পাকস্পর্শ এবং আরও দু-একটা ছোট খাটো অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর যদুগোপাল ফিরে এলো হাওড়ায়। একা। পিতৃগৃহে ফিরে না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা তার নিজস্ব, তার স্ত্রীর নয়; তা ছাড়া জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে তার কর্তব্যপালনেও সে অঙ্গীকারবদ্ধ; স্ত্রীকে সে তার বাবার সাথে সারিখোলে পাঠিয়ে দিলো, শ্বশুর-শাশুড়ীর প্রতি পুত্রবধূর কর্তব্যের বিষয়ে নবপরিণীতাকে সম্যক উপদেশ দিয়ে। হাওড়ায় আসার পর শশধরের বাড়িতেই সে উঠলো প্রথম, তারপর তাঁরই চেষ্টায় তাঁর এক যজমানের বাড়ির এক অংশে স্থান হলো তার।
এই পরিবারটি ধনী। পরিবারের কর্তা যিনি, তিনি ডাক্তার, নাম দুর্গাচরণ মৈত্র, শশধরকে দাদা সম্বোধন করেন, আগেই পরিচয় হয়েছিলো যদুগোপালের সাথে, তাকেও যথেষ্ট স্নেহ এবং সমীহ করেন তিনি। তিনি প্রস্তাব দিলেন, তাঁর বাড়ির প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহটির নিত্যপূজা করবে যদুগোপাল, এবং তারই বিনিময়ে বাড়ির সম্পূর্ণ একতলাটির দখল নেবে সে। যদুগোপাল আপত্তি জানায়, শুধুমাত্র নিত্যপূজার বিনিময়ে বাড়িটির অত বড় অংশে থাকতে সে রাজি নয়, সে কিছু অর্থমূল্যও দিতে চায়। অবশেষে শশধরের মধ্যস্থতায় মাসিক চার টাকা ভাড়া নিতে রাজি হন ডাক্তার দুর্গাচরণ।
ভাড়া বাড়িতে উঠে এলো যদু, এবং স্বপাক ভোজন শুরু করলো শশধরের স্ত্রীর আপত্তি সত্ত্বেও। জ্যাঠাইমাকে সে বোঝালো ধীরে ধীরে স্বনির্ভরতা অভ্যাস করা প্রয়োজন তার এখন, তাই স্বপাক ভোজন, কিন্তু মাঝে মাঝেই জ্যাঠাইমার কাছে ব্রাহ্মণভোজনের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করবে সে।
সাকুরি গ্রামের প্রমথ বিশ্বাস মাঝে মাঝেই কলকাতায় আসে, এখান থেকে নানা রকমের জিনিসপত্র কিনে সে নিয়ে যায়, গ্রামে তার দোকান আছে, আশপাশের কয়েকটা গ্রামের মানুষের প্রয়োজনের নানা সামগ্রী তার কাছে পাওয়া যায়। খোঁজ কোরে কোরে কয়েকমাস পর সে একদিন দেখা করলো যদুগোপালের সাথে। কালিকাপ্রসাদ যদুর আহার-বাসস্থানের ব্যবস্থার ব্যাপারে তাকে খোঁজ নিতে বলেছেন, বিয়ের পরেও সে কেন কষ্ট কোরে হাত পুড়িয়ে খাবে, এ কথা জিজ্ঞেস করেছেন, আর বৌমাকে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন কিনা জানতে চেয়েছেন। যদুর বাসস্থান সে ঘুরে ঘুরে দেখলো, কলঘরটি দেখে অবাক, যদু যে এখন বিরাট বড়লোক এ বিষয়ে তার নিঃসংশয়তার কথা বারবার জানালো, এবং অবশেষে ব্রাহ্মণের প্রসাদ ভক্ষণের পর বিদায় নিলো।
কিছুদিন পর বৌমাকে সঙ্গে নিয়ে সস্ত্রীক কালিকাপ্রসাদ এলেন যদুর গৃহে। তাঁদের তরুণ পুত্রটি যে এখানকার সমাজের একজন অতি সম্মানিত ব্যক্তি এখন সে বিষয়ে কোন সন্দেহই রইলো না তাঁদের। বিখ্যাত পালাকার এবং সঙ্গীত রচয়িতা না হোক, তাঁদের পুত্র যে এখন বিখ্যাত পণ্ডিত, এ বুঝে গর্বিত হলেন তাঁরা। ডাক্তার দুর্গাচরণের স্ত্রী নীচে নেমে এসে প্রণাম করলেন তাঁদের, নিমন্ত্রণ করে খাওয়ালেন, যদুর মাকে নতুন শাড়ি দিয়ে আবারও প্রণাম করলেন। যতদিন থাকলেন, প্রায় রোজই গঙ্গাস্নান করলেন তাঁরা। শশধরের বাড়িতেও নিমন্ত্রণ হলো তাঁদের। যদু তাঁদের কালিঘাটে নিয়ে গেলো নিজে, ডাক্তারবাবুর ঘোড়ার গাড়িতে চেপে একদিন কোম্পানীর বাগানও দেখে এলেন তাঁরা। ফিরে যাওয়ার দিন শিবপুরের ঘাট থেকে নৌকোয় কোরে জগন্নাথ ঘাটে গিয়ে আবার নৌকোয় চড়িয়ে প্রণাম কোরে বিদায় নিলো যদু।
গৃহিণীপনায় স্বাভাবিক প্রবৃত্তি বিপত্তারিণীর। শ্বশুর-শাশুড়ীকে সে পুত্রকন্যার স্নেহে কয়েক মাস প্রতিপালন করেছে, ফিরে যাওয়ার সময় তাঁরা চোখের জল ফেলেছেন। তবুও, শ্বশুর-শাশুড়ীর সংসারে সে বধূ মাত্র, শাশুড়ীই গৃহিণী। এখানে সে-ই সর্বেসর্বা, অন্দরমহলে একচ্ছত্র আধিপত্য তার। যদু এখন সদা ব্যস্ত, শশধরের চতুষ্পাঠীতে নিয়মিত অধ্যাপনা করে সে, শশধরেরই নির্দেশে তাঁর যজমানরা এখন সরাসরি তার সাথেই যোগাযোগ করে, প্রায় রোজই কোন না কোন অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করতে হয় তাকে। বাড়ি ফেরে যখন, শুকনো পরিষ্কার গামছাটি ভাঁজ করা থাকে, পা ধোয়ার জলের খোঁজ করতে হয় না, রূপোর চাপা দেওয়া গেলাসে শীতল পানীয় অপেক্ষা করে তার জন্যে। অতি উৎকৃষ্ট রাঁধে বিপত্তারিণী, বহুবিধ ব্যঞ্জন সহযোগে খাওয়ার বদভ্যাস সে করিয়ে দিচ্ছে যদুর, এ অভিযোগ প্রায়ই শুনতে হয় বিপত্তারিণীকে। প্রতিদিন খাওয়ার শেষের চমকটির জন্যে অপেক্ষা করার বদভ্যাসটিও যে তার হচ্ছে এ বুঝতে অসুবিধে হয় না যদুগোপালের। পায়েস, নানারকমের পিঠে, ক্ষীর, দৈ, কতকিছুই যে তৈরি করে দীর্ঘ নামের অধিকারিণী এই ছোটখাটো মেয়েটি !
