আজ আর সন্ধ্যেবেলা ছেলেমেয়েরা পড়তে পারবে না এ তো জানাই ছিলো। সারাদিন ধরে গোয়াল পরিষ্কার করার পর খড় কিনে এনে সেই খড় গুছিয়ে তুলে রেখে তারপর সন্ধ্যেবেলা পড়াশোনা করার মতো শারীরিক বা মানসিক ক্ষমতা থাকবেই বা কী করে ছেলেমেয়েদের ! নিজের ল্যাপটপটা নিয়ে একটু কাজ করার জন্যে ডাইনিং হলের দিকে এগোয় সোমেশ্বর। ডাইনিং হল ঝাড়পোঁছ করছে শুকি আর লকি, ঢুকতে গিয়ে বাইরে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। ওর দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে উৎপল, শুকি-লকিকে সে নানারকমের নির্দেশ দিচ্ছে আর আপন মনে বকবক করে চলেছে। সোমেশ্বর দাঁড়িয়েই রইলো বাইরে, ঝাড়পোঁছ শেষ হলে ঢুকবে সে। হঠাৎ তার কানে আসে উৎপলের গলা, যত নোংরা ছেলেমেয়েগুলো এই চেয়ার টেবিলে বসে নষ্ট করে দিচ্ছে সব দামি দামি চেয়ার টেবিলগুলোকে, বাপের জন্মে চেয়ারে বসেছে ওরা ! এই যে এ ঘরে শুরু হয়েছে পড়াশোনা রোজ রোজ, এটাকে বন্ধ না করলে চলছে না ! তারপর সে হঠাৎ মাথাটা ঘোরায়, ঘুরিয়েই দেখতে পায় সোমেশ্বর দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। একটুও অপ্রতিভ না হয়ে সোমেশ্বরকেই সে বলে সোজাসুজি, এই যে সোমদা, এবার থেকে ছেলেমেয়েগুলোকে চেয়ারে বসতে দেবেন না, এ ঘরে যদি পড়াতেই হয়, আপনি বসবেন চেয়ারে আর বাচ্চাদের বলবেন নীচে বসতে ! মেঝেতে ! বলেই, গট গট করে বেরিয়ে যায় সে, তার পিছন পিছন যায় শুকি-লকি।
সোমেশ্বর কথা বলে না, এক কোণে বসে কাজ করতে থাকে তার ল্যাপটপে।
পরের দিন সকাল সাড়ে নটায় ছোটদের ছুটির শেষে ক্লাসের বাইরে বেরিয়েই প্রথম যাকে দেখতে পায় সোমেশ্বর, সে জয়মালিকা, এক ভদ্রলোকের সাথে স্কুলবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। সোমেশ্বরকে দেখে এগিয়ে আসে সহাস্য জয়মালিকা, কিন্তু ওর পেছনেই তখন পর পর বেরোতে-থাকা ছেলেমেয়ের দল জয়মালিকাকে দেখেই একযোগে গূড মর্ণিং ম্যাডাম বলতে শুরু করায় জয়মালিকার চোখ সোমেশ্বরকে পেরিয়ে চলে যায় বাচ্চাদের দিকে। জয়মালিকা এগিয়ে আসে, কোন বাচ্চার গাল টিপে দেয়, কারো মাথায় বুলিয়ে দেয় হাত, কাউকে সোজা তুলে নেয় কোলে; কোলে-তোলা বাচ্চাটার নোংরা-লাগা খালি-পা যে ওর দুধ-সাদা শাড়িটাকে ঘসে যাচ্ছে সে ব্যাপারে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই ওর !
