পাহাড়ি খাড়িয়াদের একটা ছোট গ্রাম। মাত্র গোটা তিরিশ পরিবার, সাকুল্যে একশো জনও হবে না নারী-পুরুষ-শিশু মিলিয়ে। এখানেই কয়েকদিন থেকে গেলো জয়ি।
স্টীল প্লান্টটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে মিনিট দশেক হাঁটলে শহরের প্রধান বাজার, আর এখান থেকেই আসলে শহরটার শুরু। একটা পার্ক ছিলোই এখানে, শহর পত্তনের গোড়ার দিকেই করা হয়েছিলো; বাগান, ঝর্ণা, ছোটদের খেলার জায়গা আর বড় বড় গাছের নীচে বসার জায়গা মিলিয়ে পার্কটা এই শহরের একটা প্রধান আকর্ষণ। পাবলিক রিলেশনস ডিপার্টমেন্টটা চালু হওয়ার পর থেকে পার্কটা এই ডিপার্টমেন্টেরই দায়িত্ব। মালি যে আছে সে প্লান্টেরই কর্মচারি, কিন্তু যাদের নিয়ে সে কাজ করে তারা ঠিকেদারের লোক। উপাধ্যায় সাহেব জয়িকে দায়িত্ব দিয়েছেন পার্কটা দেখাশোনার, সেই সূত্রে প্রায় রোজই একবার চলে আসে ও এখানে হাঁটতে হাঁটতে, আর কোদাল-খুরপি হাতে ঠিকেদারের যে লোকরা কাজ করে এখানে, তাদের সাথে গল্প করে। এ ভাবেই জয়ির বন্ধুত্ব হয়ে গেলো চোরোর সাথে। জয়ি ভেবেছিলো সে সাঁওতাল বা মুণ্ডা। কিন্তু চোরো বলেছে ও খাড়িয়া – পাহাড়ি খাড়িয়া।
বেঁটে-খাটো রোগাপাতলা ছেলেটা সবায়ের চেয়ে বেশি কাজ করে, আর অনেক পরিশ্রমের পর যখন প্রথম কুঁড়িটা থেকে একটা ফুল ফোটে তখন আনন্দে প্রায় পাগল হয়ে যায়। গত বছর বর্ষার শেষে একটা জায়গা গোল কোরে ঘিরে সেখানে কয়েকটা কলমের গাছ লাগিয়ে দিয়েছিলো মালি, পাতাগুলো অনেকটা কলা গাছের পাতার মতো দেখতে, চোরোকে দায়িত্ব দিয়েছিলো তলার জমিটা পরিষ্কার রাখার। কী গাছ, কেমন ফুল, এ সব প্রশ্নের কোন উত্তর দেয়নি, শুধু মুখ টিপে হেসেছিলো একটু। এ বছর শীতের শেষে, যখন ঠাণ্ডাটা অনেকটাই কমে গেছে, প্রায় বসন্ত জাগ্রত দ্বারে, পার্কের ভেতরে, বাইরের রাস্তায়, দূরের জঙ্গলে লাল রঙের ছড়াছড়ি, তখন ঐ গাছগুলোর মধ্যেই একটাতে দুটো ফুল দেখা গেলো। লাল ফুল, কিন্তু কী আশ্চর্য চেহারা! একেবারে ছোট একটা লাল রঙের পাখি, হলুদ ঠোঁট। মালি দেখে বললো, আগেই এসে গেছে, আরও মাস দুয়েক সময় লাগবে সব ফুলগুলো ফুটতে। নাম বললো বার্ড অব
প্যারাডাইস !
জয়ির আসতে আসতে বিকেল হয়ে যায়। চোরো যেন অপেক্ষা করছিলো জয়ির জন্যে। পার্কে ঢুকতে না ঢুকতেই দৌড়িয়ে জয়ির সামনে, তারপর তাকে ডেকে নিয়ে এলো ফুল দুটোর কাছে, নামও বলে দিলো, বার্ড অব প্যারাডাইস ! আর তারপর যা বললো, শুনে জয়ি তো অবাক ! ফুলটা আসলে পাখি একটা, আমারই মতো।
তোমারই মতো? তুমি কী পাখি নাকি?
