নিলীন আর উৎপল যখন পৌঁছোলো পরের দিন, তখন রাত হয়ে গেছে। হাওড়া থেকে যে স্টীল এক্সপ্রেসটা ছাড়ে বিকেলে, সেটায় উঠেছে ওরা ঝাড়গ্রাম থেকে। যখন গালুডিতে পৌঁছোলো ওরা, তখন স্টেশনে এমন কিছু নেই যা ওদের খুশিঝোরা পর্যন্ত নিয়ে যাবে। অতএব জলধরকে ফোন করতে বাধ্য হলো নিলীন স্টেশনের বাইরের একটা দোকান থেকে। জলধর বান্দোয়ান থেকে মোটর সাইকেলে গালুডি পর্যন্ত এসে নিয়ে গেলো ওদের। খুশিঝোরার গেটে নামিয়ে দিয়েই সে হাওয়া: পরে কথা বলবো নিলীনদা, এই রাস্তায় কখনো কখনো হাতি বেরোয়, দেরি করাটা ঠিক উচিত হবে না।
সে রাতটা নিলীনও থেকে যায় উৎপলের সাথে গেস্ট হাউজের একটা ঘরে। পরের দিন ভোরেই সে বেরিয়ে পড়ে, মেদনীপুরে ঠিক সময়ে ফিরতেই হবে তাকে, আজ তার ক্লাশ আছে।
উৎপলকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব কিছু দেখায় জয়ি। গোরুগুলোকে দেখে সে নাম জিজ্ঞেস করে, এবং কোনও নাম তাদের দেওয়া হয়নি শুনে অবাক হয়। ফলের গাছ এতো লাগানো হয়েছে দেখে সে খুব খুশি, সোনাঝুরিও তার খারাপ লাগে না, রাস্তার ওপারে সদ্যপ্রোথিত এতো গাছের চারা দেখে সে অবাক, এবং দুপুরবেলা ছোট নদীটা যেদিকে বেঁকে গেছে সেদিকে নদীর পাড় ধরে খানিকটা হেঁটে সে আবিষ্কার করে খানিকটা বেশি জলের একটা খাত, আর ডুব দিয়ে চান করে সেখানে। জয়িকে সে জিজ্ঞেস করে তাকে কী কাজ করতে হবে, খানিকটা অস্পষ্ট উত্তর পায় জয়ির কাছ থেকে, তারপর নিজেই লেগে যায় রঘুনাথের কাজে সাহায্য করতে। অষ্টমী এলে সে অষ্টমীর সাথেও গল্প করে খানিকটা।
জয়ির কাছ থেকে স্পষ্ট কোন নির্দেশ না পেয়ে বিকেলে বেরিয়ে পড়ে উৎপল, হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছিয়ে যায় ভাবকান্দি গ্রামে, দু-চারজনের সাথে কথাও বলে সে। আদিবাসীদের সাথে কথাবার্তা চালাতে তার অসুবিধে হয় না, ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের সর্বজনবোধ্য মিশ্রিত ভাষাতে ছোটবেলা থেকেই সে কথা বলে এসেছে। নিলীনকে সে আগেও বলেছিলো, এখনও তার ইচ্ছে গ্রামের আদিবাসী ছেলেদের সে খেলা শেখাবে।
উৎপল অবাক হয়ে আবিষ্কার করে এ গ্রামের অনেকেই, বিশেষ করে মেয়েরা, খুশিঝোরার সাথে পরিচিত এবং জয়ির গুণগ্রাহী। বাচ্চারা অনেকেই জয়ির কাছে ছবি আঁকা শিখতে যায়, মেয়েরাও বাবই ঘাস আর খেজুরপাতায় তৈরি হাতের কাজ দেখাতে যায় তাকে। জয়ির কাছে নাকি নিজেদের তৈরি অনেক জিনিস রেখে এসেছে তারা, জয়ি বলেছে সেগুলো কলকাতায় বিক্রী করার চেষ্টা করবে সে। কিন্তু ফুটবল খেলায় উৎসাহী কোনও ছেলের সাথে দেখা হয় না তার। ফুটবল খেলতে হয়তো পারতো এমন বয়েস যে ছেলেদের তারা জঙ্গলে অথবা ক্ষেতে কাজ করে, কেউ কেউ ঝাড়গ্রাম খড়গপুর জামশেদপুর রাঁচি এমনকী কলকাতায় গিয়েও কাজ করে অথবা কাজের সন্ধানে ঘোরাঘুরি করে।
