নিলীনের বইটা বেরিয়ে গেলো। প্রচ্ছদ যিনি এঁকেছেন তিনি শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র, শিল্পী হিসেবে এবং প্রচ্ছদ-আঁকিয়ে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যদিও খুব বেশি কাজ করেন না। কবিতা লেখেন, সাধারণ মানুষ এবং ছোটদের জন্যে গবেষণাধর্মী ইতিহাসমূলক কিছু কিছু বই লিখেছেন হালকা চালে, এবং সিনেমাও পরিচালনা করেছেন কয়েকটা। কলকাতায় শুভেন্দু মৈত্রর খুব নামডাক, ওঁর গুণমুগ্ধ অনেকেই। নাম তো শুনেছে নিশ্চয়ই, কিন্তু জয়ির আলাপ ছিলো না ওঁর সাথে। কলকাতায় প্রেস ক্লাবে বেশ ঘটা কোরে প্রকাশ করা হলো বইটা, বড়ো বড়ো গবেষক-অধ্যাপক-মেধাজীবীদের অনেকের সাথে পরিচয় হলো জয়ির, এবং ওর ঝুলিতে যে পাহাড়ি খাড়িয়াদের আরও অনেক ছবি আছে, এ কথা জানাতে কসুর করলো না ও। অনেকেই ছবিগুলো দেখার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। শুভেন্দু মৈত্রর সাথে ওকে বিশেষ কোরে আলাপ করিয়ে দিলেন ভূদেবদা। শুভেন্দুদারও আগ্রহ বাকি ছবিগুলো দেখার। সুদেশের বাড়িতে যে ছবিগুলো এসেছিলো বোম্বে থেকে সেগুলো ওখানেই থেকে গেছে, নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে কোন আগ্রহ দেখায়নি জয়ি। সুদেশই তুললো সেই ছবিগুলোর কথা।
আপনি যদি দেখতে চান, কালই নিয়ে এসে দেখাতে পারি আপনাকে, শুভেন্দুদাকে বললো সুদেশ।
কালই হবে না, তবে দেখার আগ্রহ আমার খুবই আছে, বললেন শুভেন্দুদা, তারপর জয়িকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কতদিন থাকবেন কলকাতায়?
আপনি যদি দেখেন ছবিগুলো, যতদিন বলবেন ততদিন থেকে যাবো। আপনাকে দেখিয়ে তবে ফিরবো।
ভূদেবদা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন ওদের কথা, এবার সরাসরি শুভেন্দুকে বললেন, সুদেশ তো আমাদের অফিসেই চাকরি করে। ও বরঞ্চ ছবিগুলো অফিসে এনে রাখুক, তুমি তোমার সুবিধে মতো দেখে নিও।
একটু ইতস্তত করে জয়ি, তারপর বলেই ফেলে, সেই সুবিধেটার সময় আমিও থাকতে চাই, শুভেন্দুদার মন্তব্য এবং সাজেশন সরাসরি ওঁর কাছ থেকেই শুনবো।
ঠিক আছে, পরশু দুপুরে তোমার অফিসে আসছি, ভূদেবদাকে বলেন শুভেন্দু্দা।
নিলীন জয়ির মতো অত সপ্রতিভ নয়, এতক্ষণ বসে বসে চুপ করে ওদের কথোপকথন শুনছিলো। এবার সে সরাসরি ভূদেবদাকে জিজ্ঞেস করে, আপনার অফিসে যদি আমি যাই, অসুবিধে হবে?