যে বাড়ির অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করে যদুগোপাল সেখানে অনুষ্ঠানের শেষে নিয়মরক্ষার দক্ষিণাটি, একটি হরিতকী মাত্র, গ্রহণ করে সে, কিন্তু তার যজমানরা অর্থ এবং নানান সামগ্রী পাঠিয়ে দেয় তার গৃহে। এত ! অবাক হয় বিপত্তারিণী। তার বাবাও তো ব্রাহ্মণ পণ্ডিতই, পৌরোহিত্যই তাঁর পেশা, কিন্তু এত কিছু একসাথে সে দেখেনি কখনো। টাকা পয়সার হিসেব তাকে শেখাননি তার বাবা, কিন্তু সে বুঝতে পারে যদুগোপাল সাধারণ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নয়, তারা অতি সম্পন্ন, প্রায় ধনীই বুঝি ! কিছু কিছু সঞ্চয় করবে সে নিয়মিত, স্থির করে বিপত্তারিণী।
যদু জানে সে বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর তার বাবা যাত্রার দলটি ভেঙে দিয়েছেন। বিপত্তারিণীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা কোরে কোরে সে তার বাবামায়ের সংসারের খোঁজ নেয়। অর্থকষ্ট আছে সে বোঝে, কিন্তু বাবা বলবার লোক ন'ন। আর যাত্রার দলটি যতদিন ছিলো তিনি নিজে তো অন্য কোন কষ্ট বুঝতেই পারতেন না। প্রতি মাসে দশ টাকা সে মানি অর্ডারে পাঠাতে শুরু করে নিয়মিত।
যদু যখন গৃহত্যাগ করে তখন তার দুই কনিষ্ঠ ভ্রাতার একজনের বয়েস নয়, অন্যজনের পাঁচ। কৃষ্ণগোপাল আর নাড়ুগোপাল। শশধর যদুকে বলেছিলেন বস্তুপৃথিবীর দাবির কথা মনে রাখতে। আর সে-ও বাবাকে বলেছিলো জ্যেষ্ঠপুত্রের কর্তব্য সে পালন করবে। তার মনে আছে কৃষ্ণগোপালকে তার মতো চতুষ্পাঠীতে পাঠানো হয়নি। তাদের গ্রাম থেকে একটু দূরে ভঞ্জচৌধুরি বাবুরা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেখানে ভর্তি কোরে দেওয়া হয়েছিলো তাকে। কতটা লেখাপড়া সে শিখেছে সে সম্বন্ধে ধারণা নেই যদুগোপালের। গ্রামে সে কীভাবে সময় কাটায় তা-ও জানে না যদু। কিন্তু অর্থাগমের জন্যে তার যে কিছু করা দরকার সে বিষয়ে তো কোন সন্দেহ নেই। সে জীবনে এই প্রথমবার বাবাকে চিঠি লেখে। বাবার সংসারের আর্থিক অনটনের জন্যে উদ্বেগ প্রকাশ করে সে। এবং অনুরোধ করে কৃষ্ণগোপালকে হাওড়ায় পাঠিয়ে দেবার জন্যে, তার অর্থ উপায়ের কিছু ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবে সে। ডাক্তার দুর্গাচরণের সাথেও এ ব্যাপারে আলোচনা হয় তার, দুর্গাচরণ আশ্বস্ত করেন কিছুমাত্র ইংরিজিও যদি স্কুলে শিখে থাকে যদুগোপালের ভাই, তাহলে তার কিছু ব্যবস্থা তিনি কোরে দিতে পারবেন।
মাসখানেকের মধ্যেই আসে কৃষ্ণগোপাল। দুর্গাচরণ আলাদা করে কথা বলেন তার সাথে। পরের দিন ডিসপেন্সারিতে যাওয়ার সময় কৃষ্ণগোপালকে সঙ্গে কোরে নিয়ে যান তিনি। এরকম ভাবে কয়েকদিন কেটে গেলে যদুকে ডেকে আশ্বস্ত করেন দুর্গাচরণ। কৃষ্ণ বুদ্ধিমান, এবং স্কুলে সে ভালোই পড়াশোনা করেছিলো। এক বছর যদি এখানে থেকে যায় সে, তাকে তিনি গ্রামে ফিরে ডাক্তারি করার মতো উপযুক্ত কোরে দেবেন। দাদার বাড়িতেই থেকে গেলো কৃষ্ণ।
কয়েকদিন পর গভীর রাতে যদুর দরজায় করাঘাত। ত্রস্ত যদু তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে দরজা খোলে। বাইরে শশধরের মধ্যম পুত্র। বাবা হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এখনই একবার আসা দরকার আপনার। কোনরকমে প্রায় দৌড়িয়ে শশধরের বাড়িতে পৌঁছোয় সে, দুর্গাচরণ ডাক্তারও পৌঁছোন কিছুক্ষণের মধ্যে। বোধ হয় যদুগোপালকে দেখবার জন্যেই প্রাণবায়ুটুকু নির্গত হতে পারেনি শশধরের। শেষ মুহূর্তে তার ডান হাতটি ধরে বুকে স্পর্শ করান শশধর। তারপর সব শেষ।
এ তো যদুগোপালেরও পিতৃবিয়োগ ! শোকে সে বিধ্বস্ত। অবশেষে দুর্গাচরণের উপদেশে স্থির হয় সে। উপযুক্ত মর্যাদায় সম্পূর্ণ শাস্ত্রানুগ পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম করতে হবে শশধরের। এ তো স্বাভাবিক ভাবেই যদুগোপালের দায়িত্ব। ভেঙে পড়লে চলবে কেন?
এত দিন মাথার উপর ছিলেন শশধর, এখন তাঁরই পারলৌকিক। কিন্তু এ তো এক জন ব্রাহ্মণের কাজ নয়, বহু ব্রাহ্মণের নানা কাজ থাকে একটা সুষ্ঠু শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে। যদুগোপাল তো চতুষ্পাঠীর ছাত্র ছাড়া অন্য কোন ব্রাহ্মণকে চেনেই না। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়ে যায় নিজে নিজেই। শশধরের দেশ জোড়া খ্যাতি। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে দলে দলে মানুষ আসে শোকগ্রস্ত পরিবারের সাথে দেখা করার জন্যে। এঁদের মধ্যে অনেকেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে চায়। নিরলস পরিশ্রম চলে পরের দশদিন। সমস্ত কাজ সম্পন্ন হয় নির্বিঘ্নে। আশ্চর্য হয়ে যদু লক্ষ্য করে নীরবে তার নির্দেশ মেনে কাজ করছেন সবাই, তার চেয়ে বয়েসে এবং অভিজ্ঞতায় অনেক বড় যাঁরা, তাঁরাও। এ কী ভাবে সম্ভব হলো, কী ভাবে ! নিজের মৃত্যুতেও শশধর কী যদুগোপালকে এ অঞ্চলের ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করে গেলেন !
