যে বন্ধুর উচ্ছ্বসিত সুপারিশে সোমেশ্বর প্রথমবার খুশিঝোরায় আসে, সে খুশিঝোরার ফোন নম্বর জানতো না। বলেছিলো, ওদের একটা ওয়েবসাইট আছে শুনেছি, চেষ্টা করে দেখতে পারো। মনে হয় সব খবর ওতেই পাবে।
পাওয়াও গেলো। খুশিঝোরার কার্যকলাপের বিবরণ, অনেক ছবি – গাছপালা, পাহাড়, ছোট পাহাড়ি নদী – আর স্কুলের য়্যুনিফর্ম পরিহিত একদল ছেলেমেয়ে। সিটি অফিসের ঠিকানা, ফোন নম্বর। সব শেষে সম্পাদিকা জয়মালিকা সেনের নাম, এবং দুটি মোবাইল নম্বর।
সিটি অফিসে ফোন করে সোমেশ্বর, যে ভদ্রলোক ফোনটি ধরলেন তিনি বিশেষ খবর দিতে পারলেন না, বললেন, জয়িদির সাথে সরাসরি কথা বলুন না।
কার সাথে কথা বলবো? কী নাম বললেন?
জয়িদি, মানে জয়মালিকা সেন। ওয়েবসাইটেই মোবাইল নম্বর পাবেন। আপনি কোথা থেকে বলছেন?
এই, কলকাতা থেকেই।
ওয়েবসাইটে দুটো নম্বর আছে, প্রথমটায় করবেন। দ্বিতীয়টায় নয়, ওটা ঝাড়খণ্ডের নম্বর।
প্রথমটাতেই ফোন করে সোমেশ্বর, এবং পেয়েও যায় সহজেই।
ধরণ্যৈ নমঃ। জয়মালিকা বলছি, জয়মালিকা সেন।
মিজ সেন, সোমেশ্বর বলে, আমার নাম সোমেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। আপনাদের খুশিঝোরায় দুয়েকদিনের জন্যে আসতে চাই, আমার স্ত্রী আর আমি।
কোথা থেকে বলছেন? নিছক বেড়াতেই আসতে চান, না কোন বিশেষ কাজ আছে?
বলছি কলকাতা থেকে, না মানে কাজ তেমন কিছু নয়, একটা নাটকে একটু মানভূমের কথ্য ভাষা দেওয়ার দরকার ছিলো, আমার এক বন্ধু পরামর্শ দিলেন আপনাদের ওখানে অনেকে আছেন যাঁরা সাহায্য করতে পারবেন, তাই...
আপনি নাট্যকার? বাঃ ! কী কী নাটক লিখেছেন?
না না, নাট্যকার-ফাট্যকার নই, বুড়ো বয়েসে একটা সখ হলো...
কবে আসবেন?
আজ সোমবার, এই ধরুন বেস্পতিবার।
চলে আসুন, আপনারা এলেই তো আমাদের চলে, আমরা কিছু টাকাপয়সা পাই। হাওড়া স্টেশনের পঁচিশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম, সকাল ছটা পঞ্চাশে ছাড়ে ইস্পাত এক্সপ্রেস, গালুডি স্টেশনে নামবেন, ঘাটশীলার পরের স্টেশন, স্টেশন থেকে অটোরিকশা পাবেন খুশিঝোরা পর্যন্ত, তিনশো টাকা।
ঠিক আছে, তাহলে বেস্পতিবার দেখা হচ্ছে, নমস্কার।
বড়ো একটা গেট, বন্ধ। গেটের ওপরে একটা কাঠের বোর্ডে চকচকে স্টীলে বাংলা অক্ষর বসিয়ে লেখা: খুশিঝোরা। অটো রিকশার ছেলেটা নেমে গেটটা নিজেই খুলে নেয়, তারপর সোজা গেটের ভিতর ঢুকে স্যুটকেস আর ব্যাগটা শুরকির রাস্তার ধারে নামিয়ে টাকা নিয়ে চলে যায়।
যেখানে এসেছে সেটা যে কোন হোটেল নয় বুঝতে পারে সোমেশ্বর, রিসেপশন অফিস নেই কোন। কোন মানুষ চোখে পড়ছে না। শুরকির রাস্তার দুধারে নানারকমের গাছ। পাশেই বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে অনেকগুলো বড়ো গাছ পাশাপাশি ঠাসাঠাসি, বেশ ছোট বনের মতো দেখায়। সম্ভৃতার মুখ থেকে স্বতস্ফুর্ত বেরিয়ে আসে, বাঃ !
আর ঠিক তখনই পেছন থেকে শোনা যায়, গূড মর্ণিং স্যর, গূড মর্ণিং ম্যাডাম। পেছন ফিরে ওরা দেখে একটি
তেরো-চোদ্দ বছরের ছেলে, স্কুলের য়্যুনিফর্ম পরে, যদিও পায়ে হাওয়াই চটি। এদিকে আসুন স্যর, বলতে বলতে স্যুটকেস আর ব্যাগটা নিয়ে ছেলেটা বাঁদিকের বাড়িটার ভেতরে ঢুকে যায়, সোমেশ্বররা ওর পেছনে। বেশ খোলামেলা একটা বড়ো ঘরে পৌঁছোয় ওরা, লম্বা টেবিল ঘিরে দশবারোটা চেয়ার, মনে হয় ডাইনিং হল। ছেলেটা বলে, বসুন, ম্যাডামকে ডেকে দিচ্ছি। বেরিয়ে যায় সে।
কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢোকে, ম্যাডাম নয়, লুঙ্গি আর ফতুয়া পরা একজন, একটা ট্রেতে তিনকাপ চা। কাপ তিনটে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখে সে, তারপর বলে, চা খান, ম্যাডাম আসছেন।
একটু পরেই ঘরে ঢোকেন এক মহিলা। সুশ্রী, সুন্দরীই বলা যায়। পরনে সাদাসিধে শাড়ি, বয়স্ক মহিলারা যেভাবে শাড়ি পরতেন পঞ্চাশ বছর আগে সেইভাবে পরা, আর হাওয়াই চটি, হাতে কৌটো একটা। বলেন, ধরণ্যৈ নমঃ, আমি জয়মালিকা, জয়মালিকা সেন। কতকগুলো এন্ট্রি করছিলাম ক্যাশ-বুকে, দেরি হয়ে গেলো। আপনিই মিস্টার ব্যানার্জি তো? কৌটোটা টেবিলে রাখেন জয়মালিকা।
হ্যাঁ, সোমেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়।
কী হলো, চা খান আপনারা, বলেন জয়মালিকা। বিস্কুট নিন, কৌটোটা খুলে একটু ওদের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজের কাপটা তুলে নেন।
চেয়ারে বসেই মহিলা বলেন, কী বিষয়ে নাটক আপনার?
আরেঃ, আপনি আমার নাটকটাকে বেশি সীরিয়াসলি নিচ্ছেন, বলে সোমেশ্বর, ও কিছু না। একটা আইডিয়া অনেক দিন ধরে মাথায় ছিলো, এখন লিখতে শুরু করেছি। ঘটনাটা মানভূমের পটভূমিকায়, সংলাপটা একটু অথেনটিক করতে চাই, এই আর কী !
হয়ে যাবে, আমাদের এখানে অনেকেই আপনাকে হেল্প করতে পারবে। এই যে চা দিয়ে গেলো নিমাই, ও-ও পারবে। আপনারা থাকবেন ক' দিন?
দু-তিনদিন থাকবো। আমার কাজ তো বিশেষ কিছু নয়, ওই ডায়লগের ব্যাপারটা আমি দু-একজনের সাথে বসে কোরে নিতে পারবো। কিন্তু আপনাদের জায়গাটা ভারি সুন্দর, গালুডি থেকে অটো রিকশায় আসতে আসতেই বেশ ভালো লাগছিলো, খুশিঝোরার ভেতরে ঢুকে আমরা মুগ্ধ। এই যে প্লানটেশনটা আছে আপনাদের, ঠাসাঠাসি এতো গাছ, প্রায় জঙ্গলের মতো, দেখে তো আমার স্ত্রী একেবারে অভিভুত !
এবার কথা বলে সম্ভৃতা, কতো গাছ আছে আপনাদের এখানে?
