তোর বন্ধু যদি অসুস্থ হয়ে দিনের পর দিন শুয়ে থাকে তার গ্রামের বাড়িতে, স্কুলে আসতে না পারে, তোর কেমন লাগে?
খারাপ লাগে স্যর।
খারাপ লাগে সে তো বুঝলুম, কিন্তু কী মনে হয়?
স্যর, মনে হয় আমার বাড়িতে কেউ যদি ডাক্তার হতো, তাহলে তাকে নিয়ে যেতুম বন্ধুর বাড়িতে।
আর তুই যদি নিজেই ডাক্তার হতিস, তাহলে?
আমি তো সবে ক্লাস এইটে স্যর, এখনই ডাক্তার হবো কী করে?
এখনই হবি না নিশ্চয়ই, কিন্তু বড় হয়ে যদি হতে পারিস, তাহলে তোর বন্ধুর মতো অসহায় ছেলেমেয়েদের সাহায্য তো করতে পারিস?
হ্যাঁ স্যর।
তাহলে দেখ্, গরীব বন্ধুর অসুস্থতার দুঃখে ক্লাস এইটের একটা ছেলের ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে হতেই পারে, তাই না?তার মানে, তুই যদি তোর কল্পিত বন্ধুকে চিঠি লিখিস যে তার অসহায় অসুস্থতার কথা জানতে পেরে তুই ঠিক করেছিস ভবিষ্যতে তুই ডাক্তার হবি, তাহলে চিঠিটা কতটা স্বাভাবিক শোনাবে ভেবে দেখ্। তার বদলে যদি লিখিস – যেমন পরীক্ষার খাতায় প্রায় সবাই লেখে – রিসিভ্ড্ য়্যোর লেটার, য়্যু হাভ ওয়ান্টেড টু নো হোয়াট ইজ মাই অ্যামবিশন ইন লাইফ, তাহলে ব্যাপারটা বোকা-বোকা হবে না? কোন বন্ধু কাউকে লেখে নাকি তোর জীবনের অ্যামবিশন জানিয়ে আমাকে লেখ্? তুই লিখেছিস কখনও?
তা লিখিনি স্যর, কিন্তু...
কিন্তু কী রে, কোন কিন্তু-টিন্তু নয়, তোর চিঠিটা হতে হবে এমন যাতে মনে হয় অ্যামবিশনের কথাটা স্বাভাবিক ভাবে এলো, পরীক্ষার প্রশ্নের অর্ডারী উত্তরের মতো নয়, বুঝতে পারলি?
উনিশশো উনষাট ! আজ থেকে আটান্ন বছর আগের একদিনের কথোপকথন ! সোমেশ্বর ক্লাশ এইটে; কথোপকথন বিনয় বাবু স্যরের সঙ্গে, বিনোদবিহারী বয়েজ স্কুলের ইংরিজির মাষ্টারমশাই, যিনি সেই বছরেই পশ্চিম বঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সাধারণ সম্পাদকও হয়েছেন। সাদা খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি পরে যখন ইংরিজি গ্রামারের পাঠ দিতেন অথবা শেখাতেন ট্রানস্লেশন-কম্পোজিশন, কে-ই বা বুঝতো যে সেদিনও সকালের খবরের কাগজে তাঁর ছবি বেরিয়েছে হয়তো মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান রায়ের সঙ্গে, অথবা এমনকি স্বয়ং জহরলাল অথবা রাজেন্দ্র প্রসাদের সঙ্গে। পরে অবিশ্যি ষাট-সত্তরের দশকে এই মানুষটা