বোম্বের ভি-টি, মানে ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস স্টেশনে ট্রেনটা পৌঁছোলো সকাল দশটা নাগাদ। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছিলো তুলিকা আর মহেশ, দেখতে পেয়ে প্রায় দৌড়িয়ে চলে এলো ওরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলো সেখানটায়। তুলিকারা থাকে বোম্বের বড়লোকি পাড়ায়, কেম্পস কর্ণারে, স্টেশন থেকে বেশি দূর নয়। মহেশ নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলো, হাত ধরে টেনে জয়িকে বসিয়ে দিলো সামনের সীটে, নিজের পাশে। গাড়ি চালাতে চালাতে এক মুহূর্তের জন্যে পেছনে তুলির দিকে তাকিয়ে বললো, যাঃ, পুরো ব্যাপারটাই ভেস্তে গেলো!
কীরকম? – হাসি হাসি মুখে তুলির প্রশ্ন।
আরে, সব ব্রোশিয়োর-টোশিয়োরগুলো তো ফেলে দিতে হবে, নতুন কোরে সব ব্যাপারটাই করতে হবে তো আবার।
নতুন কোরে কেন? – জয়ির গলায় আতঙ্ক।
এই চেহারার মেয়েকে ট্রাইবাল আর্টিস্ট বলে চালাতে গিয়ে মারধর খাব নাকি ! – মহেশের গলায় কৃত্রিম আতঙ্ক।
পেছন ফিরে তুলিকার দিকে তাকিয়ে বলে জয়ি, আমার কিন্তু দোষ নেই তুলি, তোর বর প্রথম থেকেই লাইন মারছে,
তা-ও তো এখনো চান-টান করে পরিষ্কার-টরিষ্কার হইনি।
তুলি বললো, হুঁ, সাবান মাখিনি তবু, বল্ ! ফ্লার্ট করাটা আসলে এখন ওর প্রফেশনাল দায় হয়ে গেছে, মা ছাড়া কাউকেই ছাড়ে না। তারপর পাশে-বসা সুদেশকে বলে, সাবধানে রাখবেন মশাই প্রথম থেকেই, না হলে হয়তো দেখবেন এই এক মাসের মধ্যেই হাতছাড়া হয়ে গেছে।
হলে তো বেঁচে যাই, বলে সুদেশ, একটা এগজিবিশনই চুল পাকিয়ে দিলো আমার।
এইরকম হৈ হৈ করতে করতেই ওরা পৌঁছিয়ে গেলো তুলিদের বাড়ি। ষোল তলা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, দশ তলায় থাকে ওরা। ট্রেনে ব্রেকফাস্ট করেই এসেছে, খাওয়া দাওয়ার তাড়া নেই, চায়ের সাথে আড্ডা জমতে সময় লাগলো না।
মহেশের সম্বন্ধে আগেই কিছু কিছু জানতো জয়ি, কিন্তু সুদেশ খানিকটা অবাক হয়েই বললো, এরকম বাঙালির মতো বাংলা শিখলেন কী করে?