কতো গাছ? কঠিন প্রশ্ন, বলে জয়মালিকা। ভেতরে কতো আর, হাজার তিনেক হবে। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে যদি রাস্তাটা পেরোন, সামনেই দেখবেন বনভূমি, জঙ্গল। ওই জঙ্গলে ঢুকে পড়ুন, হাঁটতে থাকুন, অফুরন্ত জঙ্গল বলেই মনে হবে। গেলে, কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। না হলে জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারেন, দেখবেন একই জায়গায় বারবার ফিরে ফিরে আসছেন। কতো গাছ আছে ওখানে? লাখ পাঁচেক তো বটেই। গত পনেরো বছরে ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে এই জঙ্গল, এই পর্যন্ত বলে নিজের হাতের তালু দুটো টেবিলের ওপর রাখে জয়মালিকা, সব এই হাতে পোঁতা।
আপনি পুঁতেছেন? একা? – বিস্মিত সম্ভৃতার কণ্ঠস্বর মাত্রা ছাড়ায় নিজের অজান্তেই।
মৃদু হাসে জয়মালিকা। এ কথাটা সত্যি নয়। আমি একা নই, আমার বন্ধুরা না থাকলে পারতাম না। কিন্তু প্রতি বছর বেড়েই চলেছে গাছের সংখ্যা। এই যে রাস্তার দুধারে গাছ দেখছেন, কে পুঁতেছে? সবাই। খুশিঝোরায় যে-ই আসে, সে বেড়াতেই হোক বা অন্য যে কোন কারণেই হোক, সে-ই এক-আধটা পোঁতে। আপনারাও পুঁতবেন। গাছের সংখ্যা বাড়ে। কেউ কী জানে ঠিক কতো গাছ আছে এখানে? শুধু একটা কথা মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি, চোখের সামনে যেটা ঘটে গেলো সেটাকে নিজেরই অবিশ্বাস্য মনে হয়। বছর পনের আগে প্রথম যখন এসেছিলাম এখানে, চারদিকে শুধু ধু-ধু মরুভূমি। শুকনো মাটি, কাঁকুড়ে জমি, সবুজের লেশ নেই, চাষবাস হয়না, দূর দূর গ্রামে দুয়েকটা শীর্ণকায় লোক ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচে আছে কোনমতে। তারপর এই গাছ লাগানো। আজ দেখুন, বৃষ্টিও হয়, জনসংখ্যা বেড়েছে, গালুডি থেকে আসতে আসতে চাষের জমিও নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে আপনাদের ! জঙ্গল যেটাকে বললাম সেটার একটু ভেতরে যদি ঢোকেন, দেখবেন একটা পুকুর আছে আমাদের। কিছু কিছু মাছও হয় সেখানে। আর সেটাকে কেন্দ্র করে আমাদের সবজির চাষ।
সবজির চাষও করেন? নিজেরা? উচ্ছ্বসিত সম্ভৃতা, আমরা এখানে যা খাবো সে সবজি আপনাদের নিজেদের ফলানো?
সবটাই নয়, খানিকটা, বলে জয়মালিকা, কিন্তু আপনাদের আর কষ্ট দেবো না। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ট্রে্ন ধরেছেন, এখন ফ্রেশ হয়ে নিন। কীরকম ঘর চাই আপনাদের, আমাদের দুরকমের অ্যাকোমোডেশন আছে, সাতশো টাকা আর বারোশো।
ঘর নিয়ে বিশেষ কিছু চয়েস নেই, কমোড আর গীজার থাকলেই চলবে।
সে আমাদের সব ঘরেই আছে।
তাহলে সাতশো টাকা, বলে সোমেশ্বর।
সাতশো টাকা? বেশ। আপনাদের চার নম্বর ঘর দিচ্ছি। ওই ঘরেই বাপন বটব্যাল ছিলেন। একটু বসুন।
ভেতরে চলে যায় জয়মালিকা, ফিরে আসে একটা চাবি হাতে। চাবিটা সোমেশ্বরকে দিয়ে বাইরের শুরকির রাস্তাটা দেখিয়ে বলে, এই রাস্তাটা দিয়ে সোজা চলে যান। একেবারে শেষ মাথায় বাঁদিকে দেখবেন বারান্দাওয়ালা একটা ছোট বাড়ি। বারান্দা দিয়ে হেঁটে গিয়ে শেষ ঘরটা। আপনারা যান, লাগেজ পৌঁছিয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, সব কিছু খান তো আপনারা? কিছু রেস্ট্রিকশন আছে?
নো রেস্ট্রিকশনস, বলে সোমেশ্বর।
শুরকির রাস্তাটার শেষ মাথায় খুঁটির ওপর অ্যাসবেস্টাসের চাল লাগানো একটা জায়গা। সেখানে দুখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে। জায়গাটা পেরিয়ে ডান দিকে গোড়া বাঁধানো ছাতিম গাছ একটা। তার ঠিক উল্টো দিকে সিমেন্টের একটা স্ক্রীনের আড়ালে বাথরূমের মতো দেখতে কয়েকটা ঘর, আর সেগুলোর বাঁয়েই টানা বারান্দাওয়ালা ছোট একটা একতলা বাড়ি। জয়মালিকার নির্দেশ মতো বারান্দা দিয়ে সোজা হেঁটে তালা লাগানো শেষ ঘরটা।
ঘরে ঢোকে ওরা। বাহুল্যবর্জিত, কিন্তু ঠিকঠাক। পরিষ্কার। দুটো চেয়ার আছে। বারান্দায় টেনে নিয়ে বসে ওরা, বনভূমিটার মুখোমুখি।
একটু পর স্কুলের য়্যুনিফর্ম পরা একটি ছেলে ওদের লাগেজ নিয়ে, গূড মর্ণিং স্যর, গূড মর্ণিং ম্যাডাম। লাগেজ ঘরে রেখে দেয় সে।
গূড মর্ণিং, কী নাম তোমার? – জিজ্ঞেস করে সোমেশ্বর।
রিমিল।
রিমিল কী? কী পদবী?
মাহাতো। রিমিল মাহাতো। ক্লাস সিক্সে পড়ি।
স্কুল ছুটি হয়ে গেছে?
পড়ার ক্লাসের ছুটি হয়ে গেছে। এখন ব্রতচারী ক্লাস।
ব্রতচারী শেখানো হয় নাকি এখানে?
না, রোজ হয় না। একজন ব্রতচারী স্যর এসেছেন কলকাতা থেকে। উনি শেখাবেন। তিনদিন। এখনো শুরু হয়নি, এবার হবে।
কোথায় হবে?
খেলার মাঠে।
ঠিক আছে, যাও।
ছেলেটি চলে গেলে সম্ভৃতা বাথরূমে ঢোকে। সোমেশ্বর বনভূমির দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ হাসি পায় তার, বাপন বটব্যাল যে ঘরে ছিলেন সেই ঘর দেওয়া হয়েছে তাদের। যতটুকু শুনেছে খুশিঝোরা সম্বন্ধে এখানে তো নামী মানুষ অনেকেই আসেন, বড়ো বড়ো ইনটেলেকচুয়াল মানুষ সব, তার মধ্যে নাটক-সিনেমার মানুষও নিশ্চয়ই আছেন অনেকে। অনেকেই নিশ্চয়ই থেকেছে এই ঘরে। বিশেষ করে বাপন বটব্যালের নামই বা বললেন কেন মহিলা ! বাপন বটব্যালের নাম শুনেছে সোমেশ্বর, কিন্তু ঐ পর্যন্তই, তার কোন সিনেমা দেখেছে বলে মনে করতে পারে না। বলিউডি নায়ক; চটুল নাচ-গান, মারপিট, মাত্রা-ছাড়ানো মেলোড্রামায় ভরপুর সিনেমার লোক বলেই সোমেশ্বরের ধারণা। যতক্ষণ কথা বলেছেন মহিলা, মনে হয়েছে খুব স্বতঃস্ফুর্ত ভঙ্গি থাকলেও না-ভেবে কথা বলবার মানুষ ন'ন তিনি ! কী ভেবে বিশেষ কোরে বাপন বটব্যালেরই উল্লেখ !
যে লোকটি চা দিয়েছিলো সকালে, নিমাই নামে যার পরিচয় দিলেন জয়মালিকা, বেলা একটা নাগাদ সে খাওয়ার জন্যে ডাকতে এলো। ডাইনিং হলে গিয়ে দেখা গেলো জয়মালিকা বসে।
আসুন আসুন, বসুন – জয়মালিকার কণ্ঠে আপ্যায়ন – গরম জল পেয়েছিলেন তো?