খুন হয়েছিলেন তাঁর নিজের শহর হাওড়ারই এক গলিতে, খবরের কাগজের ভাষ্য অনুযায়ী নকশালদের হাতে। দুর্জনে খানিকটা কানাঘুষো করেছিলো কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দের, কয়েকমাস পর বিনয় বাবুর দাদা, কংগ্রেসের সংসদ সদস্য বিষ্টু বাবুর আত্মহত্যার পর যে কানাঘুষোর আওয়াজ প্রায় স্পষ্ট স্বরেই শোনা যেত হাওড়ার অলি-গলিতে।
আটান্ন বছর ! এতদিন পর এসব কথা ! খুশিঝোরার ইশকুলের অবৈতনিক ইংরিজি শিক্ষক সোমেশ্বর একটা পাথরের উপর বসে পড়লেন ঝোরার পাশে তাঁর বৈকালিক ভ্রমণের শেষে। এই আটান্ন বছরে একবারও কী ভেবেছেন বিনয় বাবু স্যরের কথা? আজ ক্লাসে লেটার-রাইটিঙের পাঠ দিতে দিতে প্রায় বিনয় বাবু স্যরের কথাগুলোই অবিকল বলছিলেন তিনি নিজে। বলছিলেন, এবং বলার সময়েও একবারও মনে পড়েনি বিনয় বাবুকে। শুধু কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিলো কথাগুলো বলার সময়, অদ্ভুত অনুভূতি ! এই কথাই কি আগে বলেছেন কখনো? কাউকে পড়াতে গিয়ে? নিজের মেয়েকে ঠিক এভাবে কখনো পড়াবার প্রয়োজন হয়নি। মৌবী, সে কৃতি ছাত্রী। নিজের পড়া নিজেই সামলাতে পারতো দিব্যি, কারো সাহায্য ছাড়াই। আর তাছাড়া কাকেই বা পড়িয়ে থাকতে পারেন তিনি? সারা জীবন তো কাটিয়েছেন অন্যরকমের পেশায়। স্কুল-কলেজে পড়ানোর প্রশ্ন তো আসেনি। পেশার জীবনের শেষ পনেরো বছর যখন কনস্যালট্যান্টের কাজ করতেন, তখন অবিশ্যি ট্রেনিং দেওয়া তাঁর একটা প্রধান কাজ ছিলো। কিন্তু সে তো ঠিক স্কুলের পড়ানোর মতো নয়, সে তারাখচিত হোটেলে বিজনেস ম্যানেজমেন্টের পাঠ। বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে পড়লো বিনয় বাবুকে। হঠাৎই। আর মনে পড়লো আটান্ন বছর আগে তাঁর সঙ্গে কথোপকথন। প্রায় হুবহু একই কথা, আজ তিনি নিজে যা বলছিলেন ক্লাসে। আরও মনে পড়লো উনসত্তর-সত্তরের সেই দিনটার কথা, যেদিন বিনয় বাবু স্যর খুন হয়েছিলেন। কথাটা শুনেছিলেন যখন, খুব একটা মনে দাগ কাটেনি। কে খুন করেছিলো তাঁকে, কেন এবং কীভাবে, সেটা অবান্তরই ছিলো তখন। আর একজন শ্রেণীশত্রুর পতন! শ্রেণীশত্রুই তো! কে মেরেছে সেটা বড় কথা নয়। ইতিহাস-বিজ্ঞানের অমোঘ নিয়মে মৃত্যু, এ রকমটাই ভেবেছিলেন তখন। সোমেশ্বর তখনো কলেজে, যদিও কলেজ শেষ হয়ে যাবার কথা কয়েক বছর