শিখলেন না, শিখলে। তা-ও কখনো কলকাতায় না গিয়ে ! কীভাবে? বলছি, বলে মহেশ। বিজ্ঞানী হোমি ভাবা সাহেবের নাম শুনেছো তো? খুব শিল্পপ্রেমী ছিলেন, বুঝতেনও খুব ভালো। এই যে এখানকার বিখ্যাত জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারি, ওঁরই অনুরোধে ওঁর এক আত্মীয় স্যর কাওয়াসজি এটা তৈরি করিয়েছিলেন একান্ন-বাহান্ন সালে; জাহাঙ্গীর ওঁর ছেলে, তাঁর নামেই জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারি। এখন লোকে ভুলে গেছে, কিন্তু জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারি হওয়ার বছর পাঁচেক আগে মহালক্ষ্মী অঞ্চলে একটা অ্যান্টিক শপ ছিলো, নাম ছিলো চৌধুরি অ্যাণ্ড কীর্তিকর। কীর্তিকরটা শুনেই আন্দাজ করতে পারছো নিশ্চয়ই, আমার পূর্বপুরুষ কেউ হবে। ঠিকই। আমার ঠাকুরদা। আর চৌধুরি কে? ভূতনাথ চৌধুরি। কলকাতার গভর্ণমেন্ট কলেজ অব আর্ট থেকে পাশ কোরে এখানকার জে জে স্কুলে চাকরি নিয়ে এসেছিলেন। কী ভাবে ভূতনাথের সাথে আমার ঠাকুরদার বন্ধুত্ব হয়েছিলো জানিনা, কিন্তু হঠাৎ একদিন সবাই দেখলো তাঁর মহালক্ষ্মীর বসতবাড়ির একতলায় যে কাপড়ের দোকানটা ছিলো, সেটা উঠে গিয়ে তার জায়গায় চৌধুরি অ্যাণ্ড কীর্তিকর, অ্যান্টিক মার্চেন্টস। বছর খানেকের মধ্যেই সে ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে বিশাল। আসলে, বোম্বের এই দক্ষিণ অঞ্চলটা তখনও ফ্যাশনেব্ল্ ছিলো, সাদা চামড়ার পয়সাওলা লোকদের, ফিনানশিয়াল ম্যাগনেট গুজরাতিদের, আর পার্সিদের যাতায়াত-থাকাবসা ছিলো এ দিকেই, আর ভূতনাথ চৌধুরির দৌলতে জে-জে স্কুলের ব্যাকিং তো ছিলোই চৌধুরি অ্যাণ্ড কীর্তিকর অ্যান্টিক মার্চেন্টসের ! বছরখানেক পর একতলা বাড়িটার আর একটা ঘর দোকানটার সাথে জুড়ে দেওয়া হলো, আর সেটা হলো চৌধুরি অ্যাণ্ড কীর্তিকর আর্ট গ্যালারি, ভূতনাথ চৌধুরি আর তাঁর ছাত্রছাত্রীদের একটা এগজিবিশন দিয়ে উদ্বোধন হলো সেটার।
আমার বাবার কাছে শুনেছি সে আমলে প্রাইভেট আর্ট গ্যালারি এদিকে ছিলোই না প্রায়, বেশির ভাগ আর্ট এগজিবিশন হতো জে-জে স্কুলেই। কলকাতা, বরোদা, ম্যাড্রাস, বোম্বে, প্রায় সব শহরেই ভূতনাথের বন্ধুরা তখন নামকরা শিল্পী, কাজেই প্রায় সারা বছরই চৌধুরি অ্যাণ্ড কীর্তিকর ব্যস্ত থাকতো কোন-না-কোন এগজিবিশনে। জাহাঙ্গির গ্যালারি খোলার পর আর্ট সিনটাই বদলে গেলো বোম্বেতে, চৌধুরি অ্যাণ্ড কীর্তিকরেরও ব্যবসা কমলো না, আরও প্রাইভেট গ্যালারি হলো, শিল্পীদের রমরমা ! কিন্তু বছর দশেক পর মুশকিল হলো আমাদের অ্যান্টিক ব্যবসাটার। জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারির বেসমেন্টে খুললো একটা অ্যান্টিক শপ, নটেশনস্। নটেশনস্ খোলার পরেই অ্যান্টিক ব্যবসাটা প্রায় মোনোপলি হয়ে গেলো ওদের। ভূতনাথ আর আমার ঠাকুরদা সিদ্ধান্ত নিয়ে অ্যান্টিকের ব্যবসাটা বন্ধ কোরে দিয়ে পুরোটাকেই গ্যালারি বানিয়ে দিলেন। আজও প্রাইভেট গ্যালারির মধ্যে বোম্বেতে চৌধুরি অ্যাণ্ড কীর্তিকর প্রায় এক নম্বর।