খাবার এসে যায়, প্লেট, ছোট ছোট বাটি, দুজনের জন্যে পাশাপাশি সাজিয়ে দেয় নিমাই।
আপনার? আপনারটা কী হলো? – সম্ভৃতা প্রশ্ন করে জয়মালিকাকে।
আমার এখনো খাওয়ার সময় হয়নি, সবায়ের খাওয়া হয়ে গেলে আমি খাই।
তার মানে, শুধুমাত্র আমাদের দেখাশোনা করার জন্যেই আপনি সব কাজ ছেড়ে বসে আছেন এখানে? – বলে সোমেশ্বর, থ্যাঙ্ক য়্যু ভেরি মাচ, কিন্তু প্রয়োজন হবে না ম্যাডাম, আমরা ঠিক দেখেশুনে খেয়ে নিতে পারবো।
সে আমি জানি, আমি আপনাদের আলাদা করে খাতির করছি না। আমার ভালো লাগে অতিথিদের খাওয়ার সময় বসে থাকতে, নিজের ভালো লাগার জন্যেই বসি।
আপনাদের দুজন ছাত্রর সাথে দেখা হলো আমাদের, দুজনেই আমাদের লাগেজ বয়ে দিলো, বলে সোমেশ্বর খেতে খেতে। ছেলেরা ভালো, দেখা হতে প্রথমেই উইশ করলো।
হ্যাঁ, এটা ওদের ট্রেনিং, উইশ করাটা, আর টুকটাক কাজ করে দেওয়া, যদি হাতে সময় থাকে। এই স্কুলটাকেই ওদের বাড়িঘর মনে করতে শেখানোর চেষ্টা করি আমরা, বিশেষ করে যারা হোস্টেলে থাকে তাদের। ভবিষ্যতে ওরাই তো চালাবে খুশিঝোরা। বলতে পারেন একটা ওনারশিপ ইনস্টিঙ্ক্ট তৈরি করার চেষ্টা। বাড়িতে অতিথি এসেছে, বড়োদের একটু সাহায্য করি, এ যেন ওরা নিজেরাই ভাবে।
আপনাদের স্কুলটার সম্বন্ধে জানতে ইচ্ছে করছে, কোন্ ক্লাস পর্যন্ত পড়ান আপনারা?
ক্লাস এইট, চেষ্টা করছি ক্লাস টেন পর্যন্ত চালু করতে, বোর্ডের সাথে কথা হয়ে গেছে, হয়তো অ্যাফিলিয়েশন পেয়ে যাবো।
করছেন কেন? আজকাল তো শুনেছি গ্রামে গঞ্জে অনেক স্কুল তৈরি করছে সরকার, সব ফ্রী স্কুল। আসতে আসতে রাস্তাতেই তো গোটাতিনেক দেখলাম, তার মধ্যে আবার একটা উচ্চ মাধ্যমিক।
এই সব কথার মধ্যেই নিমাই ঢোকে আবার, তার হাতে একটা বালতি, তাতে ভাত, ভাত দিই ম্যাডাম? – সম্ভৃতাকে জিজ্ঞেস করে সে।
না, ভাত নয় আর, বলে সম্ভৃতা, এইসব রান্না করেছে কে?
আমিই করি, জবাব দেয় নিমাই, আর আমার সাথে সুনীল আছে, ও-ও করে। কী দেবো তাহলে আপনাকে?
আপনাদের রান্না তো খুব ভালো, কিন্তু বেশি খাওয়া হয়ে যাবে।
ঐ পাঁচমেশালী তরিকারিটা পাওয়া যাবে আর? – সোমেশ্বর বলে, ওটা দিয়েই তো একথালা ভাত খাওয়া যায়।
হ্যাঁ, আনছি, বলে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে ফিরে যায় নিমাই।
জয়মালিকা বলে, আপনি যেটা চাইলেন সেটা দিতেই সবচেয়ে ভালো লাগবে নিমাইয়ের, ওতে যা যা আছে, সবই আমাদের নিজেদের চাষের।
একটু পরে নিমাই ফেরে, ট্রেতে দু বাটি তরকারি, জোর করে সম্ভৃতাকেও দেয়। বলে, উঠে যাবেন না হঠাৎ, আমাদের নিজেদের দুধের দৈ আছে।
জয়মালিকা বলে, বিকেলে আপনাদের দেখতে নিয়ে যাবো আমাদের চাষ, কতক্ষণ ঘুমোবেন দুপুরে?
ঘুমোবোই ধরে নিচ্ছেন কেন? আপনি যখন ফ্রী হবেন ডেকে পাঠাবেন, চলে আসবো। কিন্তু আপনার তো সবাইকে খাইয়ে তারপর খাওয়া। টেক য়্যোর ওন টাইম, আমাদের জন্যে তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই।
না না, একটু ঘুমোন, বলে জয়মালিকা, অনেক ভোরে উঠে ট্রেন ধরেছেন। আমি ঠিক সময়েই খবর দেবো।
দরজায় নক করার আওয়াজ যখন পাওয়া গেলো তখনো ওরা ঘুমিয়ে। যে ছেলেটির সাথে প্রথম দেখা হয়েছিলো সকালে, সে-ই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। আপনাদের চা দিয়েছে, আর ম্যাডামও অপেক্ষা করছেন আপনাদের জন্যে।
একেবারে বাইরে বেরোবার জন্যে তৈরি হয়েই বেরোলো ওরা।
গেটটা খুলে বাঁদিকে। খানিকটা হেঁটেই ঝোরাটা। ঝোরার সামনে দাঁড়ায় ওরা কিছুক্ষণ, জয়মালিকা বলে, এটার নাম জানতে ইচ্ছে করছে না?
কী নাম? – জিজ্ঞেস করে সম্ভৃতা।
খুশিঝোরা, এটার নামেই আমাদের নাম। প্রথম যখন এখানে আসি, এই নদীটা দেখেই ভালো লেগে গিয়েছিলো। আমরাই নাম দিলাম খুশিঝোরা, আর সেই নামেই সংস্থার নাম হলো। সামনের ঐ মাইলস্টোনটা খেয়াল করবেন, লেখা আছে খুশিঝোরা জিরো। এখন এই নামটাই সবাই মেনে নিয়েছে, সরকারও।
রাস্তাটা পেরিয়ে বনভূমিতে ঢোকে ওরা। গাছ চেনাতে শুরু করে জয়মালিকা। এটা আতা, এটা মহুয়া, গাব এটা, আর ঐটা ডুমুর। বহেরা চেনেন? এই দেখুন। ডানদিকে তাকিয়ে দেখুন শালের সারি। কেন্দু দেখেছেন কখনো, কেন্দুপাতা? ঐ দেখুন। আর এদিকে তাকিয়ে দেখুন, লাইন ধরে পলাশ। ফেব্রুয়ারির শেষ থেকেই লালে লাল। আর একটু এগিয়ে চলুন, সেগুন দেখাবো। হাঁটতে হাঁটতে পুকুরটার কাছে পৌঁছোয় ওরা, ঠাণ্ডা হাওয়া একটা গায়ে এসে লাগে ওদের। জয়মালিকা বলে, আসুন, আমাদের চাষ দেখবেন।
এমন কখনো দেখেনি ওরা আগে। পুকুরটাকে বেড় করে চার লাইন। প্রথম লাইনে লাউ, তারপর বেগুন, কাঁচালঙ্কা তারপর, আর সব শেষে কুমড়ো। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওরা। এমনও হয় ! সম্ভৃতা বলে, সেই সাত নরি হারের গান আছে না একটা? এ যেন চার নরি রঙবেরঙের জড়োয়ার হার পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে পুকুরটা !
জয়মালিকা বলে, এই পুকুরপাড়ের সবজি চাষটা আমাদের বিরাট প্রেরণা, খুব ইনস্পায়ারিং একটা ব্যাপার। নিষ্ফলা বলে পরিচিত এই শুকনো জমিতেও যে গাছ বাঁচানো যায় সেটা আমাদের শিখিয়েছে এই পুকুর। পুকুরটাকে কেটে কেটে গভীর করা হয়েছে আর সেই জলের সিঞ্চনে গাছ বেড়েছে। গাছগুলো বেঁচে যাওয়ার পর পুকুরের পাড়ে লাউ দিয়ে শুরু। এদিকে আসুন, ওদের নিয়ে পুকুরের উত্তরের জমিটায় আসে জয়মালিকা। পুকুরপাড়ে লাউ হওয়ার পর এই জমিতে চাষ। এখন তাকিয়ে দেখুন এদিকে। পুকুরের উত্তর দিকে যতটা দেখা যায় প্রায় সমস্তটাই জুড়ে নানারকমের সবজির চাষ। জয়মালিকা বলে, আজ দুপুরের পাঁচমেশালী তরকারিটা এই সবজিতেই রান্না !