পাখিই তো। ছোটবেলায় খুব রোগা ছিলাম, একদম ছোটখাটো চেহারা, তাই মা আদর করে আমার নাম দিয়েছিলো চোরো। চোরো মানে কী, তা জানো? চড়াই পাখি। ঘটা করে আসল যে নামটা রাখা হয়েছিলো, যেটা দিয়েছিলো
ধাই-মা, সেটা তো সবাই ভুলেই গেছে।
আসল নামটা কী?
হেমাল।
চোরোটাই তোমার পছন্দ?
লাজুক হেসে চোরো বললো, এতটুকু ছোট চড়াই পাখিকে মা কষ্ট কোরে প্রায় শালিখের মতো বড় করেছে। এখন জঙ্গলের বাইরে শহরে এসে কাজ কোরে টাকা আয় করছি। ছোটবেলায় সবাই ভেবেছিলো মরেই যাবো। শুধু মার ভালোবাসায় বেঁচে গেছি। নামটাকে ভালোবাসবো না?
নানা গল্প হয় জয়ির সাথে চোরোর। ওদের গ্রামটা যেখানে তার আশপাশে আর মানুষজন নেই। জঙ্গলে কাজের জন্যে কুলির প্রয়োজন হয়, তাই গোটা তিরিশ পাহাড়ি খাড়িয়া পরিবারকে গভীর জঙ্গলের ভেতর ডেকে নিয়ে এসে বসিয়েছে জঙ্গলের বাবুরা। ওরা তো জঙ্গলেই থাকে, জঙ্গলই ওদের বাড়ি-ঘর, কিন্তু প্রায়ই জঙ্গলের বাবুরা ওদের তাড়িয়ে দেয়। কখনো কখনো জঙ্গলের শেষে খানিকটা জায়গা পরিষ্কার কোরে ওদের বলে, চাষবাস করো। কিন্তু চাষ ওদের ভালো লাগে না। জঙ্গলে যা আছে, পশুপাখি-পতঙ্গ-পিপীলিকা, ফল-মূল-কন্দ, ঝর্ণার ছোট ছোট মাছ, এ সবেই ওদের চলে যায়। কাজেই জঙ্গলের বাবুদের ডাকে ওরা খুশিমনেই এসেছে। এখন ছেলেমেয়েরা বড়ো হচ্ছে, তাই ওদের মধ্যে কেউ কেউ শহরে এসে কাজ করছে। গ্রামটা বেশি বড়ো হয়ে গেলে বাবুরা এমনিতেই তাড়িয়ে দেবে, আগের থেকেই ওরা এই সব ভেবে কোন কোন ছেলেকে বাইরে পাঠাচ্ছে কাজ করতে। এই রোগা ছেলেটা, চোরো, ও-ও একদিন বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারবে কে ভেবেছিলো !
তুমি গ্রামে যাও না কখনো? – জিজ্ঞেস করে জয়ি।
যাই তো, মাকে দেখতে ইচ্ছে করলেই যাবো।
কবে যাবে এবার?
যাওয়ার সময় তো হয়ে এলো। ফাগু আসছে সামনেই, গিরিবাবুকে বলেছি তো, যেদিন ছাড়বে সেদিনই যাবো।
গিরিবাবু ঠিকেদারের নাম। জয়ি বললো, গিরিবাবুকে আমি বলে দেবো, আমায় নিয়ে যাবে?
তুমি যাবে দিদি? সত্যি যাবে? থাকতে পারবে আমাদের বাড়িতে?
