থেকে। ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস ফাইভ আপাতত, প্রত্যেক বছর একটি কোরে ক্লাস বাড়িয়ে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ানো হবে এখানে।
একটা একটা কোরে বাচ্চা বাড়তে বাড়তে এখন মোট একষট্টি জন ছাত্রছাত্রী আছে উৎপলের। এদের ভাগ কোরে আটত্রিশ জন যাবে ক্লাস ওয়ানে আর তেইশ জন ক্লাস টূতে। ভাবকান্দি ডাংলাজোড়া আর পাতাপাড়া থেকে যেসব বাচ্চারা একটু দূরের স্কুলে পড়তে যায় তাদের বাপমায়ের সাথে কথা বলে জলধর আর উৎপল আট জন বাচ্চাকে ক্লাস থ্রী, তেরো জনকে ক্লাস ফোর আর সাতজনকে ক্লাস ফাইভে ভর্তি করতে পেরেছে। এদের মধ্যে ক্লাস ফোরের দুজন আর ক্লাস ফাইভের তিনজন দূরের গ্রামে থাকে। এদের এনেছে এদের আত্মীয়রা যারা থাকে কাছাকাছি এই তিনটে গ্রামে। এরা খুশিঝোরাতেই থাকবে। এখানে থাকা খাওয়ার জন্যে কোন টাকাপয়সা লাগবে না শুনেই হতদরিদ্র পরিবারের এই পাঁচটি ছাত্রের খুশিঝোরার স্কুলে ভর্তি হওয়া।
স্কুল শুরু হলো, কিন্তু প্রথম দিন থেকেই সবচেয়ে বড়ো সমস্যা শিক্ষকের। পড়াবে কে? জলধরের নিজের কাজ আছে, তার পক্ষে নিয়ম করে রোজ রোজ আসা সম্ভব নয়। তবুও জয়ির অনুরোধে প্রথম প্রথম আসে সে, ক্লাস ফোর আর ক্লাস ফাইভকে একসাথে বসিয়ে সে পড়ায় বাংলা ইংরিজি অঙ্ক ইতিহাস বিজ্ঞান সবকিছু। জয়ি পড়ায় ক্লাস থ্রীতে, আর উৎপল তার পুরোনো নিয়মে ওয়ান আর টূ-এর পড়ানো চালিয়ে যায়। কিন্তু এভাবে কী চলবে? বেড়াতে যারা আসে তাদের মধ্যে অনেকেই আগ্রহ কোরে পড়াতে যায় যে ক্লাসে তাদের পাঠানো হয় সেখানেই, কিন্তু সেটা তো আর নিয়ম কোরে চলে না ! জয়ি তার সান্ধ্য বৈঠকে বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত মানুষদের অনেককেই বলে, থেকে যান না আমাদের এখানে, বাচ্চাদের পড়াবেন, কিন্তু ফলপ্রসূ হয় না সে অনুরোধ।
জলধর একদিন খবর দিলো এক ভদ্রলোকের, প্রতুল মিশ্র, বাঁকুড়ার ছাতরায় বাড়ি। স্কুল-কলেজের পড়া শেষ কোরে এই ভদ্রলোক প্রায় ঘুরতে ঘুরতেই একদিন হাজির হয়েছিলেন বান্দোয়ানে, সেখানে নাগবাবুদের কাপড়ের দোকানে হিসেব লেখার কাজ পেয়ে থেকে যান সেখানেই। বিয়ে-থা করেননি, রাত্তিরে দোকানেই থাকেন, খাওয়াদাওয়া এখানে ওখানে। পৃথিবীতে তাঁর একটাই টান, তাঁর মা। প্রতি মঙ্গলবার বন্ধ থাকে নাগবাবুদের দোকান, আবার খোলে বুধবার বিকেলে। প্রতুল মিশ্র নিয়ম করে মঙ্গলবার সকালে বাসে করে চলে যান ছাতরা, ফিরে আসেন বুধবার দুপুর নাগাদ। সেই মা মারা গেছেন, শ্রাদ্ধশান্তি মিটে গেছে, প্রতুল বাবুর আর পৃথিবীতে কোন টান নেই। খুশিঝোরায় থাকা-খাওয়া আর সামান্য মাইনে পেলে এখানে থেকে যেতে রাজি তিনি।
