এত মানুষ রাস্তায়! আর এত ধরণের গাড়ি! ঠিক ভয় নয়, অস্বস্তি হয় জয়মালিকার। ফ্রক আর স্কার্ট পরেই চালিয়ে দিয়েছে এতদিন, কলকাতায় আসার সময় মনে হলো শাড়ি না পরলে যথেষ্ট বড় দেখাবে না ওকে। তাই সঙ্গে এনেছে তিনটে শাড়ি, তারই একটা পরেছে ও। জেঠুর বাড়ি কালিঘাট পার্কের কাছে, কাকুকে বলেছিলেন স্টেশনে এসে উনি নিজেই নিয়ে আসবেন জয়িকে। জয়ি রাজি হয়নি। হাওড়া স্টেশন থেকে বেরিয়ে কাকুর কথা মতো পাঁচ নম্বর দোতলা বাসে বসে লেক মার্কেটে নেমে একটু পিছিয়ে এসে ডান হাতি রাস্তাটা দিয়ে সোজা হেঁটে প্রথম ক্রসিঙে বাঁ-হাতি দোতলা সাদা বাড়িটায় কলিং বেল টিপেছে। দরজা খুলে দিয়েছেন জ্যাঠাইমা নিজে, আর তারপরেই জয়িকে দেখে, ও মা, এই তো এসে গেছে, বলে ওকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়েছেন গালে।
জয়ির জন্যে আলাদা ঘর, অ্যাটাচ্ড্ বাথরূম। জেঠুর অফিস সকাল নটায়, তাই একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়েন রাতে। শুতে যাবার আগে জয়মালিকার পরের দিনের প্রোগ্রাম শুনে ওকে বলে দিলেন প্রথম দিনেই বাসে না উঠে লেক মার্কেট থেকে শেয়ার্ড্ ট্যাক্সিতে এসপ্লানেডে নামতে। তারপর এস-এন ব্যানার্জি রোড ধরে খানিকটা হাঁটলেই বাঁ-হাতে এলিট। সেই মতোই এসেছে জয়ি। শক্তিদা বলেছিলো বারটায়, ও এসে পৌঁছেছে সাড়ে এগারোটায়।
দেড় ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছে জয়ি, শক্তিদার পাত্তা নেই। ঠিকানা জানে না, একটা ফোন নম্বরও নেই, কী করবে ও বুঝতে পারে না। আশপাশে যে সব লোকদের দেখতে পাচ্ছে ও, বেশির ভাগই ব্যস্ত মনে হয়, কোন দিকে না তাকিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে যায় তারা, কিন্তু সিনেমা হলের কাছাকাছি কিছু লোককে দেখে মনে হয় কোন কাজ নেই তাদের। সিনেমা হলটার পাশেই একটা গলি, আর গলিটার ঠিক মুখেই একটা পানের দোকান। কয়েকটা লোক দাঁড়িয়েই আছে সেখানে, আর মাঝে মাঝেই জয়ির দিকে তাকাচ্ছে। তাকানোর ভঙ্গিটা ভালো নয়, অস্বস্তি বোধ করে জয়ি। কী করবে সে, চলে যাবে? ওর মনে পড়ে শক্তিদা বলেছিলো এলিট সিনেমার উল্টো দিকেই বেঙ্গল লেদার প্রোডাক্টসের অফিস। উল্টো দিকে তাকায় ও, একটা সোজা রাস্তা চলে গেছে, রাস্তাটার ডান দিকে লাল রঙের একটা বিরাট বাড়ি, বাড়িটার বিরাট একটা অংশ ও যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, সেই রাস্তাতেও, ওর ঠিক উল্টো দিকে। অত বড় বাড়ি কখনো দেখেনি জয়ি। বাঁ দিকেও বিশাল বাড়ি একটা। শক্তিদা বলেছিলো এলিটের উল্টো দিকে। বাঁ দিকের বাড়িটাই হবে কী? রাস্তাটা পার হলো জয়ি, দুটো রাস্তা যেখানে মিলেছে, বাড়িটার ঠিক সেখানে কয়েকটা সিঁড়ি। আর সেই সিঁড়ি টপকালেই বিরাট বড় একটা দরজা, তার সামনে খাকি পোশাকের একটা লোক দাঁড়িয়ে। সোজা লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো জয়ি, শক্তিদাকে চেনেন?
শক্তিদা? কৌন শক্তিদা?
চেনেন?
আরে কৌন শক্তিদার কথা বলছেন আপনি? কৌন অফিস?
কোন্ অফিস? দাঁড়ান বলছি, ভয় উত্তেজনা আর আরষ্টতা মিলিয়ে গলা প্রায় শুকিয়ে গেছে জয়ির, এই মাত্র মনে পড়লো আর এখন মনে পড়ছে না অফিসের নামটা – ও হ্যাঁ, এই তো মনে পড়েছে – বেঙ্গল লেদার প্রোডাক্টস, চেনেন আপনি?
শক্তিদা, বেঙ্গল লেদার প্রোডাক্টস? নেহী নেহী, কুনো শক্তিদা উখানে নাই। বেঙ্গল লে – এক মিনিট, ভূদেববাবুর দোস্ত? বয়েৎ লিখনেবালা শক্তিদা? আরে বলবেন তো উ কথা, সালা মাতোয়ালা শক্তিদা? বলবেন তো দিদি, লেকিন আসেনি আজ। এক মিনিট, আপনি বোসেন ইখানে, বলে সামনের একটা চেয়ার দেখিয়ে দেয় লোকটা জয়িকে, তারপর ওর পেছনের একটা টেবিল থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে ফোনে কথা বলতে শুরু করে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর ফোনটা রেখে জয়িকে বলে সে, আপনি বসুন দিদি, ভূদেববাবুর লোক আসছে, ঠিক নিয়ে আসবে শক্তিদাকে।
কিছুক্ষণ পর ওপর থেকে নেমে আসে পঁচিশ-ছাব্বিশের এক যুবক, জয়িকে বলে, আপনি চলুন ওপরে গিয়ে বসবেন, আমি খোঁজ করছি শক্তিদার। বলেছিলো আপনাকে এখানে দেখা হবে?