কিছুমাত্র নয়, আশ্বস্ত করেন ভূদেবদা, চলে আসুন। জয়মালিকার সাথেই আসুন না।
ছবিগুলো দেখতে দেখতেই বোম্বে এবং কলকাতার এগজিবিশনের কথা শুনলেন শুভেন্দুদা, নিলীনের সাথে যোগাযোগ কীভাবে হলো সে কথাও উঠলো। জয়িকে বললেন, বোম্বের এগজিবিশন তো ভালোই ডিভিডেণ্ড দিলো আপনাকে, না হলে নিলীনবাবুর সাথেও আলাপ হতো না, আর ছাপা হবার পর এখন যতো লোক দেখবে তত লোক দেখতেও পেতো না আপনার কাজ। আমি অবিশ্যি, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আপনার ঐ বোম্বের বন্ধুকেই তার কৃতিত্বটা দেবো। অত অ্যাগ্রেসিভ গ্যালারি-ওনার ছাড়া এ সম্ভব হতো না। আপনি নিশ্চয়ই কলকাতার এগজিবিশনটা দেখে সেটা বুঝেছেন।
জয়ি কিছু বলে না, একটু আনমনা হয়ে যায়, অন্যের নাম না জড়িয়ে যে ওর প্রশংসা হয় না তা পীড়িত করে ওকে। তারপর শুভেন্দুদার কণ্ঠস্বর সম্বিৎ ফেরায় ওর।
আমার মতে এ ছবি আপনার দেখানো উচিত ট্রাইবাল মানুষদের, বলেন শুভেন্দুদা, আমাদের মতো শহুরে ভদ্রলোকদের নয়। ওদের যদি দেখাতে পারেন তাহলে বুঝতে পারবেন কেন আমি এ কথা বলছি। আচ্ছা, আপনাদের ঐ স্টীল প্লান্টের শহরে দেখানোর ব্যবস্থা করা যায় না?
ওখানে তো ছবি দেখাবার মতো হল-টল পাওয়া যাবে না, তবে আমার কাজ তো, ধরাধরি করলে প্লাণ্টেই দেখানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
তাতে লাভটা কী হবে? – প্রশ্নটা ছোঁড়েন ভূদেবদা, প্লান্টের শহর তো অবিমিশ্র ভদ্রলোকের শহর। ওখানে ট্রাইবালরা কোথায়? আর, থাকেও যদি দুয়েকজন, তারা নিশ্চয়ই ভদ্রলোক হয়ে গেছে এতদিনে !
একটু ইতস্তত কোরে এবার কথা বলে নিলীন, আপনাদের ইমপ্র্যাক্টিকাল মনে হবে কিনা জানিনা, আমি কিন্তু একটা এমন জায়গার কথা বলতে পারি, যার চারপাশে সাঁওতাল-মুণ্ডা-ওরাওঁদের বাসস্থান, তাছাড়া ভূমিজ – তারাও ট্রাইবাল, নামের সাথে সিং ব্যবহার করে পদবি হিসেবে – এবং দেখাবার মতো রেডিমেড জায়গাও আছে। শুধু একটু ঘসে মেজে পরিষ্কার করা, আর একটু বাড়তি আলোটালোর ব্যবস্থা করা।
কোথায়? – জয়িই জিজ্ঞাসা করে প্রথম।
খুশিঝোরা সমিতিতে।
খুশিঝোরা সমিতি? সেটা কোথায়? – ভূদেবদার প্রশ্ন।
খুশিঝোরার ব্যাপারটা সবটাই বলে নিলীন, একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খ, আগ্রহ নিয়ে শোনেন শুভেন্দুদা আর ভূদেবদা।
ওখানে দেখানো যাবে? মানে ব্যাপারটা অর্গানাইজ করা সহজ ব্যাপার নয় তো, তাই বলছি, ভূদেবদার মন্তব্য।
নিলীন অকপটেই স্বীকার করে ছবির এগজিবিশন অর্গানাইজ করার ব্যাপারে কোনই ধারণা নেই ওর, কিন্তু সবাই মিলে চেষ্টা করলে হবে না কেন? বান্দোয়ানে ওর বন্ধু আছে জলধর, সাঁওতাল সমাজে তার খুব প্রতিষ্ঠা, তার সাহায্য নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। তা ছাড়া সুদেশ আর জয়ি মিলে কলকাতায় একটা এগজিবিশন তো করেছিলো আগেই। আর বোম্বেতে মহেশের সাথেও ছিলো, সেগুলোর থেকেও তো নিশ্চয়ই খানিকটা শিখেছে ওরা।
খুশিঝোরাতে এগজিবিশন করার কথা জয়ির মাথায় আসেনি আগে, কিন্তু এখন সে রীতিমতো উত্তেজিত। শুভেন্দুদাকে জিজ্ঞেস করে, খুশিঝোরাতে যদি করি এগজিবিশন, যাবেন আপনি?