যে হল ঘরটায় ছেলেমেয়েদের পড়াতো উৎপল সেটায় এখন থাকে ক্লাস ফোর আর ফাইভের ছেলে পাঁচটি। প্রতুলবাবুরও জায়গা হয়ে গেলো সেখানে। যখন যে ক্লাসে প্রয়োজন সেখানেই পড়ান তিনি। পড়ান প্রাণ ঢেলে। ছেলেমেয়েদের ভালও বাসেন খুব।
মাসে দুবার করে কলকাতায় যাওয়াটা বন্ধ করেনি জয়ি। শিল্পকর্ম সে চালিয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সাথে তার যোগাযোগ আগের মতোই, বইপত্রের ইলাস্ট্রেশনের কাজও সে মাঝে মাঝেই পায়। কিন্তু খুশিঝোরার প্রচারই তার প্রধানতম কাজ এখন। তার বন্ধুরা নানা সেমিনারে আহ্বান করে তাকে, কোন অবস্থাতেই সে অনুপস্থিত হয় না; বন্ধুদের প্রিয় সে, প্রায়ই তার সম্বন্ধে, অথবা তার স্কুলের বিষয়ে, কিংবা খুশিঝোরায় বনসৃজনের প্রচেষ্টার তারিফ কোরে এক-আধ কলম লেখা দেখা যায় নানা কাগজে, আর তার পরেই কয়েকদিন খুশিঝোরার গেস্ট হাউজ ভরে যায় কলকাতার মানুষে। স্কুলে যথেষ্ট শিক্ষক না থাকার সমস্যার কথা সে আলোচনা করে না কলকাতায়, করে কী লাভ ! তার এখন প্রয়োজন একটা স্কুল বাস, এই বাস না পেলে দূর দূর গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েরা আসতে পারবে না স্কুলে। স্কুলটা বড়ো হবে না।
সুদীপ্তদের চার বন্ধুর দল আবার বেড়াতে এসেছে খুশিঝোরায়, ওরা আছে নতুন-তৈরি-হওয়া লাক্সারি গেস্ট হাউজে। স্কুলের একটু বড়ো ছেলেমেয়েদের নাচগান শেখাচ্ছে ওদের বৌরা। কথায় কথায় বাসটার কথা উঠলো। বাস? একটা বাসে কতো খরচ? ধারণা নেই জয়ির, নেই ওদেরও। খোঁজ নেবে, ওদের এক বন্ধুর বাস-ট্রাকের বডি তৈরির কারখানা আছে জামশেদপুরে। ফেরার সময় জামশেদপুর হয়ে যাবে ওরা।
কিন্তু এইট্টি জি সার্টিফিকেট করিয়েছেন আপনারা? – জিজ্ঞেস করে তন্ময়।
এইট্টি জি? – অবাক হয়ে বলে জয়ি, সেটা কী ব্যাপার?
খবর তো রাখতে হবে ম্যাডাম, হেসে বলে তন্ময়, ফিলানথ্রপি করছেন, লোকের কাছ থেকে ডোনেশন নিতে হবে, কেন দেবে কেউ যদি সে নিজেও কিছু সুবিধে না পায়?