বাচ্চারা মাঠে গিয়ে খাবার লাইনে দাঁড়াবার পর জয়মালিকা সোমেশ্বরকে পরিচয় করিয়ে দেয় ওর সঙ্গী ভদ্রলোকের সাথে, পুলকেশ তরফদার, খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক। জয়মালিকা য়্যোরোপ থেকে কলকাতায় ফিরেছে গত পরশু, দু রাত্তির এই বন্ধুর বাড়িতে কাটিয়ে আজ ভোরবেলায় ওঁরই গাড়িতে রওনা দিয়ে একটু আগে পৌঁছেছে এখানে। অনেক দিন স্কুলের বাচ্চাদের না দেখে মন খারাপ লাগছিলো, তাই এখানে পৌঁছেই সোজা চলে এসেছে স্কুলে। ভদ্রলোকের নাম অতি পরিচিত, যদিও আগে কখনো দেখেনি সোমেশ্বর। সোমেশ্বর হাত তুলে নমস্কার করে, জয়মালিকা ওর পরিচয় দেয়, সেই একই পুরোনো বয়ান, একটুও বদল হয় না ভাষায় : আমাদের নতুন মাষ্টারমশাই, সস্ত্রীক এসেছেন এখানে, দুজনেই পড়াচ্ছেন আমাদের স্কুলে, খুব কোয়ালিফায়েড, মাষ্টারমশাই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির খুব বড়ো ম্যানেজার ছিলেন, একমাত্র মেয়ে বিদেশে থাকে, গাড়ি-টাড়ি নিয়ে দুজনেই চলে এসেছেন এখানে সব ছেড়েছুড়ে, কর সেবা দিচ্ছেন। তারপরই কৃত্রিম লজ্জায় জিভ কাটে জয়মালিকা, সরি সরি, কর সেবা বলা যাবে না, কর সেবায় আপত্তি আছে ওঁর !
দুপুরে খাওয়ার সময় পুলকেশও বসেন ওদের সাথে, এবং পুলকেশের বিশেষ অনুরোধে জয়মালিকাও। য়্যোরোপের গল্প হয়, পাঁচ জায়গায় সেমিনারে বক্তৃতা দিয়েছে জয়মালিকা, ধরণী মাতার আরাধনা যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম আর ভারতের ইণ্ডিজেনাস পপুলেশনের দার্শনিক চিন্তার মহাসম্মিলনের ফসল, ভারতীয় ধর্মের শ্রেষ্ঠ প্রতীক, আদিবাসী ধর্ম আর ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মিলনস্থল, এ চিন্তা নাকি আলোড়ন তুলেছে যেখানে যেখানে গেছে ও সেখানেই। ও যে বক্তৃতা দিয়েছে তার ইংরিজি অনুবাদ, এক একটি কপি পাঁচ য়্যুরো হিসেবে একশো কপি – যা ও সঙ্গে কোরে নিয়ে গিয়েছিলো – সবই বিক্রি হয়ে গেছে ! এসব আলোচনা খুব একটা প্রভাব ফেলে না সোমেশ্বরের ওপর, ও মনে মনে ভাবছিলো জয়মালিকা কী বাচ্চাদের পাদুকাবিহীন ফাটা-পাগুলো লক্ষ্য করেছে আজ !
সন্ধ্যে ছটা নাগাদ ক্লাস এইটের মিনতি সোমেশ্বরকে ডাকতে এলো। গেস্ট হাউজে আজ অনেক গেস্ট, উৎপল স্যর বলেছেন, যদি পড়তেই হয় সন্ধ্যেবেলা, আটটার মধ্যে ডাইনিং হল ছেড়ে দিতে হবে। তা ছাড়া আটটার পর ছেলেমেয়েদের কাজও আছে। সোমেশ্বর গিয়ে দেখে ওরা ডাইনিং হলের মেঝেতে দুটো খেজুর পাতার চাটাই জোড়া কোরে লাগিয়ে বসেছে, একধারে একটা চেয়ার, সোমেশ্বরের জন্যে। সোমেশ্বর কোন কথা না বলে চেয়ারটা সরিয়ে দেয়, ঐ চাটাইটাতেই বসে পড়ে, এবং পড়াশোনা শুরু হয়।
আটটার আগেই পড়ানো শেষ কোরে উঠে পড়ে সোমেশ্বর, এবং বুঝতে পারে পা মুড়ে চাটাইতে বসা ওর পক্ষে আর সম্ভব নয়, ওর হাঁটুর জোড় এই বয়েসে এ অনভ্যাস বদলাতে পারবে না। মুজফ্ফর সাহেব শুনে বলেন, আমি একটা কথা ভাবছিলাম স্যর, আমরা কাল থেকে স্কুলের একটা ক্লাস রূমে বসতে পারিনা?
কেন পারবো না, কিন্তু শুনেছি স্কুল ছুটির পর ঘরে ঘরে তালা পড়ে যায়। তালা খুলে ঢোকবার জন্যে অনুমতি নিতে হবে তো। কার কাছে পাওয়া যাবে অনুমতি?
সে আমি নিয়ে রাখবো, বলে মুজফ্ফর।