খুব ছোটবেলায় একবার বারশুয়াঁয় গিয়েছিলি আমার সঙ্গে, মনে আছে তোর? কখনো ট্রেনে চড়িসনি, ট্রেনে চড়বি বলে বায়না-ঘ্যানঘ্যান করছিলি আগের রাত্তির থেকে, আমি তোকে পরের দিন বারশুয়াঁয় নিয়ে গেলাম। এখানকার মেন স্টেশন থেকে সকালে ছাড়ে প্যাসেঞ্জার ট্রেন, যায় বারশুয়াঁ পর্যন্ত, আবার ফিরে আসে বিকেলে। আমার বন্ধু অ্যাব্রাহাম ওখানে পি-ডব্ল্যু-আই, মানে পার্মানেন্ট ওয়ে ইনস্পেক্টরের বাড়িতে রান্না করে, সে-ই দুপুরে খাইয়ে দাইয়ে, ওর সাহেবের কুলিদের ধরাধরি করে রেল লাইন ইনস্পেক্ট করার জন্যে কুলিতে-ঠেলা যে ইনস্পেকশন কার আছে, তাতে চড়িয়ে দিলো তোকে। সারাদিনের একটা মজার আউটিং হয়েছিলো তোর। মনে আছে?
মনে তো আছেই জয়ির। ওর ঘ্যানঘ্যানানির কথাটাই বললো বাবা, ওর চেয়ে দু বছরের ছোট যে ভাইটা আছে, যার একটা ভালো নামও নেই, বোন্টি বলে ডাকে সবাই, দিদির দেখাদেখি সে-ও বায়না জুড়েছিলো। তার বায়না-কান্নাকাটি বাবা যেন শুনতেই পায়নি, তাকে নিয়ে যাবার কথা ভাবেইনি যেন। মা বোন্টি আর পরের বোনটা বাড়িতে থেকে গেলো, পুজোর সময় কেনা লাল ফ্রকটা পরে বাবার সঙ্গে বেরিয়ে গেলো সে। রাতে যখন ফিরলো বাড়িতে, মা একটাও কথা বলেনি, নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়েছিলো জয়ির। সে রাতে আর খায়নি বাবা আর মেয়ে, বাবার পাশে শুয়ে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়েছিলো। মাঝরাতে একবার ঘুম ভাঙতে দেখলো বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে মা, জয়ির আজও মনে আছে মায়ের চোখে চোখ পড়তে মনে হয়েছিলো আগুন ঝরছে সে চোখ থেকে!
হ্যাঁ বাবা, মনে আছে। কিন্তু বাবা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? সেদিন বোন্টিকেও নিয়ে গেলে না কেন?
ও-ও তো খুব কান্নাকাটি করছিলো রেলগাড়িতে চড়ার জন্যে।
তোকে তো বলেছি সব কথা বলবো আজ। বড় হতে হবে তোকে, খুব তাড়াতাড়ি। সব না শুনলে বড় হবি কী করে! শোন্ না। ঐ যে আমরা বারশুয়াঁয় গেলাম সেদিন, ওখান থেকে চরাই পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে মাইল আষ্টেক হাঁটলে পৌঁছে যাবি যেখানে, সেই জায়গাটাই টেনসা। লোহার খনি, অফিস-কোয়ার্টার্স, দোকান-বাজার ছাড়িয়ে আরও খানিকটা হাঁটলে যেখানে পৌঁছোবি, তেমন জায়গায় তুই যাসনি কখনো। ঘন সবুজ জঙ্গল, ঝর্ণা, তিরতিরে পাহাড়ি নদী দিয়ে ঘেরা জায়গাটার মাঝে মাঝে ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর, আশ্চর্য শান্ত চুপচাপ জায়গা, শুধু বয়ে যাওয়া জলের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। এই রকম জায়গায়, কে জানে কী ভাবে হঠাৎ একদিন পৌঁছে গেলো একটা বাঙালি ছেলে, বছর কুড়ি-বাইশ বয়েস হবে; কোথা থেকে সে এসেছে কেউ জানে না, জানেনি কোনদিন, কাউকে কখনো বলেনি সে। কিছুক্ষণ একটা টিলার ওপর চুপ করে বসে থাকার পর সে পকেট থেকে বের করলো একটা বাঁশি। আড় বাঁশি কাকে বলে জানিস তো, সেই আড় বাঁশি। তারপর চোখ বুজে আপন মনে বাজাতে লাগলো বাঁশিটা। কিছুক্ষণ বাজিয়ে চোখ খুলে দেখে, তার সামনে বসে আছে তিন-চারটে বাচ্চা ছেলেমেয়ে। বাচ্চাগুলো চোখ খোলা অবস্থায় ছেলেটাকে দেখে ফিক করে হেসেই দৌড়।
ছেলেটার কিছুই করার নেই তখন, কিছু করার ইচ্ছেও নেই বোধ হয়। টিলা থেকে নেমে একটু হাঁটা-চলা করে আবার এসে বসলো ঐ টিলার ওপরেই। ঝোলা গোছের কিছু একটা সঙ্গে ছিলো তার, সেটা থেকে বের করলো মিইয়ে যাওয়া একটা মুড়ির মোড়ক, সেটা খুলে মুড়িটা খেয়ে খানিকটা হেঁটে একটা ঝর্ণার জল খেয়ে নিলো পেট ভরে, তারপর আবার ঐ টিলার ওপরেই ফিরে এসে শুয়ে পড়লো চিৎ হয়ে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে তখন, ওপরের নীল আকাশটায় লেগেছে সূর্যাস্তের রঙের ছোঁয়া, ভাসমান এক-একটা সাদা মেঘ এসে সেই নীল ক্যানভাসে লাল-কমলা রঙের ওপর ছোট ছোট প্যাটার্ণ তৈরি করছে; সেই অপরূপ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন বুজে এলো তার ক্লান্ত চোখ দুটো, না জেনেই ঘুমিয়ে পড়লো সে।
সকালবেলা ঘুম ভাঙলো মোরগের ডাকে। তার মানে আশপাশের ওই কুঁড়েগুলোয় মোরগ আছে। আর আছে বাচ্চাগুলো, ওকে চোখ খুলতে দেখে পালিয়েছিলো যারা। ভালো তো, একই কুঁড়েতে আছে মোরগের দল, যারা ওর চোখ খুলিয়ে দেয়, আর আছে বাচ্চার দল, যারা ও চোখ খুললেই পালিয়ে যায় ! অর্থহীন এই তুলনাটা মনে আসতেই হেসে ফেললো সে, আর মনটাও কেমন ভালো হয়ে গেলো। বাঁশিটা বের করে আবার বাজাতে শুরু করলো ছেলেটা, এবার আর চোখ বুজে নয়, চোখ খুলেই। আর আশ্চর্য, কিছুক্ষণ পর ঐ বাচ্চাগুলো আবার। কিন্তু শুধু বাচ্চারা নয়, ওদের পিছনেই একজন লোক, একজনের পক্ষে যত কম পোষাক পরা যায় এ লোকটার পরনের পোষাক ততটাই কম, লোকটা খুবই বেঁটেখাটো, আর বয়েস আন্দাজ করা কঠিন, পঞ্চাশ হতে পারে, হতে পারে পঁয়ষট্টিও।
বাঁশি বাজানো থামিয়ে, উঠে দাঁড়িয়ে, টিলাটার থেকে আস্তে আস্তে নামতে শুরু করলো ছেলেটা, হাত জোড় করে একটা নমস্কারও করলো সে। উত্তরে কোন প্রতি-নমস্কার নয়, কিন্তু কিছু একটা প্রশ্ন করলো বয়স্ক লোকটা। ছেলেটা বুঝলো না কিছুই।
বাবার গল্পটা শুনতে খুবই ভালো লাগছে জয়ির, কিন্তু ছেলেটা কে সেটা শোনবার জন্যে কৌতূহল হচ্ছে খুবই: ছেলেটা কে বাবা, তুমি? – প্রশ্ন করলো সে।
আরে আমি কী করে হবো, আমি তো তখনো জন্মাই-ইনি। এটা অনেক পুরোনো কথা। তখন ঘোর স্বাধীনতা আন্দোলন। বাঙালি যুবকরা, বিশেষ করে শহর-টহরে থাকতো যারা, স্কুল-কলেজে পড়তো, প্রায় সবাই ঐ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়তো; গান্ধীর দলেও যেতো কেউ কেউ, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে একদল ছেলের ঝোঁক ছিলো বিপ্লবী দলের।আমার একটু একটু সন্দেহ হয় এই ছেলেটাও ঐ বিপ্লবী দলেই ছিলো, পুলিশের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেছিলো জঙ্গলে।
তোমাকে বলেছে?