সবজিই করেন শুধু? আর কিছু হয়না? – জিজ্ঞেস করে সম্ভৃতা।
আর কী চান ! – চোখ পাকিয়ে বলে জয়মালিকা, আসুন আমার সাথে।
এধার-ওধার ছড়িয়ে থাকা কয়েকটা সেগুন গাছ ছাড়িয়ে শালের সারি পেরিয়ে ওরা পৌঁছোয় আকাশ-ছাড়ানো য়্যুক্যালিপটাস আর সোনাঝুরির পাড়ায়। সেখান থেকে খানিকটা ন্যাড়া জমি পেরিয়ে যেখানে পৌঁছোয় সেখানে অ্যাসবেস্টসের চাল দেওয়া সরু আর লম্বা একটা শেড। জানলা নেই, গোটা তিনেক চওড়া দরজা আর চাল ঘেঁসে পরপর পরপর জাফরি কাটা ভেন্টিলেটর। খোলা দরজা দিয়ে উঁকি মারে জয়মালিকা, বেরিয়ে আসে বুধিয়ার মা আর লকি, ওদের ময়লা কাপড়ে গোবরের ছাপ আর দু হাতে লেগে-থাকা গোবর।
কী করছিলি? – জিজ্ঞেস করে জয়মালিকা।
গোব-অর ছানছিলাম গ।
এই দাদা আর দিদিকে ভেতরে নিয়ে যা, গোরুমোষগুলো দেখিয়ে দে।
ভেতরে ঢুকতেই তীব্র গন্ধ, এ গন্ধের সাথে আজন্ম শহরলালিত সোমেশ্বর-সম্ভৃতা পরিচিত নয়। ভেতরের আলো-আঁধারিতে ইঁট-পাতা মেঝেতে ঠোকর খায় ওরা। চোখ একটু অভ্যস্ত হয়ে গেলে অবাক-চোখে দেখে সারি সারি গোরু একদিকে আর একদিকে মোষ।
ওরা যখন বেরিয়ে আসে জয়মালিকা জিজ্ঞেস করে, কী চাষ দেখলেন?
চাষ?
সম্ভৃতার দিকে তাকিয়ে বলে জয়মালিকা, শুধু সবজিই চাষ করি কিনা জিজ্ঞেস করছিলেন না? এখানে আমরা চাষ করি পঞ্চগব্যের।
পঞ্চগব্য? সোমেশ্বর একটু হোঁচট খায় মনে হয়।
সোমেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রাহ্মণসন্তান, পঞ্চগব্য জানেন না !
ব্রাহ্মণসন্তান, ব্রাহ্মণ তো নই !
দুধ দৈ ঘি, পঞ্চগব্যের প্রথম তিনটে, মানুষের খাদ্য। বাকি দুটো গোময় আর গোমূত্র, ধরণীর খাদ্য। এর প্রথমটিতে ধরণীর পোষণ, দ্বিতীয়টিতে বহিঃশত্রুর আক্রমণের প্রতিরোধ আর প্রতিষেধন। এই পুষ্টিতে বলীয়ান আর প্রতিষেধে নিশ্চিন্ত হয়ে ধরণী প্রতিপালন করে তার প্রিয়তম সন্তান বৃক্ষকে। আর বৃক্ষ প্রতিপালন করে আপনাকে-আমাকে। যেমন অসুস্থতামুক্ত মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করে শিশুর রোগ-প্রতিরোধ আর তর তর করে বেড়ে যাওয়া। যেসব গাছ দেখলেন আজ, বছর পনেরো আগে যখন সেগুলো পুঁততে শুরু করি তখন এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্যে আমরা করম পুজো করি। করম পুজো আদিবাসীদের বৃক্ষরোপণ উৎসব। সেই সময় আমি একটা শ্লোগান জনপ্রিয় করার চেষ্টা করি: মানুষের বর্জ্য গাছেদের ভোজ্য।
জানি, বলে সোমেশ্বর, আমার যে বন্ধুর কাছে প্রথম খুশিঝোরার নাম শুনেছিলুম সে বলেছিলো। কাগজ-টাগজে লিখেছিলেন আপনি।
শ্লোগানটা ঠিক ছিলো না, জয়মালিকা বলে হাসি হাসি মুখে, এখন হলে আমি বলতুম ধরণীর ভোজ্য। আসলে, জানেন তো, ঐ যে চিপকো আন্দোলন হয়েছিলো যখন আমাদের কম বয়েস, যেটার জোরে চণ্ডীপ্রসাদ ভাট ম্যাগসাসে পেলেন পরে, সেটাই আমাদের মূল ইশ্যু থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলো। আমরা গাছ বাঁচাও, পেড় লাগাও ইত্যাদি সব বলতে শুরু করলাম। গাছ তো বাঁচবেই ধরণী যদি বাঁচে।
জয়মালিকার মুখের দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে সোমেশ্বর বলে, পাত্রাধার কী তৈল কিম্বা তৈলাধার কী পাত্রের তর্কে আমার বিশেষ উৎসাহ নেই, ধরণী না থাকলে গাছ তো আর আকাশে হবে না, আর গাছ ছাড়া ধরণীতেই বা কী লাভ ! গাছ বাঁচানোর আন্দোলনে আমার পুরো সমর্থন আছে। আর ধরণী বাঁচানোর আন্দোলনের পক্ষেও যোগ দিতে রাজি আছি। আপনি যদি ধরণী বাঁচানোর আন্দোলনকে বেআইনি আর অনৈতিক মাইনিং বন্ধ করার আন্দোলনের দিকে নিয়ে যেতে চান, আমার সমর্থন আরও জোরদার হবে, তবে ব্যাপারটা ওই একই হলো, মাইনাররাও শুরু করে গাছ
কেটেই !
এবার কথা বলে ওঠে সম্ভৃতা, সবজি আর দুধ ছাড়া আর কিছু চাষ করেন না ম্যাডাম?
করি তো, ধান আর কলাইয়ের চাষ। এখানকার জমিতে কলাই ভালো হয়, নানারকমের কলাই-ই এখানকার মানুষের প্রথম এবং প্রধান চাষ। আমরা কিন্তু একটা বিশেষ ধরণের ধান করি, আমি জানি না পশ্চিমবঙ্গে আর কোথাও হয় কিনা, কালো চালের ধান।
কালো চাল মানে?
যে ধানটা হয় সেটা বাইরে থেকে অন্য ধানের মতোই দেখতে, কিন্তু খোসাটা ছাড়িয়ে ফেললে ভেতরে যে চালটা পাওয়া যায় সেটা মিশকালো। অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট নাকি, শুনেছি চিনদেশে রাজারা এই চালের ভাত খেতেন।
বিস্মিত এবং উচ্ছ্বসিত সম্ভৃতা বলে, চলুন না দেখি !
কী দেখবেন, ধান? ধান ভেতরে গিয়ে দেখাতে পারি, কিন্তু চাষটা আজ দেখা যাবে না, ঐ জমিটা একটু দূরে।
দূরেও জমি আছে আপনাদের? কতোটা জমি?
কতোটা? তার কী আর মাপজোক আছে? চলুন, ভেতরে যাই আজ, এসব কথা পরে হবে।
সোমেশ্বর আর সম্ভৃতা খেয়াল করেনি যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো ওরা সেটা খুশিঝোরার মেন গেটের প্রায় উল্টো দিকেই। গেটের দিকে এগোতে এগোতে গোয়ালটা ছাড়িয়েই ওদের চোখে পড়ে একতলা একটা ছোট বাড়ি। জয়মালিকা বলে, এটাই আমাদের তথাকথিত হোস্টেল। আজ আর সময় নেই, কাল দেখবেন।
গেটের ভেতরে ঢোকে যখন ওরা ততক্ষণে অন্ধকার নেমেছে। তিন-চারটে বাচ্চা ছেলেমেয়ে গেটের সামনের লতানো গাছটার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করছে মনে হলো। জয়মালিকা দু হাতে দুটো বাচ্চার গাল টিপে দিলো। শুরকির রাস্তাটার ডানদিক ধরে পরপর চারটে ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলছে। জয়মালিকা বললো, এগুলো সোলার ব্যাটারিতে জ্বলে, প্যানেলটা আপনারা যে বাড়িটাতে আছেন ওর ছাদে। প্রত্যেক ঘরেও একটা করে সোলার পয়েন্ট আছে, ছেলেরা দেখিয়ে দেবে আপনাদের।
বাঃ, এটা তো দারুণ, উচ্ছ্বসিত সোমেশ্বর, খুব ভালো করেছেন, আপনাদের কাজের সঙ্গে এক্কেবারে মানানসই।
সেটা ঠিকই, কিন্তু আমরা করিনি। করে দিয়েছেন একজন। আপনাদেরই মতো। বেড়াতে এসেছিলেন, আমাদের কাজকর্ম দেখে মনে করলেন উনিও কিছু কনট্রিব্যুট করবেন। করলেন। দেখুন, এরকম ভাবেই আমাদের চলে যায়, সব কাজের জন্যেই বন্ধু পেয়ে যাই আমরা। তা না হলে এক পয়সারও সরকারি সাহায্য ছাড়া চলছে কী করে
এতদিন !
কোন সাহায্য পান না?