আগেই। উত্তাল ষাটের দশকে পরীক্ষার নিয়মকানুনগুলো অবান্তর হয়ে গিয়েছিলো। কলেজগুলো তখন পরীক্ষা পাশের চেয়েও অনেক বেশি বিপ্লব-কর্মী সংগ্রহের জায়গা। সে কর্মীদের মধ্যেও তখন অনেক দ্বন্দ্ব, অনেক মতান্তর এবং মনান্তর। তথাকথিত শ্রেণীশত্রুদের এক এক করে খুন করার পক্ষপাতী যদিও নিজে ছিলেন না সোমেশ্বর, এক-আধজন পরিচিত খুন হয়ে গেলেও মনে দাগ কাটতো না খুব একটা। ব্যাপারটা অনেক বেশি ছিলো তাত্ত্বিক মতামতের বিরোধ-সংক্রান্ত।
ঘোষিত বিপ্লব হয়নি শেষ অবধি। কলেজের পরীক্ষা পাশও করেছেন মধ্যবিত্ততার অমোঘ নিয়মে। তারপর আরও একটু পড়াশোনা, চাকরির ইন্টারভ্যূ, এবং প্রায় আর পাঁচজনের মতোই গতানুগতিক পেশার জীবন। সে জীবনেও যে সাফল্য একেবারে আসেনি তা নয়, তবে তা এমন কিছু উল্লেখযোগ্যও নয়। কোন বদভ্যাস নেই, মদ্যপানও করেন না, একমাত্র সন্তান বিদেশে থাকে সপরিবার, ছোটখাট একটা ফ্ল্যাট আছে কলকাতায়, এ ছাড়াও ফলতার গঙ্গার ধারে বাড়ি আছে একটা বাগান-টাগান সমেত, ছোটখাটো গাড়িও আছে একটা, অবসরপ্রাপ্ত মধ্যবিত্তের মোটামুটি জীবন কেটে যাওয়ার মতো সঞ্চয়ও যে নেই তা-ও নয়; নিজের জীবনের হিসেব মেলাতে বসেন সোমেশ্বর। যৌবনের শুরুতে বিপ্লবের অনিবার্যতার বিষয়ে যা ভাবতেন, এখনো প্রায় সেরকম ভাবতেই ভালবাসেন; এক-আধজন ছাড়া সে সময়ের বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কোনই যোগাযোগ নেই, তাদের মধ্যে কেউ কেউ লেখক-সমালোচক-সমাজকর্মী-অধ্যাপক হিসেবে এখন খ্যাতিমান, রাজনীতিতেও আছে দু-একজন, কাগজে-টেলিভিশনে মাঝে মাঝে তাদের সাক্ষাৎ বা খবর পাওয়া যায়, কিন্তু আগের মতো করে ভাবে না প্রায় কেউই।
বিপ্লবের অনিবার্যতা! কেমন হবে সে বিপ্লব? রক্তক্ষয়ী? গত চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরে কতই তো পালটিয়ে গেলো পৃথিবী। রক্তক্ষয় আগের তুলনায় বেড়েছে বৈ কমেনি। সমাজতন্ত্রের বোধ বদলিয়ে গিয়েছে, বদলিয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শোষণ-বঞ্চনার রীতিনীতিও। বিপণনের বিশেষজ্ঞ হিসেবে সোমেশ্বর জানেন কী অদ্ভুত কৌশলে প্রায়-বিত্তহীন মানুষকে তার শেষ সম্বলটুকুও বন্ধক দেবার আশ্চর্য আনন্দ, অকল্পনীয় মাদকতায় মাতিয়ে তোলা গেছে বিশ্ব জুড়ে, নিপীড়নের আনন্দে যেন মশগুল বঞ্চিতের দল !