শশধরের মৃত্যু অনেকটাই বয়েস বাড়িয়ে দিলো যদুগোপালের। অভিজ্ঞতা ও পরিশ্রমের ছাপ পড়লো তার মুখাবয়বেও। এখন তাকে অনেক পরিণত দেখায়। পরিশ্রমও বেড়ে গেলো অনেকটাই, এখন গভীর রাত পর্যন্ত সে পড়াশোনা করে, যজন-যাজন তাকে অর্থ আর প্রতিপত্তি দিয়েছে, কিন্তু অধ্যয়ন-অধ্যাপনে তার প্রাণের টান !
কিছুদিন ধরেই শরীর ভালো চলছিলো না বিপত্তারিণীর। কাকিমা, অর্থাৎ দুর্গাচরণ ডাক্তারের স্ত্রী মহাসমারোহে ঘোষণা করলেন সে অন্তঃসত্বা। তার বিশেষ যত্ন নিতে শুরু করলেন তিনি, কয়েকদিনের জন্যে কৃষ্ণগোপালকে সারিখোলে পাঠিয়ে সেখানে খবর পাঠালেন, যদুর মায়ের কাছ থেকে তাদের পারিবারিক নিয়মকানুন জেনে নিলেন, এবং জাঁকজমক কোরে কিছুদিন পরেই সাধ দিলেন বিপত্তারিণীর। বিপত্তারিণীর রান্নাঘরে প্রবেশ বন্ধ হলো, তার প্রতিটি মুহূর্তের চলাফেরা এখন কাকিমার আজ্ঞানুযায়ী, কাকিমার শাসনে যদুগোপাল এবং কৃষ্ণগোপাল নিয়মিতই তাঁর অতিথি, কোন ওজর-আপত্তি শুনতে প্রস্তুত ন'ন তিনি।
যথাসময়ে একটি কন্যাসন্তান প্রসব করলো বিপত্তারিণী। দুর্গাচরণের স্ত্রী তাকে দেখে মুগ্ধ। যদুগোপাল নিজে অতি উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, তার চোখ-ধাঁধানো ফর্সা রঙ থেকে ছটা বেরোচ্ছে মনে হয়। সদ্যোজাত মেয়েটাও ফর্সা, কিন্তু ফর্সার ঔজ্জ্বল্য কমিয়ে দিয়ে তার মধ্যে এক ধরণের স্নিগ্ধতা এনে দিয়েছে বোধ হয় তার মার চাপা শ্যামলা রঙ। রোদ নয়, এ জোছ্নার আলো। কাকিমা বললেন, তোমাদের পণ্ডিতী আমি মানি না। এ মেয়ের নাম আমি রাখলাম বনজ্যোৎস্না। কালিদাস পড়েছে যদুগোপাল, বনজ্যোৎস্না তারও পছন্দ।
পরেরটিও মেয়ে। বাবার মতো মুখ তার, মায়ের মতো গায়ের রং। বিপত্তারিণী বললো, দিদি যদি জ্যোৎস্না হয়, এ শ্যামলী। শ্যামলী, এই নামই স্থির হলো মেয়ের।
এর মধ্যে ডাক্তারি শিখে গ্রামে ফিরে গেছে কৃষ্ণ। দাদার নির্দেশে বাবার বাইরের ঘরটা, যেখানে যাত্রার মহড়া দিতেন কালিকাপ্রসাদ, সেখানে তৈরি হয়েছে তার ডিসপেন্সারি। শুরু করে দিয়েছে সে কাজ, এবং দাদার নির্দেশ মতোই এবার পাঠিয়ে দিয়েছে নাড়ুগোপালকে। আরও একটা কাজ সে করেছে দাদার অনুমতি ছাড়াই। অতি সঙ্কোচে চিঠি লিখে সে দাদাকে জানিয়েছে সে কথা। তাদের কনিষ্ঠতম ভাইটি, দুর্গাপ্রসাদ যার নাম, সে এতদিন বাড়িতেই বসে ছিলো। তার বিশেষ পড়াশোনায় মন নেই, এতদিন দাদা নাড়ুগোপালের খিদমতগারি করাই তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো। নিজেকে দেখে সে বুঝতে পারছে একটু-আধটুও ইংরিজি শেখার সুফল কী। দুর্গাকে সে জোর করেই ভঞ্জচৌধুরিবাবুদের স্কুলে ভর্তি কোরে দিয়েছে।
নাড়ুগোপাল এসেই ঝড় বইয়ে দিলো বাড়িতে। সে দীর্ঘকায়, রং চাপা, এবং পেটানো চেহারা তার। গ্রামের ছেলেরা আখড়া তৈরি করেছে, সেখানে কুস্তি করতো সে। তার সাহেব পেটানোর খুব সখ, এখানে সে দু-চারজন সাহেবকে পেটানোর আশায় আছে। যদু সাবধান কোরে দিলো তাকে। বৌদির সাথে তার খুব রেষারেষি, সে প্রমাণ কোরে দেবে মায়ের চেয়ে তার ছোট ছোট দুই ভাইঝি তাকেই ভালোবাসে অনেক বেশি।
এদিকে চতুষ্পাঠীর ছাত্রসংখ্যা বেড়েছে অনেক। এমনকি কলেজ-য়্যুনিভার্সিটিতে পড়ে যারা, তাদের মধ্যেও অনেকে ভালোভাবে সংস্কৃত শেখার আশায় এখন আসে যদুর চতুষ্পাঠীতে। শশধরের বাড়ির ঐ দু খানা ঘরে চলে না আর। যদুর যজমান গাঙ্গুলি পরিবার, অনেক জমিজমা আছে তাদের হাওড়া শহরেই, যদুকে দু কাঠা জমি দান করার প্রস্তাব করলো তারা চতুষ্পাঠীর নিজস্ব বাড়ি তৈরি করার জন্যে। এই দান গ্রহণে যদুর সঙ্কোচ। অবশেষে ডাক্তার দুর্গাচরণের মধ্যস্থতায় একটা সমাধান বের হলো। প্রয়াত শশধরের স্মৃতিতে শশধর চতুষ্পাঠী সমিতি তৈরি হলো। দুর্গাচরণ নিজে সভ্য হলেন তার, এবং গাঙ্গুলি বাড়ির কর্তা বনোয়ারিলালকেও সভ্য হতে রাজি করালেন। জমি দান করা হলো যদুকে নয়, সমিতিকে।
বাড়ি তৈরির কাজ দ্রুত এগিয়ে চলে। নাড়ুগোপাল একাই একশো। সে অনেক রকমের কাজ জানে, যা জানে না তা-ও খুব তাড়াতাড়ি শিখে নেয়, আর কোন কাজেই আপত্তি নেই তার। মিস্ত্রী-মজুরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলো সে। বনোয়ারিলাল রেলের কন্ট্রাকটারি করেন, অনেক সাহের সুবোর সাথে তাঁর ওঠাবসা, তিনি লক্ষ্য করলেন নাড়ুর কাজ। বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়েতে রেলগাড়ির ইঞ্জিনে কাজ শেখার ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি নাড়ুগোপালকে। শিক্ষানবিশ হয়ে যোগ দেবে সে, থাকতে হবে খড়গপুরে, জায়গাটা মেদনীপুরের কাছে, আর কাজ শেখা হয়ে গেলেই পাকা চাকরি।
নাড়ু চলে গেলো খড়গপুর, বাড়িটা ফাঁকাই হয়ে গেলো প্রায়। বিপত্তারিণীরও মন খারাপ, হৈ হৈ করে, পেছনে লেগে সমস্ত বাড়িটাই জমিয়ে রেখেছিলো সে। এদিকে নতুন চতুষ্পাঠীর উদ্বোধন নিয়ে ব্যস্ত যদুগোপাল। তার বাবা-মা এতদিনেও দেখেননি নাতনীদের, হঠাৎ যদুর মনে হলো বিপত্তারিণী আর তার মেয়েদের একবার সারিখোলে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয় !