বলেনি। বললাম তো কাউকেই কোনদিনও বলেনি ও কোথা থেকে এসেছে। কেউ বেশি কৌতূহল দেখালে বরং রেগেই যেত। হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, বাঙালিদের চিরকালই ধারণা, যে বাংলা বোঝে না সে নিশ্চয়ই হিন্দী বোঝে। ছেলেটা লোকটাকে তাই বললো, মেহ্মান হুঁ। কিছুই বোধ হয় বুঝলো না লোকটা। হাত দিয়ে খাওয়ার ভঙ্গী করে জিজ্ঞাসা করলো খিদে পেয়েছে কিনা। ছেলেটা ঘাড় নেড়ে বোঝালো, হ্যাঁ। লোকটার ইসারায় ওর পেছন পেছন হেঁটে শেষ পর্যন্ত পৌঁছোলো ওর বাড়ি, মানে ঐ বাইরের থেকে কুঁড়ে ঘর মনে হচ্ছিলো যেগুলোকে, তাদের মধ্যে একটায়। যতটা ছোট মনে হয়েছিলো বাইরের থেকে, ভেতরে ঢুকে মনে হলো ঠিক ততটা ছোট নয়। একটা উঠোন গোছের জায়গা, সেখানে ঘোরাঘুরি করছে এক দঙ্গল মোরগ-মুরগী, আর উঠোন থেকে একটু উঁচুতে একটা রকের মতো জায়গায় মাটি দিয়ে তৈরি একটা উনুন। উনুনটা জ্বলছে না, সেটার সামনে নেইও কেউ, কিন্তু তার উপরে কাঁচা শালপাতা ঢাকা দেওয়া একটা পেতলের পাত্র। বয়স্ক লোকটা কিছু না বলে পাত্রটাকে নামিয়ে আনলো, ছেলেটাকে ইশারায় ডেকে নির্দেশ দিলো রকটাতে বসার, আর তারপর ওর সামনে পেতলের পাত্রটাকে রেখে পাতাটা সরিয়ে দিলো। ছেলেটা দেখলো পাত্রটা প্রায় ভর্তি পান্তা ভাতে। হাতটা মুখের কাছে কয়েকবার নিয়ে গিয়ে লোকটা বুঝিয়ে দিলো ছেলেটাকে খেতে বলছে ও। মুখে একটু অপ্রস্তুত হাসি, কিন্তু খিদেও পেয়েছে খুব। দেরি না করে খেতে শুরু করে সে। প্রসন্ন মুখে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ওর খাওয়া দেখলো লোকটা, তারপর দ্রুত পদে ঢুকে গেলো রকটার লাগোয়া একটা ঘরে। পেতলের একটা ঘটিতে জল, আর হাতে গোটা দুই লঙ্কা নিয়ে ঘরটা থেকে বেরিয়ে ছেলেটার পাশে রাখলো সে। যতক্ষণ না ওর খাওয়া শেষ হলো দাঁড়িয়েই রইলো।
পরে ও শুনেছে বয়স্ক এই লোকটা ওখানকার মোড়ল গোছের, ওদের ভাষায় পানুয়া। যে ভাষায় ওরা কথা বলে সেটা হলো কুরুখ, আর কুরুখভাষী এই লোকেরা নিজেদের কুরুখ বলেই পরিচয় দেয়। কী করে যে এই কুরুখদের মধ্যেই থেকে গেলো ও, আর ক্রমে হয়ে উঠলো ওদেরই একজন, তার খুব বেশি ডিটেলে যাওয়ার দরকার নেই আমাদের। কিন্তু থেকে ও গেলো, একেবারেই। পানুয়া ওকে খেতে দিচ্ছিলো রোজই, কিন্তু দু-একদিন বাদেই ও বোঝালো যে এভাবে খেতে ও রাজি নয়, ওকে কাজ করতে দিতে হবে। কী কাজ করতে পারে ও? চাষবাস করে এখানকার লোকেরা, কিন্তু চাষের কাজ ও জানে না। ওর বয়েসের অন্য যে ছেলেরা আছে, তারা কাজ করে জঙ্গলে, প্রধানত শিকার, তীর-ধনুক দিয়ে। কিন্তু তা-ও তো ও পারবে না। পড়াশোনা করতো যদি ওখানকার ছেলেমেয়েরা, ও তাদের পড়াতে পারত। কিন্তু তাতে তো কারো উৎসাহ নেই। শেষ পর্যন্ত কাজ অবিশ্যি জুটলো একটা। শক্ত-সমর্থ ছেলেদের আরও একটা কাজ আছে জঙ্গলে। গাছ কেটে কাঠ বানিয়ে বিক্রী করা। কাপড়-চোপড়, বাসনপত্র, আর আরও কিছু কিছু টুকিটাকির প্রয়োজনে ক্যাশ টাকার দরকার হয় ওদের। শহর-বাজারের কিছু মানুষ এসে ওদের কাছ থেকে কাঠ কেনে, টাকার বিনিময়ে। ছেলেটার নাম এতদিনে সবাই জেনে গেছে। শরৎ। কাঠ কাটা আর বেচার কাজে লেগে গেলো শরৎ।
খাওয়ার পর শোয়া। কুরুখদের সমাজে ওর বয়েসি অবিবাহিত ছেলেরা নিজেদের বাড়িতেই থাকে না। অনাত্মীয় যুবককে বাড়িতে থাকতে দেবার রেওয়াজ নেই এই মানুষদের মধ্যে। প্রথম দিন এসে যে টিলাটায় শুয়েছিলো, সেখানেই ও শুয়ে রইলো কয়েকদিন। তারপর পানুয়া এসে ওকে ডেকে নিয়ে গেলো একদিন। পানুয়ার বাড়ির ঐ উঠোন গোছের জায়গাটায় এক দল যুবকযুবতী গায়ে মুখে রং-চং লাগিয়ে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর আছে বয়স্ক কিছু মানুষ, স্ত্রী এবং পুরুষ, বসে। বয়স্ক মানুষগুলোর সামনে শরৎকে দাঁড় করিয়ে কিছু বললো পানুয়া। বলা শেষ হতে মাথা নেড়ে সমর্থন জানালো উপস্থিত লোকজন। তারপর বসে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে থেকে এক জন উঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেবার ভঙ্গীতে বেশ উঁচু গলায় বললো কিছু। সঙ্গে সঙ্গে উচ্চকিত সমবেত হাসি বেশ কিছুক্ষণ। পানুয়া এসে হাত ধরে তারপর শরৎকে দাঁড় করিয়ে দিলো যুবকযুবতীদের যে সারিটা দাঁড়িয়েছিলো, তার সামনে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো নাচ। কিছুক্ষণ নাচের পর দাঁড়িয়ে পড়লো সবাই। বয়স্কদের মধ্যে একজন মহিলা ততক্ষণ আগুন লাগাচ্ছিলো পাকানো একটা কাপড়ে। নাচটা থামার পর জ্বলন্ত কাপড়টা যুবকযুবতীদের সারির একেবারে ধারে দাঁড়িয়েছিলো যে যুবক, তার হাতে তুলে দিলো মহিলা। কাপড়টায় আগুন তখনো লেগে আছে, যুবকটি সেই জ্বলন্ত কাপড় দিয়ে শরতের বাঁ হাতে কনুই এর ঠিক ওপরে পাশাপাশি পাঁচটা রেখা এঁকে দিলো, যন্ত্রণায় এক মুহূর্তের জন্যে মুখটা কুঁকড়ে গেলো শরতের, পরমুহূর্তেই সামলিয়ে নিয়ে সমবেত আনন্দধ্বনিতে যোগ দিলো সে। যুবকটি এবার হাত ধরে শরৎকে নিয়ে এলো তাদের নাচের সারিতে। শুরু হলো উদ্দাম নাচ। এ নাচেই যেন সে আবাল্য অভ্যস্ত, এ ভাবেই তাতে যোগ দিলো শরৎ। সেই রাত থেকে আর খোলা আকাশের নীচে নয়, শরতের জায়গা হলো যুবকদের আবাসস্থলে, কুরুখরা যাকে বলে ধুমকুরিয়া।
