রীতি মতন ব্যাণ্ডপার্টি নিয়ে মিছিল।
তাসা আর ব্যাগপাইপ নিয়ে একদল লোক রঙীন পোশাকে দু সারে লাইন দিয়ে, আর তাদের মাঝখানে ঊর্ধ্বমুখে সানাই বাজাতে বাজাতে তাদের দলনেতা। মিছিলের একেবারে সামনে দুজন ধরে আছে একটা ব্যানার, যাতে লেখা শুধু পাঁচ অক্ষরের একটা শব্দ: শিল্পসম্রাট। ব্যানারের ঠিক পেছনেই এক-মুখ-দাড়ি এক প্রায়-চল্লিশ যুবক মোটা ফুলের মালা গলায় হাঁটছে, কে শিল্পসম্রাট বোঝার কোন অসুবিধে নেই। এই মিছিলের ঠিক পিছনেই একটা হূড-খোলা জীপে একরাশ ছবি: ক্যানভাসে, কাগজে, মাউন্ট করা কোনটা, কোনটা আঠা দিয়ে বোর্ডের ওপর জুড়ে দেওয়া। একটা বাঁশ আর একটা বাঁশের তৈরি মই হেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জীপের ভেতরেই। মিছিলটা আসছে ধর্মতলার দিক থেকে। শনিবারের বিকেল, চৌরঙ্গি রোডে মানুষের অভাব নেই। কৌতূহলী যারা, এই আশ্চর্য মিছিলের দিকে তারা তাকায় ; কেউ কেউ শিল্পসম্রাটকে চিনতেও পারে, দশ-পনের বছর আগে মিউজিয়মের রেলিঙে ছবির প্রদর্শনী এ-ই করেছিলো না?
কয়েকটা শনিবার ধরেই ময়দানে একটা মেলা চলছে, মুক্তমেলা। কর্পোরেশনের পাওনা মিটিয়ে, জমির ইজারা নিয়ে, পুলিশের অনুমতি-টতির ব্যবস্থা করা মেলা নয়; শনিবার বিকেলের মুখে চলে আসে একদল পাগলাটে লোক, কেউ কবিতা পড়ে, গান গায় কেউ, হঠাৎ শুরু হয়ে যায় একটা নাটক, পথনাটিকা যাকে বলে কেউ কেউ। ঘাসের ওপর বসে ছবি আঁকে অনেকে, বিক্কিরিও হয়ে যায় কিছু। পোট্রেটের বেশ চাহিদা, অল্প খরচে নিজের ছবি আঁকিয়ে নিতে খারাপ লাগে না; এটা চলছে গত কয়েক বছর ধরেই, মার্কেট স্কোয়ারের ওপ্ন্ এয়ারের পর থেকেই ! গত শনিবার একটা চ্যাংড়া মেয়ে জামা খুলে আবক্ষ ছবি আঁকানোর মতলবে ছিলো, মেলার সংগঠকদের একজন – অবিশ্যি সংগঠক যে কে তা-ও বোঝা যায় না ঠিক ঠিক মতো – তাকে এবং তার শিল্পীকে জোর কোরে সরিয়ে দিয়েছে। তারা যাওয়ার সময় দেখে নেবে বলে শাসিয়ে গেছে।
শিল্পসম্রাটের নাম প্রকাশ কর্মকার। সে মিছিল সমেত মুক্তমেলার প্রাঙ্গণে ঢোকার সাথে সাথেই প্রায় জয়ধ্বনি। মিনিট দশেক মাত্র সময় লাগলো প্রদর্শনীটা সাজিয়ে ফেলতে। যে ব্যানারে শিল্পসম্রাট লেখা ছিলো দেখা গেলো সেটা ভাঁজ করা। ভাঁজ খুলতেই ব্যানারের অপর পিঠে দেখা গেলো একটা ছবি, প্রকাশ কর্মকারের অধুনা-বহুআলোচিত অ্যাক্রিলিকের কাজ। মনোরম এক দৃশ্য। বাঁশের আগায় সেটা লাগিয়ে বাঁশটা পুঁতে দেওয়া হলো: প্রদর্শনীধ্বজা ! যে মইটা ছিলো জীপে, ধ্বজার ঠিক নীচেই কয়েকটা ইঁট সাজিয়ে সেটাকে লম্বালম্বি করে খাড়া শুইয়ে দেওয়া হলো ঘাসের ওপর, আর সেটাকে ভর করে মাটির ওপর দাঁড়িয়ে রইলো গোটা পনেরো ছবি। প্রদর্শনী !