সোমবার রাতে এসেছে উৎপল, এভাবেই কেটে গেলো প্রায় পুরো সপ্তাহটা। শনিবার সকালে, বলা নেই কওয়া নেই, আগে থেকে জানানো নেই, দুখানা গাড়ি ভর্তি কোরে হাজির চার জোড়া স্বামী স্ত্রী, সঙ্গে গোটাকয়েক সাত-আট বছরের বাচ্চা। সকালে পাশের মাঠটায় একটু-আধটু দৌড়োদৌড়ি, হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে উৎপল, সদ্য সেসব সেরে গেট দিয়ে ঢুকে নিজের ঘরের দিকে হাঁটছে সে, লোহার গেটের বাইরে গাড়ির হর্ণের শব্দ। উৎপল এগিয়ে আসে, গেটটা খুলে বাইরে বেরোয়। গাড়ি থেকে নেমে এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেন, এটা কী খুশিঝোরা?
হ্যাঁ।
জয়মালিকা সেনের সাথে দেখা করা যাবে?
যাবে। আপনারা ভেতরে আসুন, দেখছি।
গেটটা খুলে দেয় উৎপল, ভদ্রলোক সামনের গাড়িটার ড্রাইভারের সীটে গিয়ে বসেন, পরপর গাড়ি দুখানা ভেতরে ঢুকে আসে, একটু ভেতরে আসার পর থামে। ততক্ষণে উৎপল জয়ির ঘরের বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে ধাক্কা দিয়েছে, জয়ি সাড়া দিয়েছে, কিন্তু এখনো বাইরে আসেনি। উৎপল অপেক্ষা করে, জয়ি বেরোলে তাকে খবর দেয় গাড়ি করে আসা মানুষদের সম্বন্ধে, তারপর যেখানে গাড়ি দুখানা অপেক্ষারত, সেখানে ফিরে আসে। গাড়ি খুলে ততক্ষণে যাত্রীরা সবাই বাইরে, বাচ্চারা বাগানের আশেপাশে দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে, বড়োরা একটু হাত-পা ছড়িয়ে নিচ্ছে।
আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, উনি আসছেন, বলে উৎপল।
জয়ি এসে পৌঁছোয় একটু পর।
নমস্কার। সামনের ভদ্রলোক হাত তুলে নমস্কার করেন, আমার নাম সুদীপ্ত রায়।
নমস্কার, বলে জয়ি, আমি জয়মালিকা সেন।
আমরা না জানিয়ে-শুনিয়ে একটু ঝুঁকি নিয়েই এসে গেছি চারটে পরিবার। আপনাদের গেস্ট হাউজে থাকার জায়গা পাওয়া যাবে?
আমাদের গেস্ট হাউজের খবর পেলেন কোথায়?
আমাদের কয়েকজন বন্ধু এখানে এসেছিলো কয়েকদিন আগেই। তাদের কাছেই আপনাদের গেস্ট হাউজের কথা শুনলাম, যদিও আপনার কথা শুনেছি আগেই।
আগেই শুনেছেন? কীভাবে শুনলেন?
আপনি তো বিখ্যাত শিল্পী, তার ওপর আদিবাসীদের মধ্যে নানারকমের সমাজ সেবার কাজ করেন। আপনাকে নিয়ে কতো লেখা তো বেরিয়েছে কাগজে। আপনাদের গেস্ট হাউজ আছে জানলে আগেই আসতাম। আমাদের বন্ধুরা ফিরে গিয়ে বলায় যত তাড়াতাড়ি পারি চলে এসেছি।
সে তো এসেছেন, কিন্তু আপনারা যেরকম আরামে অভ্যস্ত আমাদের গেস্ট-হাউজ ঠিক সেরকম নয়। আপনাদের অসুবিধে হবে না তো?