তোমরা থাকতে দিলেই থাকতে পারবো।
দশদিনের ছুটি নিয়ে সত্যি সত্যিই চোরোর সাথে রওনা দিলো জয়ি ওদের গ্রামের উদ্দেশে। চোরোর একটা ছোট বোন আছে, তার নাম বাদালি, বছর বারো-তেরো বয়েস, এ ছাড়া বাবা আর মা। সবায়ের জন্যে জামাকাপড় কিনলো জয়ি, কেনবার সময় চোরোকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলো দোকানে, পছন্দ করালো তাকে দিয়েই, আর চোরোকে কিনে দিলো একজোড়া জুতো, ওর পছন্দের। জয়ির সঙ্গে একটা কিট-ব্যাগ গোছের, তাতে নিজের প্রয়োজনীয় টুকিটাকি, সামান্য জামাকাপড়, ছবি আঁকার সরঞ্জাম আর মাসখানেক আগে কেনা একটা ক্যানন ক্যামেরা, গোটাকয়েক ফিল্মের রোল সমেত। একটা বড়ো চটের থলি ভর্তি কোরে চোরো কিনলো পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা লঙ্কা, শুকনো লঙ্কা, আলু, বাঁধাকপি আর শুটকি মাছ।
প্রথমে ট্রেনে ঘন্টাদুয়েক, তারপর একটা বাসে বেশ খানিকটা, বাকিটা হেঁটে। এটা রিজার্ভ ফরেস্ট, ঢোকবার মুখে চোরোকে শুধু দুয়েকটা প্রশ্ন করলো উর্দিপরা ফরেস্ট গার্ড, কিন্তু জয়ির পারমিট কোথায়? পারমিটের ব্যপারটা জয়ির জানা ছিলো না, সোজাসুজি কবুল করলো সে কথা। চিন্তিত ফরেস্ট গার্ড ওদের বসিয়ে রেখে ঘন্টা খানেক ঘুরে এলো জঙ্গলের ভেতর থেকে, ফিরলো যখন তখনও তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। ফিরে বললো, বিট অফিসারকে ধরতে পারলাম না। প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে চোরো জিজ্ঞেস করে, কী হবে এখন? ফিরে যেতে হবে দিদিকে? আসলে, পারমিটের ব্যাপারটা সে যে জানতোই না, এটাই পীড়া দিচ্ছে তাকে। দোষটা তারই !
গার্ড জিজ্ঞেস করলো, আই-ডি আছে কিছু? জয়ির সঙ্গে স্টীল প্লান্টের পরিচয়পত্র আছে একটা, দেখিয়ে বললো এতে হবে? পরিচয়পত্রটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো গার্ড, তারপর জয়িকে জিজ্ঞেস করলো, এটা রেখে দিয়ে যেতে পারবেন?
কেন পারবো না, দিন না রেখে।
কার্ডটা রেখে দিলো গার্ড, তারপর চোরোকে বললো, কাল মেমসাহেবকে নিয়ে ঠিক এই সময়ে এখানে আসবি আবার। আমি বিট অফিসারকে বলে রাখবো, তখন পারমিট হলে কার্ডটা ফেরত পাওয়া যাবে।
অবশেষে ঢোকা গেলো ভেতরে। বেশ খানিকটা হাঁটার পর চোরো বললো এখানে হাতি আছে অনেক, আমাদের যেখানে গ্রাম সেই জায়গাটার চারদিক ঘিরে একটা খালের মতো খুঁড়ে দিয়েছে জঙ্গলের বাবুরা, হাতি যাতে না ঢুকতে পারে। সেটা পেরিয়ে আমাদের যেতে হবে। লম্বা দুটো শালের খুঁটির ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে গ্রামে পৌঁছোলো ওরা।