চেষ্টা করলে হয়তো পেতে পারি। কিন্তু কী প্রয়োজন? সরকারি মন্ত্রী-আমলাদের পেছনে যতো সময় নষ্ট হবে সেই সময়ে অনেক কাজের কাজ করা যায়। আর পয়সা-কড়ি? ঠিক কেউ-না-কেউ দেবেই ! এতদিন তো চলে গেলো। যতো দিন যাচ্ছে ততই তো আমাদের বন্ধুর সংখ্যাও বেড়েই যাচ্ছে !
কথা বলতে বলতে ডাইনিং হলের দিকে এগোয় ওরা। ডাইনিং হল সংলগ্ন বারান্দাটায় সুবেশা সুসজ্জিতা দুই মহিলা গল্প করছিলেন, জয়মালিকাকে দেখে হাসলেন।
চা খেয়েছেন আপনারা? – জিজ্ঞেস করে জয়মালিকা।
খেলাম তো।
মুড়ি?
বোধ হয় আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছে।
জয়মালিকা কোন কথা না বলে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়, কিছুক্ষণ পর ওর পিছনেই নিমাই আর আরেকজন – বোধ হয় সুনীল এরই নাম হবে – দুটো ট্রে থেকে সবাইকে এক-এক বাটি মুড়ি দিয়ে যায়, সঙ্গে আলুর চপ জাতীয় কিছু। কয়েকটি ছেলেমেয়ে, যাদের মধ্যে সকালের ছেলে দুটিও আছে, গোটা চোদ্দ-পনেরো চেয়ার নিয়ে এসে সারি সারি পাততে থাকে। সোমেশ্বর জিজ্ঞেস করে জয়মালিকাকে, এতো চেয়ার কেন?
বসুন না, আমাদের ছেলেমেয়েরা গান-টান গাইবে, আর অতিথিরাও কেউ কেউ। চাইলে আপনারাও করতে পারেন। কিছুক্ষণ পর আরো তিনজন পুরুষ আর একজন মহিলা ওপর থেকে নেমে আসেন, তাদের পেছন পেছন পনের-ষোল বছরের একটি মেয়ে, এরা এসে যোগ দেয় আগের থেকে বসে থাকা মহিলা দুজনের সাথে। সোমেশ্বর বোঝে এঁরা সবাই বারোশো টাকার ঘরের অতিথি, অ্যাসবেস্টসের চালের নীচের গাড়ি দুটো সম্ভবত এঁদেরই। যে ছেলেমেয়েরা চেয়ার পাতছিলো বারান্দার নীচে খোলা জায়গাটার এক কোণে বসে যায় তারা, বোঝা যায় অনুষ্ঠান গোছের যেটা হবে সেটা ঐ খোলা জায়গাটাতেই।
একটু পরেই জয়মালিকার অনুরোধে হে মোর দেবতা গেয়ে শোনান মহিলাদের মধ্যে একজন, অবিশ্যি নিজের চেয়ারে বসেই। যে বাচ্চারা লতানো গাছকে আদর করছিলো কিছুক্ষণ আগে, তারা নীচে নেমে খোলা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে প্রথমে সমবেত গান গায় পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে। ইংরিজি স্কুলের নীচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা যেসব রাইম-টাইম শেখে সচরাচর, সেগুলোও আবৃত্তি করে তারা, তারপর কে জানে কী খেয়ালে যেখানে স্কুলের ছেলেমেয়েরা বসে আছে সেখানে গিয়ে বসে থাকা তিনটে মেয়ের গলা জড়িয়ে সেখানেই বসে পড়ে।
জয়মালিকার নির্দেশে স্কুলের ছেলেমেয়েরা সবাই মিলে গান গায় তারপর, মনে হয় সাঁওতালি গানই হবে। অতি সুখশ্রাব্য, মনে হয় খুবই যত্ন করে এ গান শিখেছে ছেলেমেয়েরা। তারপর একটি একটি করে পাঁচ-ছটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় তারা, কোনটি সমবেত, একক কোনটি, কিন্তু গায় খুবই ভালো। সম্ভৃতা সোমেশ্বরকে নীচু গলায় বলে, এরকম উচ্চারণে রবীন্দ্রসঙ্গীত এতো ভালো শোনাতে পারে ! কথাটা কানে যায় জয়মালিকার। সে বলে, ঠিকই বলেছেন, ওদের শেখাতে গিয়ে এটা আমার এক অভাবিত অভিজ্ঞতা। তারপর থেকে ওদের উচ্চারণ শোধরাবার চেষ্টা করিনি কখনো। ক্লাস ফাইভের দুটি ছেলে অভিনয় সহযোগে আবৃত্তি করে সুকুমার রায়, হ্যাঁরে হ্যাঁরে তুই নাকি কাল সাদাকে বলেছিলি লাল ! হ-য-ব-র-ল থেকে খানিকটা পড়ে শোনায় ক্লাস সেভেনের একটি মেয়ে, এবং মানভূমের উচ্চারণে, মনে হয়, নতুন মাত্রা পায় হ-য-ব-র-ল ! সবায়ের অনুরোধে আরও একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় ছেলেমেয়েরা।
সেদিন রাত্তিরে ঘুমোবার আগে সম্ভৃতা বলে সোমেশ্বরকে, ঠিক ঠিক শেখাতে পারলে অসাধ্যসাধন করবে এই বাচ্চাগুলো।
জয়মালিকাকে ওরা বলেই রেখেছিলো, সকাল সাড়ে পাঁচটায় স্কুলবাসের ড্রাইভার ওদের দরজায় ধাক্কা দিলো। ছটার মধ্যে তৈরি হয়ে বাসে উঠলো ওরা, প্রথম ট্রিপের ছেলেমেয়েরা আসবে। এই বাসযাত্রা শুধু যে প্রকৃতির সৌন্দর্যে নয়নসুখকর তা-ই নয়, জঙ্গলমহলের দারিদ্র দেখা এবং বোঝার জন্যে কণ্ডাক্টেড ট্রিপ যেন ! দূরে দূরে এক-একটি হতদরিদ্র বিচ্ছিন্ন গ্রাম, কৃষিকর্মের কোন চিহ্ণ নেই, দোকানবাজারের প্রশ্নই আসেনা, শুধু একটাই প্রশ্ন অনবরত মাথায় ঘুরপাক খায়, জীবিকার জন্যে কী করে এখানকার মানুষ? বেঁচে থাকার জন্যে? শ্রীহীন ছোট ছোট মাথা গোঁজবার ঠাঁই এক-একটা, কখনো কখনো শীর্ণকায় কোন মানুষ বা মানুষীর অস্পষ্ট অবয়ব দেখা যায় দূর থেকে; রাস্তা নেই, মনুষ্যরচিত কোন কিছুই দেখা যায় না, কাতর-ধ্বনিতে ধীরে ধীরে ঘষটে ঘষটে উঠতে থাকে বাসটা। তারই মধ্যে হঠাৎ দেখা যায়, স্কুলের জামাকাপড়ে একটি বা দুটি শিশু দৌড়োতে দৌড়োতে আসছে বাসের দিকে, বাসটি দাঁড়ালে উজ্জ্বল হাসিমুখ শিশুটি বাসে উঠে ড্রাইভারকে বলে, গূড মর্ণিং স্যর। কাকু নয়, দাদা নয়, স্যর ! কারণ, এটাই ওদের শেখানো হয়েছে, বয়েসে বড়ো পুরুষরা সবাই স্যর, মহিলারা সবাই ম্যাডাম ! তারপর সম্ভৃতা আর সোমেশ্বরকে আবিষ্কার কোরে একগাল হেসে গূড মর্ণিং ম্যাডাম, গূড মর্ণিং স্যর।
স্কুলে ফেরার পর সোমেশ্বর জয়মালিকাকে বলে, গতকাল আমি একটা ভুল কথা বলার চেষ্টা করছিলুম, আলোচনাটা বেশি দূর এগোয়নি, মাঝপথে বাধা পড়েছিলো। তবুও, ভুল বলছিলুম, ক্ষমা চাইছি।
কী বলুন তো, কী কথা?
নতুন নতুন স্কুল তৈরি করার আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কিনা প্রশ্ন তুলেছিলুম আমি, গ্রামে গ্রামে সরকার এমনিতেই তো অবৈতনিক স্কুল খুলছে অনেক। গালুডি থেকে খুশিঝোরায় আসতে আসতেই তিনটে স্কুল দেখেছি। কিন্তু আজ এই বাচ্চাদের আনতে গিয়ে বুঝেছি এই সব বাচ্চারা আমাদের দেশে জনসংখ্যায় ধর্তব্যই নয় ! কোন প্ল্যানিঙেরই আওতায় আসেনা এরা। আপনাদের মতো মানুষেরা স্কুল না চালালে স্কুলশিক্ষা এদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে চিরকাল।
ঠিকই বলেছেন, বলে জয়মালিকা, যতগুলো কাজ আমরা করার চেষ্টা করি এখানে, তার মধ্যে স্কুলটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম দিন থেকে এটাতেই জোর দিতে চেয়েছি আমি সবচেয়ে বেশি, অথচ দুর্ভাগ্য কী জানেন তো, এটা চালাতেই সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হয় আমাকে। সেই প্রথম দিন থেকেই।
কেন?