কলেজের শেষের দিকে দু ধরণের রাজনীতিক কর্মীদের সঙ্গে সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়েন সোমেশ্বর। রাজনৈতিক কোনও কাণ্ডজ্ঞানই নেই, আবেগঘন এমন কিছু আদর্শবাদী প্রায়-কিশোর যখন দলে দলে গ্রামে চলেছে বিপ্লব সংগঠিত করতে, তাদের বিরত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে তাদের, এবং দলের পক্ককেশ কিছু নেতার, বিরাগভাজন হয়েছিলো সেদিনের তরুণ সোমেশ্বর। আর অপাপবিদ্ধ এই কিশোরদের সঙ্গে ছিলো 'খতম' নেশাগ্রস্ত আর একদল শহুরে এবং আধা-শহুরে দুষ্কৃতি, পার্টির পরিভাষাতেও যাদের লুম্পেন আখ্যাই দেওয়া হতো – অবিশ্যি ঈষৎ সংস্কৃতায়িত লুম্পেন – লুম্পেন প্রোলেতারিয়েত! বিপ্লবের আমদানী-রপ্তানীতে বিশ্বাস করতো না সোমেশ্বর, তার বিশ্বাস ছিলো শিক্ষায়; অক্ষর পরিচয় থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ জীবনযাপনের শিক্ষায়। তরুণ সোমেশ্বর বিশ্বাস করতো গ্রামে যাওয়ার প্রয়োজন আছে, কিন্তু তা বিপ্লব সংগঠনের জন্যে নয়, নিপীড়িত মানুষের কাছ থেকে শিক্ষা পাওয়া, আর সেই মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার জন্যে; তার বিশ্বাস ছিলো সেই শিক্ষাই বিপ্লবের জন্ম দেবে।
অবসর গ্রহণের কিছুদিন পর থেকে এই চিন্তাটাই আবার মাথায় ঢোকে সোমেশ্বরের। ভেবে দেখেন, তাঁর চিন্তা এবং বিশ্বাস এখনো সেই ছাত্রজীবনের মতোই। শিক্ষা। সম্পূর্ণ শিক্ষা। সম্পূর্ণ শিক্ষাই এ দেশের বেশির ভাগ মানুষকে সচেতন করবে তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে, এবং সেখান থেকেই শুরু হবে আমূল বদলাবার প্রস্তুতি। এখানে ওখানে ঘুরতে ঘুরতে খুশিঝোরায় পৌঁছোন সোমেশ্বর। বাংলা আর ঝাড়খণ্ডের সীমানায় সাঁওতাল-মুণ্ডা-ওরাওঁ অধ্যুষিত এই জঙ্গলমহল অঞ্চলে এক মহিলা শিল্পী তাঁর আপাতপ্রকাণ্ড কর্মকাণ্ডের একটি অংশ হিসেবে চালান তাঁর ছোট স্কুলটি। জয়মালিকা সেনের কর্মকাণ্ডের ঠিক ঠিক মতো সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যাখ্যা খুঁজে পান না সোমেশ্বর। শুনেছেন, শুরু হয়েছিলো বনসৃজনের পরিকল্পনা নিয়ে। পাথুরে, ঊষর পাহাড়িয়া জমিতে বহু গাছ পুঁতেছিলেন তিনি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুবান্ধব, এবং বহু যত্নে বাঁচিয়েছিলেন তাদের, বাড়িয়েও ছিলেন। কত গাছ? হদিশ করা মুশকিল। হয়তো এক লক্ষ, পাঁচ লক্ষও হয়তো বা। এ সবই শোনা কথা। জয়মালিকা নিজেই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যার কথা বলেন। কিন্তু আসলে সংখ্যাটি অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক। জমি এবং প্রকৃতির চরিত্র অনেকটাই বদলিয়ে দেবার মতো যথেষ্ট সংখ্যক বৃক্ষরোপণ যে হয়েছিলো, সে বিষয়ে তো সন্দেহ নেই। আজ এখানে ধান ফলে, প্রতিটি মরশুমে শাক-সবজিও ফলানো হয়। বড় বড় ফলের গাছ, আম-কাঁঠাল-আতা-গাবের অভাব