ছোট ছোট যে কুঁড়ে ঘরগুলোয় থাকে এক একটা কুরুখ পরিবার, ধুমকুরিয়া তার তুলনায় অনেক বড়। আট-দশ বছরের কিশোর থেকে প্রায় চব্বিশ-পঁচিশ বছরের যুবক পর্যন্ত অনেকে থাকে একটা ধুমকুরিয়ায়, সবাই পুরুষ। মেয়েদের কোন ধুমকুরিয়া নেই এখানে, কিন্তু একটু বড় হয়ে যাওয়ার পর চার-পাঁচটা মেয়ের এক একটা দল থাকে একা-হয়ে-যাওয়া কোন বিধবার বাড়িতে। এই সব মেয়েদের অবাধ যাতায়াত আছে ধুমকুরিয়ায়, কেউ কেউ কখনো কখনো থেকেও যায় সেখানে, কেউ কিছু বলে না। ধুমকুরিয়ায় আশ্রয় পাওয়ার ঠিক আগেই যে সমবেত নাচে যোগ দিয়েছিলো শরৎ, সেখানে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলো সে, নাচছিলো যে যুবক যুবতীর দল, তাদের সবাই তার তুলনায় অনেক বেঁটে, প্রায় কেউই ওর কাঁধ ছাড়িয়ে উঠতে পারেনি। শুধু একজন ছাড়া। একটি মেয়ে, ওর থেকে পাঁচ-ছ জনের পর দাঁড়িয়ে। এই মেয়েটি অনেক লম্বা, ওর সমান না হলেও অনেকটা।
কাঁধে একটা টংগী, কাঠ কাটার কুঠারের এটাই নাম কুরুখদের ভাষায়, জঙ্গল থেকে সদ্য ফিরেছে শরৎ কোন একদিন, দেখলো ধুমকুরিয়ায় এক দল মেয়ে, খুব উৎসাহে চেঁচিয়ে গল্প করছে তারা। শরৎকে দেখার পর এক মুহূর্ত থমকে গেলো মেয়ের দল, তারপর মনে হলো নিজেদের মধ্যে চোখে চোখে কিছু কথা বললো তারা, তারপর লম্বা মেয়েটি হঠাৎ দৌড়ে এসে শরতের হাত ধরে টেনে তাকে নিয়ে গেলো মেয়ের দলের মধ্যে, আর দাঁড় করিয়ে দিলো ঠিক নিজের পাশে। আর তারপর, মেয়েদের মধ্যে সে কী হাসির ধুম ! একটু পরে ছেলেরাও এসে যোগ দিলো সে হাসির মধ্যে।
এই পর্যন্ত বলার পর একটু থামে বাবা, চোখ বড় বড় করে থাকা মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, কী রে, ঘুম পাচ্ছে নাকি তোর?
বাবার ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে জয়ি, না বাবা, ঘুম পাচ্ছে না একটুও, তুমি আরও বলো, সবটা।
মেয়ের সাথে এত গল্প কতদিন করেনি সে, কিন্তু ঠিক কতটা বলা যায় মেয়েকে, সে জানে না। একটু ভাবে, তারপর আবার শুরু করে সে–
সে রাত্তিরে থেকে গেলো মেয়েটা। জানা গেলো ওর নাম কীবা। ওদের ভাষায় কীবা মানে তুষার; কুরুখদের মধ্যেই একটু ফর্সা মেয়েটা, তাই বোধ হয় এরকম নাম।
সকালে রোদ্দুর ভালো করে ওঠার আগেই রোজ বেরিয়ে পড়ে ছেলের দল, যত তাড়াতাড়ি বেরোনো যায়, ততই ভালো কাঠ কাটার পক্ষে। এর মধ্যে একদিন সূর্য ওঠার আগেই কীবা হাজির। দৌড়িয়েই এসেছে বোধ হয়, হাঁপাচ্ছে রীতিমতন, হাতে পাতা চাপা দেওয়া বাটি একটা। ধুমকুরিয়ার ছেলেরা তখন সার দিয়ে বসে খাচ্ছে পান্তা ভাত। শরতের সামনে এসে দাঁড়ায় কীবা, চাপা দেওয়া পাতাটা সরিয়ে বাটিতে যা ছিলো ঢেলে দেয় শরতের পাতে।
কী এটা? – না ভেবেচিন্তেই জিজ্ঞেস করে শরৎ, হয়তো ঈষৎ উষ্মাও তার গলায়।
একটু থতমত কীবা, “ওসগা”, বলে তারপর।
ওসগা? ইঁদুর? ভালো করে তাকিয়ে দেখে একটা মাঝারি মাপের ইঁদুরকে ঝলসানো হয়েছে। ঝলসানো ইঁদুর খেতে ভালবাসে এখানকার মানুষ। শরৎ খায়নি কখনো, একটু অস্বস্তি হয় তার। তারপর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে। কুরুখদের মধ্যে থেকে তাদেরই একজন হবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে সে, আর তাছাড়া সে তো ভালো মতই জানে এখানে কোন নালা-নর্দমা নেই, ইঁদুর তো জঙ্গলেরই প্রাণী, জঙ্গলের খরগোস যদি খাওয়া যায়, ইঁদুর নয় কেন! সংস্কার কাটিয়ে ইঁদুরটাকে হাত দিয়ে তুলে ধরে একটা কামড় বসিয়ে দেয় সে। চিবিয়ে, গিলে ফেলে, কীবার উৎসুক মুখের দিকে তাকায়: লুডূঊঊ, টেনে টেনে বলে সে, নরম !
কৃতজ্ঞতায় বুক ভরে যায় কীবার।
সে রাত্তিরে চুপি চুপি এসে শরতের পাশেই শুয়ে পড়ে কীবা।
মাস ছয়েক পর একদিন পানুয়া ডেকে বলে তাকে, ধুমকুরিয়াতেই থেকে যাবে চিরকাল, নাকি বিয়ে-টিয়ে করে ঘর-সংসার করার ইচ্ছে আছে?
ঠিক ঠিক জবাব দিয়ে উঠতে পারে না সে, লজ্জাই করে বোধ হয়। পানুয়া বলে, ধরতি আয়ো, বেরি বেলা, কে তোমাকে পাঠিয়েছে জানিনা, কিন্তু তোমাকে দেখেই আমার মনে হয়েছিলো আমাদের কীবার জন্যেই তোমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তোমার মনে আছে, ধুমকুরিয়ায় যেদিন তোমাকে নেওয়া হলো, কীবার বাবা সেদিন উঠে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলায় সবাই খুব খুশি হয়েছিলো, মনে আছে তোমার?