কৃষ্ণগোপালকে চিঠি দিয়ে আনিয়ে নিলো যদু, তার সাথে যদুর পরিবার চলে গেলো সারিখোল। নানা ব্যাপারে ব্যস্ত রইলো যদু মাস চার-পাঁচ, পুরো চতুষ্পাঠীটাই ধীরে ধীরে সরিয়ে আনতে হলো শশধরের বাড়ি থেকে, নতুন চতুষ্পাঠীতে পাচক এবং ভৃত্য রাখতে হয়েছে, আবাসিকরা এখন এখানেই থাকে। খরচ বেড়েছে, সরকারী অর্থ কী প্রক্রিয়ায় আনাতে হয় সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ সে, অবিশ্যি শশধরের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজকর্মচারী, সে অনেক খোঁজ-খবর নিলো, নানা রকমের কাগজপত্রে সই করতে হলো তাকে, এবং সমস্যার সমাধান হলো।
এমন সময় কালিকাপ্রসাদের একটি চিঠি এলো তার নামে। এই প্রথম, এর আগে বাবার কাছ থেকে কোন চিঠি সে কখনো পায়নি। পত্রবাহক ডাকঘর নয়, সেই সাকুরি গ্রামের প্রমথ বিশ্বাস। এখান থেকে তার পরিবার যখন সারিখোল যায়, তখনই বিপত্তারিণী প্রায় মাস দেড়েকের অন্তঃসত্বা, যা সম্ভবত যদু বা তার স্ত্রী বোঝেনি। যাই হোক, শাশুড়ী কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যাপারটা বোঝেন, এবং যথাসাধ্য তাঁরা বৌমার যত্ন নিয়েছেন। কিন্তু প্রসবের দিন যতই এগিয়ে আসছে মনে হয় বৌমা ততই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন। যদুর বাবা এবং মা, দুজনেই মনে করছেন মুখে না বললেও বৌমা হাওড়ায় ফেরার জন্যে আকুল। এমতাবস্থায় তাঁরা মনে করেন তাঁকে এখানেই যথাশীঘ্র নিয়ে আসা উচিত। পত্রবাহক মারফত যদু সম্মতি পাঠালেই তাঁরা বৌমা এবং তাঁর কন্যাদের নিয়ে রওনা দেবেন।
যদুর বাড়ি আবার জমজমাট। ঘরের অভাব নেই, অনেকগুলো ঘর তারা এমনিতেই ব্যবহার করতে পারে না। সস্ত্রীক কালিকাপ্রসাদ পৌত্রের মুখদর্শনের আশায় থেকেই গেলেন। তাঁর কোন সন্দেহ নেই দুই কন্যার পর এবার পুত্রের জন্ম দেবে বিপত্তারিণী।
পুত্রই হলো এবার। একটু চাপা গায়ের রং তার, মায়ের মুখ যেন হুবহু বসানো। সবাই বললো মাতৃমুখো ছেলে সুখী।
সুখী সবাই। যদুগোপালও। ছেলের নাম হলো সতীনাথ।
বছর দেড়েক বয়েসে অনর্গল কথা বলে সতীনাথ। দু বছরে তার উচ্চারণ স্পষ্ট। বাবার পাশে রাত্রে ঘুমোয় সে। ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যাত্যাগ করে যদু, সতীনাথও। বাবার সঙ্গে আবৃত্তি কোরে কোরে তিন বছর বয়েসে সে স্তবকবচমালা সম্পূর্ণ আবৃত্তি করতে শিখেছে। প্রতিদিন বিকেলে বাবার সাথে টোলে যায় সে। তাকে ছোট মাপের ধুতি কিনে দেওয়া হয়েছে। দুর্গাচরণ পাঠিয়ে দিয়েছেন ডজন খানেক অর্ডারী মেরজাই, তারই মাপে তৈরি করা। বাবা যখন পড়ায়, সে চুপ করে বসে বসে পড়ানো শোনে। বাড়ি ফেরার সময় সে আপন মনে বলতে থাকে, এদৈতোঃ কণ্ঠতালু। ওদৌতাঃ কণ্ঠৌষ্ঠম্। বকারস্য দন্তৌষ্ঠম্...। ভারি মজা পায় যদুগোপাল।
পাঁচ বছরে হাতে খড়ি দেবার পর সতীনাথকে ব্যাকরণের ছাত্রদের সাথে পড়াতে শুরু করে যদুগোপাল। অতি দ্রুত শেখে সতীনাথ। কলেজে পড়া ছেলেদের সাথে তার বিশেষ বন্ধুত্ব। যে সব সূত্র তারা মনে রাখতে পারেনা, সতীনাথকে জিজ্ঞেস করলে অনর্গল সে আবৃত্তি করে সেগুলো। অর্থ বুঝে হয়তো নয়, কিন্তু অজস্র সূত্র তার মুখস্থ। প্রায় শ্রুতিধর সে।
আদ্যানাথ চট্টোপাধ্যায়ের পরিবার যদুগোপালের যজমান। আদ্যানাথ রিপন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, অবসর নিয়ে এখন স্কুল খুলেছেন নিজের শহরে, হাওড়ায়। যদুকে তিনি নিজের ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করেন, প্রয়োজন মনে করলে উপদেশও দেন নানা ব্যাপারে। যদুকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন সতীনাথের শিক্ষার বিষয়ে কী ভাবছে সে।
আমার চতুষ্পাঠীতেই যেতে শুরু করেছে সতীনাথ। পড়াশোনায় তার প্রবল আগ্রহ। ওখানেই পড়ুক, তারপর আমার বিদ্যা তার শিক্ষার পক্ষে যথেষ্ট নয় বলে যখন মনে হবে তখন কী করবো, এ বিষয়ে গুরুচরণ বিদ্যার্ণব মশায়ের সাথে কথা বলবো একবার।
তুমি তাকে ইংরিজি-টিংরিজি পড়াবে না বলেই ঠিক করেছো?