বলতে বলতে লিফটে উঠে পড়ে ছেলেটা জয়িকে আগে তুলে দিয়ে, তারপর আবার বলে, বলেছিলো?
না, ঠিক এখানেই দেখা হবে বলেনি, বলেছিলো এলিটের সামনে অপেক্ষা করতে, তারপর এখানে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে।
ও, আর আপনি এলিটের সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন? কতক্ষণ?
নাঃ, ব্যাপারটা লঘু কোরে দেওয়ার জন্যে বলে জয়ি, এই কিছুক্ষণ।
বুঝলাম, বলে ছেলেটা, তারপর কোন একজনকে ডেকে জয়ির জন্যে চা আনার নির্দেশ দিয়ে বলে, আমি ধরে আনছি দেখুন না, কী নাম বলবো?
জয়মালিকা।
ছেলেটা বেরিয়ে যায়।
যেখানে জয়িকে বসিয়ে রেখে চলে গেলো ও, সে জায়গাটা ঠাণ্ডা, বেশ সাজানো-গোছানো। সোফার সামনে একটা নীচু টেবিলে খবরের কাগজ দু-তিনটে, গোটা কয়েক চকচকে ম্যাগাজিন, সময় কাটাতে বিশেষ অসুবিধে হলো না জয়ির। ঘন্টাখানেক পর ফিরে এলো ছেলেটা, সঙ্গে শক্তিদা, দেখেই বোঝা যায় মদ্যপানে চুর। জয়মালিকাকে দেখে বললো, কেমন আছিস, জয়ি? কলকাতায় কবে এলি?
জয়ি উত্তর দেবার আগেই ছেলেটা বললো কলকাতায় যেদিনই আসুক, আজ বেলা এগারোটায় এলিটের সামনে এসেছে। ওই রকম একটা জায়গায় কোন মহিলাকে দাঁড়াতে বলে কেউ?
বাঃ, তোদের অফিস তো উল্টো দিকে, কোথায় দাঁড়াবে?
তাহলে সাত-সকালে খালাসিটোলায় না ঢুকে ঠিক সময়ে আসা উচিত ছিলো।
একেবারে ভুলে গেছিলাম রে, এক গাল হেসে বলে শক্তিদা, কিছু মনে করিস না রে জয়ি। তারপর ছেলেটার দিকে ফিরে বলে, জয়িকে লাঞ্চ খাওয়াবি না সুদেশ?
জয়িকে খাওয়াবো, আপনাকে নয়।
কিছুক্ষণ পর লাঞ্চ আসে, টোস্ট, ওমলেট আর কফি, তিনজনের জন্যেই।
লাঞ্চের পর সুদেশকে বলে শক্তিদা, একটা ট্যাক্সি ধরে দিবি আমাকে, অ্যাকাডেমি যাবো, জয়ির সঙ্গে সবায়ের আলাপ করিয়ে দেবো আজ। অফিস থেকে বেরোয় তিনজনে, একসঙ্গে। বেরোবার মুখে খাকি পোশাকের লোকটা। জয়িকে বলে, সব ঠিক আছে তো দিদি? জয়ি হাসে। শক্তিদাকে বলে তারপর অভিযোগের সুরে, কেন পরেশান করান শক্তিদা? শক্তিদা-ও হাসে।
ট্যাক্সিতে উঠে পড়ার পর সুদেশকে বলে শক্তিদা, ভাড়াটা দিয়ে দিয়েছিস?
হাত নেড়ে বলে সুদেশ, হুঁ।
রাস্তায় জয়ির মাথায় হাত দেয় শক্তিদা, বলে, একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম রে, মাতাল মানুষ; ভূদেব গেছে দিল্লী, পরশু ফিরবে, সোমবারটা বাদ দিয়ে মঙ্গলবার তোর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবো, তুই কিছু ভাবিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
সবুজ ময়দান চিরে একটু পরেই ট্যাক্সিটা দাঁড়ায় বিরাট একটা চার্চের পাশে অ্যাকাডেমির সামনে। জয়ির চোখে শুধু বিস্ময়। ভেতরে ঢুকে ডান দিকের বারান্দায় বসে আছে কয়েকজন, শক্তিদা সোজা গিয়ে দাঁড়ায় সেখানে। যত্ন করে ছাঁটা দাড়ি, লম্বা ছিপছিপে সুদর্শন এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন, সেখানে গিয়ে শক্তিদা বললো, নিখিলেশ, তোমার হাতে সঁপে দিলাম জয়িকে, জয়মালিকা ওর নাম, সারাণ্ডার জঙ্গল থেকে ধরে এনেছি, মহীরুহ হবে ও, কলকাতায় ওকে রোপন করার দায়িত্ব তোমার।
জবাবে নিখিলেশ বলেন, ভেজিটেবল চপ খাবে?