মনে আছে শরতের, সে শুধু জানতো না, ঐ বয়স্ক লোকটাই কীবার বাবা।
পানুয়া নিজেই বরকর্তা হয়ে, কুরুখদের যাবতীয় নিয়ম-আচার মেনে, প্রচুর হাঁড়িয়া খেয়ে এবং খাইয়ে, মাস চারেকের মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দিলো শরতের সঙ্গে কীবার। বিয়ের পর ধুমকুরিয়া থেকে নির্বাসন, একটা কুঁড়েতে থাকতে দেওয়া হলো কীবা আর শরৎকে। আর, ঠিক পাঁচ মাসের মাথায় জন্মালাম আমি।
তুমি? উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে জয়ি।
বোকা মেয়ে, এতক্ষণেও বুঝতে পারিসনি শরতের ছেলে হেমন্ত!
সত্যিই, মনে মনে ভাবে জয়ি, শরৎ নামটা শুনেই তো ওর বোঝা উচিত ছিলো বাবা ওকে নিজের কথা বলছে। বলে উঠলো, বাবা, তাহলে তুমি কুরুখ? আমিও?
তুই হয়তো নোস, কিন্তু আমি তো বটিই। আমার বাবার প্রাণপণ সাধনা ছিলো কুরুখ হয়ে ওঠার। কিন্তু কীবার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর সব যেন কেমন গোলমেলে হয়ে গেলো। কারণ, আমার মা প্রাণপণ সাধনা শুরু করলো বাঙালি হয়ে ওঠার। মার অবিশ্যি জোরদার যুক্তি ছিলো একটা। তুই পিতৃতন্ত্র-মাতৃতন্ত্র বুঝিস? তোকে সংক্ষেপে বলি। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী যদি স্বামীর পরিবারের নিয়ম-টিয়ম মেনে চলে, স্ত্রী স্বামীর পরিবারে এসে থাকে, ছেলেমেয়েদের পদবি বাবার পদবি অনুযায়ী হয়, মোটামুটি সেটা পিতৃতন্ত্রের লক্ষণ, উল্টোটা হলে মাতৃতন্ত্র। কু্রুখদের সমাজে পিতৃতন্ত্রই চলে, আর বাঙালিদের তো বটেই। কাজেই বিয়ের পর, বিশেষ করে আমি জন্মাবার পর, মা বললো মা বাঙালি হয়ে গেছে, পদবি সেন, মার নাম এখন থেকে কীবা সেন, সে শরৎ সেনের স্ত্রী এবং হেমন্ত সেনের মা। অতএব বছর আষ্টেক বয়েস পর্যন্ত হেমন্ত সেন অন্য কুরুখ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেললো, কিন্তু সকাল-সন্ধ্যে ইংরিজি-বাংলা পড়াশোনা করতেও বাধ্য হলো, মার তত্ত্বাবধানে, যদিও তার মার অক্ষরপরিচয় ছিলো না। সূর্যাস্তের পর বাবা ফিরলে বাবার ইশকুল চালু হতো, রিডিং পড়া-হাতের লেখা-অঙ্ক কষা ছাড়াও সে ইশকুলে শোনানো হতো নানা গল্প; রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী ছাড়াও তার মধ্যে থাকতো মোগল বাদশাদের কথা, সিপাহি বিদ্রোহের বিবরণ, বিদ্যাসাগর নামে এক জেদি পণ্ডিতের আশ্চর্য কাণ্ডকারখানা আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে একজনের কবিতা আর গান। বিশেষ করে গান। ইশকুলের এই অংশটায় মা-ও ছাত্রী হয়ে যেত দিব্যি, আর মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে গেয়ে পাগল করে দিতে পারতো এমনকি কুরুখদেরও।
কুরুখদের সমাজে আট-ন বছর বয়েস হলেই ছেলেদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ধুমকুরিয়ায়। আমাকে পাঠানো হলো না। খেলাধুলোর সঙ্গী নেই কেউ। তার ফলে আমি খুব একা হয়ে গেলাম। আমার তো বই-পত্র ছিলো না যে বাড়িতে বসে বই পড়বো। আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলো বাবা। আসলে বাবার খুব একটা আপত্তি ছিলো না আমার ধুমকুরিয়ায় যাওয়ার। কিন্তু মা একেবারেই রাজি নয়। কী করা যায় এই অবস্থায় ! কাঠ কিনতে আসতো যারা তাদের সঙ্গে কথা বলে বাবা আমাকে পাঠিয়ে দিলো তাদেরই একজনের সঙ্গে। ঠিক কেন যে পাঠিয়ে দিলো আমি বুঝলাম না, আজ পর্যন্ত আমার ধারণা বাবা নিজেও ঠিক স্পষ্ট করে জানতো না কেন আমাকে পাঠিয়েছিলো। টেনসার ঐ কুরুখপল্লী থেকে নীচে কোন গ্রাম বা শহরে আসতে রাজি ছিলো না বাবা। বোধ হয় কপাল ঠুকেই পাঠালো আমাকে। যার সঙ্গে এলাম সে লোকটার নাম কী আমি জানিনা। সবাই তাকে বাবু বলে ডাকে, আমিও বাবু বলেই ডাকতে শুরু করলাম তাকে।
বাবু আমাকে নিয়ে এলো মহুলপল্লী নামের একটা গ্রামে। জায়গাটা কোথায় আমার ধারণা ছিলো না, এখন জানি, এই স্টীল প্লান্ট থেকে খুব একটা দূরে নয় মহুলপল্লী। সেখানে একটা মুদির দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা বলে তার দোকানেই আমাকে রেখে দিলো বাবু। দোকানের মালিক আমাকে দোকানদারি করতে শিখিয়ে দিলো, তার মানে ওজন-টোজন, মাপজোক, এ সব করে লোককে নানারকমের জিনিষ দেওয়া আর পয়সা নেওয়া। রাত্তিরে দোকানেই থাকতাম একা একা।
ভয় করতো না তোমার?