ঠাকুরদার এক ছেলে, উমেশ, আর ভূতনাথের এক মেয়ে, রুনুঝুনু। দুজনে প্রায় একই বয়েসি, খুব বন্ধুত্ব। ঠাকুরদার অনেকগুলো ভাইবোন ছিলো, তারা অনেকদিন অবধি ঐ মহালক্ষ্মীর বাড়িটাতেই থাকতো, ফলে বাড়িটা গমগম করতো। এ দিকে ভূতনাথের স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন কম বয়েসে, বাড়িটা ফাঁকাই প্রায়, অতএব ছোট বেলাটায় রুনুঝুনুর অনেকটা সময়ই কাটতো আমাদের বাড়িতে। বড়ো হয়ে উমেশ আর রুনুঝুনু দুজনেই ভর্তি হলো জে জে স্কুলে, উমেশ পড়লো আর্কিটেকচার, আর রুনুঝুনু ফাইন আর্ট।
জে জে স্কুলের পাঠ শেষ হলে আমার বাবা – নিশ্চয়ই বুঝেছো উমেশ আমার বাবার নাম – বোম্বে ম্যুনিসিপাল কর্পোরেশনে চাকরিতে ঢুকে গেলো আর ভূতনাথ চৌধুরি তাঁর মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন য়্যোরোপে। কোন বিশেষ আর্ট স্কুলে নয় কিন্তু, তাঁর অনেক বন্ধু ছিলেন য়্যোরোপে, তাদের তত্ত্বাবধানে পুরো কন্টিনেন্ট ঘুরে গ্রেট মাস্টার্সদের ছবি দেখা আর নানা সেমিনারে যোগ দেওয়া দু বছর ধরে; এটাই কাজ, এটাই হায়ার এডুকেশন। দু বছর পর যখন ফিরলো রুনু পিসি, তার মধ্যে আমাদের বাড়ির রেওয়াজ অনুযায়ী বাবার বিয়ে হয়ে গেছে, আরও বছর খানেক পর জন্মালাম আমি। আমার দখল নিয়ে নিলো রুনু পিসি। সত্যি কথা বলতে কী, বছর চোদ্দ বয়েস পর্যন্ত নিজের বাবা-মার চেয়েও রুনু পিসিকেই আমি চিনতাম বেশি। আমার যখন দশ বছর বয়েস, বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ একদিন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন ভূতনাথ। পৃথিবীতে তখন আমি ছাড়া রুনু পিসির আর কোন নিজের লোক নেই। এর মধ্যে যথেষ্ট নামডাক হয়েছিলো তার, সারাদিন শুধু ছবি আঁকা, এগজিবিশন আর আমাকে পড়ানো। রবীন্দ্রনাথ তো বটেই, আমার মনে হয় গড়পরতা বাঙালি ছেলেমেয়ে যে সব বই পড়ে বড়ো হয়, তার চেয়ে বেশিই পড়েছি আমি বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্য। এখনো গড়গড় করে মুখস্থ বলতে পারি পথের পাঁচালি আর হ-য-ব-র-ল-র অনেক লাইন ! এই হলো মোটামুটি আমার বাঙালি বনে যাওয়ার ইতিহাস।
কিন্তু রুনু পিসির কী হলো? তিনি কোথায়? – জিজ্ঞেস করে জয়ি।
রুনু পিসির কী হলো এক কথায় বলা মুশকিল, তাহলে কীর্তিকর ফ্যামিলির বাকি ইতিহাসটাও শুনতে হয় তোমাদের। ধৈর্য আছে?