প্রচুর পেঁয়াজ সহযোগে।
এর আধ ঘন্টা পর আর একটা ট্যাক্সিতে ওরা তিনজন। লেক মার্কেট পর্যন্ত গিয়ে জয়িকে নামিয়ে দেয় ওরা। নামবার সময় শক্তিদা বলে মঙ্গলবার আসিস, বারোটায়। এলিটের সামনে নয়, বেঙ্গল লেদারের অফিসে। এখান থেকে হেঁটে হেঁটে ফিরে যা জেঠুর বাড়ি। বাড়িটা আমি চিনতে চাই না।
জয়ি ফেরার কিছুক্ষণ পরেই জেঠু ফিরলেন। ও জানতো না জেঠু-জ্যাঠাইমার কোন ছেলেমেয়ে এখানে নেই, একটিই মেয়ে, বিয়ের পর আমেরিকায় থাকে, জয়িকে পেয়ে ভারি খুশি ওঁরা। জেঠু বললেন, চলো, আজ বাইরে খেতে যাবো। জেঠুর গাড়িতেই যাওয়া হলো, জেঠুই চালালেন। যেখানে গেলো সে রেস্টোর্যান্টের নাম ওয়লডর্ফ, চিনেদের দোকান নাকি। কী কী খাওয়া হলো সব বুঝতে পারলো না জয়ি, কিন্তু দেখেশুনে তাক লেগে গেলো ওর। ওকে একা একা প্রথম দিনেই এলিটের সামনে – ও রকম একটা পাড়ায়, বললেন জ্যাঠাইমা – ছেড়ে দেওয়ায় জ্যাঠাইমা খুবই অসন্তুষ্ট, খুব রাগারাগি করলেন জেঠুর ওপর। জেঠু হাসলেন, বললেন কাকু আর জেঠু দুজনেই ঠিক করেছেন জয়িকে একা একাই ছাড়া হবে, পৃথিবীটা যে খুব সহজ জায়গা নয় সেটা বুঝতে দিতে হবে ওকে। কখন বেরোবে, কখন ফিরবে, কোথায় যাবে, কী ভাবে যাবে – সবই ঠিক করবে ও নিজে। বড় যাকে হতে হবে তাকে নিজেকেও বড় হয়েছে ভাবতে দিতে হবে।
পরের মঙ্গলবার যখন ভূদেববাবুর অফিসে শক্তিদার সঙ্গে যাওয়া হলো শেষ পর্যন্ত, প্রাথমিক কথাবার্তার পর ভূদেববাবু বললেন, একজন মডার্ন মহিলা রাস্তায় বেরোলে তাঁর সঙ্গে কটা চামড়ার তৈরি জিনিষ থাকতে পারে? জয়মালিকা জিজ্ঞেস করলো, বাঙালি না অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান?
হঠাৎ অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান মাথায় এলো কেন তোমার?
এ কদিন কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়ালাম অনেকটা, বাঙালি-পাঞ্জাবী-মাড়োয়ারি ছাড়াও অনেক অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানকেও দেখলাম তো, তাই জিজ্ঞেস করছি।
কী করে বুঝলে অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান?
প্যান্ট আর ঝোলা হাওয়াই-শার্টের মতো কী একটা জামা পরে রাস্তা দিয়ে হাঁটে, অথচ মেমসাহেবের মতো ফর্সা নয়। তাই অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান বলছি।
ওঃ, তাই! না, ওরা বেশির ভাগই অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান নয়, অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান কমে গেছে এখন অনেক, ওরা বাঙালি-পাঞ্জাবী এ সবই হবে, তবে ওদের মধ্যে অনেকেই এখন পুরোনো অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানদের কাজ-টাজগুলো করছে, যেমন রিসেপশনিস্ট, টেলিফোন অপারেটর, সেক্রেটারী এই সব; সে ঠিক আছে, তুমি অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানই ধরো, ওরাও নিশ্চয়ই মডার্ন মহিলা, অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান ধরেই বলো।
অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান হলে চারটে, আর অন্যরা তিনটে।
কীরকম?
জুতো, ব্যাগ, ঘড়ির স্ট্র্যাপ, এই তিনটে কমন, আর অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান হলে কোমরের বেল্টটা।
তোমার ঐ অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানদের বেল্টটা আমরা তৈরি করি না, বাকি তিনটে করি। তুমি একটা কাজ করো, দুটো স্কেচ করো এখানে বসে; একটা বাঙালি মেয়ে, শাড়ি-টাড়ি পরে, আর একটা ঐ অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান, ওদের পোশাকে, দুজনের সঙ্গেই চামড়ার জিনিষগুলো থাকবে। কাগজ দেবো?
না, লাগবে না। নিজের সঙ্গে যে স্কুলব্যাগের মতো ব্যাগটা ছিলো, তার মধ্যে থেকে কাগজ পেনসিল আর বোর্ড বের করে ঘসঘস করে মিনিট তিনেকের মধ্যে ছবি দুটো এঁকে ফেললো জয়ি। ভূদেব দেখে বললেন, বাঃ, এ তো কবিতা হয়েছে, এত কম রেখায় এত কথা ! কার কাছ শিখলে এ সব !
আমার কাছে, হঠাৎ বলে উঠলো শক্তিদা।