প্রদর্শনী ঘিরে বেশ উত্তেজনা, মোটামুটি জটলা, এমন সময় প্রদর্শনীর পাশেই একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে হঠাৎ একটা মেয়েকে দেখা গেলো উত্তেজিত কণ্ঠে কিছু বলতে: এ আর্ট নয়, অনুকরণ আর টেকনিক। এত রং কেন, রং চাই না। এ টেকনিক শুধু চোখ ভোলানো, মন ভোলানো নয়। কোথায় গেলো এই শিল্পসম্রাটের সেই সব ছবি যাতে যন্ত্রণার চিহ্ণ ছিলো? কোথায় গেলো পথঘাটের মানুষ? এবার ছবি আঁকার আগে শিল্পসম্রাটকে নতুন করে শিখতে হবে, জঙ্গলে যেতে হবে, শিখতে হবে জঙ্গলের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত শিল্পের কাছ থেকে......
ধীরে ধীরে ভীড় জমছে বেশ, গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, মেয়েটি কে? কে একজন বলে উঠলো, হ্যাঁ হ্যাঁ, চিনি তো, এ তো জয়মালিকা, তারপর হঠাৎই সবাইকে সচকিত করে একটা শ্লোগান শোনা গেলো, প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা বন্ধ হোক্, তিন-চারজন জবাবও দিলো বন্ধ হোক্ বন্ধ হোক্ বলে, জয়মালিকা একটু থেমে শ্লোগানরত ছেলেদের দিকে তাকালো, তারপর উচ্চকিত ধ্বনি শোনা গেলো আবার, আর্ট কলেজে আগুন জ্বালো, প্রতিধ্বনি শোনা গেলো আগুন জ্বালো আগুন জ্বালো, আবার ধ্বনি, ড্রয়িং রূমের রঙীন ছবি চাই না, সঙ্গে প্রতিধ্বনি চাই না চাই না, আর তারপরেই সব কণ্ঠস্বরকে ছাপিয়ে কয়েকটি পুরুষকণ্ঠের উচ্চগ্রাম শ্লোগান, নকশালবাড়ি লাল সেলাম, সি-আই-এর দালালদের অপসংস্কৃতি বন্ধ হোক্, মুক্তমেলা ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও......
জয়মালিকাও যেন খানিকটা হতচকিত; মার মার, ভেঙে দে, ছিঁড়ে ফেল্ শব্দগুলো ঘুরে ফিরে আসছে, কিছু মানুষ দৌড়োচ্ছে, তাদের পেছনে পেছনে ধর্ ধর্ আওয়াজ তুলে তাড়া করছে আর একদল, তিনটে ছবি আছড়িয়ে ভেঙে দিলো যেন কারা, গুটি গুটি ফিরে যাচ্ছে কিছু মানুষ যারা শুধুই কৌতূহলী দর্শক বা শ্রোতা হিসেবে এসেছিলো। মেলার মাঠের একধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো জয়মালিকা, চোখে জল তার, কিন্তু কেউ যেন লক্ষ্যই করলো না তাকে।
মুক্তমেলা শুনশান হয়ে যেতে সময় লাগলো না বেশি। কেমন একটা হতাশ, পরাজিত মন নিয়ে হাঁটতে থাকে জয়মালিকা ক্যামাক স্ট্রীটের দিকে, যেখানে তার গেস্ট হাউজ। এই লোকগুলো কারা, যাদের হাতে অবলীলায় চলে গেলো ওর প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর ! আর তা ছাড়া, প্রতিবাদ কিসের, কিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলো সে? প্রকাশ কর্মকারকে সোডা ফাউন্টেনে দেখেছে সে, যদিও আলাপ হয়নি তার সাথে। যখনই দেখা যায় তাঁকে, তাঁকে ঘিরে থাকে অগণিত বন্ধু আর গুণগ্রাহীরা। জয়মালিকা শুনেছে তিনি আর্ট কলেজের পাঠ শেষ করেননি। কিন্তু শেষ না করেও তিনি ভালোই এঁকেছেন, ছবি এঁকে পেটও চালিয়েছেন – শুধু নিজের নয়, সংসারের অনেকের ! তারপর আবার নতুন করে শিখেছেন এখানে-ওখানে, বিদেশেও গেছেন। ছবি আঁকা না শিখেও জয়মালিকাও তো ছবিই আঁকছিলো, লোকে তো বলে না মন্দ আঁকছিলো সে; এখন তাকেও আবার শিখতে হবে প্রথা অনুযায়ী ! স্কুলে পড়ার সময় যে ছবি সে আঁকতো, মিসেস পাণ্ডে বলেছিলেন