কিসের অসুবিধে? আমরা তো সব জেনে-শুনেই এসেছি। রান্না-বান্নার অসুবিধে তো? আমাদের চার-চারটে বৌ আছে। ঘাবড়াচ্ছেন কেন?
ঠিক আছে, আপনাদের চার-চারটে বৌ না হয় বেড়াতে এসে রান্নাই করলেন। কিন্তু টয়লেট পরিষ্কার? আমাদের এখানে টয়লেট পরিষ্কার করার লোক নেই। সব নিজেদের কোরে নিতে হবে। যাওয়ার আগে আবার সব পরিষ্কার-টরিষ্কার কোরে রেখে যেতে হবে। পোষাবে আপনাদের?
আপনি কোন চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। আমাদের বাচ্চারা এর মধ্যেই দৌড়োদৌড়ি শুরু করেছে। যতই আপনি ডিসকারেজ করুন আমাদের ফেরাতে পারবেন না।
চোদ্দ জন খাওয়ার লোক বেড়ে গেলো, বুঝলে উৎপল? – বলে জয়ি। এক সপ্তাহ ধরে জলধর আসছে না, কে জানে কী হলো ওর ! ও থাকলে কোন চিন্তাই ছিলো না। এখন তোমাদেরই সামলাতে হবে। এক কাজ করো, চা তৈরি করে ফেলো সবায়ের জন্যে, আমি ততক্ষণ দেখি রঘুনাথ কী করছে।
রঘুনাথ চায়ের ব্যবস্থাই দেখছিলো। জল বসিয়ে দিয়েছে, উৎপল বুঝতে পারেনা কী করবে। জয়ি এসে দেখে শুনে বললো, চা-টা ওদের আমিই দিয়ে দিচ্ছি রঘুনাথদা। তুমি উৎপলকে নিয়ে মোটর সাইকেলে করে বান্দোয়ানে চলে যাও। আচ্ছা, তুমি কী জানো বান্দোয়ানে জলধরকে কোথায় পাওয়া যায়?
জানি তো। অলগুরু প্রিন্টিং ওয়র্কস।
ঠিক আছে, ওকে যদি খবর দিতে পারো, দিয়ে দিও। এইসব গেস্ট-ফেস্ট আসার কথাও জানিও। আর উৎপল আর তুমি, দুজনে মিলে বাজার কোরে আনবে যতটা পারবে। আমার মনে হয় এরা দুদিনে চার বেলা খাবে। আমরাও আছি, আর জলধর। মাছ, খাসির মাংস, মুরগী। ব্রেকফাস্টের ডিম। সবজি যা পাও। তেল-নুন-মশলা কী লাগবে তুমি জানো।একদিনে যদি সব বাজার না হয় কালও যেতে হবে। আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ো। চাল-আটা সব কতোটা আছে তুমি তো জানোই। আর হ্যাঁ, মিষ্টি এনো। ল্যাংচা।
মোটর-সাইকেলে ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর টেবিলে চা সাজিয়ে অতিথিদের ডাকে জয়ি। অতিথিরা আসে। হাতে বিস্কুটের প্যাকেট, সন্দেশের বাক্স, কলকাতা থেকে আনা। ওরা বলে, রাস্তায় ওরা ব্রেকফাস্ট সেরে এসেছে, এখন কিছু খাবে না। বিস্কুটের একটা কৌটো জয়ি টেবিলে রেখেছিলো, ওরা সেখান থেকেও বিস্কুট নেয়, নিজেদের