নিলীনবাবুর কাছে আপনাদের খুশিঝোরার যে বিবরণ শুনলাম তাতে আমার তো এখনই যেতে ইচ্ছে করছে। এগজিবিশনটা তো আর কালই হচ্ছে না, কিছুদিন সময় লাগবেই সে ব্যবস্থা করে উঠতে। দিনটা ঠিক হয়ে গেলেই আমাকে জানাবেন। নিশ্চয়ই যাবো।
প্রবল উত্তেজিত জয়ি পরের দিন সকালেই ইস্পাত এক্সপ্রেসে গালুডি স্টেশনে পৌঁছোল। নিলীন ছিলো ওর সাথে খড়গপুর পর্যন্ত। গালুডি স্টেশন থেকে একটা ভিড়-উপচে-পড়া জীপে লাক্ষার কারখানাটার গেটের সামনে। হেমন্ত ওকে দেখে অবাক। কী ব্যাপার, বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ?
এগজিবিশনটা কবে করতে চাস? – সব শুনে প্রশ্ন করে হেমন্ত।
সেটা এখনই ঠিক ঠিক বলতে পারছি না। সমস্ত ব্যাপারটা ঠিকঠাক গুছিয়ে নিতে হবে। শুভেন্দুদা আর ভূদেবদা দুজনেই আসবেন বলেছেন। শক্তিদাকে তো আমি আনতে পারবোই। কলকাতায় শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁদের মধ্যে যতোজনকে পারি, নিয়ে আসবো। সবায়ের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। এটাই আমার শেষ চান্স বাবা। এই এগজিবিশনটা আমাকে সফল করতেই হবে। কিন্তু খুব একটা বেশি দেরি করা চলবে না।
এর মধ্যে আরও দুটো গোরু কিনেছে হেমন্ত। লাক্ষার কারখানা বিক্রী হয়ে গেলে ও কোথাও একটা চলে যাবে ঠিক করেছিলো। বিক্রীটা হলো, কিন্তু হেমন্ত যা ভেবেছিলো তা হলো না। এখন ও যদি চলে যায় এখান থেকে, সম্পত্তিটা বেদখল হয়ে যেতে পারে। যতদিন না জয়ি অথবা ওর বন্ধুদের মধ্যে কেউ জায়গাটার দায়িত্ব নেয়, ততদিন ওর হাত-পা বাঁধা। এতটা জায়গা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখাও সহজ নয়। কাজেই রঘুনাথও থেকে গেছে, আর ডাংলাজোড়ার ঐ মেয়েটা, যার নাম অষ্টমী। চারটে গোরুর মধ্যে দুটো দুধ দিচ্ছে এখন, কম নয়। দুটোতে মিলে সের পনেরো ষোল তো নিশ্চয়ই। আরও ভালো জাতের গোরু কিনতে পারলে আরও বেশি হতো। এই গোরুর দুধ এখন বান্দোয়ানের বড়ো মিষ্টির দোকানটা রোজ কেনে। গালুডি থেকে বান্দোয়ান পর্যন্ত যে ভাড়ার জীপগুলো যাতায়াত করে নিয়মিত, তাদেরই একটা দুধের ক্যানটাকে নিয়ে যায় রোজ, আবার ফিরিয়েও আনে। তাছাড়া বাগানে কিছু সব্জীও ফলায় রঘুনাথ। হেমন্ত রঘুনাথ আর অষ্টমীর এতেই চলে যায় মোটামুটি।
এই জীপকে দিয়েই খবর পাঠিয়ে দেয় হেমন্ত মিষ্টির দোকানে, সেখান থেকে জলধরকে। পরের দিন জলধর হাজির। এগজিবিশনের খবরে সে খুব খুশি, মাস তিনেকের প্রস্তুতি নিতে পারলে একটা গ্র্যাণ্ড এগজিবিশন দাঁড় করিয়ে দেবে সে।