তিনি সংশোধন করতে গেলে সে ছবি খারাপ হয়ে যেত নাকি ! তাহলে? তবে কেন প্রথাগত শিক্ষা? গণেশদা স্পষ্ট কোরে তাকে কলেজে ভর্তি হয়ে শিখতে বলেননি ঠিকই, কিন্তু এ রকম একটা ইঙ্গিত কী ছিলো না তাঁর কথায়? বিকাশদা তো জোর কোরে ভর্তিই করে দিলো নিজের কলেজে, কিন্তু ভালো লাগে না তার, ভালো লাগে না তার কলেজে যেতে। সবই তার মনে হয় নিয়ম রক্ষার পড়াশোনা, নিয়ম রক্ষার অভ্যাস ! এই যে ন্যুড স্টাডি করে তারা, যে মেয়েরা আসে, হাড়ের ওপর চামড়া ছাড়া কী আছে তাদের শরীরে, কী স্টাডি করবে ওরা তাদের এঁকে? আর তা ছাড়া এত টেকনিক, আউটলাইন থেকে রঙ চাপানো পর্যন্ত সবই তো টেকনিকে ভরা। অথচ, সব কিছু শিখে-টিখে যখন নিজেরা ছবি আঁকেন এখন যারা নাম করেছেন, কতজন কলেজে শেখা টেকনিক ব্যবহার করেন ! তা হলে টেকনিক শিখে সময় নষ্ট করবো কেন !
সময় ! এই সময় জয়মালিকার কাছে বড় দামি। দু বছর তো এই কলেজেই সময় নষ্ট হয়ে গেলো তার, বিকাশদার কথা শুনে। শুনছে বিকাশদাও নাকি ছেড়ে দেবে, সরকারি কলেজে জয়েন করবে নাকি। কিন্তু জয়মালিকার তো সময় নেই, সে অপেক্ষা করতে চায় না। সে শুধু চায় আরও বেশি বেশি লোক তার ছবি দেখুক। মিসেস পাণ্ডে সেই স্কুলের সময়েই বলেছিলেন সে আঁকে অন্য সবায়ের মতো নয়, ঠিক নিজের মতো কোরে। তার মানে তার নিজের স্টাইল তো তৈরি হয়েই গেছে, তাহলে আর কেন কলেজে যাওয়া !
জয়মালিকা ভেবেছিলো অন্তত একজন তাকে ঠিক ঠিক বুঝবে। তাই শক্তিদার সমর্থন চেয়েছিলো ও। কিন্তু শক্তিদা, শক্তিদার মতো মানুষও, ঐ বিকাশদার মতোই কথা বললো। সব আর্টেই অনুশীলন করতে হয় রে জয়ি, কঠোর অনুশীলন, বলেছিলো শক্তিদা। কিন্তু কেন? কেন সবাইকেই অনুশীলন করতে হবে?
এই কথাটাই জয়মালিকা আজ মুক্তমেলার সব দর্শকের মাঝে বলতে চেয়েছিলো। মুক্তমেলা তো ! সকলেরই তো অধিকার সেখানে কথা বলার ! কিন্তু কিসের থেকে কী হয়ে গেলো ! কারা ওরা, জয়মালিকার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলো মুক্তমেলা !
অবিশ্যি মনে মনে আরও একটা কথা জানে সে। বেশ কয়েক বছর তার হয়ে গেলো কলকাতায়। কফি হাউজে, খালাসিটোলায়, সোডা ফাউন্টেনে, সব জায়গায় সে লক্ষ্য করেছে নতুন, বেপরোয়া কথার চমক। কেউ-বলে-না এমন কিছু একটা বলে দাও, সবাই চিনে যাবে তোমাকে। সবাই যে তোমার সাথে একমত হবে, সবাই যে তোমার কথা মেনে নেবে, এমনটা নয়, কিন্তু চিনে যাবে তোমাকে সবাই। আর পরিচিতির সুবিধে যে কী, তা জয়মালিকার চেয়ে বেশি কে-ই বা জানে আজ ! এত তো দেখছে কলকাতায়, কটা লিট্ল্ ম্যাগাজিন নিয়ম কোরে ঠিক ঠিক মতো বেরোয়? কলকাতা থেকে এতদূরে থাকে সে, সেখান থেকে তারা শাম্ব বের করে, কখনও একটা সংখ্যাও অনিয়মিত হয়েছে শাম্ব? নিয়মিত বিজ্ঞাপন পেয়েছে তারা, কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ-ছবি যা চেয়েছে পেয়েছে নিয়মিত, সে কিসের জোরে? তুলিকা-সুজয়-অনলাভ-জুঁই-শ্যামলিমা-অরুণিমা যাকেই জিজ্ঞাসা করো সবাই এক বাক্যে বলবে জয়ির পরিচয়ের এই জোর না থাকলে কোন মতেই সম্ভব হতো না এটা। নিজের মনের সাথেই কথা বলে জয়মালিকা। একটু চমক তৈরি করেই না পরিচয়ের বৃত্তটা আর একটু বাড়াতে চাইছিলো সে !