যেটা আনা সেই প্যাকেটটাও খোলে, জয়ির দিকেও এগিয়ে দেয়। সন্দেশের বাক্সটা জয়ির হাতে দিয়ে বলে, এটা এক্সক্লুসিভলি আপনাদের জন্যে, এখানে যাঁরা থাকেন। আমাদের যদি মিষ্টি খাওয়াতে চান, লোকাল মিষ্টি খাবো। বৌরা চারজন, সুপর্ণা, মৌসুমী, মিত্রা আর অঞ্জলি। সুদীপ্ত রায়, যার সাথে কথা হচ্ছিলো ওরা আসার সময়, তার বৌ অঞ্জলি। বাকিদের বররা তন্ময়, কাজল আর অনিমেষ। অঞ্জলি বলে, রান্নাটা কিন্তু আমরা করবো।
আরে, এখানে সাইট সীইং আছে, মিস করবেন কেন ! রান্নার ব্যবস্থা হয়ে যাবে, ভাববেন না।
চা শেষ হলে জয়ি বলে, আমাদের গেট দিয়ে বেরিয়ে বাঁদিকে একটু হাঁটলে একটা ছোট নদী গোছের দেখতে পাবেন, আমরা বলি ঝোরা। খুশিঝোরা। ওটার নামেই আমাদের নাম। রাস্তার যেদিকে ঝোরাটা তার উল্টো দিকের জমিতে আমরা গাছের চারা পুঁতেছি, সেগুলোও দেখতে পারেন। ঐ জমির ওপর দিয়ে খানিকটা হাঁটলে একটা পুকুর পাবেন। আমাদের পুকুর, আমরা সংস্কার করেছি, আর ঐ পুকুরের জলেই চারাগুলো বাড়বে আশা করছি। ওগুলো একটু বড় হলে যখন গাছ নামে ডাকা যাবে ওদের, তখন ঐ পুকুরে আমরা মাছের চারা ফেলবো। যান না, ঘুরে আসুন না।
উৎসাহী কয়েকজন উঠে পড়ে, সুদীপ্ত আর কাজল বসেই থাকে। দলের বাকিদের উদ্দেশে ওরা বলে, তোমরা ঘুরে এসো, আমরা এখানেই আছি।
সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করে হঠাৎ, আপনার যে এগজিবিশন হয়েছিলো এখানে, তার কিছু ছবি কী দেখা যাবে?
হ্যাঁ, অনেকগুলোই দেখতে পাবেন, এখানেই রেখে দেওয়া আছে।
সেগুলো দেখতে চাই, আপনার যখন সময় হবে, বলবেন। আচ্ছা, এই যে ট্রাইবালদের সঙ্গে থেকে, কী যেন নাম, হ্যাঁ পাহাড়ি খাড়িয়া, ওদের এতো ছবি যে আপনি আঁকলেন, তারপর এই আদিবাসী অঞ্চলেই থেকে গেলেন পার্মানেন্টলি, কেন? কোন্ প্রেরণায়?
ও বাবা, এসব তো অনেক বড়ো বড়ো কথা। না না, জায়গাটা সুন্দর, এমন পাহাড়-জঙ্গল-সবুজের মধ্যে থাকা, থাকতে ভালো লাগবে, তাই। নাহলে আপনারাই বা কেন কলকাতা থেকে এখানে এলেন বেড়াতে?
আমাদের কথাটা আলাদা ম্যাডাম, বলে কাজল, আমরা শুধু পাহাড়-জঙ্গল দেখতে আসিনি, সে তো অনেক জায়গাতেই পাওয়া যায়, আমরা এসেছি আপনাকে দেখতে।
আমাকে দেখতে? আমি কী চিড়িয়াখানার জীব নাকি?