নেই। ফুল ফোটে হাজারো রকমের, বসন্তে অশোক-পলাশের লাল, নীল পাহাড়ের পটে অপরূপ শোভা ধরে। গো পালন হয়, প্রায় পঁয়ত্রিশ-চল্লিশটা ষাঁড়-গোরু-মোষের সংসার। শিল্পীমহলে মহিলাকে চেনে অনেকেই, কলকাতার কোন-না-কোন গ্যালারিতে দু-এক বছর অন্তর নানা যৌথ প্রদর্শনীতে তাঁর ছবিও দেখা যায়। বহু প্রকাশন সংস্থা এবং খবরের কাগজের সঙ্গে যোগাযোগ আছে তাঁর, বই-পত্র এবং পত্র-পত্রিকার অলঙ্করণ-প্রচ্ছদের কাজও করেন প্রায়ই। ফলত ওঁর এবং ওঁর প্রতিষ্ঠানের নাম বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে একেবারে অপরিচিত নয়। দুয়েকজন বন্ধুর উচ্ছ্বসিত সুপারিশে প্রথমে এখানে এসে পড়াটা ছিলো নতুন একটা জায়গায় বেড়াতে আসার মতোই। কিন্তু প্রথম বারেই জায়গাটা ভারি ভালো লেগে গিয়েছিলো। এরপর প্রায়ই এখানে সস্ত্রীক বেড়াতে এসেছেন। চমৎকার কথা বলেন এই শিল্পী মহিলা, মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা অনুচ্চারিত থাকে না। বনাঞ্চল, আশপাশের আদিবাসী এবং অন্যান্য প্রান্তিক মানুষদের বিষয়ে তাঁর আবেগ ধরা পড়ে তাঁর শিল্পকর্মে। স্কুলটিও এই আবেগেরই ফলশ্রুতি বলে মনে হয়। শুনেছেন সরকারি কোন সাহায্য আসে না প্রতিষ্ঠানটিতে, কিন্তু আর্থিক অনটনও চোখে পড়ে না। বোঝা যায়, তাঁর অগণিত পরিচিত এবং সুহৃদরা মুক্তহস্তে সাহায্য করেন প্রতিষ্ঠানটিকে। এ ছাড়াও এখানকার গেস্ট-হাউজের আট-দশটি ঘরে প্রায় সারা বছরই ভ্রমনার্থীর ভিড়। বিলাসবিহীন কিন্তু আরামদায়ক ঘরগুলো থেকেও আয় ভালোই। গেইনফুলি এমপ্লয়েড নই – কী করেন, প্রশ্নের এই উত্তরে – প্রথমবারেই মহিলা প্রস্তাব দেন অবৈতনিক শিক্ষকতার, আপনাদের মতো মানুষরা এলে হতদরিদ্র এই ছেলেমেয়েগুলো একটু লেখাপড়া শেখার সুযোগ পায়, এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় যথেষ্ট অর্থের বিনিময়েও ঠিকমতো শিক্ষক তো পাওয়া যাবে না।
প্রস্তাবটা মনে ধরে সোমেশ্বরের, যদিও প্রথমবারেই কথা দেননি। প্রস্তাবটা কি সীরিয়সলি দিচ্ছেন, নাকি কথার কথা? মানে, আসবো না জেনেও প্রস্তাব, বলার জন্যেই বলছেন? কিছু যদি না মনে করেন, একটা কথা বলি। নিজের অভিজ্ঞতার থেকেই বলছি। আর পাঁচজনের মতো নয়, একটু অন্য ধরণের, অর্থাৎ আরাম-বিলাস-স্বচ্ছন্দ জীবনযাপন ছেড়ে একটু অমসৃণ জীবন বেছে নেন যে মধ্যবিত্তরা, তাঁরা, বিশেষ করে তাঁদের ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে যদি সমাজ-সেবার গন্ধ মিশে থাকে একটুও, সেই মানুষরা, প্রায়ই আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন নিজেদের ত্যাগের কথা ভেবে। তাঁদের চিন্তায় একটা প্রবণতার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে: অন্যরা পারলো না, আমি পারলুম, ঈষৎ আত্মশ্লাঘা! কাজেই কেউ আসবে না জেনেও এই প্রস্তাব! আরও একজনকে বললুম, কৈ এলো না তো! সে রকম ভেবে বলছেন না তো?