সে তো তুমি শোনাবার মূডেই আছো বাপু, মন্তব্য তুলিকার।
ঠিক আছে, শোন। এর মধ্যে কর্পোরেশনের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে আমার বাবা, আর নিজের একটা ফার্ম খুলেছে আর্কিটেকচারের। ভূতনাথ মারা যাওয়ার পর আমার ঠাকুরদাও ভেঙে পড়লেন, একা একা আর্ট গ্যালারি চালাতে তাঁর আর ভালো লাগছিলো না। রুনু পিসিকে বারবার বলা সত্ত্বেও কোন উৎসাহ দেখালো না গ্যালারিটা চালানোর ব্যাপারে। বাবা চাকরিটা ছেড়েছিলো এই সব দেখেশুনেই। জুনিয়র ইঞ্জিনীয়ার-আর্কিটেক্ট যাদের নিয়েছিলো ফার্মটা চালাতেন প্রায় তাঁরাই, আর বাবা বেশির ভাগ সময়টাই দিতো চৌধুরি অ্যাণ্ড কীর্তিকর আর্ট গ্যালারিতে। ঠাকুরদা খুব একটা ব্যবসা করার মতো লোক ছিলেন না, পৈতৃক সূত্রে সম্পত্তি পেয়েছিলেন, নিজে ক্ল্যাসিকাল গান গাইতেন, আর বন্ধুর অভিভাবকত্বে গ্যালারিটা চালাতেন। আমার বাবা কিন্তু একেবারে ডাউন-টু-আর্থ, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আর্কিটেকচার ফার্মটা যেমন দাঁড়িয়ে গেলো, চৌধুরি অ্যাণ্ড কীর্তিকরও তেমন ফুলে ফেঁপে উঠলো। চৌধুরী অ্যাণ্ড কীর্তিকর তখন জয়েন্ট বিজনেস, ফর্টি পার সেন্ট রুনু পিসির, সিক্সটি পার সেন্ট বাবার। এই সময় পেডার রোডে আর একটা গ্যালারি খুললো বাবা, সেটা বাবার একার।
আমার যখন চোদ্দ বছর বয়েস, স্কুলের উঁচু ক্লাশে পড়ি, হঠাৎ একদিন বিলেত চলে গেলো রুনু পিসি, লণ্ডনে স্লেড স্কুল অব ফাইন আর্টে একটা টিচিং পোস্ট নিয়ে। সেই যে চলে গেলো, কারোর সাথে আর যোগাযোগও রাখলো না। কেন গেলো, কার ওপর অভিমান, কেউ বুঝলো না। বাবার বন্ধুবান্ধব অনেকেই বাবার অনুরোধে স্লেড স্কুলে খোঁজখবর নিতে গেছে রুনু পিসির, কারো কারো সাথে দেখাও হয়েছে, কথাবার্তা হয়েছে, কিন্তু ব্যস, ঐ পর্যন্ত। তারপর বহুদিন পর এখানকার এক অ্যাটর্ণি ফার্ম বাবার সাথে যোগাযোগ করে। এর মধ্যে রুনু পিসির বাড়ি বেচে দিয়েছে তারা। চৌধুরি অ্যাণ্ড কীর্তিকরের পার্টনারশিপটা ক্লোজ করিয়ে যা টাকাপয়সা রুনু পিসির শেয়ারে ছিলো সেটার সাথে বাড়ি বিক্রির টাকা যোগ কোরে জে জে স্কুলের জন্যে একটা ইনডাউমেন্টের ব্যবস্থা করার ম্যানডেট ছিলো তাদের। সেটাও হয়ে গেলো। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, তারপর থেকে আর রুনু পিসির কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। স্লেড স্কুলেও খোঁজ নিয়েছে বাবা, সেখানকার চাকরিতেও আর নেই রুনু পিসি, কোথায় আছে সে ব্যাপারে কিছু বলতে পারেনি ওরা। মার্টিন আর্চার নামে এক ব্রিটিশ পেন্টার একবার এসেছিলো এখানে, বাবার গ্যালারিতে একটা গ্রূপ এগজিবিশনে তারও কিছু কাজ ছিলো। বাবাকে বলেছে সে রুনু পিসির ছাত্র, সে নাকি শুনেছে কোন ব্যারনকে বিয়ে করে প্রায় অজ্ঞাতবাসের জীবন বেছে নিয়েছে রুনু পিসি, বেশির ভাগ সময়টা কাটায় কন্টিনেন্টে।
একদম পাতি বাঙালির মতো একটা প্রশ্ন করবো, ইচ্ছে না হলে জবাব না-ও দিতে পারো, বললো সুদেশ, একেবারেই অপ্রয়োজনীয় কৌতূহল; যেখানে তোমাদের অত বিখ্যাত গ্যালারি চৌধুরি অ্যাণ্ড কীর্তিকর, রুনু পিসির সাথে পার্টনারশিপ ক্লোজ করার পর এখন যেটা শুধু তোমাদেরই, সেই মহালক্ষ্মীর বাড়িতে না থেকে এখানে থাকো কেন তোমরা?
