বোম্বে মেল ভায়া নাগপুর ছেড়ে দিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। খড়গপুর ছাড়ানোর পর জিজ্ঞেস করে সুদেশ, খেয়ে নেবে?
ক্লান্তি আছে শরীরে। খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লেই হয়। ফার্স্ট এ-সি-র দুজনের কুপেতে নিজেদেরই রাজত্ব। অন্য কোন প্যাসেঞ্জারের সুবিধে-অসুবিধের সাথে মানিয়ে-টানিয়ে নিজেদের শোয়া বসার সময় ঠিক করতে হয় না। ইচ্ছেমতো খাও, দরজাটা টেনে হুক লাগিয়ে দাও, শুয়ে পড়ো।
জয়ির কিন্তু মন ভালো নেই একটুও। এত আরামের ট্রেন-জার্ণি, সেটা উপভোগ করার মতো ইচ্ছেও নেই একেবারেই। কলকাতার এগজিবিশনের নিদারুণ অভিজ্ঞতাটা গত এক মাস ধরে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ওকে, এক মুহূর্তও অন্য কিছু ভাবার উপায় নেই যেন। কী বিপুল পরিশ্রম সে করেছে ছ-সাত মাস ধরে; যা আঁকতে চেয়েছিলো জঙ্গলে তোলা ফটোগুলোর থেকে, মোটামুটি সবই এঁকেছে; পাহাড়ি খাড়িয়াদের রোজকার জীবন, উৎসব, জঙ্গলের সাথে তাদের সম্পর্ক, যৌথ লড়াই বাঁচার তাগিদে, এবং এই সমস্ত কিছুর অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য। এ ছাড়াও অন্তত কুড়ি-বাইশটা ছবি এঁকেছে ব্যক্তি-মানুষ খাড়িয়াদের। খাড়িয়া মানুষ এবং খাড়িয়া মানুষী। একা। ব্যক্তি খাড়িয়া নিজের চিন্তায়। অন্তর্সমীক্ষণে ! প্রসাধনে, স্নানে, মদ্যপানে, বিষাদে, এবং শিকারের অন্বেষণে। চোরোর বিয়েতে জয়ির সাথে একই ঘরে ছিলো বারো-তেরো বছরের যে তিনটি কিশোরী তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গোপন প্রসাধনের একটা অতর্কিত ছবি ছিলো ওর ক্যামেরায়। ওর ড্রয়িঙে সে ছবিও মূর্ত হয়েছে। এত ছবি থেকে বেছে বেছে তিরিশটা ছবি রেখেছিলো এগজিবিশনে। একটা ছবিও কিনলো না কেউ !
শুধু যে ছবি কেউ কেনেনি তা-ই তো নয় ! এতগুলো খবরের কাগজ আর পত্রিকায় নিজে গিয়ে সম্পাদক আর যাদের যাদের চিনতো, উদ্বোধনের দিনে আসার জন্যে নেমন্তন্ন কোরে এসেছিলো তাদের। কোনও কাগজে, কোনও পত্রিকায়, কেউ একটা মন্তব্যও করলো না ! এ ছাড়াও কলকাতায় ওর চেনা-জানা লোক তো কম নেই। শিল্পসাহিত্য মহলে যারা ঘোরাঘুরি করে, যাদের মধ্যে অনেকেই কিছু-না-কিছু লিখেছে-এঁকেছে শাম্বর জন্যে, তাদেরও তো অনুরোধ করেছিলো আসার জন্যে, কতজনই বা এলো ! এমনকি এসেওছিলো যারা, ওর ছবির বিষয়ে ভালোমন্দ মন্তব্যই বা করলো তাদের মধ্যে কতো জন ! জঙ্গল নিয়ে, জঙ্গলে ওর যাওয়া-থাকা-সময় কাটানো, এ সব নিয়েও উৎসাহ দেখালো অনেকে, কিন্তু ছবির বিষয়ে খুব একটা গুরুত্বই কেউ দিলো বলে মনে হলো না। গুটিকয়েক লোক যারা এসেছিলো ওর এগজিবিশনে, তারা সবাই, ভূদেবদার ভাষায়, ক্যাজুয়াল ভিজিটর, অ্যাকাডেমি-রবীন্দ্র সদনে আসা লোকজন !
নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি জয়ি, কেঁদেছিলো সেদিন। এগজিবিশনের শেষ দিন বুক ভরা হতাশা আর কান্না নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুদেশের সাথে চলে গিয়েছিলো গঙ্গার ধারে, আর গোয়ালিয়র মনুমেন্টের অন্ধকারে বুক ভরা জমে থাকা কান্নায় ভিজিয়ে দিয়েছিলো সুদেশের শার্ট। একটা কথাও বলেনি সেদিন সুদেশ, শুধু চুপ করে বসেছিলো জয়ির হাতটা ধরে। কাঁদতে দিয়েছিলো তাকে, যতটা কাঁদতে পারে। ফেরার সময়, ট্যাক্সির নির্জনতায় নীরব জয়ির হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো, এই এগজিবিশনে তার একটাই পাওনা ! সুদেশ !