পরিচয় ! আর একটু স্বীকৃতি ! মার্কেট স্কোয়ারের এগজিবিশনের আগে ছবি-আঁকিয়ে কজনই বা চিনতো
জয়মালিকাকে ! তারপর সাহস করে সোডা ফাউন্টেনে যেতে শুরু করলো যখন, এক এক করে কতজনের সাথেই তো পরিচয় হলো তার। কিন্তু প্রকাশ কর্মকারের ধারে কাছেও যেতে পারছিলো না সে। অথচ এই প্রকাশ কর্মকার, সে শুনেছে, দারিদ্রের সাথে – আর শুধু দারিদ্রের সাথেই বা কেন, এমনকি গুণ্ডা-বদমায়েশের সাথেও – লড়াই করেও ছবি আঁকা বন্ধ করেননি। সে শুনেছে প্রকাশ কর্মকার ফুটপাথে ছবি বিক্রি করেছেন, সদর স্ট্রীটে মিউজিয়মের রেলিঙে ছবির প্রদর্শনী করেছেন অনেক কম বয়েসে। তাঁর কাজ জয়মালিকা দেখেনি বেশি, কিন্তু এই সব শুনেই একলব্যের গুরুর মতো প্রকাশ কর্মকারকে মনে মনে গুরু ভাবতে শুরু করেছিলো সে। যেমন অতর্কিতে শক্তিদার সাথে আলাপ হয়ে গিয়েছিলো তার, ভেবেছিলো, কে জানে, হয়তো সে ভাবেই প্রকাশ কর্মকারের সাথেও আলাপ হয়ে যাবে একদিন। প্রকাশ কর্মকারকে সব সময় ঘিরে থাকে কত যে মানুষ, জয়ি ভেবেছিলো মুক্তমেলায় প্রতিবাদ-প্রতিরোধই বোধ হয় তাকে নিয়ে যাবে প্রকাশ কর্মকারের কাছাকাছি। কিন্তু কী ভেবেছিলো আর কী হলো !
জয়মালিকা !
হঠাৎ নিজের নামটা শুনে একটু চমকে ওঠে সে। হাঁটতে হাঁটতে গেস্ট হাউজের প্রায় দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে, কে তার নাম ধরে ডাকলো এখন? পেছন ফিরে দেখে সুদেশ।
তোমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি।
কতক্ষণ? কেন দাঁড়িয়ে আছো?
বেশিক্ষণ নয়। মুক্তমেলা থেকে তুমি যখন বেরোলে আমিও বেরোলাম তখনই। তুমি আস্তে হাঁটছিলে, আমি হাঁটলাম জোরে। তাই তোমার চেয়ে একটু আগেই পৌঁছেছি আমি। বসবে?
তাই ভাবছি। কোথায় বসা যায়, গেস্ট হাউজে তো অ্যালাউ করবে না।
চাইনিজ খাবে? চলো, জিমিজ কিচেন পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে যাই, তারপর তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমি চলে যাবো।
আমার আজ মন একটুও ভালো নেই সুদেশদা, খেতেও ভালো লাগবে না।
মন ভালো নেই সে তো আমি জানি। চলো, খেতে খেতে মন ভালো হয়ে যাবে।
তুমি ছাড়া আমার আর কোন বন্ধু নেই কলকাতায়। চলো।
সোমবার সন্ধ্যের মুখে খালাসিটোলায় ঢুকলো জয়ি। খুঁজছিলো কমলদাকে, পেয়েও গেলো অনেকের মধ্যে। এসো বালিকা, বললেন কমলকুমার মজুমদার, মুক্তমেলায় নাকি খ্যাতির চূড়া আরোহণ করেছো; দেখো, হঠাৎ পদস্খলন না হয় !