ঢুকে অবাক জয়ি। আধখানা নারকোলের মালা উপুড় করলে যেমন দেখায় প্রায় সে রকম দেখতে এক একটা বাড়ি। ঘেসাঘেসি নয়, একটার থেকে আর একটার দূরত্ব অনেকটা। আর সেই উপুড় করা মালাটার মাথায় শুকনো ঘাসজাতীয় কিছু জমাট করে ছাদ। জয়ির আসার কোন খবর ছিলো না চোরোর বাড়িতে, ওকে দেখে সবাই হতবাক। বিস্ময়, সঙ্কোচ, খানিকটা ভয়, এ সব কেটে যেতে অবিশ্যি সময় বেশি লাগলো না, যখন ওর ব্যাগ থেকে এক এক কোরে সবায়ের জন্যে বেরোলো উপহার। বাদালির জন্যে আনা সালোয়ার-কামিজটা তখনই জয়ির সাহায্যে পরে ফেললো ও। সকালবেলায় বেরিয়েছে ওরা, পৌঁছোতে পৌঁছোতে দুপুর হয়ে গেছে, তেষ্টাও পেয়েছে খুব। চোরোর মারফত জানতে পেরে পেতলের একটা বাটিতে একটা পানীয় এনে দিলো ওর মা। একটু ঘোলাটে চেহারার জল। প্রথমে একটু অস্বস্তি থাকলেও একটা চুমুক দিলো জয়ি। মিষ্টি নয়, একটু কষা স্বাদের, কিন্তু খেতে ভালোই! কী এটা? চোরো বললো এর নাম পালুয়া। বিশেষ একটা গাছের মূল বেটে, জলে সেটা মিশিয়ে, ছেঁকে নিয়ে, তারপর রোদ্দুরে শুকিয়ে রেখে দেওয়া হয় বাড়িতে। এটা ভেষজ ও-আর-এস, দাস্ত-বমির ওষুধ। রোদে এসেছে ওরা, জয়িকে খাতির করেই দেওয়া হয়েছে বোধ হয় !
দুপুরে খাওয়া হলো পান্তা ভাত আর পিঁপড়ের ডিমের চাটনি। কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ আর রসুন দিয়ে পিঁপড়ের ডিম বাটা হয়েছে। ভালোই খেতে, বেশ টক টক, খানিকটা লেবু লেবু স্বাদ। আগের দিন বোরিগাঁও গিয়েছিলো চোরোর বাবা, এই জঙ্গলেই এখান থেকে আর একটু দূরে বোরিগাঁও, এখানে বছরে দুয়েকদিন জঙ্গলের বাবুরা যেতে অনুমতি দেয় ওদের, সারা বছরের খাদ্যসংগ্রহের জন্যে। ওখান থেকে ওরা মধু সংগ্রহ করে, সংগ্রহ করে পালুয়া, পিঁপড়ের ডিম আর নানারকমের কন্দ, যা ওদের অনেকদিন চলবে খাদ্য হিসেবে।
জানা গেলো ভালো সময়েই এসেছে ওরা, দু দিন পরেই পূর্ণিমা, ফাগুর প্রথম উৎসব তখন ওদের, পার্ধি। পাহাড়ি খাড়িয়ারা জঙ্গলবাসী, জঙ্গলেরই প্রাণী ওরা, যা ওদের প্রয়োজন ওরা জঙ্গলের থেকেই নেয়, জঙ্গলের যা প্রয়োজন জঙ্গল নিয়ে নেয় ওদের কাছ থেকে। খাদ্যের প্রয়োজনে শিকার করতে হয়, শিকারে জঙ্গলদেবতার আশীর্বাদ চাই, তাই পার্ধি। শিকারের, অতএব মূলত পুরুষের উৎসব পার্ধি। জয়ি বুঝলো বাইরে বেরিয়ে উৎসবে যোগ দিতে পারবে না ও, না যাতে পারে তার ব্যবস্থাও আছে, সেটা বুঝলো পরে। ক্যামেরাটায় টেলিস্কোপিক লেন্স লাগিয়ে খানিকটা দূরে, একটু উঁচু জায়গায় বসে থাকলো সে চুপচাপ।
