আমরা সবাই ছেলেবেলায় সন্ন্যাসীর সংসার করা নিয়ে একটি প্যারাবল পড়েছি। সেই এক যে ছিল সন্ন্যাসী, মনে বৈরাগ্য জেগে ওঠায় ঘরবাড়ি ছেড়ে সে গেল জঙ্গলে তপস্যা করতে। কিন্তু ইঁদুরে তার কৌপীন কেটে অতিষ্ঠ করায় সে নিয়ে এল বেড়াল। শুরু হল তার অনিবার্য চক্র। বেড়াল পুষতে দুধের জোগান, দুধের জন্য গরু পোষা, গরুর জন্য সবুজ ঘাস ও চারা। এই করতে করতে সন্ন্যাসী ক্রমশঃ গৃহস্থ হয়ে গেল।
শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘বৃত্তরৈখিক’ উপন্যাসটি, এক অর্থে, সেই প্রাচীন প্যারাবলের আধুনিক রূপ। এই ধারাবাহিক উপন্যাস ৫৮টি পর্বে বিধৃত।
ছোটখাট এপিকের মত এই উপন্যাসটির কালখণ্ডের বিস্তারও কয়েক দশক ধরে। প্রাক-স্বাধীনতা থেকে নব্বইয়ের দশক। দুটো এলাকার মধ্যে পাঠক ঘোরাফেরা করবেন—রাঢ়বাংলায় ঝাড়খণ্ডের সীমান্তের আদিবাসীবহুল এলাকার বনভূমি, সেখানকার বান্দোয়ান ব্লকের একটি অবহেলিত বনগ্রাম খুশিঝোরা, এবং মহানগর কোলকাতা।
কালখণ্ডের কথা বললে বলতে হয় বাংলার সেই সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাসের কথা। লেখক ছুঁয়ে গেছেন বিপ্লবীদের স্বদেশী আন্দোলন এবং পাশাপাশি স্বাধীনতার এবং দেশগঠনের স্বপ্ন চোখে সাদাসিদে জীবনযাপনে অভ্যস্ত কিছু মানুষের কথা, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় হয়ত কংগ্রেস—কিন্তু বোঝা যায় সে’কথা অবান্তর।
একইভাবে আসে স্বাদীনতার দুই দশক পর স্বপ্নভঙ্গের কথা, এবং তরুণদের ফের নতুন স্বপ্ন দেখা যার নাম নকশাল আন্দোলন—তার বর্ণনা পাই স্বল্প ক’টি লাইনে।
“হিন্দু হোস্টেলের আড্ডাটা এবার ছড়িয়ে পড়লো পুরো প্রেসিডেন্সী কলেজেই। কয়েকজন ছাত্রের বহিষ্কার আর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্সে ভর্তির নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো কলকাতা আর তার আশপাশের কলেজগুলোয়। প্রেসিডেন্সী কলেজের লন, ছাত্রদের সবাই মিলে বসে আলোচনা করার নতুন জায়গা, ভবিষ্যতে যা প্রেসিডেন্সী কনসোলিডেশন নামে পরিচিত হবে, যেন বিপ্লবের প্রস্তুতি শিবির”।
তারপর আখ্যানের বড় অংশটি জুড়ে আমরা পাই আজকের কোলকাতা ও বাংলাকে; উন্নয়নের নামে গড়ে তোলা হয় একের পর এক হাইরাইজ, ফ্লাই ওভার ও মল। বন কেটে বসতের গল্পে প্রান্তিক মানুষেরা সরে যায় আরও ওধারে, মুখ লুকোয় প্রায় জঙ্গলের পশুপ্রাণীর মত।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জয়মালিকা সেন, ওই পাহাড়ি রুক্ষ অনুর্বর বনভূমির কুরুখ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে বড় হয়। তার দাদু , সম্ভবতঃ পরাধীন ভারতে কোলকাতা থেকে পালিয়ে আসা এক নিঃসঙ্গ বিপ্লবী বাঙালি যুবক, যে এসে কুরুখদের মধ্যে আশ্রয় পায়, ওদের আরণ্যক জীবনযাপন ও মেঠো খাদ্যাভ্যাস রপ্ত করে; ওদের মেয়ের সংগে ঘর বাঁধে। কিন্তু ভোলে না মহানগরীতে অর্জিত প্রথাগত শিক্ষা এবং বাংলা ও ইংরেজি ভাষা। তার সন্তান হেমন্ত মায়ের ইচ্ছায় বড় হয় কুরুখ নয়, বাঙালি পরিচয়ে। শিখে নেয় বাবার ভাষার ঐশ্বর্য কিন্তু ভালবাসে কুরুখ সমাজ ও সংস্কৃতিকে।