জয়ি বুঝলো খবরটা রটে গেছে, বললো, পদস্খলন তো হয়েই গেছে কমলদা, উঠতে আর পারলাম কোথায়?
তোমার পদস্খলন ! আরে রামোঃ ! তোমার তো শীর্ষস্তরেই বসবাস। এই যে এখানে বসে আছো, কেউ দেখাক দেখি তোমার মতো আর একডা মাইয়ারে এতগুলান পুরুষের মধ্যে বসে সন্ধ্যেবেলায় খালাসিটোলায় কালী পূজা করে ! তা হলোটা কী সে দিন, করেছিলেটা কী?
প্রকাশ কর্মকার নিজেকে শিল্পসম্রাট ঘোষণা কোরে মুক্তমেলায় প্রদর্শনী করছিলেন, আমি আপত্তি করেছিলাম।
আপত্তি করেছিলে? কেন, নিজে করবে বলে?
আপনি মজা করছেন কমলদা।
আরে মজা নয়, মজা নয়। নিজেকে শিল্পসম্রাট ঘোষণা করার মতো বুকের পাটা যে গুটিকয়েকের আছে এই কলকাতা শহরে, তাদের মধ্যে তুমি পড়ো। বিকাশ বা ওই গণেশ-টণেশ – মানে ঐ দুই গণেশের কথাই কই – কারোর নেই সে সাহস ! তা হলোটা কী? প্রকাশের ছবি কী তোমার না-পসন্দ্?
প্রকাশ কর্মকারের এখনকার ছবি তো সব ব্যাকরণ-মানা টেকনিক-সর্বস্ব। ওতে প্রাণ কই?
এটা তর্কসাপেক্ষ। প্রাণ অবিশ্যি তুমি যদি না পেয়ে থাকো, তাহলে প্রাণ নেই। অন্তত তোমার কাছে নেই। কিন্তু সে কথা থাক এখন। তোমার আপত্তি কোথায়, ব্যাকরণে? ব্যাকরণ না মেনে হাঁসজারু তৈরি করতে চাও? হাঁসজারু তৈরি করাটা সহজ, কারণ ওতে ব্যাকরণ লাগে না, আর ব্যাকরণ মানতে গেলে হাঁস অথবা সজারুর এমন একটা সমার্থক শব্দ খুঁজে বের করতে হয় যেখানে হাঁসের শেষটায় অথবা সজারুর গোড়াটায় এমন একটা স্বর বা ধ্বনি আসবে যাতে ব্যাকরণের নিয়ম মেনেও তাদের জোড়া লাগানো যায় ! কাজটা কঠিন, অতএব হাঁসজারু !
কিন্তু আপনার গদ্যে তো কতো জায়গায় আপনি ব্যাকরণ না মেনেই লিখেছেন !
আর একটু পান করো বালিকা, আরও দু ঢোক গিলে নাও, বলেন কমলদা, বোঝা যাচ্ছে অন্তত আমার ছবি তুমি বিশেষ দেখোনি, কিন্তু আমার গদ্যে ব্যাকরণের ভুল খুঁজতে যেও না। অসমাপিকা ক্রিয়া সংযুক্ত বাক্যসমূহ হয়তো তোমাকে বিহ্বল করে থাকতে পারে খানিকটা, কিন্তু ওটা বুঝতে গেলে বাংলা গদ্যের আধুনিকতার মোড়, মানে জাংশন স্টেশনটায়, পৌঁছোতে হবে তোমাকে। কিছু বুঝলে? সেই ইস্টিশানটায় দাঁড়িয়েছিলো বেম্মরা, রামমোহনের সময় থেকে। তারপর সেই যে ভুল রেলগাড়িতে চড়িয়ে দিলো ওরা বাঙালিকে, সেই থেকে রবিবাবু পেরিয়ে কল্লোল-কালিকলম হয়ে এই কিত্তিবাস ইস্তক কেউ আর নামতেই চায়না সেই গাড়ি থেকে ! ঠিক গাড়িতে চড়লে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক চেহারাটা অন্যরকমের হতো। তুমি যেটাকে ভুল ব্যাকরণ ভেবে ভুল করছো, শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে ওটাই নিয়ম ! নিয়তিকৃত নিয়মকে রহিত করেই রসসৃষ্টি হয়, বুঝলি ছুঁড়ি? কিন্তু নিয়মটা না শিখলে রহিত করবি কী করে? তারা-ব্রহ্মময়ী-ঠাকুর রামকৃষ্ণের – আর ওঁদের যদি না মানিস – তোর-আমার রিখিয়ার কিরে, কমল হবার চেষ্টা করিস না, জাল কমল হয়ে যাবি। হাটে বিকোবে না।