পড়াবে কে? শিক্ষক কোথা থেকে পাবো? এই যে এতো লোক খুশিঝোরায় আসে বেড়াতে, আমাদের নানারকমের সাহায্য করে তারা। স্কুলের জন্যেও সাহায্য করে অনেকে। কিন্তু শহরের আরাম ছেড়ে এখানে এসে পড়াতে রাজি নয় কেউ, আর এখানেই বা পড়ানোর মতো লোক কোথায় !
দুপুরে খাওয়ার সময় সম্ভৃতার আবার মনে পড়ে যায় কালো চালের কথা। জয়মালিকা সুনীলকে বলে, উৎপলকে একবার ডাকো তো। কিছুক্ষণ পর বেঁটেখাটো প্রায় থপথপে মোটা কালো চেহারার একজন হাজির, দেখে বয়েস আন্দাজ করা মুশকিল। জয়মালিকা আলাপ করিয়ে দেয়, উৎপল আমাদের অল-ইন-ওয়ান। ফার্স্ট ডিভিশনে ফুটবল খেলতো, খুশিঝোরার কথা ওর মামাতো ভাইয়ের কাছে শুনে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে এখানে চলে এসেছে। অনেক জোরজার করে পাঁচ হাজার টাকা মাইনে দিই ওকে, তারই থেকে টাকা জমিয়ে খুশিঝোরাকে একটা মোটর সাইকেল কিনে দিয়েছে। এরকম জায়গায় একটা বারোয়ারি মোটর সাইকেল না থাকলে নাকি চলে না ! আমাদের যাবতীয় চাষের কাজ ওরই অবদান। এই পাথুরে শুকনো জমিতে কোন্ যাদুতে ফসল ফলায় ও-ই জানে ! উৎপলের দিকে ফিরে বলে জয়মালিকা, কালো চাল দেখেননি ওঁরা কখনো, দেখাতে পারো?
ভেতরে চলে যায় উৎপল, ফিরে আসে একমুঠো ধান হাতে। গোটাকয়েক ধান ছাড়িয়ে কালো কালো চাল সম্ভৃতার প্রসারিত হাতে ঢেলে দেয় উৎপল। সত্যি, কতো কিছু আছে পৃথিবীতে! – মুগ্ধ সম্ভৃতা বলে সোমেশ্বরকে। তারপর উৎপলের দিকে তাকিয়ে বলে, এই ধানের ক্ষেতটা দেখা যাবে?
যাবে না কেন, তবে ওই ক্ষেতগুলো এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে। দেখি, কী ব্যবস্থা করা যায়।
উৎপল চলে যাওয়ার পর সম্ভৃতা প্রশ্ন করে জয়মালিকাকে, আপনাদের জমি কতোটা?
আমাদের জমি কতোটা? – উত্তর দেয় জয়মালিকা, কঠিন প্রশ্ন ! সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে !
এতক্ষণ কথা বলছিলো না সোমেশ্বর, এবার বলে, কলকাতায় আপনাকে অনেকেই চেনে; ব্যক্তিগতভাবে চেনে না কিন্তু আপনার কথা শুনেছে এমন লোকও কম নয়। আমি অবিশ্যি আপনার কথা আগে শুনিনি, যে কাজ করতুম সেটাই এত ছন্নছাড়া ছিলো যে শিল্প সংস্কৃতি সাহিত্য এবং এসবের সাথে যুক্ত যাঁরা তাঁদের খবরই রাখিনি বহুদিন। খুশিঝোরার কথা প্রথম শুনলুম যে বন্ধুর কাছে সে বলছিলো আপনি নাকি দশ-পনেরো বছর আগে আদিবাসীদের নিয়ে আঁকা আপনার ছবির একটা প্রদর্শনী করেছিলেন এখানে। এখানে আপনার নিজস্ব বিরাট সম্পত্তি ছিলো, কিন্তু ঐ প্রদর্শনীর সময়েই সমস্ত সম্পত্তি খুশিঝোরাকে দান করে দেন আপনি। শুনে, আমার ধারণা হয়েছিলো আপনি এখানকারই মানুষ। কিন্তু কাল থেকে কয়েকবার আপনি বললেন বছর পনেরো আগে আপনি প্রথম এখানে এসেছেন ! মানে, মোটামুটি ঐ প্রদর্শনীটারই সময়েই ! এসব নিয়ে কৌতূহল দেখানোটা অবিশ্যি একটু আনসিভিলাইজ্ড্ মনে হতে পারে, যেহেতু এটা আপনার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু আপনি তো আর নিজেকে ব্যক্তিগত মানুষ করে রাখেননি, আপনি এখন পাবলিক মানুষ। কাজেই খানিকটা অস্বস্তি নিয়েই আপনাকে বলছি, যা লোকমুখে শুনেছি আর যা আপনার কাছে শুনছি সে দুটোকে মেলাতে পারছি না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে জয়মালিকা, তারপর বলে, যা যা আপনি শুনেছেন প্রায় সবটাই ঠিক। আমি এখানকার মানুষ হয়ে গেছি ঠিকই, কিন্তু সে ঐ বছর পনেরো আগে। আমি বড়ো হয়েছি যে জায়গাটায় সেটা সারাণ্ডা রেঞ্জে যে স্টীল প্লান্টটা তৈরি হয়েছিলো স্বাধীনতার পর, সেই প্লান্টের শহরে। পড়াশোনাও ওখানে, চাকরিও করেছি ঐ প্লান্টেই। আমার বাবা একটু অ্যাডভেঞ্চার-মাইণ্ডেড লোক ছিলেন, তিনি আমাদের সাথে বিশেষ থাকতেন না। তিনিই এই অঞ্চলে এসেছিলেন, একা একাই। এই যে আমাদের কম্পাউণ্ডটা, গেট দিয়ে ঢুকে যা যা দেখছেন, এই স্কুল, খেলার মাঠ, গেস্ট হাউজ, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সব জায়গাটাই আমার বাবার। প্রায় চল্লিশ বিঘে। বছর পনেরো আগে আমাকে ডেকে পাঠিয়ে এই সম্পত্তিটা আমার নামে রেজিস্ট্রেশন করে দিয়ে বাবা আবার কোথাও চলে যান। কোথায় গেছেন আমি জানিনা, কাউকে বলেননি। জায়গাটা আমার ভালো লেগে যায়, আমি ঠিক করি এখানেই থেকে যাবো। তখনই খুশিঝোরা তৈরি হয়, আমার বন্ধুরাও অনেকে সঙ্গে ছিলো। সম্পত্তি নিয়ে আমি কী করবো, সম্পত্তিটা আমি খুশিঝোরার নামে ট্রান্সফার করিয়ে দিই, একটা পাবলিক ট্রাস্ট তৈরি হয়। মূল ঘটনাটা এই। আর এই পাঁচিলের বাইরে যা যা দেখছেন এবং দেখছেন না – ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে – সেই শখানেক বিঘে জমি, পুকুরটা ছাড়া, এসব পাঁচজনের। পুকুরটা আমরা কিনেছিলাম। আমরা নানারকমের কাজ করছি দেখে এখানকার মানুষরা আমাদের অনেক জমি দিয়েছে। সেগুলো তো পড়েই ছিলো, এখন চাষ হচ্ছে। কেউ কেউ জমির দলিল দিয়ে গেছে আমাদের, অনেকে খুঁজেই পায়নি দলিল, অনেকে আবার দেয়ওনি ! আমরা চাষ করি, ওদের ছেলেমেয়েদের পড়াই, জমির মালিকানা নিয়ে মাথা ঘামায় কে ! আমার কী ইন্টারেস্ট ! আমি শুধু বুঝি, এই মানুষরা সবাই খুশিঝোরা পরিবারের লোক।
কিন্তু, খানিকটা যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলে জয়ি, আপনাদের খাবারদাবার সব তো ঠাণ্ডা হয়ে গেলো ! খেয়ে নিন, বাকি কথা পরে হবে।
বিকেলে যখন চায়ের জন্যে আসে ওরা তখন জয়মালিকা বসে আছে এক ভদ্রলোকের সাথে। ওদের দেখে ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় জয়মালিকা, ইনি আমাদের ছেলেমেয়েদের ব্রতচারী ট্রেনিং দিচ্ছেন। ভদ্রলোক নমস্কার করে বলেন, আমার নাম সঞ্জয় মাইতি, গত বছর মাউন্টেনীয়ারিঙের ট্রেনিং দিয়েছিলাম এখানকার বড়ো ছেলেদের, এবার ব্রতচারী ট্রেনিং দিচ্ছি ছোটবড়ো সব ছেলেমেয়েকে।
আপনি মাউন্টেনীয়ারিঙও করেন ! – যথেষ্ট মুগ্ধ সোমেশ্বর।
এখন আর করিনা, এখন তো বয়েস হয়ে গেছে, কিন্তু আমার একটা টীম আছে, তাদের নিয়ে এসে শিখিয়েছিলাম ছেলেদের, অযোধ্যা পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে, অনেকটাই শিখেছিলো ওরা। তবে একবার শিখেই তো লাভ হবে না, চেষ্টা করছি কোন স্পন্সর যোগাড় করতে, পেলে কোন ছোটখাটো পাহাড়ে নিয়ে যাবো ওদের। এবারে এখানে এসে ভালোই হলো। তিনটে ফ্যামিলি কয়েকদিনের জন্যে বেড়াতে এসেছিলো এখানে, আজ দুপুরে চলে গেলো। ওই তিনজনের একটা বীয়ার ফ্যাক্টরি আছে। ওঁরা আজ ছেলেমেয়েদের ব্রতচারী ট্রেনিং দেখতে এসেছিলেন সকালে। সব শুনে ওঁরা খুব উৎসাহ দেখালেন। বলেছেন, ওঁরাই হয়তো স্পন্সর করবেন মাউন্টেনীয়ারিং ট্রিপটা। দেখা যাক কী দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত।
কথা বলতে বলতে উৎপল আসে, বলে, কী সঞ্জয়দা, যাবেন না?