পাশ্চাত্য বিদ্যার পিছনে দৌড়োবার প্রয়োজন কী?
বিদ্যার আবার প্রাচ্য-পাশ্চাত্য কী হে যদুগোপাল, এত লেখাপড়া শিখে তোমার এই বুদ্ধি হলো?
শশধর বেদান্তবাগীশ মশায় আমাকে বলেছিলেন আমি যেন বস্তুপৃথিবীর দাবির কথা কখনো না ভুলি। আমার ছোট ভাই কৃষ্ণ নানা কারণে পরাবিদ্যা শিক্ষার সুযোগ পায়নি, সে কৈশোরে খানিকটা ইংরিজি শিখেছিলো। তার ক্ষেত্রে আমি প্রাচ্যবিদ্যা শিক্ষার কোন উদ্যোগই নিইনি। ডাক্তারবাবুর কাছে শিক্ষানবিশি করে সে এখন গ্রামের লোকজনের চিকিৎসা করে, সে ভালোই আছে। তার কনিষ্ঠ নাড়ুগোপালের ক্ষেত্রেও অন্য ব্যবস্থা হয়েছে। ভাগ্যক্রমে সতীনাথের বুদ্ধি এবং সুযোগ দুইই আছে। তাকে অপরাবিদ্যার জন্য তৈরি করবো কেন?
দেখো, তোমাদের ঐ পরা-অপরা আমি বুঝি না। আমার মনে হয় না বেদ-উপনিষদ-রামায়ণ-মহাভারত কোন বিদ্যাকেই ছোট বা অপ্রয়োজনীয় বলেছে। তোমার ছেলে বুদ্ধিমান, চটপট শিখে ফেলে বলে শুনেছি। তুমি তাকে পড়াও না যত ইচ্ছে, সে তো তোমারই ছেলে। কিন্তু যে বিদ্যে তোমার নেই সে বিদ্যের থেকে তুমি তাকে বঞ্চিত করবে কেন? বস্তুপৃথিবীর দাবি বলতে তুমি টাকা-পয়সা আয়ের কথা বলছো তো? সে যা ইচ্ছে করুক বড় হয়ে, তুমি তাকে নিজের আদর্শেই তৈরি করো, আমার কিছু বলার নেই তাতে। কিন্তু ইশকুলে ভর্তি করে দাও তাকে, শুধুমাত্র শিক্ষার জন্যেই।
স্কুলে যেতে শুরু করলো সতীনাথ, মহা উৎসাহে। বাবার টোলের মতো আসন পেতে বসতে হয় না সেখানে, চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চি-ডেস্কের ব্যবস্থা। স্যররা চকখড়ি দিয়ে দেয়ালে টাঙানো ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে লিখে পড়ান, সমস্ত ক্লাসের ছেলে একসাথে দেখতে পায় সে লেখা। টিফিনের ছুটিতে দৌড়োদৌড়ি-খেলাধুলো হয়, খুবই মজা। অনেক কিছু নতুন নতুন শিখেছে সে, কিন্তু বাড়িতে শেখাবার কাউকে পাওয়া যায় না। বড়দিকে পড়তে বললেই রান্নাঘরে মায়ের কাছে পালিয়ে যায়, ছোড়দির সাথে খুব ভাব তার, ভাইকে খুশি করার জন্যে খাতা পেনসিল নিয়ে পড়তে বসেও সে, কিন্তু কী বোকা ! এতদিনেও ঠিক ঠিক মতো এ-বি-সি-ডি শিখতেও পারলো না। দশ বার দিন পর পর ফুলকাকা আসে খড়গপুর থেকে, তাকেই সতীনাথ পড়ায়, সে শিখেও যায় চটপট। তাদের খড়গপুরে নাকি সাহেবদের আলাদা পাড়া আছে, সেখানে সে সতীনাথকে নিয়ে যাবে একবার, ইংরিজিতে কথা বলে সতীনাথ অবাক করে দেবে সাহেবদের!
সতীনাথের যখন বার বছর বয়েস, ফোর্থ ক্লাসে পড়ে, স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়ে গেছে, তখনও ফিরলো না সে একদিন। উদ্বেগে পায়চারি করছে যদুগোপাল, স্কুলে গিয়ে দেখবে কিনা ভাবছে, প্রবল ভাবে কড়া নড়ে উঠলো সদর দরজায়। তাড়াতাড়ি দরজা খোলে যদুগোপাল, এ কী ! সন্দীপন, তুমি ! শক্ত কোরে সন্দীপন হাত ধরে আছে সতীনাথের।
সন্দীপন শিবপুর থানার বড়বাবু, সে যদুগোপালের যজমানও বটে। পুলিশের উর্দি পরেই এসেছে সে। স্কুলের ছেলেরা বেলা দুটোর সময় স্কুল থেকে বেরিয়ে এ অঞ্চলের একটা মদের দোকানের সামনে পিকেটিং করছিলো, মদের দোকান বন্ধ করার দাবিতে। অনেকক্ষণ ধরে পিকেটিং চলার পরও যখন পিকেটিং বন্ধ হলো না তখন পুলিশ লাঠিচার্জ করতে বাধ্য হয়। এই লাঠিচার্জের সময়েই সন্দীপন লক্ষ্য করে সতীনাথকে, সতীনাথকে সে জোর করেই ধরে এনেছে। সারা রাস্তা সতীনাথ তার সাথে তর্ক করতে করতে এসেছে, সে যদি মনে করে পিকেটিং করে অন্যায়ই করেছে ছেলেরা, তাহলে সবায়ের সাথে সাথে সতীনাথকেও লাঠিপেটা করা উচিত ছিলো তার। সন্দীপন সাবধান কোরে দিলো যদুনাথকে, ছেলেকে চোখে চোখে রাখতে হবে, না হলে সন্দীপনও বাঁচাতে পারবে না তাকে। তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো সে।
ঠিকই, লাঠিপেটা করা উচিত ছিলো তোমাকেও, বললো যদু, এবং বলতে বলতে খাটের থেকে একটা ছত্রি খুলে নিয়ে এই প্রথম, জীবনে প্রথম, সতীনাথের পিঠে আঘাত করলো সে। কাঁদলো না সতীনাথ, বাবার দিকে স্পষ্ট কোরে তাকিয়ে উঁচু গলায় বললো, বন্দে মাতরম।
কী বললি, রাগে উন্মত্ত হয়ে একাধিক আঘাত করে সে ছেলের পিঠে। সতীনাথ ক্রমাগত বলে যেতে থাকে বন্দে মাতরম, তার চোখে এক ফোঁটা জল নেই।
কাল থেকে তোর ইশকুল যাওয়া বন্ধ, বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে রওনা দেয় টোলের দিকে।
টোলে গিয়েও শান্ত হয় না তার মন। ছাত্রদের না পড়িয়ে সে একা একা বসে থাকে একটা কোণের ঘরে, নানা চিন্তা মাথায় এসে ভীড় করে তার।
বার বছর ! বার বছর বয়েসেই বাবার সাথে বিরোধ হয় তার। নিজের হাতে তার বার বছরের সন্তানকে সে আঘাত করেছে আজ, তার বাবা কিন্তু সে রকম কিছুই করেননি। তিনি শুধু নিজের যা ইচ্ছে তা ব্যক্ত করেছিলেন সরল ভাবে। যদু মেনে নিতে পারেনি, সে গৃহত্যাগ করেছিলো। তাঁর প্রাণের আবেগে যে কাজ তিনি করতেন, যদুর গৃহত্যাগের পর সে কাজ কালিকাপ্রসাদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। অভিমানে, অভিমানেই ছেড়েছিলেন, যদু তা জানে। কিন্তু কী করতে পারতো যদু? এটা মান-অভিমানের প্রশ্ন ছিলো না, সে সত্যের পথে ছিলো, শাস্ত্রোক্ত সত্যের পথ, কন্টকাকীর্ণ সত্যের পথ। ক্লেশ কী হয়নি তার, কিন্তু কোন ক্লেশই তাকে বিপথগামী করতে পারেনি। আজ সতীনাথ যে বিপথগামী হচ্ছে, সে তো স্পষ্ট। রাজদ্রোহ ব্রাহ্মণের কাজ নয়, দলে পড়ে সে কী রাজদ্রোহী হয়ে যাবে?
