খুশিঝোরায় জয়ি চলে এসেছে, সে-ও তো প্রায় বছর দেড়-দুই হলো। সরকারবাবুরা হাসি মুখেই মেনে নিয়েছেন ওদের প্রস্তাব। জমি হস্তান্তর হয়নি, এখনই বিক্রি করতে চাননা ওঁরা, কিন্তু ওঁদের জমিতে খুশিঝোরা যদি গাছ লাগায় আপত্তি নেই ওঁদের। পুকুরটা অবিশ্যি বিক্রি করেছেন ওঁরা খুশিঝোরাকে, সেটা কিনে, জলধরের উদ্যোগে স্থানীয় কিছু যুবককে নিয়োগ করে পুকুরটার সংস্কার করিয়েছে ওরা। আমূল সংস্কার। পুকুরের পাড় ধরে মাটি কাটতে কাটতে পুকুরটার পরিসর বাড়ানো হয়েছে খানিকটা, যতটা পর্যন্ত সরকার বাবুদের সাথে চুক্তি ছিলো। গভীরও করা হয়েছে অনেকটা। যতটা মাটি পাওয়া গেছে, যে জমির থেকে গাছ লাগানো শুরু হবে, সেখানে ফেলা হয়েছে সেই মাটি। ভিজে মাটি হয়তো জমির উর্বরতাও বাড়াবে খানিকটা। বনদপ্তর গাছের চারা দিতে আপত্তি করেনি, যদিও মূলত সেগুন আর সোনাঝুরির চারা দেওয়ারই ইচ্ছে ছিলো তাদের, আর কিছু য়্যুক্যালিপটাস। য়্যুক্যালিপটাস জমিতে পোকামাকড় কমাতে সাহায্য করবে, এরকমটাই বনদপ্তরের দাবি। শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি পাওয়া গেছে অনেক পেয়ারার চারা, আরও নানারকমের ফলের গাছ কিছু, কিছু মহুয়া আর শাল। একটা ডিজেল-পাম্প কেনা হয়েছে খুশিঝোরায়। পুকুরের জল মাঝে মাঝেই দেওয়া হয় নতুন গাছের চারা-বসানো জমিতে। গাছের চারা জোর কদমে লাগানো চলছে যখন তখন এক অভিনব উৎসবের ব্যবস্থা করলো জলধর।
ছবি আঁকতে, গল্প করতে, পরিবারেরই কারো কারোর নামে নালিশ করতে, অথবা বিনা প্রয়োজনেই, ডাংলাজোড়া আর ভাবকান্দি গ্রাম থেকে মেয়েরা আজকাল প্রায়ই আসে খুশিঝোরায় জয়ির কাছে। জলধর একদিন এইসব মেয়েদের সাথে খানিকটা নীচু গলায় কী সব কথাবার্তা বললো জয়ি তার বুঝলো না কিছুই। মেয়েরা চলে যাওয়ার পর জলধর বলে, একটা উৎসবের ব্যবস্থা করছি জয়িদি, আশা করা যায় এই উৎসবের পর স্থানীয় মানুষরাও যোগ দেবে আমাদের বনসৃজনের কাজে। কাল অনেক ভোরে রঘুনাথকে মেন গেটটা খুলে রাখতে বলবেন, সূর্যোদয়ের আগেই এসে হাজির হবো আমি।
পরের দিন জলধর পৌঁছোনোর একটু পরেই হাজির হলো চোদ্দ-পনেরো বছরের সাত-আটটা মেয়ে, সাথে সদ্য-বিয়ে-হওয়া আরো দু-তিনজন। এবং এদের মায়ের বয়েসী দুজন মহিলা। একজন মহিলার মাথায় একটা বস্তা গোছের, অন্যজনের হাতে একটা পুঁটুলি, মেয়েদের হাতে ছোট ছোট বাঁশের ঝুড়ি। মেয়েরা তাদের ঝুড়িগুলো বয়স্কাদের জিম্মায় রেখে একটু দূরে বয়ে যাওয়া খুশিঝোরার-প্রায়-আপন ছোট নদী