পুজো হবে। ঠিক বিগ্রহ বলতে যা বোঝায় তা নয়। একটা পাথরের বড়োসড়ো টুকরো। কিন্তু খাড়িয়াদের বিশ্বাস জঙ্গলের এ দেবতা নগ্ন। অতএব শিকারিদের প্রধান, যাকে বলা হয় লয়াশিকারি, সে-ও নগ্ন। তাকে নির্দেশ দেবে গ্রামের পুরোহিত বা প্রধান, দেহুরি বলে ওরা যাকে। সে উপবাসে আছে, তার উপবাস চলবে সারাদিন যতক্ষণ না গ্রামের সব পুরুষ শিকার শেষ করে ফেরে। ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে দেখে জয়ি। আজকের শিকারে যত অস্ত্র ব্যবহার করা হবে সব জমা করা হলো দেবতার সামনে, তার সামনের জমির খানিকটা গোবর লেপে পবিত্র করা হলো, সিঁদুর দিয়ে পাশাপাশি তিনটে সমান্তরাল দাগ দেওয়া হলো সেখানে, তারপর প্রদীপ গোছের একটা কিছু জ্বেলে দুটো সাদা মোরগ বলি দেওয়া হলো। তারপর গ্রামের সব সমর্থ পুরুষ নিজের নিজের অস্ত্র নিয়ে জঙ্গলের ভেতর ঢুকলো শিকারে।
চোরোও গেছে শিকারে, এ বার প্রথম। ওর বাবা তো গেছেই। দেহুরির মতো চোরোর মা-ও উপোস করবে সারাদিন। জয়ি বললো সবাই মিলে উপোস করলে কেমন হয়? বাদালিকে খাইয়ে দাও, তুমি-আমি একসাথে খাবো। বাদালিই বা কম কিসে? সে-ও খেতে রাজি নয়।
সন্ধ্যের মুখে ফিরবে শিকারির দল। প্রশ্ন কোরে কোরে জয়ি বুঝলো সোজাসুজি ফেরা নয়, ফেরার সময়েও নিয়ম-কানুন আছে। দেহুরির অনুমতি নিয়ে বাদালি আর জয়ি তারই সাথে গেলো গ্রামের শেষে। ঢোকবার সময় যে শালের খুঁটির ওপর দিয়ে হেঁটে এসেছিলো সেগুলোকেই পেরিয়ে জঙ্গলের মুখে দাঁড়ালো ওরা। জয়ি ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত হতে-না-হতে পুরুষদের গলা। ফিরছে ওরা, বীরের দল, প্রায় প্রত্যেকের কাঁধে বা হাতে মৃত শিকার। ছবি তুললো জয়ি। শিকারিরা এসে সবাই মিলে প্রায় পুলিশ-মিলিটারির কায়দায় একসাথে ডানদিকে ঘুরে গেলো – মিলিটারির ডাইনে মুড়্ বা রাইট টার্ণের মতো – আর সেই ভাবেই এক এক কোরে শালের খুঁটি পেরিয়ে ঢুকলো গ্রামে। ব্যাপারটা কী? দেহুরি বললো গ্রামে ঢুকতে হবে পশ্চিমে মুখ করে, জঙ্গল থেকে এসে ডান দিকে মুখ করলে পশ্চিম। এর পর দেহুরি সবায়ের মধ্যে সমান কোরে ভাগ করে দিলো শিকার। নিজের নিজের বাড়ির দিকে চললো সব একে একে।
বাড়ির বাইরে তৈরিই ছিলো চোরোর মা। সে একে একে ধুইয়ে দিলো ছেলে আর তার বাবার পা। তারপর সবাই মিলে ঢুকলো বাড়িতে। সে রাতে জোর ভোজ।