হ্যাঁ, সে তো বোঝাই যাচ্ছে, বলেন ভূদেব, তারপর নিজে যেখানে বসেছিলেন সেখান থেকে উঠে সোফায় জয়ির পাশে বসে ছবি দু্টোকে দেখিয়ে বলেন, একটা বড় কাগজে তলার দিকের সেন্টারে এই ছবি দুটো আঁকবে, একজন বাঁ দিকে তাকিয়ে থাকবে, আর একজন ডান দিকে, ঠিক যেমন এঁকেছো তেমনই; বাঙালি মেয়েটার পায়ে যেমন চটি আছে তাই থাকবে, আর অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানের পায়ে পেনসিল হিলের স্ট্র্যাপ বাঁধা জুতো। শুধু অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানের জামাটা বদলিয়ে দিও, চামড়ার বেল্টটা থাকবে না। দুটো ছবির দু পাশে যথেষ্ট জায়গা রাখবে, আমাদের প্রোডাক্টের ছবি থাকবে সেখানে, ওটা আমরা ঢুকিয়ে দেবো। আর মেয়ে দুটোর মাথার ওপর কপি থাকবে, কপি মানে বিজ্ঞাপনে যেটা লেখা হবে—সে জায়গাটুকু রেখো। তারপর হাঁটু মুড়ে প্রায় হাফ-দাঁড়ানো অবস্থায় সোফা থেকে একটু উঠে দূরের ডেস্কে বসে থাকা সুদেশকে চেঁচিয়ে বললেন, এই সুদেশ, একটা অ্যাডভান্স ভাউচার লেখ্ একশো টাকার, তারপর ক্যাশ থেকে টাকাটা তুলে জয়মালিকাকে দিয়ে সই করিয়ে নে। তারপর আবার সোফায় বসে জয়ির দিকে ফিরে বললেন, অ্যাডভান্স একশো আজ পাবে, নেক্সট তিন দিনের মধ্যে কাজটা জমা দিয়ে আরও একশো টাকা পেমেন্ট নিয়ে নিও। আর শোন, পেনসিলে আঁকবে না, চারকোল কিনে নেবে জি-সি-লাহার দোকান থেকে, আর হ্যাণ্ডমেড পেপার। তার জন্যে আলাদা একটা ভাউচারে সই করে পঞ্চাশ টাকা নিয়ে নিও, সুদেশ দিয়ে দেবে।
এত টাকা! এই টুকু কাজ করে! বিশ্বাস করতে পারে না জয়মালিকা। জি-সি-লাহার দোকান ও চেনে না, ভূদেবদা বলে দিয়েছিলেন কাছাকাছিই, কিন্তু আজ থাক, কাল আসা যাবে, এসপ্লানেড থেকে একটা শেয়ার্ড্ ট্যাক্সিতে উঠে সোজা লেক মার্কেটে গেলো ও। জলযোগের মিষ্টির দোকান, সেখানে পাওয়া যায় পয়োধি নামের দৈ। কলকাতায় আসার আগে কখনো মিষ্টি দৈ খায়নি জয়ি, জেঠুর বাড়িতে খেলো দুবার। প্রথম যেদিন খেয়েছিলো, খেয়ে অবাক হয়েছিলো সে, এমন মিষ্টিও পাওয়া যায় ! আর তারপর আবার যেদিন খেলো, অবিশ্বাস্য ! জ্যাঠাইমা বললেন, এর নাম পয়োধি, রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন নাকি নামটা। এই লেক মার্কেটেই পাওয়া যায়, জলযোগে। এক হাঁড়ি দৈ কিনলো জয়ি। যদিও ওজনটা হলো গ্রাম-কিলোগ্রামে, দোকানের ভদ্রলোক বললেন, এটা নাকি আড়াই সেরি হাঁড়ি। এত দৈ কে খাবে রে জয়ি, জ্যাঠাইমা হাঁড়ি দেখে বলে উঠলেন স্বতঃস্ফুর্ত। জেঠু অফিস থেকে এলে ফ্রিজ খুলে দৈ-এর হাঁড়ি বের করলেন জ্যাঠাইমা, হেসে জেঠু বললেন, ওর প্রথম আয়ের টাকা থেকে কিনেছে, দৈ তো দেবভোগ্য, মাঙ্গলিক। ফোন করে তুলি আর কাকু-কাকিমাকেও দেওয়া হলো খবরটা। তুলি বললো, যখন ফিরবি, আমাদের জন্যেও নিয়ে আসিস।
ধীরে ধীরে কলকাতা চেনে জয়ি। অ্যাকাডেমি আর কফি হাউজ। কফি হাউজ আবার একটা নয়, অনেকগুলো। কলেজ স্ট্রীটেরটাই জমজমাট বেশি, কলেজ-য়্যুনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা, শিল্পী-সাহিত্যিকের দল, এমনকি সিনেমা-থিয়েটারের লোকজনও আসে। কলেজ টলেজের ছেলেমেয়েদের মধ্যে অনেকে আবার বাম রাজনীতির কর্মী, তারা নিজেদের মধ্যেই থাকে, খুব একটা মেশে না অন্যদের সাথে, বেশিক্ষণ বসে না, এই আসে, এই যায়। সকাল থেকে রাত অবধি সিগারেটের ধোঁয়া, কফির গন্ধ, জোরে জোরে কথা বলা, আর ভিড়ের মধ্যের নির্জনতায় ডুবে যাওয়া প্রেমিক-প্রেমিকাও। কিছুই করার না থাকলেই ঢুকে পড়ে জয়ি, কোন একটা টেবিলে বসে যায়, কখনো আড্ডায় সক্রিয়, চুপচাপ কখনো বা। ওকে এখন চেনে অনেকেই, কেউ কেউ ডেকে নেয় আড্ডায়, ভুরু নাচিয়ে পরিচিতির ভদ্রতাটুকুই শুধু করে অনেকে আবার। কাজও পায় কিছু কিছু। বেঙ্গল লেদারের যে বিজ্ঞাপনের ছবিটা ও করেছিলো সেই বিজ্ঞাপনটা এবার অনেকগুলো পুজোসংখ্যায় বেরিয়েছে, শক্তিদা আর ভূদেবদার সূত্রে অনেকেই জেনে গেছে সেটা ওর করা, কাজেই অনেক লিট্ল্ ম্যাগাজিনের লোকজনরা ওকে প্রচ্ছদ-অলঙ্করণের জন্যে অনুরোধ করে। শক্তিদা বলে দিয়েছে সবাইকে, কেউ যেন বিনি পয়সায় কাজ না করায় ওকে দিয়ে, লিট্ল্ ম্যাগাজিনের এক-একটা ছবির জন্যে দশ টাকা। দশ টাকাই তো মাত্র, অনেক কাজ পায় জয়ি। যামিনী রায়ও নাকি দশ টাকায় ছবি বেচতেন আমেরিকান সেপাইদের কাছে যুদ্ধের সময়ে, ভূদেবদা বলেছে ওকে, দশ টাকাকে খেলো মনে করিস না জয়ি!
তুলি ডাকছে অনেকদিন ধরে, জয়মালিকা ভাবে একবার বাড়ি গেলে হয়। বাড়ি, বাড়ি আছে তার! বাবা যখন আসে, দুচারদিন থাকে, বাবার সঙ্গে কথা বলে, গান গেয়ে, তবুও বাড়িটাকে বাড়ি বলে মনে হয় তখন। এতদিন হয়ে গেলো, একা একা দিব্যি তো কেটে যাচ্ছে কলকাতায়। জেঠুর পরামর্শে জেঠুর বাড়ির উল্টোদিকের বাড়িটায় একটা ঘরে ছবি-আঁকা শেখানোর ক্লাশ খুলেছে জয়ি, একটা সাইন বোর্ড লাগানো হয়েছে, তাতে লেখা, ছবি আঁকো জয়মালিকার সঙ্গে। এক এক করে বাড়তে বাড়তে এখন বার-তেরোটা ছাত্র-ছাত্রী তার, ভালোই লাগে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ছবি-আঁকা শেখাতে। জেঠু-জ্যাঠাইমার বাড়িতেও পরম আদরে আছে সে; এত ভালো ঘরে কখনো সে শোয়নি আগে, এত ভালো ভালো খাবার যে হয়, তা-ই জানতো না কোনদিন, এত স্নেহ-ভালোবাসার পারিবারিক জীবন তার জন্যে অপেক্ষা করছিলো!