আমি আপনার কথা কিছু বুঝলাম না, জয়ির কাঁচুমাচু মুখ।
সুদীপ্ত বলে, ঢের হয়েছে, পাকামি করিসনা। ব্যাপারটা বুঝিয়ে দে, আর তুই কী কী হেল্প করতে পারবি সেটা বলে দে।
জয়ির কাছ থেকে অনেকরকমের খবর সংগ্রহ কোরে, অনেক কাগজের ফোটোকপি সঙ্গে নিয়ে, জামশেদপুর হয়ে, ওরা ফেরে কলকাতায়। জয়িকে বলে আসে এর পর যখন কলকাতায় আসবে, টেলিফোনে যেন জানিয়ে আসে জয়ি ওদের। তন্ময় চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, কলকাতায় ফিরে সে সব কাগজপত্র ঠিক কোরে রাখে, জয়ি এলে সই করিয়ে নিতে হবে।
এবং কলকাতায় সই করতে এসেই জয়ি সুখবরটা পেলো। আঠেরো সীটের একটা মিনি বাস খুশিঝোরা সমিতি পাবে। এই বাসটার খরচ ভাগ করে নেবে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ জন লোক। খরচটা কতো, সেটা ঠিক ঠিক বলা যাচ্ছেনা এখনই, কিন্তু সাধারণত যা হয় তার চেয়ে কম হবে। হলুদ রঙের বাসের বডিতে লেখা থাকবে, খুশিঝোরা আপার প্রাইমারি স্কুল, ডাংলাজোড়া, পুরুলিয়া। বাই কার্টসী: প্রীমিয়ার বডি বিল্ডার্স, জামশেদপুর, অ্যাণ্ড ঝলক লিটারারী ম্যাগাজিন, কলকাতা। বাসটার যা শেষ পর্যন্ত দাম পড়বে, সেই অঙ্কটা খুশিঝোরা পাবে কুড়ি-পঁচিশটা চেকে, প্রতিটি চেক আলাদা আলাদা মানুষ দেবেন। চেকগুলো জমা দিতে হবে খুশিঝোরার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে, এবং পুরো অঙ্কটাই বাসের দাম হিসেবে ঐ অ্যাকাউন্ট থেকেই চেকে মিটিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ যত টাকা এলো বাস কেনার জন্যে, তত টাকাই চলে গেলো। এইট্টি জি-টা হয়ে যাক, তন্ময় জয়িকে বুঝিয়ে দেবে কীভাবে ঐ কুড়ি-পঁচিশ জন দাতার প্রত্যেককে আলাদা আলাদা সার্টিফিকেট দেবে খুশিঝোরা।
বাসটা আসার পর খুশিঝোরার মানুষ যারা তারা খুশি তো নিশ্চয়ই, খানিকটা অবাকও। এখানকার স্কুলের জন্যে বাস ! এইসব আদিবাসী ছেলেমেয়েরা বাসে চড়ে স্কুলে আসবে !
আর শুধু বাস নয়, ডাক্তারও এসে গেলো এর মধ্যে। মাসে একদিন নয়, এই ডাক্তার এখানেই থাকবে।
ডাক্তারবাবুর বয়েস বেশি নয়, বছর তিরিশেক হবে। বাড়ি লালগড়ের কাছাকাছি, জঙ্গলমহলের মধ্যেই। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, এখানকার ভাষাতেই কথা বলেন তিনি। ওঁর পেশেন্টরা সহজেই ওঁর সব কথা বুঝতে পারে। আর রোগীদের আর্থিক এবং পারিবারিক অবস্থা বুঝে ওঁর পথ্যের নিদান তো একেবারে অব্যর্থ ! হলঘরটায় প্রতুল বাবুর চৌকির পাশে ডাক্তারবাবুরও চৌকি পড়লো একটা।
জলধর বলে একদিন, সবই তো হচ্ছে জয়িদি, কিন্তু টীচারের কী হবে ! স্কুলে এখন এতোগুলো বাচ্চার জন্যে রান্না করতে হয় রোজ, তাছাড়া গেস্ট হাউজের ঘরগুলোও তো প্রায়ই ভর্তি থাকে আজকাল। বান্দোয়ান থেকে নিমাই নামের একজনকে নিয়ে এসেছে জলধর, সে রঘুনাথকে সাহায্য করে। তাছাড়াও লকি-শুকি। এমনকী প্রতুলবাবুও এগিয়ে আসেন সাহায্য করতে, কাজেই অসুবিধে হয় না। পুকুরপাড়ে লাউ কেন, এখন কুমড়ো আর বেগুনও হচ্ছে, গাছপালা যা লাগানো হয়েছিলো সবই বাড়ছে তরতর কোরে ! গেটের উল্টো দিকে লকিশুকিদের জমিতে তৈরি গোয়ালে এখন আরও কয়েকটা গোরু, এমনকী মোষও দুটো! সবই হচ্ছে জয়িদি, স্কুলের টীচারের কী হবে?