গ্রামের শিশু আর মেয়েদের সাথে খুব ভাব হয়ে গেছে জয়ির। তাদের সাথে নাচগান কোরে, ছবি এঁকে, ফটো তুলে দিব্যি হৈ হৈ কোরে কেটে গেলো কয়েকটা দিন। তারপর হঠাৎ একদিন সকাল থেকে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে খুব তোড়জোড়। হাঁড়িয়া তৈরি হচ্ছে, সাদা একটা ছাগল যোগাড় করে এনেছে কে, দেহুরি কীসব পুজো-টুজো করছে, তারপর ছাগলটাকে কেটে রান্নাও করা হলো। কী ব্যাপার? চোরোর মা বললো, কিছুদিন আগে এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে অসনকুড়া নামের একটা গ্রামে চোরোর বাবা, দেহুরি আর গ্রামের আরও কয়েকজন মাতব্বর গিয়ে চোরোর কনে দেখে এসেছে। ওদের গ্রামের থেকে খবর এসেছে ওরা আজ পাকা কথা বলতে আসবে। তাদের আপ্যায়ন করতে হবে, গ্রামের সবাই তাই ব্যস্ত।
মুশকিলটা হচ্ছে, এই অতি সাধারণ ব্যাপারটায় কারো যে কোন প্রশ্ন থাকতে পারে, তা-ই বোঝে না ওখানকার মানুষরা। জয়ি প্রশ্ন করলে অবাক হয়ে ভাবে, এ রকম একটা মেমসাহেব মেয়ে, এ টুকুও জানে না ! আর নিজেদের মধ্যে হাসাহাসির ধুম পড়ে যায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক প্রশ্ন কোরে জয়ি বুঝলো যদিও বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতেই ঘর করতে আসবে নতুন বৌ, বিয়ের জন্যে যোগাযোগ, মেয়ের বাপ-মা-আত্মীয়স্বজনকে ধরাধরি, খুশি করা, এ সব কিছুরই দায় ছেলের আত্মীয়দের। এমনকি ঠিক ঠিক মতো পণ না পেলে বেঁকেও বসতে পারে কনেপক্ষ। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে বরের বাড়ি এত ছোট গ্রামে, সেখানে বড়ো গ্রামের মেয়ে এসে মানিয়ে নিতে পারবে কিনা সেটাও তো দেখতে হবে ! সারা গ্রামের লোক তাই কোমর বেঁধে নেমেছে যাতে কনেপক্ষের লোকদের আপ্যায়নে কোন খুঁত না থাকে !
কনেপক্ষ এসে পৌঁছোলো যখন, দুপুর তখন গড়িয়ে গেছে। সাত-আট জন লোক। প্রথমে সীরিয়স মীটিং, তারপর খাওয়া-দাওয়া, হাঁড়িয়া পান আকণ্ঠ; অনেক রাত পর্যন্ত সেদিন তিরিশটা বাড়ির ছোট গ্রামটার আবালবৃদ্ধবনিতা জেগে রইলো। পরের দিন সকালে দুটো সাদা মোরগ সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার সময় কনেপক্ষ জানিয়ে গেলো বিয়ে পাকা, দিনও ঠিক হয়ে গেলো। মাস দুয়েক পরের এক শুভদিন !
তার পরের দিন জয়ির সাথে সাথে চোরোও ফিরে এলো স্টীল প্লান্টের শহরে, তার কাজের জায়গায়। জয়ি কথা দিয়ে এসেছে চোরোর বিয়েতে সে আর চোরো ফিরবে একই দিনে।
এই দু মাস জয়ি খুব ব্যস্ত। এখনও পর্যন্ত শাম্ব বেরিয়েছে নিয়মিত, কিন্তু এখন শাম্বর জন্যে সময় বের করাও মুশকিল। অজস্র ফটো তুলেছে সে চোরোদের গ্রামে গিয়ে, সেগুলো দেখে দেখে ছবি আঁকতে হবে এখন। দু মাস পর চোরোর বিয়েতে যাবে যখন, তখন তো আরও বেশি ফটো তোলার সুযোগ হবে তার, কাজেই তার আগেই এ-দফার ছবিগুলো শেষ করতেই হবে। তুলি এখানে থাকলে তার ওপর শাম্বর দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যেত, কিন্তু সেই যে জে জে স্কুল অব আর্টে পড়তে চলে গেলো তুলি বোম্বেতে, আর ফিরবে না কে ভেবেছিলো ! যতদিন কলেজে পড়েছে, তবুও ছুটি-ছাটায় আসতো, এখন পাশ-টাশ করে শুধু যে বোম্বেতেই চাকরিতে ঢুকে গেলো তা-ই তো নয়, বিয়েও করে বসলো ওখানেই। পনেরো-কুড়িটা শাম্ব এখন তুলিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নিয়মিত, শাম্বর পাঠক-পাঠিকাও ও জুটিয়েছে বোম্বেতে; লেখা পাঠায়, ছবি পাঠায়, কিন্তু আসা আর হয়ে ওঠে না। শাম্বর কী হবে ! যাদের নিয়ে শুরু হয়েছিলো শাম্ব, তারা সবাই আজও আছে, ওদের চেয়ে বয়েসে ছোট কিছু কিছু ছেলেমেয়েও এখন শাম্বর ব্যাপারে উৎসাহী, কিন্তু পত্রিকাটা নিয়মিত বের করার দায়িত্বটা এখনো সেই জয়িরই ঘাড়ে। পুরোনোদের মধ্যে জুঁইদি এখানকার প্লান্টেই চাকরি করে, শাম্বতেও তার উৎসাহ কমেনি, যদিও তার বর সুকান্ত, যে প্লান্টের হাসপাতালের হার্ট-সার্জেন, শিল্প-সাহিত্যের এই সব ছেলেমানুষি দেখে হাসাহাসিই করে। জুঁইদির কাছেই একদিন গেলো জয়ি। আগামী ছ মাস শাম্বর দায়িত্ব নিতে হবে তাকে। জঙ্গলের ছবি আঁকবে জয়ি, কলকাতায় একটা সোলো করার বাসনা তার। জুঁইদির একটিই ছেলে, সে দার্জিলিঙের সেন্ট পল্স্ স্কুলে পড়ে, হোস্টেলে থাকে, কাজেই কোনই অসুবিধে নেই তার। সে দায়িত্ব নিলো খুশি মনেই।
অনেকদিন আগে একটা লিট্ল্ ম্যাগাজিনে পরপর তিন সংখ্যার প্রচ্ছদ এঁকেছিলো জয়ি, তিরিশ টাকার বিনিময়ে। সেই ম্যাগাজিন এখন মোটামুটি পরিচিত একটা প্রকাশনা সংস্থা। একটা ছড়ার সংকলন বের করছে তারা, ছড়ার সঙ্গে ছবি। জয়িকে খবর পাঠিয়েছে তারা, সে ছবি কী আঁকতে রাজি আছে ও? অনেকদিন যাওয়াও হয়নি কলকাতায়, যেতেও ইচ্ছে করছিলো তার। অফিস থেকে একটা কাজ জুটিয়ে কলকাতায় পৌঁছোলো জয়ি।
নামমাত্র কাজটা অফিসে হয়ে গেলো আধ ঘন্টার মধ্যেই, এখন অখণ্ড অবসর। কলেজ স্ট্রীট, কফি হাউজ, যে প্রকাশনা সংস্থায় কাজ ছিলো, সেটাও সাড়া। সুদেশকে ফোন করলো জয়ি, আসছি তোমার অফিসে, ভূদেবদা আছেন?
আমার কাছে আসছো, না ভূদেবদার?
রাগ করলে? তুমিও? রাগ কোরো না প্লীজ, আসছি তোমারই কাছে, লিণ্ডসে স্ট্রীটে গিয়ে দুধ খাবো, সকাল থেকে এক কাপ কফি ছাড়া কিছুই খাইনি আর, তারপর তুমি-আমি একসাথে ভূদেবদার সাথে কথা বলবো, ভূদেবদার সাহায্য চাই।
ক্রীম চীজ দিয়ে পাঁউরুটি আর ঠাণ্ডা দুধ খেতে খেতে জয়ি বললো, একটা সোলো করবো ভাবছি।
সোলো মানে? – জিজ্ঞেস করে সুদেশ।
সোলো এগজিবিশিন, আমার একার।
তোমার একার এগজিবিশন করবে? কবে করবে? কোথায়?