তবুও এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখলো জয়ি এক রাতে। শেষ যেদিন শক্তিদার সঙ্গে ছবি আঁকতে বেরিয়েছিলো, শুকিয়ে-যাওয়া ঝর্ণার বোল্ডারের ছবি আঁকা শেষ করে শক্তিদাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলো, আর তার পর হৃদয়ে দয়া যেন পাই গাইতে গাইতে সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে-থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করেছিলো শক্তিদাকে, সে দিনের দৃশ্য স্বপ্নে। শক্তিদা কালো ছোপের লাল আকাশে তাকিয়েই আছে, আর পেছন থেকে জয়ি ক্রমাগতই ডেকে চলেছে, এমন সময় পিছন ফিরে তাকালো শক্তিদা। এ কী, শক্তিদার চেহারাটা বদলিয়ে গিয়ে জয়ি দেখলো তার মা দাঁড়িয়ে ! মলিন বেশে, করুণ চোখে দাঁড়িয়ে মা, আর তার চোখ দিয়ে জলের বন্যা। জয়িকে দেখে ছুটে এসে মা জড়িয়ে ধরে জয়িকে, জয়ি যেন ছোট বাচ্চাটি হয়ে যায়, মা বুকের আঁচল সরিয়ে দুধ খাওয়ায় জয়িকে, কতক্ষণ, কতক্ষণ ! তারপর পেছন থেকে একটা বাঘের গর্জন, বাঘটা বোধ হয় লাফিয়ে পড়বে ঘাড়ে, মায়ের হাত ধরে দৌড়োতে থাকে জয়ি প্রাণপণ, দৌড়োয় দৌড়োয়, কতক্ষণ যে দৌড়োয়, কতক্ষণ... আর তারপর দেখে ও আর ওর মা দাঁড়িয়ে আছে ডি-ফোর-এর যে কোয়ার্টারে শক্তিদা এসে ছিলো, সেই কোয়ার্টারটার সামনে। হঠাৎ দরজা খুলে বেরিয়ে আসে বাবা, একটাও কথা বলে না, জয়িকে নিঃশব্দ ইঙ্গিতে ঢুকিয়ে নেয় বাড়ির মধ্যে, দরজা বন্ধ হয়ে যায়, মা বাইরে দাঁড়িয়েই থাকে।
ঘুম ভেঙে যায় জয়মালিকার, নাইটিটা ঘামে ভিজে গেছে।
সেদিনই ঠিক করলো বাড়ি যাবে জয়ি। জেঠু জ্যাঠাইমা আপত্তি করলেন না। জেঠু বললেন, রাতের ট্রেনে যাস, আমি টিকিটের ব্যবস্থা করছি। দু হাঁড়ি পয়োধি কিনলো জয়ি, রাসবিহারী অ্যাভিন্যুয়ের একটা দোকানের শো-কেসে চওড়া-পাড় তাঁতের শাড়ি সাজানো ছিলো একটা, দোকানে ঢুকে সেটাও কিনলো, এমনকি সায়া-ব্লাউজও। রাতের খাওয়ার পর গাড়িতে করে ওকে হাওড়া স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে এলেন জেঠু-জ্যাঠাইমা।
শুধুমাত্র ছবি আঁকার জোরে টাকা-পয়সা আয় করে কলকাতায় কাটিয়ে এসেছে জয়ি কয়েক মাস, শিল্পী-সাহিত্যিকদের অনেককেই চেনে সে এখন, জয়ি এখন স্বাভাবিক নেতা ওর বন্ধু-বান্ধবীদের। সবাই মিলে ঠিক হয়েছে পরের সংখ্যা থেকে শাম্ব ছাপানো হবে, আর হাতে-লেখা নয়। রাঁচি থেকে শ্যামলিমা-অরুণিমাও এলো; দুজন সম্পাদক, অরুণিমা আর জয়ি। তুলি প্রস্তাব দিয়েছিলো শাম্বর ঠিকানাটাও বদলিয়ে এখন কলকাতায় জেঠুর বাড়ির ঠিকানা দেওয়া হোক, সে প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেলো। জয়ি বললো কলকাতার হাজারো লিট্ল্ ম্যাগাজিনের মধ্যে শাম্ব হারিয়ে যাবে, এখানকার ঠিকানাই ভালো। প্রত্যেক মাসে অন্তত একবার আসবে জয়ি, যেসব লেখা-টেখা কলকাতা থেকে সংগ্রহ হবে সেগুলো নিয়ে আসবে, কিন্তু ছাপা হবে এখানেই। অনেক ঘোরাঘুরি করে উদিতনগরে একটা ছাপাখানা পাওয়া গেলো যাদের কাছে বাংলা হরফ আছে।
পরের সংখ্যা শাম্বর প্রচ্ছদের জন্যে নিখিলেশদাকে অনুরোধ করে জয়মালিকা। ছবিটা আঁকা হয়ে গেলে নিখিলেশদা বলে, চল্ তোকে একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দি। কলেজ স্ট্রীটের কফি হাউজ থেকে হাঁটতে হাঁটতে বৌবাজারের মোড়ে এসে ডানদিকে ঘুরে ট্রামলাইন ধরে খানিকটা এগোবার পর বাঁ দিকের একটা গলিতে ঢুকে যায় ওরা, আর তারপর এ গলি সে গলির মধ্যে দিয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে যেখানে এসে পৌঁছোয় সেটা একটা বিরাট বড়ো বাড়ি, পলেস্তারা খসে পড়ছে, এখানে-ওখানে ভাঙা। একতলায় একটা ঘরে ঢোকে ওরা, আর তারপরেই একটা আশ্চর্য দৃশ্য। মেঝেতে বসে আছে কয়েকজন ছেলে, জয়ির বয়েসি আছে, একটু বড়োও কেউ কেউ। বেশ বড়ো একটা ক্যানভাসে ব্রাশ হাতে কাজ করছে একজন, ওদের চেয়ে সামান্যই বড়ো, লম্বা, ফর্সা, একটু মোটার দিকে, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। আর ছবিটার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে, জয়ি আসার আগে পর্যন্ত একমাত্র মেয়ে ঐ ঘরে। নিখিলেশদাকে দেখে, কাজ করছে যে ছেলেটা সে হাসলো শুধু একটু, মেয়েটা মুখ ফিরিয়ে বললো, বোসো। জয়ি বসে পড়লো ছেলেমেয়েরা যেখানে বসে আছে মেঝেতে, সেখানেই, নিখিলেশদা দাঁড়িয়ে। বসে থাকা ছেলেদের মধ্যে একজন হাতে একটা কেটলি নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
একটু পর ছবি আঁকা থামিয়ে একটা কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে ছেলেটা বললো, বলো নিখিলেশদা, কী খবর?