জয়ি হেসে বলে হয়ে যাবে। বলে, আমার এক বন্ধু একবার আমাকে বলেছিলো, আমার যখন কোন কিছুর প্রয়োজন হয়, আশ্চর্য কোন যাদুতে ঠিক সময়ে সেই কাজটা কোরে দেবার ঠিক লোকটা জুটে যায়। ভেবে দেখো না, তুমিই ঠিক সময়ের ঠিক লোকটা হয়ে কতো বার কতো সমস্যার সমাধান করে দিয়েছো ! তুমি না থাকলে খুশিঝোরা টিকতে পারতো ! এতো বড়ো হতে পারতো খুশিঝোরা ! সামনের সপ্তাহ থেকে তুমি আর আমি গ্রামে গ্রামে ঐ বাসটা নিয়ে যাবো, আর গ্রামের মানুষকে বোঝাবো তারা যেন তাদের ছেলেমেয়েদের আমাদের স্কুলে পাঠিয়ে দেয়। এখনো এখানকার ভাষাটা ঠিক রপ্ত করতে পারিনি আমি, তুমি যাবে তো আমার সাথে?
যে ছেলেটি বাস চালায়, বিশু, সে এই অঞ্চলেরই ছেলে, রাস্তাঘাট চেনে ভালোই। পাহাড়ি রাস্তার পাকদণ্ডী ধরে শাল শিমুল মহুয়া কেন্দু অশোক পলাশের আকর্ষণ ছাড়িয়ে এক-একটি গরীবেরও গরীব আদিবাসী গ্রামের দশ-বারোটা মাটির বাড়ির হাড়-জিরজিরে মেয়েপুরুষ বাসিন্দাদের মধ্যে পৌঁছিয়ে যায় তার বাস। অবিশ্বাসী চোখমুখ নিয়ে ছেলেমেয়েদের ইশকুলে পাঠাবার প্রস্তাব শোনে এই মানুষরা। কোন গ্রামে এক বয়স্ক মানুষ জানায় তাদের গ্রামে পুলিশ আসে মাঝে মাঝেই, এ গ্রাম মাওবাদী বলে লেখা আছে পুলিশের খাতায়। নেবে আমাদের ছেলে মেয়েদের? নানারকমের আশঙ্কা হতাশা অবিশ্বাসের কথা শুনতে শুনতেও বোঝাতে পারে ওরা কোন কোন বাপ-মাকে, বেশির ভাগকেই পারে না। তবুও, ধীরে ধীরে আশ্বাস পাওয়া যায়, একটা একটা করে ছেলে বা মেয়ে ভর্তি হয় স্কুলে। ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শিখে বড়ো হবে আশা করে কোন বাপ, স্কুলেই যদি থাকার জায়গা পায় অন্তত দুবেলা পেট ভরে খেতে তো পাবে, আশা করে কোন মা ! দিনের পর দিন জঙ্গলমহলের গ্রামে গ্রামে ঘোরে জলধর আর জয়ি, গোটা তিরিশ ছেলেমেয়ে ভর্তি হয় আরও।
জয়ি আর জলধর ফিরেছে একদিন তাদের ছাত্র ভর্তি অভিযান সেরে, বাসটা গাড়ি পার্ক করার অ্যাসবেস্টাসের চালের নীচে ঠিকঠাক রাখা হয়েছে সদ্য, নিজের মোটর সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে গেছে জলধর এইমাত্র, এমন সময় একটা হর্ণের আওয়াজ পাওয়া যায় গেটের ঠিক বাইরেটাতেই। জয়ি নিজেই খোলে গেটটা, বাইরে দাঁড়িয়ে একটা জীপ। পুলিশের। ড্রাইভারের পাশেই বসে অনেকগুলো তকমা লাগানো বয়েসে তরুণ যে অফিসার, জয়িকে দেখে নেমে পড়ে সে। আপনিই কী মিস সেন? মিস জয়মালিকা সেন? – প্রশ্ন করে সে।
হ্যাঁ, আমিই জয়মালিকা।
আমি ব্রতীন সমাদ্দার। এই সাব-ডিভিশনের, অর্থাৎ সদর-ঈস্ট সাব-ডিভিশনের এস-ডি-পি-ও, মানে সাব-ডিভিশনাল পুলিস অফিসার, ভেতরে আসতে পারি?