বললাম না, আমার বাবা পুরোপুরি ডাউন-টু আর্থ ! পেডার রোডের প্রপার্টি কেনার আগে ঠাকুরদার ভাইদের সাথে, মানে আমার বাবার কাকাদের সাথে, মহালক্ষ্মীর বাড়িটার ব্যাপারে ফিনানশিয়াল সেট্ল্মেন্ট করেছে, গ্যালারিটা এখন আরও বড়ো, একতলা আর দোতলা মিলিয়ে, শুধু তিনতলাটা আমাদের থাকার জায়গা। আমি জে-জে স্কুল থেকে বেরোবার পর বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলো কী করতে চাই আমি। আমার ভাবাই ছিলো, আমি বললাম আর্ট গ্যালারির ব্যবসাটায় ঢুকে যাবো। কোন কথা না বলে পেডার রোডের গ্যালারিটা, গ্যালারি-ও-মেরিনা, বাবা আমাকে দিয়ে দিলো, আমি হাণ্ড্রেড পার সেন্ট মালিক। আর সাবধান করে দিলো চৌধুরি অ্যাণ্ড কীর্তিকরে আমি যেন নাক না গলাই। গ্যালারি-ও-মেরিনা তখন এমনিতেই দাঁড়িয়ে যাওয়া, আমাকে বললো, তোমাকে একটা রানিং গ্যালারি দিয়ে দিলাম, না চালাতে পারলে তোমার দায়িত্ব। আর, কেম্পস কর্ণারে আমাদের এই যে আস্তানাটা দেখছ, এটা আমার নয়, বাবারও নয়। এটা তুলিকার। তুলিকার একার। আমাকে গ্যালারি দিয়েছে, বাবা এটা তুলিকাকে দিয়েছে বিয়ের উপহার হিসেবে। তাই কুঁকড়ে-মুকড়ে কোন রকমে থাকি আমি এটায়। প্রতি মাসেই এক তারিখে আমাকে তুলিকার ধমক খেতে হয়, আর চ্যারিটি নয়, পরের মাস থেকে রীতিমতো ভাড়া দিতে হবে !
সবাই যখন হাসিতে যোগ দিয়েছে, তখন মুখ গম্ভীর করে ডান হাতটা তুললো মহেশ। এবার তোমাদের একটা কথা বলে রাখি, বলছি সুদেশ আর জয়মালিকাকে। অন তুলিকাজ বিহাফ। ও হয়তো লজ্জা পাবে, আমিই বলে দিই। কারণ ও হয়তো এখনো পুরোপুরি মারাঠি হতে পারেনি, কাজেই এই পাতি – পাতি কথাটা সুদেশের কাছ থেকেই ধার করলাম – পাতি মারাঠি কথাটা আমাকেই বলতে হচ্ছে। তুলিকার এই কনজার্ভেটিভ মারাঠি অ্যাপার্টমেন্টে লিভ-ইন রিলেশনশিপ প্রোহিবিটেড। তোমাদের এই প্রথম বারের ভিজিটে অনেক টেনেটুনে এক মাসের গ্রেস দেওয়া গেলো। এই এক মাস আমরা কষ্ট করে চোখ বুজে থাকবো, বিশেষ বিশেষ সময়ে তোমাদের দিকে তাকাবো না। কিন্তু ফিরে যাওয়ার আগে ফুল-ফ্লেজেড লিগালী ম্যারেড হাজব্যাণ্ড-অ্যাণ্ড-ওয়াইফ কাপ্ল্ বনতে হবে তোমাদের। অ্যাণ্ড অল কাইণ্ডস লিগাল, অর্গানাইজেশনাল অ্যাণ্ড মরাল সার্ভিসেস উইল বী অ্যাভেলেব্ল্। ফর ফ্রী !