সেটাই তো তোমার সাথে পরামর্শ করতে চাই।
চোরোর সাথে ওদের গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা বললো জয়ি সুদেশকে, বিশদ ভাবে। কতো ফটো তুলেছে, তার থেকে কীভাবে ছবি আঁকছে, সব। দু মাস পর আবার যাওয়ার কথা আছে চোরোর বিয়েতে, তখন আরও বেশি দিন থাকবে, আরও বেশি দেখবে পাহাড়ি খাড়িয়াদের জীবন, উৎসব, সম্পর্ক। আর, তার ফলে আঁকা হবে আরও ছবি। এই সব ছবির প্রদর্শনী করবে ও কলকাতায়।
ছবির প্রদর্শনীর ব্যাপারে ধারণা নেই সুদেশের। কত খরচ হয়, কীভাবে ব্যবস্থা করতে হয়, কিছুই সে জানে না। তবে হ্যাঁ, ভূদেবদা তো নিশ্চয়ই জানেন।
ভূদেবদা বললেন, সোলো করবে, সে তো অনেক খরচ ! স্পন্সর যোগাড় করতে পারবে?
আমাকে আর স্পন্সর করবে কে ভূদেবদা, যা করার নিজে নিজেই করতে হবে, একা।
খুব যে ভালো ডিসিশন নিচ্ছো, তা বলতে পারি না। শুধু খরচটাই নয়, ফুট ফল ! তোমার একার কতটুকু পরিচিতি, কত জন চেনে তোমাকে? কয়েকজন বন্ধু-টন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে নাও, অনেক সাকসেসফুল হবে, আর খরচটাও শেয়ার হয়ে যাবে নিজেদের মধ্যে।
না ভূদেবদা, অন্য কোন এগজিবিশনে ছবি চাইলে সব সময়ই দিতে রাজি আছি, কিন্তু এই এগজিবিশনটা আমি একা করবো, একা !
তাহলে অ্যাকডেমিতে খবর নাও, অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস। ওখানে পেলে খরচ একটু কম হবে, আর তাছাড়া একটা রেগুলার ফুট ফল আছে। নাটক দেখতে যায় যারা তারা মাঝে মাঝে ঢুঁ মারে এগজিবিশনে, আনসলিসিটেড।আর তা ছাড়া রবীন্দ্রসদনের পাবলিকও আছে। তবে অ্যাকাডেমিতে পাওয়া শক্ত। করবে কতদিন?
তিন দিন তো নিশ্চয়ই, তার কম করার তো কোন মানে হয় না।
হ্যাঁ, সেটা ঠিকই, তবে তিনদিন একটানা জায়গা পাওয়া সহজ নয়। দেখো, চেষ্টা কোরে দেখো।
একটু ইতস্তত করে জয়ি বলে, ধরুন জায়গা যদি না-ই পাই অ্যাকাডেমিতে, অল্টার্নেটিভ কী আছে?
অল্টার্নেটিভ অনেক আছে, কিন্তু তোমাকে কোন্টা স্যুট করবে সেটাই প্রশ্ন। যাই হোক, তুমি বিড়লা অ্যাকাডেমিতেও চেষ্টা করতে পারো, সাদার্ণ অ্যাভেন্যু। তবে মনে হয় ওদের চার্জ একটু বেশি। আমি বলি কী, ও সব চিন্তা পরে করা যাবে, তুমি আগে অ্যাকাডেমিটাই চেষ্টা করো।
ভূদেবদা একজনের নাম দিয়ে দিয়েছিলেন, সঙ্গে একটা চিঠি। ভদ্রলোক চিঠিটা পড়লেন, তারপর একটা মোটা রেজিস্ট্রী খাতা গোছের খাতা দেখে বললেন আঠেরোই নভেম্বরের আগে দিন নেই, চলবে আপনার?
আঠেরোই নভেম্বর মানে ছ-সাত মাস। জয়ির এখনো কিছুই আঁকা হয়নি প্রায়। এখনো ছবি আঁকা, বাঁধানো, নানা ধরণের প্রস্তুতি। এ টুকু সময় তো লাগবেই।
ভদ্রলোক বললেন, চলে যদি যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি অ্যাডভান্স করে দিন। তা ছাড়া আরও ফর্মালিটিজ আছে, কাল আসুন, বেলা বারোটা নাগাদ, সব বলে দেবো।
দুর্দান্ত : ক্লাসিক উপন্যাস