আসুন না।
সাহেবের নিঃশব্দ ইঙ্গিতে গাড়ি থেকে নেমে এসে গেটটা খুলে গাড়িসমেত ভেতরে ঢুকে যায় ড্রাইভার, পেছন পেছন হেঁটে ঢোকে জয়ি আর পুলিশসাহেব। বাগান দেখতে দেখতে কম্পাউণ্ডটা ঘুরতে ঘুরতে সাহেব খোঁজ নেয় স্কুল কেমন চলছে, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কতো, কতো লোক থাকে খুশিঝোরায়। সে মাত্র মাসখানেক আগে এখানে এসেছে, এরই মধ্যে জয়মালিকা সেন আর তাঁর খুশিঝোরার কথা শুনেছে, শুনেছে জয়মালিকা সেন বড়ো শিল্পীও। আরও শুনেছে কলকাতা থেকে বহু মানুষ আসেন এখানে বেড়াতে, তাঁদের মধ্যে অনেকেই নাম-করা ইনটেলেকচুয়াল, এখানকার ডাইনিং টেবিলের সান্ধ্য আড্ডার আকর্ষণ নাকি অপ্রতিরোধ্য !
আরে, অনেক কিছুই তো শুনে ফেলেছেন আপনি। মাঝে মাঝে চলে আসুন না, আপনাকেও তো কম ইনটেলেকচুয়াল মনে হচ্ছে না।
পুলিশের চাকরি করি ম্যাডাম, আমাদের আর আড্ডার সময় কোথায়?
এসেছেন যখন, চলুন, একটু চা খাই বসে।
ডাইনিং রূমের পাশেই ডাক্তারবাবু প্রতুল বাবু আর পাঁচজন ছাত্রের থাকবার ঘরটা ব্রতীনের চোখে পড়ে যায়। এখানে কারা থাকে? – জিজ্ঞেস করে সে।
এটাই আমাদের হোস্টেল, পাঁচটি ছাত্র থাকে এখানে, সঙ্গে ওদের মাষ্টারমশাই প্রতুল বাবু। ডাক্তারবাবুও থাকেন একই ঘরে একপাশে।
বাঃ, এ তো তপোবনে গুরুগৃহে থেকে পড়ার মতো !
তপোবনের খবর রাখি না, এরা খুবই গরীব বাড়ি থেকে এসেছে। বাড়িতে থাকলে হয়তো খাওয়াও জুটতো না দুবেলা, তাই আমাদের কাছে থাকে, আমরা যা খাই শেয়ার করে, আর মাষ্টারমশায়ের সাথে একই ঘরে থাকার সুবাদে স্কুলের পরেও লেখাপড়া দেখিয়ে নিতে পারে একটু।
এরা থাকে কোথায়? কোথায় বাড়ি এদের?
কথা বলতে বলতে চা এসে যায়। ছোট একটা চুমুক দিয়ে বলে জয়ি, আমাদের স্কুলের এখনকার ছাত্রছাত্রীরা আসে তিনটে গ্রাম থেকে, তিনটেই কাছাকাছি গ্রাম, ভাবকান্দি ডাংলাজোড়া আর পাতাপাড়া। এই পাঁচজন এইসব গ্রামের নয়, এরা একটু দূরের গ্রামের।
দূরের গ্রামের? কোথায়?