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ান, হ্যাঁ যাবো তো, তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি। তারপর সোমেশ্বরকে বলেন, একটু কাজ আছে, রাত্তিরে দেখা হবে।
জয়মালিকা বলে সম্ভৃতাকে, বিশুকে বলে রেখেছি, ও বাস নিয়ে বাইরে রেডি। ধানক্ষেত দেখতে যাবেন তো?
বাসটা যেদিকে যায় সেদিক দিয়েই সকালে ওরা বাচ্চাদের আনতে গিয়েছিলো। তবে সাতঘুরুং নদীটার কাছে গিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় না উঠে ডানদিক দিয়ে একটা মেঠো রাস্তায় ঢুকলো বাসটা। খানিকটা গিয়ে বাঁ দিকে একটা গ্রাম। জয়মালিকা বললো এই যে গ্রামটা দেখছেন এটার নাম ভাবকান্দি। এই গ্রামের মানুষরাই খুশিঝোরায় আসার পর আমার প্রথম বন্ধু। এগজিবিশনটা শেষ হয়ে গেলে এদের ছেলেমেয়েদের ছবি আঁকা শেখানো দিয়েই আমি কাজ শুরু করি। এই গ্রামের প্রায় সব বাচ্চাই আমাদের স্কুলে পড়ে। আদিবাসী গ্রাম এটা, এরাই আমাদের ধান চাষের জমিটা দিয়েছে।
ধান জমিটাকে বাঁয়ে রেখে দাঁড়িয়ে পড়ে বাসটা। বাস থেকে নামে ওরা। ছোট্ট একফালি জমি, বড় জোর বিঘে তিনেক হবে। ওরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করে আশপাশে আর অন্য কোন জমিতে কোন কৃষিকার্য নেই, পতিত জমির মতো খানিকটা খোলা জায়গার মাঝখানে এই জমিটা। বিঘের পর বিঘে একটানা কর্ষিত জমি দেখতে অভ্যস্ত ওদের চোখ খানিকটা হতাশই হয় কৃষিক্ষেত্রটিকে দেখে। ধান রোয়া হয়েছে যে জমিতে তার সবটাই জলে ডোবা, একটু একটু সবুজ চূড়া কোথাও কোথাও জেগে।
কী ম্যাডাম, জয়মালিকা বলে সম্ভৃতাকে, মন খারাপ হয়ে গেলো তো? এই জন্যেই এখানে আসার ব্যাপারে আমি ততটা উৎসাহ দেখাচ্ছিলাম না। মাইলের পর মাইল সবুজ ধানক্ষেত অথবা ঘোলাটে জল, তার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ায় জলের নাচন, আর প্রায় জল-ছুঁই-ছুঁই উচ্চতায় উড়ে যাওয়া ঝাঁক ঝাঁক পাখি কিছুই নেই এখানে। জীবনানন্দ এদিকে আসেননি কোনদিন।
একটু অপ্রস্তুত হাসি সম্ভৃতার চোখেমুখে, না ঠিক তা নয়...
উঠুন বাসে, বলে জয়মালিকা, চলুন, সাতঘুরুং নদীটার পাড়ে গিয়ে বসি, মন ভালো হয়ে যাবে।
একটা মন্দির আছে সাতঘুরুঙের ধারে, রাস্তার ওপর। মন্দিরের ঠিক পেছনে নদীর ধারে বসে ওরা। ঘুরপাক খেতে খেতে অজস্র ছোটবড়ো বোল্ডারকে ধাক্কা দিতে দিতে নানারঙের ফেনার ম্যাজিক দেখাতে দেখাতে মৃদু কণ্ঠে গান গাইতে গাইতে তিরতির করে বয়ে চলেছে সাতঘুরুং। জলের ধারের স্বাভাবিক ঠাণ্ডা, আর মৃদু একটু হাওয়াও। জয়মালিকা বলে, পরের বার আসবেন যখন, পাতাপাড়ায় নিয়ে যাবো। গ্রামের ঠিক ভেতরে নয়, ঢোকবার মুখেই আমাদের অনেকটা জমি আছে। সেখানে ধান হয়, সব্জিও। শীতকালে ফুলকপি আর বাঁধাকপি। পাতাপাড়া ঠিক আদিবাসী গ্রাম নয়, যদিও আদিবাসীও আছে কয়েক ঘর। ওখানে কৃষিক্ষেত্র দেখতে পাবেন টানা, আপনাদের কল্পনার সাথে মিলে যাবে। কিন্তু ভাবকান্দির মতো আদিবাসী গ্রাম এরকমই।
চুপচাপ বসে থাকে ওরা তিনজন। কিছুক্ষণ পর সোমেশ্বর বলে, আচ্ছা ম্যাডাম, আপনাদের স্কুলে ছাত্রছাত্রী কতোজন?
মাঝখানে খানিকটা বেড়েছিলো, এখন আশপাশে আরও দুয়েকটা স্কুল হওয়ার পর কমে গেছে অনেক। শখানেক হবে।
আশপাশের স্কুলগুলোয় তার মানে ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে। আপনি বলছিলেন খুশিঝোরার আশপাশের মানুষদের সবাইকে মিলিয়ে খুশিঝোরা পরিবার। যারা অন্য স্কুলে ছেলেমেয়েদের পাঠাচ্ছে তারাও কী আপনাদের পরিবারের?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর জোরে একটা শ্বাস টানে জয়মালিকা। তারপর বলে, না, তাদের আর পরিবারের লোক বলি কী করে ! আসলে পনেরো বছর আগে যখন আমি এসেছিলাম সেই সময় থেকে এখন সময় তো খানিকটা বদলিয়েছে। আদিবাসী গ্রামগুলোর মূলত কোন পরিবর্তন হয়নি, এমনকী অন্য গ্রামগুলোরও তেমন কিছু নয়, কিন্তু বাইরের মানুষ এসেছে তো কিছু, আর এখানকার মানুষরাও বাইরে গেছে। টেলিভিশন আর মোবাইল ফোনের প্রভাব, কম হলেও, এখানেও তো পড়েছে। আপনি যদি কয়েকদিন এখানে থাকেন তাহলে বুঝতে পারবেন আঠেরো-উনিশ বছরের পর এখানকার ছেলেমেয়েদের কিছুই করার নেই। টাকাপয়সা আয় করার কোন উপায়ই নেই তাদের। কিন্তু তবুও তো চাহিদা বাড়ে। অনেকেই বড়ো শহরে চলে যায়, টাকাপয়সা পাঠায় বাড়িতে। দেখতে দেখতে একটা ব্যাপারী শ্রেণী – ট্রেডার ক্লাস – তৈরি হয়ে গেছে। যেখানে আপনি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলটা দেখেছেন, লক্ষ্য করলে দেখবেন, তার আশপাশে একটা ছোটখাটো বাজারের মতো। এইসব বাজারের মানুষরা কী আর খুশিঝোরা পরিবারে থাকে? খুশিঝোরা পরিবারে তো সদস্য তারাই, যারা হয় আদিবাসী অথবা একেবারেই চালচুলোহীন সাধারণ মানুষ।
এটা আমি বুঝি, বলে সোমেশ্বর, কিন্তু আমি আপনাকে প্রশ্নটা করলুম অন্য কারণে। দুদিন ধরে আপনার সাথে কম কথা তো হয়নি, কেমন যেন মনে হচ্ছিলো এখানকার মানুষরা সবাই আপনাদের পছন্দ করে, ভালোবাসে, কেউ কোন অসুবিধে করেনা কখনো। ব্যাপারটা কী সত্যি সত্যিই তাই? কেউ বিরোধিতা করেনা?