ও সব কথা আমাদের বলে লাভ নেই ম্যাডাম, কাজল থামে না, এই যে আপনি এতো বড়ো চিত্রশিল্পী, যেখানে আপনার সত্যি-সত্যিই সমাদর হবে সেই কলকাতা-বোম্বে-বরোদা ছেড়ে এই আদিবাসীদের মধ্যে আপনি থাকতে এসেছেন, তাদের উন্নয়নের জন্যে কাজ করছেন, বনসৃজন করছেন, নিজের কেরিয়ার আহুতি দিচ্ছেন এদের জন্যে, এ কী সবাই করতে পারে? কোন্ প্রেরণায় আপনি করছেন এসব হয়তো আমরা বুঝতেও পারবো না। না বুঝি, আপনার কোনও কাজে লাগতে পারি যদি, বলবেন।
কাজ? যে কাজ আমি করছি – নাঃ, সত্যি কথা হচ্ছে করতে চেষ্টা করছি – তাতে তো যে কেউ সাহায্য করতে পারে। আপনি যদি এখানে এসে একটা গাছের চারাও পোঁতেন, সেটাই তো আমাদের কাজকে আরও এক-পা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমরা যেখানে চারা পুঁতেছি কম্পাউণ্ডের বাইরে, সেখানে যদি যান দেখতে পাবেন ফেস্টুন টাঙিয়ে আমরা পথিককে ডেকে বলছি, যতটা পারো জল ঢালো এখানে।
গাছের চারা তো পুঁতবোই, আমরা সবাই পুঁতবো, কিন্তু আমি সেই সাহায্যের কথা বলতে চাইছিলাম না, আরও অন্য কিছু।
সুদীপ্ত কথা বলে এবার, ম্যাডাম, এই যে এত দূরে আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করছেন আপনি, ইলেক্ট্রিসিটি তো আছে দেখছি, কী করে পেলেন? আশপাশে তো গ্রাম-ট্রাম নেই কোন।
ওটা আমাদের কপাল। এই যে প্রপার্টিটা দেখছেন, এখানে আগে একটা লাক্ষার কারখানা ছিলো। সেই কারখানার মালিকরাই অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে আনিয়েছিলো ইলেক্ট্রিসিটি। আমরা হলে পারতাম না।
যদি হঠাৎ যোগাযোগ করতে হয় কোথাও, টেলিফোন পান কোথায়?
এটা একটা অসুবিধে। এখান থেকে মাইল আট-দশ দূরে বান্দোয়ান নানে একটা ব্লক-শহর আছে। সেখানে যেতে হয়।
কাজলের দিকে তাকায় সুদীপ্ত, কী রে কাজল?
হ্যাঁ, এ ব্যাপারে হয়তো কিছু একটা করা যায়, বলে কাজল।
সুদীপ্ত বলে, কাজল বি-এস-এন-এল-এর একজন জেনারাল ম্যানেজার। ও হয়তো কাজে লাগতে পারে আপনার।
হ্যাঁ, হয়তো, বলে কাজল। ফেরার দিন বান্দোয়ান হয়ে ফিরবো। কী কী ফেসিলিটি আছে ওখানে নিজের চোখে দেখে যাওয়াই ভালো। হয়ে যাবে ম্যাডাম, আমাকে তিন মাস সময় দিন।
বাঃ, এটা তো একটা দারুণ প্রতিশ্রুতি দিলেন আপনি। থ্যাঙ্ক য়্যু।
আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ম্যাডাম? – হঠাৎ প্রশ্ন করে সুদীপ্ত।
বলুন না কী বলবেন।
ব্লাস্ট ফার্নেসের একটা ছবি এঁকেছিলেন আপনি। সেই ছবিতে একটা অনাগত অশুভর ছায়া দেখা যাচ্ছিলো, বলেছেন একজন সমালোচক। একটু ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবেন?