তোমাদের সঙ্গে আলাপ করাতে নিয়ে এলাম আমাদের এই ছোট্ট বন্ধুকে, জয়মালিকা সেন। জয়ি, তোর সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে ওকে চিনিস? ওর নাম বিকাশ, বিকাশ ভট্টাচার্য, কলকাতায় আগামী দিনের শ্রেষ্ঠ চিত্রকর। আর এই যে মেয়েটাকে দেখছিস, ওর নাম কিসমত, কিসমত সোরাবজি, ও বিকাশের বন্ধু; ওরা একসঙ্গে আর্ট কলেজে পড়েছে, আর এখনও একই সঙ্গে কাজ করে অনেকটাই। অলরেডি অ্যাকাডেমিতে সোলো হয়ে গেছে কিসমতের। আর শোন্, তুই যা স্ট্রাগ্ল্ করছিস তার চেয়েও বেশি করতে হয়েছে বিকাশকে। শোন্ বিকাশ, শোন্ কিসমত, জয়িকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলো শক্তি। শক্তি বলেছে ওকে নাকি শক্তি সারাণ্ডার জঙ্গল থেকে তুলে এনেছে, ও একদিন মহীরুহ হবে। আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলো কলকাতায় ওকে রোপন করার। আমি এই গ্র্যান্ট লেন স্টুডিওয় রোপন করে গেলাম ওকে, জল-টল ঢালিস। বলেই নাটকীয় ভঙ্গীতে লম্বা পা দ্রুত চালিয়ে চলে গেলো নিখিলেশদা।
দৃশ্যটার রেশ কাটার আগেই কেটলি নিয়ে চা আনতে গিয়েছিলো যে ছেলেটা সে ফিরে আসে। স্টুডিওর এ-কোণ সে-কোণ আনাচ কানাচ থেকে বেরিয়ে আসে কয়েকটা চিনেমাটির কাপ, হাতল-ভাঙা দুয়েকটার, তিন-চারটে ছোট কাচের গ্লাস, চা ঢালা হয়, সবাই মিলে ভাগ করে খাওয়া হয়। আলাপ হয় সবার সঙ্গে, চা আনতে গিয়েছিলো যে তার নাম পিন্টু, বাকিরা সমর, শুভাশিস আর নির্মাল্য, ওরা সবাই এখনো ছাত্র, ধর্মতলায় ইণ্ডিয়ান কলেজ অব আর্ট অ্যাণ্ড ড্রাফ্টসম্যানশিপে পড়ে, সময় পেলেই স্টুডিওয় এসে বিকাশদার কাজ করা দেখে। বিকাশদা আর কিসমতদিও ওদের কলেজেরই প্রাক্তনী।
বিকাশদা খোঁজ নেয় জয়ির, কোথা থেকে এসেছে, কী ভাবে শক্তিদাকে চিনলো, কেন ছবি আঁকতে চায়, কোথায় থাকে কলকাতায়, কী ভাবে চলছে ওর, এ সব। তারপর জিজ্ঞেস করলো নিজের আঁকা কোন ছবি আছে নাকি ওর সাথে। ব্যাগ থেকে বের করে বেঙ্গল লেদারের বিজ্ঞাপনটা দেখায় জয়ি, সবাই ঝুঁকে পড়ে দেখে। বিকাশদা বলে তারপর, সত্যিই ছবি আঁকতে চাও?
