প্রথমবারেই যখন জয়মালিকা সেন খুশিঝোরায় থেকে যাওয়া আর ছেলেমেয়েদের পড়ানোর দায়িত্ব নেবার জন্যে অনুরোধ করলেন তিনি কী জানতেন কতোটা ব্যগ্র সোমেশ্বর নিজেই ছিলো ! এ তো সোমেশ্বরের নিজেরই সারা জীবনের স্বপ্ন ! সেই যে কলেজে পড়বার সময় কিছু দিনের জন্যে দুবরাজপুর গিয়েছিলো গণ-আন্দোলনের সাংগঠনিক প্রস্তুতি বোঝবার জন্যে, তখন থেকে এই একটা ইচ্ছেই মনে মনে লালন করে এসেছে সে সারাজীবন, কিছুই-না-পাওয়া কিন্তু তবুও-বেঁচে-থাকা মানুষের সঙ্গে শিক্ষার আদান-প্রদান। নিজেকে শিক্ষিত কোরে তোলা আর নিরন্ন এই মানুষদের আর তাদের সন্তানদের সম্পূর্ণ শিক্ষায় গড়ে তোলা। নানা কারণে যা হয়ে ওঠেনি এতোদিন, আজ যদি আর একবার সুযোগ পায় চেষ্টা কোরে দেখবে সে।
তবুও প্রথমেই হ্যাঁ বলেনি সোমেশ্বর। সম্ভৃতা কী চায় বোঝা দরকার, সে কী রাজি হবে? জীবনে কষ্ট তো কম করেনি সম্ভৃতা। সেই অতটুকু বয়েসে যখন সোমেশ্বরের সাথে সংসার শুরু করেছিলো নন্দী স্ট্রীটের এক কামরার ফ্ল্যাটে, কীই বা জানতো সংসারের ! তারপর এ শহর ও শহর ছোটবড়ো নানান রকমের আস্তানা আর বিচিত্র অভিজ্ঞতা পেরিয়ে, অভিজাত কর্পোরেট আবাসন এয়ারকণ্ডিশন্ড্ গাড়ি আর আনুসঙ্গিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে আসা জীবন ছেড়ে, এক কথায় আবার কলকাতায় ফিরে প্রায় শূন্য থেকে শুরু ! চাকরি করবে না আর সোমেশ্বর ! পলায়নরত মূলধনের ক্ষয়িষ্ণু কলকাতা শহরেই সে পেশার শেষ পনের-ষোল বছর বিপণন পরামর্শদাতার কাজ করলো ! নন্দী স্ট্রীটের মতো জীবন নয় আর ঠিকই, পেশার জগতে তার অনেকটাই পরিচিতি তৈরি হয়েছিলো ততদিনে, নতুন পেশায় নিশ্চয়ই ধীরে ধীরে খানিকটা প্রতিষ্ঠাও গড়ে নিয়েছিলো সোমেশ্বর, কিন্তু কী ধৈর্যের প্রয়োজন হয়েছে সম্ভৃতার তা কী সে নিজে ছাড়া আর কেউ জানে ! আজ সোমেশ্বর অবসর নেওয়ার পর সেই জীবনে নতুন করে অভ্যস্ত হতে-না-হতেই আবার কলকাতা ছেড়ে পুরুলিয়ার গ্রাম ! অবৈতনিক শিক্ষকতা ! মেনে নেবে সম্ভৃতা?
সম্ভৃতাকে বলতে সে বললো, যেদিন প্রথম খুশিঝোরায় পৌঁছোই, সেদিন রাত্তিরবেলা ওখানকার ছেলেমেয়েদের গানটান শোনার পর একটা কথা আমি বলেছিলাম তোমাকে, খেয়াল আছে?
কী বল তো।
আমার মনে হয়েছিলো ঠিক ঠিক শেখাতে পারলে অসাধ্যসাধন করবে এই বাচ্চাগুলো, আর সে কথাই বলেছিলাম তোমাকে, মনে নেই তোমার?
হ্যাঁ, মনে পড়ছে এখন।
ঐ অসাধ্যসাধন করাবার খানিকটা দায়িত্ব নিতে চাই আমিও, আমিও পড়াবো ওদের। কিন্তু তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, সিদ্ধান্তটা ভেবেচিন্তে নিচ্ছো তো? পরে আফশোস করবে না?
আফশোসের কথা বলছো কেন?
ঐ ধরণ্যৈ নমঃ দিনের মধ্যে কয়েকবার শোনা তোমার পোষাবে তো? তোমার তো যে কোন নমোতেই অ্যালার্জি। মনে আছে, কী বলে এসেছো বরাবর? জন্মের সময় তোমার ঘাড়ে কব্জাটা লাগাতে ভুলে গিয়েছিলেন ভগবান, ঘাড় নোয়াতেই পার না !
সেটা ঠিকই, কিন্তু দেখলে ভদ্রমহিলার ক্যারেক্টার? ঐ ময়লা পরিষ্কার করার ঘটনাটা...