থেকে চান করে ফিরলো ভিজে কাপড়ে। বস্তা থেকে বালি নিয়ে তারপর তারা ভরে ফেললো নিজের নিজের বাঁশের ঝুড়িগুলোকে। যে মহিলার কাছে ছিলো পুঁটুলিটা, তিনি পুঁটুলিটা খুললেন এবার। তাতে নানারকমের ছোটখাটো টুকিটাকি। ছোট ছোট টুকরো শালের ডাল প্রায় দাঁতন-কাঠির মতো; মটর, ছোলা, মুগকলাই আর কুরথির দানা কিছু, একরাশ শালপাতা, ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো কয়েকটা, হলুদ-গুঁড়ো, সিঁদুর আর কাজললতা, আর কাশফুলের কাঠি।
মেয়েরা ছোলা-মটর-কুরথি-মুগকলাই এর দানাগুলোতে তেল আর হলুদ মাখিয়ে, বালি ভরা ঝুড়িগুলো জলে ভিজিয়ে তাতে ছড়িয়ে দিলো শস্যের দানাগুলো, তারপর নিজেদের প্রত্যেকের চিহ্ণ হিসেবে কাশফুলের কাঠি গুনে গুনে গুঁজে দিলো বালিতে। ফিরে যাওয়ার আগে এগুলোকে তারা লুকিয়ে রাখবে বাগানে কোথাও, তারপর ঠিক দিনে ঠিক সময়ে কাশকাঠির হিসেব মিলিয়ে যে যার নিজের নিজের ঝুড়ি খুঁজে নেবে। কিন্তু তার আগে কাজ আছে। ঝুড়িগুলোকে এক জায়গায় রেখে তিনবার সেগুলোকে ঘুরে ঘুরে গান গাইলো তারা, জলধর বললো এই গানের নাম জাওয়া গান।
এবার শালপাতাগুলো কাঠি দিয়ে গেঁথে গেঁথে প্রত্যেক মেয়ে তৈরি করলো নিজের নিজের জন্যে একটি করে থালা। ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো জলে ভিজিয়ে সেগুলো পেতে দেওয়া হলো সেই থালার ওপর। এবার সিঁদুর আর কাজল দিয়ে তিনটে করে দাগ টেনে ঐ ভিজে কাপড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হলো ছোলা-মটর-কুরথি-মুগকলাই এর দানা। এগুলো নিজের নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে মেয়েরা।
জলধর জিজ্ঞেস করে, আজ কী তিথি জানেন জয়িদি?
তিথির খবর রাখিনা। পরিষ্কার আকাশ থাকলে চারদিকে যখন জোছ্নার আলো, আকাশের দিকে না তাকিয়ে উপায় থাকেনা যখন, তখন জানি পূর্ণিমার কাছাকাছি এসেছি। বাকি সময় বুঝতে পারি না।
আজ চতুর্থী। এটা শুক্লপক্ষ। এখন রোজ একটু একটু করে কলায় কলায় বাড়বে চাঁদ। তারপর পূর্ণিমায় শেষ, কৃষ্ণপক্ষের শুরু। আজ থেকে আর সাতদিন পর একাদশী। ভাদ্রের শুক্লা একাদশী। তখনই চাঁদ যথেষ্ট বড়ো। কদম গাছের পেছনে এই চাঁদ দেখার কপাল যদি কোরে থাকেন, তাহলে বুঝবেন ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশীর রাতের সৌন্দর্য। আর সে সৌন্দর্য যদি কপালে না-ও থাকে আপনার, একটা অল্টার্নেটিভ ব্যবস্থা করবো। সেই উৎসবই শুরু হয়ে গেছে। করম উৎসব।
করম উৎসব? এই সব গোছগাছ তারই জন্যে?