সতীনাথকে ডাকে যদু, তাকে বোঝাতে হবে। বাবার ডাকে সাড়া দিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন করে সে, কাল থেকে কী স্কুলে যাওয়া বন্ধ আমার?
ভেবে দেখতে হবে।
বাবার দিকে জিজ্ঞাসু মুখে কিন্তু নীরবে তাকিয়ে থাকে সতীনাথ। যদুগোপাল বলে, তোমাকে তো ইশকুলে পাঠানো হয়েছিলো পড়তে, কাল যেখান থেকে তোমাকে উদ্ধার করে সন্দীপন, সে তো ইশকুল নয়, আর পড়াশোনা শেখানোও হচ্ছিলো না সেখানে।
বিদেশী শাসক আমাদের নানা ভাবে দুর্বল কোরে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বিদেশী কাপড় পরাতে চায় ওরা, যাতে আমাদের কাপাস চাষী আর তাঁতীরা মরে, আর তার বদলে ওদের কাপড় বেচে টাকা নিয়ে যেতে পারে ওরা আমাদের দেশ থেকে; মদের দোকানের সংখ্যা বাড়িয়ে ওদের মদ বিক্রি করে শুধু যে আমাদের টাকাই নিয়ে যাচ্ছে ওরা তা নয়, আমাদের নৈতিক অধঃপতনেরও চেষ্টা করছে। আমরা যদি আমাদের দেশকে ভালবাসি, এ সব বন্ধ করার জন্যে চেষ্টা আমাদের করতেই হবে।
ঠিক কী বলে ছেলেকে বিরত করবে বুঝতে পারে না যদু। বলে, তুমি ছেলেমানুষ, এখনো বালক। এ সব অনেক গুরু বিষয়, তোমার এখনো এ সব নিয়ে আলোচনার বয়েস হয়নি।
আমি আপনাকে যা বললাম তার থেকে কী আপনার মনে হলো আমি না বুঝে কথা বলছি?
তুমি যতটুকু বুঝেছো ততটুকুই বলছো, কিন্তু যা বোঝনি তা-ও অনেক। এটা মনে রেখো ইংরেজরা বিদেশী ম্লেচ্ছ হতে পারে, কিন্তু আমাদের সামাজিক-ধার্মিক ব্যাপারে তারা অযথা নাক গলায় না। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম তাদের শাসনে অনেকটাই সুরক্ষিত। যাই হোক, আমার মনে হয় এ ব্যাপারে আরও বিশদ আলোচনার যোগ্য এখনো তুমি হওনি। আরও কিছুদিন টোলে পড়, আরও একটু বড় হও, আমার কথার যাথার্থ্য তুমি বুঝতে পারবে।
আপনি তো জানেন বাবা, টোলে পড়তে আমার কোন আপত্তি নেই, টোলের পড়া আমি খুব সহজেই বুঝি, এবং তা পড়ার পরেও আমার অনেক সময় থাকে অন্য বিষয় পড়ার। আপনি যদি মনে করেন, আমি স্কুল থেকে ফিরে সোজাই টোলে গিয়ে আবার পড়তে পারি সেখানে।
অতিরিক্ত পরিশ্রম হবে তোমার তাতে, আমার মনে হয় এখন কিছুদিন ইশকুলে যাওয়া বন্ধ থাকুক।
টোলে পড়ার আগ্রহ আমার কম নয়, কিন্তু স্কুলে পড়ার আগ্রহ আমার সম্ভবত আরো বেশি।
রুষ্ট হলো যদুগোপাল, কিন্তু তার মনে পড়লো সেদিন বিকেলেই তার রুষ্টতার কী বহিঃপ্রকাশ হয়েছিলো। সে নীরবে উঠে গেলো, এবং তার যাওয়ার ভঙ্গীতে সতীনাথের বুঝতে অসুবিধে হলো না যে এ আলোচনা সেদিনের মতো তখনই শেষ।
দুর্গাচরণের বিগ্রহের নিত্য সান্ধ্যপূজার শেষে ঠাকুরঘর থেকে নেমে আসার সময় ডাক্তারবাবুর মুখোমুখি পড়ে গেলো যদু। কী যদুগোপাল – তাকে দেখে বললেন দুর্গাচরণ – আমার স্ত্রী বলছিলেন আজ নাকি খুব বকাঝকা করেছো সতীনাথকে।
হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, ইশকুল থেকে সে আজ বাড়ি ফেরেনি সোজা।
স্বদেশীর ভূত তো? তোমাকে একটু সাবধান করে দি' যদু। ভূত বেশি তাড়াতে যেও না, যত তাড়াবার চেষ্টা করবে, ততই চেপে বসবে ঘাড়ে।
যদুও ভাবে। প্রাচ্যবিদ্যার আগ্রহে গৃহত্যাগ করেছিলো সে নিজে, আজ যদি সতীনাথও একই কাজ করে তার নিজের আগ্রহের তাড়নায় !
পরদিন সকালে সতীনাথকে বলে সে, ইশকুলে যাও তুমি, কিন্তু ছুটি হলেই তাড়াতাড়ি ফিরে এসে টোলে চলে যাবে।অন্য দিকে মন দিও না, ছাত্রাণাম অধ্যয়নং তপঃ।
এটাই রাস্তা, অতিরিক্ত পড়ার চাপে রাখতে হবে সতীনাথকে ! পড়তে ভালও বাসে সে, তা হলে মন বিক্ষিপ্ত হবে না তার !