না, ভয় যাকে বলে, সে ব্যাপারটাই বুঝতাম না। চুরি ডাকাতি এ সব তো ছিল না কুরুখদের গ্রামে, আর বাবা কোনদিন ভূতের গল্পও বলেনি। কিন্তু মন খারাপ হতো। কোথায় সন্ধ্যেবেলা বাবা ফিরলে নানারকমের গল্প আর গান, আর কোথায় মহুলপল্লীর এই দোকানে সারা সন্ধ্যে একা একা কাটানো। কিছুদিন পর বাবু একবার এলো আমি কেমন আছি খবর নিতে। আমি ধরে পড়লাম আমাকে আমার বাবা-মার কাছে পৌঁছে দিতেই হবে। তার সঙ্গেই আবার ফিরে গেলাম।
বাবা আমাকে অঙ্ক কষতে শিখিয়েছিলো, আর দোকানে কাজ করতে গিয়ে টাকাপয়সা, মাপজোক, ওজন-টোজন শিখে গেলাম চটপট। মনে হলো বাবা খুশিই হয়েছে। অনেক পেনসিল, কালি-কলম, কাগজ আর একটা মাপজোকের ফিতে দিয়েছিলো আমাকে দোকানের মালিক, বোধ হয় মাইনে হিসেবেই। তাতে সুবিধে হলো একটা। সকাল বেলা কাঠ কাটতে যাবার আগে বাবা নানা বিষয়ে রোজ একটা কিছু লিখতে দিয়ে যেত। কিরকম বিষয় জানিস? আমরা যেখানে থাকি সেখান থেকে মিনিট পনের হাঁটলে যে ঝর্ণাটা দেখা যায়, সেটার সম্বন্ধে কিছু লেখো, অথবা মহুয়ার ফুলের বিষয়ে, কিংবা শাল জঙ্গল নিয়ে কিছু একটা। এটা খুব মজার কাজ ছিলো। যা মাথায় আসতো, লিখতাম। আর মাঝে মাঝে মনে হতো যেটার ব্যাপারে লিখছি, সেটাকে দেখে আসি একবার। এই রকম দেখতে দেখতে এক দিন মনে হলো এগুলোকে আঁকলে কেমন হয় ! সেই থেকে আর একা একা লাগতো না নিজেকে, সারাদিন মাঠেঘাটে ঘুরে ঘুরে ছবি আঁকতাম আর লিখতাম।
সাতচল্লিশে দেশ স্বাধীন হলো, তখন আমার বয়েস উনিশ। খবরের কাগজ, রেডিও, কিছুই নেই টেনসায়। তবুও আমরা খবরটা পেয়ে গেলাম। এই প্রথম দেখলাম বাবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা। কাঠের ব্যাপারীদের সঙ্গে কথা-টথা বলে, বাবা মা আর আমি একদিন হাঁটতে হাঁটতে এলাম বারশুয়াঁয়। লোহার খনির খবর পাওয়া গেছে ওখানে। এধার-ওধার থেকে অনেক লোক তখন ভিড় জমাচ্ছে। পাথর কাটলেই নাকি টাকা। কাঠের ব্যাপারীদের পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে নানা কথা বললো বাবা। ঐ ব্যাপারীদের সুপারিশেই হোক্, আর আমার সঙ্গে কথা বলেই হোক্, একজন আমাকে কাজ দিতে চাইলো তার কাছে। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে, কিছু টাকা পয়সাও দেবে, আর ব্যবসাটা যদি বুঝে নিতে পারি তাহলে তো কথাই নেই, অনেক টাকা আয় করতে পারবো। দুপুর বেলা একটা ভাতের হোটেলে খেতে ঢুকলাম আমরা। খেতে খেতে বাবা আমাকে বললো এই মানুষদের সঙ্গে নিজের জীবনকে আর মেলাতে পারবে না বাবা, কিন্তু আমাকে এখানেই থাকতে হবে। থেকে গেলাম। জীবনে প্রথমবার বাবার মুখে কষ্টের ছায়া দেখলাম, ঠিক কেন যে, কে জানে !
বারশুয়াঁয় কয়েক বছরের বেশি থাকিনি আমি। বোণ্ডামুণ্ডায় রেলের খুব বড়ো কাজ শুরু হলো কিছুদিনের মধ্যেই, অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়েছিলো, ওখানে একজন কন্ট্রাক্টরের কাছে কাজ নিয়ে চলে গেলাম। আয় বেড়ে গেলো অনেকটাই, বাবা-মাকে জানাবার জন্যে একবার গেলাম টেনসা। শুনে বাবা খুশি হয়েছে কিনা বুঝতে পারলাম না, শুধু মনে হলো অনেকটাই বয়েস বেড়ে গিয়েছে বাবার হঠাৎ।
এর মধ্যে পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে স্টীল প্লান্ট বানানোর কাজ। ক্রুপ নামে একটা জর্মন কোম্পানি দায়িত্ব নিয়েছে। প্রথম দফায় শ দুয়েক, তার পর আরো শ তিনেক জর্মন সাহেব এসেছে এখানে। কেউ কেউ পুরো ফ্যামিলি নিয়েই। প্লান্টের কাজের সঙ্গে সঙ্গে এতগুলো সাহেবের থাকার জায়গা তৈরি করা হবে। বোণ্ডামুণ্ডায় যে কন্ট্রাক্টরের কাছে কাজ করতাম আমি, সে এখানে বিরাট কন্ট্রাক্ট পেয়েছে। এতদিনে আমার ওপর তার খুবই ভরসা। সাহেবদের বাড়ি তৈরি হচ্ছে যেখানে, সে আমায় তার সাইট-ইন-চার্জ করে পাঠিয়ে দিলো। যে সাহেবরা এর মধ্যেই এসে গিয়েছিলো, তারা তখন থাকতো তাঁবুর মধ্যে, এমনকি স্ত্রী-পরিবার নিয়ে এসেছিলো যারা, তারাও। দিব্যি থাকতো কিন্তু, দেখে মনে হতো না তাদের কোন অসুবিধে হচ্ছে। কাজপাগল জাত, সকাল থেকে নানা কাজে লেগে যেত সবাই, ভাঁজ-করা টেবিল-চেয়ারের ভাঁজ-টাজ খুলে পুরোপুরি অফিস বসিয়ে দিতো সকাল থেকেই, সেখানেই মীটিং-ফিটিং করতো, বড় বড় কাগজ খুলে ড্রয়িং করতো, কেউ কেউ মাঠে-ময়দানে গিয়ে মাপজোক করতো, জীপ নিয়ে দূরে দূরে চলে গিয়ে কোদাল গাঁইতি দিয়ে পাথর কেটে আনতো কখনো কখনো, আরো আরো দূরে অনেক লোকলস্কর নিয়ে গিয়ে বোমা-টোমা দিয়ে পাহাড় গুঁড়িয়ে নানারকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করতো কেউ কেউ। আর সন্ধ্যে হলেই হৈ হৈ গানবাজনা আর মদ খাওয়া। ওদের সবায়ের বস ছিলো যে, লোকটার নাম কাই, ঐ কাই নামেই ডাকতো সবাই; তার বউ-টউ ছিলো না, একা একাই থাকতো, হাফ-প্যান্ট ছাড়া আর কখনো কিছু পরতে দেখিনি তাকে। এখানে আসার পর মহুয়ার অভ্যেস হয়েছিলো তার, সে নিজেদের মদ না খেয়ে ঐ মহুয়াই খেতো।
জর্মন সাহেবদের সঙ্গে, আর বিশেষ কোরে কাইয়ের সঙ্গে আমার প্রায় বন্ধুত্বই হয়ে গেলো, তার কারণটা কী জানিস?
কী?
সাহেবরা নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভাষাতেই কথা বলে। আর তাছাড়া ভাঙা ভাঙা ইংরিজিও বলে আমাদের এখানকার অফিসিয়ালদের সাথে। কিন্তু সাইটে যাদের সঙ্গে ওদের কথা বলতে হয়, তারা কেউই ঐ দুটো ভাষার একটাও জানে না। আমিই শুধু একটু আলাদা। বাবার ইশকুলের দৌলতে ভাঙা ভাঙা ইংরিজি বলতে পারি আমিও। ফলে আমাকে ছাড়া ওদের চলেই না।
তো, জমি পরিষ্কার করে, জরিপ-টরিপ কোরে কন্সট্রাকশনের জন্যে তোড়জোড় শুরু করেছি আমরা যখন, কাই আমাকে ডেকে একদিন বললো, তোমাদের প্ল্যানটা আমাকে দেখাবে একদিন। অসুবিধেয় পড়ে গেলাম। প্ল্যানটা দিল্লী থেকে এসেছে। এখন জর্মন সাহেবরা থাকবে ঠিকই, কিন্তু ওরা চলে গেলে প্লান্টের সব বড় বড় সাহেবরা থাকবে এখানে, সে ভাবেই তৈরি হয়েছে প্ল্যান। ও যদি বলে কোন বদল-টদল করতে, সে আমার এক্তিয়ারের বাইরে।
খোলাখুলিই বললাম কাইকে। বললো, তোমার কোন চিন্তার দরকার নেই, প্ল্যানটা দেখাও আমাকে। দেখালাম। জিজ্ঞেস করলো, ক্লাবটা কোনখানে?