বিপদে ফেললেন আপনি। এ ছায়া যিনি দেখেছেন তাঁকেই জিজ্ঞেস করতে হবে।
আপনি এড়িয়ে যাচ্ছেন ম্যাডাম। এই খুশিঝোরাতে যখন আপনার পাহাড়ি খাড়িয়াদের প্রদর্শনী হচ্ছিলো তখন দিগন্ত নামের এক সাপ্তাহিক পত্রিকায় আলোচনা প্রসঙ্গে আপনার তরুণ বয়েসে আঁকা এই ছবিটার কথা উল্লেখ করেছেন আলোচক। আপনার ওই ছবি আমি দেখিনি, কিন্তু দেখেছেন এরকম একজনকে আমি চিনি। তিনি আমাকে বলেছেন আপনার এই ছবি নাকি আলোড়ন তুলেছিলো। অসাধারণ প্রতিভাময়ী সম্পূর্ণ মৌলিক একজন চিত্রকরের প্রতিশ্রুতি ছিলো সেই ছবিতে। এই কথা শোনার পর থেকেই আপনার সাথে দেখা করার জন্যে আমি উদগ্রীব ছিলাম। আমার সেই অপেক্ষা আজ সার্থক হয়েছে। আপনি এড়িয়ে যাবেন না প্লীজ। আপনার নিজের মুখে শুনতে চাই এই ছবি আঁকার কাহিনী।
দেখুন, একটা কথা বলি আপনাকে। ক্রিয়েটিভ কাজ কী সত্যি সত্যিই এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? আমি ছবি এঁকেছি, এঁকেই আমি খালাস। এর পরের কথা অন্যরা বলবেন।
এই সব কথা চলতে চলতেই দুটো মোটর সাইকেলে উৎপল, জলধর আর রঘুনাথ ঢোকে। জলধরের পেছনে উৎপল, তার হাতে শালপাতার বাক্সে মিষ্টি। রঘুনাথের মোটর সাইকেলে অনেকগুলো বড়ো বড়ো নাইলনের থলি দড়ি দিয়ে বাঁধা, সেগুলোতে আছে বাজার থেকে কেনা শাকসব্জি-মাছমাংস-তেলনুনচাল। জয়ি বলে কাজল আর সুদীপ্তকে, আপনারা একটু ঘোরাঘুরি করুন, আমি দেখি কী খাদ্য জুটবে আজ আপনাদের কপালে।
বলতে বলতেই হৈ হৈ করে ফিরে আসে সুদীপ্ত-কাজলদের দলের অন্যরা, যারা ঘুরতে বেরিয়েছিলো। বড়োরা পেছনে হাঁটতে হাঁটতে আসে, সামনে বাচ্চারা, হাঁটতে বোধ হয় ভুলেই গেছে, দৌড়োতে দৌড়োতে স্লোগান দিতে দিতে ঢোকে তারা : মানুষের বর্জ্য গাছেদের ভোজ্য ! মানুষের বর্জ্য গাছেদের ভোজ্য !
ওদের শ্লোগান শুনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে যায় জলধর।
কাজলের মেয়ে নয়নতারা বলে, বাবা, এটার মানে তুমি জানো? আমরা যা খাই না, যা ফেলে দিই, মা বলেছে এমনকি নিশ্বাস নিয়েও বের করে দিই যেটা, সেগুলো সবই গাছ নিয়ে নেয়, সেগুলো নিয়েই গাছ বেঁচে থাকে। ঐ বাগানের রাস্তাটায় বড়ো বড়ো কাপড় টাঙিয়ে তাতে লিখেও দিয়েছে।
লিখে দিয়েছে? তাই? কে লিখেছে?
কে জানে ! – ঠোঁট উল্টিয়ে বলে নয়নতারা।
বাঃ দারুণ তো, আপনাদের শ্লোগান? – জয়ির দিকে তাকিয়ে বলে সুদীপ্ত।
একটু হাসে জয়মালিকা সেন, কথা বলে না !
জলধর ফিরে যেতেই চেয়েছিলো, কিন্তু জয়ির জোরাজুরিতে থেকে গিয়ে নতুন অতিথিদের সঙ্গ দেয়। রঘুনাথ আর উৎপল ঢোকে রান্নাঘরে। জয়িও মাঝে মাঝে গিয়ে সাহায্য করে তাদের।
দুপুরের খাওয়া, ভাতঘুম, আর তারপর বিকেলের চা-আড্ডা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে কাচের গ্লাসে গরম দুধ হাজির করে উৎপল বাচ্চাদের জন্যে। বড়োরাও বলে ওঠে, আমরা কী দোষ করলাম !
রাতের খাওয়ার আগে পর্যন্ত আড্ডা চলে, সাথে নাচ-গান-আবৃত্তি। রাতের খাওয়া কিছুতেই খেতে রাজি হয় না জলধর, তবে ফিরে যাওয়ার আগে সবাইকে চমৎকৃত করে শুনিয়ে যায় সাঁওতালি গান :
সঙ্গে আছি।
আগের অংশগুলো কিভাবে পাবো যদি জানতে পারতাম......
পেয়েছি l ভালো লাগলো, পরের অপেক্ষায় থাকলাম
পড়ে যাচ্ছি আর অভিভূত হচ্ছি