খুশিঝোরায় আরও কয়েকবার যায় ওরা, আলাপ হয় অনেকের সাথে। বিকাশ বসু বিখ্যাত নাট্য পরিচালক, তিনি জয়মালিকা সেনের প্রায় ফ্যান একজন। 'কনেক্ট বাংলা' নামে যে টেলিভিশন চ্যানেল আছে সেখানে এক কুইজ অনুষ্ঠানে কয়েকবছর আগে জয়মালিকার সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনিও। জয়মালিকার অসাধারণ শিল্প প্রতিভার কথা তিনি বহুদিন আগে এক চিত্রকর বন্ধুর কাছে শুনেছিলেন। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও নাকি জয়মালিকার প্রতিভার কথা বলেছিলেন এই চিত্রকরের কাছে। বিখ্যাত শিল্পী হয়ে ওঠার সেই প্রায়-নিশ্চিত সম্ভাবনা অবলীলায় দূরে সরিয়ে রেখে আদিবাসীদের জন্যে এইভাবে জীবনের সর্বস্ব দিয়ে দেওয়া ! সোমেশ্বর-সম্ভৃতার সাথে প্রথম যেবার আলাপ হলো, বিকাশ বসু তখন মাসে দুবার করে আসছিলেন খুশিঝোরায় ছেলেমেয়েদের নাটক শেখাবার জন্যে। আদিবাসী উন্নয়নে নিয়োজিত-প্রাণ জয়মালিকার স্বার্থত্যাগের কথা বারবার বলেও শেষ করতে পারেন না বিকাশ। এ ছাড়াও কিরণ দত্ত। তিনি তো নিজেও কতো বড়ো চিত্রকর ! স্কুলের দেয়ালে তিনি ছেলেমেয়েদের নিয়ে ছবি আঁকার ওয়র্কশপ করেছেন। এই ওয়র্কশপ অবিশ্যি সোমেশ্বররা দেখতে পায়নি, ওরা যেদিন পৌঁছোলো তার আগের দিনই ওয়র্কশপ শেষ হয়েছে, কিন্তু ছবিগুলো তো দেখা গেলো, ওগুলো তো স্কুলের সম্পদ হয়ে আর ছাত্রছাত্রীদের চিত্রশিক্ষা এবং প্রতিভার সাক্ষী হয়ে স্কুলের দেয়ালে থেকেই যাবে !
এইসব মানুষ, যাঁদের ইনটেলেকচুয়াল নামে অভিহিত করাই রেওয়াজ, তাঁরা এলে খুশিঝোরায় বেশ জমাটি সান্ধ্য আড্ডা হয়, এঁরা অনেকেই নানা ব্যাপারে পারদর্শী, গান আবৃত্তি বা এমনকি নিছক আড্ডা জমিয়ে রাখাতেও অনেকে। সন্ধ্যেটা ভালো কাটে।
আর খুশিঝোরার আবাসিকরা? বিশেষ করে মাষ্টারমশাই মুজফ্ফর সাহেব আর প্রতুল বাবু? নিজের জেলা মুরশিদাবাদে বিড়ি শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের জন্যে স্কুল খুলেছিলেন মুজফ্ফর সাহেব। চালাতে পারেননি। ওঁদের গ্রাম থেকে কিছুটা দূরের শহরে কলেজ ছিলো একটা। বাবার সংস্থান ছিলো, ছেলেকে কলেজে পড়িয়েছিলেন। বি-কম পাশ করেছিলেন ঠিক সময়ে, কিন্তু নিজেই বলেন শেখেননি কিছুই। পাশ করার পর চাকরি বা ব্যবসা করতে ইচ্ছে করেনি, প্রয়োজনও ছিলো না। নিজের বাড়িতেই খুলেছিলেন ছোটদের স্কুল, চললো না। বিড়ি শ্রমিকদের বাড়ির বাচ্চারাও বাড়িতে বসে বিড়ি বাঁধে, গুনতিতে পয়সা পায়, তারা আসেই না স্কুলে। শেষ পর্যন্ত খবরের কাগজে খুশিঝোরার কথা পড়ে চলে এসেছেন এখানে। নিজের সাধ্যমতো পড়ান বাচ্চাদের। এখানকার ভাষা বলেন এমন, মনে হয় এখানেই জন্মেছেন, বড়ো হয়েছেন। আর রোজ বিকেলে লুঙ্গিটাকে গুটিয়ে হাফ-প্যান্টের মতো করে নিয়ে বাচ্চাদের সাথে ফুটবল খেলেন। সব বাচ্চা, যারা এখানে থাকে, সবাই। ছেলে মেয়ে সব।