এর দু বছর পর আবার গণ্ডগোল। খবর পাওয়া গেলো সরকারী স্কুলে পিকেটিং করতে গেছে সতীনাথ আর তার সহপাঠীরা। স্কুল বন্ধ করতে হবে।
বাড়িতে ফিরেই যদুগোপালের মুখোমুখি হতে হয় সতীনাথকে, কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
সরকারী স্কুলে পিকেটিং চলছিলো, এখন আসছি সেখান থেকে।
কিসের পিকেটিং?
স্কুল বন্ধ করতে হবে, লবণ সত্যাগ্রহের সমর্থনে সমস্তরকমের নিয়ম ভাঙার দিন আজ, স্কুল-কলেজেও পড়া হবে না।
পড়ুয়াদের আন্দোলন পড়ার বিরুদ্ধে?
এটা পড়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়। বিদেশী সরকারের যত নিয়ম আছে, সব নিয়মই ভাঙতে হবে। যে সরকার ভাতের সাথে গরীব মানুষের নিজের দেশের নুনটুকু খাওয়ার নিয়মটাও ভাঙতে চায়, তার কোন নিয়ম, কোন আইন আমরা মানব না। আমাদের পড়াশোনা আটকাবে কে? বাড়িতে আমরা আরও বেশি বেশি পড়ব। কিন্তু এ সত্যাগ্রহ যতদিন চলবে ততদিন কোন আইন আমরা মানবো না।
এ সব আশ্চর্য যুক্তির কী উত্তর যদুগোপাল বুঝতে পারে না। সে স্মৃতি এবং ন্যায়ের পণ্ডিত, ব্যবহারশাস্ত্রের প্রতিটি অনুশাসন সে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারে, তার ক্ষুরধার যুক্তি খণ্ডন করতে পারেন না দিকপাল পণ্ডিতরাও, বহু বিতর্ক সভায় এটাই তার অভিজ্ঞতা; কিন্তু সতীনাথের এ আশ্চর্য যুক্তি সে খণ্ডন করবে কীভাবে তা সে বোঝে না।
ব্রাহ্মণ্য ধর্ম তুমি মানো সতীনাথ?
মানি। আপনাকে বহুবার সে কথা বলেছি আমি।
বলেছো, কিন্তু তোমার পথপ্রদর্শক তো ঐ বৈশ্যসন্তান যে জাতিভেদ মানে না, বর্ণাশ্রমধর্মই মানে না বস্তুত।
আপনি গান্ধীজীর কথা বলছেন, তিনি নিশ্চয়ই আমার পথপ্রদর্শক অনেক ব্যাপারে, কিন্তু তাঁর সাথে অনেক ব্যাপারে মতবিরোধ আছে এমন অনেক মানুষকেও আমি শ্রদ্ধা করি, তাঁদের নির্দেশিত পথই অনেক ব্যাপারে আমার পথ। আর যদিও গান্ধীজীর সাথে অনেক বিষয়েই ভিন্নমত পোষণ করেন এঁরা, তাঁর উপরে শ্রদ্ধা কিন্তু কিছু কম নেই এঁদেরও।
দেখো সতীনাথ, তুমি আমার জ্যেষ্ঠপুত্র, আমার ধর্ম এবং চিন্তার সংবহন হবে তোমার দ্বারাই। তুমি বুদ্ধিমান এবং সত্যবাদী, তোমার সাথে আমার বিরোধ নেই। এদিকে এসো তুমি, আমার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করো সনাতন ধর্ম তুমি মেনে চলবে, মনু-পরাশর আজীবন তোমার অভিভাবক থাকবেন, তাঁদের অনুশাসন কখনো অবহেলা করবে না।
এগিয়ে এসে দণ্ডায়মান যদুগোপালের পায়ের নীচে বসে পড়ে সতীনাথ, হাত দুটিকে আড়াআড়ি কোরে ডান হাত দিয়ে বাবার ডান পা এবং বাঁ হাত দিয়ে বাঁ পা স্পর্শ কোরে বলে, প্রতিজ্ঞা করছি ধর্ম মেনে চলবো, ব্যক্তিগত জীবনে মনু-পরাশরও মানবো যথাসম্ভব, কিন্তু অন্যের ক্ষেত্রে তার প্রয়োগে বিচ্যুতি হতে পারে।
অর্থাৎ?
আমার ঘনিষ্ট বন্ধু সুনীল দাস, সে সংস্কৃতের ভালো ছাত্র, মাঝে মাঝে তাকে সাহায্য করি আমি পড়াশোনায়, সে যদি অনধিকারী হয় সংস্কৃত ভাষা এবং শাস্ত্রচর্চায়, তবুও তাকে সাহায্য আমার করতেই হবে। শুধু সে-ই নয়, নিম্ন বর্ণের সন্তানদের পড়াশোনার উপযোগিতায় বিশ্বাস করি আমরা, তাদের সাহায্যও করতে হয় অনেক সময়, তারা যদি এতে অনধিকারী হয়, তবুও এ কাজ আমি বন্ধ করতে পারব না।
কথা শেষ হবার পর বাবার মুখের দিকে তাকায় সতীনাথ, অনর্গল অশ্রুতে যদুগোপালের মুখমণ্ডল যেন ধুয়ে যাচ্ছে, এক মুহূর্তের জন্যে মন হয় সতীনাথের এ যেন পবিত্র গঙ্গাবারি, কলুষমুক্ত করছে তার বাবাকে; পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলিয়ে নেয় সে: তার বাবা তো এমনিতেই নিষ্কলুষ !
পুত্রের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে যদুনাথ, সফল হও তোমার প্রতিজ্ঞা রক্ষায়, তোমার সাথে কোন বিরোধ নেই আমার।
স্কুলের শেষ পরীক্ষার ফল ভালো হলো সতীনাথের। সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হলো সে। এই কলেজের শিক্ষক যাঁরা তাঁদের সাথে তার স্কুলের শিক্ষকদের কোন তুলনাই হয় না। নিজের নিজের বিষয়ে দিকপাল পণ্ডিত তাঁরা, দেশে-বিদেশে তাঁদের খ্যাতি। অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের বন্ধু, তাঁর অনুরোধে একাধিকবার কলেজে এসে নানা আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ নিজে। স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ অনেক কমে গেলো সতীনাথের, নতুন এক জ্ঞানের জগতে এসে পড়লো সে।
সদ্য যখন দর্শনশাস্ত্রে এম-এ পরীক্ষা দিয়েছে সতীনাথ, সুরেন্দ্রনাথ তখন সংস্কৃত কলেজ থেকে অবসর নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, একদিন ডেকে পাঠালেন তাকে। কেম্ব্রিজে যেতে হবে সতীনাথকে। বছর দু-তিন থাকবে সেখানে সে, স্কলারশিপের ব্যবস্থা হয়েছে, প্রিন্সিপিয়া ম্যাথ্ম্যাটিকার সত্য এবং ভারতীয় দর্শনের সত্যের একটি তুলনামূলক আলোচনা হবে তার গবেষণার বিষয়।
চোখে জল এসে যায় সতীনাথের, স্যর তাকে এত ভালোবাসেন ! কিছু না জানিয়ে এত ব্যবস্থা করে ফেলেছেন তিনি !