পরের দিন সুদেশ বললো, তোমার ছবির উৎকর্ষ বোঝার মতো বিদ্যে বা স্বাভাবিক বোধ আমার নেই, কিন্তু তোমার নিজের কী মনে হয়? গড়পরতা আর্টিস্টদের তুলনায় নিজেকে কোথায় রাখবে তুমি?
জানিনা, কিন্তু ছবি আঁকা ছাড়া আর কিছুই পারিনা, তাই ছবি এঁকেই নাম করবো, করবোই !
তোমার ছোটবেলার এক বন্ধুর কথা শুনেছি তোমার কাছে, সে-ও তো শুনেছি ছবিই আঁকে। তুলিকা। সে তো বোম্বেতে থাকে, তুমি বলছিলে পারিবারিক সূত্রে তার বর একটা আর্ট গ্যালারির মালিক, তা ছাড়া সে আর তার বর দুজনেই আর্টিস্ট, জে-জে স্কুলের গ্র্যাজুয়েট। এক কাজ করা যাক, আজ সন্ধ্যেয় ওদের সাথে টেলিফোনে কথা বলা যাক। বলবে?
সেই সন্ধ্যেতেই টেলিফোনে কথা হলো তুলি আর ওর বরের সাথে। মহেশ কীর্তিকর। প্রতিটি ছবির ছোট ছোট প্রতিলিপি সমেত যে ব্রোশিয়োর তৈরি করা হয়েছিলো এখানকার এগজিবিশনের জন্যে, সেটার একটা কপি আর উদ্বোধনের একটা নিমন্ত্রণপত্র যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি ওরা পাঠিয়ে দিতে বললো ওদের কাছে কোন একটা ক্যূরিয়রকে দিয়ে। জয়ির বাড়িতে টেলিফোন নেই, নেই সুদেশেরও। অতএব যেখান থেকে হোক জয়িই যেন ফোন করে আবার দিন তিনেক পর। তার মধ্যে পেয়ে যাবে ওরা জয়ির পাঠানো কাগজপত্র। তখন আবার কথা হবে।
কথা হলো জয়ির সাথে। এগজিবিশন হবে। হবে এক মাস পর মহেশদের গ্যালারিতেই, গ্যালারি-ও-মেরিনা। কিন্তু ব্রোশিয়োর তৈরি করতে হবে নতুন করে। কলকাতার ব্রোশিয়োরের লেখা-টেখাগুলো ওরা দেখে নিয়েছে, সেখান থেকেই ওরা নতুন করে লিখে নিতে পারবে। তুলি যে অ্যাড-এজেন্সীতে কাজ করে সেখানকার একজন কপিরাইটার লিখে দেবে, কিন্তু ছবিগুলোর বড়ো কপি চাই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন করে বড়ো কপি বানিয়ে ক্যূরিয়র করে দেয় যেন জয়ি।
তাড়াহুড়ো করে আবার কলকাতায় আসতে হলো জয়িকে। হাওড়া স্টেশনেই সুদেশ, সেখান থেকে সোজা বোর্ণ অ্যাণ্ড শেফার্ড। ক্যামাক স্ট্রীটের গেস্ট হাউজে ফিরে আধ ঘন্টার মধ্যেই তৈরি হয়ে ডালহৌসি স্কোয়ারের অফিসে বুড়ি ছুঁয়ে আবার বেরোনো। তিরিশটা ছবির বড়ো কপি ডেলিভারি নিয়ে ভালো করে প্যাক করিয়ে রেখেছে সুদেশ। সে রাতেই ক্যূরিয়রে সেগুলো পাঠিয়ে দিয়ে, ফোন তুলিকে।
কোথা থেকে বলছিস? – কাজের কথা হয়ে গেলে জিজ্ঞেস করে তুলি।
জি-পি-ও।
ও, কলকাতায় এসে গেছিস? আছিস কোথায়, গেস্ট হাউজে?
তাছাড়া আর কোথায় থাকি বল্, এতদিন পর জেঠুর বাড়িতে যেতে লজ্জা করবে।
আরে, আমি জেঠুর কথা ভেবে বলিনি, তোর যে সেই কে একজন আছে না, সু না কী যেন, সে সু আর তুই কু, দুজনে মিলে সুকু সুকু, সুবোধ না রে? ভাবলাম তার বাড়িতেই হয়তো...
রিসিভারটা কানে চেপে সুদেশের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে জয়ি বলে, ঠিক বলেছিস, সুবোধ, একেবারে মামাজ বয়, ওর বাড়িতে, বাবা ! একেবারে সুবোধ রে, সত্যি বলছি, দুদু খেতে কী ভালোবাসে !
মানে?