হ্যাঁ, এই মেয়েরা এখন ফিরে যাবে যে যার নিজের থালা নিয়ে। দিনের চান-টান সেরে পাঁচটা করে ঝিঙেপাতা উল্টো করে রেখে সেগুলোর ওপর রাখবে একটা করে শালের দাঁতন কাঠি। পরের দিন গোবর-ছড়া দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার কোরে আলপনা দেবে আর দেয়ালে সিঁদুরের দাগ দিয়ে তার ওপর দেবে কাজলের ফোঁটা। এখন থেকে মূল করম পুজোর দিন, অর্থাৎ একাদশী পর্যন্ত রোজ সন্ধ্যেতে চান করে নিজের নিজের বপন করা শস্যবীজে দেবে হলুদ গোলা জলের ছিটে।
এই পর্যন্ত বলে জলধর হঠাৎ বলে ওঠে, একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি জয়িদি। করম উৎসব বা করম পুজো বনের পুজো, আবার চাষেরও পুজো, এই পুজো এতএব ঘরে হয় না, হয় বাইরে। আমি ভেবে রেখেছি পুজোর আখড়া বানানো হবে ঐ যেখানে গাছ পুঁতছি আমরা, সেখানেই। ফাঁকা দেখে একটা জায়গায়।
তার মানে তোমার এই উৎসব খুশিঝোরায় নয়, খুশিঝোরার বাইরে?
খুশিঝোরার আবার ভেতর-বার কী জয়িদি, যেখানে গাছ লাগাচ্ছি, বনসৃজন করছি, দলিলপত্রে না হলেও স্পিরিটে তো সেটা খুশিঝোরার অংশই হলো, তাই না? আসলে বনসৃজনে এই অঞ্চলের সব মানুষকে টেনে আনার জন্যেই তো আমাদের করম উৎসব।
কী করবে? কী কী হবে উৎসবে?
আখড়াটা যেখানে হবে তার ঠিক মাঝখানে একটা গর্ত করা হবে, আর সেখানে পোঁতা হবে দুটো করম ডাল, একটা করম দেবতা আর একটা ধরম দেবতা।
পাবে কোথায়?
এতক্ষণ মেয়েদের কাজ দেখছিলেন, এ কাজটা ছেলেদের। ছেলেরাই যোগাড় করে আনবে ডালদুটো ঠিক সময়ে। এই যে আখড়ার মাঝখানে পোঁতা হবে ডালদুটো, এটা কিন্তু সঙ্কেতবহ, এর একটা বার্তা আছে। ডালদুটো আসলে যেন স্পর্শ করছে ধরণীর নাভিকে। এ সৃষ্টির সঙ্কেত, বনসৃজন করছি তো আমরা।
বাঃ, ভারী চমৎকার তো !
হ্যাঁ, একাদশীর দিন পুজো হবে সন্ধ্যেবেলায়। এই যে মেয়েদের দেখলেন, এরা সারাদিন উপোস কোরে সন্ধ্যেবেলায় নৈবেদ্যর ডালি সাজিয়ে নিয়ে আসবে পুজোর জন্যে। ডালিতে থাকবে কাটা ফল আর ফুল, জাওয়া ফুল। জাওয়া ফুল কী জানেন? জাওয়া ফুল আসলে ফুল নয়, তিন বা পাঁচ বা সাত রকমের দানাশস্যের অঙ্কুর, যা তারা বপন করেছিলো নিজের নিজের শালপাতার থালায় সাত দিন আগে, আর অঙ্কুরোদ্গম করিয়েছিলো রোজ সন্ধ্যেতে জল ছিটিয়ে। পুজোর পর চলবে হাঁড়িয়া পান আর সারা রাত ধরে নাচ; নাচে যোগ দেবে মেয়ের দল আর ধামসা-মাদল নিয়ে ছেলেরা। পরের দিন সকালে, ঐ যে মেয়েরা লুকিয়ে রেখেছিলো ভিজে বালিতে দানাশস্য ছড়ানো জাওয়াগুলো, সেগুলোর থেকে অঙ্কুরিত বীজ উপড়ে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে তারা, আর সেগুলো ছড়িয়ে দেবে নিজের নিজের