তা কী হয়? – বলে জয়মালিকা, বিরোধিতা করে, নিশ্চয় করে, কিন্তু আমরা কী করি তখন, তাই না? আপনাকে একটা ঘটনা বলবো, আপনি বুদ্ধিমান লোক, বুঝতে পারবেন। আপনি কী জানেন, বছর দুয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমাকে শিল্পকর্মের জন্যে একটা পুরস্কার দেয়?
হ্যাঁ জানি তো, শুনেছি, বলে সোমেশ্বর, নন্দলাল পুরস্কার।
খুশিঝোরার গা ঘেঁসে একটা খেলার মাঠ আছে লক্ষ্য করেছেন? ওটা খেলার মাঠ ছিলো না আগে, পড়েই থাকতো। বিশেষ কেউ যেতো না ওদিকে। এখানে যেমন হয়, খানিকটা খোলা জায়গা পড়ে আছে, কার জায়গা কেউ জানে না, লক্ষ্যই করে না কেউ, তেমন আর কী ! খুশিঝোরায় যে ধরণের টয়লেট আছে প্রথম থেকেই, সেরকম টয়লেট আগে তো এখানে ছিলোই না, এখনো খুবই কম। নারীপুরুষ প্রায় সবাই টয়লেট হিসেবে এখনও ব্যবহার করে মাঠ। আমাদের যখন সেপটিক চেম্বার তৈরি করা হয়েছিলো পাঁচিলের ধার ঘেঁসে, বোধ হয় তখন কিছু খামতি ছিলো সেই কাজে। যে কোন কারণেই হোক, বছর তিনেক আগে থেকে আমাদের সেপটিক চেম্বারের ময়লা বেরিয়ে এসে পাঁচিলের ধার ধরে ঐ মাঠে এসে পড়া শুরু হয়েছিলো। আমরা কেউই জানতাম না ব্যাপারটা, খেয়ালই করিনি। খেয়াল করা উচিত ছিলো, কিন্তু করিনি।
নন্দলাল পুরষ্কারটা যেদিন দেওয়া হবে আমাকে তার আগের দিন সন্ধ্যেবেলা আমার কলকাতায় যাওয়ার কথা। বিকেল তিনটে নাগাদ ট্রেন। যখন বেলা প্রায় বারোটা, কুড়ি-পঁচিশ জন ছেলে এসে আমাদের গেটে ধাক্কাধাক্কি শুরু করলো। কী ব্যাপার? কারা এরা? বেরিয়ে দেখি বেশির ভাগকেই চিনি না, কিন্তু মুখচেনা দুয়েকজনকে দেখতেও পেলাম। ঐ যে আপনাকে বলছিলাম যে স্কুলটা আপনি দেখেছেন, যার আশপাশে একটা বাজারের মতো গড়ে উঠছে কিছুদিন ধরে, সেই অঞ্চলের ছেলে এরা সব। এরা ঠিক করেছে ঐ খোলা মাঠটায় ওরা খেলবে এখন থেকে। মাঠটা তাই পরিষ্কার করতে গিয়েছিলো, কিন্তু করতে গিয়ে ময়লাটা দেখতে পেয়েছে ওরা। আমিও দেখলাম। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আমাদের এখানে এই ধরণের ময়লা পরিষ্কার করার লোক পাওয়া মুশকিল। বান্দোয়ানে গিয়ে হাসপাতাল পরিষ্কার রাখে যারা তাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে, তারা লোক জোগাড় করে পরিষ্কারও করবে, আর এই কাজ যারা করে সেরকম মিস্ত্রী যোগাড় করে সেপটিক চেম্বারটাও সারিয়ে দেবে। ছেলেদের বললাম তিন-চার দিন সময় দাও আমাদের, পরিষ্কার করিয়ে দেবো।
ছেলেগুলো আসলে গণ্ডগোল করার মতলবেই এসেছিলো। বললো, চব্বিশ ঘন্টা সময় দিচ্ছি, তার মধ্যে না হলে আগুন জ্বালিয়ে দেবো। এখানকার এস-ডি-পি-ও কে চিনতাম আমি, ডি-এস-পি কেও চিনি, খবর দিলে হয়তো সাহায্য পেতাম, কিন্তু সে রাস্তায় যাইনি। সেদিন গেলাম না কলকাতায়। একজন মিস্ত্রীকে চিনতাম, যে আমাদের টয়লেট অনেকগুলো তৈরি করেছে। খোঁজ করে করে তাকে ধরলাম, সেপটিক চেম্বার সারাবার ব্যবস্থাটা হলো। বান্দোয়ানের হাসপাতালে গেলাম, কোনই ব্যবস্থা করা গেলো না। মিস্ত্রী বললো, কাউকে দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করিয়ে যদি ঢাকাঢুকি দিয়ে কোথাও রেখে দিতে পারি, ও পরের দিন সেগুলো সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দেবে। তারপর কী করলাম জানেন? গোটা কয়েক ড্রাম কিনে বান্দোয়ান থেকে ফিরলাম।
পরের দিন নন্দলাল পুরস্কার পাওয়ার কথা আমার। পুরোনো এক জোড়া সালোয়ার কামিজ পরে একটা কোদাল আর ড্রামগুলো সঙ্গে নিয়ে সকাল সাতটায় যেখানে ময়লাটা জমেছিলো সেখানে গেলাম আমি। উৎপল আমাকে চেনে, ও বললো আমাকে কিছু করতে হবে না, ও নিজে পরিষ্কার করবে সবটা। আমার ধমকে পিছিয়ে গেলো ও। জমে থাকা ময়লাটা কোদাল দিয়ে কেটে কেটে ড্রাম ভর্তি করতে শুরু করলাম আমি। ওপরের স্তরে ময়লাটা মাটির মতো, কিন্তু তার নীচেই? কী যেন একটা ভর করেছিলো সেদিন আমায়, নাহলে এতো জোর পেলাম কী করে? কোদাল দিয়ে কাটছি, আর ভরছি একটা একটা করে ড্রাম। আমার সর্বাঙ্গে ছিটে আসছে ঐ ময়লা, নাক চোখ মুখ মাথা বাদ থাকছে না কিছুই। ভাবতে পারেন ঐ ময়লা ছিটে এসে লাগছে আমার ঠোঁটেও ! কিন্তু আমার কাজ করেই চলেছি আমি। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম অবিশ্রান্ত জল ঝরছে আমার চোখ থেকে, নাক থেকে ! হে ভগবান, আমায় শক্তি দাও ! হে মাতা ধরণী, আর কতো পরীক্ষা নেবে আমার ! বেলা দশটার মধ্যে সব ময়লা সাফ হয়ে গেলো। উৎপল জল নিয়ে এলো, জল ঢেলে পরিষ্কার করলাম সমস্ত জায়গাটা। বড়ো বড়ো জেরিক্যানে ফিনাইল কেনা থাকে আমাদের। সমস্ত জায়গায় ফিনাইল ছড়ালাম। ওই যে বীর ছেলেরা যারা আগুন জ্বালাবে বলেছিলো তারা দূর থেকে দেখছে আমার কাজ। আমাদের মাটি জমানোই থাকে, বাগান করি, চাষ করি, মাটির কী অভাব ! লকি আর শুকি ঝুড়ি ভর্তি করে মাটি এনে দিলো। ফিনাইলের পর অন্য একটা কোদাল দিয়ে সেই মাটি সমান করে চাপিয়ে দিলাম জায়গাটায়। ময়লা ভর্তি ড্রামগুলো খেলার মাঠে নিয়ে গিয়ে দূরের পাঁচিলের গায়ে যে গাছ আছে তার ঝোপে রেখে ঢাকা দেওয়া যখন শেষ হলো তখন বেলা সাড়ে বারোটা।
বাংলা অ্যাকাডেমীর মঞ্চে রাজ্যপাল যখন আমার গলায় পরিয়ে দিচ্ছিলেন একটা শাল সন্ধ্যেবেলায়, তিনি কী জানতেন সেদিন সকালে আমি কী শিল্পকর্ম করছিলাম !
এই এপিসোডে আমার মন ভরে গেল।
যত পড়ছি তত মুগ্ধ হচ্ছি।