বিকেলে সবাই মিলে গ্যালারি-ও-মেরিনা দেখতে গেলো পেডার রোডে। এটাও হাই-রাইজ অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, সামনের দিকের গ্রাউণ্ড ফ্লোরে দুটো ফ্যাশনেব্ল্ শো-রূম, দোতলায় মহেশের গ্যালারিটা। কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়তে হয়, সামনের দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে প্রায় বাক্স্ফুর্তি হয় না ! পুরো দেয়াল জুড়ে হুসেনের বিখ্যাত এক ঘোড়া। মহেশ বললো এই গ্যালারির প্রথম এগজিবিশন হুসেনের। কী মূড ছিলো কে জানে, হুসেন নিজেই প্রায় এক মাস কাজ করে এই ঘোড়াটা করেছিলেন এগজিবিশনের আগে। এই কাজের আর্থিক মূল্য কতো হবে কে জানে, হুসেন এক পয়সাও নিতে চাননি এটার জন্যে। বাবাকে বলেছিলেন, আমি নিজের আনন্দে করেছি, তুমি তো কমিশন করনি আমাকে ! অনেক ধরাধরি করে শেষ পর্যন্ত একটা ফরেন ট্রিপের টিকিট কিনে দিয়েছিলো বাবা, কিন্তু বুঝতেই পারো, এ কাজের দামের কাছে সেটা কিছুই নয়।
গ্যালারির রিসেপশনে একটা বড় স্কালপচার, হয়তো সরস্বতী। রিসেপশনিস্ট ওদের দেখে মিষ্টি হাসলো, গূড ইভ্নিং। মূর্তিটার ঠিক উল্টো দিকে দেয়াল-জোড়া একটা হোয়াইট বোর্ড। তাতে লেখা প্রোগ্রাম্স্ ফর দ্য কারেন্ট মান্থ। আগামী কাল পয়লা ফেব্রুয়ারি, কিন্তু ফেব্রুয়ারির সব প্রোগ্রাম এর মধ্যেই লেখা হয়ে গেছে। জয়ি লক্ষ্য করে আঠেরোই ফেব্রুয়ারিতে লেখা আছে ড্রয়িংস অব আ ট্রাইবাল আর্টিস্ট।
ভেতরে ঢুকলো ওরা। বিরাট হল। অনেক রকমের পার্টিশনের ব্যবস্থা, একসাথে প্রায় সাত-আটটা এগজিবিশন চলতে পারে। কিন্তু সবটাই ফাঁকা। মহেশ বললো আজ মাসের শেষ দিন, দ্য ডে অব প্রিপারেশন ফর দ্য নেক্সট মান্থ। সোমবারের উইকলী হলিডে ছাড়াও মাসের প্রথম এবং শেষ দিন আমরা কিছু এগজিবিট করি না। প্রতি মাসের প্রথম দিন আমাদের এখানে একটা প্রেস মীট হয়, যেখানে সারা মাসের প্রোগ্রাম আমরা জানিয়ে দিই। যাঁদের এগজিবিশন হবে, তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ থাকেন তখন। ইনফর্মাল একটা গেট-টোগেদার গোছের, ফলোড বাই ককটেল্স্। এই পি-আর এক্সার্সাইজটা আমিই শুরু করেছি, বাবা যখন চালাতো তখন হতো না। ভালোই মাইলেজ পাওয়া যাচ্ছে।
রিসেপশনের পাশের ঘরটাই মহেশের। দরজা ঠেলে সেখানে ঢুকলো ওরা। মহেশের বিরাট ডেস্কটার সাথে কোনাকুনি কোরে অপেক্ষাকৃত ছোট একটা ডেস্কে বসে কাজ করছে সুদর্শন একটি ছেলে। মহেশকে দেখে একটু হেসে কয়েকটা টাইপ-করা কাগজ সে এগিয়ে দেয়। মহেশ বসে পড়লো নিজের ডেস্কে কাগজগুলো নিয়ে। মিনিট দশেক পর সই-টই করে কাগজগুলো ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, চলো, আমরা যাই।
গ্যালারি থেকে বেরিয়ে মহেশ বলে, কোথায় যাবে এখন?