বাড়িতে। করম উৎসব বন্ধুত্বেরও উৎসব। বীজ ভাগ করা হয়ে গেলে মেয়েরা পরস্পরকে পরিয়ে দেবে রাখী, এই রাখীর নাম করমডোর। এখন থেকে ওরা করমসখী, বিপদে-আপদে পরস্পরকে রক্ষা করার অঙ্গীকার ওদের, বনে-জঙ্গলে বিপদে পড়লে পাখির ডাকের নকল করে করমডোর ডেকে করমসখীদের জানাবে ওরা। এর পর হবে মহা-সমারোহে করম ডালের ভাসান, এই ঝোরাতেই আমাদের করম ডালকে ভাসান দেবো আমরা।
জলধরের বিবরণে উৎসাহ পেয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে করম উৎসব লক্ষ্য করলো জয়ি, ফটো তুললো, ছবিও আঁকলো বেশ কয়েকটা। আসল চমকটা অপেক্ষা করছিলো ভাসানের পর।
কয়েকজন ছেলের সাথে কথাবার্তা বলে, তাদের শিখিয়ে-পড়িয়ে, আগের থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিলো জলধর। নানা গাছের চারা লাগানো হয়েছিলো যে জমিতে, তার সংলগ্ন রাস্তায় বড়ো বড়ো কাপড়ে নানা ভাষায় লেখা ব্যানার ঝুলিয়ে দিলো জলধর আর তার দলবল, বাংলায়, হিন্দীতে আর অলচিকিতে, সব ব্যানারে একই কথা লেখা: এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পাশের জমিতে লাগানো গাছের চারায় জল ঢালুন, যে যতটা পারেন। আর ঢালুন যাবতীয় ময়লা, শুধু প্লাস্টিক বাদ দিয়ে। গাছ বড়ো হবে। মানুষের বর্জ্য গাছেদের ভোজ্য।
খুশিঝোরায় পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করার পর থেকে মাসে নিয়ম করে দুবার কলকাতায় যায় জয়ি। ওর যারা পরিচিত, শিল্পী সাহিত্যিক আর বিশেষ কোরে বিভিন্ন সংবাদপত্রের সাথে যুক্ত যারা, নানা কথায়-আড্ডায় তাদের জানিয়ে রাখে খুশিঝোরার ক্রিয়াকর্ম। এ বছর করম পুজোর পর কলকাতার অতি জনপ্রিয় এক সংবাদপত্রে রবিবারের সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশ হলো সচিত্র এক প্রবন্ধ। প্রবন্ধের নাম, জনজাতি উৎসব: খুশিঝোরায় করম পুজো, লেখক ও চিত্রকার, জয়মালিকা সেন। প্রবন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ করম পুজোর, প্রথম দিনে মেয়েদের ঝোরাস্নান থেকে রাস্তায় ব্যানার টাঙিয়ে পথচারীকে মনে করিয়ে দেওয়া “মানুষের বর্জ্য গাছেদের ভোজ্য” পর্যন্ত। অনুপস্থিত শুধু এই শ্লোগানের রচয়িতা জলধরের নাম! আর পরের দিনই, অর্থাৎ সোমবার, একটি ইংরিজি পত্রিকার কলকাতা ক্রোড়পত্রে একটি কার্টুন চিত্র জয়মালিকা সেনের। জয়মালিকার দৃষ্টি নিবদ্ধ উত্তোলিত এক ব্যানারে, ব্যানারে লেখা, মানুষের বর্জ্য গাছেদের ভোজ্য। কার্টুন চিত্রটির সাথে একটি রসরচনা। বিখ্যাত এক চিত্রশিল্পী জাগতিক সব স্বাচ্ছন্দ্য বর্জন কোরে এক আদিবাসী অঞ্চলে বনসৃজন করছেন ! মাথাটি সুস্থ আছে তো !
ভালোলাগা