কিন্তু স্যর, বাবার কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ আমি, ব্যক্তিগত জীবনে মনু-পরাশরের নির্দেশ অমান্য করবো না।
মানে? – বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করেন সুরেন্দ্রনাথ।
চোদ্দ বছর বয়েসে বাবার পা ছুঁয়ে তার প্রতিজ্ঞার পুরো কাহিনী শোনেন সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, অবাক হয়ে শোনেন সমুদ্রযাত্রায় তার অক্ষমতার কথা, তার পর তিক্তকণ্ঠে হেসে বলেন, রামায়ণেই এ ধরণের কাহিনী শেষ হয়ে গেছে ভেবেছিলাম।
আবার দু মাস পর স্যরের ডাক, তোমাকে যে প্রস্তাব দেব এবার, আশা করি তোমার বাবার আপত্তি থাকবে না তাতে, তোমারও প্রতিজ্ঞাভঙ্গের কোন ভয় নেই।
অধীর আগ্রহে স্যরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সতীনাথ।
সুরেন্দ্রনাথ বলেন, পুনার ভাণ্ডারকার ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিট্যুটের সাথে কথা হয়ে গেছে আমার, কেম্ব্রিজের স্কলারশিপটা বলবৎ থাকবে ওখানেও, একই বিষয়ে কাজ করবে তুমি, অফিশিয়াল সুপারভাইজার কে হবেন সেটা এখনও ফাইনাল হয়নি, তবে তুমি তোমার থীসিস সাবমিট করবে বোম্বে য়্যুনিভার্সিটিকে, কেম্ব্রিজের সাথে কী ভাবে পার্টনারশিপ হবে ওরা সেটা নিয়ে আলোচনা করছে। তোমার আগ্রহ আছে তো?
উত্তেজনায়, খুশিতে প্রায় বাক্স্ফুর্তি হয় না সতীনাথের, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করে, কবে যেতে হবে স্যর?
তোমাদের এম-এ পরীক্ষার ফল তো বেরোয়নি এখনও, আরও দিন পনের লাগবে বোধ হয়, তার পর যত তাড়াতাড়ি পারো, মানে মাস খানেকের মধ্যেই।
ঠিক আছে স্যর, আমি কাল-পরশুর মধ্যেই আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি কবে যেতে পারবো।
বাড়ি ফিরে মাকে প্রথম খবরটা দেয় সতীনাথ। সঙ্গে একটা দুশ্চিন্তার কথাও সে জানায় মাকে। যদুগোপাল এতদিনে নিজস্ব বাসগৃহ তৈরিতে হাত দিয়েছে। তার টাকার যে খুব অভাব আছে তা নয়, কিন্তু নিয়মিত খাজনা জমা না পড়ায় তাদের সারিখোলের স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি নিলামে উঠেছিলো, ভয়ে কালিকাপ্রসাদ কিছুই জানাননি তাকে। অন্য সূত্রে জেনে, এখান থেকে ব্যবস্থা কোরে সে সম্পত্তি সে আবার কিনে নিয়েছে, অনেক খরচ হয়েছে তাতে। এ ছাড়াও ছোট বোনটি এবং অন্য দু ভাইয়ের বিয়ে দিয়েছে সে, নিজের দু মেয়েরও বিয়ে দিতে হয়েছে, নিজের সংসারও অনেক বড়ো হয়েছে তার, সতীনাথের পরে আরও তিন পুত্র হয়েছে, তার হাতে জমানো টাকা প্রায় নেই। জ্যেষ্ঠ পুত্র সতীনাথ জানে বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে বেশ কিছু ধার হয়েছে তার বাবার। অথচ পুনা যাওয়ার খরচ আছে, যতদিন না স্কলারশিপের টাকা হাতে আসে ততদিন চালাতে হবে বিদেশে, তার জন্যেও টাকা চাই। কোথা থেকে পাবে সে এসব !
তুই কিছু ভাবিস না, টাকা তোকে আমি দেব।
তুমি? তুমি কোথা থেকে পাবে মা?
বিপত্তারিণী তাকে শোনায় সদ্য বিবাহোত্তর তার প্রায়-কৈশোরের গল্প; যজমান বাড়ির পাঠিয়ে দেওয়া দক্ষিণা থেকে সে কিভাবে সঞ্চয় শুরু করে সেই কচি বয়েসেই। সেই সঞ্চয় এতদিনে বেড়ে বেড়ে যা হয়েছে তাতে সতীনাথের কুলিয়ে যাবে নিশ্চয়।
মাকে পাঁজাকোলা করে তুলে ধরে পাঁচ-ছ পাক ঘুরিয়ে দেয় সতীনাথ।
ওরে ছাড় ছাড়, কী ডাকাত ছেলে রে বাবা, মাথা ঘুরছে আমার !
বিকেলের পর চতুষ্পাঠী থেকে ফিরে ডাক্তারবাবুর বিগ্রহের সান্ধ্যকৃত্য সম্পন্ন কোরে যখন নীচে নামে যদুগোপাল, তাকে প্রণাম কোরে খবরটা জানায় সতীনাথ। কোন উত্তর দেয় না যদু কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে মেঝেতেই বসে পড়ে সে, ইঙ্গিতে সতীনাথকে তার সামনে বসার নির্দেশ দিয়ে বলতে শুরু করে সে: ধর্মের জয় যুগে যুগে, তার প্রমাণ আরও একবার হলো। পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছি আমি, এখন আমার বানপ্রস্থের বয়েস। অথচ বিধাতাসৃষ্ট সে নিয়ম লঙ্ঘন করে আমি সংসারপঙ্কে ডুবে আছি, বাড়ি তৈরি করছি, টাকা ধার করছি, দিবারাত্র টাকার কথাই চিন্তা করছি। সে পাপের ফলভোগ তো আমায় করতেই হবে। এই বয়েসে যে কোনদিনই মৃত্যু হতে পারে আমার, পারেই। হবেই। আর তা যদি হয়, মৃত্যুপথযাত্রীর একমাত্র কাম্য যা, জ্যেষ্ঠপুত্রদত্ত গঙ্গোদক, তা-ও জুটবে না আমার। কারণ আমার যে জ্যেষ্ঠপুত্র, সে তখন থাকবে বিদেশে। এই হবার ছিলো। ধর্মই শেষ কথা বলে।
বলে না, প্রমাণ করার দায়িত্ব নিয়ে পুনায় যাওয়া থেকে বিরত হয় সতীনাথ।
পড়লাম