জয়ি বললো, চলো, জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারিটা দেখে আসি।
যাবো, জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারিটাই আমার মাথায় আছে, বলে মহেশ – এবং সোজা জয়ির দিকে ফিরেই বলে এবার – তুলির কাছে তোমার সম্বন্ধে যা শুনেছি তার ভিত্তিতেই তোমাকে একটু সাবধান করার প্রয়োজন আছে আমার। কলকাতার সিনটা ঠিক জানি না, কিন্তু একটা কথা জেনে রেখো, বোম্বেতে আর্টকে কেন্দ্র করে যে কমার্শিয়াল ব্যাপারস্যাপারগুলো আছে, সত্যি কথা বলতে কী, সেগুলো একটু আপমার্কেট কার্যকলাপ। যেমন ধরো, সাধারণ একজন শিল্পী যদি তার ছবির প্রদর্শনী করতে চায়, তার মুশকিল আছে। যেমন-তেমন আর্ট গ্যালারিতেও স্পেস পেতে যথেষ্ট পয়সা খরচ করতে হয়। পয়সা ছাড়াও, মোটামুটি নামটাম না হলে পাত্তাই পাওয়া যায় না। যার অন্তত কিছু ছবি বিক্রী হবে কিনা নিশ্চয়তা নেই, স্পেসের পয়সা যোগাড় করতে পারলেও তার পক্ষে স্পেস পাওয়া শক্ত, পাত্তাই দেবে না কেউ। এ ছাড়া আরও নানা আনুসঙ্গিক খরচ আছে, সবটার ডিটেলে আমি যাচ্ছিনা। তো, তুলির কাছে আমি যা শুনেছি, তা হলো স্ট্রাগলিং আর্টিস্ট যারা তাদের সম্বন্ধে একটু বিশেষ উইকনেস আছে তোমার, মানে, আমাদেরও নেই তা নয়, কিন্তু তোমারটা একটু স্পেশালি অ্যাগ্রেসিভ কাইণ্ড, আসলে ওদের সাথে তোমার একাত্মতার বোধটা প্রবল।অ্যাম আই রাইট?