ক্লাব?
হ্যাঁ, ক্লাবই। কেন, ক্লাবের কোন প্রভিশন নেই এখানে?
আমি তো কোন ক্লাবের কথা শুনিনি।
কাই আমাকে একটা জিপ দিয়ে পাঠিয়ে দিলো বোণ্ডামুণ্ডা, যেখানে আমার কন্ট্র্যাক্টর দরবেশ শাহ্ তার নিজের টেন্টে থাকে। বললো, তাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে।
দরবেশ শাহ্ আসার পর তার সঙ্গে সাহেবের কী কী কথা হলো জানিনা, কিন্তু কথা শেষ করেই চলে গেলো দরবেশ, আমার সঙ্গে একটাও কথা না বলেই।
দিন তিন-চার পর দরবেশ নিজেই হাজির, নিজের জীপে। কাই তখন কোথায় বোঝা মুশকিল। সে হয়তো কোন মাপজোকের মধ্যে আছে, দূরে কোথাও বোমা ফাটাবার দলে থাকাও অসম্ভব নয়। কিন্তু বসেই থাকলো দরবেশ কাইয়ের তাঁবুর সামনে, যতক্ষণ না সে ফেরে। কাই ফেরার পর দুজনে কথা বললো কিছুক্ষণ, একটা ছোট কাগজে পেনসিল দিয়ে কিছু আঁকাজোকা করলো সাহেব, সেটা পকেটে পুরে দরবেশ আমাকে বললো পরের দিন বিকেলে বোণ্ডামুণ্ডাতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে। গেলাম। আমার হাতে সে দিয়ে দিলো একটা ড্রয়িঙের রোল। বলে দিলো আপাতত ওর কাছে আর আসার দরকার নেই। ড্রয়িংটা কাইকে দেখালে ও যা যা বলবে তা-ই যেন করি।
সাহেব দেখলো ড্রয়িং, এক মুহূর্তের জন্যে। আমাকে বললো, তোমাকে একটু দূরে পাঠাব। এই যে ক্লাবটা তৈরি করবে তুমি, সেটা ঠিক এখানে হবেনা। হবে এখান থেকে দূরে, নদীর ধারে। তারপর কী ভেবে বললো, ঠিক আছে, চট করে খেয়ে নাও, এক সঙ্গেই যাব আমরা।
জীপ চালিয়ে বেশ খানিকটা যাওয়ার পর একটা পাহাড়ের গা দিয়ে বয়ে চলেছে নদীটা। নদীর পাড়ে দাঁড়ালাম আমরা দুজন। বেশ চওড়া নদী, মাঝে মাঝে বালি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তারপরেই যেখানে গভীর, নীল জলের স্রোত সেখানে বেশ ভালোই, আর সাদা ফেনা। সাহেব জিজ্ঞেস করলো, এ নদীর নাম জানো?
জানিনা।
ব্রাহ্মণী। আসলে দুটো নদী মিলে তৈরি হয়েছে ব্রাহ্মণী। শঙ্খ আর কোয়েল।
তুমি কী করে জানলে এত কাই? তুমি তো এ দেশের লোক নও।
সাহেব তার হাতে ধরা বোতলটা দেখালো আমায়: স্টীল প্লান্ট তৈরি করতে এসেছি আমি, বুঝলে? স্ক্র্যাচ থেকে শুরু বলে ইংরিজিতে একটা কথা আছে জানো তো? এখানে আমার শুরু যেখান থেকে সেখানে একটা স্ক্র্যাচও নেই; ব্ল্যাঙ্ক থেকে শুরু আমার। প্রথম যখন তোমাদের এই দেশে আসি, আর তোমাদের ক্যাপিটাল থেকে এখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আমাকে, তখন ভেবেছিলাম ফিরে যাব। এই লাল কাঁকুড়ে মাটিতে লোহা আছে, এটুকুর বেশি আর কোন ইনফর্মেশন দেওয়া হয়নি আমাকে। স্টীল প্লান্ট, একটা স্টীল প্লান্ট কত বড় ব্যাপার জানো? র মেটেরিয়াল সোর্স তো তার সামান্য একটুখানি। কত জায়গা লাগবে, কত লোক ডিসপ্লেস্ড্ হবে, কত ভাঙা হবে, নতুন করে গড়া হবে কত, কত রকমের রিসোর্স, সেগুলো আসবে কোথা থেকে, কী ভাবে, কোন ট্রান্সপোর্টে, কী বিশাল হিউম্যান রিসোর্সের প্রয়োজন, তাদের তৈরি করবে কে, তারা সেট্ল্ড্ হবে কীভাবে, আরো কত কিছু ! এদিকে আমার কোম্পানী ক্রুপ ফিনান্স কমিট করে বসেছে ! যে সরকারী অফিসার আমাকে সঙ্গ দিচ্ছিলো, সে খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। বললো, কাই, অধৈর্য হোয়ো না। তোমাদের য়্যোরোপের এত পাওয়ারফুল একটা দেশকে দুশো বছর ধরে চেষ্টা করে করে তাড়িয়েছি আমরা, আমাদের আণ্ডারএস্টিমেট কোরো না। তোমার এক্সপার্টাইজ আছে, আমাদের নেই; আমাদের লীডারশিপ দাও, আমরা করে দেখাবো। আর এই নদীটার দিকে তাকিয়ে দেখো, মন ভালো হয়ে যাবে। আমরা দুজনে নদীর পাড়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি একটা মেয়ে মাথায় কয়েকটা আর্দেন পট নিয়ে চলেছে। আমার সঙ্গী তাকে ডাকলো। কী কথাবার্তা হলো বুঝলাম না। মেয়েটা পটগুলো নামিয়ে বসলো আমাদের সামনে। শালপাতা তো জানোই। ওর একটা পটের মধ্যে কিছু শালপাতা ছিলো, সবুজ। সেগুলোকে নিয়ে মুড়িয়ে মুড়িয়ে মেয়েটা তৈরি করলো পাতার বোউল, একটা করে দিলো আমাদের হাতে। তারপর ওর ঐ আর্দেন পট থেকে লিকুইড ঢেলে ঢেলে দিলো তাতে। আমার সঙ্গীর দেখাদেখি আমিও চুমুক দিলাম। ওঃ, গ্লুভাইন! এ তো আমাদের খৃস্টমাসের মদের মতো! হাউ মেলো! অসগারাইফ্ট্!
আর একবার বোতলটাতে হাত বোলালো সাহেব। থেকে গেলাম তোমাদের দেশে। এত ভালো বন্ধু পেয়ে গেছি। পরে নাম শুনেছি, মহুয়া। এখানে বলে মহুল। হাউ সুইট!