না হলে কি কলকাতায় এসে থাকতাম একা একা?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিকাশদা বলে, তাতেই সব হলো না। কলকাতায় নানা আকর্ষণ, সব ছেড়ে ছবি আঁকায় লেগে থাকা সহজ কাজ নয়।
আমি লেগে থাকবো, বলে জয়ি।
ভালো, বলে বিকাশদা, তুমি তো কালিঘাটের কাছে থাকো বললে, তাই না? কালিঘাটের আশেপাশে, আদি গঙ্গার পাড় ধরে, তিন-চার দিন আঁকো না। আমার একটা এগ্জিবিশন আছে সামনের মাসে, তার জন্যে এই ছবিটা ফিনিশ করতে হবে। তিন-চার দিন লাগবে আমারও। তারপর ছবিগুলো নিয়ে এসো, দেখা যাক্।
কিন্তু শুধু ছবি-আঁকিয়ে পরিচয়ে তো কলকাতায় চলবে না জয়ির, সে এখন একটা লিট্ল্ ম্যাগাজিনের সম্পাদকও বটে। শাম্বকে কেন্দ্র করে তার পরিচয়ের পরিধি বাড়তে লাগলো ক্রমশ। নিঃসঙ্কোচে সে পৌঁছে যায় বিখ্যাত ক্ষমতাবান মানুষদের কাছে, তাদের কাছে দাবি করে সাহায্য: কখনো লেখা, ছবি কখনো, কখনো বা বিজ্ঞাপন, আর এই সূত্রেই সে আবিষ্কার করে কলকাতায় যাঁরা একটা-কিছু, তাঁদের কয়েকটা মিলনস্থান।
শুনেছে এর মধ্যে একটা হলো শ্যামবাজারের কফি হাউজ। সারাদিন ধরে পিন্টু, নির্মাল্য আর কিসমতদির সঙ্গে হাতিবাগান-শোভাবাজার-সুতানুটির গলি-টলিতে স্টাডি করার পর ওরা যখন সবাই চলে গেলো, জয়ি ঠিক করলো শ্যামবাজারের কফি হাউজে গিয়ে দুয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে আসবে। এক কাপ কফি খেলো বসে বসে, চেনামুখ একটাকেও পেলো না। এতদিনে অনেক স্মার্ট হয়ে গেছে জয়ি, অচেনা লোকজনের সঙ্গে আলাপ করতে সে যে ভয় পায় তা নয়। যে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হলো তাঁর নাম ও কখনো শোনেনি, বললেন তিনি নাকি বাংলা প্যারডি গানের বিখ্যাত গায়ক, যে কোনদিন সন্ধ্যেবেলা এখানে এলেই ওঁকে পাওয়া যাবে। প্যারডি গান কাকে বলে জয়ি জানে না, ভদ্রলোক বুঝিয়ে দিলেন জনপ্রিয় আধুনিক বাংলা গানের সুরে স্বরচিত মজার কথা বসিয়ে উনি গান করেন, জলসা-টলসায় তার নাকি খুব চাহিদা। দু কলি গেয়ে শুনিয়েও দিলেন ওকে। শক্তিদার নাম বলতে বললেন, শক্তি-সুনীল-তারাপদ-শরৎকে উনি ভালোই চেনেন, ওরা রোজই এখানে আসে, তবে দেরী হয়। অনেক সময় ওরা আসতে আসতে কফি হাউজ বন্ধ হয়ে যায়, ওরা ওখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়।
জয়ি বুঝলো কালিঘাট পার্কে জেঠুর বাড়িতে থেকে শ্যামবাজারের কফি হাউজে কাউকে ধরার আশা ওকে ছাড়তে হবে।
সেন্ট্রাল অ্যাভেন্যু কফি হাউজের দুটো ঘর, লর্ডস আর কমনস, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনুসরণে। পার্লামেন্টই তো, এমন তর্ক-বিতর্ক যেখানে ! কমনসে ঢোকে প্রথম প্রথম, দুয়েকটা চেনা মুখও দেখা যায়, যাদের কলেজ স্ট্রীটে দেখেছে কখনো কখনো, বিশেষ করে সন্ধ্যের পর আর শনিবার। বসে যায় কোন একটা টেবিলে, সুযোগ পেলেই চেয়ে বসে গল্প-কবিতা-ছবি অথবা নিদেনপক্ষে একটা বিজ্ঞাপন!
আর এই বিজ্ঞাপন খোঁজার সুত্রেই একদিন একজন পাঠিয়ে দিলো লর্ডসে। বললো, লিট্ল্ ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন চাও? একজনকে যদি কনভিন্স্ করতে পারো, পাবেই।
কে?
চিদানন্দ দাশগুপ্তর নাম শুনেছো? ইম্পিরিয়াল টোব্যাকোর ডিরেক্টর, লর্ডসে যাও, পেয়ে যাবে।
চিনি না তো।
মানিকবাবুকে চেন?
মানিকবাবু?
সত্যজিৎ রায়।
ছবি দেখেছি, দেখলে চিনতে পারবো।
একই টেবিলে আছেন।
লর্ডসে ঢুকেই দেখতে পেলো সত্যজিৎ রায়কে, টেবিলে আরও তিনজন। ভয়ে ভয়ে বেরিয়ে এলো জয়ি।
উত্তর কলকাতার অলি-গলিতে জয়মালিকা যা স্টাডি করে, তা দেখে বিকাশ আর কিসমত দুজনেই খুশি। দুটো ফুটপাথ দূরে গিয়ে যেখানে মিশে যায়, ক্যামেরায় লং-শট যাকে বলে, মাত্র কয়েকটা আঁচড়েই তা খুব ভালো আঁকে জয়ি। কিন্তু, মানুষ কোথায়? জয়ির ছবিতে মানুষ আসে না কেন? বিকাশ একদিন নিজে ওর সঙ্গে বেরোলো। রাস্তার ধারে বসে থাকা ভিখারিনী, বাজারে ঢোকবার রাস্তাটার বাইরে বিড়ি খেতে খেতে অপেক্ষমান ঝাঁকামুটে, ওদের দেখতে পায় না জয়মালিকা? তেলেভাজার দোকানের শো-কেসের ঠিক পেছনটায় উবু হয়ে বসে বঁটিতে বেগুন কাটছে যে বউটা, তার ভল্যুম দেখতে পায় না ও? তোকে আরও দেখতে শিখতে হবে রে, আরও একটু যত্ন করে দেখ্, দেখাটাই প্রধান, স্টাইল তোর নিজের থেকেই তৈরি হবে।
এত খুঁতখুঁতে বিকাশদা, এত সময় নেয় প্রত্যেকটা ছবি আঁকতে ! কোন আড্ডা নেই, রিল্যাক্স করে না, ছবিই আঁকে শুধু, সবাই কি এ রকম হতে পারে?