খুব যে ভুল বলছো তা নয়, বলে জয়ি।
এই যে জাহাঙ্গীর গ্যালারি, এটা কিন্তু একেবারেই এলিটিস্ট, আর তার ফলে স্ট্রাগলিং আর্টিস্টদের অনেকদিনের টার্গেট। গ্যালারির বাইরের ফুটপাথে অনেকবার অনেক আর্টিস্ট ছবি বিক্রী করার চেষ্টা করেছে, হঠাৎ হঠাৎ একটা মেকশিফ্ট্ এগজিবিশন লাগিয়ে দিয়েছে, আর তারপর বুঝতেই পারছো, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ভাগিয়েও দিয়েছে তাদের। এই ধরণের গণ্ডগোল প্রায়ই লেগে থাকে ওখানে। আর মজা হচ্ছে, বেশ কিছু এস্ট্যাবলিশড আর্টিস্টও ওদের সাপোর্ট করেন। আমাদের জে জে স্কুলের ছেলেমেয়েরাও অনেকে আছে এদের মধ্যে। পার্সোনালি আমিও মনে করি, এদের আটকানো উচিত নয়, এদের যদি সত্যি সত্যিই ঐ ফুটপাথে ছবি দেখাতে এবং বিক্রী করতে দেওয়া হয় তাহলে এদেরও ভালো হবে, আর্টের ব্যবসারও কোন ক্ষতি হবে না, সব কিছু যেমন চলছে তেমনই চলবে, হয়তো আর্টের পক্ষেও ভালোই হবে শেষ অবধি, কিন্তু সেটা অন্য কথা। তোমাকে যেটা আমি বলতে চাই, সেটা হলো ওখানে যদি এ ধরণের কোন ঘটনা ঘটে, তোমাকে একেবারে নির্বিকার থাকতে হবে, কারো সাথে কথা বলাও চলবে না, বুঝলে?
কেন, কথা বললে কী ক্ষতি?
তোমাকে আমি লুকিয়ে রাখতে চাই, শীল্ড করে রাখতে চাই। এই বোম্বে শহরে কাকপক্ষীরও জানার প্রয়োজন নেই যে জয়মালিকা নামের এক সুন্দরী যুবতী এখন এই শহরেই কিছুদিনের জন্যে বসবাস করছেন।
মানে?
মানে, এই সুন্দরীর মুখদর্শন করার জন্যে বোম্বের নাগরিককে আরও কিছুদিন ধৈর্য ধরতে হবে।
এটা কী ওর পেছনে লাগার জন্যে বলছো, না তুমি সীরিয়স? – প্রশ্ন করে সুদেশ।
সীরিয়স, ড্যাম সীরিয়স, বললো মহেশ, আমাদের এখানে সেপ্টেম্বর মাসে একটা বড় উৎসব হয়, গণেশ চতুর্থী। বিরাট বড় বড় গণেশের মূর্তি আরও বড়ো প্যাণ্ডেলে সাজানো হয়। কিন্তু যতদিন না কোন ডিগনিটারী এসে অফিশিয়ালি উদ্বোধন করছেন ততদিন পাবলিক দেখতে পায় না সেই মূর্তি। চাদরের মতো কিছু একটা মূর্তিটার সামনে টাঙিয়ে দিয়ে মূর্তিটাকে আড়াল করা হয়। তারপর উদ্বোধনের দিন উদ্বোধক চাদরটা সরিয়ে দেন, উৎসব শুরু হয়ে যায়। জয়ির মুখের সামনেও আমি একটা চাদরের আড়াল রাখছি। ওর এগজিবিশনের দিন রিসেপশনের সময় চাদরটা সরানো হবে।
কিন্তু এত সব কেন? – খানিকটা অসহিষ্ণু প্রশ্ন জয়ির।
শ্রীমতি, আপনি কী আয়নায় কখনো দেখেছেন নিজেকে? আমার জানা এমন কোন ভারতীয় উপজাতি নেই যার সাথে বিন্দুমাত্রও মিল খুঁজে পাওয়া যাবে আপনার চেহারার। আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন আপনার ব্রোশিয়োরেও কোন ছবি দেওয়া হয়নি আপনার। এ সব কেন? আমাদের ট্রাইবাল আর্টিস্টকে আমরা এখনই দেখাবো কেন? আপনি তো প্রদর্শনীর দিন সারাণ্ডার জঙ্গল থেকে হাজির হবেন, আর তারপর রিসেপশনের সময় বিস্মিত সংবাদমাধ্যমের সামনে নিজের জন্মের গোপন কথাটি মেলে ধরবেন ! বোঝা গেলো?
হেসে ফেলে জয়ি, চলুন, নীরবে দেখে আসি জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারি।
চমৎকার এগোচ্ছে
পড়ছি।