এলাকাটি প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে ধনী। জার্মানদের তৈরি কারখানার উদ্ঘাটনের দিন ঘটনাচক্রে এক বাঘের ব্লাস্ট ফার্নেসে লাফিয়ে পড়ে ঝলসে ছাই হয়ে যাওয়ার প্রতীক আমাদের অভিভুত করে রাখে। স্বাধীনতার পর পাবলিক সেক্টর। ফ্যাক্টরি, স্কুল এবং ছোটখাট শিল্পনগরী—ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও হাসপাতাল। হেমন্ত খাপ খায় না শিল্পনগরীর সংস্কৃতিতে।
মেয়ে জয়ী বা জয়মালিকা শিল্পীর বিরল প্রতিভা নিয়ে জন্মেছে। অবাক হয়ে দেখে ওর বাবা আদিবাসী পরিচয়ের ভিত্তিতে সরকারি সুবিধে নিতে এবং মেয়েকেও সেই সহজ সুবিধে পাইয়ে দিতে অরাজী। কিন্তু ওর মনে অংকুরিত হয় আজকের গলাকাটা প্রতিযোগিতা ও ভোগবাদী সংস্কৃতির বীজ।
জয়মালিকা কোলকাতায় যায়, ক্রমশঃ পরিচিত হয় সেখানকার বিশিষ্ট শিল্পী সাহিত্যিক বৃত্তে। কিন্তু দ্রুত বুঝতে পারে শিল্পের একাগ্র সাধনা ওর যাপন বা অভীষ্ট কোনটাই নয়। নিজেকে চিনতে পারে –ও চায় খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা যত দ্রুত সম্ভব।
সারান্ডার কাছে এখানে ওখানে ঘুরতে ঘুরতে খুশিঝোরায় পৌঁছে আদিবাসী মেয়েদের ছবি এঁকে প্রদর্শনী করে ধীরে ধীরে পরিচিতি পায় জয়ী, কিন্তু প্রতিষ্ঠা ও অর্থ তখনও দূর অস্ত। বন্ধু-বান্ধব ও বিভিন্ন শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্যে গড়ে তোলে সাদামাটা কিন্তু প্রাণশক্তিতে ভরপুর এক ছোটখাট স্কুল। ওর দাদু ও বাবা হেমন্তও চাইত কুড়ুখদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার যা উন্নুয়নের এবং ক্ষমতায়নের প্রাথমিক শর্ত। একটি বৃত্ত পূর্ণ হল।
জয়মালিকার উদ্ভাবনী শক্তি এখানেই থেমে থাকে না। আদিবাসী ছেলেমেয়েদের স্বেচ্ছা শ্রমকে মূলধন করে সে শুরু করে গ্রীন এগ্রিকালচার। তার সংগে চলে জলাধার নির্মাণ ও জমির ক্ষয় আটকাতে এঁটোকাটা দিয়ে সারের কাজ করিয়ে রুক্ষ মাটিকে ক্রমশঃ উর্বর করে তোলা, ক্রমশঃ এক ছোট কিন্তু নিবিড় বনভূমি গড়া। এরপর জয়মালিকাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সাহায্য আসে, সরকারি ও বেসরকারি।
এবার সেই সন্ন্যাসীর মত সেও পথ হারায়। ক্রমশঃ মুল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে খ্যাতি ও সম্পত্তির প্রাপ্তিই তার লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এই রোলার কোস্টার যাত্রায় একের পর এক পথের বাঁকে হারিয়ে যেতে থাকে তার পুরনো সঙ্গী সাথীরা;-- তার বাবা, রঘুনাথ ও জলধর, নিলীন, সুদেশ ও বিকাস বসুর মত আরও অনেকে। হারিয়ে ফেলে হয়ত হলেও- হতে= পারত এক প্রেমকে। বৃত্তরেখা একটি কনসেন্ট্রিক কিন্তু আরও বড় বৃত্ত আঁকতে শুরু করে।