মোট দুখানা বড়ো হলঘর আর চারটে সাধারণ মাপের ঘর আছে এখানে। হলঘর দুটোয় এগজিবিশন লাগিয়ে দিলে প্রায় ষাট-সত্তরটা ছবি দেখানো যায়। আবার ঐ একই ঘরে ক্যাম্প-খাট পেতে দিলে আট-দশজন দিব্যি শুতে পারে রাত্তিরে এক-একটা ঘরে। অন্য ঘরগুলোর মধ্যে একটা জয়িদি আর কাকুর জন্যে আলাদা করে রাখলেও বাকি তিনটে ঘরে ছয় থেকে আট-ন'জন থাকতে পারে। অর্থাৎ, জলধর বলে, মোটামুটি জনাপঁচিশেক লোককে স্বচ্ছন্দে অ্যাকোমোডেট করতে পারে খুশিঝোরা। আমরা যদি পনেরো দিন খোলা রাখি এগজিবিশনটা, যাঁরা বাইরে থেকে আসবেন তাঁরা প্রত্যেকে তো পনেরো দিনই থাকবেন না, দু-তিনদিন পর-পর চলে যাবেন এক একটা ব্যাচ। কাজেই অন্তত শখানেক কলকাতার লোককে অ্যাকোমোডেট করতে পারবো আমরা। এ ছাড়াও বান্দোয়ানের কাপড়ের ব্যবসায়ী নাগবাবুরা খুব কালচার্ড লোক। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি ভি-আই-পি গোছের তিন-চারজনকে ওঁদের বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করতে পারবো আমি। এগজিবিশনটা আমাদের এ অঞ্চলে একটা উৎসব হয়ে উঠবে। সবাই কোঅপারেট করবে।
কিন্তু মুশকিল হলো, একটিই মাত্র বাথরূম-টয়লেট এখানে, হেমন্ত বলে, এত লোকের এতে অসুবিধে হবে না?
বাথরূম-টয়লেট আরও কয়েকটা তৈরি করে নেওয়া যায় না? – জয়ির প্রশ্ন, জায়গার তো অভাব নেই এখানে।
সেরকমই ব্যবস্থা হয়। অ্যাসবেস্টসের চালের গাড়ি রাখার জায়গাটা থেকে আর একটু এগিয়ে গেলে পাঁচিলের গায়ে যে ছোট দরজাটা আছে, সেটার পাশে একটুখানি ফাঁকা জায়গায় কয়েকটা টয়লেট-বাথরূম তৈরি করা যাবে। দুপুরে খাওয়ার পর মোটর বাইকের পিলিয়নে জয়িকে বসিয়ে বান্দোয়ানে নিয়ে যায় জলধর। একটা হার্ডওয়্যারের দোকানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একজন মিস্তিরি-কন্ট্র্যাক্টর গোছের লোকের দেখা পাওয়া যায়, তাকে নিয়ে খুশিঝোরায় ফেরৎ আসে ওরা।
পাঁচখানা টয়লেট পাশাপাশি, তিনটে পুরুষদের, দুটো মহিলাদের, একমাসেই হয়ে যাবে, খরচ প্রায় লাখখানেক, একটু কমই হতে পারে তার চেয়ে। বাবার কাছ থেকে দু লাখ টাকা পেয়েছিলো জয়ি, তার এক লাখ খরচ হয়েছে ওর নিজের কন্ট্রিব্যুশন হিসেবে প্রপার্টিটা কেনার সময়। কাজেই এক লাখ তো দিতেই পারে ও। শুরু হয়ে যাক কাজ। কন্ট্র্যাক্টর যে, তার নাম ফেলারাম দত্ত। বললো, আমি কাল থেকেই মাল ফেলতে শুরু করছি, এখানে আমার টাকা মার যাবে না। দিন পনেরো পর কিছুটা টাকা দেবেন, ধরুন হাজার পঞ্চাশেক।
ফেলারাম চলে যাওয়ার পর জলধর জিজ্ঞেস করে জয়িকে, কবে যাচ্ছেন আপনি? এখানে কতো দিনের প্রোগ্রাম?
কোন কাজ না থাকলে কালই চলে যাবো।
ঠিক কাজ নয়, কিন্তু আমার মাথায় একটা প্ল্যান ঘুরঘুর করছে কয়েকদিন ধরে, বলে জলধর। সেটা বলি আপনাকে।মনে আছে প্রপার্টিটা কেনার দিন আমরা সবাই মিলে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম রাস্তার ওপারটায়? ঐ যেখানে একেবারে রুক্ষ মরুভূমির মতো, অথচ খানিকটা দূরেই একটা সবুজ পাহাড়, আর প্রায় জঙ্গলের মতো ঘন গাছপালা? ওই রুক্ষ জমিগুলোর মালিক কে আমি খোঁজ নিচ্ছিলাম। এখান থেকে বেরিয়ে খুশিঝোরাকে বাঁয়ে রেখে সোজা যদি হাঁটা যায় মাইল দু-তিন, ডান দিকে একটা রাস্তা পাওয়া যাবে। সেই রাস্তা দিয়ে খানিকটা হাঁটলে একটা গ্রাম, নাম পাতাপাড়া।
পাতাপাড়া ! জয়ি বলে, বাঃ, বেশ নাম তো !