কিন্তু নদী নালার খবর পেলে কোথা থেকে এত? – জিজ্ঞেস করলাম আমি।
আমার ঐ সঙ্গী। অনেক খবর রাখে সে। ঐ যে পাহাড়টা দেখছো, হাত দিয়ে পাহাড়টা দেখায় কাই, ওখানে একটা মন্দির আছে। দেখবে নাকি? বললাম, চলো। সাধারণ শিব মন্দির একটা, খানিকটা চরাই বেয়ে উঠতে হয় পাহাড়ে। কাই বললো, এখানে অনেকবার এসেছি আমি তার পর। মন্দির দেখাশোনা করে যে লোকটা সে আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেয় না, কিন্তু পাহাড়টা দেখিয়েছে আমাকে। এটা একটা কেভ, গুহার মতো।
আমরা দেখতে দেখতে মন্দিরে পুরোহিত হাজির। কাইকে চেনে, ওকে দেখে হাসলো। ভুরুটা একটু তুলে নীরবে জানতে চাইলো আমার পরিচয়। পরিচয় দিলাম। বললো, তোমার সাহেবের খুব কৌতূহল, অনেক কিছু জানতে চায়, কিন্তু না আমি বুঝি ওর ভাষা, না ও বোঝে আমারটা ! এই মন্দিরের ইতিহাসটা আমি বলছি তোমাকে, তুমি তোমার সাহেবকে বুঝিয়ে দিও।
পুরোহিত বললো গুহা সমেত এই পাহাড়ের নাম বেদব্যাস, মহাভারত লেখা হয়েছিলো এখানে। পরাশর নামে এক মুনি ছিলেন পুরাকালে, এখানেই থাকতেন, পুজো-আর্চা-সাধন-ভজন সবই তাঁর এখানে। এই যে নদী দেখছো, ব্রাহ্মণী, এখানেই এক মাছ-ধরা জেলে আর তার মেয়ে সত্যবতী মাছ ধরতো নদীতে। মুনি লক্ষ্য করতেন নিয়মিত। দেখতে দেখতে মুনির খুব পছন্দ হয়ে গেলো সত্যবতীকে। কিছুদিন পর তাঁদের একটি ছেলে হলো, সে-ও বড় হয়ে এখানেই থাকলো, অনেক সাধনা করে সে হলো মহামুনি বেদব্যাস। সারা ভারতবর্ষ তাঁকে জানে, এখানেই তিনি লিখেছিলেন মহাভারত। ভারতবাসী তাই তাঁর স্মৃতিতে এই গুহারও নাম দিয়েছে বেদব্যাস।
পুরোহিত বললো, এত জায়গা থাকতে পরাশরের মতো এত বড় মুনি এখানে থাকতে এলেন কেন তাই বোধ হয় ভাবছো তুমি। নদীর দিকে আর একবার চেয়ে দেখো, এই নদী প্রয়াগসঙ্গমের মতো পবিত্র। কোয়েল-শঙ্খ-ব্রাহ্মণীর সঙ্গমস্থল। এখানে স্নান করলে জীবনের সব পাপ ধুয়ে যায়, এবং পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি পায় মানুষ।
শুনে কাই খুব খুশি। মহাভারত? আই নো মহাভারত। তোমাদের পুরোনো ইতিহাস। দেখো, না জেনে ঠিক জায়গাটাই সিলেক্ট করেছি আমি। এখানেই ক্লাব হোক আমাদের। স্বাধীনতার পর নতুন করে তৈরি হবে তোমাদের দেশ, নতুন ইতিহাসের শুরু। এসো, আমরা স্নান করি এই সঙ্গমে। ধুয়ে যাক পুরোনো সব পাপ। ব্রাহ্মণীর পাড়ে নতুন মহাভারত লিখবো আমরা, এ যুগের নতুন বেদব্যাস।
হৈ হৈ করে শুরু হয়ে গেলো ক্লাব তৈরির কাজ। আপাতত এটাই আমার সাইট, পুরোহিতের সঙ্গে কথা বলে ঐ গুহার ভেতরেই মন্দিরের পাশে আমার থাকার জন্যে একটা জায়গা পরিষ্কার করে নিলাম। কাই প্রায় রোজই একবার করে একটা মহুয়ার বোতল সঙ্গে নিয়ে আসে, কাজ কতটা এগোলো দেখে, বসে বসে বোতলটা শেষ করে চলে যায়। ক্লাবের যা প্ল্যান হয়েছে তাতে কাই ক্লাবেই নিজের থাকার জন্যে ব্যবস্থা করেছে, কন্সট্রাকশন হয়ে গেলে ও ক্লাবেই থাকবে, টেন্টে ফিরবে না আর।
মাস তিনেকের মধ্যেই মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেলো ক্লাবটা। সাহেব তার নিজের জিনিষপত্র নিয়ে এলো, আমাকেও বললো এখানে চলে আসতে। সাহেবের গাড়িতেই ওর সঙ্গে যাতায়াত করতাম, যা রান্না করতাম দুজনেরই হয়ে যেত তাতে। এ ভাবে থাকতে থাকতে কেমন একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেলো দুজনের মধ্যে, অসম বন্ধুত্ব, ও একটা অত বড় ইঞ্জীনিয়ার, কত লোককে চলতে হয় ওর হুকুম মতো, আর আমি একটা সাধারণ কন্ট্র্যাক্টরের আরও সাধারণ কর্মচারী ! নানা গল্প হতো সাহেবের সাথে। কম বয়েসে বাবা মারা গেছে ওর, মা নার্স ছিলো, যে হাসপাতালে কাজ করতো সেকেণ্ড ওয়র্ল্ড ওয়রে সেই হাসপাতাল বোমার আক্রমণে ধ্বংস হয়, ওর মা মারা যায় তাতে। বিয়ে-টিয়ে করেনি, কাজেই দেশে ফেরার অত টান নেই।
কথায় কথায় কাই জিজ্ঞেস করলো একদিন, তোমার কন্ট্র্যাক্টের কাজ ফুরোলে তারপর কী করবে তুমি? এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই, বললাম, জানি না, যা হোক একটা কিছু জুটেই যাবে। কাই বললো পছন্দসই কিছু জোটে তো ভালো, তা না হলে এই ক্লাবটাই দেখাশোনা করতে পার তুমি, এখানকার ম্যানেজার হয়েই থেকে যেতে পার। আমি বললাম, আমি তো শুনেছি তোমরা এসেছো কয়েক বছরের কন্ট্র্যাক্টে, প্লান্ট পুরোপুরি চালু হয়ে গেলে আবার ফিরে যাবে। ক্লাব কী চলবে তারপর? চলবে না কেন, বললো কাই, যে কলোনি তৈরি করছো তুমি জর্মনদের জন্যে, সেই কলোনিতে থাকবে যারা ক্লাবটাও তাদেরই হবে। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো তোমাকে ম্যানেজারের অফিসে বসিয়েই ফিরবো আমি।
এর মধ্যে সাহেব একদিন খোঁজ নিচ্ছিলো আমার ছোটবেলার। এই স্টীল প্লান্টের অঞ্চলে এলাম কোথা থেকে, বাড়ি কোথায়, বাবা-মা কোথায়, ইত্যাদি। ওকে সব খুলে বললাম, খুব মন দিয়ে শুনলো। বললো, বাঃ, খুব ইন্টারেস্টিং পাস্ট তো তোমার, তোমার জন্মস্থানটা দেখতে ইচ্ছে করছে। ভেবেছিলাম কথার কথা। কাই কিন্তু লেগেই রইলো। শেষে একদিন লোকজনকে জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করে ওকে নিয়ে ওর জীপেই পৌঁছোলাম টেনসা। আমাদের গ্রামটা যেখানে, তার থেকে কিছুটা দূরে জীপটা রেখে পৌঁছোলাম আমাদের বাড়িতে। মা আমাকে দেখে খুব খুশি, কিন্তু সাহেবকে দেখে অবাক। ওর চেহারাটাই বিশ্বাস করতে পারছিলো না মা, কোন মানুষকে সত্যি সত্যিই ও রকম দেখতে হতে পারে মা ভাবতেও পারে না। বাবা ছিলো জঙ্গলে। খবর পেয়ে হাজির হলো। আরো বুড়ো দেখতে হয়ে গেছে বাবাকে, কিন্তু কাইয়ের সঙ্গে কথা বলে খুবই খুশি মনে হলো। অনেক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে স্টীল প্লান্টের ব্যাপারে অনেক কিছু জেনে নিলো। বারশুয়াঁতে বাবার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময়ে বাবার মুখে যে কষ্টের ছায়া দেখেছিলাম, মনে হলো সেটা যেন মিলিয়ে গিয়েছে অনেকটা।
