পরের দিন জলধর এলে ওকে এই সিনেমার লোকদের কথা বললো জয়ি, আরও বললো পঁচিশ হাজার টাকা পাওয়ার কথা। জলধর শুনে বলে, এটা তো খারাপ নয় জয়িদি, খবরের কাগজের লেখা দুটোয় কাজ হয়েছে। মনে হচ্ছে এখন থেকে গেস্ট হাউজের ডিমাণ্ড হবে, আমরা এখানে যে ধরণের কাজ করতে চাই তা উদ্বুদ্ধ করবে অনেককে, অনেকেই নিজের চোখে দেখতে চাইবে, আমাদের কাজেও সাহায্য করতে চাইবে হয়তো। বোনাস হিসেবে গেস্ট হাউজ থেকে যদি মোটামুটি একটা আয়ের ব্যবস্থা হয় তাহলে তো আমাদের নিয়মিত আয়ের সমস্যাটার একটা সহজ সমাধান হয়েই গেলো।
সেটা ঠিকই, বলে জয়ি, কিন্তু একটা গেস্ট হাউজ চালানো তো সহজ নয়, তার জন্যে অনেক ব্যবস্থা লাগে। এবার তো ঐ ছেলেগুলোও রঘুনাথদার সাথে হাত লাগালো তাই হয়ে গেলো, কিন্তু সবায়ের সাথে তো এরকম চলবে না। তা ছাড়া রেট কী হবে, ঘরদোর পরিষ্কার রাখা হবে কীভাবে, এ সবও তো ভাবতে হবে। এগজিবিশনের সময় বাবা কীভাবে সব ম্যানেজ করলো কে জানে ! তখন তো জানতেও চাইনি একবারও, ম্যাজিকেই যেন হয়ে যাচ্ছিলো সব ! আমার মনে হয় সামনের রোববারেই একটা মীটিং ডাকা যাক। চলো, তোমার সাথে বান্দোয়ানে যাই। টেলিফোনে জানাই সবাইকে।
যে মীটিং হলো এবার তাতে সুকান্তদা আর জুঁইদি আসেনি, ওদের আশাও করেনি জয়ি। শ্যামলিমাও আসতে পারেনি, ওর শ্বশুরবাড়িতে কিছু একটা উৎসব আছে, ওরা সপরিবার গেছে সেখানে। তুলিও যথারীতি অনুপস্থিত। গেস্ট হাউজটা নিয়মিত চালাতে হবে, মীটিঙে যারা ছিলো সবাই একমত। সিনেমার লোকরা যদি শেষ পর্যন্ত পছন্দ করে খুশিঝোরাকে, সেটাও খুশিঝোরার পক্ষে, অন্তত আর্থিক ব্যাপারটা মাথায় রাখলে, ভালোই হবে, বললো প্রায় সবাই; বিশেষ করে মাত্র এক রাত্তির গেস্ট হাউজে থেকে যে টাকাটা ওরা দিয়েছে, সেটা তো অভাবনীয়, বললো কোষাধ্যক্ষ অনলাভ। সবাই সিনেমার ব্যাপারে উৎসাহী, শুধু নীরব জলধর। ও ঠিক জানে না, কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিলো ওর সিনেমার ব্যাপারটায়, কী অস্বস্তি স্পষ্ট করে বোঝাতে পারবে না, কাজেই চুপ করে থাকাই ওর মনে হলো ভালো।
জয়িই থাকে এখানে, কাজেই এই আলোচনা শেষ হবার পর কয়েকটা খুঁটিনাটির কথা তুললো জয়ি। প্রথম কথা, গেস্ট হাউজ চালাতে গেলে একা রঘুনাথের পক্ষে রান্নার ব্যাপারটা সামলানো কী সম্ভব? রঘুনাথকে বলেছে জয়ি ওর কোন সহকারি যোগাড় করার জন্যে, কিন্তু সেরকম লোক এখানে পাওয়া মুশকিল। এ ছাড়া গেস্ট হাউজ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। কে করবে এই কাজ ! গোরু আছে চারটে, অষ্টমী তাদের দেখাশোনা করছে ঠিকই, কিন্তু জয়ি তো এসব কিছুই বোঝে না। কে দায়িত্ব নেবে এতো কিছুর?