তাৎক্ষণিক কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সোজা সোমেশ্বরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন মহিলা, মুখে একটু হাসির ছোঁয়া। সামনের চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলতে থাকেন তারপর: দু দিন তো থাকলেন আমাদের এখানে, ঘুরে-টুরে দেখলেন সবকিছু, কী ধারণা হলো আমাদের সম্বন্ধে? আমরা কতজন আবাসিক এখানে, বুঝলেন? আমাদের রান্নাঘরে কাজ করে দু জন, বাগানে এক জন, সে-ও মাঝে মাঝে রান্নাঘরের কাজে হাত দেয়, আমিও দিই। গোয়ালে একজন আছে, বুধিয়ার মা। ডাক্তারবাবু আছেন একজন, মেডিকাল কলেজে পড়া ডাক্তার ন'ন, কিন্তু আমাদের দাতব্য আউট-পেশেন্ট সেন্টার চালানোর, আর প্রয়োজন বুঝলে রোগীকে সরকারী মহকুমা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। গ্রামের মানুষ, গোরুর দুধ দুইতে পারেন ভালো, সে কাজটাও উনিই চালিয়ে দেন। সারা বছর কিছু-না-কিছু চাষ করি আমরা, তার জন্যে আমাদের মালিকে সাহায্য করে নিতু আর তার বৌ শিবানী, ওরা এখানে রাত্তিরে থাকে না, সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি কাজ-টাজ করে, তারপর রাতের খাবার বেঁধে নিয়ে ফিরে যায় ওদের বাড়িতে, পাশেই ওদের গ্রাম। বাসন-কোসন ধোয়াধুয়ি, ঝাঁট-পাট দেওয়া, গেস্ট হাউজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, এ সবের জন্যে দুই বিধবা মহিলা আছে, তাদের আমরা বড় মাসি আর ছোট মাসি বলে ডাকি, তাছাড়া সব সময়ের যে কোন কাজের জন্যে দু বোন, বাল্যবিধবা, শুকি আর লকি। স্কুলের দুজন শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী আশপাশের গ্রাম থেকে আসেন, তাঁরাও বিকেলে চায়ের পর ফিরে যান নিজের নিজের বাড়িতে। এ ছাড়া মাষ্টারমশাই মুজফ্ফর সাহেব আর প্রতুল বাবু। এঁরা দুজনের কেউই এখানকার মানুষ ন'ন, কিন্তু ভাগ্যক্রমে দুজনেই অবিবাহিত। এখানেই থাকেন আমাদের ডর্মিটরিতে, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে। আঠেরো-উনিশ জন ছাত্রছাত্রীও থাকে এখানে। হোস্টেল বললে যে ছবিটা ভেসে ওঠে মনের মধ্যে, ঠিক সেরকম অর্থে হোস্টেল নয়, কিন্তু ম্যানেজ-ট্যানেজ করে ওদেরও অ্যাকোমোডেট করি আমরা। আপনি তো দেখলেনই আমাদের স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীদের জন্যে খাওয়া-দাওয়ারও ব্যবস্থা করি আমরা। সরকারী মিড-ডে মীল নয়, নিজেরাই করি। এই সব মিলিয়ে মিশিয়ে আমাদের যে সংসার, তার মধ্যে আপনি আর আপনার স্ত্রী ঢুকে পড়লে আমরা প্রায় জানতেই পারবো না। থাকাটা একটু কষ্টের হবে ঠিকই, কিন্তু যতটা কষ্টের হবে, এই দু-দিন আপনাদের সঙ্গে মিশে মনে হলো সেটা খুব গায়ে মাখবেন না আপনারা। আপনার মতামত খুব জোরদার, মনে মনে একটা জোরদার আদর্শ পোষণ করেন এটা বোঝা যায়। আসেন যদি, আমরা আপনার সঙ্গে মানিয়ে চলার চেষ্টা করবো। আপনার সম্বন্ধে এটা বোঝা যায় যে আসবেন বললে আপনি আসবেনই। একটু ভেবে দেখুন, এলে আমাদের ভালো লাগবে, ছেলেমেয়েদের উপকার হবে, আর আপনিও বোধ হয় মনের মতো কাজ পাবেন একটা।