সেটা বলতে গেলে একটু ডিটেল্স্ দেখতে হবে, গ্রামের নাম আমার মনে নেই।
না না, সে দরকার নেই। আসলে আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম অন্য একটা কারণে। কয়েকদিন ধরে নাকি আপনাদের স্কুলের বাসটাকে ভেতর দিকে যেগুলো মাওইস্ট ভিলেজ বলে মার্কড, সেই অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে। হয়তো সেটা একটু রিস্কি ব্যাপার হতে পারে আপনাদের পক্ষে। মনে হলো আপনাকে একটু সাবধান করে দেওয়াই ভালো। আর তাছাড়া আপনাদের ছাত্রছাত্রীরা তো আসেও না ঐ সব জায়গা থেকে।
থ্যাঙ্ক য়্যু, বলে জয়ি, সাবধান করে দিয়ে ভালোই করলেন, আমরা বাইরের লোক তো ! আপনাকে বলি কেন আমাদের বাসটাকে দেখা যাচ্ছে দূরের গ্রামগুলোতে। আমরা ঐ সব গ্রামের বাচ্চাদের আমাদের স্কুলে ভর্তি করতে চাই। তাই ঘোরাঘুরি করে গ্রামের লোকদের কনভিন্স করার চেষ্টা করছি। খুশিঝোরার যেগুলো ডিক্লেয়ার্ড্ প্রোগাম তার মধ্যে এটা একটা, এখানকার বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখানো। পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমাদের কিছু অর্থসাহায্যও করেছে এই জন্যে। এতে কিসের রিস্ক?
বললাম না ঐ গ্রামগুলোর মধ্যে বেশ কিছু আছে যেগুলো মাওইস্ট গ্রাম?
মাওইস্ট গ্রাম তো আমাদের কী? আমরা তো ওদের ছেলেমেয়েদের পড়াবো। যারা খুব গরীব তাদের ছেলেমেয়েদের এখানে থাকারও ব্যবস্থা করে দেবো। আমাদের কী ভয় মাওইস্টদের থেকে?
আপনার সঙ্গে বাসে যে লোকটি যাচ্ছে তার ব্যাপারে পুলিশ খুব নিশ্চিত নয়।
নিশ্চিত নয় মানে? ও তো জলধর মুর্মু, আমাদের এগজিকিউটিভ কমিটির মেম্বার।
সেটা জানি, কিন্তু পুলিশ ঠিক ঠিক জানে না ওর মাওইস্টদের সাথে যোগাযোগ আছে কিনা। আপনি জানেন ও ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার একজন সক্রিয় সদস্য? অ্যাক্টিভিস্ট?
সক্রিয় সদস্য কিনা আমার জানা নেই, কিন্তু ও তো নিজেও সাঁওতাল, বান্দোয়ানে ওর প্রেস আছে।
এগুলো একটাও আমার কাছে নতুন খবর নয় ম্যাডাম, কিন্তু ওর সম্বন্ধে রিপোর্ট আছে আদিবাসীদের সেসেশনিস্ট যে গ্রুপটা, যে গ্রুপটা পশ্চিম বাংলা এবং বিভিন্ন রাজ্যকে ভেঙে আদিবাসীদের আলাদা স্টেট চায় ও তাদেরই লোক। অনেকেরই সন্দেহ ওর মাওইস্টদের সাথেও যোগাযোগ থাকতে পারে। আপনার ইন্টেনশন আমরা জানি, আপনার কাজকর্মে অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পুরো সাপোর্ট আছে। তাই আপনাকে সাবধান করে দেওয়া উচিত মনে হলো। কোন গণ্ডগোল দেখলেই লোকাল থানাকে জানিয়ে রাখবেন।
লোকাল থানাকে জানাবো কেন? আমার তো মনে হলো আপনি নিজেও আমাদের কাজের সিমপ্যাথাইজার একজন। আপনি যোগাযোগ রাখবেন না আমাদের সাথে? তেমন তেমন অসুবিধেয় পড়লে আপনাকেই জানাবো, লোকাল থানার সাথে আমাদের কী?
হেসে ফেলে ব্রতীন, হ্যাঁ, আমি তো আছিই। কিন্তু লোকাল থানা ইজ ইম্পর্ট্যান্ট।
ভালো লাগছে, নিয়মিত পড়ছি ।
ভালো লাগছে, নিয়মিত পড়ছি ।
খুব ভালো
খুব ভালো লাগছে পড়তে। নিয়মিত পড়ছি
পরের পর্যায়ের অপেক্ষায় থাকি