কথা বললো নিলীন। ওর এক পিসতুতো ভাই আছে, গ্রামের ছেলে, মোটামুটি এই অঞ্চলেরই, ঝাড়গ্রামের কাছে বিনপুরে ওদের বাড়ি। লেখাপড়ায় খুব একটা মন ছিলো না ছোটবেলায়, ভালো ফুটবল খেলতো, ক্লাশ টেন-এ যখন পড়ে, সুব্রত কাপে ওর খেলা দেখে উয়ারি ক্লাবের কোচ ওকে ডেকে নিয়ে যান কলকাতায়। পরের বছরেই ফার্স্ট ডিভিশনে খেলার সুযোগ পায়, কিন্তু ওর কেরিয়ারের দ্বিতীয় খেলাতেই হাঁটু ভেঙে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। তারপর ও মাসাজ করার কাজ শিখে ফুটবল প্লেয়ারদের মাসাজের কাজ পায় ওর কোচেরই সাহায্যে। কিন্তু ইদানিং শিক্ষিত ফিজিওদেরই ডিমাণ্ড, ওদের মতো ছেলেরা আর এসব কাজ পাচ্ছে না। গ্রামের ছেলে, নিজেদেরও ক্ষেত-খামার, গোরু-টোরু, এসব আছে। সবাই যদি রাজি হয়, ওকে নিলীন এখানে নিয়ে আসতে পারে হোলটাইমার হিসেবে। অনেক কাজে সাহায্য করতে পারবে, আর এখানকার ছেলেদের খেলাধুলোও শেখাতে পারবে।
সবাই হৈ হৈ কোরে রাজি হয়ে যায় নিলীনের প্রস্তাবে, জয়ির মনে হয় একেবারে আদর্শ ছেলেটাকে পাওয়া গেলো।
জলধর বলে বান্দোয়ান থেকে ও কাউকে জোগাড় করে আনবে রঘুনাথের অ্যাসিস্টান্ট হিসেবে। এ ছাড়াও আরও দুয়েকজনকে জয়ি নিজেই যোগাড় কোরে নিতে পারবে ঘর-দোর পরিষ্কার করার জন্যে, পারবে না?
আসল অসুবিধেটা অন্য, জয়ি বলে এবার। এগজিবিশনের সময় বাবা কীভাবে ম্যানেজ করেছিলো আমি জানিনা, কিন্তু গেস্ট হাউজ যদি নিয়মিত ভাড়া দেওয়া হয়, সেটা পরিষ্কার রাখা সহজ নয়। বাথরূম সাফ করবে কে?
অরুণিমা বলে, কেন, যারা ঘরদোর পরিষ্কার রাখবে তারা করবে না?
করবে মনে করছিস তুই? – সুজয় বলে ওঠে, টয়লেট পরিষ্কার করতে রাজি হবে না কেউ।
জলধর একমত, এ ধরণের টয়লেট ব্যাপারটাই তো নতুন এখানে, বান্দোয়ানে তবু দুয়েকজনকে পাওয়া যেতো হয়তো, এখানে কেউ রাজি হবে না।
রাজি হবে না, আর আমিও কাউকে জোর করতে পারবো না এই কাজের জন্যে।
তাহলে? – ওদের সমবেত দুশ্চিন্তা।
একটাই সমাধান, জয়ি বলে ওঠে। এখন কী হয়? এখন কী করি আমরা? এই যে আমরা এখানে থাকি, আমাদের টয়লেট পরিষ্কার করে কে? আমরা নিজেরাই করি তো। ঘরদোর পরিষ্কার রাখবে যারা, বাথরূমের মেঝে পরিষ্কার করতে তারা আপত্তি করবে না। আমরা ফিনাইল-টিনাইল, ব্রাশ-ট্রাশ, রেখে দেব, যাঁরা গেস্ট হাউজে থাকতে আসবেন তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হবে টয়লেট পরিষ্কার করার লোক আমাদের নেই। ঘর ছাড়ার আগে প্রতিটি ঘরের অতিথি তাঁদের নিজের নিজের টয়লেট আর বেসিন পরিষ্কার করে, তার পর যাবেন। যাঁরা রাজি হবেন তাঁদেরই শুধু আমরা গেস্ট হাউজের ঘর ভাড়া দেবো। এই শর্তেই।
ঠিক আছে, দেখা যাক এই শর্তে চলে কিনা আমাদের হোটেলের ব্যবসাটা, বলে অনলাভ, শ পাঁচেক টাকা নিস ঘর পিছু, চালিয়েই দেখ্ না কয়েকদিন।
সবাই একমত। ওরা ঠিক করেছে থেকে যাবে আজ, কাজেই মীটিং শেষ করার তাড়া নেই, মীটিঙের ফাঁকে ফাঁকে গুলতানিও চলতে থাকে। হঠাৎ নিলীন বলে, যদি ইম্পর্ট্যান্ট ইশ্যু আর না থাকে কিছু, আমি চলে যেতে চাই, বিকেলের ইস্পাতটা ধরে ঝাড়গ্রামে যাবো। পারলে উৎপলকে কালই ধরে আনবো।
উৎপল নাম বুঝি ছেলেটার? – প্রশ্ন করে জয়ি।
হ্যাঁ, উৎপল সিংহ। এখানে ভালো মানাবে ওকে। কালোকোলো, গাঁট্টাগোট্টা। আমি তো মজা করে মাঝে মাঝে বলি ওকে, তোরা আসলে সিং, ভূমিজ ছিলি আগে। আমার পিসিকে বিয়ে করার লোভে তোর বাবা একটা হ জুড়ে নিজেকে বাঘসিঙ্গি বানিয়ে নিয়েছে।
রসিকতাটায় সবাই হেসে ওঠে জোর। জলধর বোধ হয় বলতে যাচ্ছিলো একটা কিছু, ওর গলাটা চাপা পড়ে যায় সমবেত হাস্যরোলে।
সুন্দর এগোচ্ছে