এদিকে তার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে সোমেশ্বর। নকশাল আন্দোলনের ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে সে বুঝেছে শিক্ষার গুরুত্ব। তাই অবসরের পর ও আর তার স্ত্রী সম্ভৃতা চাইছিল বিনা পয়সায় প্রান্তিক সমাজের শিশুদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের কোন প্রকল্পে যুক্ত হতে।
পৌঁছোন সোমেশ্বর খুশিঝোরায় । বুঝতে পারেন বাংলা আর ঝাড়খণ্ডের সীমানায় সাঁওতাল-মুণ্ডা-ওরাওঁ অধ্যুষিত এই জঙ্গলমহল অঞ্চলে এক মহিলা শিল্পী তাঁর আপাতপ্রকাণ্ড কর্মকাণ্ডের একটি অংশ হিসেবে চালান তাঁর ছোট স্কুলটি। জয়মালিকা সেনের কর্মকাণ্ডের ঠিক ঠিক মতো সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যাখ্যা খুঁজে পান না সোমেশ্বর।
“চমৎকার কথা বলেন এই শিল্পী মহিলা, মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা অনুচ্চারিত থাকে না। বনাঞ্চল, আশপাশের আদিবাসী এবং অন্যান্য প্রান্তিক মানুষদের বিষয়ে তাঁর আবেগ ধরা পড়ে তাঁর শিল্পকর্মে। স্কুলটিও এই আবেগেরই ফলশ্রুতি বলে মনে হয়”।
সোমেশ্বর ও সম্ভৃতা যোগ দেন জয়মালিকার আদিবাসী ছেলেমেয়েদের জন্য তৈরি বোর্ডিং হাউস স্কুলে। ভাল লাগে জয়মালিকার “মানুষের বর্জ্য গাছেদের ভোজ্য” শ্লোগান। ।
কিন্তু অচিরেই ওদের চোখে ধরা পরে ভেতরের ফাঁকি। বুঝতে পারে খুশিঝোরা ক্রমশঃ হয়ে উঠেছে এক ট্যুরিস্ট স্পট, ভাল আয়ের উৎস । তৈরি হয়েছে এক ডকুমেন্টারি যার কেন্দ্রে শুধু জয়মালিকার কৌশলী বিপণন; আদিবাসী বাচ্চারা তার পণ্য, আরেক পণ্য পরিবেশ সংরক্ষণ। “মোটের ওপর, এ ছবি যে দেখবে জয়িকে জনজাতির জননী ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে পারবে না সে !”
সোমেশ্বর খেয়াল করে বাচ্চাদের দিয়ে কুরুখ উপভাষায় ডাকঘর নাটক হয়েছে কিন্তু তার উদ্দেশ্য অতিথিদের মনোরঞ্জন ও শো-কেসিং। তাদের সংস্কৃতির চর্চা কোথায়? তাদের দেবতা ও বীরগাথা কোথায়? জলধরের শেখানো সাঁওতালি গানটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আর বাচ্চাদের শেখানো হচ্ছে নেহাতই দায়সারা ভাবে। জয়মালিকার এদের পেছনে সময় দেওয়ার উৎসাহ নেই। উৎপলের কথাই শেষ কথা। ওর নির্দেশে বাচ্চারা পড়ার চেয়ে বেগার শ্রম দেওয়ায় ব্যস্ত।
পারা নেমে যাচ্ছিল একটু একটু করে। সোমেশ্বরের বাচ্চাদের জুতো কিনেদেওয়ার ও রোজ একটা কড়ে ডিম সেদ্ধ খাওয়ানোর প্রস্তাবকে উপলক্ষ করে ঝড় ফেটে পড়ল খুশিঝোরায়।
উন্নয়ন ও পরিবেশ রাজনীতির দুই ভিন্ন মডেলকে লেখক ধরেছেন, স্বল্পকথার মুনশিয়ানায়।
আমার মত মুগ্ধ পাঠক একেবারে শেষপাতে সেই ঠোকাঠুকিকে উল্লেখ না করেই পারল নাঃ
--আমরা আদিবাসী ছেলেমেয়েদের আদিবাসী হিসেবেই মানুষ করতে চাই, এটা মনে রাখতে হবে।
--আদিবাসী হিসেবে মানুষ করতে চান? তাই তো চাওয়া উচিত, আমিও তো তাইই চাই। তাহলে ডিম খাওয়াতে অসুবিধে কোথায়? আদিবাসীরা ডিম খায় না বুঝি?