আমাদের এই অঞ্চলের ভাষায় পাতা মানে মেলা। ধরুন কোন একটা জনপদে খানিকটা জমি পতিত পড়ে ছিলো অনেকদিন, কোন কাজেই লাগছিলো না। ক্রমে সেই পতিত জায়গাটা হয়ে উঠলো আশপাশের গ্রামের একটা মিলনক্ষেত্র, মেলার জায়গা। পতিত, তাই মেলা। পতিত, তাই পাতা। সেই থেকেই পাতা মানেই মেলা।
আপনি বলছেন আমাদের অঞ্চলের ভাষা। কী ভাষা? সাঁওতালি? পাতাপাড়া কী সাঁওতালিদের গ্রাম?
না, সাঁওতালি নয় ঠিক, আবার সাঁওতালিও।
সাঁওতালি নয়, আবার সাঁওতালিও। কীরকম?
নানা উপজাতির মানুষ, তা ছাড়া রাঢ়ী বাঙালি যারা বহুদিন ধরে এখানকারই অধিবাসী, তারা সবাই মিলে আমাদের এই মানভূম-সিংভূম-ধলভূম অঞ্চলে আছে বহুদিন পাশাপাশি। এদের সবায়ের ভাষা মিলে এক ধরণের ভাষা – উপভাষাও বলে কেউ কেউ – কালক্রমে তৈরি হয়ে গেছে। কেউ কেউ একে ঝাড়খণ্ডী লোকভাষাও বলেন। এই ভাষায় এ-পাড়া ও-পাড়া, এ-গ্রাম-ও-গ্রাম মিলিয়ে একধরণের মেলার গান আছে, তাকে বলে পাতার গান। পাতার গান ভালো কোরে শুনলেই এর মূল বাংলা ভাষাটা বুঝতে পারবেন, কিন্তু গাওয়া হয় সাঁওতালি সুরে। শুনবেন একটা? গান ধরে জলধর –
পাওড়া দুলি পখরকে গেলে
শালুক ফুল তুলি মাথায় গুঁজিল
হাতে ত তেল গিনা, মাথায় ত কুলসী
কাঁখে ত গাগরা গায়ে ত গামছা
পাওড়া কুল্হি দুলি আল করিল।
ছত্রে ছত্রে বাংলা। দেখুন, পাওড়া গ্রামের দুলি পুকুরে গিয়ে মাথায় গুঁজলো শালুক ফুল। তার হাতে তেলের বাটি, মাথায় কলসি – আমার মনে হয় এটা ছোট কলসি, ঘটি জাতীয় – কাঁখে গাগরি, বোধ হয় বড় কলসি – গায়ে তার গামছা, গাঁয়ের পথ সে আলো করে চলেছে।
এই পাতাপাড়া গ্রামে সাঁওতাল-মুণ্ডা আছে কিছু, সে এই অঞ্চলে যেখানেই যান পাবেন। কিন্তু গ্রামটা মূলত কুম্ভকারদের, এ ছাড়াও কায়স্থ আছে তিন-চার ঘর। এই কায়স্থরা সরকার। ঐ যে রুক্ষ অঞ্চলটা, যে জন্যে পাতাপাড়া, ওর বেশির ভাগটাই ঐ কায়স্থদের। পড়েই আছে, ওদের কোন প্ল্যানই নেই এই জমির ব্যাপারে। ওদের এক ভাই বান্দোয়ানের স্কুলে মাষ্টার। তার কাছে খোঁজ নেওয়ায় সে বললো, একে তো চাষ করার মতো জমিই নয়, তা-ও হয়তো কিছু করা যেতো এখন সব নতুন নতুন পদ্ধতি বেরিয়েছে সেই সবের সাহায্যে, কিন্তু তা-ও হবে না। দেখে মনে হয় একটানা জমি, আসলে কিন্তু তা নয়। ওর মাঝে মাঝে দুয়েকটা প্লটের মালিকানা অন্যের, আর সেগুলো যাদের, তাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে যে একটা বড়ো চাষের প্লট তৈরি করবো, তারও উপায় নেই; প্লটগুলো কাদের সেটা নিয়ে যে অস্পষ্টতা আছে তা তো বললামই, তার ওপর শুনেছি অনেকগুলোই ট্রাইবাল প্লট। আমাদের কেনার উপায় নেই। একটু দম নিয়ে বলে জলধর, আমার কী মনে হয় জানেন? সবাই মিলে চেষ্টা করলে পুরো জমিটাই কিনে নেওয়া যায়, মনে হয় খুবই সস্তায় পাওয়া যাবে।
জমি কিনে আমরা কী করবো? আমাদের কী কাজে লাগবে ঐ টুকরো টুকরো সরকারদের জমি?