আমি কমল হবার চেষ্টা করিনি, সে সাধ্য আমার নেই; কিন্তু ঐ যে মোড়টার কথা আপনি বললেন সেখানেই যাবার চেষ্টা করছিলাম। ছবি এঁকে।
আরে ছবির কথা আলাদা। বেম্মদের গা-বাঁচানো পিউরিটান চোখ ছবির দিকে টানেনি ওদের। গোড়ার দিকে কটা বেম্মই বা ছবি এঁকেছে বল্। শোন্, সত্যিই যদি ভালো কাজ করতে চাস, মেলা বকবক না করে অভ্যেস কর্। ছবি আঁক্ আর ছবি দেখ্। তারপর এস্টাইলের কথা ভাবিস। কমল মজুমদারকে সাক্ষী মেনে শুধু অসম্পূর্ণ লাইনেই ছবি এঁকে যাবো, এ হয় না ! অসম্পূর্ণ লাইন আর অসমাপিকা ক্রিয়া এক কথা হলো না। তোকে একটা গল্প বলি শোন। জর্জবাবুকে চিনিস?
জর্জবাবু?
জর্জ বিশ্বাস রে, দেবব্রত বিশ্বাস নামে খ্যাত।
চিনি না, তবে গান তো শুনেইছি।
কোন একটা কোথাও একটা ছেলেকে গান গাইতে শুনে খুব খুশি জর্জবাবু। ছেলেটাকে বললো, আমার বাড়িতে আসিস, তোকে গান শেখাবো। দেবব্রত বিশ্বাস নিজের থেকে গান শেখাতে চেয়েছে, আর কে পায় তাকে ! শেখা হলো গান কয়েক মাস, খুব নাম ডাক তার। তারপর রেকর্ড বের কোরে ফেললো কয়েকটা, খুব চললো সেগুলো। তারপর, হঠাৎ একদিন কে যেন জর্জকে বললো অমুক ছেলেটা যা গাইছে না, ঠিক আপনার মতো ! জর্জ এত নামডাকের খবর রাখে না, লোকটার কাছেই ওর রেকর্ডের গান শুনলো। কিছু বললো না। পরের দিন ছেলেটা যখন গান শিখতে এসেছে, জর্জ বললো, যাও, আর শিখে কাজ নেই তোমার, আমারে ভ্যাঙাও, এত সাহস ! বুঝলে জয়মালিকা, ভ্যাঙাতে যেও না কাউকে।
খালাসিটোলা থেকে বেরোলো যখন তখন প্রায় টলছে জয়মালিকা। যদিও ভয়-ডর ওর বিশেষ নেই, তবুও, রাস্তাঘাটে লোকজন কম, একা একা ট্যাক্সি কোরে এখান থেকে ক্যামাক স্ট্রীট যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা ভাবছে যখন ও, পেছন থেকে গম্ভীর মুখে এসে দাঁড়ালো সুদেশ। বললো, চলো, একটুখানি হাঁটি, তারপর ট্যাক্সি ধরবো।
তুমি কোথা থেকে এলে, এই সময়, এখানে?
এখানেই ছিলাম। তুমি আজ বেহেড হবে জানাই ছিলো। হাত ধরো আমার।
সুদেশের হাত ধরে এগিয়ে যায় জয়মালিকা। এত ঘনিষ্ঠ আগে কখনও হয়নি সুদেশের সাথে। কৃতজ্ঞতায় ভরে যায় ওর বুক। সুদেশ বলে, ভালো হাওয়া আছে আজ, চলো হাঁটতে হাঁটতেই যাই আমরা, খানিকটা হাঁটলে শরীর ভালো লাগবে তোমার, ক্যামাক স্ট্রীট এমন কিছু দূর নয়।
চলো। নিঃশব্দে এগিয়ে যায় দুজন।
পড়ছি।
মুক্তমনায , সম্ভবত: দ্বিতীয় দিন , ছবি ছিঁড়ে দেওয়ায় প্রকাশ কর্মকার এর ক্রুদ্ধ মুখ চোখে জল চেহারা মনে পড়ছে।
বৃত্ত ফিরে পেয়ে আপ্লুত। পড়লাম