--ওদের বাড়িতে ওরা কী খেতে পায় সেটা তো ভাবতে হবে। যার পক্ষে যেটা স্বাভাবিক তাকে সেখানে রাখাই ভালো। সেখানে রাখা ! নিজের জায়গার রাখা !
-ঠিক, ঠিক, ঠিকই বলেছেন। --স্কুলে এসে পড়াশোনা করা, ঠিক ঠিক মতো বেড়ে ওঠার জন্যে স্বাস্থ্যকর খাওয়া আর খেলাধুলো করা – সে সবের বদলে গোয়াল পরিষ্কার করা খড় কেনা আর রাজমিস্ত্রীর যোগাড়েগিরি করা ! স্বাভাবিক ! এটাই স্বাভাবিক ! এটাই ওদের নিজের জায়গা !
--এতো কথায় গিয়ে লাভ নেই মাষ্টারমশাই, এখানে যদি থাকতে হয় আপনাদের, তাহলে মনে রাখতে হবে স্কুলটা উৎপলের, আর ওর কথা মতোই চলতে হবে।
রেডিওতে সকালে শোনা যায় বিশিষ্ট শিল্পী, শিক্ষাব্রতী ও পরিবেশবিদ জয়মালিকা সেনের রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পাওয়ার খবর। আর সোমেশ্বর দম্পতি রওনা হয় কোলকাতার উদ্দেশে। পথে গাড়ি আটকে এক বৃদ্ধ অনুরোধ করে ওর গ্রামে গিয়ে পড়ানোর কাজ চালিয়ে যেতে।
“কেমন যেন চেনা লাগে সোমেশ্বরের বৃদ্ধকে, মনে করতে পারে না কোথায় দেখেছে। বৃদ্ধটি কাছে এসে বলে, কাজটা যে শেষ হলো না মাষ্টারমশাই ! কাজটা, দেখতে পাচ্ছেন না ডাকছে আপনাদের দুজনকে”?
না, শেখরনাথ কোন ইচ্ছাপূরণের কাহিনী শোনাতে বসেন নি। নির্মম স্বল্পবাক শেখর ফিরিয়ে দেন ওই দম্পতিকে কোলকাতায়। কিন্তু পাঠক যে জয়িকে ও তার শিল্পী মনকে ভালবেসে ফেলেছে। বুঝতে পারি ও টলস্টয়ের সেই ‘একজন মানুষের কতটা জমিন চাই’ গল্পের নায়কের মত দৌড়ে চলেছে এক বৃত্তরৈখিক পথে। সূর্যাস্তের আগে যে ওকে বৃত্তটি সম্পূর্ণ করতে হবে!
নোটঃ এই আখ্যান আমার চেনা। প্রান্তিক মানুষের শিশুও বালকদের নিয়ে শো-কেসিং করে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পুরষ্কার আদায়ের বাণিজ্য আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি- হিন্দিভাষী অঞ্চলে এবং আমার ঘনিষ্ঠদের মাঝে। আর দেখেছি সোমেশ্বরের মত মানুষদের যারা লেখক শেখরনাথ ও আমার সমসাময়িক হবেন। কিন্তু এই বহুমাত্রিক আখ্যানকে কয়েকটি কন্সেন্ট্রিক বৃত্তের আকারে এঁকে ফেলা এক দুরূহ কাজ। লেখক শেখরনাথ সেই কঠিন সাধনায় সফল। অপেক্ষা করে থাকব পরবর্তী উপন্যাসের জন্যে। কারণ এইরকম একটা বিশাল উপন্যাসের চরিত্র এবং প্লট ও সময়কে সঠিক ভারসাম্য দিয়ে গ্রহণ ও বর্জনের মাধ্যমে পরিকল্পনা করার শিল্পে ওঁর দক্ষতা ঈর্ষণীয়।
সম্পূর্ণ উপন্যাসটি পড়ার জন্য এই লিঙ্কে ক্লিক করুন