প্রতুল বাবুকে নিয়ে এসেছিলো জলধর নামে কেউ। সে খুশিঝোরার প্রথম দিকের মানুষ। সাঁওতাল। পড়াতোও স্কুলে। সে নাকি মাওবাদী ছিলো, পুলিশের সাথে নাকি সংঘর্ষে নিহত হয় ! দুটো নাকিই প্রত্যেকবার বলেন প্রতুলবাবু, নড়চড় হয় না একটারও ! প্রতুল বাবুর বয়েস সত্তর-টত্তর হবে, এই বাচ্চারা ছাড়া কেউ নেই পৃথিবীতে ! পড়ানো ছাড়াও আর একটা দায়িত্ব তিনি নিজেই তুলে নিয়েছেন কাঁধে। রান্নাঘরের বাইরে একটা বড়ো উনুন আছে, যাতে সাধারণত গোরু-মোষের বিপুল খাদ্য ফোটানো হয়। কিন্তু সবকিছুর আগে সকালে সেখানে স্কুলের সব বাচ্চার সকালের খাবারটা – ফ্যানযুক্ত ভাত বা খিচুড়ি – তিনি নিজে রান্না করেন রোজ।
একদল মানুষ আসে খুশিঝোরায় যাদের দেখে খানিকটা অবাকই হয় সোমেশ্বর। এরা ধরণ্যৈ নমঃ-জপ-করা জয়মালিকা সেনের ভক্ত। জয়মালিকার পরণে সবসময়ই সাধারণ শাড়ি, কিন্তু এই ভক্তরা এলে সে সাদা শাড়ি পরে, মেটেরঙা পাড়, আর সবায়ের বিকেলের চা-মুড়ি শেষ হলে ডাইনিং হলে এসে বসে। ডাইনিং হলটাই এখানে সান্ধ্য-বৈঠকের মিলনস্থল। ভক্তদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেয় সে, প্রশ্নকর্তা বা কর্ত্রীর তো আগে থেকেই ঘোরতর বিশ্বাস, ফলত উত্তর যা-ই পায় তাতে ভক্তি বাড়েই, কোন তর্ক বা সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হয় না। ব্যক্তিগত সমস্যার কথাও বলে কেউ কেউ, জয়মালিকা বলেন ধরণী মাতার ওপর বিশ্বাস রাখ্। রামায়ণ পড়েছিস তো, সীতার চেয়ে বেশি দুঃখী আর কে আছে, কিন্তু দেখ্, শেষ পর্যন্ত সীতা যখন সইতে না পেরে আর কাউকে না ডেকে ধরণীর কাছে প্রার্থনা করলেন, তখন কী হলো? ধরণী বিদীর্ণ হলেন। ভূতল থেকে দিব্য সিংহাসন পাঠালেন সীতাকে, আর
তস্মিংস্তু ধরণী দেবী বাহুভ্যাং গৃহ্য মৈথিলীম্।
স্বাগতেনাভিনন্দ্যৈনামাসনে চোপবেশয়ৎ।।
নিজের দুহাতে মৈথিলী, মানে সীতাকে, ধরে, অভিনন্দন আর স্বাগত জানিয়ে ঐ সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন ধরণী, মানে নিজের কাছে টেনে নিলেন, অথচ রাম লক্ষ্মণদের ভাইদের সবাইকেই সরযূর জলে ডুবে মরতে হলো !
একবার খড়গপুরের আই-আই-টি থেকে শিক্ষকদের একটা দল হাজির। আগে থেকে বলা ছিলো না, গেস্ট হাউজের সব ঘরেই অতিথিরা আছেন, থাকার জায়গা কোথায়? বরাত জোরে ছুটির দিন ছিলো, আই-আই-টির দল ক্যাম্প খাট পেতে স্কুলের একটা ঘরে দিব্যি কাটিয়ে দিলো। আড্ডা মেরে, গান-বাজনা কোরে, হাটের থেকে একরাশ বাজার কোরে, এবং সন্ধ্যেবেলা ছেলেমেয়েদের একটু-আধটু পড়িয়ে পরের দিন সকালে ফিরে যাওয়ার আগে সোমেশ্বরকে একান্তে ডেকে বলে গেলো তারা, সবই হয় এখানে, পড়াশোনাটা ছাড়া। পড়াবার লোক নেই। আপনারা দুজন শুনলাম পাকাপাকি চলে আসছেন, স্কুলে পড়াবেন। আশা করবো, শারীরিক আর মানসিক নানা কষ্টে দৃকপাত না করে আপনারা থেকেই যাবেন। আর তা হলে, এবার বোধ হয় পড়াশোনার একটা পরিবেশ তৈরি হবে স্কুলে। এই যে আমরা সন্ধ্যেবেলায় পড়তে বসালাম ছেলেমেয়েগুলোকে, মনে করবেন না তাতে সত্যি সত্যি ওদের কিছু উপকার হলো। মাঝে মাঝেই আমরা আসি তো, যখন আসি ভালো কাজে আমরা শুধু জয়িদিকে একটু সাহস জুগিয়ে দিই, আমরা সাথে আছি ! ছেলেমেয়েদের তাতে লাভ হয় ঘেঁচু ! আসল কাজটা কিন্তু আপনাদের দুজনকেই করতে হবে সোমদা ! বেস্ট অব লাক !