সে তোকে পরে বলবো।
আচ্ছা নে, তোর সাথে মহেশ কথা বলবে।
মহেশ বললো কলকাতায় ওর থাকাটা যদি দুয়েকদিন এক্সটেণ্ড করতে পারে জয়ি, তাহলে ভালো হয়। বড়ো কপি ছবিগুলো দেখে ও একটু কথা বলতে চায় জয়ির সাথে। কলকাতায় থাকলে সাথে সাথে ওর গেস্ট হাউজে কথা বলতে পারে। গেস্ট হাউজের ফোন নম্বরটা নিয়ে নিলো মহেশ।
থেকেই গেলো জয়ি। তৃতীয় দিন রাত্তিরে আবার তুলির ফোন, গেস্ট হাউজের ঘরে সরাসরি: এই যে সত্যবতীর নাতনী, কথা বল্ মহেশের সাথে।
দাঁড়া দাঁড়া, হঠাৎ এ রকম একটা সম্বোধন করলি কেন, এতদিন পর, আমি তো ভুলতেই বসেছিলাম।
ভুলতে তোকে দিচ্ছে কে? নে, কথা বল।
কলকাতায় ওর এগজিবিশনটার নাম ছিলো ড্রয়িংস অব জয়মালিকা। মহেশ বললো, এবার তোমার এগজিবিশনের নাম আমি দিতে চাই ড্রয়িংস অব আ ট্রাইবাল আর্টিস্ট। শুধু তাই নয়, নিমন্ত্রণপত্রে স্পষ্ট কোরে লেখা থাকবে ছবির বিক্রীর পঞ্চাশ শতাংশ খরচ করা হবে পাহাড়ি খাড়িয়া নামক লুপ্তপ্রায় জনজাতির কল্যাণার্থে। অন্য মাত্রা পাবে তোমার এগজিবিশন। রাজি?
দ্রুত ভাবতে থাকে জয়ি। বলে, সত্যিই তো, এ রকম ভাবে চিন্তাই করিনি আমি। তুমি আর্ট গ্যালারির মালিক, আমার চেয়ে অনেক ভালো বোঝো। তুমি যা বলবে, সেটাই ফাইনাল।
কী ভাবছো, জয়ি? খেয়ে নেবে?
সুদেশের কণ্ঠস্বরে চটকা ভাঙে জয়ির। আজ সারাদিন ধরে দুজনে একটা একটা করে প্যাক করেছে তিরিশটা ছবি। তারপর সেগুলোকে তিনটে স্যুটকেসে ভর্তি করা হয়েছে। এরকমটাই হবে, সুদেশ বলেছিলো। আর তাই, ফার্স্ট
এ-সিতে এ রকমভাবে যাওয়ার প্ল্যানটা ও-ই করেছিলো। তা না হলে ভালোভাবে নিয়ে যাওয়া যাবে না ছবিগুলো, প্লেনে নিয়ে গেলেও নয়। রিজার্ভেশনটা তাই ও-ই করিয়েছে।
জয়ি ক্লান্ত, কিন্তু ওর খিদে পাচ্ছে না। জানলার বাইরে অন্ধকার। কম্পার্টমেন্টের স্লাইডিং দরজাটা বন্ধ। একটা আয়না, তার নীচে স্টীলের পাতের খোলশের একটা স্ট্যাণ্ডের ওপর রেলের নিজস্ব ডিজাইনের একটা প্লেট বসানো, সুদেশের আনা খাবারের প্যাকেটটা যার ওপর। ঐ খোলসটার ভেতর দিয়ে আসলে চলে গেছে একটা জলের পাইপ, তার উপর বসানো একটা ওয়শ-বেসিন, প্লেটটা তুলে উলটিয়ে দিলেই হাত-মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা। সম্পূর্ণ প্রাইভেসি, পৃথিবীতে আর কেউ নেই, শুধু ওরা দুজন। জয়ি ভাবে, আর তাকায় সুদেশের দিকে। যখনই জয়ি অসহায়, হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ওর দিকে। হাত দুটো। টলতে টলতে খালাসিটোলা থেকে ফিরছে জয়ি, সুদেশ হাজির, আমার হাতটা ধরো। কলকাতার এগজিবিশনের পর হতাশ জয়ি কেঁদে আকুল, দুটো অবিচলিত হাত তার হাত দুটো ধরেছে, কিছুই তো চায়নি তার বদলে।
কথা না বলে সুদেশের একটা হাত টেনে নেয় জয়ি, নিজের দু হাতের মধ্যে পরম মমতায় রেখে দেয় সুদেশের হাতটা। তারপর আস্তে আস্তে নিজের শুকনো ঠোঁটদুটো ঘসে ওর হাতটায়, নিজের বুকের ওপর চেপে ধরে তারপর। সুদেশদা, গলাটা ফ্যাস ফ্যাস করে জয়ির, মুখের কাছে কান নিয়ে এলে তবে বোধ হয় শোনা যাবে। সুদেশদা, এত ভালোবাসো তুমি আমায়, নীরবে এত দিয়েছো, সব দুর্যোগ থেকে আগলিয়ে রেখেছো তোমার হাত দুটো দিয়ে, আজ তুমি আমাকে নাও সুদেশদা, নাও !
মৃদু হাসে সুদেশ। তোমাকে তো নিয়েইছি জয়ি। না নিলে কী জোর পেতাম? কিন্তু আজ আর কথা নয়। খেয়ে নাও। তোমার ঘুমের দরকার। আমারও।
আহা
সুন্দর