ছেলে বাড়ি এসেছে এতদিন পর, সঙ্গে আবার লালমুখো-সোনালি চুল-নীল চোখের এক সাহেব। মা কী যে করবে ভেবে পায় না, কী খাওয়ানো হবে! আমি চলে গেলাম মার কাছে, সাহায্য করতে। একটা মুরগী কেটে রান্না করা হলো, আমার অনুরোধে মহুয়াও নিয়ে এলো বাবা খানিকটা। সাহেব খুব খুশি। খাওয়া-দাওয়ার পর ফেরার পথে রওনা দিলাম আমরা। কিছুটা চলার পর জীপ থেকে নেমে প্রায় ঘন্টাখানেক হাঁটাচলা করলো কাই, এধার-ওধার। কেন যে করলো, কী যে দেখলো, কিছুই বললো না আমাকে। চুপচাপ অনেকক্ষণ গাড়ি চালিয়ে হঠাৎ বললো আমায়, তোমার বাবা মেটালার্জি জানে, কলেজে পড়েছে।
পাহাড়ে বোমা ফাটিয়ে পাথর-টাথর নিয়ে আসতো জর্মন সাহেবদের যে দলটা, কিছুদিন পর দেখলাম তারা মাঝে মাঝে টেনসা যাচ্ছে। এক-আধবার কাইও ওদের সঙ্গে গেলো, আমাকেও নিয়ে গেলো কয়েকবার। যখনই যেতাম বাবা-মার সঙ্গে দেখা করে আসতাম একবার, কাইও যেত মাঝে মাঝে। এ রকমই একবার, বাড়ি গেছি, সেবারটা একা একা, কাই যায়নি, বাড়ির সামনে দেখলাম অচেনা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বছর চোদ্দ-পনের হবে, কুরুখ মেয়ে। আমাকে চেনে না, আমিও চিনি না তাকে। তাকে এড়িয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলাম। আরও দু-তিনটে মেয়ে। একটু পরে মাকে দেখতে পেলাম। আমাকে দেখে হাত নেড়ে মেয়েগুলোকে চলে যেতে বললো মা। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে ভেঙে পড়লো কান্নায়। বাবা নেই। কুরুখদের নিয়ম অনুযায়ী মার সঙ্গে এখন থাকে কয়েকটা মেয়ে। মা আমাকে বললো আর যেন ফিরে না আসি আমি, মা আর বাঙালি নেই, আবার কুরুখ হয়ে গেছে।
পৃথিবীতে এবার আমি পুরোপুরি একা। বাবা নেই, মা থেকেও নেই। ক্লাবেই থাকি, কাজ করি সারাদিন, ফিরে এসে রাত্তিরে আর রান্না করতে ইচ্ছে করে না প্রায়ই। এর মধ্যে জর্মনদের ক্লাব পুরোপুরি চালু হয়ে গেছে; রান্নার জন্যে, অন্যান্য কাজ করার জন্যে, লোকজন এসেছে কয়েকজন। আমার বস দরবেশ শাহ্ই জোগাড় করে দিয়েছে তাদের। রান্নাঘরে যে কাজ করে সে বাঙালি, তার বাড়ি মেদনীপুরে, চৈতন্য পণ্ডা। তার স্ত্রী নেই, একটি মেয়ে, নাম সাবিত্রী, সে-ও মাঝে মাঝে এসে সাহায্য করে বাবাকে। বাবা-মেয়ে দুজনেরই খুব ভাব শিব মন্দিরের পুরোহিতের সঙ্গে, যখন কাজ থাকে না মন্দিরে বসে গল্প করে ওরা।
সাবিত্রী? মানে মা? – জিজ্ঞাসা করলো জয়ি।
হ্যাঁ, তোর মা-ই, শোন্ পুরোটা।
ঐ পুরোহিতই একদিন ডাকলো আমাকে। বললো, তোমার তো কেউ নেই, সারাদিন খাটো, রাত্তিরে ফিরে হাত পুড়িয়ে রান্না করে খাও। সাবিত্রীকে কেন বিয়ে করে নাও না তুমি, ওর বাপ তো তোমারও বাপ হবে। বিপদে আপদে পাশে দাঁড়াবার লোক পাবে একজন। পৃথিবীতে কি একা একা থাকতে পারে কেউ?
কোথা থেকে শুনে কাইও আমাকে বললো একদিন একই কথা। বেশি আর মাথা ঘামালাম না। বলে দিলাম রাজি।
রাজি? – বললো জয়ি, তার মানে ঐ রকম করেই বিয়ে হয়ে গেলো তোমার আর মার? কোন উৎসব হলো না?
নাঃ, উৎসব আর কী, ঐ পুরোহিতই বিয়ে দিয়ে দিলো, কাই পার্টি দিলো ক্লাবে, বিয়ে খতম! ক্লাবে যে ঘরটায় আমি থাকতাম, সেখানেই তোর মা-ও থাকতে শুরু করলো। দু বছর পর তুইও এলি।
আর ভাই?
হুঁ, ভাই! একটু থামলো হেমন্ত। উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙলো সে। বাথরূমের দিকে গেলো, কী ভেবে ফিরে এলো আবার। ঘরের কোনায় ছোট টিপাইটার উপর একটা স্টীলের গ্লাস ছিলো, সেটায় জল ভরে নিয়ে এসে খেলো খানিকটা, জয়িকে বললো তারপর: ভাই, মানে বোন্টি, তাই তো? আচ্ছা, তোর, তোর অন্য ভাইবোন, আর বোন্টির মধ্যে তফাৎ কী বল্ তো?
তফাৎ আর কী, ওর একটা ভালো নাম নেই, আর ওকে দেখতে আমাদের চেয়ে একটু ভালো, চুলটা কেমন সোনালি।
হুঁ, তুই হওয়ার পর দু বছর বাদে যখন ও এলো ওকে দেখে অবাক হলাম আমি। চুলের রংটা দেখে ভালো লাগলো না। কাই খুব খুশি ওকে দেখে, মাথার চুলে বিলি কেটে দিয়ে বললো, ও, ব্লোন্ট, লাভলি ! উই উইল কল হিম ব্লোন্টি। সেই ব্লোন্টিই বোন্টি হয়ে গেছে, ভালো নাম দেওয়া হয়নি আর। আমাকে বললো, হেমন্ত, আই উইল অ্যাডপ্ট ব্লোন্টি, ফেরার সময় জর্মনীতে নিয়ে যাবো ওকে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে হেমন্ত। তারপর তার দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে পরের কথাগুলো। নিশ্বাস পড়তে থাকে ঘন ঘন, কেমন ভয় ভয় করে জয়ির। তারপর থেকে পরপর চারটে বাচ্চা হয়েছে তোর মার। সব কটা কালো, কুরুখের রক্ত সব কটার গায়ে!
খুব ভালো লাগছে। খানিকটা খানিকটা জায়গাটা চিনতে পারছি। অপেক্ষায় আছি। অনেকদিন পরে একটা বহুমাত্রিক ভাঙাগড়ার আখ্যান শুনছি--পুরাণকথার মত।
হেমন্তর মার হেমন্তকে বাঙালি করে বড় করার সিদ্ধান্তটা খুব সহজে সেরে দিলেন লেখক। এটা নিশ্চয় সহজ সিদ্ধান্ত নয়, না তার পক্ষে না কুরুখ সমাজের পক্ষে। আবার যদি সহজ হয়েও থাকে তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। মনে হয় নিছক প্লটের প্রয়োজনে এটা করা হল।
অতদিন আগে জর্মন সাহেবের মুখে "হিউম্যান রিসোর্স" কথাটা কানে বাজে।
গল্প এগিয়ে চলেছে দুর্দম গতিতে