টুকরো টুকরো কেন? আমরা তো ট্রাইবাল ল্যাণ্ডগুলোও কিনতে পারি।
পারি হয়তো, কিন্তু তারপর?
গাছ লাগাবো। বনসৃজন করবো। বড়ো বড়ো গাছ। এখানে বৃষ্টি আনাবো।
একটু ভাবে জয়ি, তারপর বলে, প্রস্তাবটা আপনার মন্দ নয়, কিন্তু আমি একা তো এতো বড়ো সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না। সবায়ের সাথে কথা বলতে হবে, সবাই রাজি হলেও, যতই কম হোক, সে টাকাটাও তো জোগাড় করতে হবে।
হ্যাঁ, আপনি কথা বলতে থাকুন, আমি প্রস্তাবটা দিলাম। আর একটা কথা।
বলুন।
বনদপ্তর থেকে গাছের চারা দিচ্ছে, আমি খোঁজ নিয়েছি। টয়লেটগুলো যেখানে হচ্ছে ওর পাশে যে দরজাটা আছে, ওটা থেকে বেরোলেই তো ছাড়া ছাড়া পাঁচিল দেওয়া ফাঁকা জমি। ওটার মালিকানা তো খুশিঝোরার। ওখান থেকেই শুরু করতে পারি না আমরা বনসৃজনের কাজ? তবে একটা কথা আছে। আমরা, মানে এই অঞ্চলের মানুষ যারা, অনেকদিন ধরেই দাবি করছি এখানকার পতিত বা খাস জমিতে শাল-মহুয়া লাগানো হোক, আসলে শাল-মহুয়াই এই ঝাড়খণ্ডী অঞ্চলের জঙ্গলের প্রকৃত সম্পদ। নানা কারণে, নানাধরণের ইন্টারেস্টের স্বার্থে, বনদপ্তর শাল-মহুয়ার বদলে সোনাঝুরি বা য়্যুক্যালিপটাস জাতীয় গাছের চারাই দিচ্ছে বেশি বেশি কোরে, আর শাল গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে যেখানে, সেখানে লাগাচ্ছে সেগুন গাছ। শুনেছি ইদানিং কিছু কিছু ফলের গাছের চারাও পাওয়া যাচ্ছে। যদি ভবিষ্যতে সরকারদের জমিটা আমরা নিতে পারি তাহলে ওখানে শাল-মহুয়াই লাগাবো। কিন্তু আপাতত এখানে জমির প্রান্ত ধরে বর্ডার ইণ্ডিকেট করার জন্যে কিছু কিছু সোনাঝুরি-য়্যুক্যালিপটাস, আর কিছু আম-জাম-কাঁঠাল-আতা-গাব লাগালে কেমন হয়?
কোন কথা না বলে এতক্ষণ শুনছিলো হেমন্ত। বললো, আপনি যদি যোগাড় করতে পারেন, আনুন না। আমরা সবাই মিলে পুঁততে শুরু করি। যদিও বৃষ্টি খুব একটা হয় না এখানে, ক্যালেণ্ডারের হিসেবে তো বর্ষা আসার সময় হয়েই এসেছে। তার আগেই পুঁতে ফেলি আমরা। আর সোনাঝুরি তো দুবছরেই দশ মিটার লম্বা হয়ে যাবে, প্রথম বছরেই তো ফুল আসবে, সাথে সাথে মৌমাছি আর হয়তো পাখিও !
পড়ছি।
পড়ে গেলাম। জমে উঠেছে।