সবাই হতে পারে না, তাই সবাই শিল্পী হয় না, বুঝলি? জীবনানন্দ বলেছিলেন, সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। সব আর্টেই অনুশীলন করতে হয় রে জয়ি, কঠোর অনুশীলন, বলে শক্তিদা।
এসব যেদিন শোনে সেদিন মন খারাপ হয়ে যায় জয়ির। কলকাতায় দু বছরের উপর হয়ে গেলো তার, বিনা অনুশীলনেই কী এতোটা পথ পার হয়ে এলো সে? বেঙ্গল লেদার শুধু নয়, এখন তো অন্য বিজ্ঞাপনেও কাজ করে সে। এই তো সেদিন ক্ল্যারিয়নের বিভাসদা ওকে দিয়ে কাজ করালো, ছোটদের জন্যে লেখা একটা গোটা বইয়ের ইলাস্ট্রেশনও করেছে সে। আর, তা-ই কী শুধু? শাম্ব কেমন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ! অত বড়ো ব্যাঙ্কের গোটা এক পাতা বিজ্ঞাপনও যোগাড় করে দিলেন চিরপ্রিয়দা। শেষ পর্যন্ত ইম্পিরিয়াল টোব্যাকোও তো পাওয়া গেলো।
যে জায়গাটায় এতদিন ধরে যেতে কিছুতেই সাহস পাচ্ছিলো না, আজ সেখানে যাবেই, এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে বেরোলো জয়ি। কিন্তু যাবে কী ভাবে! ঠিক ঠিক কোন্ জায়গাটা না জানলেও ও জানে কোন্ অঞ্চলটায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কাছাকাছি পৌঁছোতে পারলেও, ঠিক কোন্খানে? কাউকে জিজ্ঞেস করাও চলবে না, তাতে উল্টো বিপত্তি হতে পারে। অনেক ভেবে জয়ি ঠিক করে বেঙ্গল লেদারের অফিসেই যাবে ও, সেখান থেকেই কাছাকাছি।
দারোয়ানটা এতদিনে ভালো চিনে গেছে ওকে, দেখে একগাল হেসে নমস্কার করলো। লিফটে উঠে সোজা অফিসে ঢুকলো ও। দেখতে পেয়ে সুদেশ হেসে বললো, ভূদেবদা বেরিয়েছেন, ফিরতে দেরি হবে।
ভূদেবদাকে খুঁজছি না আমি, খুঁজছি আপনাকেই।
আমাকে? কী ব্যাপার?
একটুও দম না নিয়ে প্রায় এক নিশ্বাসে বলে জয়ি, আমাকে একটু খালাসিটোলায় নিয়ে যাবেন?
অ্যাঁ? খালাসিটোলায়?
হ্যাঁ, তাই তো বলছি।
কেন? মাথা খারাপ হয়েছে আপনার?
মাথা ঠিকই আছে, একটু দরকার ছিলো, জায়গাটা ঠিক ঠিক চিনিনা তো, তাই।
চিনবেন কী করে, চেনার কথাও নয়, মেয়েরা যায় না ওখানে।
পুরুষদের বাথরূম ছাড়া আর যে যে জায়গায় পুরুষরা যায়, সে সব জায়গাতেই মেয়েরা যেতে পারে, আশা করি মানবেন আপনি?
ঠিক আছে, তাহলে চলে যান, আমাকে কেন বলছেন নিয়ে যেতে?
আপনাকে বলছি কারণ আমি ঠিক ঠিক চিনি না জায়গাটা, যদিও অঞ্চলটা আন্দাজ করতে পারি। আপনি নেহাত রাজি না হলে কাছাকাছি গিয়ে আপনারই মতো কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে। সে-ও হয়তো আপনার মতো করেই ভাববে ! তাই আপনি যদি সাহায্য করতেন, ব্যপারটা সহজ হতো।
আপনাকে নিয়ে পারা যাবে না, চলুন।
ভেতরে ঢুকে অবাক হয়ে যায় জয়ি। এত বড় জায়গা! কাঠের টেবিলগুলোর কোন ছিরি নেই, টুল-বেঞ্চি-চেয়ার-টেয়ার মিলিয়ে বসার ব্যবস্থা, কিন্তু অবাক হয়ে ভাবে জয়ি কতো লোক একসাথে বসে মদ্যপান করে এখানে! মদের মতো জিনিষ, এতগুলো লোককে সামলায় কে! এখন অবিশ্যি ফাঁকাই, আর যারা এখনই বসে গেছে, তাদের তো কুলি-মজুর বলেই মনে হয়। জয়ি আশা করেছিলো দুয়েকজন অন্তত চেনা মানুষ দেখতে পাবে সে, কিন্তু পেলো না। তার মানে, বিকেলের দিকে আবার আসতে হবে ওকে। যাই হোক্, জায়গাটা তো চেনা হয়ে গেলো।
বেরিয়ে আসার পর সুদেশ জিজ্ঞেস করে, এখন কোথায় যাবেন?
সেটাই ভাবছি, যেটা ভেবে এসেছিলাম, সেটাই তো হলো না।
খিদে পেয়েছে?
ততটা পায়নি, তবে খেলে মন্দ হতো না।
চলুন, আপনাকে প্রায়শ্চিত্য করিয়ে আনি।
মানে?
চলুন না, গেলেই বুঝবেন।
একটু হেঁটেই ন্যূ-মার্কেটের উল্টোদিকে লিণ্ডসে স্ট্রীটের ওপর কেভেন্টারস লেখা কাচের দরজা ঠেলে একটা দোকানের ভেতরে নিয়ে এলো ওকে সুদেশ। ছোট ছোট, প্রায় কফি হাউজের টেবিলের মতো টেবিলে বসে, বোতল থেকে
স্ট্র-পাইপ দিয়ে দুধ খাচ্ছে কিছু লোক। এ রকম আশ্চর্য দৃশ্য কখনো দেখেনি জয়ি, মজা পায় ও। ওকে বসিয়ে কাউন্টার থেকে সুদেশ কিনে আনে পাঁউরুটি, দুধ দু বোতল আর কাগজে মোড়া একটা কিছু। বসে বলে, যেখানে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে বেরিয়ে এটাই আপনার খাওয়া দরকার, পাশাপাশি দুটো কলকাতা দেখুন। কাগজে মোড়া জিনিষটা দেখিয়ে জয়ি জিজ্ঞেস করে, ওটা কী, মাখন?
না, ক্রীম চিজ, কালিম্পঙে তৈরি হয়। রুটিতে মাখিয়ে খান, ভালোই লাগবে।
ক্রীম চিজ, পাঁউরুটি আর দুধ খেয়ে বাইরে বেরোবার পর জয়ি বলে, আপনি যান, আমি ছবি আঁকবো।
কোথায়?
এখানে। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে। কফি হাউজ আর খালাসিটোলার পর কেভেন্টারের ভেতরে বৃত্ত সম্পূর্ণ।
ফিদা হয়ে গেছি।
গুরু কর্তৃপক্ষকে অভিনন্দন। এই লেখা ও লেখকের জন্যে । সেই সময়টায় ফিরে গেছি ,ঢুকে পড়েছি।
অনবদ্য